মা জানতে চাইলেন‚ ‘কিরে রুবি আজ কি রকম বেড়ানো হল, চারুমাসি কতদূর নিয়ে গেল?’
বুড়ি ঝি চারু এবাড়ির কাজের মানুষ। রুবি উৎসাহ ভরে জবাব দেয়, ‘কী সুন্দর একটা বেজি দেখলাম মা, ওই যে কেয়াগাছের ঝোপটা আছে না, ওইখান থেকে বেরিয়েই আমাদের দেখে পালাল। চারুমাসির কিন্তু হাতটা কেটে গেছে, এমন ভীতু ভয়ে কাঁটা ঝোপের ওপর পড়ে গিছল।’
‘কোন কাঁটা ঝোপ?’
‘কেন ওই যে কেয়াবনের পাশে! ঠিক যেন বেড়ালে আঁচড়ে দিয়েছে, এমন দেখাচ্ছিল মা চারুমাসিকে।’
‘আচ্ছা! বেচারি চারু তো আমাকে কিছু বলেনি। তোমার বাবা এইবার পুজোর সময় ওসব ঝোপঝাড় কাটিয়ে দেবেন।’
‘না, মা, আমার বেশ লাগে। মাঝে মাঝে কেমন ঘন ঝোপ। ওইখানেই রাঙাদির সঙ্গে লুকোচুরি খেলার মজা!’
মা মন দিনে কথাটা শোনেননি, আয়নায় মাথার চুলগুলো ঠিক করছিলেন।
রুবি আবার বলে‚ ‘বাবা যদি জঙ্গলটা সাফ করিয়ে দেন তাহলে রাঙাদি বেচারি কি করবে? কোনও থাকবার,খেলা করবার জায়গা নেই ওর, চারুমাসির যখন হাতটা কেটে গেল রাঙাদির কী হাসি!’
রুবির মার কানে এবারও কথাটা পৌছায় না। তিনি দাঁত দিয়ে কয়েকটা কাটা ধরে আছেন, কথা বলার উপায়ও নেই।
রুবি আবার বলছে‚ ‘জানো মা, রাঙাদি এমন মজার মজার সব খেলা জানে, আর নাচতে পারে, কি বলব। জানো মা, ওই যে মনসা আর ক্যাকটাস গাছের কাছে বাবা ছোট্ট একটা ফোয়ারা বানিয়ে দিয়েছে, একদিন সেই জলের দিকে তাকিয়ে দেখি, দু’টো মুখ, যেন দু’টো আমি, বল তো কি? রাঙাদি। তারপর চারুমাসি আসতেই রাঙাদি কোথায় চলে গেল, আমি একা একা বসে পাতার নৌকা জলে ভাসাতে লাগলুম।’
বার বার রাঙাদির কথাটা কানে যেতে রুবির মা চুলের কাটাগুলি মুখ থেকে নামিয়ে বলে উঠলেন‚ ‘কে তোমার রাঙাদি, খালি রাঙাদি রাঙাদি করছ?’
‘বারে, এতক্ষণ তো বললাম তোমাকে। রাঙাদি পুতুল। লাল টুকটুকে একটা বড়ো পুতুল, আমার চেয়েও বড়ো। প্রকাণ্ড পুতুল। কথা বলতে পারে না, আর ডলপুতুলের মতো শুয়ে পড়লে চোখটা বুজে যায় না।’
‘আমি তো জানি তোমার পুতুলের নাম তুলতুলি। রাঙাদি পুতুল আবার কবে হল?’
‘আরে তুলতুলিটাতো গেল বছর পুজোর সময় রন্টুমামা দিয়েছিল, সে পুতুলটাতো ছোটো জাপানি পুতুল। তুলতুলিকে শুইয়ে দিলে ওর চোখ বন্ধ হয়ে যায়। জানো মা, ওর পেটটা টিপলে কেমন গানের সুর শোনা যায়, খোকা ঘুমানোর মতো তুলতুলি‚ আমার খেলাঘরের পুতুল। রাঙাদি তা নয়, ও বাইরের পুতুল। বাইরে থাকে, বাইরে খেলে,এমন সুন্দর টুকটুকে দেখতে মা‚ আমি না ওকে পুজোর সময় আমাদের বাড়ি আসতে বলেছি…।
‘রুবির মা ভাবলেন, তাহলে টুকটুকে রাঙাদি একটা মনগড়া পুতুল, পুজোর সময় চাই। তাই এখন থেকে তার জোগাড় করছে রুবি। এইবার ওকে একটা কোথাও ভর্তি করে দিতে হবে, সামনের পৌষে ও পাঁচে পড়বে। আর নয়। খালি পুতুল। মেয়েটা কেমন অদ্ভুত হয়ে উঠছে।
আশ্চর্য খেয়ালি, আপনমনে বকবক করবে, যেন কার সঙ্গে কথা বলছে,আবার ডাকো, চুপচাপ। হাজার ডাকলেও সাড়া দেয় না। এদিক থেকে অনেকটা মার মতো, মুখখানা আর গায়ের রঙটা কিন্তু একেবারে বাবার মতো, পিতৃমুখী মেয়েরা নাকি সুখী হয়।
এই সব ভাবতে ভাবতে রুবির মা চিঠি লিখতে বসলেন। এখন থেকেই রুবির জন্য একটা ভালো জাতের স্কুল খোঁজা দরকার।
বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। আশ্বিন মাস পড়ে গেছে, পুজোর আর পনেরো–ষোল দিন বাকি। বৃষ্টি থামার নাম নেই। ফ্যাক্টরিতে একটা নতুন জার্মান মেশিন বসছে। রুবির বাবা সারাদিন পর বাড়ি ফিরে বেশ পরিশ্রান্ত।
রুবির মা বললেন‚ তুমি তাড়াতাড়ি হাত-পা ধুয়ে নাও আমি চা নিয়ে আসছি।
রুবির মা চা নিয়ে আসতে রুবির বাবা বলতে শুরু করলেন‚ ‘ওঃ আজ যা কাজের চাপ ছিল, বুঝলে কেউ কিছু নয়। নিজের হাতে সব কি করা সম্ভব? অথচ আজকাল যা অবস্থা কেউ কিছু করতে চায় না। আর জানেই বা কি‚ যে করবে!’
রুবির মা বললেন‚ ‘দেখো এবার পুজোর সময় মেন গেটের মুখটায় যে সব জঙ্গল আছে কাটতে হবে। তুমিও বলেছিলে ওসব আর রাখবে না।’
বাবা বললেন‚ ‘ওরে বাবা, ও যে একেবারে ভয়ানক হাঙ্গামা। মিলিটারিরা এ বাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেজকাকাবাবুর করে ফেলা উচিত ছিল। তিনি তখন হাত দিলেন না।‘
‘তিনি জ্ঞানী লোক ছিলেন, এদেশে তারপর আর বাস করতে আসেননি। অনেক বয়সও হয়েছিল। কিন্তু এই সম্পত্তিটা যারা পাবে তাদের মুখের পানে তাকানোর প্রয়োজন তো ছিল!’
‘তিনি হয়তো ভাবেননি, আমরা বোকার মতো এখানে এসে বাস করব।’ রুবির বাবা মত প্রকাশ করলেন।
রুবির বাবার মেজকাকি শেষবয়সে কাশীতে মারা যান, তারপর রুবিরা শিবনারায়ণপুরের এই বাড়িতে চলে এসেছে, কাছাকাছি একটা ফ্যাকটরি বসিয়েছেন রুবির বাবা, সেখানে দিনরাত কাজ হয়, কত রকমের লোহার জিনিস ঢালাই হয়। সেই কারণে এই পল্লী অঞ্চলে বাস করতে আসা।
রুবির মা বললেন‚ ‘তুমি অবশ্য একটা কাজ করতে পারো। তোমার ওই কৃত্রিম ঝরনাতলার কাছটায় যে কেয়াবন আছে ওটা পরিষ্কার করে দিতে পারো। আজ আমাদের চারুর সঙ্গে খুকি ওদিকে বেড়াতে গিয়েছিল, কাঁটায় কাপড় জড়িয়ে না কি যেন কিসে চারুর শাড়ি ছিড়ে গেছে, হাত-পা ছড়ে গেছে ।
‘তাহলে না হয় কালই উমাশংকরকে খবর দিই। লোকজন এনে চত্বরটা সাফ করে দিক। আচ্ছা এই ভর সন্ধ্যেবেলায় রুবি ওখানটায় কি করছিল, আমি ডাকতেই ছুটে পালাল।’
‘রুবি ওর ঘরেই তো ছিল!’ রুবির মা অবাক হলেন। ‘এই একটু আগেও আমার কাছে এসে চারুর পড়ে যাওয়ার গল্প বলছিল। ওকে তো এখন রোদ থাকতে ঘরে ফিরে আসতে বলি। সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা। জানো‚এবার ওকে স্কুলে ভরতি করা দরকার।’
‘আমিও তো তাই অবাক হয়ে গেলাম!’ রুবির বাবা মাথা নাড়লেন‚ ‘সঙ্গে যেন আরও একটা মেয়ে, আমার হাঁক-ডাকে সেটাও পালাল।’
‘হয়তো তোমার কারখানার কোনো লোকের মেয়েটেয়ে হবে।’
‘তাই হবে বোধ হয়। আশ্চর্য, এ কথাটা আমার মনে হয়নি একবারও!’
চায়ের কাপটা শেষ করে রুবির বাবা বললেন‚ ‘জায়গাটা সাফ-সুতরো করে বাস করার যোগ্য করতে অনেক খরচ পড়বে। তারপর রুবিটা রুগ্ন, ওর যদি একটা ভাই থাকত…।’
‘তাহলে অন্তত ওর একটা খেলার সঙ্গী হত। কেউতো নেই, কোথায় যায়…।’
‘থাক, যাই হোক, মেয়েটার শরীর একটু ভালো হয়ে সারলে হয়। যা রোগা হচ্ছে দিন দিন।’
রুবির বাবা যা কখনও করেন না, তাই করলেন। কথা শেষ করে আস্তে রুবির ঘরে ঢুকলেন তিনি। চারু তখন রুবিকে রামের বনবাসের গল্প শোনাচ্ছিল। রুবির বাবা বললেন‚ ‘কি গো চারু? তোমার নাকি কেয়াবনে পড়ে গিয়ে হাতপা ছড়ে গেছে। কাপড় ছিঁড়েছে?’
‘না দাদাবাবু।’ ত্রস্তে মাথা নাড়ল চারু‚ ‘ওমনি কেমন মাথাটা ঘুরে গেল। তারপর মনে হল কে যেন ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিল।’
তার মুখে-চোখে একটা আতঙ্কের ভাব লক্ষ্য করলেন রুবির বাবা। বললেন‚ ‘কালই আমি সব ঝোপঝাড় কাটাবার ব্যবস্থা করছি। তাহলে ওখান দিয়ে চলাফেরার অনেক সুবিধা হবে।’
চারু বলল‚ ‘সেই বেশ ভালো হবে। ওই যে ঝরনা না কি আছে ওখানেই রুবি দিদিমণি দিনরাত ছুটে ছুটে যাবে, ওর ওই জায়গাটাই বেশি পছন্দ।’
রুবি কান পেতে শুনছিল। মনে মনে বলল‚ রাঙাদির কিন্তু এসব ভালো লাগে না। সে মোটেই পছন্দ করবে না,কি দরকার বাপু, ওসব সাফ করার। কিন্তু এদের কাছে রাঙাদির কথা বলা বৃথা। তাই মাথা ঝাঁকিয়ে শুধু বলে‚ ‘তাহলে কিন্তু বিচ্ছিরি হবে, ভারী খারাপ দেখাবে।
পরদিন উমাশংকর দল নিয়ে কাজ করল। দুপুর পর্যন্ত কাজ করেও আর কাজ এগোয় না। একটা জায়গায় বিশ্রী সব কঙ্কাল, কিছু পাখির পালক ছড়িয়ে পড়ে আছে। তাই নিয়ে কাজের লোকেদের ফিসফাস। নানা কথা। উমাশংকরের বয়স হয়েছে। সে অনেকদিন এই অঞ্চলে আছে। বলল‚ ‘এসব জন্তু-জানোয়ারের কাজ নয় বাপু। অন্য কিছু। এসব ডাকাত-টাকাতও হতে পারে।’
বিকালের দিকে চারু গিয়েছিল রুবিকে নিয়ে কতখানি জঙ্গল পরিষ্কার হল দেখতে। উমাশংকর উৎসাহভরে বলে‚ ‘কাজ তো আরও হত, ওই হাড়গোড় বেরিয়ে পড়ে ঢিলে পড়ে গেল। রুবি দিদিমণি যেমনি তুমি এলে আমার পা খানা কাটা গেল।’
রুবি বিস্মিত তার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
যাই হোক, যে জন্তুটা এই সব হাড়গোড়ের জন্য দায়ী, সে নিশাচর। কারণ পরদিন সকালে দুটো রাজহাঁস মরে পড়ে আছে দেখা গেল। মাটিতে বরফের মতো সাদা পাখনাগুলো ছড়ানো। উমাশংকরের দলের একজন মিহিলাল বলে‚‘ওটা জন্তুটন্তু নয় মোটেই, মানুষ। কেন না হাঁস দু’টোর মুণ্ডুগুলো কামড়ে ছেঁড়া নয়। টেনে ছেঁড়া হয়েছে।’
কে একজন জঙ্গলের ভেতর থেকে ছোটো মেয়ের এক গাছা কলঙ্ক ধরা পেতলের বালা নিয়ে এল।
পথটা পরিষ্কার হয়ে গেল। রুবি এখানে বেড়াতে এসে ঝরনার কাছটিতে অনেকক্ষণ বসে রইল, তারপর চারু একটু অন্যমনস্ক হতেই কাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে‚ ‘তুমি দুষ্টু, পাজি, তুমি একটা পশু। আমি আর তোমার সঙ্গে খেলব না, পুজোর সময় জামা–টামা কিছুই দেব না।’
এই বলে রুবি জিভ দেখায়।
চারু এমন সময় এসে পড়ে সেই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে বলে‚ ‘কি দিদিমণি! ওকি করছ! তোমার শরীরটা ভালো তো? রাঙাদি রাঙাদি করে কি বলছিলে?’
‘রাঙাদির নাম মুখে আনতে নেই। কাউকে বলো না যেন চারুমাসি।’ রুবি ঠোঁটের উপর আঙুল রাখে।
সেই দিন রাতে রুবির মা আর বাবা যাবেন জমিদারবাবুদের বাড়ি ছেলের অন্নপ্রাশনে। রুবি রাজি হল না যেতে। তার শরীর ভাল নেই। বাড়িতে চারুমাসির কাছে থাকবে। রুবির মাকে আজ ভারী ভালো লাগছিল। মায়ের দিকে তাকিয়ে রুবি বলে উঠল‚ ‘মা, তোমাকে রানির মতো দেখতে।’
মা খুশি হয়ে বললেন‚ ‘লক্ষ্মী হয়ে থাকবে। পুজোর সময় তোমাকে ঠিক একটা রাঙাদি পুতুল কিনে দেব।’
‘না মা, রাঙাদি নয়?’
‘কি আশ্চর্য! এই তো কদিন আগে রাঙাদি, রাঙাদি করছিলি!’ রুবির মা কিছু অবাক হলেন।
রুবি শুকনো গলায় বলে, ‘না ওর সঙ্গে আমার আড়ি হয়ে গেছে।’
অনেক রাত হল ওঁদের নিমন্ত্রণ বাড়ি থেকে ফিরতে। গাড়িটা বাগানের মধ্যে ঢুকিয়ে খানিকটা যেতেই হেড লাইটের আলোয় দেখা গেল সাদা ফ্রক পরা দুটো মেয়ে যেন দৌড়ে পালাল।
আতঙ্কে শিউরে উঠলেন রুবির বাবা। কী আশ্চর্য! রুবি কী এই রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে নাকি!
তাড়াতাড়ি গাড়িটা বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে, রুবির বিছানায় গিয়ে দেখেন, বিছানায় রুবি নেই, ঘরদোর তোলপাড়। কী কাণ্ড! পুতুলগুলো সব ভাঙাচোরা মুণ্ডহীন হয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে।
রুবির মা বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুবি রুবি করে গলা ফাটাচ্ছেন। বুড়ি ঝি চারু ছুটছে এঘর থেকে ওঘর।
রুবির বাবা দৌড়লেন সেই কেয়াবনের পাশে, ঝরনার ধারে‚ যেখানে ফ্রক পরা দুটি মেয়েকে মিলিয়ে যেতে দেখেছেন।
টর্চের আলোয় শেষ পর্যন্ত রুবির সন্ধান মিলেছিল। দেহ থেকে মাথাটা টেনে কে খসিয়ে নিয়েছে। আর রাজ হাঁসের ঝরা পালকের মতো তার ফ্রকের টুকরোগুলো চারপাশে ছড়ানো।
চারু ঝি কখন এসে দাঁড়িয়েছিল পাশে, রুবির বাবা লক্ষ্য করেননি, কঁদতে কাঁদতে সে খালি বলতে থাকে‚‘শয়তান রাঙাদির কাণ্ড! এ সব সেই রাঙাদির শয়তানি।’
(সমাপ্ত)