প্রায় একশ বছর আগেকার কথা বলিতেছি। তখন সমস্ত উত্তর ভারতে সিপাহি-বিদ্রোহ চলিতেছে। বিদ্রোহের আরম্ভ ১৮৫৭ সালের মে মাসে। আমরা তার কয়েক মাস পরের কথা বলিতেছি। ইতিমধ্যে বৃটিশ বাহিনী দিল্লী পুনরাধিকার করিয়া লইয়াছে, তাহার আগেই কানপুর তাহাদের হস্তগত হইয়াছে,
বড় সহরের মধ্যে লখনৌ তখনও বিদ্রোহীগণ কর্তৃক অধিকৃত। স্যার কলিন ক্যাম্বেল লখনৌ অধিকার করিবার উদ্দেশ্যে রওনা হইয়াছিল। বৃটিশ বাহিনীর একটি শাখা এলাহাবাদ হইতে অপর একটি শাখা কানপুর হইতে লখনৌ যাত্রা করিয়াছে। কানপুর হইতে লখনৌ অভিযাত্রী শাখাটিকে অবলম্বন করিয়াই আমাদের গল্প। এই শাখাটির সেনাপতি হোপগ্রান্ট। দলের মধ্যে আছে লেঃ রবার্টস, তরুণ বয়স,
এদেশে নবাগত। লেঃ রবার্টস পরে বৃটিশ ভারতের কমাণ্ডার-ইন-চীফ হইয়াছিল। গল্পটি আংশিক ভাবে তাহার আত্মজীবনীতে আছে।
এখন ১৮৫৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। কানপুরে সসৈন্যে গঙ্গা পার হইয়া হোপগ্রান্ট সংবাদ পাইল যে পলাতক নানা সাহেব মিঞাগঞ্জ নামক একটি গ্রামে আশ্রয় লইয়াছে। মিঞাগঞ্জ ২০ মাইল দূরে। হোপগ্রান্ট স্থির করিল যে মিঞাগঞ্জ অধিকার করিতে হইবে। সম্ভব হইলে নানা সাহেবকেও বন্দী করিতে হইবে। দুইদিন পরে হোপগ্রান্ট মিঞাগঞ্জের কাছে পৌছিল।
মিঞাগঞ্জ শহর বা দুর্গ নয়, একটি বড় গ্রামমাত্র। সেকালের অনেক গ্রামের মত এই গ্রামও প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত,
গাঁথুনি কোথাও ইটের কোথাও মাটির, আর প্রাচীরের বাহিরে কতক অংশে একটি পরিখা, বর্ষাকালে জল থাকে, এখন শীতকালে কাদায় পূর্ণ। হোপগ্রান্ট আরও খবর পাইল দুই হাজার সিপাহী গ্রামটিতে আশ্রয় লইয়াছে, তাহারাই প্রাচীরের উপরে কামান সাজাইয়া গ্রামটিকে দুর্ভেদ্য করিয়া তুলিয়াছে, তাহারাও খবর পাইয়াছে যে বৃটিশ সৈন্য আসন্ন।
বৃটিশ সৈন্য বিভাগ কামানের গোলায় প্রাচীর ধ্বসাইয়া দিল, কিভাবে গ্রামটি দখল করিল, এসব চিত্তাকর্ষক কাহিনী হইলেও, আমাদের গল্পের সঙ্গে তাহার প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ না থাকায় আমরা সে কাহিনী বলিব না। গ্রামটি দখল করিয়া হোপগ্রান্ট দেখিল সিপাহী কতক মরিয়াছে, কতক পলাইয়া গিয়াছে,
পলাতকগণের সঙ্গে নানা সাহেবও উধাও হইয়াছে। তখন বৃটিশ সেনাপতি স্থির করিল যে গ্রামটি এমন ভাবে ধংস করিতে হইবে যে সে গ্রামে বিদ্রোহীরা আর আশ্রয় না লইতে পারে। গ্রামের বড় বড় বাড়ী ঘর ও অবশিষ্ট প্রাচীর ধ্বংস করিবার ভার পড়িল লেঃ রবার্টসের উপরে। রবার্টসের সঙ্গে ছিল তাহার অবদালী অঞ্জন তেওয়ারী। রবার্টস পরে যখন কমাণ্ডারইন-চীফ হইয়াছিলেন, তখনো তাহার সঙ্গে অঞ্জন তেওয়ারী ছিল, আরদালিরূপে।
বৃটিশ সৈন্য বাড়ী ঘর ভাঙিতেছিল,
যেখানে প্রয়োজন কামান ব্যবহার করিতেছিল, রবার্টস ঘুরিয়া ঘুরিয়া তদারক করিতেছিল। এমন সময় একজন মুসলমান বৃদ্ধ আসিয়া তাহার পায়ের কাছে কঁদিয়া পড়িল, বলিল, সাহেব আমার বাড়ীখানা রক্ষা কর, সর্বনাশের ভরা আর আর ভারী করো না। সে বলিতে লাগিল আর অঞ্জন তেওয়ারী সাহেবকে বুঝাইয়া দিতেছিল।
সাহেব কালকে আমার মত সুখী কে ছিল? আজ আমার মত হতভাগা আর কে?
কাল আমি পাঁচটি উপযুক্ত ছেলের বাপ ছিলাম, ঐ দেখ তাদের মধ্যে তিনজন ওখানে উপুড় হয়ে পড়ে আছে, তাদের মুখের উপরে মাছি উড়ছে, আর দুজন যে কোথায় গিয়েছে খোদা জানেন।
রবার্টস তাকাইয়া দেখিল একগাদা মৃতদেহের একান্তে একত্রে তিনটি যুবকের মৃতদেহ পড়িয়া আছে, তাহাদের সর্বাঙ্গ মাছিতে কালো। রবার্টস মনে মনে শিহরিয়া উঠিল। চিত্রে ও কাব্যে যুদ্ধ অতিশয় রমণীয় ও চিত্তাকর্ষক, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে তাহা মেলে কই?
বৃদ্ধ বলিতেছিল, সাহেব, আমার বাড়ীখানা ধ্বংস হলে আমার শেষ অবলম্বন যাবে, তখন আমি এ বয়সে কোথায় যাবে? হুজুর, আমার বাড়ীখানা রক্ষা করে, খোদা তোমার ভালো করবে, তুমি জঙ্গীলাট হবে।
রবার্টস তাহার বাড়ীখানা ধ্বংস না করিতে আদেশ দিল।
তখন বৃদ্ধ মাটির উপরে জানু পাতিয়া বসিয়া হাত আকাশের দিকে তুলিয়া অবোধ্য ভাষায় তারস্বরে কি যেন বলিয়া গেল।
বোধকরি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিল,
তবে তাহা খোদার উদ্দেশে না ভারতের জঙ্গীলাটের উদ্দেশে তাহা কেহ বুঝিল না, তবে সবাই দেখিল যে তখন তাহার বলিচিহ্নিত গাল বাহিয়া তরঙ্গিত অশ্রু বহিতেছে।
রবার্টস স্থান পরিত্যাগে উদ্যত হইলে বৃদ্ধ তাহাকে একটু অপেক্ষা করিতে বলিয়া বাড়ীর ভিতরে ঢুকিল এবং এক লহমা পরে বাহিরে আসিয়া বলিল—সাহেব এই পাথরখানা কাছে রেখে দাও, বিপদে আপদে তোমাকে রক্ষা করবে।
সকলে দেখিল তাহার প্রসারিত করতলের উপরে জামের বিচির আকারের একটি ছোট কালো পাথর।
বৃদ্ধ বলিল—সাহেব এর নাম মোল্লাকি পাথর। এই পাথরের অনেক কুদরৎ।
সে আরও বলিল‚ এই পাথর যদি সঙ্গে থাকে আর বিপদের মুখে ‘মোল্লাকি পাথর’ যদি স্মরণ করা যায়, তবে সঙ্গে সঙ্গে সব মুস্কিলের আসান হয়।
তারপর সে পাথরটার এক সুদীর্ঘ ইতিহাস বলিয়া গেল। কোন্ প্রসিদ্ধ মোল্লা প্রথমে কাহাকে দিয়াছিল,
কাহার কত সঙ্কট উদ্ধার হইয়াছে, তারপর কি ভাবে উহা তাহার কাছে আসিল ইত্যাদি। তখনও তাহার প্রসারিত করতলের উপরে কালো পাথরটা চকচক করিতেছিল।
বলাবাহুল্য রবার্টসের মোল্লাকি পাথরের উপরে বিশ্বাস হইবার কোন কারণ ছিল না, তবে ঐ সামান্য উপহারটা না লইলে পাছে বৃদ্ধ মনে দুঃখ পায় তাই সে অঞ্জন তেওয়ারীকে উহা লইতে ইঙ্গিত করিল।
তেওয়ারী উহা সাগ্রহে লইয়া সযত্নে কুর্তির জেবের মধ্যে রাখিয়া দিল।
ইহাই গল্পটির আদিপর্ব।
তারপর দিন তিনেক অতিবাহিত হইয়াছে। হোপগ্রান্টের সৈন্যবাহিনী লখনৌয়ের দিকে আরও খানিকটা অগ্রসর হইয়াছে।
সেদিন মেঘ নির্মুক্ত শীতের সকাল,
তাজা রৌদ্রে মাঠ ভরিয়া গিয়াছে, যত দূর দেখা যায় রৌদ্রে ভাজা অবাধ মাঠ তার আর যেন শেষ নাই, কেবল মাঝে মাঝে এখানে ওখানে আমের বাগান। লেঃ রবার্টস, ক্যাপ্টেন ওয়াটসন ও অঞ্জন তেওয়ারী মূল বাহিনী হইতে কিছু পিছনে পড়িয়াছিল, তাহাদের অশ্ব যথেচ্ছ মন্দ গতিতে চলিয়াছিল, তাড়া ছিল না তাই তাড়াতাড়ি ছিল না।
এমন সময়ে ওয়াটসন বলিয়া উঠিল,
রবার্টস ঐ দেখ একটা নীল গাই।
তাই তো‚ চল দেখা যাক পাওয়া যায় কিনা। তেওয়ারী কহিল‚ হুজুর ওটা গাই গোরু, মারলে দেবতা রাগ করবেন।
রবার্টস বলিল‚ গোরু নয়, হরিণ,
তোমরা ভুলক্রমে গোরু বলো, আর সব দেশে ওকে হরিণ বলে।
এই বলিয়া রবার্টস এবং ওয়াটসন ঘোড়া ছুটাইয়া দিল, অগত্যা তেওয়ারীকেও ছুটিতে হইল।
নীল গাই যে হরিণ তাহাতে সন্দেহ নাই, গোরুর সাধ্য কি এমন বাতাসের আগে ছোটে। কখনও তিনজনে হরিণটির কাছে গিয়া পড়ে, আবার মুহূর্তের মধ্যে যেন মন্ত্রবলে কোন্ দূর দেশে চলিয়া যায়। এমনি ভাবে ঘণ্টা দুই চলিল, সোয়ার থামিল, ঘোড়া থামিল, তাহার পর কোথা হইতে কোথায় আসিয়া পড়িল কিন্তু নীল গাইয়ের নাগাল আর মিলিল না। নীল গাইটা মাঠের যেদিকে গিয়াছে সেখানটায় দৃষ্টি রাখিয়া তিনজন একটু থামিয়াছে, ঘোড়ার পক্ষে এই বিশ্রামটুকুর প্রয়োজন ছিল এমন সময়ে ওয়াটসন চীৎকার করিয়া উঠিল, রবার্টস ঐ দেখ।
তিনজনে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল উত্তর দিকের দিগন্ত জুড়িয়া প্রকাণ্ড একটি অশ্ববাহিনী। সিপাহীদের।
পালাও, পালাও। তিন জনে বিপরীত দিকে ঘোড়া ছুটাইয়া দিল।
তেওয়ারী বলিল—হুজুর, আমি আগেই বলেছিলাম‚ দেবতারা রাগ করেন।
তাহারা তিনজন, সিপাহীদের অশ্বারোহী অনেক। কত হইবে পাঁচশো না হাজার। তিনজনের পক্ষে পাঁচশোর অনেক কমই যথেষ্ট।
ইহাদের ঘোড়া দুই ঘণ্টা ছুটিয়া ক্লান্ত। এখন সে কথা ভাবিয়া আর লাভ নাই, তাহারা পরস্পর ঘোড়ার পেটে জুতার কাটা বিঁধাইয়া দিতে লাগিল। ঘোড়াগুলাও যেন আসন্ন বিপদ বুঝিয়াছে,
প্রাণপণে ছুটিতেছে।
শত্রুবাহিনী ক্রমেই কাছে আসিয়া পড়িতেছে। পাঁচশোর চেয়ে হাজারের কাছে হইবার সম্ভাবনা। তিনজনে একবার ঘাড় ফিরাইয়া দেখে, তাহাতে একটু সময় যায়, ও ভাবে না দেখাই উচিত, কিন্তু না দেখিয়াও পারা যায় কই!
এবার শত্রু সৈন্য একশ গজের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে, অবধারিত মৃত্যু।
তখন রবার্টস বলিল, তিনজনে আর একত্র থেকে লাভ নেই, তিন জনে তিন দিকে ছোট, হয়তো বা কেউ রক্ষা পেতে পারে। তিনজনে পরস্পরের দিকে শেষ বারের মত তাকাইয়া লইয়া প্রাণপণে ঘোড়ার পেটে কাঁটা বিঁধাইয়া দিল,
সিপাহীদের হাতে বিপক্ষের কি মর্মান্তিক দশা হয়, তিনজনে তাহার বহু ঘটনার সাক্ষী। নাঃ আজ আর রক্ষা নাই। এবার বোধ করি উহারা পঞ্চাশ গজের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। এখনি খোলা। তরোয়াল সবেগে ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িবে।
এমন সময়ে তেওয়ারির কি মনে হইল জানি না, সে জোরে চিৎকার করিয়া উঠিল‚ মোল্লাকি পত্থর! মোল্লকি পত্থর!
এমন বিপদের মধ্যেও রবার্টস না হাসিয়া পারিল না। কিন্তু একি!
—হুজুর খোদার কুদরৎ। দুশমন কোথায় গেল!
—তাইতো‚ একি হ’ল !
জাদু না চোখের ভুল। তিনজনেই দেখিল, তেওয়ারী সকলের আগে দেখিয়াছে, শত্রু সৈন্যর চিহ্নমাত্র নাই। সমস্ত বাহিনীটা দ্বিধাবিভক্ত পৃথিবীর গর্ভে যেন ঢুকিয়া গিয়াছে।
তিনজনে ঘোড়া থামাইয়া দাঁড়াইল।
তাইতো ব্যাপার কি? চোখের ভুল হইতেই পারে না, এক সঙ্গে তিনজনের এমন ভুল হয় না।
ওয়াটসন বলিল, হিন্দুস্থানের জাদু।
রবার্টস বলিল‚ মরীচিকা।
মরীচিকা যদি হয় তবে আর দেখা দিচ্ছে না কেন?
জাদুতে বিশ্বাস করিলে কাজ চলে না।
তেওয়ারী বলিল, হুজুর দেবতারা রাগ করে ছিলেন, মোল্লাকি পত্থর বাঁচিয়ে দিয়েছে।
মোট কথা ঘটনাটি সে সময়ে যেমন রহস্যময় ছিল শেষ পর্যন্ত তেমনি থাকিয়া গেল, সকলের বিশ্বাসযোগ্য সিদ্ধান্ত আর হইল না।
তারপর ত্রিশ বছর চলিয়া গিয়াছে। মিঞাগঞ্জের বৃদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী সফল করিয়া তরুণ রবার্টস এখন হিন্দুস্থানের বৃদ্ধ জঙ্গীলাট। সেদিনের ঘটনা বিবৃত করিতে বসিলে লর্ড রবার্টস ব্যাপারটাকে মরীচিকা বলিয়া উড়াইয়া দেয়!
কিন্তু সন্ধ্যাবেলা জঙ্গীলাটের অল্পবয়স্ক আবদালী চাপরাশী মহলে বৃদ্ধ অঞ্জন তেওয়ারী যেদিন এই গল্পটা বলে,
সবাই জিজ্ঞাসা করে, চাচাজী ব্যাপার কি ?
তেওয়ারী কোন কথা না বলিয়া অভ্যস্ত মততা ধীরে ধীরে উঠিয়া পুরাতন টেবিলের দেরাজ খুলিয়া একটি ছোট কালো পাথর বাহির করিয়া প্রসারিত করতলের উপরে সযত্নে রক্ষা করিয়া বলিয়া উঠে মোল্লাকি পত্থর।
যুবকের দল মুখ টিপিয়া হাসে,
তেওয়ারীর তাহা চোখে পড়ে না। ঘরের আলো নিস্তেজ, আর তাহার চোখের আলোও ক্রমে নিস্তেজ হইয়া আসিতেছে।
(সমাপ্ত)