বিয়ের মাত্র এক মাস হয়েছে। শ্বশুড় সাহেব অসুস্থ শুনে বৌকে নিয়ে দেখতে গিয়েই বিপদ হল। নতুন জামাইকে আলুর বস্তা ধরিয়ে দিয়ে কেউ কোল্ড স্টোরেজে পাঠাবে এটা আশা করিনি। তারওপর কলেজ পাস জামাই আমি। এলাকায় একটা সুনাম আছে আমার- সেই আমাকেই কিনা আমার নতুন শ্বশুড় আব্বা তার এই বছরের আলু গুলো বস্তায় বেধে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “বাজান, শরীলটা ভাল ঠেকতেছে না। আলুর বস্তা গুলা একটু ঠাকুরগাঁও গিয়া কোল্ড স্টোরেজে রাইখা আসো। ঘরে তো ছেলে পেলে নাই। তুমিই যখন আসছো – একটু কষ্ট কইরা আলু গুলা দিয়াসো। আমার নাম বললেই হবে। রিসিটে নাম্বার দিয়া দিবে।
রিসিট নিয়া আসবা সাবধানে। বস্তা প্রতি দুইশো পনেরো টাকা লাগবে। টেরাক দিয়া দিছি। নিয়া পৌছায়া দিবে।” বোগল ঘ্যাস ঘ্যাস করে চুলকাতে চুলকাতে বললেন কথাগুলো। হাত পাখার ডাট দিয়ে পিঠে চুলকালেন, ঘামাচি হয়েছে তার। আমি কোনো মতে মুখে হাসি টেনে বললাম, “অবশ্যই আব্বা। কোনো চিন্তা করবেন না। যাবো আর আসবো।” “রাস্তা খারাপ। যাবো আর আইবো বললে হবে না। যাইতে যাইতে সন্ধ্যা হইয়া যায়। স্টোরের মালিক আমার বদনু মানুষ। সাত্তার আলী। সে তোমার আর ড্রাইভারের থাকার ব্যবস্থা কইরা দিবে সেখানে। পরের দিন টেরাক নিয়া চলে আসবা।” “জী আচ্ছা আব্বা।” ঘাড় কাত করে বললাম। আমার স্ত্রী পারুল পাংশু মুখে খাটের স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বাকে বাধা দেয়ার সাহস নেই তার। তবে আমার শ্বাশুড়ি আম্মা একটু চেষ্টা করলেন কথা বলার, “ ইয়ে, নতুন জামাই মানুষ। শিক্ষিত পোলা। তারে দিয়া এইসব কাজে না পাঠাইলে হয় না?” ধমকে উঠলেন আব্বা, “তুমি চুপ করো। মহিলা মানুষ- বুদ্ধি শুদ্ধি তোমার হাটুর নিচে। শিক্ষিত পোলা দেখেই তো হিসাব পাতির কাজ দিয়া পাঠাইতেছি। অন্য কাউরে দিলে তো সব উল্টায় পাল্টায় দিবো!”
আমি জোর করে হাসি আনলাম মুখে, “জী আব্বা ঠিক বলেছেন। হিসাব কিতাবের ব্যপার। যে কেউ কি আর বুঝবে? আমার যাওয়াটাই ভাল হবে।” “উত্তম বলছো জামাই। এই জন্যই তোমারে আমার এত পছন্দ। ভাল কথা, আমার বন্ধু সাত্তার আলীরে আমি মোবাইল ফোনে সব বইলা রাখছি। তুমি খালি নিয়া যাবা বস্তাগুলা। বাকি কাজ তার। সে কিন্তু আমার মত গেরস্থ না। খুব শিক্ষিত মানুষ। আমাদের আমলের বি.এ. পাস। বিরাট বড়লোক। আদব লেহাজের সাথে চলবা। সে যেন মন্দ কথা না বলে তোমারে নিয়া।” আব্বা বোগল যে হারে চুলকাচ্ছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে পাঞ্জাবীর বোগল আজকে ছিঁড়েই উঠবেন। নতুন খদ্দরের পাঞ্জাবী কিনে এনেছিলাম তার জন্য। কিন্তু ওনার হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছে পাঞ্জাবীটা কাপড়ের না, বিচ্ছুটি পাতার পাঞ্জাবী। “জী আব্বা।” আমি মাথা কাত করে উঠে পরছিলাম। উনি বললেন, “জামাই, তোমার পছন্দ বড় ভাল।” “জী আব্বা?” বুঝতে না পেরে ফিরে তাকালাম।
“এই যে পাঞ্জাবীটা আনছো- খুব ভাল পাঞ্জাবী। কিন্তু মাড়ের গন্ধটা একদম সহ্য করবার পারিনা। তাই আতর মাখছি। আতর মাখলেই ঈদ ঈদ লাগে।” দেখলাম একটা শিশি থেকে আতর নিয়ে পাঞ্জাবীতে লাগাচ্ছেন। এই নিয়ে তেরো চৌদ্দবার আতর মাখলেন, “মাখবা নাকি একটু?” একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “ না আব্বা। আপনি মাখেন।” আমার শ্বশুড় বাড়ি হল ময়দানদীঘি নামের একটা জায়গায়, পঞ্চগড় জেলার পূর্ব দিকে। এখানে প্রায় সব পরিবারই কৃষি নির্ভর পরিবার। তার মধ্যে আমার শ্বশুড় শমসের মিয়া হলেন বিশাল ধনী কৃষক। মাইলের পর মেইল জমি তার। তার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করেছি এক মাস হল। শ্বশুড় বাড়ি আসতে না আসতেই আলুর বস্তা নিয়ে ঠাকুরগাঁও যেতে হবে- ভাবিনি।
এখান থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের দূরত্ব দুই ঘন্টার রাস্তা। তবে গ্রামের ভেতরের রাস্তা খারাপ বলে সময়টা আরো বেশি নেয়। আলুর বস্তা ট্রাকে নিয়ে আরো আগে বের হওয়া যেত। কিন্তু বের হতে হতে বিকেল তিনটা বেজে গেল আমার। বেশ অসন্তুষ্ট মনে ঠাকুরগাঁও যাচ্ছি। ড্রাইভার মতিন পাশে। গান ধরেছে হেড়ে গলায়-
“আমার লাইন হইয়া যায় আঁকা বাঁকা ভাল না হাতের লেখা” লাইন আঁকা বাঁকার সঙ্গে রাস্তার সম্পর্ক কোথায় বুঝলাম না। সে একবার ডানে যায়, একবার বামে। ট্রাক জমির মধ্যে নামিয়ে দেবে যেন! আমি প্রমাদ গুণছি মনে মনে। ঠাকুরগাঁও আদৌ পৌছাবো তো? নাকি ট্রাক উল্টে জমির মধ্যে পরবো? “দুলাবাই? মুখের কন্ডিশন এরুম ক্যা?” মতিন দাঁত বের করে হাসল। “তুমি ভাল করে ট্রাক চালাও। সন্ধ্যার আগে আগে ঠাকুরগাঁও যেতে হবে।” থম থমে গলায় বললাম। “রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ দুলাবাই। যাতি যাতি রাত্তির নামিবি।” গ্রামের কাঁচা রাস্তা দেখিয়ে বলল ও। “এটা তো আরো ভালো কথা!” বিড়বিড় করলাম। হাতে একটা চিরকুটে কোল্ড স্টোরেজের ঠিকানা দেয়া- “হিমাদ্র কোল্ড স্টোরেজ, বাঘাই পট্টি, ঠাকুরগাঁও।” কতক্ষণে যে পৌছাবো হাত ঘড়িতে সাড়ে নটা বাজে।
হিমাদ্র কোল্ড স্টোরেজে এসে আলুর বস্তাগুলো নামিয়ে তাতে নাম্বার দিয়ে স্টোরে জমা দিতে দিতে দেরি হয়ে গেল। কোল্ড স্টোরেজের মালিক সাত্তার আলী অনেক সাহায্য করলেন এ সময়। নিজের লোক দিয়ে বস্তা গুলো আনলোডিং এর কাজ করে দিলেন। ভদ্রলোকের বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। মাথা ভর্তি পাঁকা চুল। মুখে পাতলা গোঁফ। চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা পরে থাকেন সারাক্ষান। হঠাৎ করে দেখলে ভার্সিটির প্রোফেসর বলে মনে হয়। খুব ফর্সা আর শক্ত সামর্থ একটা চেহারা। দেখেই বোঝা যৌবন কালে অসম্ভব সুদর্শন ছিলেন। নতুন জামাই বলে খুব খাতির যত্ন করলেন। মতিনকে আবার ট্রাক নিয়ে উত্তরে যেতে হবে এখান থেকে। আব্বা কোনো কাজ দিয়ে দিয়েছেন ওকে। কোল্ড স্টোরেজের লোকদের সাথে আগেই খেয়ে নিল। সাত্তার সাহেব চাচ্ছিলেন মতিন ওনার বাসায় খেয়ে যাক এক বেলা, কিন্তু ওর নাকি তাড়া আছে। জরুরী কাজ দিয়েছেন শ্বশুড় আব্বা। মালপত্র নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
সাত্তার আলী আমাকে নিয়ে কোল্ড স্টোরেজের পেছনের দিকে ওনার বিশাল টিনের বাড়িতে এলেন। হিমাদ্র কোল্ড স্টোরেজ আর টিনের বাড়িটা একেবারে সামনা সামনি। কোল্ড স্টোরেজের বিল্ডিংটা পাঁচ তলা বিল্ডিং এর সমান উঁচু, অনেক বড়। পেছনে জেনারেটর হাউস আর কুলার মেশিনের ঘর। রাতের ঝিঁ ঝিঁ পোঁকার শব্দ ছাপিয়ে মেশিনের শব্দ রাতের বাতাস ভারী করে রেখেছে। আমি টিনের বাড়িটার একটা ঘরে বসে আছি। বাংলা ঘরের মত অনেকটা। বাড়িটা দেখলেই বোঝা যায় খুব শখ করে বানিয়েছেন সাত্তার আলী। নাস্তা দিয়েছে। একটু পর রাতের খাবার দেবে। আমি বসে বসে গল্প করছি সাত্তার আলীর সাথে।
“চাচা, এত টাকার কারবার, কিন্তু বাড়িটা পাঁকা না করে টিন শেডের করলেন কেন?” “তোমার চাচী আম্মার ইচ্ছা। উনার ভয় একদিন ভূমিকম্প হবে আর ছাদ ভেঙ্গে পরবে মাথার উপর, টিন শেডের হলে তো আর তেমন কিছু হবে না যদি ভেঙ্গে পরে- তাই।” হাসতে লাগলেন। চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিলাম। ওপরে গাঢ় স্বর ভাসছে। গরুর দুধ দিয়ে বানানো। চুমুক দিতেই শরীরটা ঝরঝরে লাগা শুরু করল।
“চাচী আম্মা কি ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষ? নাকি বাড়ি দূরে?” “সোঁনাগাজী। দূর আছে। বছরে একবার যায় ঘুরে আসতে। নয়তো সারা বছরে বাড়ির কাজ নিয়ে পরে থাকে।” দরজা দিয়ে বাহিরে রান্না ঘরের দিকে তাকালেন, চাচী সেখানে বসে রান্না করছেন লাকড়ির চুলায়। গলা উঁচিয়ে বললেন, “কই? তাড়াতাড়ি করো। জামাই মানুষ- কতক্ষণ না খাওয়ায় রাখবা?” শুনতে পেলাম চাচী বলছেন, “এই তো হয়ে গেছে।
তোমরা গল্প করো। আমি ঠিক ঠাক করে নেই।” কড়াইয়ের তেলে মাছ ভাজার শব্দ হচ্ছে, বাতাস মোঁ মোঁ করছে সেই ঘ্রাণে। আমার পেটের ক্ষিদেটা আরো চাগিয়ে উঠল। সেটাকে ঢাকতে সাত্তার সাহেবের সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম। ভদ্রলোক বেশ বাঁচাল স্বভাবের মানুষ, প্রচুর কথা বলেন। সারাক্ষণ চেষ্টা করেন বইয়ের মত শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে, তবে মাঝে মাঝে আঞ্চলিকতা এসে পরে। কথা বলে জানা গেল ভদ্রলোকের তিন মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। তিন মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। দুই জন থাকে দুবাই স্বামী বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে, আরেক জন থাকে পঞ্চগড় শহরে। এই বিশাল বাড়িতে মানুষ বলতে এখন সাত্তার সাহেব, তার স্ত্রী জয়গুণ নাহার আর কামলা মোতালেব থাকে। মোতালেব রাত কানা মানুষ। তাই সন্ধ্যা হতে না হতেই খেয়ে ঘুমিয়ে পরে। সাত্তার সাহেবের ধারণা মোতালেব আসলে রাত কানা না, কাজ যাতে কম করতে হয় তাই রাত কানার ভান করে থাকে। কারণ এই রাত কানা মোতালেবই গত বছর রাতের বেলা একটা সিঁদেল চোরকে ধরে গামছা দিয়ে বেধে রেখেছিল!
সেই থেকেই গ্রামের লোকজন মোতালেবকে খুব তেয়াজ করে চলে। তাদের ধারণা মোতালেবের গায়েবি শক্তি আছে। রাতে না দেখতে পেলেও দৈব শক্তি বলে সব দেখতে পায়। তবে তার নাকি একটা বদ অভ্যাস আছে, ছোট থেকেই লুকিয়ে কেরোসিন তেল চুরি করে খায়। এ বাড়ির কোনো হারিকেনে তাই তেল থাকে না। মোতালেবকে দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সে এখন ঘুমাচ্ছে। সন্ধ্যার সময় তাই কোল্ড স্টোরেজের এক লোক দিয়ে বাজার করিয়ে এনেছেন সাত্তার সাহেব। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমে ঘামছি দর দর করে। মাথার ওপর হলুদ একটা বাতি জ্বলছে আর একটা ফ্যান ঘটর ঘটর করে ঘুরছে। বেশ জোরেই ঘুরছে- কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার গায়ে বাতাস লাগছে না! আমি হাত পাখা দিয়ে নিজেকে বাতাস করছি। সামনে সাত্তার সাহেব না থাকলে শার্টের দু একটা বোতাম খুলে বুকে পেটে বাতাস দেয়া যেত। কিন্তু ওনার সামনে তো আর তা করা সম্ভব না। নতুন জামাই বলে কথা।
সাত্তার সাহেবের বোধ হয় এত গরম লাগছে না। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন, “তা জামাই, শুনলাম তুমি নাকি লেখা লেখি করো? টুকটাক বই পত্রও বের হয়েছে। সত্য নাকি?” নড়ে চড়ে বসলাম। এই তথ্যটা পুরোপুরি ঠিক না। লেখা লেখি করার অভ্যাস আছে আমার ঠিকই। তবে হাজার চেষ্টা করেও বই বের করতে পারিনি। প্রকাশকদের কাছে পান্ডুলিপি নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে জুতার শুঁকতলা ক্ষয়ে গেছে- কিন্তু লেখা প্রেসের মুখ আর দেখেনি। লেখার হাত নাকি আমার যাচ্ছে তাই। ভাষা জ্ঞান ভাল না। তবে এক প্রকাশক গোপনে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, “লেখা ছাপাইতে পারি- তয় একতা কথা, আমার কোম্পানির রাতের কাজের জন্য কিছু চটি বই লেখে দিতে হইবো। চটি বই কি জিনিস জানো তো?” হলুদ দাঁত বের করে হেহ হেহ করে হেসেছিল। ঢোক গিলে শুকনো মুখে চলে এসেছিলাম সেদিন। তখনই লেখা ছাপানোর চেষ্টার ইস্তিফা দিয়ে দিয়েছি। আমাকে দিয়ে লেখা লেখি সম্ভব না। কিন্তু সাত্তার সাহেবকে তো আর এত কিছু বলা সম্ভব না। নিশ্চই আমার শ্বশুড় আব্বা বড় মুখ করে কথা গুলো বলেছেন। এখন যদি অন্য কিছু বলি তাতে শ্বশুর আব্বা কষ্ট পাবেন শুনলে। তাই ইতস্তত গলায় বললাম, “এই টুকি টাকি আর কি। তেমন বেশি কিছু না।”
“খুব ভালো অভ্যাস। ছাড়বা না, সবাই পারে না এইসব জিনিস।” বেশ ভরাট গলায় বললেন, “এক কালে আমিও চেষ্টা করেছিলাম লেখার, পারিনি।” আমি মাথা ঝাঁকালাম কেবল, জোর করে হাসলাম। বাড়িটার মেঝেটাই পাঁকা। দেয়াল, ছাদ- সব টিনের। খোলা জানালা দিয়ে হঠাৎ করে বেশ জোরে সোরে বাতাস আসা শুরু করেছে। উল্টো পাল্টা বাতাসে জানালার পর্দা উড়ছে। বাহিরে তাকালেন গা ছম ছম করে ওঠে। কোল্ড স্টোরেজ আর এই বাড়িটা ছাড়া এই এলাকায় দেড় দুই কিলোমিটারেও কোনো বাড়ি ঘর নেই। চারপাশে ভূট্টা আর পাটের বিছানো ক্ষেত। এগুলোর মালিক নাকি সাত্তার সাহেব। অন্ধকারে বাড়ির সীমানার বাহিরের ক্ষেত গুলোর দিকে তাকালে কেমন অদ্ভূত লাগে, জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম দমকা ঝড়ো বাতাসে ভূট্টা আর পাট ক্ষেতের লম্বা গাছ গুলো ধীরে ধীরে দুলছে, ঢেউ বয়ে যাচ্ছে যেন। বাহিরে চাঁদ নেই, কৃষ্ণপক্ষের রাত চলছে। সাত্তার সাহেব খোলা দরজা দিয়ে বাহিরের আকাশটা দেখলেন এক নজর, “জামাই, বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। তোমার চাচী একা একা পাক ঘরে ভয় পাবে- আসো, বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসি।” উনি একটা চেয়ার নিয়ে বাহিরে বারান্দায় এলেন। আমিও একটা চেয়ার উঠিয়ে তাঁর পিছু পিছু এলাম।
এখানে বাতাস অনেক। ঘরের ভেতরের মত গুমোট ভাবটা নেই। গরম লাগছে না। ভালই লাগছে। বাতাসের ছোটা ছুটির মাঝে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি হঠাৎ হঠাৎ হায়ে এসে পরছে।
“তুমি একটু বসো। কারেন্ট চলে যেতে পারে। হারিকেন জ্বালিয়ে আনি। মোতালেবের অত্যাচারে তো কেরোসিন লুকিয়ে রাখতে হয়।” দেখলাম ভেতরের ঘরের আলমারি খুলে কেরোসিনের বোতল বের করলেন। দেয়ালে হারিকেন ঝোলানো ছিল- সেটা নামিয়ে আগে কেরোসিন ভরলেন। তারপর হারিকেন জ্বালালেন। আমি চুপচাপ বসে এদিক সেদিক তাকাচ্ছি। উঠানের অন্য প্রান্তে রান্নাঘর। খোলা রান্না ঘর, লাকড়ির চুলাতে রান্না করছেন চাচী। তার ওপাসে কলতলা, যদিও বাড়িতে মোটর রয়েছে। তারপরো টিউবয়েলের ব্যবস্থা আছে। চারপাশে নিচু জমিতে ভূট্টা আর পাট ক্ষেত। বাড়ি আর কোল্ড স্টোরেজটা জমির লেভেলে থেকে সামান্য উঁচুতে। যত দূর চোখ যায় ভূট্টা আর পাটের বিছানো ক্ষেত। অন্ধকারের সমুদ্র যেন। উঠানের এক পাশে কয়েকটা আমগাছ আর পেয়ারা গাছ। বাতাসের চোটে এদিক সেদিক দুলছে যেন মাতাল হয়ে। আকাশে থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সাত্তার সাহেব হারিকেন জ্বালিয়ে আমার সামনে এসে বসার সাথে সাথে কারেন্ট চলে গেল।
“বললাম না কারেন্ট যাবে! এই পল্লি বিদ্যুতের লাইন এত খারাপ!” বিরক্তি মেশানো গলায় বললেন তিনি। ফিরে রান্না ঘরের দিকে চেঁচিয়ে বললেন, “জয়গুণ, ভয় পেলে ডাল দিও। আমরা বারান্দাতেই আছি।” রান্না ঘরে এখন চেরাগ জ্বালিয়েছেন জয়গুণ নাহার। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ছাপিয়ে চেঁচিয়ে জবাব দিলেন, “ভয়ের কি আছে? বয়স কি কম হয়েছে নাকি! এই বয়সে আবার কিসের ভয়?” “ভয় না পেলেই ভাল।” চেয়ার টেনে বসলেন। হারিকেনের হলদে আলোয় তাঁর দিকে তাকালাম, “আমি এসে আসলে আপনাদের অনেক ঝামেলায় ফেলে দিলাম। চাচীর অনেক কষ্ট হচ্ছে। সাহায্য করারও কেউ নেই দেখি। একা ওনাকে এত সব ঝামেলায় না ফেললেই ভাল হত।” একটু অপ্রস্তুত গলায় বললাম। হা হা করে উদার গলায় হাসলেন সাত্তার সাহেব, “আরে রাখো তো তোমার ভদ্রতা! নতুন জামাই তুমি। শমসের আলীর জামাই মানে আমারও জামাই। তোমার জন্য আরো অনেক কিছু করা উচিত ছিল। তাহলে ভাল লাগত নিজের কাছে। এগুলো তো সামান্য।” আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “কোল্ড স্টোরেজে জেনারেটর আছে এখানে আনলেন না কেন?” “ছিল। কিন্তু লাইনে সমস্যা করছে কয়দিন ধরে।”
আমি কিছু বললাম না আর।
একা দুজন বয়স্ক মানুষ আমার মেহেমানদারী করছেন- ভেবেই কেমন যেন খারাপ লাগছে। অন্ধকার জমি গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম এক দৃষ্টিতে। “একে বারে বিরান জায়গায় বাড়ি করেছেন। থাকেন কিভাবে?” হঠাৎ প্রশ্ন করলাম সাত্তার সাহেবকে। চশমাটা খুলে নাকের দুপাশের গভীর দাগ গুলোয় আঙ্গুল বোলালেন, “অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি আগে থেকেই ঘর কুনো স্বভাবের মানুষ ছিলাম। একা থাকতে ভাল লাগত। অবশ্য আগে ঘরটা এত খালি ছিল না। মেয়ে গুলো থাকতে বাড়িটা ভরা থাকত। বিয়ের পর চলে যাওয়ায় এখন বাড়িটা খালি হয়ে গেছে। জমি গুলো যে দেখছো- রাতের বেলা দেখা যাচ্ছে না, ওখানে আধিয়ারদের বাড়ি আছে ছাড়া ছাড়া ভাবে। আমার জমিতে থেকে চাষ করে খায়। তুমি তো এই এলাকার ছেলে- আধিয়ার মানে বোঝো তো?” “জানি, বর্গা চাষী।” সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন, “হ্যা। ওদের বাড়ি গুলো জমির মধ্যে, তাই এখন বোঝা যাচ্ছে না। দিনের বেলা দেখা যায়। তাই একেবারে যে বিরান জায়গা- তা বলা যাবে না।”
“কবে থেকে আছেন এখানে? মানে আপনার পৈতৃক ভিটা কি এখানেই ছিল?” “নাহ। শহরের দিকে ছিল। এখানে এসেছি তো কোল্ড স্টোরেজ দেয়ার পর। একটু নিরিবিলি জায়গা পছন্দ আমার। তোমার চাচীও এ রকম জায়গায় থাকতে চেয়েছিল- তাই চলে এলাম বাড়ি করে।” বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বারান্দায় বসে থাকায় গায়ে বৃষ্টির ছিটে এসে পরছে। ভালই লাগছে।গরমে অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টি আসায় হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সাত্তার সাহেব চেয়ার টেনে সরে বসলেন, “আমার আবার একটুতেই ঠান্ডা লাগে, ভিজি না তাই।” আমি হাসলাম কেবল। কিছু বললাম না। টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে ।
শব্দটা শুনতে খুব ভালো লাগছে। একটানা বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। তাকিয়ে দেখলাম সাত্তার সাহেব এক দৃষ্টিতে জমি গুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। চোখে ভূলও দেখে থাকতে পারি- মনে হল তার মুখে অদ্ভূত একটা যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠেছে। অন্ধকার জমির দিকে স্থির চোখে চেয়ে আছেন। ভাবলাম জিজ্ঞেস করবো- কিন্তু তার আগেই আস্তে আস্তে বললেন, “তুমি তো লেখা লেখি করো জামাই? জীবনে ব্যাখ্যাতীত কোনো ঘটনা ঘটতে দেখেছো?” প্রশ্নটা কোন দিক থেকে করলেন বুঝতে পারলাম না, “ভূতের গল্প? মানে ভূতুড়ে ঘটনা? নাহ। আমি এমনিতেই ভীতু স্বভাবের মানুষ। ভূতুড়ে কিছু দেখলে জানে পানি থাকবে না আমার।”
“আমি দেখেছি।” একটা নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকালেন। “কি রকম?” সামান্য কৌতুহলি গলায় বললাম। “আমি প্রায় ত্রিশ বছর আগে এখানে আমার কোল্ড স্টোরেজটা দিয়েছিলাম। তখনকার ঘটনা। আমার জমিতে আধিয়ার তখন অল্প। দুই তিনটা পরিবার হবে। আর আমার বড় মেয়ের বয়স তখন তিন কি চার। ছোট দুটো তখনো হয়নি। ঐ দিকে- ” হাত তুলে অন্ধকার জমির দিকে দেখালেন- একটু আগে সে দিকেই তাকিয়েছিলেন। “ওখানে একটা আধিয়ারের বাড়ি ছিল।
মাটির বাড়ি। এখন নেই। বাড়িটা যার ছিল, মানে আধিয়ারটার নাম হল তাজল শেখ। পঞ্চগড় থেকে এসেছিল। শক্ত সামর্থ জোয়ান মানুষ। ওর বৌটা ছিল ঠিক ওর অর্ধেক বয়সের। সুলতানা। তের কি চোদ্দ হবে বয়স। বিয়ে করে এখানেই প্রথম এনে তুলেছিল। শ্যামলা রঙের হালকা পাতলা মেয়েটা। একা থাকতে পারতো না, দৌড় দিয়ে তোমার চাচীর কাছে চলে আসতো যখন তখন। এটা সেটা করে দিত। ভীশণ ভাল একটা মেয়ে। দেখতেও খুব সুন্দর ছিল। বয়স কম বলে সারাক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতো। সেজে গুজে থাকতে খুব পছন্দ করত। তাজল প্রায়ই নানা রকম চুড়ি, লেস ফিতা, কাজল কিনে দিত মেয়েটাকে। আমার বড় মেয়েটা তখন কথা বলতে পারে বেশ ভাল মত, ওটাকে নিয়ে কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেড়াতো সে-ই জানে। আমিও কিছু বলতাম না। ছোট মানুষ- ছটফটে স্বভাবের তো হবেই। আমার কোল্ড স্টোরেজে প্রায়ই গিয়ে হাজির হত- বলত ঠান্ডা কুয়াশার মত স্টোর রুমে যেতে নাকি খুব মজা লাগে।
আমিও কিছু বলতাম না, ছেলে মানুষ, নতুন বিয়ে হয়েছে – বাচ্চা স্বভাবটা এত তাড়াতাড়ি যায় নাকি। তাই নিষেধ করতাম না। বরং চারপাশে এ রকম ছটফটে স্বভাবের কাউকে পেয়ে ভালই লাগত, একা নির্জন এই জায়গাটাকে সুলতানা মাতিয়ে রেখেছিল বলতে পারো। তাজল শেখ সারা দিন জমিতে চাষ বাষ নিয়ে পরে থাওক্ত, সুলতানা থাকত তোমার চাচীর সঙ্গে। তাজল মাটি কুপিয়ে সারাদিন খেটে যেত। বেশ ভাল একটা ছেলে – নামায কালামও পড়তো নিয়মিত। কত বার দেখেছি ভর রদ্দুরে জমিতে গামছা বিছিয়ে নামায পড়ছে। ওদের দুজনকে দেখলে এমনিতেই কেন জানি মনটা ভাল হয়ে যেত। ভাল মানুষ গুলোর ভেতরে বোধ হয় আল্লাহ নিজে কিছু দিয়ে দিয়েছেন। দেখলেই মন ভাল হয়ে যায় সে জন্য।” কিন্তু ভাল মানুষ বেশি দিন থাকে না আমাদের মাঝে। দুনিয়ার বড় অদ্ভূত নিয়ম! তাজল একদিন জমি কোপাতে গিয়ে মাটির নিচে বাঁকা ভাবে বসে থাকা একটা মূর্তি আবিষ্কার করে। মূর্তিটা কালো রঙের শিবের মূর্তি। গলায় সাপ প্যাঁচানো। কিন্তু কিছু পার্থক্য রয়েছে। শিবের মূর্তিতে কোনো বাড়তি হাত ছিল না, এটায় আছে। তিন জোড়া হাত। সব থেকে বড় পার্থক্যটা হল এই শিবের মূর্তি কোমড়ের নিচ থেকে মাছের মত আঁশ আর পায়ের জায়গায় ঘোড়ার খুড়ের মত।
অনেকটা গ্রিক পুরাণের কাহিনীর মত। আদৌ সেটা শিবের মূর্তি কিনা বোঝা গেল না। দৈর্ঘে চার ফুটের মত। তাজলের কোঁদালের আঘাতে মূর্তিটার কাঁধের দিকে বিশাল একটা জায়গা কেটে গেছে। ঘটনাটা ঘটেছিল ভর দুপুরে। জমিতে কয়েকজন মিলে কাজ করার সময় হয়েছে। মাটি কোপানোর সময় শক্ত কিছুতে লাগতেই তাজল বাকিদের ডেকে মাটি খুঁড়তে শুরু করে। খুঁড়তে গিয়ে মূর্তি বের হয়। যারা যারা ওখানে ছিল- সবাই দেখেছে কোঁদালের কোপে মূর্তিটার কাঁধের দিক থেকে জীবন্ত প্রাণির মত ফিনকি দিয়ে রক্ত পরছে, কালচে রক্ত! আমি অবশ্য যখন যাই তখন রক্ত টক্ত দেখিনি, তবে কাঁধের কাছটা কেটে মাংস বের হয়ে থাকার মত ফাঁক হয়েছিল তখনো। ব্যপারটা জানা জানি হতেই আশে পাশের মন্দির গুলো থেকে পুরোহিতরা চলে আসে দেখতে। একটা শিব মন্দির থেকে কয়েক জন ঠাকুর এসে মূর্তিটাকে গোসল করিয়ে নিয়ে চলে যায়। আমি বাধা দেইনি। কারো দেবতা আটকে রাখার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। যদিও আমি আমার জমিতে দেবতার মূর্তি থাকার পেছনে কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। কিভাবে এলো পুরোহিতরাও জানে না।
কেবল অনুমান করলেন হয়ত বহু বছর পূর্বে এখানে কোনো মন্দির জাতীয় কিছু ছিল, সেখান থেকেই এসেছে এটা। এর থেকে ভাল কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না যা হোক। কাহিনী এর পর থেকে ঘটতে সুরু করে। যদিও বেশ ছোট ঘটনা। তাজলের কাঁধে দু দিন পরেই আপনা আপনি বিশাল একটা কাটা ক্ষত সৃষ্টি হয়। মূর্তিটার কাঁধে যে রকম ঠিক সে রকম, কোনো কিছু দিয়ে কাটেনি। এমনি এমনি হয়ে গেল! দিন রাত চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পরে। আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার সেলাই করতে গিয়ে সুঁই ভেঙ্গে ফেলতে লাগলেন বারবার। অবাক হয়ে বললেন, “আশ্চর্য! এনার চামড়া মানুষের নাকি লোহার? ঢুকছেই না সূঁচ!” আমি নিজেও টিপে দেখলাম- লোহার মত হয়ে আছে কাটা জায়গাটার চারপাশের চামড়া! আর বরফের মত ঠান্ডা! ভীষণ অবাক হলাম! ক্ষত স্থান গরম হয় বলে জানতাম, এটা এমন কেন? সেলাই করা সম্ভব হল না। ডাক্তার সাহেব রক্ত পরা থামাতে আয়োডিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। বাড়ি নিয়ে এলাম। তবুও রক্ত থামে না। এদিকে সুলতানা তো কান্না কাটি করে ঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে তাজলের রক্ত দেখে। তোমার চাচী আর আমি মিলেও ধরে রাখতে পারছি না মেয়েটাকে।
তাজল খুবই শক্ত সামর্থ ছেলে। টানা দশ দিন এভাবে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ল, তবু ছেলেটা দিব্যি চলে ফিরে বেরাচ্ছে। এর মাঝেই একদিন আমাকে একা ডেকে জানাল তার কোমরের নিচ থেকে পঁচন ধরেছে। কেমন মাছের মত আঁশে ঢেকে যাচ্ছে। আমাকে দেখালো পা আর ঊরুর অবস্থা। আমি তো দেখে থ হয়ে গেলাম। ইলিশ মাছের মত জ্বলজ্বলে রুপালী আঁশে ঢেকে গেছে কোমর থেকে পা পর্যন্ত। পায়ের আঙ্গুল গুলো পঁচে যাচ্ছে আমি মহা দুশ্চিন্তায় পরে গেলাম। তাজল মাথা চুলকে বলল, “সাত্তার ভাই, মোর মনে হয় ওই মূর্তি কুপাইয়া এই ব্যারাম ধরাইছ। নাইলে এতদিন তো ভালা আছিলাম।” “কি করতে বলো তাহলে আমাকে?” “গিয়া মূর্তিটার কাছে মাফ চাইয়া আসিম? ঠাকুরক কহিম মন্ত্র পড়ে পূজা দেয়ে দেক?” “এরকম করে যদি লাভ হয়- করে দেখতে পারো। আমিও গেলাম তোমার সাথে।”
সেদিন আমি আর তাজল সন্ধ্যার দিকে রওনা হলাম পূর্ব দিকের শিব মন্দিরে। দশ মাইলের বেশি পথ। তাজল পায়ের পঁচন ব্যাথায় হাটতেই পারছে না। তবু দাঁতে দাঁত চেপে হেটে যাচ্ছে। আমরা যতক্ষণে পৌছালাম- রাত হয়ে গেছে। গিয়ে দেখি নতুন কাহিনী- মন্দির গত পরশু রাতে আপনা আপনি ভেঙ্গে পরেছে! ভেতরের সব মূর্তি মাটির নিচে চলে গেছে! একটা মূর্তিও নেই! আমাদের সেই মূর্তিটাও না। কি আর করা, তবুও পুরোহিত দিয়ে ছোট একটা পূজা দেয়ালাম। চলে এলাম তাজলকে নিয়ে। কিন্তু আসার বেলা তাজল হাটতেই পারলো না, ওর পায়ের আঙ্গুল পঁচে খুব খারাপ অবস্থা, গোড়ালির দিকটা কাঠের মত শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন খুড়ের মত অবস্থা ভীষণ জ্বর তারওপর। শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আমি উপায় না দেখে একটা মোষের গাড়ি ভাড়া করলাম। ফেরার পথে সারা রাত জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বকতে লাগল তাজল শেখ। প্রায় সব কথাই অর্থহীন, বিজাতীয় ভাষায় ও কি সব বলল। মনে হল কথাগুলো তাজল না, অনয কেউ বলছে। একতা কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল- বারবার বলছিল বলে বুঝতে পেরেছিলাম কথাটা- “মোক ঠান্ডায় নিয়ে যা, মোক খুব গরম লাগেছে। মুই আলো বাতাসত রহিবা পারিমনে” তাজল শেখ মারা যায় এক মাসের মাথায়।
মৃত্যুর পূর্বে ওর দুপা পঁচে গিয়ে খুড়ের মত হয়ে গিয়েছিল। পিঠের মেরুদন্ডের দিকে টিউমারের মত হয়ে দুই জোড়া হাতের মত তৈরি হয়েছিল- কিন্তু খুব ছোট। সারাক্ষণ মাটির বাড়ির মেঝেতে শুয়ে থাকতো। আর বিড়বিড় করে বলত ওকে বরফ দিয়ে চেপে ধরে রাখতে। কয়েকবার বলেছিল মাটি খুড়ে তাকে মাটি দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিতে। কোনোটাই করা হয়নি। সুলতানা ওর ওসুখ দেখে পাগলের মত হয়ে যায়। তাজল মারা যাওয়ার দিন রাতে নাকি একটা কালো সাপ এসে ওর গলায় পেঁচিয়ে বসেছিল। মারা যায় তারপর। সুলতানা তাজলের মৃত্যুর পাগল হয়ে গিয়েছিল।” ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফ্বলল্বন সাত্তার সাহেব। আমি চুপচাপ তাঁর কথাগুলো শুনছিলাম, উনি থামতেই বললাম, “এখানেই শেষ? তাজল আসলে ঐ মূর্তিটার রূপ ধরে মারা গিয়েছিল- তাই না? এরপর? এরপর আর কিছু হয়নি?” হাসলেন বিচিত্র ভাবে, কাঁশলেন খুক খুক করে, “এর পরেই তো আসল কাহিনীর শুরু। বললাম না ব্যাখ্যাতীত ঘটনা? তাজলের মৃত্যুর পরেই আসল ঘটনা শুরু হয়েছিল। যেটার কোনো ব্যাখ্যা আমি আজ পর্যন্ত ভেবে বের করতে পারিনি।
” বৃষ্টি বাড়ছে ক্রমশ। আমি অন্ধকার জমির দিকে তাকালাম নিজের অজান্তেই। গা শির শিরে একটা অনুভূতি হল রাতের খাবার খেয়ে বারান্দায় বসে আছি আমি, সাত্তার সাহেব ও তাঁর স্ত্রী জয়গুন নাহার। বাহিরে গুড়ি গুড়ি মিহি বৃষ্টি, হাল্কা বাতাস। কারেন্ট আসেনি এখনো। আমি বসেছি চেয়ারে। সাত্তার সাহেব মাদুর বিছিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছেন। হুক্কা টানছেন। গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। চারপাশে মিষ্টি জাফরানের ঘ্রাণ। জয়গুন নাহার স্বামীর পাশে বসে পানের খিলি সাজাচ্ছেন। “এরপর কি হল? তাজল মারা যাবার পরের ঘটনা?” কৌতুহলি কন্ঠে জানতে চাইলাম আমি। হুকার পাইপে বারদুয়েক টান দিয়ে এক রাশ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমার দিকে তাকালেন সাত্তার সাহেব, চোখে বিচিত্র একটা দৃষ্টি, “এরপরের ঘটনাটা একটু আজব -অবাস্তব বলে মনে হবে তোমার”। জয়গুন নাহারকে দেখলাম সামান্য ভীত চোখে অন্ধকার জমিটার দিকে তাকালেন একবার। চাপা গলায় বললেন, “রাত বিরাতে কিসব শুরু করলা? জামাই মানুষ, ভয় টয় পাবে তো!”
“আরে পাবে না। সাহস আছে ছেলের”। আমার দিকে তাকালেন। আমি ঢোক গিললাম। “তাজল শেখ মারা যাওয়ার দিনের ঘটনা। কবরটা দেয়া হয়েছিল এখান থেকে এক মাইলের মত পূবে একটা গোরস্থানে। অল্প কয়েকটা কবর মাত্র সেখানে। বেশিদিন হয়নি ওখানে গোরস্থানের জন্য জমি দেয়া হয়েছে। জঙ্গল ধরনের জায়গা। বড় বড় বাঁশঝাড় আর ঝোপে ভরা। দিনের বেলাতেই যেতে কেমন লাগে যেন। রাতের বেলাতো ওটার ধারে কাছ দিয়েও মানুষ যায় না। তাজলের কবরটা দেয়া হল জঙ্গলের মাঝামাঝি একটা জায়গায়। সরু পথ কেটে জঙ্গলের ভেতর তাজনের কবর পর্যন্ত নেয়া হয়েছিল। তাজলের জানাযার সময় অনেক মানুষ এসেছিল ওকে দেখতে। তাই কবর দিতে দিতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। প্রচন্ড গরম পড়েছিল সেদিন। কবর দিতে গিয়ে সবাই ঘেমে নেয়ে একাকার।
সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টির ভাব শুরু হল। ঘন মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, গর্জন করছে গম্ভীর স্বরে। গোরস্থানের বাঁশঝাড়গুলো একবার এদিক দুলছে আরেকবার ওদিক। দাফনের কাজ শেষে সবাই মোনাজাত ধরেছি সবে এমন সময় বৃষ্টি নামল চারপাশ ঝাপিয়ে। এমনিতেই সন্ধ্যা তার ওপর ঘন মেঘের জন্য চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। জানাযার নামাজে মুসল্লি যতজন হয়েছিল-দাফনের সময় এসেছে একেবারেই কম। মাত্র আটজন। ইমাম সাহেব সবে হাত তুলে দোয়া পড়ানো শুরু করেছেন তখন নামল বৃষ্টি। আমরা কবরটা চারপাশ থেকে ঘিরে মোনাজাত করছি। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়াতে খারাপ লাগছে না। গরমের হাত থেকে বাঁচা গেল। চোখ বন্ধ করে মোনাজাত করছি। প্রথম দিকে কেমন একটা গোঁ গোঁ চাপা শব্দ হচ্ছিল। বোঝা যাচ্ছিল না শব্দটা কোথা থেকে আসছে। হঠাৎ ঘটল ঘটনাটা। প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে আচমকা কবরের ভেতর থেকে কাঁচা মাটি ফুঁড়ে একটা কালো কুচকুচে হাত বের হয়ে এলো! বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা হাতটার গায়ে লেগে থাকা কাদা মাটি ভিজিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। আমরা যারা ছিলাম ওখানে ব্যাপারটা অনেকেই প্রথমে খেয়াল করল না কারণ মোনাজাত করছিল সবাই নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে।
সম্ভবত আমিই প্রথম দেখলাম ব্যাপারটা। জমে গেলাম বরফের মত। আমার থেকে বড়জোড় দুই হাত সামনে কবরের ভেতর থেকে হাতটা কব্জি সহ আরো একটু বেরিয়ে এসেছে! কয়লার মত কালো হাত। দ্বিতীয় ধাক্কায় অন্য হাতটা বের হয়ে এলো কবর ফুঁড়ে! সেই হাতে একটা ত্রিশূ্ল ধরা! ত্রিশূলের চকচকে ফলা বজ্রপাতের আলোয় জ্বলজ্বল করছে! আমি শুনতে পেলাম বাকিরা ভয়ঙ্কর আতংকে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পালানো শুরু করেছে! আমিই কেবল নড়তে পারছিনা। আমার দুই পা যেন হাজার মণ ভারি হয়ে গেছে। মাটি থেকে তুলতেই পারছি না। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখলাম কবরের বাঁশ চাটাই সব ঠেলে নিচ থেকে কালো কুচকুচে একটা মানুষের মাথা বের হল কবরের মাটির ওপর! বজ্রপাতের সাদা আলোতে দেখতে পেলাম হলুদ রঙের দুটো চোখে মানুষটা সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে! মানুষের চোখের মণি এরকম হলুদ হতে পারে না! লোকটার গলায় পেঁচানো কালো বিষধর একটা সাপ! ফণা তুলে হিস্ হিস্ করছে আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।
বোধহীন জড়বস্তুর মত সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখের সামনে মানুষটা কবর ভেঙে উঠে এল মাটির ওপর। কাদা মেখে আছে লোকটার গায়ে। সাদা কাফনটা দিয়ে কোমড়ের অংশটা পেঁচিয়ে রেখেছে। তাজল শেখ! এত কালো ছিল না দাফনের আগেও এখন দেখতে ওকে ঠিক সেই শিব মূর্তিটার মত লাগছে অবিকল তাজল আমার দিকে তাকিয়ে চিনতে পারার মত কোনো ভাব দেখালো না। হলুদ রঙের জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে খুরওয়ালা পায়ে সাবলীল ভঙ্গিতে হেঁটে বৃষ্টির মাঝে জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গেল! ওর পিঠে আরো দুইজোড়া হাত টিউমারের মধ্য থেকে নড়ছে আমি নিজের পায়ের উপর ভর টিকিয়ে রাখতে পারছিলাম না। কেবল মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর অশুভ-অশূচি কিছু একটা ঘটছে ঘটনাটা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রাম জুড়ে। এমনকি শিব মন্দিরের পুরোহিতদের কান পর্যন্ত চলে গেল। সেই রাতেই মন্দিরের পুরোহিতরা চলে এলো গোরস্থানে। তাদের কথা অনুযায়ী তাজল শেখ হল তাদের দেবতা- তার শরীরে শিব ভর করেছে। কবরটার ভেতরে তখন হাজার হাজার সাপ কিলবিল করছে যখন পুরোহিতরা যায় ওখানে। কিন্তু তাজল শেখকে পাওয়া যায়নি। বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। মশাল জ্বালিয়ে সারা জঙ্গল তন্ন তন্ন করে খুঁজল মন্দিরের সবাই। বার বার বলতে থাকল তারা- তাদের দেবতা মন্দির ছেড়ে চলে এসেছে বলে মন্দিরটা ভেঙে গেছে।
মাটির নিচে চলে গেছে মূর্তিগুলো। তাই তাদের দেবতাকে খুঁজে বের করতে হবে।
কিন্তু চারপাশের দশ মাইল চষে ফেলার পরও তাজল শেখকে পাওয়া যায়নি। সে রাত থেকে আমার প্রচন্ড জ্বর শুরু হল। এমন জ্বর বহুদিন হয়নি। কাউকেই চিনতে পারছিলাম না। কেবল বিছানায় শুয়ে কাথার নিচে কাঁপছিলাম থরথর করে আর পাগলের মত প্রলাপ বকছিলাম। সুলতানার কোনো আত্বীয় স্বজন ছিল না। কারণ তাজল শেখ মারা যাবার সময় কেউ আসেনি। থাকলে নিশ্চই আসতো। স্বামী মারা যাওয়ায় মেয়েটা পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। তোমার চাচী সুলতানাকে এবাড়িতে এনে রেখেছিল কিছুদিন। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলত না। একা একটা ঘরে সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে বসে থাকত। কিছু খেতেও চাইত না। ফেলে দিত সব। জয়গুন অনেক চেষ্টা করেও সুলতানাকে কিছু খাওয়াতে পারত না। দেখতে দেখতে হাসিখুশি মেয়েটা চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে লাগল। শুঁকিয়ে চোয়ালের হাড় বের হয়ে এল।
বড় মায়া লাগত মেয়েটাকে দেখে। আমার জ্বর থেকে সেরে উঠতে পাঁচদিন সময় লাগল। সুস্থ হবার পর প্রায়ই গিয়ে সুলতানাকে বোঝাতাম খাওয়া দাওয়া করার জন্য। মানুষ মারা যাবে এটাইতো স্বাভাবিক। এভাবে ভেঙে পরলে তো জীবন চলবে না। ওর বয়স কম। সামনে ওর পুরো জীবনটা পরে আছে। কিন্তু এত কথা বলে কোনো লাভ হত না। মূর্তির মত যে মেয়েটা বসে থাকত তো থাকতই। কোনো কথাই বলত না। প্রায় রাতেই মসজিদ থেকে এশার নামাজ পড়ে ফিরে আসলে সুলতানার ঘরের দিক থেকে শুনতে পেতাম একা একা কথা বলছে মেয়েটা। শুনে মনে হয় যেন কারো সঙ্গে কথা বলছে -কেবল অন্যজনের কথা শোনা যাচ্ছেনা। আমি পাগলের প্রলাপ ভেবে পাত্তা দিতাম না। তাজল শেখের কবর থেকে বেরিয়ে আসার ঘটনাটা সুলতানাকে কেউ বলেনি। বললে কি করত কে জানে। এমনিতেই তাজলের শোকে পাথর হয়ে আছে। আমি শুক্রবার বিকেলে আমাদের বাড়িতে হুজুর এনে মিলাদ দেয়ালাম। কারণ তাজল শেখ মারা যাবার পর থেকেই এই বাড়িটা কেমন যেন হয়ে গেছে। যদিও এ বাড়িতে তাজল থাকত না। কিন্তু সুলতানা আসার পর থেকে এ বাড়িতে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। খুব বেশি সাপ বের হচ্ছে বাড়ির নানান জায়গা থেকে। হাঁস মুরগি গুলো সব মরতে শুরু করেছে একে একে। আর বাড়ির চারপাশে কে যেন মাটি খুঁড়ে বড় গর্তের মত করে রাখে প্রতিরাতে।
মিলাদের পরদিন কাজের চাপে সারাদিন বাসায় আসতে পারলাম না। গঞ্জে যেতে হয়েছিল মালপত্র নিয়ে আসতে। সেসময় এখানে লোক এসে কোল্ড স্টোরেজ়ে বস্তা দিয়ে যেত না। গঞ্জে আমার মূল অফিসে দিয়ে যেত। আমাকে নিয়ে আসতে হত। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। নামাজের পর ফিরলাম। রাতে আমি মসজিদ থেকে ফিরে সবে বাড়িতে পা রেখেছি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। বাড়ির কোথাও কোনো আলো নেই। কারেন্ট না থাকতে পারে কিন্তু হারিকেন তো জ্বলবে-সেটাও জ্বলছে না। আমি হাতের টর্চ দিয়ে এদিক সেদিক দেখলাম। জয়গুন কিংবা আমার বড় মেয়ে কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই।
অবাক হলাম ভীষণ। এমনকি চারপাশে অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা, কোনো ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দও নেই। হাঁস মুরগির খোঁপ গুলোতেও কোনো আওয়াজ হচ্ছে না! সারা বাড়ি যেন কবর হয়ে আছে! আমি জয়গুনের নাম ধরে সবে ডাকতে যাবো- মুখ খুলেছি- হঠাৎ শুনতে পেলাম সুলতানা ওর ঘরটা থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, অস্পষ্ট গলায় কিছু বলছে। বোঝা যাচ্ছে না। আমি টর্চের আলো ফেললাম ওর ঘরটার দিকে, জানালা বন্ধ, দরজাও বন্ধ। অন্ধকারে ভয় পেয়ে কাঁদছে নাকি? আমি এগিয়ে গেলাম তাড়াতাড়ি। ওর ঘরটার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে যাবো-থমকে গেলাম আমি। স্পষ্ট শুনতে পেলাম একটা পুরুষ কন্ঠে কেউ বলছে, “মোর নগত কাহো আসিবা পারিবা নাহায় ”কন্ঠটা শুনে জমে গেলাম। তাজল শেখের গলা! শুনতে পেলাম সুলতানা ভাঙা গলায় বলছে, “মুই যাম, মুই একলা রহিবা পারিবা নহু।” আমি দরজার ফাঁক দিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকালাম ভেতরে কি হচ্ছে দেখার জন্য।
কিন্তু তার আগেই আমার হৃদপিন্ডটা ধরাস করে উঠল। আমি দরজার যে অংশে চোখ রেখে তাকাতে গেছি- ঠিক সেখানেই হলুদ একটা চোখ আমার দিকে ওপাশ থেকে চেয়ে আছে দরজার ওপাশ থেকে! গোরস্থানের সেই তাজলের চোখগুলো! আমি আতংকে পেছন দিকে ছিটকে এলাম। পায়ে পা বেঁধে হোচট খেয়ে পরে গেলাম উঠানে। টর্চটা হাত থেকে গড়িয়ে অন্যদিকে চলে গেল। আমি ভয়ার্ত চোখে দেখলাম সুলতানার ঘরের দরজা খুলে গেল। চাঁদের ঘোলাটে আলোয় দেখা গেল তাজল শেখের সেই দেবতা রুপটা একহাতে ত্রিশূল নিয়ে, গলায় সাপ পেঁচানো- কালো কুচকুচে মুখে হলুদ দুটো চোখ। জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! অন্য হাতে সুলতানার একটা হাত ধরে রেখেছে। আমি নড়তে পারছিলাম না ভয়ের চোটে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাজল সুলাতানার হাত ধরে নেমে এল উঠানে। আমার দিকে না তাকিয়ে দুজন সোজা হেঁটে যেতে লাগল ওদের মাটির বাড়িটার দিকে! পুরো দৃশ্যটায় ভয়ংকর একটা অশুভ আর অবাস্তব ব্যাপার রয়েছে। আমার মনে হচ্ছে আমি খুব ভয়াবহ একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি। কারণ আমি চাঁদের আলো আর পরে থাকা টর্চের আলোতে আবছা ভাবে দেখতে পাচ্ছি সুলতানার ঘরের খোলা দরজাটা দিয়ে-সিলিং থেকে সুলতানা ঝুলে রয়েছে ঘরের ভেতর!
ওর শাড়িটা ফাঁস বানিয়ে গলায় দেয়া, ব্লাউজ আর পেটিকোট পরনে। দুপা সোজা হয়ে রয়েছে, আঙ্গুল গুলো মাটির দিকে! বিস্ফোরিত চোখে অন্য দিকে তাকালাম। এখনো চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে সুলতানা ওর স্বামীর দেবতা মূর্তির হাত ধরে ওদের পুরনো ভিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জমির আল দিয়ে। সুলাতানা যদি ওখানে থাকে-তবে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে কে? আমি হাঁচড়ে পাচড়ে উঠে টর্চ হাতে দৌড়ে ঘরটায় ঢুকলাম। সুলাতানা ঘরে ফাঁস দিয়ে ঝুলে রয়েছে। এক নজর দেখেই বোঝা গেল ফাঁসটা এখন না, বেশ আগেই খেয়েছিল।
ফুলে রয়েছে সারা শরীর! আমি খুব একটা সাহসী মানুষ তা বলব না। তবে সে সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারলাম। জয়গুন আর বড় মেয়েকে না দেখতে পাওয়ার কারণটা বুঝতে পারলাম। সম্ভবত লাশটা দেখে ভয়ের চোটে অন্য আধিয়ারদের বাড়িতে চলে গেছে। আমি নেই- ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। হয়ত অন্যদের ডেকে আনার আগেই আমি চলে এসেছিলাম। সুলতানার লাশটা নামাতে গেলাম না আমি। পুলিশি ব্যাপার। ওরা আসুক আগে। কতক্ষন আগে ফাঁস খেয়েছিল কে জানে। লাশটা দ্রুত ফুলে যাচ্ছে। আমি উঠানে বেরিয়ে এলাম টর্চ হাতে। দেখতে পেলাম চারপাশের জমিগুলোর আধিয়ারদের বাড়ি থেকে হারিকেন হাতে লোকজন ছুতে আসছে ক্ষেতের মাঝ দিয়ে। আমি তাজলদের মাটির বাড়িটার দিকে তাকালাম। শিরশির করে উঠল গা। ভোররাতে পুলিশ যখন আসে তার একটু আগে সুলতানার লাশটা বেশি ফুলে গিয়ে শাড়ি ছিঁড়ে মেঝেতে পড়ে যায়।
ঠিক একই সময়ে তাজলদের মাটির বাড়িটা অদ্ভুতভাবে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। একেবারে মিশে যায় বাড়িটা” থামলেন সাত্তার সাহেব। আস্তে আস্তে বললাম, সুলতানা এমন করল কেন? হাসলেন তিনি, সংসার। সংসার বড় আজব জিনিস। । বেধে রাখা যায় না, আবার ছেঁড়ার পরেও জোড়া দেয়ার বড় পাগল নেশায় টানে সুলতানাকে সংসারের নেশায় ধরেছিল, তাজলের সংসারের নেশা। কাটাতে পারেনি সেটা। ফাঁসিতে ঝুলে নতুন করে ছেঁড়া সম্পর্কটা জুড়ে দিতে চেয়েছিল। চুপ হয়ে গেলেন দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্তের জন্য। চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোঁকার একঘেয়ে ডাক।
আমি ঢোক গিললাম, “তারপর?” “তারপর অনেক ঘটনা ঘটেছিল, সব বলার মত না। তবে একটা ব্যাপার- ওরা মারা যাওয়ার পর আমার কোল্ড স্টোরেজে প্রায় রাতেই তাজল আর সুলতানাকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে অনেকে। আমি নিজেও তালা বন্ধ করতে গিয়ে বেশ কয়েক রাতে দেখেছি। আবছা অন্ধকারের মাঝে কোল্ড স্টোরেজের ভেতরে বাঁশের তাকগুলোতে বস্তার উপর পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে তাজল শেখ।পায়ে ঘোড়ার খুর,গলায় সাপ। চুপচাপ বসে আছে প্রচন্ড ঠান্ডার মাঝে। কুয়াশার মত ধোঁয়া ওর চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। অদ্ভুত সুরে বিজাতীয় ভাষায় গুনগুণ করে গান গাওয়ার মত করে কিছু একটা বলে তাজল শেখ। কাকে বলে জানিনা। কিন্তু ঐ সময়টায় পুরো এলাকার সব ঝিঁ ঝিঁ পোকা, শিয়াল, খাটাস- একদম চুপ মেরে যায়। কোনো প্রাণের সাড়া পাওয়া যায় না।” হুক্কা টানতে গিয়ে খেয়াল করলেন আগুন নিভে গেছে। বিরক্ত হলেন যেন পাইপটার উপর। ফেলে দিলেন একপাশে পাইপটা। দীর্ঘ নীরবতা।
“জামাই, অনেক রাত হয়েছে। ঘুমায় পরো বাবা।” জয়গুন চাচী বললেন এক সময়। আমি মাথা কাত করে উঠে দাঁড়ালাম। চারপাশে কুয়াশার মত বৃষ্টি, তার মাঝেই মেঘ সরে গিয়ে চাঁদের ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে পরেছে চারপাশের ক্ষেত গুলোতে। চাঁদের আলোতে মিহি বৃষ্টি। হঠাৎ খেয়াল করলাম চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকা, শিয়াল, কুকুর- কোনো কিছুর ডাক শোনা যাচ্ছে না! গায়ে কাঁটা দিল! কেন যেন মনে হল অন্ধকার জমির সেই জায়গাটায় আলের ওপর থেকে কেউ একজন জ্বলজ্বলে হলুদ চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এইদিকে। চোখের ভূল কিনা বুঝতে পারলাম না। তবে হঠাৎ যেন লাগল সেখানে কম বয়সী একটা মেয়ের আবছা অবয়ব প্রকট হচ্ছে ধীরে ধীরে প্রথম জনের পাশে…..