সত্যি ভূতের গপ্পো

সত্যি ভূতের গপ্পো

দেশের বাড়ি কাজলদীঘিতে যাচ্ছি আমার এক আত্মীয়ের বিবাহ অনুষ্ঠানে।

যাওয়ার আগে বার বার করে আমার সেই আত্মীয়দের বলেছি, একজন যেনো লোক কিংবা একটা ট্রলি যেনো চকে থাকে। কেনোনা আমার দেশের বাড়ি যাওয়ার সবচেয়ে দুর্গম রাস্তা হচ্ছে এই শেষের দশ কিলোমিটার। ট্রলি ছাড়া যাওয়ার একমাত্র বাহন এগারো নম্বর গাড়ি। মানে পায়দল।

অফিসের কাজ শেষ করে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় রওনা হলাম। ছ’টা দশের মেদনিপুর লোকাল।

হাওড়া স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন ছ’টা বাজে। টিকিট কেটে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছাড়লো দশমিনিট লেটে, ছটা কুড়িতে। ঝাল মুড়ি চা, সহযাত্রীদের সঙ্গে তাস খেলতে খেলতে আমার গন্তব্য স্টেশনে এসে নামলাম রাত সাড়ে নটা।

এখান থেকে বাসে পাক্কা এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিটের রাস্তা। তারপর চকে পৌঁছবো।

লাস্ট বাস।

স্ট্যান্ডে এসে দেখলাম। বাস আছে, কন্ডাক্টর ড্রাইভার নেই। যাত্রী বলতে গোটা পনেরো জন।

সারাদিনে মাত্র চারটে বাস যায় আমাদের ওপাশে।

খোঁজ নিয়ে জানলাম, আমি আপ ট্রেনে এসেছি। ডাউন ট্রেন এলে তার প্যাসেঞ্জার নিয়ে তবে বাস ছাড়বে।

অগত্যা মুড়ি ঠান্ডা আলুর চপ সহযোগে উষ্ণগরম চা খেয়ে পেটের খিদে মেটালাম।

ডাউন ট্রেন এলো দশমিনিট লেটে। গাড়ির ড্রাইভার কন্ট্রাক্টর এলেন। অতবড়ো বাসে সাকুল্যে আমরা গোটা পঁচিশ যাত্রী।

বাস ছাড়লো দশটা পনেরো নাগাদ।

এতোক্ষণ বেশ ভালো ছিলাম হঠাৎ কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিলো। বাসের কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞাসা করলাম ব্যাপারাটা কি।

যা গরম পরেছে কয়েকটা দিন, মনে হচ্ছে কোথাও বৃষ্টি পরছে। তাই ঠান্ডা হাওয়া ছেড়েছে।

সব্বনাশ। আমার বুকে কাঁপন দিলো। দশ কিলোমিটার রাস্তা আমাকে পার হতে হবে। যদিও চিন্তার কোন কারণ নেই চকে লোক থাকবে।

মাঝে মাঝে বাস থামছে লোক নামছে। ওঠার কোন প্যাসেঞ্জার নেই। এতো রাতে কে উঠবে। যারা আছে তার সবাই ট্রেণ থেকে নেমে বাড়ি যাচ্ছে। আমি ঘরির দিকে তাকাই।

ঠিক এগারোটা চল্লিশ নাগাদ চকে এসে বাস থামলো। দেখলাম তখন আমরা বাসে মাত্র সাতজন যাত্রী।

আমিই একমাত্র চকে নামলাম। আর কেউ নামলো না।

আমাকে নামিয়ে দিয়ে বাস হুস করে বেরিয়ে গেলো।

চোখে অন্ধকার দেখছি।

চারদিক ঘুট ঘুটে অন্ধকার। একবারে শুনসান। ধারে কাছে কেউ নেই। একটু আলোর চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না।

বাসের পেছনের লাল লাইটটা ক্রমশঃ অন্ধকারে মুখ ঢাকা দিলো।

স্থানুর মতো কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এতোবার বলা সত্বেও কেউ এলো না।

মোবাইলটা পকেট থেকে বারকরলাম। হায় কপাল একটা টাওয়ারও নেই।

আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশটা কেমন লাল। এতো অন্ধকার হাত পনেরো দুরের রাস্তাটুকু খালি দেখতে পাচ্ছি তারপর ঘুটঘুটে অন্ধকার সব কিছু গ্রাস করে নিয়েছে। জোনাকীর ইতি উতি আলোটুকু পর্যন্ত নেই। একমাত্র ঝিঁঝিঁ পোকার তারস্বর চিৎকার ছাড়া। ভীষণ বিরক্ত লাগলো। ভাবলাম একবার পরিদার বাড়িতে গিয়ে শুয়ে পরি।

কি ভাববে। তাছাড়া এতোরাতে গ্রামের ঘরে কেউ জেগে থাকে না।

বুঝলাম আজ কপালে আমার অশেষ দুর্গতি। যদি এখান থেকে শেষ বাস থাকতো এখুনি কলকাতায় ফিরে যেতাম।

খুব তাড়াতাড়ি হাঁটলেও আমার আড়াইঘন্টা লাগবে এই রাস্তা টুকু পার হতে। যতই আমি গ্রামের ছেলে হই। আজ প্রায় দশ বছর গ্রামের বাইরে। বছরে একবার অকেশনালি আসি।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করলাম। পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরালাম।

পকেটে টর্চ নেই তবে ছাতাটা আছে।

মা বার বার বলতেন, শীতের কাঁথা আর বর্ষার ছাতা সবসময় সঙ্গে রাখবি। দেখবি পথে ঘাটে কখনো অসুবিধে হবে না।

আলো বলতে, লাইটারের পেছনে ছোট্ট লাইট, আর মোবাইলের টর্চ।

গ্রামের ভাষায় লাইটারের পেছনের ছোট্ট লাইটটাকে বলে ফুটোর ডুম।

ভেবে কোন লাভ নেই। হাঁটতে যখন হবেই এখানে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। জামা প্যান্ট খুলে ব্যাগে ভরলাম পরনে খালি গেঞ্জি জাঙ্গিয়া। হাতে লাইটার আর ছাতা। শুরু করলাম হাঁটা। সামনে এক দেড় কিলোমাটার হাঁটতে কোন অসুবিধে হবে না। জনবসতি আছে। কিন্তু সেই কাশিঘরের ডাঙা। পাঁচ কিলোমিটার ফাঁকা মাঠ জনবসতি শূন্য নিশুত পুরি। ভাবতেই বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেলো।

বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। সামান্য হাওয়া দিচ্ছে। বাঁশ গাছ গুলো নড়ছে। ক্যাঁচর ক্যাঁচর একটা আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে সব দেবতার নাম স্মরণ করতে আরম্ভ করলাম। আকাশের দিকে তাকালাম। মুখটা কেমন ভার ভার, বুঝলাম বাড়ি পৌঁছবার আগ ঝড় উঠতে পারে। জোড়ে জোড়ে কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করলাম, যতো বড়ই কবিতা আবৃত্তি করি কেমন ছোট ছোট লাগছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বে-সুরে গান গাইতে আরম্ভ করলাম। কোন গানই পুরো গাইতে পারি না। সব কেমন যেন ছোট ছোট হয়ে যাচ্ছে।

তিতিক্ষার শেষ। কাশিঘরের ডাঙায় এলাম। চায়ের দোকানটা বন্ধ দেখলাম। এই কানা রাতে কে খোলা রাখবে। গ্রামের ঘরে সাতটা মানে খেয়েদেয়ে ঘুমবার সময় হয়েগেছে। এখন রাত একটা দেড়টা হবে।

এখনো ছয় কিলোমিটার!

মাঠের শেষ প্রান্তে একটা হাল্কা রেখা দেখা যাচ্ছে। আলোর চিহ্নমাত্র নেই। ফুটোর ডুম জ্বালানর পর নেভাতেই চোখ কেমন যেন ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। দরকার নেই আলোর। অন্ধকারই ভালো। এই এতোবড়ো ফাঁকা মাঠে দু-তিনটে বট অশ্বত্থ গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। গলা ছেড়ে তারস্বরে গাণ ধরলাম। নিজের গান নিজেই শুনি। আর মাঝে মাঝে শব্দের অনুরণণ কানে এসে বাজে।

কিছুটা যাওয়ার পরই দেখলাম হাওয়ার গতিবেগ বাড়লো। একটা সাঁই সাঁই আওয়াজ। সঙ্গে বিদ্যুতের ঝিলিক। মেঘর কড় কড় সেই বিভত্স গর্জন। বুকে কাঁপন ধরালো।

হায় ঠাকুর এ কি করলে, এতো জীবন হাতে নিয়ে যাওয়া। দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি গায়ে লাগলো। ছাতাটা শক্ত করে ধরলাম।

তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম, ভূত আমার পূত/পেত্নী আমার ঝি/রাম লক্ষ্ণণ সাথে আছে/করবি আমার কি।

কে কার কথা শোনে। বুকের কাঁপন বেরে গেলো। একটা দমকা হাওয়ায় ধানক্ষেতে আছাড় খেয়ে পরলাম।

তাড়াতাড়ি ফুটোর ডুম জ্বালিয়ে দেখলাম ঠিক আছি কিনা। না বহাল তবিয়েতেই আছি। গা-হাত-পা ঝেড়ে ঝুড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির বেগটা বাড়ল। কেউ যেনো আমাকে ঢিল ছুঁড়ে মারছে। ছাতা খুললাম। হাওয়ার চোটে দু’তিনবার ছাতা উল্টে গেলো, তাকে সোজা করতে বেশ সময় লাগলো। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। কেনো মরতে এই কানা রাতে এলাম। তার থেকে কাল সকালের ট্রেনে এলেই ভালো হতো।

বৃষ্টির বেগ আরো বেড়ে গেলো। জুতো খুলে ব্যাগে ভরে ছুটতে শুরু করলাম। প্রাণ পণে ছুটছি। সামনে একটা বটগাছ দেখতে পাচ্ছি।

মাইক পাওয়েল তুমি কি ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করেছো, এই মুহূর্তে তুমি আমার সঙ্গে দৌড়লে হলফ করে বলতে পারি, তুমি নিশ্চই আমার পেছনে থাকতে।

ভিঁজে চান করে গেছি।

বটগাছের তলায় এসে কুত্তার মতো এক হাত জিভ বার করে হাঁপাতে আরম্ভ করলাম। বিড়ি খাওয়া দম এতোটা দৌড়তে পেরেছে বাবার ভাগ্য ভালো।।

বটগাছের তলায় একটা মোটা সোঁটা শেকড়ে পেছনটা ঠেকিয়ে একটু বসলাম।

অঝোড়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। সামনে ধোঁয়ার মতো ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। তেমনি হাওয়া সঙ্গে বিদ্যুতের চমক আর মেঘের গর্জন।

মাথার ওপর টপ টপ করে জল পরতে শুরু করলো, বুঝলাম গাছের পাতা বেয়ে জল পরছে। ছাতা খুলে গুঁড়ি শুঁড়ি মেরে বসলাম। শীত শীত করছে। সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটের কথা মনে পরে গেলো।

সব্বনাশ এতোক্ষণ মনে ছিলো না। ভিঁজে গেলে মাথায় এই সময় বাজ পরবে। কোনপ্রকারে আস্তে আস্তে ব্যাগটা খুলে জামাপ্যান্টের ফাঁক দিয়ে সিগারেটের প্যাকেটে হাত রাখলাম না ভেঁজে নি। এখনো অক্ষত আছে। এটাই এখন আমার যক্ষের ধন। কোন প্রকারে একটা বার করে ধরালাম। গায়ে জল পরছে না। তবে হাওয়ায় কাঁপন ধরাচ্ছে শরীরে। সিগারেটে সুখ টান দিয়ে নিজেকে একটু তাজা তাজা লাগছে।

মেঘের এফোঁড় এফোঁড় করে বিভৎস একটা বিদ্যুৎ চমকালো সঙ্গে সঙ্গে বুক হিম করা মেঘের গর্জন।

কিছুটা দূরে সামনের ঝোপটায় চোখ গেলো। স্পষ্ট দেখতে পেলাম। একজন ভদ্রমহিলা ঘোমটা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে।

আমি যেখানে বসে আছি। সেখান থেকে ওই ঝোপটার দূরত্ব খুব বেশি হলে তিনশো মিটার।

এতো রাতে ভদ্রমহিলা!

আমি খুব ভালো করে জানি। খুব কম করে তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোন বসতি নেই। মাঠের পর মাঠ খালি ধান ক্ষেত।

বুকের ভেতরটা মৃদু কম্পন অনুভব করলাম। চোখ বন্ধ করে যতো ধর্মের যতো দেবতা আছেন তাদের ডাকতে শুরু করলাম।

গলা টিপে যদি আমাকে এই কানা রাতে মেরেও দেয়, কাল সকালের আগে কেউ টের পাবে না।

বিদ্যুৎ চমকেই চলেছে আর আমার চোখ ইচ্ছে না করলেও বার বার ওদিকে চলে যাচ্ছে। হ্যাঁ বিদ্যুতের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ভদ্রমহিলা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।

কতোক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। মেঘের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল। সময় পেলি না বাবা, বাড়ি পৌঁছবার পর যতখুশি হতে পারতিস, কে বারণ করতে যেতো।

শুনেছি কাছে লোহা থাকলে ভূতে ধরে না। লোহা নাকি ভূতের যম। আমার ছাতার ডান্ডিটাতো লোহার।

ধ্যুস লোহা তোকে কে বললো, ওটা তো স্টেইনলেস স্টিলের।

তাতে কি হয়েছে। স্টেইনলেসস্টিল কি সোনা দিয়ে তৈরি হয়। ওর মধ্যে লোহা আছে।

পাগল, পিওর লোহা যদি হয় তবে। ভেজাল লোহাতে ভূতকে আটকানো যাবে না।

মহা মুস্কিল।

বার বার চোখ চলে যাচ্ছে। হ্যাঁ ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন।

একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে পারতিস বাবা। একবারে আমার পথের ওপর তোকে দাঁড়াতে হবে। ওই পথ দিয়েই আমাকে যেতে হবে। একেবারে ওর ঘাড়ের ওপর দিয়েই।

ভীষণ রাগ হচ্ছে চিকনাটার ওপর তুই অন্ততঃ আসতে পারতিস। আর কেউ আসুক না আসুক। নীপার বিয়েতে না আসলেই ভালো হতো। কেনো যে মরতে এলাম। লোভ। নেমন্তন্ন খাওয়ার নোলা। কলকাতায় মেসে থাকি। ভালো মন্দ খাওয়া জোটে না। এখানে এলে তবু বাড়ির ভাত একটু অন্যস্বাদের তরকারি পাবো। লোভী কোথাকার। গা জ্বলে যায়। নিজের ওপর নিজের ভীষণ রাগ হচ্ছে।

বৃষ্টিটা মনে হচ্ছে একটু ধরেছে। বিদ্যুৎ সমানে চমকে যাচ্ছে। আর চোখ চলে যাচ্ছে ওই ঝোপটার দিকে।

বহুত বাজে মেয়েতো। আমি কি তোর প্রেমিক। যা না বাবা অনেক ছেলে আছে কেনো আমার পেছনে পরলি। এখনো জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ কিছু উপভোগ করতে পারলাম না।

আচ্ছা ছাতাটা যদি আড়াল করে ওই পথটুকু পেরিয়ে যাই কেমন হয় ?

গলা টিপে ধরবে।

ফালতু কথা একবারে বলবি না।

ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা সিগারেট বার করে ধরালাম।

বৃষ্টি পরছে কিন্তু আগের সেই মোসানটা আর নেই। চারিদিকে ব্যাঙের গ্যাঙর গ্যাঙর ডাক কানে তলা ধরিয়ে দেয়। একটা ঝড় ঝড় আওয়াজ হতেই চমকে উঠে দাঁড়ালাম। এই অন্ধকারেও চোখে যেনো কে হাজার পাওয়ারের বাল্ব জেলে দিয়েছে। বড়ো বড়ো চেখ করে দেখলাম এই-আ মোটা বিশাল লম্বা একটা কালো সাপ বটগাছের মাথা থেকে আছাড় খেয়ে পরে তীর বেগে বর্ষায় ভেঁজা খেতের দিকে চলে গেলো। এক নিমেষে বুকের লাবডুব শব্দটা যেনো হাজার গুণ বেরে গেলো। হাত পা কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। মনে হচ্ছে যেনো অজ্ঞান হয়ে পরে যাবো।

চিৎকার করে নিজেকে নিজে চূড়ান্ত গালাগাল দিলাম।

যা থাকে কপালে এসপার নয় ওসপার। মড়ার থেকে পৃথিবীতে চরমতম সত্য আর কিছু নেই। কি হবে মরে যাবো এই তো, যা থাকে কপালে। ছাতাটাকে আড়াল করে সামনের দিকে গট গট করে হাঁটতে আরম্ভ করলাম।

কানের কাছে নাকি শুরে ভেসে আসছে, তুই কার ঘরের ছেলে রে এতো রাতে এই পথে যাচ্ছিস।

গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে গেলো। সারাটা শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করলাম।

হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে, মিন মিনে গলায় বললাম, তুমি কে, আমার পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছো। সরে যাও।

নিজের গলা নিজেই স্পষ্ট শুনতে পেলাম না।

কোন শব্দ নেই, বাতাসের সাঁই সাঁই আওয়াজ। বৃষ্টির ঝম ঝম। সারাটা শরীরে রক্ত বুকে এসে জড়ো হয়েছে। যেনো সমুদ্রের পাগলপানা ঢেউয়ের মতো ছলাৎ ছলাৎ করে পাড়ে এসে আছড়ে পরছে।

ডিসিসন নিলাম আর নয়, চোখ বন্ধ করে ছাতাটাকে লাঠির মতো ধরলাম। খ্যাপা সাঁড়ের মতো সিং বাগিয়ে ছুটে এসে সজোরে ছাতাটা দিয়ে আঘাত করলাম। ছ্যাত করে একটা আওয়াজ হলো। পা পিছলে ছিটকে পরলাম তিনচার হাত দূরে। বাবাগো মাগো করে উঠলাম। মরার মতো পরে থাকলাম। বুকটা কামার শালের হাপরের মতো ওঠানামা করছে। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো এখন বেশ আরাম বোধ হচ্ছে। শরীরে উঠে দাঁড়াবার শক্তিটুকু নেই। হাত-পা সব অবশ। আকাশের বুক চিড়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো, চোখ মেলে তাকালাম। সামনে একটা কলাগাছের পাতা ছিঁড়ে পর্দাফাই। মেঘটা রাগে গর্জন করে উঠে আমাকে যেনো সেলাম করে উঠলো।

আমি উঠে বসলাম নিজের মনে নিজে হেসে উঠলাম। সারাটা শরীর কাদায় মাখামাখি। হাতের ব্যাগটা দূরে কোথাও ছিটকে পরেছে। ছাতাটা তখনো কলাগাছের সঙ্গে ঝুলছে। হাওয়ায় বেগে সেটা দুলছে।

আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। ব্যাগটাকে খুঁজে পালাম। হামাগুড়ি দিয়ে ব্যাগটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ভিঁজে চপচপে হয়ে গেছে। কোনপ্রকারে উঠে দাঁড়িয়ে কলাগাছের পাতায় ঝুলে থাকা ছাতাটাকে টেনে নামালাম।

নিজেকে এখন বীর পুঙ্গব মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে পুরুষ সিংহ।

বাড়ির পথে হাঁটা আরম্ভ করলাম। ছাতাটা আর খুললাম না। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল গায়ে মাখতে এই মুহূর্তে ভীষণ ভালো লাগছে।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত