ভূতের গল্প

ভূতের গল্প

হঠাৎ মাখন সিং এসে হাজির হল অনেকদিন পর। শিকারী মাখন সিং। কাঁধে বন্দুক। হাতে একজোড়া মরা পিনটেল। পিনটেল অতি সুস্বাদু বুননাহাঁস। মাখন অনেক বুনোহাঁস খাইয়েছে আমাকে। প্রায়ই হাঁস মেরে আনত। হরিণের মাংস,
বুনো শুয়োরের মাংস, সজারুর মাংস,
ফ্রবিকানের মাংস ওর দৌলতেই খেয়েছি। আমার ঘরে বাঘের যে চামড়াটা দেওয়ালে টাঙানো আছে সেটাও মাখনের দেওয়া। খুব বড় শিকারী। পরনে খাকি হাফ শার্ট, হাফ প্যান্ট,
কাইজারি গাঁফ। মাথার চুল কদম ছাঁট।

অনেক দিন পরে এল আজ। ‘কি মাখনলাল, এস এস। এতদিন কোথায় ছিলে?’

‘নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াই। ভাবলাম অনেকদিন দাদার সঙ্গে দেখা হয় নি, দেখা করে আসি। আজ ভাগ্য ভালো,
দুটো পিনটেলও পেয়ে গেলাম।’

‘বেশ, বেশ। বস। চা খাবে না কফি?’

মাখন রহস্যময় হাসি হেসে বললেন,
‘কিছু খাব না। আপনি একটু অন্যমনস্ক হয়ে আছেন মনে হচ্ছে!’

‘হ্যাঁ, মনে মনে কল্পনার দরবারে ধন্না দিয়েছি। একটা ভৌতিক গল্পের প্লটের জন্য।’

‘আমার একটা অদ্ভুত ভূতের গল্প জানা আছে। শুনবেন?’

‘বেশ, বল।’

মাখন সিং বলতে লাগল:
‘গৌড়ের কাছে একটা জঙ্গলে শিকার করতে গিয়েছিলাম। একজন খবর দিয়েছিলে সেখানে ভোরের দিকে বড় বড় কালো তিতির পাওয়া যায়। খুব ভোরে বেরোয় তারা। তা ঠিক করলাম রাতে গিয়ে বনের ধারেই শুয়ে থাকব। আমার ছোট একটি বিলিতি খাটিয়া আছে। সর্বত্র নিয়ে যাওয়া যায় প্যাক করে। তার মাপে মশারিও আছে আমার একটা। ঠিক করলাম জঙ্গলের ধাবেই মশারি খাটিয়ে শুয়ে থাকব রাত্রে।

‘খাওয়া-দাওয়া করে চলে গেলাম রাত দশটার পর। সন্ধ্যা থেকেই আমার চাকর শুকুর বিছানা করে মশারি টাঙিয়ে অপেক্ষা কবছিল আমার জন্য। আমি গিয়ে তাকে ছুটি দিয়ে দিলাম। সে বাসায় চলে গেল। আমি লোডেড বন্দুকটি নিয়ে শুয়ে পড়লাম। তখনও চাঁদ ওঠেনি।

কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। কিন্তু বেশ হাওয়া দিচ্ছিল। একটু পরেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ একটা ফেঁস করে শব্দ হল। মনে হল সাপ নাকি! সঙ্গে টর্চ ছিল। জ্বেলে দেখি ও বাবা, সাপ নয়,
হাতী। বিরাটকায় একটা হাতী। ঠিক সেই সময়েই আকাশে মেঘটা সরে গেল। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের-জ্যোৎস্নায় ভরে গেল চতুর্দিক। দেখলাম হাতী শুধু বিরাটকায় নয়, বেশ সুসজ্জিতও। পিঠে হাওদা রয়েছে। আমার মশারির ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে শুড় নাড়ছে, কান নাড়ছে, আর ফোস ফোস শব্দ করছে মাঝে মাঝে। আর কিছু করছে না। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম। চুপটি করে বসে রইলাম। ভাবলাম কোথা থেকে এসেছে, আপনিই চলে যাবে। এ বুনো হাতী নয়, পোষা হাতী। প্রায় মিনিট দশেক কেটে গেল হাতী কিন্তু নড়ে না! ক্রমাগত শুড দোলাচ্ছে আর কান নাড়ছে। আরও মিনিট দশেক কেটে গেল! কি করব ভাবছি। এমন সময় হাতীটা এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। হঠাৎ সে আকাশে দিকে শুঁড়টা তুলে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপব শুঁড়টা নামিয়ে আমার মশারির ভিত শুঁড়টা ঢুকিয়ে দিল। শুঁড়ে একটি রুদ্রাক্ষের মালা ছিল, সে মালাটি পবিয়ে দিল আমার গলায়। শুঁড়ের ভিতর থেকে ঠক করে কি একটা পড়ল আমার কোলের উপর। তুলে দেখি শ্বেতপাথরের ছোট শিবলিঙ্গ একটি। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল আমি গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক আর এটি হচ্ছে আমার প্রিয় হস্তী মৈনাক।

‘বললাম, মৈনাক, কি খবর?

‘সঙ্গে সঙ্গে মৈনাক হাঁটু গেড়ে বসল। আর তার শুঁড়টি বেঁকিয়ে ধরল। আমি তার শুঁড়ে পা রেখে হাওদায় গিয়ে বসলাম। সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করল সে। গজেন্দ্র গমন নয়‚ ছুট লাগল মৈনাক। কত মাঠ বন গিরি নদী পার হয়ে গেলাম। রাত্রি প্রভাত হয়ে গেল। মৈনাক তবু থামে না। দিনের আলোয় দেখলাম চমৎকার এক দেশ। চারিদিকে প্রাচুর্য, চারিদিকে সৌন্দর্য। কত মন্দির, কত হর্ম, কত জলাশয়,
কত বাগান পার হয়ে গেলাম। মৈনাককে দেখে রাস্তার লোক সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিতে লাগল। জয় মহারাজ শশাঙ্কের জয়
‚ জয়ধ্বনিতে প্রকম্পিত হতে লাগল চারিদিক। মৈনাক কিন্তু এক নিমিষের জন্য থামে নি। সে ছুটে চলে। সমস্ত দিন ধরে সে ছুটল।

তারপর সূর্য যখন অস্ত গেল,
অন্ধকার রাত্রি নামল, তখন বিরাট এক জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল মৈনাক। শুঁড় দিয়ে বড় বড় গাছের ডাল ভেঙে পথ পরিষ্কার করতে করতে এগিয়ে চলল জঙ্গলের ভিতর। কিছুদূর গিয়ে দেখতে পেলাম একটি পরিষ্কার জায়গায় চিতা জ্বলছে। আর চিতার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাজ্যশ্রী। আমি রাজ্যশ্রীকে ভালবাসতাম কিন্তু তার ভাই রাজ্যবর্ধন ও হর্ষবর্ধনের সঙ্গে আমার ঝগড়া ছিল, তাই তাকে পাইনি।

‘বললাম‚ রাজ্যশ্রী, এখানে কি করছ?

‘আমি জ্বলন্ত চিতায় প্রাণ বিসর্জন করব। তুমি আমাকে বাধা দিও না।
‘নিশ্চয় দেব।

‘সঙ্গে সঙ্গে আমি মৈনাকের পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়লাম। হঠাৎ একটা বর্শা এসে বিধল আমার বুকে। দেখি রাজ্যবর্ধনের প্রেত দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ কুটিল, চোখে আগুন।’

ঠিক সেই সময়ে আমার পৌত্র হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকল।
‘দাদু, আজ আমাদের প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন ছিল। দেখ, আমি কী সুন্দর রামায়ণ পেয়েছি।’

প্রকাণ্ড কৃত্তিবাসী রামায়ণটা সে রাখল টেবিলের উপর।

সঙ্গে সঙ্গে মাখন সিংযেন উবে গেল। মরা পিনটেল দুটো যেখানে পড়ে ছিল, দেখলাম, সে দুটোও নেই সেখানে। পরদিন খবর পেলাম, শিকার করতে গিয়ে মাখনলালের মৃত্যু হয়েছে। একটা বনের ভিতর তার মৃতদেহটা পড়েছিল।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত