ইবলিস

ইবলিস

দাউদকান্দি থেকে ঢাকায় আসতে কোন অবস্থাতেই দু;আড়াই ঘন্টার বেশি সময় লাগার কথা না । সেখানে বয়স্ক মানুষের মতো পথে ধুকে ধুকে বাসটা যখন ঢাকায় এসে পৌছল ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় রাত আড়াইটা বাজে । জগলুরা কয়েকজন বন্ধু মিলে গিয়েছিল দাউদকান্দি । ওর এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে । যাবে না , যাবে না করেও সবার চাপা চাপিতে শেষ পর্যন্ত আর না গিয়ে পারেনি জগলু । বাংলায় একটা প্রবাদ আছে অনুরোধে ঢেকি গেলা, কিন্তু জগলুর কাছে এখন মনে হচ্ছে, সে অনুরোধে ঢেকি নয়, কামান গিলেছে । আর তা হজম না হয়ে হয়েছে বদহজম হয়েছে ।

বন্ধুরা সবাই বিয়ে বাড়ীতে রয়ে গেলেও । জগলু তারাহুরো করে চলে এসেছে কারন আগামিকাল ওর অফিস আছে । জগলু একটা তৈল কম্পানীতে মোটা বেতনে চাকরি করে । সেখানে শুক্রবার ছাড়া অন্য কোন দিন কোন রকমের ছুটি নেই। বছর শেষে আছে টানা ত্রিশ দিনের লম্বা ছুটি ।

শান্তি পরিবহনের বাসটা যাত্রাবাড়িতে আসতেই বেশির ভাগ যাত্রী নেমে গেল। সায়দাবাদেও নামলো আরো কয়েক’জন। জগলু নামলো টিকাটুলিতে । ওর বাসা নারিন্দার মুনির হোসেন লেনে। বাস’টা ওকে রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে পুলিশ বক্সের কাছে নামিয়ে দিয়ে একটানে চলে গেল গুলিস্তানের দিকে। বাসে তখনও কিছু যাত্রি বসেছিল । জগলু বিরক্তি নিয়ে ছুটে যাওয়া বাসটার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থাকলো । তারপর মনে মনে বললো- হারামজাদা।

ইদানিং ও’র এই একটা বদ অভ্যাসটা হয়েছে । যখন তখন মনে মনে ও যাকে তাকে গালি গালাজ করে । অনেক সময় নিজের দেয়া গালিতে নিজেই চমকে উঠে জগলু । তবে এ’তে একধরনের তৃপ্তি বা আরাম পাওয়া যায় । ব্যথার উপড় আলতো করে হাত বুলালে যে ধরনের আরাম পাওয়া যায় । অনেকটা সে ধরনের আরাম । জগলু এর নাম দিয়েছে “পরিবেশ বান্ধব তৃপ্তি “।

পথে বারবার বাসটা খারাপ হওয়াতে এমনিতে জগলুর মেজাজটা তেতে আছে , তার উপর এখন পথ ঘাট এ রকম শূণ্য দেখে, ওর মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল । মনে মনে ও গজগজ করতে লাগলো, এর কোন মানে হয় ? এভাবে বিয়ে খেতে যাওয়ার কি দরকার ছিল ? বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে জগলু মনে মনে ‘তিন অক্ষরের’ একটা গালি দিল । তবে আরাম পালো কিনা বোঝা গেল না । ব্যাগ দু’টো পায়ের দু’পাশে রেখে পকেট থেকে রুমাল বেড় করে ও মুখ মুছলো ।

জগলুর সঙ্গে দু’টো ব্যাগ । একটা লেদারের জার্র্নি ব্যাগ তাতে ওর কাপড় চোপোর । অন্যটা সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বানানো বাজারের ব্যাগ । জগলু দাউদকান্দি বাজার থেকে বাসার জন্য কিছু মাছ কিনেছে । যদিও মাছওয়ালা পলিথিনের ব্যাগে বরফ দিয়ে মাছ গুলো বেঁধে দিয়েছিল তবুও জগলুর ধারনা মাছ গুলো এখন নষ্ট হচ্ছে । বরফ গলে ব্যাগটা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঠান্ডা পানি পরছে । সেই সঙ্গে একটু একটু মাছের গন্ধও মনে হয় পাওয়া যাচ্ছে বলে ওর মনে হচ্ছে ।

টিকাটুলি থেকে হেঁটেই বাসায় যেতে হবে । এতো রাতে রিকসা পাবার কোন প্রশ্নই উঠে না । পথ ঘাট একেবারে শুনশান । কোথাও কোন লোকজন বা জনমানব নেই । আকাশে বিশাল একটা চাঁদ মেঘের সঙ্গে লুকুচুড়ি খেলছে । জগলু হেঁটে পুলিশ বক্সে থেকে খ্রিষ্টান কবরস্তানের রোডটায় এসে দাঁড়ায় । ওর হাতের বাম পাশে খ্রিরিষ্টান কবরস্তান, ডানপাশে বলধা গার্ডেন ।

খ্রিষ্টান কবরস্তান আর বলধা গার্ডেন দু’টোই উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা । রাতের অন্ধকারে বলদা গার্ডেন থেকে বড় বড় ইউকিলিয়াস গাছগুলো অজগর সাপের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে । হঠাৎ দেখলে কেমন যানি গা ছমছম করে উঠে । জগলু একবার সেদিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল । তারপর খ্রিরিষ্টান কবরস্তানটার দিকে চাইতে ওর মনে হলো ভেতরের গাছপালা গুলো একটা আরেকটার উপর ঝুকে রাস্তার দিকে উকি দিয়ে আছে । জগলু হঠাৎ অনুভব কললো ওর কেমন ভয় ভয় লাগছে । মাথার চুলগুলো মনে হলো, একটা একটা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে । কিন্তু ওর বাস্তববাদী মন ভয় পাওয়ার কোন কারণ খুঁজে না পেলও নানান আজে বাজে চিন্তা মনের ভেতর উঠে আসছে । চারিদিকে কবরের শুনশান নীরবতা । জগলু ঘড়ি দেখলো , রাত পৌনে তিনটা বাজে ।

জগলু এদিক সেদিক তাকিয়ে লোকজন বা রিকসা খুঁজছে । একা হেঁটে যেতে ওর ক্যামন জানি মন সায় দিচ্ছে না । অজানা একটা ভয় একটু একটু করে ওর অজান্তেই এগিয়ে আসছে । জগলু মাছের ব্যাগটা পায়ের কাছে রেখে, পকেট থেকে মোবাইল বেড় করলো । সুইচে টিপ দিয়ে অন করতেই -দু বার পিপ পিপ শব্দ করে মোবাইলটা বন্ধ হয়ে গেল । বাসে বসেই ও দেখেছিল মোবাইলের চার্জ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে । তাই এখন মোবাইলটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ও খব একটা অবাক হলো না । শুধু মুখে “চুক” করে শব্দ করে মোবাইলটা আবার পকেটে রেখে দিয়ে বললো- না , হেঁটেই যেতে হবে । কবরস্হান তো কি হয়েছে । আল্লাহ ভরসা । জগলু যেই হাঁটার জন্য পায়ের কাছে রাখা ব্যাগ দুটো তুলে নিয়েছে, ঠিক সেই সময় ও খেলাল করলো রাস্তার ওপর পাশ থেকে কেউ একজন হেঁটে এগিকটায়ই আসছে । মনে মনে ও সাহস পেল । যাক, বাঁচা গেল । সঙ্গে কেউ একজন থাকলে হাঁটা কোন ব্যাপার না ।
খাঁটো মতো , কালো কোট পড়া লোকটা জগলুর সামনে এসে দাঁড়াল । একবার ওর দিকে, তারপর ওর পাশে রাখা ব্যাগ দু’টোর দিকে তাকিয়ে বললো, জনাব কোন সমস্যা ?

জগলু মাথা নেড়ে না করলো , তারপর বললো – না কোন সমস্যা না । ভাল করে লোকটার দিকে তাকাতেই ও দেখলো, লোকটার পরনে কোট প্যান্ট থাকলেও পা দুটো খালি । ও মনে মনে ভাবলো পাগল টাগল না তো । লোকটার মুখের আকৃতিটাও কেমন যেন একটু চ্যাপটা আর লম্বাটে । গলাটা মনে হচ্ছে শরীর থেকে বেড় হয়ে যেতে চাচ্ছে । কোটের কলারের উপড় দিয়ে লম্বা গলাটা বিশ্রীভাবে বেড় হয়ে আছে । জগলুর কাউকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার স্বভাব নেই । কিন্তু তবুও কেন যেন হঠাৎ উদয় হওয়া এ লোকটার সব কিছুর দিকে জগলুর চোখ অতি সহজেই ছুটে যাচ্ছে । এবং বেঁছে বেঁছে লোকটার শারীরিক খুঁতগুলো ওর চোখে পরছে । জগলু আরো খেয়াল করলো যে, লোকটার উপস্হিতি ওর মধ্যে একধরনের ভীতির সৃষ্টি করছে । লোকটা ঠিক যেন স্বাভাবিক না । কোথায়ও যেন একটা সমস্যা রয়েছে । ও অসস্থি বোধ করতে লাগলো ।

জগলুকে চুপ থাকতে দেখে লোকটা আবারও প্রশ্ন করলো – জনাব কোন সমস্যা ? আমি কি কোন কাজে আসতে পারি ?

-না সমস্যা না । তবে কোন রিকসা পাচ্ছি না । এটা অবশ্য একটা সমস্যা ।
-কোথায় যাবেন ?
-এইতো সামনেই । জগলু হাত দিয়ে সামনের টিপুসুলতান রোডটা দিকটা দেখালো ।
ও নারিন্দা ! আমিও ওদিকটায় যাবো , চলুন তবে হাঁটি । লোকটা ওর মাছের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসতে হাসতে বললো ।

জগলু ইতস্তর্থ করতে লাগলো, মনে মনে সিদ্বান্ত নিতে পারছেনা লোকটার সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে কি না ।
লোকটা এবার ও’র মুখের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো – ভয় পাচ্ছেন ? তবে থাক । আমি একলা একলাই যাই । লোকটার মুখ থেক বিশ্রী একটা গন্ধ এসে ওর নাকে লাগলো । জগলুর মনে হলো ওর ভেতটা গুলিয়ে উঠলো । পেটটা ক্যামন মোচর দিয়ে উঠলো । জগলু কোন মতে বললো – না , আপনাকে আবার ভয় কিসের । তারপর “থু’ করে রাস্তার একপাশে একদলা থুতু ফেললো ।

লোকটা খেক খেক করে হেসে বললো – জি,ঠিক বলেছেন, আমাকে আবার ভয় কিসের ? জগলু ব্যাগ দু’টো নিয়ে হাঁটতে শুরু করতেই লোকটাও হাঁটতে ওর পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো ।
ব্যাগে ভেতর মনে হয় মাছ আছে, তাই না জনাব ?

জগলু অনেকটা চমকে উঠে লোকটার দিকে তাকালো । অন্য কেউ হলো অবাক বিস্ময়ে পাল্টা প্রশ্ন করতো -আপনি কিভাবে জানলেন ? কিন্তু জগলু পাল্টা কোন প্রশ্ন না করে শুধু ছোট্র শব্দ করলো হু । এবং মনে মনে ভাবলো ব্যাগের ভেতর যে মাছ আছে সেটা বুঝতে আইনএস্টেন হতে হয় না । একটু জ্ঞান থাকলেই বোঝা যায় । ব্যাগ থেকে যে চুইয়ে চুইয়ে পানি পরছে সেটা দেখলেও বোঝা যায় যে ব্যাগের ভেতর মাছ আছে । আর ঘ্রাণ শক্তি যদি একটু প্রখর হয় তবে তো কোন কথাই নাই । গন্ধ শুকেই বলে দেওয়া যায় যে, ব্যাগের ভেতর কি আছে । কেননা জগলুর ইতি মধ্যে মনে হয়েছে ব্যাগের ভেতর থাকা মাছগুলো গন্ধ ছড়াচ্ছে । সুতারাং লোকটার ঘ্রাণ শক্তি প্রখর ।

– বাঘা পাপদা আর টেংরা মাছ তাই না জনাব ? লোকটা একবার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে তারপর সামনের দিকে তাকায় । মুখে বিশ্রী রকমের একটা হাসি । এবার কিন্তু জগলু না চমকে পারে না । বেশ চমকে উঠে । বুকের ভেতটা কেমন যেন ধক করে উঠলো । শুধু জগলু কেন ? যে কোন মানুষেরই কথাটা শুনার পর চমকে উঠার কথা ।

কেননা, দাউদকান্দি বাজারে বড় বড় পাপদা মাছগুলো দেখে জগলু বেশ বেশ অবাক হয়েছিল । মাছওয়ালা বলেছিল , স্যার নিয়া যান, এগুলি বাঘা পাপদা । সবসময় পাওয়া যায় না । একবার খাইলে সারা জীবন মুখে সোয়াদ লেগে থাকবো । জগলু নিজে পাপদা মাছ খায় না । পাবদা কেন, এক ইলিশ ছাড়া কোন মাছই ও খায়না । তবুও মাছগুলো কিনেছে ওর বাবা জন্য । ওর বাবা বরিশালের মানুষ । কথায় কথায় মাছের গল্প শুনায় । তার গল্পের মধ্যে এ বাঘা পাবদা মাছের গল্প ও আছে । তাই বাঘা পাবদা নাম শুনেই জগলু বাবার জন্য মাছগুলো কিনে ফেলেছে । আর মায়ের জন্য কিনেছে তার প্রিয় ছোটছোট টেংরা মাছ ।

জগলুর বাবা বেশ কিছু দিন যাবত অসুস্থ । ডাক্তার রোগ ধরতে পারছেন না । আগামী মাসে তার জগলুর বড় বোন টুম্বার কাছে আমেরিকায় যাবার কথা আছে । ভিসাও হয়ে গেছে । সেখানে চিকিৎসা হবে ।
জগলু লোকটার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে হাঁটতে থাকে । মুখে কথা না বললেও ওর মধ্যে একধরনের ভয় কাজ করছে । ও আসলে ভয়টাকে পোশ্রয় দিতে চাচ্ছে না । ভয় হলো চুইংগামের মতো । টানলে বড় হতেই থাকে, বড় হতেই থাকে ।

তা কত দিয়ে কিনলেন জনাব ? লোকটা জগলুর প্রায় কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে । আবারও পঁচা গন্ধে জগলুর পেট গুলিয়ে উঠে । জগলু চট করে সড়ে যায় । তারপর মনে মনে বলে, সেটাও আপনি জানেন নিশ্চই । একটু রাগত ভাবে কথা বলতে ইচ্ছে হলেও জগলু নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকায়, তারপর বলে -আপনি আসলে কে ?

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে জগলু টের পায় ওর মাথাটা আবারও ঝিমঝমি করছে । ঘা’ড়ের লোমগুলো একটা একটা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে । এর মানে হচ্ছে ও এখন ভয় পাচ্ছে ।

আমি কে ? জগলুর প্রশ্নটা রিপিট করে লোকটা খেক খেক করে হেসে উঠে । শেয়ালের মতো সে হাসির শব্দ । ঠিক সে সময় হঠাৎ রাস্তার দু’পাশের সোডিয়াম বাতিগুলো নিবে যায় । জগলু দাঁড়িয়ে পরে । একবার ঝেরে দৌড় মারতে ইচ্ছে করে ওর । কিন্তু চিন্তাটা দ্রুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জোড়ে জোড়ে হাঁটতে থাকে । মনে মনে ভাবে এভাবে মাছ আনাটা ঠিক হয়নি । নিশ্চিত খারাপ কোন জিনিষের পাল্লায় পরেছে ও । এ ধরনের জিনিষের কথা বাবার কাছে ও অনেক শুনেছে । যদি জিনিষটা একবার বুঝতে পারে যে, ও ভয় পেয়েছে, তা হলে আজ খবর আছে । জগলুর ডান পাশ দিয়ে কোন শব্দ না করেই লোকটা হাঁটছে ।

পাঁচশো বিশ টাকা তাই না ? উত্তরটা দিয়ে লোকটা আবারও হেঁসে উঠে ।
জগলু এবার দাঁড়িয়ে পরে সোজা লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে – আপনি কে ? কি চান ? কেন আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছেন ?
জগলুর চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেছে । মনে মনে ও আল্লাহকে ডাকছে । আর বলছে আমি ভয় পাবো না । আমি কিছুতেই ভয় পাবোনা ।
হাঁটতে থাকো, থেমো না । আমার পরিচয় আসলেই জানতে চাও ? লোকটা চটকরে আপনে থেকে তুমিতে নেমে আসে ।

জি, আপনি কে ? কি চান ?
তোমার সঙ্গ চাই । আবারও সেই খেক খেক করে হেসি । আমি ইসলিস । লোকটা হাসতে হাসতেই বলে । হাসি যেন আর থামেই না । চেনো আমাকে ? আমাকে চেনা যায় ? নাম শুনেছো নিশ্চয় ।

জগলুর হঠাৎ মনে হয় এটা কি কোন মাস্তান টাস্তানের নাম ? কিন্তু পরক্ষনেই ওর চট করে মনে পরে যায় ইবলিস শয়তান না তো ? জগলু কোন রকম তোতলাতে তোতলাতে বলে – দেখুন মজা করবেন না ? এখন মজা করার সময় না ।

ইবলিস তো মজা করে না । যা করে বুঝে শুনেই করে । মজা করে মানুষ জাতি । আশরাফুল মাখলুকাত । সৃষ্টির সেরা জীব । কথাটা বলে, লোকটা দু’টো ঠোট দিয়ে ফু ফু ফু ফু ফু শব্দ করে । তারপর হাসতে থাকে । জগলু কি করব বুঝতে পারে না । ফেল ফেল করে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে । এই মুহুর্তে ওর মাথা কোন কাজ করছে না । যেন হঠাৎ করেই চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছে । জগলু মনে মনে দোয়া দুরুত পড়তে চেষ্টা করে । কিন্তু কোন কিছু মনে আসে না । অথচ ও কোরআন শরীফ বেশ শুদ্ধভাবে পড়তে পারে ।

পারবা না । কোন দোয়া বা আয়াতই এখন তোমার মনে করে পড়তে পারবানা । তোমার সব আমি ভুলিয়ে দিয়েছি । আমার অনেক ক্ষমতা । আমার ইচ্ছেই এখন তোমার কর্ম । হাঁটতে থাকো । হাঁটতে থাকে । একদম থামবা না ।
জগলুর হঠাৎ মনে হয়, লোকটা ওর সঙ্গে রসিকতা করছে না তো ? কঠিন রকমের কোন রসিকতা । পরে বন্ধু বান্ধবের কাছে এ ঘটনা বর্ননা করে মজা করবে । হঠাৎ জগলু ঘুরে বলে আপনি, যেই হন, এখান থেকে চলে যান ।

just leave ।
লোকটা কুতকুতে চোখে কিছুক্ষন জগলুর দিকে তাকিয়ে থাকে , তারপর ফোস করে নিশ্বাস ছেড় বলে , তোমার বিশ্বাষ হচ্ছে না যে আমি ইবলিশ । তাই না ? লোকটার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠেছে । আবচ্ছা আলোতেও জগলু তা বেশ দেখতে পায় ।

আপনি যে ই হোন না কেন ? আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না । এখান থেকে চলে যান । আমাকে বিরক্ত করবেন না। আমি কিন্তু চিৎকার করবো ।

করো,যতো খুশি চিৎকার করো, দেখো গলা দিয়ে কোন শব্দ বেড় হয় কিনা ?
জগলু সত্যি সত্যি চিৎকার করতে চেষ্টা করে টের পায় গলা দিয়ে কোন শব্দ বেড় হচ্ছে না । লোকটা আবার ও খেক খেক করে বিশ্রী ভাবে হেসে উঠে । জগন্য হাসির শব্দে রাতের আকাশ বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠে । আকাশের চাঁদটা হঠেই চলে গেছে মেঘের আড়ালে । আবচ্ছা আলোয় সব ক্যামন রহস্যময় মনে হচ্ছে ।
জগলু কোন মতে বলে- তোর বিশ্রী হাসি নিয়ে দূর হ শয়তান ।

– তাহলে সুন্দর করে মেয়েদের কন্ঠে হাসি ? যা শুনেই তোমার ভেতর প্রেম জেগে উঠে । হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে । শরীরে শরীরে ঢলাঢলি খেলতে ইচ্ছে করে । বলেই লোকটা মেয়ে কন্ঠে হেঁসে উঠে । জগলু নিজের চোখ, কানকে বিশ্বাস করতে পারে না ওর মনে হলো ও মাথা ঘুরে পরে যাবে । জগলু চোখ বন্ধ করে ফেলে । তারপর মনে মনে বলে, ‘আমি যা দেখছি তা সব ভুল । আমার অবচেতন মনের কল্পর্ণা । ভুত প্রেত বলে কিছু নেই । কিচ্ছু নেই’ ।
শুন জগলু মিয়া, ভুত-প্রেত বলে কিছু নাই সত্যি । কিন্তু ইবলিস আছে । আমি ইবলিস । চোখ খোল । আমাকে দেখ । আমার সঙ্গে প্রেম প্রেম খেল । আবারও নারী কন্ঠে হাসি । এবার জগলু আরো চমকে উঠে । কেননা হাসির শব্দটা তিথির । জগলুর খালাত বোন। গতমাসে যার বিয়ে হয়েছে ।

চোখ খুল জগলু । এখন তোমার ইচ্ছে বলে কিছু নাই । আমার ইচ্ছাই তোমার ইচ্ছা ।
জগলুর মনে হলো ওর চোখ আপনা আপনি খুলে গেল । বিস্ময়ে ও আরো হতবাক হয়ে যায় । সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আর কেউ না । তিথি ।

কি, আমার সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলতে ইচ্ছে হয় ? তিথি ভ্র নাচিয়ে প্রশ্ন করে । বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে ? আসো প্রেম প্রেম খেলি । ছাদের সিড়ির কথা মনে নেই । চলো ঐভাবে আবারও ঘষাঘষি খেলি । তিথি হাসতে থাকে । তারপর হাসি থামিয়ে বলে – কামরানের কথা ভেবো না । ওটারে ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের নীচে ফেলে দেবো । তারপর তুমি আর আমি পিটিস পিটিস । কুত্তাটা impotent । আর তুমি বেশ মোটাতাজা । অনেক মজা হবে । কাছে আসো আমাকে জড়িয়ে ধরো জগলু । আমার দেবদাস । আর লুকিয়ে লুকিয়ে পানি খেতে হবে না । জগ থেকে এবার ঢকঢক করে শরবত খাও । তিথি হা হা হা হাসতে থাকে ।

জগলুর মনে হলোও মরে যাবে । তিথিকে সিঁড়িতে চুমু খাবার কথা পৃথিবীর কেউ জানে না । সত্যিকারের তিথি কোন অবস্থাতেই ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারে না । কোন অবস্থাতেই না ।

যে করেই হোক এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হবে । নিশ্চই আমার কঠিন রকমের হেলুসিনেসন হচ্ছে । যা দেখছি সব ভুল । ভ্রম। জগলু মাথা ঝাকাতে চেষ্টা করে । যেন মাথা ঝাকালে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে ।

কোন কিছুই ভুল না জগলু । যা দেখছো সব সত্যি । তুমি শুধু তিথির উপরটা দেখেছ । ভেতরটা দেখনি । দেখা সম্ভবও না । মানুষ হয়ে অন্য মানুষের মনের খোঁজ পাওয়া সম্ভব না । মনের খোঁজ জানে শুধু আল্লাহ আর ইবলিস । আমি সেই ইবলিস । আবার ও হাসির শব্দ । তবে এবার আর তিথি না । সেই পুরানো শেয়ালের মতো হাসি । তিথি থেকে লোকটা আস্তে আস্তে আগের রুপে ফিরে আসে । জগলুর কাছে মনে হয় ওর পা গুলো মাটিতে গেঁথে যাচ্ছে । কে যেন মাটির নীচ থেকে পাগুলো নিজের দিকে টানছে । শত চেস্টা করেও জগলু পা গুলো নাড়াতে পারে না । তারপরও মনের সব শক্তি এক করে নিজেকে বোঝাতে চেস্টা করে । ভয় পেলে চলবে না । ভয়ে পেলে চলবে । আল্লাহ আছেন । আল্লাহ আছেন । আল্লাহ বাঁচাও । জগলু হঠাৎ আল্লাহু বলে চিৎকার করে উঠে ।

ঠিক সে সময় উল্টো দিক থেকে । তীব্র আলো এসে পরে জগলুর শরীরে । জগলু মাথা ঘুরে ড্রেনের উপর পরে যায় । কয়েটা পা ওর আশে পাশে ছোটাছুটি করে । ওকে ড্রেন থেকে টেনে তুলে । জগলু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে – মাছের ব্যাগটা ছিড়ে বড় বড় পাপদা মাছ গুলো লাফিয়ে লাফিয়ে ড্রেনে নেমে যায় ।

পরিশেষ : রাতে টহলে বেড় হয়ে নারিন্দা পুলিশ ফারির সেকেন্ড অফিসার তমাল কান্তি সাহা জগলুকে খ্রীষ্টান কবরস্থানের কাছের ড্রেন থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল ভর্তি করেন । আর ঠিক সেদিন ভোরেই জগলুর খালাতো বোন তিথির স্বামী ইন্জেনিয়ার কামরান অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে ট্রেনের নীচে কাটা পরে মারা যায় । কামরান বিয়ের সপ্তাখানেক পরেই একটা সন্মেলনে অংশগ্রহন করার কথা বলে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে গেলেও আসলে সে সেখানে গিয়েছিল চিক্যিসার জন্য ।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত