নিশি ভৌমিকের বাড়ি

নিশি ভৌমিকের বাড়ি

হাতের কাজ শেষ করে যখন চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়েছে ঠিক সে সময় আমার পিয়ন নয়ন এসে বলল,” স্যার, জামাল সাহেব এসেছে । ঘড়িতে তখন বাজে প্রায় সাড়ে ৫টা ।” এ সময় কাউকে নিয়ে বসার কথা নয় । অফিস ছুটি হয়ে গেছে সেই ৫টার সময় । অনেকেই ইতিমধ্যে চলে গেছে । আমিও চলে যেতাম কিন্তু হাতের কাজটুকু শেষ না করে উঠতে পারছিলাম না, তাই দেরি হয়ে গেছে । শীতকাল । এমনিতেই তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে যায় । এ সময় জামাল মিয়াকে নিয়ে বসার কোন মানে হয় না ।

আমি একবার হাত ঘড়ি দেখে নয়ন এর দিকে তাকিয়ে বললাম, ” এ সময় জামাল মিয়া আবার কি মনে করে ? যাও কাল আসতে বল ।”

-স্যার কাল তো শুক্রবার ।
-ও আচ্ছা, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে, কাল শুক্রবার । ঠিক আছে জামাল মিয়াকে আসতে বল ।
জামাল মিয়া আমাদের অফিসে একজন সাপলাইয়ার হিসাবে কাজ করেন । স্থানীয় বাজার থেকে কাগজ,কলম,লোহা,লক্কড় এটা সেটা কিনে অফিসে সাফলাই দেয়াই তার মূলকাজ । মোটাসোটা লোকটার মাঝে সততার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না । তার উপড়ে প্রচুর মিথ্যা কথা বলে । সারাক্ষণ মুখ পানের পিকে লাল হয়ে থাকে । সেই সঙ্গে আছে জর্দার কড়া গন্ধ । কিন্তু তবুও জামাল মিয়া খুব কাজের লোক । আমার বিশ্বাস জামাল মিয়াকে যদি বাঘের চোখ যোগার করে আনতে বলা হয় তাহলে সে সেটাও যোগার করে এনে দিতে পারবে ।
কিন্তু জামাল মিয়ার এখন আমার কাছে আসার কারণটা বুঝতে পারলাম না । যতোটুকু মনে পরে গত সপ্তাহে ওর বিল টিল যা ছিল পরিশোধ করা হয়েছে । অফিসে নতুন কিছু লাগবে বলেও তো শুনিনি । তা হলে, এসময় ব্যাটা এলো কি মনে করে? নিশ্চয় কোন ধান্ধা আছে । আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলাম । যাক আগামী কাল যেহেতু বন্ধ আছে তাহলে আরো কিছু সময় না হয় বসা যাক । এমনিতেও বাসায় গিয়ে এক বই পড়া ছাড়া কোন কিছু করার নেই । মফস্বল শহরে আছি আজ প্রায় বছর খানেক হল । একা থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে ।

– সেলাম স্যার । জামাল মিয়া দরজায় দাঁড়িয়ে বিরাট করে হেসে সালাম দিল ।
– ওলাইকুমআসসালাম । তা জামাল মিয়া এ অসময়ে কি মনে করে ?
– স্যার আপনাকে নিতে এলাম ।
– আমাকে নিতে ? কোথায় ? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ।
– ঐ যে স্যার গত সপ্তাহে বললেন না যে ভৌকিম বাড়ী যাবেন !
– ভৌমিক বাড়িটা আবার কোথায় ? কি আবোল তাবোল বলছ জামাল !

– স্যার বুঝি ভুলে গেছেন , গত সপ্তাহে না বললেন ভুত দেখতে যাবেন । জামাল চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল । আমার হঠাৎ মনে পরে গেল গত সপ্তায় বিলে আমার সই নেবার সময় কি এক প্রসঙ্গে জামাল মিয়া ভৌমিক বাড়ির কথা তুলে বলে ছিল ও বাড়িতে নাকি ভুত আছে । আমি তখন হেসে বলেছিলাম ভুত থাকলে একদিন আমায় এসে নিয়ে যেও সুখ,দু:খের কথা বলে আসবো । অনেক দিন ভুত দেখার সাধ বুকের ভেতর লালন করে আছি । আমার কথায় জামাল মিয়া কিঞ্চিত ব্যথিত হলেও মাথা নেড়ে বলেছিল, ঠিক আছে স্যার আগামী সপ্তাহে এসে নিয়ে যাবনে । কিন্তু সেটা তো ছিল কথার কথা।

– কি স্যার ভয় পেয়েছেন নাকি ? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে জামাল মিয়া হেসে প্রশ্ন করলো ।
– না, ভয় পাবো কেন ? তুমি কি সত্যিই যাবে জামাল ?
– জ্বি স্যার , এই জামাল যে মিথ্যা বলে না সেটা ভুতের সঙ্গে গিয়ে বাৎচিত করলেই বুঝতে পারবেন ।
– তোমার ভুত কথাও বলে নাকি ? আমি হেসে প্রশ্ন করলাম ।
– জি স্যার বলে, কাউকে পছন্দ হইলে তার সঙ্গে কথা বার্তা কয় শুনেছি । আর পছন্দ না হইলে চড় থাপ্পড় দিয়া বেড় কইরা দেয়।
– কি সব আবোল তাবোল বলছ । আমি জামালের কথায় নড়েচড়ে বসলাম ।
– আবোল-তাবোল না স্যার চলেন নিজে চোখে দেখবেন । মিথ্যা বললে, আপনার জুতা আমার গাল ।
আমি মনে মনে ঠিক করে ফেললাম জামাল মিয়ার সঙ্গে গেলে মন্দ হয় না । যেহেতু আগামী কাল শুক্রবার আছে , তাই যেয়ে দেখা যাক না, ব্যাটা আসলে কি দেখাতে চাচ্ছে ।

– তা, কোথায় যেন যেতে হবে জামাল ।
– আপনি সত্যিই যাবেন স্যার ? জামালের চোখ দুটো যেন চকচক করে উঠলো ।
– অবশ্যই যাবো । এখান থেকে কতো দূর তা বল তো !
– দূর আছে স্যার , তা এখন রওনা দিয়ে ১১টা ১২ নাগাত পৌঁছে যাবো ।
– বল কি তা হলে তো বেশ দূরের রাস্তা ? এতো রাতে গিয়ে কি কিছু দেখা যাবে ?
– ভুত দেখার জন্য তো গভীর রাতই আদর্শ স্যার । জামাল মিয়া ক্যামন খ্যাঁক খ্যাঁক হেসে বলল ।
– তোমায় দেখে তো মনে হচ্ছে খুব মজা পাচ্ছে জামাল ?
– পাচ্ছিই তো স্যার । আপনার ধারণা জামাল সারাক্ষণ মিথ্যা কথা বলে বেড়ায় । এখন ভৌমিক বাড়ি গিয়ে যখন ভুতের কবলে পরে হাউমাউ করে কাঁদবেন তখন তো আমি আপনাকে উদ্ধার করবো স্যার ।
– ঠিক আছে তবে চলো যাওয়া যাক ।
– শিতের কাপড় নিতে হবে স্যার । রাতে খুব ঠাণ্ডা পরে ।
– যাবার সময় বাসা থেকে নিয়ে যাবো ।
– ঠিক আছে স্যার । জামাল হেসে বলল ।
এমন সময় নয়ন এসে দরজার দাড়িয়ে বলল স্যার আমি ও যাবো আপনার সঙ্গে ।
– তুমি ও যেতে চাও ? আমি নয়নের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে, জামালের দিকে তাকিয়ে বললাম কি জামাল নয়ন গেলে কোন অসুবিধা হবে না তো ?
না স্যার অসুবিধা কি চলুক না । জামাল যেন অনিচ্ছা সত্ত্বে কথাটা বলল ।

-তা হলে যাও নয়ন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও । বেশি করে শীতের কাপড় পরে নাও । অনেকটা পথ যেতে হবে কিন্তু।
– জী স্যার,আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি ,বলেই নয়ন চট করে বেড় হয়ে গেল ।
– আমিও তাহলে একটু বাথরুম থেকে ঘুরে আসি কি বলেন স্যার ? জামাল খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলল ।
– যাও । বলে আমি ড্রয়ার থেকে মোবাইল আর মানিব্যাগ বের করে পকেটে নিলাম । কেমন জানি একটা অসুস্থি লাগছে । কে যেন বারংবার ভেতর থেকে যেতে নিষেধ করছে । ফুস করে নিশ্বাস ফেলে আমি বললাম- বনের বাঘে খায় না , মনের বাঘে খায় । ঠিক সেসময় লাল রংয়ের একটা সোয়েটার পরে নয়ন ঢুকল ।

– কি রেডি ? আমি ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ।
– জি স্যার , তয় একটা কথা ,
– কি কথা নয়ন ?
– স্যার জামাল মিয়ার সঙ্গে যাওনটা কি ঠিক হচ্ছে ?
– এর মধ্যে তুমি আবার বেঠিকের কি দেখল ?
– না স্যার , লোকটারে তেমন সুবিধার মনে হয় না ।
– ভয় নেই নয়ন , জামাল অনেক বছর যাবত আমাদের সঙ্গে কাজ করছে আমাদের ক্ষতি হবে এমন কাজ ও করবে না । আমি বলেছিলাম ভুত বলে কিছু নাই ও বলেছিল আছে । আর এখন তাই প্রমাণ করতে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে ।
– কোথায় নিয়ে যাচ্ছে স্যার ?
– কোন এক ভৌমিক বাড়ি ।
– নিশি ভৌমিকের বাড়ি স্যার ?
– হ্যাঁ , তাই তো বলল মনে হয় । তুমি চেন নাকি ?
– চিনি স্যার । ওখানে নিশি ভৌমিকের কোন বাড়ীটারই নাই । একটা ছাড়া মাঠ আর কয়েকটা ভঙ্গা দেয়ালের অংশ ছাড়া কিছুই নাই । লোকজন খুব একটা ওদিকে যায় টায় না ।
– বল কি কোন বাড়ি নেই ?
– না স্যার, আমি নিজের চোখে দেখেছি ।
– দেখার জন্য চোখের দরকার আছে নয়ন মিয়া । তোমার তা নাই । খেকখেকখেক । দরজার কাছ থেকে কথাটা বলে জামাল মিয়া হাসতে লাগল ।
– আমি নিজের চোক্ষে একবার দেইখা আইছি ঐখানে কোন বাড়িটারই নাই ।
– আছে কি নাই তা তো গেলেই দেখন যাইব । কি কন স্যার ? জামাল আমার দিক সমর্থনের আশায় তাকাল ।
– তা ঠিকই বলেছ । আমি কেমন আমতা আমতা করে বললাম ।
– তয় চলেন বের হয়ে পরি ।
– চলো ।
– স্যার টর্চ নিয়ে নেই ? নয়ন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল ।
– টর্চ লাগবো কেন ? আমি কিছু বলার আগে জামাল যেন খেঁকিয়ে উঠে বলল ।
– নিয়ে নাও । গ্রামের রাস্তা ঘাট টর্চ হলে উপকারই হবে । চল চল তাড়াতাড়ি চল , তা না হলে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে।
আমি নয়ন কে তারা দিলাম ।

অফিস থেকে বের হয়ে প্রায় ঘণ্টা দু’য়ে-ক ভ্যান আর হাঁটার পর আমরা একটা নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম । সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ হল । হাত ঘড়ি দেখলাম পৌনে আটা বাজে । ঠান্ডা খুব একটা না লাগলেও হালকা কুয়াশা পরেছে। নদীটা প্রায় শুকিয়ে গেছে । হাত দশেক নদীর ভেতর হাঁটু পানিতে একজনকে মাছ ধরতে দেখলাম । লোকটাকে দেখে বেশ অবাক হলাম । এই শিতের রাতে কেউ এভাবে মাছ ধরে ? কথাটা নিজের মনে মনেই বললাম ।
– ধরে স্যার । ধরে । পেটে খিধা থাকলে মানুষ সব করে । রওনা হবার পর জামাল কথা বার্তা খুব একটা বলছে না । হঠাৎ ওর নিজ থেকে কথা বলে উঠায় আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম – আর কতো দূর ?
– এই তো এসে পরেছি স্যার নদীটা ওপারেই ভৌমিক বাড়ি ।
– নদী পারাবো কি করে কোন নৌকা ও তো দেখছি না ।

আছে স্যার আছে । নৌকা আছে । জামাল হাতে তালি দিয়ে বলল – এই কে আছো মাঝি ? ভৌমিক বাড়ি যামু। আছোনি কেউ ?

– স্যার চলেন ফেরত যাই , দিনের বেলায় একদিন আসবোনে । নয়ন আমার গা ঘেঁষে ফিসফিস করে কথাটা বলল ।
– কেন ভয় খাইছোনি ? নয়ন কে কথাটা বলেই খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে উঠল জামাল মিয়া । ওর এই হাসিটা আমার কাছে কেমন যেন অসহ্য মনে হল । আমি কিছু বলার আগেই দেখলাম – অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা ডিঙ্গি নৌকা এসে পাড়ে ভিড়ল।

– চলেন স্যার নৌকা এসে গেছে । বলেই জামাল প্রায় দৌড়ে নৌকায় গিয়ে উঠল । আমি ওর পেছন পেছন গেলাম । নয়ন যেন অনেকটা অনিচ্ছা স্বত্বে এসে নৌকায় দাঁড়াল । নৌকায় উঠার সময় মাছ ধরতে থাকা লোকটাকে কাছ থেকে দেখলাম । লোকটার শরীরে কোন কাপড় নেই । কোমরের নীচে ধূতির মতো কিছু একটা জড়িয়ে রেখেছে । কালো ছিপছিপে শরীরটা যেন মুচরে আছে । শুকনো দুটো হাত লোকটা পানিতে শব্দ করে করে ডুবিয়ে দিচ্ছে আর একটু পর পর তুলে আনছে মাছ । লোকটার মাছ ধরার দক্ষতা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না । মনে মনে ঠিক করলাম ফেরার সময় কিছু মাছ কিনে নিয়ে যাবো । ঠিক সেসময়ই যেন নাকে মাছের আঁশটে গন্ধ এসে লাগল । আমি নাক কুচকে এদিক সেদিক তাকালাম । জামাল যেন আমাকে দেখে বুঝতে পারল আমি কি খুঁজছি , ও আমাকে ইশারায় মাঝির সামনের অংশটা দেখিয়ে দিল । ওর ইশারা অনুযায়ী তাকিয়ে দেখলাম মাঝি লোকটার সামনে সাদা সাদা কেয়েকটা মাছ ছটফট করছে । আমি বেশ অবাক হলাম । একটু আগেও তো ওখানে কিছু দেখিনি । এখন মাছ এলো কোথা থেকে?

– এরা মাছ’টাচ ধরেই দিন কাটায় স্যার । আমি কিছু বলার আগেই জামিল বলে উঠল । নদীতে মাছ ধরতে থাকা লোকটার পাশ দিয়ে যাবার সময় লোকটার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল, লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে ফেকাসে মুখে হাসল । রক্তশূন্য মুখের সে হাসিতে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল । আমি চোখ সরিয়ে নিলাম ।

নদীটা পার হতে খুব একটা বেশি সময় লাগল না । কোন রকম শব্দ না করে বৈঠা চালিয়ে মাঝি আমাদের এপারে নামিয়ে দিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল । জামালের পেছন পেছন আমরা হাঁটতে লাগলাম । কারো মুখে কোন কথা নেই । সবাই একরকম নি:শব্দে হাঁটছি । গ্রামটা যেন অতিমাত্রায় নির্জন হয়ে আছে । চারিদিকে এক গাছ পালা ছাড়া কোন জনমানবের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে । শীতটাও যেন হঠাৎ ঝাঁকিয়ে বসেছে । আমি হাত দু’টো প্যান্টর পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটছি । সুরু রাস্তা ধরে হেঁটে একটা একটা খোলা জায়গায় আসতেই খালি গায়ে একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম । লোকটা এক হাতে কয়েকটা মাছ ঝুলিয়ে রেখেছে । লোকটাকে দেখে আমি বেশ অবাক হলাম । এতো লোকটা এখানে মাছ নিয়ে কি করছে ? আমরা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লোকটা মাছ ধরা হাতটা তুলে ধরে বলল – বাবু মাছ নেবেন মাছ । একদম টাটকা মাছ। লোকটার বলার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যে, আমি ঝটকা মেরে পেছনে চলে এলাম । জামাল চট করে পেছনে এসে বলল- যা, ভাগ ভাগ এখান থেকে ।
লোকটা কিন্তু নাছর বান্ধা আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, নেন না বাবু একটা মাছ । নদীর টাটকা !
– যা ভাগ ভাগ এখান থেকে । বলতে বলতে জামাল আমার হাত ধরে টান দিয়ে বলল স্যার আপনি আসেন আমার সাথে।

আরো ঘণ্টা খানেক হাটার পর আমরা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম । বাড়ি না বলে একে ছোট খাটো একটা প্রাসাদ বলা চলা । অন্ধকারের মাঝে মাথা তুলে দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে । নয়ন আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল- স্যার এখানে কয়েক দিন আগেও কোন কিছু ছিল না ।

– কি পাগলের মতো কথা বলছ নয়ন । দেখছ না কতো বড় একটা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ।
– স্যার আমার কথা বিশ্বাস করেন । সব চোখের ভুল ।
– এতো বড় বাড়িটাকে তুমি চোখের ভুল বলছ ?
– তোমার চশমা লাগবে দেখছি । বলে আমি জামাল এর দিকে তাকালাম । জামাল কিছু বলল না চোখ বড় বড় করে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে । হঠাৎ আমার কেমন ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠল। মনে হাড়ের ভেতর পর্যন্ত শীতে কেপে উঠছে ।

– স্যার যান ভেতরটা ঘুরে আসেন । জামাল আমার দিকে তাকিয়ে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসল । আমি ভয় পেয়ে গেলাম । টের পেলাম তালুর চুলগুলো একটা একটা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে । আমি হাতে হাত ঘষে বললাম – তুমি যাবেনা ?
– না স্যার । তেনারা আমারে পছন্দ করে না ।
– আপনি যান , দেখা সাক্ষাৎ করে আসেন ।

– নয়ন তুমি যাবে ? মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, নয়ন মনে হয় না বলব । কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও বলল – চলেন স্যার ।
– চলো । বলে আমি পা বাড়ালাম ।

বাড়ির দেয়ালটা দেখে বোঝা যায় এক সময় কি যত্ন করে গড়ে তোলা হয়েছিল । কালের বির্বতনে সব খসে গেছে । বাড়িটার ভেতরে পা রেখতেই আমার শরীর কেমন জানি করে উঠল । মনে হল, কিছু একটা সত্যিই আছে এ বাড়িতে। ইতিমধ্যে অন্ধকারটা চোখে সয়ে এসেছে । নয়ন এর হাতের টর্চটা বাকিটুকু অন্ধকার ও দূর করে দিচ্ছিল । আমি ঘড়ি দেখলাম । পৌনে আটটা বাজে । ঘড়িটা কি নষ্ট হয়ে গেছে ? একটু আগেও তো মনে হয় পৌনে আটটাই দেখেছিলাম ।

– স্যার আমার কেমন ভয় ভয় করছে ।
– চলো ভয়ের কিছু নাই, যা হবার হবে । চল ভেতরটা দেখে আসি ।
– স্যার, এ জায়গাটার খুব বদনাম আছে শুনেছি । নয়ন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল ।
– শুনাতে কিছু আসে যায় না, নয়ন । জগতে দেখাতেই সব । এখন চল ভেতরে যাই । আমি নয়নের কাঁধে হাত রেখে বিজ্ঞের মতো বললাম । কথাটা ওকে বললেও নিজেকেই যেন সান্ত্বনা দিলাম । পেছন ফিরে দেখলাম জামাল বুকের উপর দু’হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে তাকাতে দেখে কেমন বিশ্রী করে হাসল ।
আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম । নয়ন আমার গাঁ ঘেঁষে ঘেঁষে এগুচ্ছে । বাড়ির প্রাচীরটা পেছনে ফেলে এসে সিঁড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে নয়নের হাতে থাকা টর্চটা নিবে গেল ।
-কি হল ? টর্চটা নেভালে কেন ? আমি জিজ্ঞেস করাতে ও বলল – স্যার টর্চ তো জ্বলছে না ।
– জ্বলছে না কেন ?
– বুঝতে পারছি না স্যার । নতুন ব্যাটারি না জ্বলার তো কোন কারণ নেই । কথাটা বলে নয়ন টর্চটা মোচড়াতে মোচড়াতে ঠিক করতে চেষ্টা করল কিন্তু পারল না ।

আমরা টর্চ ছাড়াই বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম । গুমোট একটা বাতাস এসে চোখে মুখে লাগল । হঠাৎ মনে হল কিছু একটা পোড়ানোর গন্ধ পেলাম । দরজা দিয়ে ঢুকতেই আমরা বড় একটা ঘরে এসে পরলাম । আবছা আলোয় দেয়ালগুলোকে কেমন কালো, কালো মনে হল । নয়ন আরো কয়েকবার টর্চটা হাতের তালুতে ঝাঁকাতেই ওটা জ্বলে উঠলো । তবে আলোটা আগের মতো আর তেমন তীব্র নেই । তবুও সেটা কাজ চলে যাবার মতো । আমি ভূতের ভয়ের চেয়েও সাপের ভয়ে আছি । নয়ন কে ধরে ধরে খুব সাবধানে পা ফেলে ভেতরের দিকে অগ্রসর হচ্ছি ।
হঠাৎ অন্যপাশ থেকে কেমন একটা ছন ছন শব্দের সঙ্গে গুরুর গুরুর শব্দ ভেসে এলো । খুব ক্ষীণ সে শব্দ । ভাল করে কান না পালতে যেন শুনাই যায় না । আমি আরো কয়েকবার খুব মনোযোগ দিয়ে শব্দটা শুনে নয়নের দিকে তাকালাম । নয়নও তাকাল আমার দিকে ।

-নয়ন,শুনতে পাচ্ছ কিছু ?
-জী স্যার, মনে হচ্ছে কোথাও বাদ্য বাজছে ।
– ঠিকই শুনেছ, কিন্তু এখানে বাদ্য বাজবে কোথা থেকে ? চলো অন্য পাশটায় গিয়ে দেখি । আমি নয়নের অপেক্ষায় না থেকে হাঁটতে লাগলাম । শরীরটা কেমন জানি লাগছ । পুরো শরীর মনে হচ্ছে ঠাণ্ডায় জমে যাবে । দাঁতের সঙ্গে দাঁত বারি খাচ্ছে । হঠাৎ স্পষ্ট মেয়েলি হাসির শব্দ ভেসে এলো। আমি আর নয়ন দু’জনেই চমকে উঠলাম । খিল খিল করে কে যেন খুব কাছ থেকে হেসে, দৌড়ে অন্য দিকে চলে গেল । সঙ্গে সঙ্গে ছন ছন ছন নূপুরের শব্দ শুনতে পেলাম ।
নয়ন আমার গাঁ ঘেঁষে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল- স্যার মনে হয় নিশি ভৌমিক ।
– নিশি ভৌমিকটা আবার কে ? আমিও ওর মতো ফিসফিস করেই বললাম ।
– স্যার , তিনি ছিলেন নারায়ণ ভৌমিক এর ছোট বউ ।
– তাই নাকি ?
– জী স্যার , তেনাকেই নাকি এ বাড়িতে দেখা যায় ।
– কেন ? শুধু নিশি ভৌমিকেই কেন ? আমি লক্ষ করে দেখলাম আমার হাত পা কেমন যেন ঠকঠক করে কাঁপছে।
– স্যার, তেনাকে নায়ায়ন ভৌমিক সাহেব মেরে ফেলেছিলেন ।
– বল কি ?

– জী স্যার, তেমনটাই শুনা যায় । নয়ন এর কথা শেষ হতে পারলো না হঠাৎ সামনের ঘরের দরজা জানালা গুলো ধুমধাম শব্দ করে খুলতে আর বন্ধ হতে লাগলো । হঠাৎ শব্দে আমরা চমকে উঠলাম । একবার মনে হল এক দৌড় দিয়ে পালিয়ে যাই । নয়নকে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না । দু’জন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম । এক সময় শব্দটা কমতে কমতে একেবারে থেমে গেল ।নয়ন বলল- স্যার চলেন এ বাড়ি থেকে বেড় হয়ে যাই । আমিও চলো বলতে যাচ্ছিলাম । এমন সময় কারো কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম । কে যেন খুব কাছ থেকে গুন গুন করে কাঁদছে ।

– কে কাঁদে ? আমি ফিসফিস করে বললাম ।
– নয়ন বলল স্যার, চলেন ফিরে যাই ।
-দাঁড়াও আগে দেখি না কে কাঁদে ? আমি নয়নকে নিয়ে কান্নার শব্দ অনুসরণ করে একটা দরজা বন্ধ ঘরের কাছে এসে দাঁড়ালাম । ভেতরে কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে । আমি দরজা ধাক্কা দিয়ে এক চুল নাড়াতে না পেরে শব্দ করে দরজায় কিল মারতে লাগলাম। হঠাৎ নয়ন আমার হাত খামছে ধরে টান দিলো । আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম – কি ?

নয়ন আঙুল দিয়ে দিয়ে অন্যপাশের একটা দরজা দেখিয়ে দিলো। সেদিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম । দরজায় সাদা শাড়ি পরা অল্প বয়সী একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে । মুখে আলতো হাসি টুকু না থাকলে আমি বোধ হয় দম বন্ধ করে মারা যেতাম । আমার ভেতরটা ধুকধুক করে লাফাচ্ছে । নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছি । হঠাৎ খুব কটু একটা গন্ধ এসে নাকে লাগল । আমি অপলক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি । আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছন ছন ছন ছন নূপুরের শব্দ তুলে মেয়েটা দৌড়ে ভেতরের দিকে চলে গেল । আমি ও মেয়েটার পেছন পেছন ছুটলাম । নয়ন আমাকে আঁকড়ে ধরে থামাতে চাইল । কিন্তু পারল না । আমি নূপুরের শব্দ অনুসরণ করে এ ঘর ও ঘর ছুটতে লাগলাম । কিন্তু মেয়েটাকে আর দেখতে পেলাম না । শুধু নূপুরের শব্দ আর খিলখিল হাসির শব্দ আমাকে যেন আরো পাগল করো তুলল । ছুটতে ছুটতে হঠাৎ বারান্ধায় আসতেই মোটা আর কালো একটা লোকের সঙ্গে প্রায় ধাক্কাই খেয়ে গিয়েছিলাম । লোকটা আমাকে দেখে একটা দরজা দেখিয়ে দিয়ে বলে উঠল- ত্রই দিকে যান বাবু । আমি দরজা বরাবর ছুটলাম । শাড়ি পরা মেয়েটাকে দেখার জন্য আমার ভেতরটা তখন ছটফট করছে ।

ঘরটাতে ঢুকে আমি আবারও চমকে উঠলাম । কেননা ঘরটাতে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে তাদের সঙ্গে মেয়েটাও আছে । মেয়েটাকে দু’জন লোক দু’দিক থেকে ধরে আছে । আমি ঘরে ঢুকতেই মেয়েটা আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল। আমার ভেতরটা কেন যেন মোচড় দিয়ে উঠল । আমি একটু এগুতেই দেখতে পেলাম ঘরের ঠিক মাঝখানে একজন বৃদ্ধ, হাতলওয়ালা একটা চেয়ারে বসে আছে । তার ঠিক সামনেই কয়েকজন একটা লোককে জোড় করে মাটিতে চেপে রেখেছে । লোকটা নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে ও পারছেনা। আমি আরো কাছে গিয়ে বলে উঠলাম কি হচ্ছে এসব ? কিন্তু কেউ আমার দিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না । লোকগুলোর মাঝে হঠাৎ আমি জামালকে দেখতে পেলাম । হাতে একটা বড় রাম দা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । দা’টা দেয়ালের মশালের আলোয় চকচক করছে । আমার বুঝতে কিছু বাকি থাকলো না ঘরে কি ঘটতে চলেছে । আমি কিছু একটা বলতে চাইলে বৃদ্ধ লোকটা আমার মুখের কাছে আঙুল নিয়ে হুসসসসসস করে শব্দ করে আমাকে কিছু বলতে নিষেধ করলেন ।

আমি দাঁড়িয়ে গেলাম । নীচে চেপে রাখা লোকটা গোৎ গোৎ করে শব্দ করছে । আমি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলাম । জামালের দিকে চোখ যেতেই দেখলাম ও মিটমিট করে হাসছে। রাগে আমরা ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠল। বৃদ্ধ লোকটা হঠাৎ জামালের দিকে ইশারা করতেই জামাল খুব দ্রুত চেপে রাখা লোকটাকে উল্টো শোয়াতে বলল । লোকটাকে চিতকরে শোয়াতেই আমি চমকে উঠলাম । সে লোকটা আর কেউ নয়, “আমি নিজে” । আমাকেই নিচে শুইয়ে রাখা হয়েছে । জামাল আমার দিকে তাকিয়ে আবারও হাসল । তারপর তাকাল বৃদ্ধার দিকে । বৃদ্ধ লোকটা মাথা নেড়ে ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গে জামাল মাথার উপর দা’টা তুলে চোখের পলকে নীচে নামিয়ে আনল । ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে আমার চোখে মুখে লাগল । আমি বিস্ফোরিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম । টু শব্দটি মুখ দিয়ে বেড় হল না । মেয়েটার তাকিয়ে দেখি সেও বোবা হয়ে গেছে । একবার কেটে ফেলা লোকটার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার আমার দিকে তাকাচ্ছে । নীচে পরে থাকা লোকটার শরীর কাটা মাছের মতো লাফাতে লাফাতে এক সময় থেমে গেল । বৃদ্ধ লোকটা এবার আমাকে ধরে থাকা লোক দু’জনের দিকে ইশারা করতেই লোক দুটো আমাকে এক টানে নীচে শুয়িয়ে ফেলল । জামালকে দেখলাম আমার বুকের দু’পাশে পা রেখে দাঁড়াতে । দা’টা থেকে টপটপ করে আমার শরীরে রক্ত পরছে । ভয় শূন্য দৃষ্টিতে আমি দা টার দিকে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম । শুধু আমার দাঁতের সঙ্গে সঙ্গে ঠকঠক করে বাড়ি খাচ্ছে।

হঠাৎ বৃদ্ধ লোকটা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো – দেখ,নিশি দেখ, আমার অবাধ্য হলে কি হয় দেখ । মেয়েটা বৃদ্ধ লোকটার গলা শুনে যেন খেপে উঠল এক ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে লাফ দিয়ে জামালের হাত থেকে দা’টা কেড়ে নিয়ে চোখের পলকে বৃদ্ধ লোকটার মাথায় কোপ মেরে বসলো । ফিনকি দিয়ে আবারও রক্ত ছুটতে দেখলাম । মেয়েটা দা নিয়ে জামালের দিকে ঘুরতেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে সবাই পেছনে সড়ে গেল । মেয়েটা, তুই শুয়োর ,তুই একটা জানোয়ার বলে চিৎকার আর কান্না করতে করতে বৃদ্ধ লোকটাকে কোপাতে লাগল । একসময় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া বৃদ্ধের দেহের উপর থু করে এক ধলা থুতু ফেলে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল- আসো । তারপর দরজার দিকে ছুটতে লাগল । আমিও মেয়েটার পেছন পেছন ছুটতে লাগলাম । পেছনে অনেকগুলো পায়ের শব্দ আমাদের অনুসরণ করে আসতে লাগল । ছুটতে ছুটতে মেইন দরজার আমরা যখন মেইন দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি তখন পেছন থেকে কয়েকজন এসে মেয়েটাকে ধরে ফেলল । মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো যাও তুমি চলে যাও । চলে যাও । আমি ছুটতে ছুটতে দরজা দিয়ে বেড় হয়ে এলাম । বাড়িটা থেকে বেড় হয়ে প্রাচীরের কাছে আসতেই কিছু একটা সঙ্গে মাথা ঠুকে যেতেই আমি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পরে গেলাম ।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত