বৈশাখ মাসের দুপুর ।
মাথার উপড় সূর্য যেন খসে পরছে । বাতাস না তো লু হাওয়া । শরীরে লাগলে পুড়ে পুড়ে যাচ্ছে । আমার আর রন্জুর শরীর দিয়ে ঘাম টপ টপ করে পরছে । তোজার মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই । বাস থেকে নেমে একটা ভ্যান নিয়ে ছিলাম । সেটাও অধেক পথ এসে বললো আর যাবে না । যাবেই বা কি করে বলা নেই কওয়া নেই সামনের চাকাটা হঠাৎই ভেঙ্গে দুমরে মুচরে গেল । অজ্ঞতা বাকি পথ টুকু পায়ে হেঁটেই হওনা হলাম । কৈই ভেবে ছিলাম অনেক দিন পর গ্রামে ভ্রমনটা ফাটাফাটি হবে । না এখন দেখছি গরমে আর জার্নিতেই অবস্হা টাইট । দু’পাশের ধান ক্ষেতের মাঝ খান দিয়ে একে বেঁকে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে আমরা চলেছি । গন্তব্য আমাদের হারিয়ে যাওয়া বন্ধু নিখিলেশের বাড়ি ।
হারিয়ে যাওয়া বন্ধু বলছি এ কারনে যে , আমরা তখন মাত্র সেকেন্ড ইয়ার শেষ করেছি । আমি ; রন্জু ,নিখিলেস আর তোজাম্মেল জহুরুল হক হলের ৩২৭ নম্বরে থাকি । চার জনে দস্তির চুড়ান্তু । নিজেদের আন্ডার ওয়ারটা ছাড়া আর বাদবাকি সব কিছু ভাগা ভাগি করে ব্যবহার করি । কে কার জন্য কতোটা করতে পারছি সেটাই ছিল মুখ্য বিষয় । ছাত্র হিসাবের চার জন তুখোর । পাল্লা দিয়ে চলে পড়া শুনা । এ সেমিষ্টারে আমি ফাস্ট তো পরেরটায় রন্জু ,তার পরেরটায় নিখিলেস । ব্যতিক্রম শুধু তোজা মানে তোজাম্মেল । সব সেমিষ্টারে থার্ড । এর কারন হলো , শালায় পড়াশুনা খুব একটা করে না । আমাদের তৈরি নোট দিয়ে দিব্ব্যি চালিয়ে যাচ্ছিল । তবে ছাত্র হিসাবে তোজাও তুখো। কোন একটি বিষয় ওকে দু’বার পড়তে শুনিনি । সেই সময় এক রাতে নিখিলেস ব্যাগ টেগ গুছিয়ে রাড়িতে চলে গেল। আর ফিরলোনা । ওর এভাবে চলে যাওয়াটাকে আমরা মেনে নিতে পারলাম না । অনেক খোঁজা খুঁজির পরে ও যখন ওকে পেলাম না তখন আমরা ঠিক করলাম শালাকে খুঁজে বেড় করে তবেই ছাড়বো । এর মধ্যে ওর একটা চিঠি পেয়েছি -তাতে ও এভাবে চলে যাবার জন্য ক্ষমা চেয়েছে । কিন্তু ক্ষমা আমরা করতে পারলাম না । এভাবে একটি ছেলে লেখা পড়া বন্ধ করে চেলে যেতে পারে না । নিশ্চই এর পেছনে কোন কার আছে । আর আমরা এখন চলেছি সেই কারন বেড় করতে ।
কিছুটা পথ হাঁটার পরেই রন্জু বসে পরলো -না আমি আর যাচ্ছি না । মালোয়ানটারে আমার কোন দরকার নাই । আমি আর হাঁটতে পারমু না । তোরা খুইজা নিয়া আয় আমি হারামজাদারে দু’ইডা জুতার বারি মারি । নিখিলেস কে আমরা রেগে গেলে মালাউন বলে খেপাতাম ।
আমার দু’ইডাও মাইরা দিস বলে ওর পাশে বসে পরলো তোজা ।
সালা এতো দু’র জানলে কে আসতো ? মোনালিসার সঙ্গে পককোন খেতে খেতে ওর ফ্লাটে বসে আড্ডা মারতাম না আইছি গাইয়া ভুতটারে খুঁজতে । রন্জু পকেট থেকে সিগারেট বেড় করতে করতে বললো ।
তুমি কি মামা শুধু আড্ডাতেই ক্ষান্ত হইতা এইডা আংগোরে বিশ্বাস করতে কও ? তোজা আমার দিকে চেয়ে চোখ মারে ।
ঐ শালা আমার বউ এর লগে আমি আড্ডা মারি না অন্য কিছু করি তোর বাপের কি ?
না , মামা আমার বাপের এখন আর কিছু না । বুড়া হইয়া গেছে । তয় মামা আমার কিন্তু অনেক কিছু ; বলে তোজাম্মেল ঝট করে সড়ে যায় ।
আবে যা , তোর ঐ কালা বগের ঠ্যাং সুস্মিতার সঙ্গে যাইয়া যা করবি কর । মোনার দিকে চোখ দিবি তো চোখ তুইলা লামু । রন্জু মাটির একটা ঢিল তুলে তোজাকে ছুড়ে পারে ।
তোজা বসে পরাতে ঢিলটা ওর মাথার উপড় দিয়ে গিয়ে ঝোপের মধ্যে পরে । সঙ্গে সঙ্গে কেউ একেজন বলে উঠে -ওই ঢিল মারে কে রে ?
ঝোপের ভেতর থেকে হঠাৎ শব্দ আসায় আমরা হকচোকিয়ে গেলাম ।
আমি বললাম – আমরা ;
আমরা কারা ? ঝোপের ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠে ।
আপনি কে ? ঝোপের ভিতরে কি করেন ? রন্জু পাল্টা প্রশ্ন করে ।
কি করি মানে ? ওই তোরা কারারে ? বলতে বলতে ঝোপের ভেতরে থেকে কালো করে একটা লোক বেড় হয়ে আসে । হাতে একটা রাম দা ।
আমি যখন দৌড় দেবো কিনা ভাবছি । রন্জু তখন দু’পা সামনে এগিয়ে গিয়ে বলে – চাচা সালাম – আমারা শহর থেইকা আইছি ।
হেইডা তো দেইখাই বোঝা যায় । তয় ঢিল মারছো কেন ? সন্মধন তুই থেকে তুমিতে আসায় আমার সাহস ফিরে আসে আমি বলি- এক বন্ধুর খোঁজে এসেছি । ঢিলটা আপনাকে মারা হয়নি । ভুল করে ওদিকে চলে গেছে । আর আপনি যে ঝোপরে ভেতর আছেন তা ও আমরা বুঝতে পারিনি ।
চোখ কান খোলা না রাখলে বুঝবা কেমনে ? তয় কার বাড়ী যাইবা কইলা ?
মানে আমরা এক বন্ধুরে খুঁজতে এসেছি ।
আরে বাবা হেয় তো কোন না কোন বাড়ীতেই থাকে ? হেই বাড়ীর নাম কি ?
সেটা তো বলতে পারবো না । তবে আমাদের বন্ধুর নাম নিখিলেস চৌধুরী । ইউনিভারসিটির রেজি:ষ্টারে এই জল্লা গ্রামের কথাই লেখা আছে । এটা তো জল্লা গ্রামই নাকি ? আমি পকেট থেকে নিখিলেসের ঠিকানা বেড় করতে করতে বলি ।
কি নাম কইলা নিখিলেস চৌধুরী ? আমার মনে হলো লোকটা একটু অবাক হয়েই নামটা উচ্র্চারন করলো ।
জ্বি । আমি মাথা নাড়ালাম । এটা কি জল্লা গ্রাম না ?
হ ; এইটা জল্লা গ্রামই । গ্রামের ভেতরেই চৌধুরী বাড়ি । যাও তোমরা । এই পথ ধইরা সোজা চইলা যাও । লোকটা আর দাঁড়ালো না । অনেকটা তারা হুরা করেই ঝোপের আড়ালে চেলে গেল । আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ।
কি হইলো রে মামা ? রন্জু আমার কাধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো ।
বুঝলাম না আমি অবাক হয়ে উত্তর দিলাম ।
আমার মনে হয় ভয় খাইছে । তোজা হাসতে হাসতে বললো ।
কিসের ভয় আমি কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলাম ।
আবে আংগোরে না , মনে হয় চৌধুরী বাড়ি যামু শুইনা ভয় খাইছে । তোজা হাসছে ।
চিকার মতো হাসছোস কেন – চৌধুরী বাড়ি নাম শুইনা ভয় পাইবো কেন ? রন্জু তোজার মাথায় চাটি মেরে জিজ্ঞেস করে ।
আর কেন জানছস না চৌধুরীরা জমিদার আর জমিদারগো মাইনসে কেন ভয় পাইতো । তোজা জ্ঞান দিতে শুরু করেছে ।
কেন ? কপাল কুচকে রন্জু জিজ্ঞেস করে ।
আবে শালায় অত্যাচারের জন্য । এইডাও বুঝোস না ?
যা । সেই দিন আর নাই । রন্জু নাক ছিটকায় ।
আহা গবেষনা বন্ধ কর চল সামনে হাঁটি । আমার খিদায় পেট চো চো করছে । আমি পেটে হাত দিয়ে বললাম ।
আমারও খিদা লাগছে । তোজা বললো । চল পা চালাই ।
একবার দেখমু না চাচায় ঝোপের আড়ালে কি করে ? রন্জু ঝোপের দিকে তাকিয়ে বলে ।
বাদ দে তো । যা ইচ্ছা করুক ।
আমি রন্জুর হাত টেনে হাটতে লাগলাম ।
জল্লা গ্রামটা বেশ বড় । আমারা প্রথমে গিয়ে পৌছালাম বাজারে । বাজারটা প্রায় লোক শূন্য বলা চলে । দু’তিনটা দোকান খোলা । বাকি সব গুলো বন্ধ । ঘরিতে তখন সাড়ে চারটা বাজে । কালো কাঠের তক্কার বেড়ায় ঘেরা একটা হোটেলে ডুকে ভাতের অডার দিলাম । হোটেলের ক্যাশে ১০ কি ১২ বছরের একটি ছেলে বসে ছিল । আমরা ডুকে বসতেই ছেলেটা এসে টেবিলে তিনটা প্লেট দিয়ে বললো কি খাবেন ?
কি কি আছে । আমি জিজ্ঞেস করলাম ।
এখানেই সব । হাতের ডান পাশে একটা গ্লাস ভাঙা সোকেসের মধ্যে ছোট ছোট তিনটা থালা । তার একটাতে ছোট মাছের বুনা , মাঝ খানেরটাতে কি একটা মাংস আর শেষেরটাতে হাতের পান্জার মতো লম্বা কি একটা মাছ ।
ঐ ডা কি মাছরে পিচ্চি ? তোজা লম্বা মাছটা দেখিয়ে প্রশ্ন করলো ।
আমার নাম পিচ্চি না মাহাবুব । ঐডা পুয়া মাছ ।
বাব্বা ! তো বাবা মাহাবুব পুয়া মাছটা আবার কি ?
তোজা আমার দিকে তাকায় । মনে হয় পোয়া মাছ হবে । আমি মাছের দিকে তাকিয়ে বলি ।
হ । পুয়া মাছ । ছেলেটা বলে ।
আর ঐডা কি ?
রন্জু মাঝখানের থালাটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে ।
ঐ ডা গরুর মাংস । আর এইডা কাচকি বুনা । কুনডা দিমু ?
সবই দে ।
সব খাইবেন ? ছেলেটা অবাক হয়ে তাকায় ।
আরে বাবা তিনডা বাটিতে তিনজনরে দে । যেইডা ভাল লাগে হেইডা বেশি খামু ।
খেতে শুরু করে বুঝলাম । খাবার খাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না । এমন ঝাল যে নাক মুখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো । মাংসটা কোন অবস্হাতেই নরম করতে পারলাম না । খাওয়ার পালা শেষ করে আমরা সিগারেট ধরালাম ।
মাহাবুব টেবিল থেকে প্লেট নিয়ে যাচ্ছে ।
তুই কি নিখিলেসকে চিনিস ? রন্জু জিজ্ঞেস করে ।
না । মাহাবুব টেবিল মুছতে মুছতে উত্তর দেয় ।
চৌধুরী বাড়ি চিনোস ?
হু ; চিনি ।
আমরা ঐ বাড়ী যামু ।
ঐ বাড়ী যাইবেন ? ছেলেটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ।
হু । মনে হইল অবাক হইছোস ?
ঐ বাড়িতে কেউ থাকেনি ? কার কাছে যাইবেন ?
নিখিলেসের কাছে যামু । রন্জু ছেলেটার সঙ্গে কথা বলছে ।
ঐ নামে কাউরে চিনি না । ছেলেটা আর দাঁড়ায় না ।
মহাবুব চা হইবো রে ? তোজা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ।
না ।
কোথাও থেউকা আইনা দিতে পারবি না ?
না । আপনারা উডেন হোডোল বন্ধ করমু ।
বলোস কি ? আমি চমকে উঠে বললাম । এখন বাজে কয়টা যে হোটেল বন্ধ করবি ? আমি ঘড়ি দেললাম সোয়া পাঁচটা বাজে ।
আপনেরা উডেন ।
তোর বিল দে ।
১০০ টাহা দেন । এহানে যা খাইবেন পয়ত্রিশ টাহা । তিন জনে হইছে ১০৫ টাহা । পাচঁ টাহা মাপ । ১০০ টাহা দেন ।
ছেলেটা সত্যি সত্যি হোটেলের ঝাপ নামাতে লাগলো । আমরা টাকা দিয়ে বেড় হয়ে এলাম । বেড় হবার আগে জেনে নিলাম চৌধুরী বাড়ি যাবার রাস্তা । হোটেল থেকে বেড় হয়ে দেকি যে দুটো দোকান খোলা ছিল সেগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে । আমি অবাক হয়ে বললাম- কোন ভুতরা জায়গায় এলামরে বাবা । মাহাবুবের দেখানো পথ ধরে আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা সাকোর কাছে এসে পৌছালাম । আমরা যে রাস্তাটা দিয়ে হাটছি সেটা মাটির একটা রাস্তা ।অতি মাত্রায় নির্জন । কেমন গা ছমছম করে । তারউপরে সন্ধ্যা হয়ে আসছে । রাত্রিরে কোথায় থাকবো তা ভেবে আমি ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে আছি । ওদের দু’জনের মধ্যে কোন চিন্তা দেখছি না । দু’জনই বেশ নিশ্চিন্তে হাঁটছে । তোজা একটু পর পর ভাঙা গলায় গান গাইছে -সোয়া চাঁদ পাখি আমার সোয়া চাঁদ।
সাকোটা পার হয়ে আমরা যখন এপারে এসে দাঁড়ালাম । তখন কোথাও থেকে অস্পস্ট ভাবে আযানের শব্দ এসে কানে লাগলো । সেই সঙ্গে ঠুং ঠুং ঘন্টির শব্দও শুনতে পেলাম । সাকো থেকে চিকন দু’টো পথ দু’দিকে চলে গেছে । আমরা কোন পথটা দিয়ে যাবো বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলাম । দু’টো পথই ঝাপসা দেখাচ্ছে । সন্ধ্যা হয়ে গেছে । ঝি ঝি পোকাদের ডাক শোনা যাচ্ছে ।
কি রে কোন দিকে যামু ? রন্জু জিজ্ঞেস করলো ।
বুঝতে পারছি না । দুটো পথের দিকে ভালকরে তাকিয়ে আমি বললাম – ডান দিকের পথটা বেশি পরিস্কার মনে হচ্ছে। মনে হয় এগিকটা দিয়ে লোক চালাচল আছে এদিকটা দিয়েই চল ।
ঠিক আছে চল । রন্জুর বলা শেষে যেই পা বাড়াবো ওমনি প্রায় হুট করে বাম পাশের রাস্তাটা থেকে একটা লোক উদয় হলো । ধুতি ফোতুয়া পরে আছে । আমাদেরকে দেখে বললো -নমস্কার । আমরা মাথা নাড়ালাম । আপনারা কি নিখিলেস বাবুর কাছে এসেছেন ? আমরা সবাই প্রায় এক সঙ্গে মাথা নেড়ে হ্যা বললাম ।
চলুন আমার সাথে বাবু আপনাদের নিতে পাঠিয়েছেন ।
আমাদের নিতে এসেছেন আপনি ? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম ।
আপনারা ঢাকা থেকে এসেছেন তো ?
হ্যা ।
বাবুর আপনাদের সঙ্গে লেখা পড়া করতেন তো ?
কে নিখিলেস ?
জি । আমি তেনার কথাই বলছি ।
হ্যা । ও আমাদেরে সঙ্গেই পড়তো ।
তা হলেতো ঠিকই আছে । আমি আপনাদেরই নিতে এসেছি । তিনি আপনাদের এগিয়ে নিতে পাঠিয়েছেন । দেন তো বাবুরা আপনাদের ব্যাগগুলো আমাকে দেন । এই তোরা কৈই গেলি ?
অন্ধকার থেকে বল্লম হাতে কালো মোটা দুটো লোক বেড় হয়ে এলো ।
নে নে বাবুদের ব্যাগ গুলো নিয়ে নে । তা বাবুরা আমার না হেমন্ত । আমি বাবুর খাসলোক হুকুমের গোলাম । আপনারা নিশ্চিন্তে আমার সঙ্গে চুলুন ।
কিন্তু নিখিলেস কি ভাবে জানলো যে আমরা আসছি ?
তোজা হেমন্তের দিকে তাকিয়ে বললো ।
তিনি সব জানেন বাবু । না জানলে কি চলে ? এতো বড় জমিদারী চালানো কি চাট্রিখানি কথা ।
কি বললে ছাগলটা জমিদার নাকি ? রন্জু কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মোটা লোক দুটো রন্জুকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো । কি বললি তুই বাবুকে কি বললি বলে দু’জনই রন্জুর বুক বরাবর বল্লম তাক করলো ।
আরে করে কি ?করে কি ? বলে আমি হেমন্তর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলাম ।
এ্যই মুখ্যর দল তোরা থাম । তেনারা বাবুর বন্ধু মানুষ । তেনারা বাবুকে যা ইচ্ছে বলতে পারে ।সর সর পোড়ামুখোরা সড়ে যা বলছি ।
কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে দু’জন সরে গেল । তারপর আমাদের ব্যাগ গুলো তুলে নিয়ে হাটতে লাগলো । রন্জুর ব্যাগটা পরে রইল মাটিতে । ওরা সড়ে যেতেই আমরা দ্রুত গিয়ে রন্জুকে মাটি থেকে তুলে নিলাম । হেমন্ত রন্জুর ব্যাগটা মাটি থেকে তুলতে তুলতে বললো -বাবুরা কিছু মনে মনে নেবেন না । এরা গ্রাম্য মুর্খ্য-সুখ্য মানুষ কিছু বুঝে না। রন্জু ভেবাচেকা খেয়ে গেছে । ও উঠে প্যান্ট ঝাড়তে লাগলো ।
চলেন বাবুরা । তারা তারি পা চালান । তিনি আপনাদের প্রতিক্ষায় আছেন । এমন সময় কোথা থেকে অ—-উ—-উ করে শেয়ালের ডাক শুনা গেলো । আমারা দ্রুত পা চালালাম । হেমন্ত যেন উড়ে চলছে । আমরা বারবার পিছিয়ে পড়ছি । রন্জ একদম চুপ মেরে গেছে । কোন কথা বলছে না । রাস্তার দু’পাশে ঘন ঝোপ জঙ্গল । হঠাৎ আমার কাছে মনে হলো আমাদের ফলো করে কারা যেন ঝোপ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটে চলছে । দু ‘ একবার তাকিয়ে আমি দেখতে চেষ্টা করলাম । কিন্তু নিকোষ কালো অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পরলো না । তোজার দিকে তাকালাম ও’ও আমার দিকে তাকাল । হেমন্ত প্রায় উধাও হয়ে গেছে । আমরা প্রায় আন্দাযের উপড় হাটছি । এক সময় চোখে কিছু না দেখে আমি ডাক দিলাম – হেমন্ত বাবু ? হেমন্ত বাবু ?
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার পেছন থেকে জবাব এলো -এ্যাই যে বাবু আমি । একটু পিছিয়ে পরেছিলাম ।
আপনি পিছিয়ে পরেছিলেন ? আপনি তো আমাদের সামনে সামনে হাঁটছিলেন । তোজা আর আমি প্রায় এক সাথে বলে উঠলাম ।
কৈই বাবুরা আমি তো পেছনেই ছিলাম । হয়তো অন্ধকারে ঠাওর করতে পারেননি । চলেন বাবুরা চলেন দেরি হয়ে যাচ্ছে আবার ছুটতে লাগলো ।
হেমন্ত এখটু আস্তে হাটেন না । আমাদের হাঁটতে তো কষ্ট হচ্ছে ।
জ্বি বাবু । বলে হেমন্ত প্রায় আমার গা ঘেষে হাটতে লাগলো । আরো প্রায় আধা ঘন্টা হাটার পর আমরা বিশাল একটা বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ালাম । বাড়ী না বলে একে প্রাসাদ বলাই ভাল । বিশাল গেট ঢেলে ডুকতেই বিশাল উঠান উঠানের শেষ মাথায় প্রাসাদের ভেতরে ঢুকার সিঁড়ি । সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে নিখিলেস । ওর দুপাশে আরো দু’জন বাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে । আমারা কাছে যেতেই নিখিলেস দু’সিড়ি নেমে এলো । একে একে আমরা সবাই হাত মেলালাম । যে নিখিলেশের জন্য এতোটা ছুটে আসা সে নিখিলেসকে যোনো আমরা পেলাম না ।
কোথায় জানি সুতা ছিড়ে যাওয়ার টের পেলাম । আসরে রন্জুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাই পুরো পরিস্থিকে পাল্টে দিয়েছে । নিখিলেস কিন্তু আমাদের সঙ্গে যথেষ্ট স্বাভাবিক আচড়ন করার চেষ্টা করলো -রন্জুর মুখ কালো দেখে নিখিলেস ওর কাঁধে হাত রেখে বললো- তুই মন খারাপ করিস না । দেখ আমি জানোয়ারটাকে কি করি । তার পরেই হাক দিলো কৈই রে জানোয়ার দু’টো কৈই ?
উঠানের এক পাশ থেকে সেই লোক দুটো বেড় হয়ে এলো – ওদের কে দেখেই নিখিলেস চিৎকার করে উঠলো -তোরা আমার বন্ধুর শরীরে হাত দিছোস কোন সাহসে । নিখিলেসের এমন রুপ আমরা কোন দিন দেখিনি ।
লোক দুটো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে । নিখিলেস ওর ডান হাতটা মেলে ধরলো সঙ্গে সঙ্গে পাশে দাঁড়িয়ে একজন
একটা তরবারি ওর হাতে তুলে দিল । বাতির আলো খোলা তরবারিটা যেন রক্তের নেশায় চকচক করে উঠলো । আমরা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছি ।
কিছু বুঝে উঠার আগেই । নিখিলেস সিঁড়ি থেকে নেমে লোক দুটৌর কাছে গিয়ে দাড়াঁল । তারপর যে লোকটা রন্জুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো সে লোকটাকে তরোয়ালের আগা দিয়ে ঠেলে আলাদা করে ফেললো । অজানা কোন আসংন্কায় আমি ডাক দিলাম নিখি ? নিখিলেস আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো । আমি বুঝলাম নিখিলেস লোকটাকে ভয় দেখিয়ে রন্জুকে খুশি করতে চেষ্টা করছে । নিখিলেস লোকটাকে বললো বসে পর । লোকটা বিনা বাক্যে মাথা নীচু বসে পরলো । নিখিলেস লোকটার ঘাড়ে তরোয়ালটা রেখে বললো -আমার বন্ধুর শরীরে হাত দেয়ার অর্থ হচ্চে মৃত্যু । আমি বুঝেছি নিখি মজা করছে । হঠাৎ নিখি বলে উঠলো রন্জু এটা তোর জন্য -জয় মা কালি বলেই নিখিলেস তরোয়ালটা মাথার উপরে তুলে নীচে নামিয়ে আনলো । আমারা কিছু বুঝে উঠার আগেই লোকটার মাথা শরীর থেকে ছিটকে মাটিতে পরলো । তীরের বেগে বের হওয়া রক্ত এসে আমাদের শরীরে লাগলো । আমরা সবাই ভয়ে আতন্কে এক সঙ্গে চিৎকার করে উঠলাম । আমাদের পেছনে দাঁড়িয় থাকা সবাই এক সঙ্গে বলে উঠলো জয় মা কালি । আমি বমি করে দিলাম ।
পেছন থেকে কয়েক জন আমাদের শক্ত করে ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে লাগলো । আমি পেছন ফিরে দেখলাম -লোকটার কাটা শরীরটা কাটা মাছের মতো লাফাচ্ছে । আমি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পরে গেলাম ।
যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি । আমাকে ঘিরে বসে আছে তোজা ,আর রন্জু মেঝেতে একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে আছে নিখি মানে নিখিলেস । পরনে দুধ সাদা পান্জবি আর ধৌতি । দেয়ালে একটা মশাল জ্বলছে ।
কি রে কেমন বোধ করছিস ? আমাকে তাকাতে দেখে নিখিলেস জিজ্ঞেস করলো । আমি কিছু না বলে রন্জু আর তোজার দিকে তাকালাম । ওদের মুখ থমথমে হয়ে আছে ।
শুন ! গরম পানি দেওয়া হয়েছে যা গোসল করে ফ্রেস হয়ে নে । তোদের সঙ্গে অনেক কথা আছে ; আমাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো নিখি ।
তুই একটা মানুষ মেরে ফেললি নিখি ? আমি বলে উঠলাম ।
ওরা জন্মেছেই মরার জন্য । সব পরে বলবো , যা গোসল করে খেতে আয় ; বলে নিখিলেস হাতে তালি দিলো । সঙ্গে সঙ্গে দু’জন মহিলা এসে ঘরে ডুকলো । নিখি বললো ওদের গোসল খানায় নিয়ে যাও । ভাল করে সেবা করো । সাবধান ওরা আমার বন্ধু । আমরা উঠে মেয়ে দুটোর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম । মনে হচ্ছে সারা শরীর অবস হয়ে আছে । কোথায় পা ফেলছি বুঝতে পারছি না । রন্জু আমার পাশ দিয়ে হাঁটছিল আমি ওর কাঁদে হাত রাখলাম ।
অনেক বদলে গেছে রে । অনেক বদলে গেছে ,ফিসফিস করে বললো রন্জু । ঘর থেকে বেড় হয়ে বারান্দা দিয়ে যাবার সময় দেখলাম দু’জন লোক উঠানটা পানি দিয়ে ধুচ্ছে । আমার মাথা আবারও গুলিয়ে উঠলো ।
ধৈর্য্য ধর । আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে, এরা কেউ নরমাল না । রন্জু খুব নীচু স্বরে কথাটা বললেও সামনে হাঁটতে থাকা মহিলাটা আমাদের দিকে ফিরে বললো -সে চিন্তা ভুলেও করবেন না বাবুরা । তেনারা ছিড়ে টুকরা টুকরা কইরা ফেলবে । ভুল কইরেন না । এখান থেকে পালানোর কোন পথ নাই । মহিলাটা আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো -কেমন একটা বিশ্রী গন্ধ এসে নাকে লাগলো । আমি মুখ সরিয়ে নিলাম ।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা বিশাল একটা গোসল খানায় এসে দাঁড়ালাম । দুটো বড় বড় বাথটাবে পানি টলমল করছে । বার্থটাবের পাশে পরপর সাজানো চারটে পিতলের ঘটি রাখা । মহিলা দু’টো আমাদের জামা খুলে দিতে উদ্দ্যত হলে আমরা সড়ে গেলাম । তোজা বললো -আপনারা বাহিরে গিয়ে দাঁড়ান আমরা গোসল শেষে আপনাদের ডাকবো । মহিলা দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে বেড় হয়ে গেল ।
রন্জু বললো – এরা স্বাভাবিক না। এখন বুঝতে পারছি ,চৌধুরী বাড়ির নাম শুনার পরে সবাই কেন এমন চমক চমকে উঠছিল ।
তয় এখন কি করমু ? তোজা জিজ্ঞেস করে ।
কি আর ওরা যা বলে তাই করমু , ভায়ে ভায়ে থাকতে হবে । সুযোগ এলে প্রথম সুযোগেই পালামু ।
কিন্তু ঐ মহিলা যে কইলো … আমি রন্জুর গা ঘেষে দাঁড়িয়ে বললাম ।
আরে রাখ ; অমন কথা ভয় দেখানোর জন্য অনেকে কয় । আমাদের ভয় পেলে চলবে না । মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে ।
আমার কিন্তু মনে হয় না মহিলা মিথ্যা বলেছে , তোজা আমার কথার সমর্থন দেয় ; একটু থেমে আবার বলে –
আর দেখোছ না একেক জন ক্যামন অন্ধকারে মিশে থাকে ? ডাক দিলে সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হয় । আমার কিন্তু দোস্ত অনেক ভয় করছে ।
ভয়ের কিছু নাই । আমরা যতোক্ষন নিখির কথা মতো চলমু ততোক্ষন মনে হয় না কেউ আমাদের কোন ক্ষতি করার সাহস পাবে । আমি রন্জুর কথার সমর্থনে মাথা নাড়ারাল ।
এখন চল তারাতারি গোসল করে নিখির কাছে যাই । দেরি করলে ও আবার সন্দেহ করতে পারে । রন্জু সাট প্যান্ট খুলে একটা ঘটি হাতে তুলে নিয়ে শরীরে পানি ঢালতে লাগলো ।
তোর কি মনে হয় এটা আমাদেরই নিখিলেস ? সাট খুলতে খুলতে তোজা আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে ।
বিন্দু মাত্র সন্দেহ নাই ,এটাই আমাদের নিখিলেস । তোদের মনে আছে নিখির বাম হাতে একটা কাটা দাগ ছিলো ?
আমি মাথা নাড়লাম ছিলো । ছিল ।
আমি ঐ দাগটা আজও ওর হাতে দেখেছি । রন্জু বিজ্ঞের মতো বললো । নে এখন তারাতারি গোসল কর । বলে রন্জু মাথায় পানি ঢাললো ।
গোসল করে আমরা রুমে এসে জামা কাপড় পাল্টালাম । হেমন্ত এসে আমাদের ড্রাইনিং রুমে নিয়ে গেল । বিশাল একটা রুম । মাথার উপড় ঝাড় বাতি জ্বলছে । মার্বেল পাথরের টেবিলের চর্তুর দিকে চেয়ার সাজানো । টেবিলের এক মাথায় টেবিলের এক মাথায় বসে আছে নিখিলেস । টেবিলের উপড় নানান রকমের খানা খাদ্য । হঠাৎ খাবারের গন্ধ নাকে এসে লাগাতে পেট চো চো করে উঠলো ।
এদিকটায় বোস । নিখিলেস দু’হাত তুলে ওর দুপাশের চেয়ারগুলো আমাদের দেখিয়ে দিলো । আমি আর তোজা একপাশে অন্যটাতে রন্জু বসলো । নিখিলেস বললো নে শুরু কর । আমরা খেতে শুরু করলাম । কোন খাবারেই তেমন টেষ্ট বুঝতে পারলাম না । মুখে দেবার পর মনে হলো আজব কিছু চিবিয়ে চিবিয়ে গিলছি । আমাদের খাবার পরিবেশন করা জন্য জনা দুই লোক দাঁড়িয়ে আছে । সবাই নিখিলেসের সামনে নিচের দিকে চেয়ে আছে । হেমন্তু এসে নিখিলেসের কানে কানে ফিস ফিস করে কিছু বললো । সঙ্গে সঙ্গে নিখিলেস উঠে দাঁড়িয়ে বললো-তোরা খা আমি আসছি।তারপর দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো -খেয়াল রেখিস বাবুদের কিছু লাগবে কিনা ।
জি বাব । প্রায় এক সঙ্গে সবাই বলে উঠলো । নিখিলেস হেমন্ত কে নিয়ে বেড় হয়ে গেল । আমরা কোন কথা বললাম না । চুপচাপ খেয়ে দেয়ে মেয়ে গুলোর পিছু পিছু বারান্দা দিয়ে আগের সেই রুমটাতে এসে বসলাম । চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘরটা গোছগাছ করা হয়েছে । বিছানায় নতুন চাদর লেগেছে । জানালার পাশে দুটো সিঙ্গেল সোফা দেখতে পাচ্ছি । আমি জানালার কাছে হাতল ওয়ালা চেয়ারটাতে বসেছি । রন্জু আর তোজা বিছানায় । রন্জু জানালাটার দিকে তাকিয়ে বললো এটা কি খোলা যায় না ?
খুলে দেবো বাবু ? দু’জন মহিলার একজন বললো ।
দিননা প্লিজ । খুব গরম লাগছে ।
একজন এগিয়ে এসে আমার উপড় দিয়ে জানালা খুলে দিতে লাগলো । আমি চেয়ার থেকে উঠে যাবার কোন সুযোগ পেলাম না । মহিলা হাত উঁচিয়ে যখন জানালার উপরের সিটকিনিটা খুলছিল তখন তার শরীরটা আমার হাতের সঙ্গে প্রায় চেপে থাকলো । আমি অসস্থির মধ্যে পরে গেলাম । আমার মনে হলো মহিলা ইচ্ছা করেই একটু বেশি সময় নিয়ে জানালাটা খুললো । জানালা খোলা শেষে মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে সড়ে গেল । আমি কেমন অসুস্থি নিয়ে রন্জু আর তোজার দিকে তাকালাম । দেখলাম ব্যাপারটা ওরা যেন খেয়ালাই করলো না । জানালাটা খুলতেই দমকা একটা হাওয়া এসে আমাদের চোখে মুখে লাগলো । অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পেলাম সামনে একটা পুকুর । হালকা চাঁদের আলোয় পানি চকচক করছে । হাসনা হেনা ফুলের গন্ধ এসে নাকে লাগলো ।
দারুন দৃশ্য তো । বলে তোজা জানালার কাছে এগিয়ে গেল । আমরা মুগ্ধ হয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম । হঠাৎ মহিলাদের একজন বলে উঠলো -বাবু বেশি রাতে জানালা খোলা রাখবেন না ।
কেন ? আমি জিজ্ঞেস করলাম ।
এমনি বাবু ! নানান জিনিষ আছে ।
কি নানান জিনিষ ? আমি আবার জানতে চাইলাম ।
সে আমরা বলতে পারবো না । আমরা তাহলে এখন যাই । বলে দু’জনই ছুটে বেড় হয়ে গেল । রন্জু উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল । আমরা তিনজন খাটে পা তুলে আরাম করে বসলাম । নানা বিষয় কথা বলতে বলতে চোখ লেগে এসেছিল ।
হঠাৎ দরজায় খুট খুট শব্দ হতে আমি আর রন্জু উঠে বসলাম । দু’জন দু’জনার মুখ চাইয়া করছি কে হতে পারে তা ভেবে । এমন সময় দরজাটা আপনা আপনি খুলে গেল – ভেতরে ডুকলো নিখিলেস । আমি অবাক হলাম সিটকিনি লাগানো দরজা আপনা আপনি খুললো কি ভাবে ? আমাদের বসে থাকতে দেখে নিখি বললো-কিরে ঘুমিয়ে পরেছিলি নাকি ? তারপর ও খোলা জানালাটার দিকে একবার তাকাল ।
জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে । সারা দিন জার্নি করেছি তো তাই মনে হয় চোখ লেগে এসেছিল- রন্জু হাই তুলতে তুলতে বললো ।
তা তুই কি মনে করে ?
তোদের বউ দি এসেছে ।
বলিস কি ? তুই বিয়েও করেছিস নাকি ? বলে আমরা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম । তোজা ও উঠে গেছে । তা আসতে বল বউদি কে ভেতরে আসতে বল ।
তমা ভেতরে আস । নিখিলেস দরজার দিকে তাকিয়ে বললো ।
মাথায় কাপড় দেয়া খুব ফর্সা গোল চেহারার বিশ পচিশ বছরের শাড়ি পরা একটা মেয়ে ভেতরে ডুকলো । পেছনে আর দু’জন মেয়ে । তাদের একজন হাতে একটা ট্রে ধরে আছে । তাতে চার পাঁচটি গ্লাসে লাল রঙের কিছু একটা পর্দাথ । খুব সম্ভব শরবত হবে ।
আমরা এক সঙ্গে সবাই বললাম -বউদি নমস্কার ।
নিখিলেসের বউ হেসে বললো-নমস্কার । তারপর আমাদের হাতে একটা করে গ্লাস তুলে দিয়ে বললো -আপনাদের জন্য ডালিমের শরবত , আমি নিজে তৈরি করে এনেছি , পান করুন ভাল লাগবে ।
আমরা শরবত মুখে দিলাম । নিখিলেশ ও নিলো এক গ্লাস । ও ডগডগ করে পুরো শরবতটা একবারে শেষ করে ফেললো । আমার শরবতটা মুখে দেবার পর মনে হলো নোনা কিছু একটা মুখে দিয়েছি । আমি খেতে পারলাম না । নিখিলেসের বউ এর অনুরোধে আর দু’ডোক গিলে রেখে দিলাম । নিখিলেস কাল কথা হবে বলে বউসহ চলে গেল । আমার ভেতটা ক্যামন গুলাতে লাগলো । আমি টেবিলের উপড়ে রাখা জগ থেকে পানি খেলাম । জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি পুকুরের পানি কেমন চকচক করছে । হঠাৎ একটা ঝোপের দিকে চোখ যেতেই দেখলাম একটা কুকুরের মতো কি যেন বসে আছে । মুখটা লম্বা । চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে । আমি রন্জুকে দেখিয়ে বললাম ওটা কিরে ?
কৈই ?
ঐ যে বা দিকের ঝোপের পাশে বসে আছে কুকুরের মতো । আমি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম ।
মনে হচ্ছে তো কুকুরই ।
কিন্তু কুকুরের মুখ কি এতো লম্বা হয় ? তোজা আমার মনের কথাটাই বললো ।
হা মুখটাতো ওতি লম্বা মনে হচ্ছে । নেকড়ে টেকরে নাতো ?
রন্জু একটু চিন্তিত ভাবে বললো ।
এখানে নেকড়ে আসবে কোথা থেকে ?
আমি কি করে বললো কোথা থেকে এসেছে ? মনে হলো তাই বললাম । এমনিতে যে ভুতরা পরিবেশে আছি তাতে কুকুর না হয়ে এপরিবেশে নেকড়েই মানায় । রন্জু কিন্চিত হেসে বললো ।
ঐ দেখ আরেকটা তোজা হাত দিয়ে দেখালো । আমরা অবাক হয়ে দেখলাম সত্যিই আরেক এসে আগেরটার পাশে বসেছে । তার পর আরেকটা ,তারপর আরেকটা ; এমন করে প্রায় শ’খানেক নেকড়ে এসে পুরো পুকুরটাকে ঘিরে গোল হয়ে বসলো । আমারা সবাই বড় বড় চোখ করে দেখছি । কারো মুখে কোন কথা সরছে না । এখন বুঝতে পারলাম মহিলা কাদের কথা বলেছিল যে ,তেনারা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে । হঠাৎ নেকড়েগুলো আকাশের দিকে মুখ করে আ———–উ——-উ—-উ করে একসঙ্গে ডেকে উঠলো । আমাদের সবার কানে তালা লেগে যাবার যোগার হয়েছে । আমরা পরস্পর মুখ চাওয়া চায়ি করলাম । আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি চাঁদটা মেঘে ডেকে গেছে হাঠাৎ করেই যেন অন্ধকার নেমে এলো । রন্জু তারাহুরো করে জানলাটা বন্ধ করে দিলো ।
অনেকক্ষন যাবৎ সবাই চুপচাপ শুয়ে আছি । কেউ কথা বলছি না । কথা বলতে ভালও লাগছে না । মনে মনে সবাই একই চিন্তা করছি কখন ভোর হবে আর এখান থেকে পালাবো । আমি ঘড়ি দেখলাম ত টা দুই মিনিট । কেমন একটা দুপ দুপ শব্দ ভেসে আসছে জানালার ওপাশ থেকে । মনে হচ্ছে কেউ ঘাসের উপড় জোরে জোরে পা ফেলে হাঁটছে । রন্জু আমাগকে বললো দেখবি নাকি কে হাটছে ?
আমি কিছু বলার আগেই ও আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে কোন শব্দ না করে জানালাটা একটু ফাঁক করে বাহিরে তাকিয়ে থাকলো ।
আমি শুয়ে শুয়ে দেখছি ও কি করে । রন্জু জানালা থেকে চোখ না সড়িয়েই একটা হাত পেছনে দিয়ে আমায় ডাকতে লাগলো ।
আমি উঠে এসে ওর পেছনে দাঁয়ে বললাম কি ? রন্জু ফিসফিস করে বলল ,চুপ কোন কথা বলবি না , দেখ ; বলে আমাকে দেখার সুযোগ করে দেবার জন্য একটু সড়ে দাঁড়াল ।
আমি জানালার ফাঁকটুকু দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে চমকে উঠলাম – সন্ধ্যায় নিখিলেস যে লোকটার মাথা কেটে ফেলেছিল সে লোকটা বাহিরে হাঁটছে । এক হাতে একটা লাঠি অন্য হাত দিয়ে নিজের কাটা মাথাটা ধরে আছে । আমি ভয়ে ছিটকে পেছনে চলে এলাম , কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলাম ; রন্জু বললো কোন শব্দ করিস না । ভয়ে আমার শরীর অবস হয়ে যাচ্ছে , হাত পা গুলো মনে হলো কাঁপছে । আমি চেয়ারে বসে পরলাম । নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না । মরা মানুষ আবার হাঁটে কি ভাবে ?
এদিকে আয় এদিকে আয় রন্জু আবার আমাকে ডাকলো । আমি এগিয়ে গিয়ে বাহির তাকালাম – দেখি মাথা কাটা লোকটা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে । অন্ধকার থেকে বেড় হয়ে এলো নিখিলেশ । পা পযর্ন্তু কেমন কালো একটা আলখাল্লা পরে আছে । ও এসে সোজা দাঁড়ালো মাথা কাটা লোকটার সামনে । নিখিলেশের সামনে লোকটা হাঁটু ঘেরে বসে পরলো । নিখিলেশ লোকটার কাটা মাথাটা হাতে তুলে নিয়ে লোকটার কাটা ঘারের উপড় রাখলো তারপর কাটা গলাটার উপর হাত বুলিয়ে দিতেই কাটা মাথাটা শরীরের সঙ্গে লেগে গেল ।
আমরা আবার ও বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে গেলাম । বিস্ময়ের গোর কাটতে না কাটতেই দেখলাম – মাথাটা জোড়া লাগতেই লোকটা এলো মেলো এদিক ও দিক পা ফেলে আবার এসে দাঁড়ালো নিখিলেসের সামনে , নিখিলেস ওর বাম হাতটা লোকটার কাধে রাখতেই লোকটা মাটিতে বসে পরলো । পুকুর পাড় থেকে নেকরে গুলো এসে লাইন দিয়ে লোকটার পেছনে বসেছে । নিখিলেস একবার চাদের দিকে তাকিয়ে আমাদের জানালার দিকে তাকালো । ভয়ে আমি আর রন্জু চট করে সড়ে গেলাম । দু’জনই কাঁপছি । বুকটা হাপারের মতো লাফাচ্ছে । আমার হঠাৎ মনে হলো আমি মরে যাবো । কিন্তু বাহিরে কি হচ্ছে তা দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না । রন্জু এগিয়ে যেতেই আমিও ও’র পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম । বাহিরে তাকিয়ে দেখি নিখিলেস ওর আলখাল্লার পকেট থেকে চকচকে একটা ছুরি বেড় করে নীজের হাতে একটা পোচ দিলো -সঙ্গে টপটপ করে রক্ত বেড় হয়ে এলো । নিখিলেস কাটা মাথা ওয়ালার মুখের উপড় ওর হাতটা ধরেতেই লোকটা মুখ হা করলো .টপটপ করে লোকটার মুখের ভেতর নিখিলেসের হাত থেকে রক্ত পরতে লাগলো । সঙ্গে সঙ্গে নেকড়েগুলো আ——উ—উ——–করে ডেকে উঠলো । লোকটা পিছিয়ে গিয়ে নেকড়ে গুলোর সঙ্গে চাঁদের দিকে মুখ করে গলা মেলাল । আমি স্পষ্ট দেখলাম নিখিলেশের রক্তে লোকটার মুখ আর বুক কালো হয়ে আছে । নিখিলেশ ও চাঁদের দিকে মুখ করে আ——উ—উ——–করে ডেকে উঠলো । আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম নিখিলেশ ডেকে উঠতেই নেকড়েগুলো ডাক বন্ধ করে দিয়ে – জঙ্গলের ভেতর ছুটে পালাল । নিখিলেশ ডাকতেই থাকলো । হঠাৎ খেয়াল করলাম কাটা মাথা ওয়ালা লোকটা আস্তে আস্তে নেকড়েতে পরিনত হয়ে যাচ্ছে । পুরোপুরি নেকড়েতে পরিনত হতেই নেকড়েটা আমাদের দিকে তাকাল । ভয়ে আমাদের কল্জে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে । বুঝতে পারছিনা স্বপ্ন না বাস্তব্যে দেখছি । নেকড়েটা জানালা দিকে তাকিয়ে তাকালো নিখিলেসের দিকে । নিখিলেসও তাকালো জানালার দিকে আমার কাছে মনে হলো ওরা বুঝতে পেরেছে আমরা ওদেরকে দেখছি । আমি রন্জুকে ধরে পেছনে টেন আনলাম । ফিসফিস করে বললাম -বাচঁতে হলে আমাদের পালাতে হবে । অবশ্যই পালাতে হবে । হাঠাৎ জানালায় খরররর খরররর শব্দ হতে লাগলো । মনে হলো নেকড়েটা নোখ দিয়ে আচড় কাটছ। রন্জু আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি করমু ? আমি বললাম চুপ করে থাক । হঠাৎ বারান্দা থেকে পায়ে হাটার শব্দ ভেসে এলো । মনে হলো কে যেনো হেটে আমাদের দরজার দিকেই আসছে । রন্জু একলাফে খাট থেকে নেমে গিয়ে জানালার কাছে থাকা একটা সিঙ্গেল সোফা টানতে লাগলো । আমিও নেমে দিয়ে হাত লাগালাম । দু’জন মিলে যেই না দরজায় সোফাটা চাপা দিয়েছি ওমনি দরজায় শব্দ হলো । সেই জানালার খরররর খরররর শব্দ ।
হঠাৎ তোজা শোয়া থেকে উঠে বসে বললো পানি খাবো । আমাকে পানি দে ।
আমি টেবিল থেকে গ্লাসে ঢেলে ওক পানি দিলাম । পানি খাওয়া শেষ করে ও বললো- কি হয়েছি ?
রন্জু বললো কে যেন ঘরে ঢুকতে চাচ্ছে ।
কে ঘরে ঢুকতে চাচ্ছে ? তোজা পাল্টা প্রশ্ন করলো ।
জানি না । আমি ফিসফিস করে বললাম ।
হয়েছে শুয়ে পর বলে তোজা শুয়ে পরলো । আমি আর রন্জু বাকি রাত টুকু বসে কাটালাম ।
দরজায় দুম ধাম শব্দে ঘুম ভাংলো আমাদের । মনে হচ্ছে দরজাটে কেউ ভেঙ্গে ফেলবে । জানালার ফাক ফোকর দিয়ে ঘরে আলো আসছে । আমরা বুঝতে পারলাম বেশ বেলা হয়ে গেছে । রন্জু উঠে জানালাটা খুলে দিল । আলোতে পুরো ঘরটা যেন নেচে উঠলো । দরজায় আবার শব্দ হতেই রন্জু জিজ্ঞেস করলো কে ?
বাবু আমি । অনেক বেলা হয়েছে । উঠবেন না ।
আমি হাত ঘড়ি দেখে চমকে উঠলাম ২ টা বাজে । রন্জু আর আমি মিলে দরজা
আমি হাত ঘড়ি দেখে চমকে উঠলাম ২ টা বাজে । রন্জু আর আমি মিলে দরজার সামনে থেকে সোফাটা সড়িয়ে দরজাটা খুলে দিলাম । আমাদের বয়সিই একজন দাড়িয়ে আছে । আমাদের দরজা খুলতে দেখে বললো – বাবুরা নমস্কার । আমি বললাম – তুমি কে ?
জি ; আমার নাম নগেন । আমি এ বাড়িতে কর্ম করি ।
কাল কি তোমাকে দেখেছি ?
না বাবু আমি রাতে এখানে থাকি না । সন্ধ্যায় চলে যাই বাবু !
কেন চলে যাও ? ভুতের ভয়ে ? রন্জু সরাসরি জিজ্ঞেস করলো ।
নগেন কিছু বলেনা , চুপকরে থাকে ।
কি হলো কথা বলছো না কেন ? রন্জু চিৎকার করে উঠে ।
বাবুরা খাতে আসে , খাবার দেয়া হয়েছে । বলে নগেন আর দাড়ায় না চুটে চলে যায় । রন্জু আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে তারাতারি রেডি হয়েনে চলে যেতে হবে । হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে আমরা জামা কাপড় পরে নেই । নগেন এসে আবার দরজায় দাঁড়ায় বাবুরা খেতে আসেন ।
রন্জু বলে নগেন ভেতরে আসো । নগেন নড়ে না । দরজায়ই দাঁড়িয়ে থাকে ।
আমি জানি তুমি ওদের মতো না , নগেন তুমি আমাদের হেল্প করো । আমরা এখান থেকে চলে যেতে চাই ।
বাবুরা খেতে আসেন । নগেন মাথা নীচু করে বলে ।
তুমি আমাদের হেল্প করবে কিনা বলো ? রন্জু দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই নগেন চেলে যায় । তোরা ব্যাগ গুছিয়ে রাখ আমি আসছি বলে রন্জু ও নগেন এর পেছন পেছন যেতে চায় -আমি ওর হাত চেপে ধরে বলি -একা যাবার দরকার নেই । যা করবার একসাথেই করবো । নগেন কে হাত করতে হবে । আমার মনে হয় না কারো হেল্প ছাড়া একান থেকে বেড় হতে পারবো ।
তুই ঠিক বলেছিস । চল এখন খেতে যাই । তোজা এগিয়ে এসে বললো ।
তাই চল । আমরা আবার ড্রাইনিং রুমে চলে এলাম । টেবিলে নানান রকমের খাবার সাজানো আছে । টেষ্ট গতরাতের মতো না । স্বার্দ বোঝা যাচ্ছে । টেবিলের পাশে শুধু নগেন দাঁড়িয়ে আছে ।
আমরা আর ওকে আমাদের সাহায্য করার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না ।
রন্জু খেতে খেতে বললো -খাবারটা ফাস্ট ক্লাস হয়েছে । নগেন রান্না করেছে কে ?
জি আমি বাবু । নগেন মুখ নীচু করে বলে ।
তুমি বখশিস পাবে । দাঁড়াও খেয়ে নেই ।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে রন্জু সত্যি সত্যি নগেন এর সামনে একটা ১০০ টাকার নোট মেলে ধললো । নাও ,তোমার বখশিস ,
বাবু লাগবে না ।
লাকবে না কেনো ?
নাও বলছি ।
লাগবে না বাবু ।
ভয় নেই কেউ কিছু বলবে না । তুমি নাও ।
আচ্ছা বলো নিখিলেস কোথায় ?
বাবু বাহিরে গেছেন । রাতে ফিরবেন ।
আর আর ওর বউ কোথায় ?
তিনিও বাবুর সঙ্গে গেছেন ।
দেখো নগেন আমার কাছে মিথ্যা বলে কোন লাভ নেই । গতরাতে আমরা সব যেনে গেছি । আমি জানি ওরা সব পিশাচ দিনের বেলায় কোথাও লুকিয়ে থাকে রাতে বেলায়ই শুধু বেড় হয় ।
আমি কিছু জানিনা বাবু । বলে নগেন চলে যেতে উদ্দত হয় । রন্জু খপ করে ওর হাত চেপে ধরে বলে -ঠিক আছে রাতে যখন নিখিলেশ আসবে আমরা তখন ওকে বলবো তুমি আমাদের বলেছো ও’নাকি পিশাচ ।
বাবু আমাকে মারবেন না । আপনাদের পায়ে পরি ,বলে নগেন সত্যি সত্যি রন্জুর পা জড়িয়ে ধরলো ।
আমার কথা শুনলে তোক কথাও আমি শুনবো । রন্জু পা ছাড়াতে ছাড়াতে বললো । উঠ ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শোন ,তারপর সিদ্ধান্ত নে কি করবি ।
নগেন চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাড়াঁলো । বলেন বাবু কি করতে হবে ।
তুই এখানে কি ভাবে এলি । এখানে তো কারো কাজ করার কথা নয় । আমার যতোদূর মনে হয় এখানে কেউ দিনের বেলাতেও আসার কথা না । তুই কিবাবে এলি ?
বাবু আমি শুধু দিনের বেলায় আসি । ভুতের বাড়ি বলে নোক জন এদিকটাতে আসে না , আমি বাবু সপ্তাহে দু’দিন সকালে এসে ঝাড়পোছ করে বিকেল বিকেল চলে যাই । মাসে হাজার তিনেক টাকা পাই বাবু । হেমন্ত বাবু আমাকে নিয়োগ দিয়েছে । অভাবের সংসার বাবু না করতে পারিনি ।
নিখিলেস কবে মারা গেছে ? রন্জু আন্ধাজের উপর ঢিল মারে ?
সে বাবু আমি জানিনা ।
হুম ; তুই থাকিস কোথায় ?
বাবু বাজারের কাছে ।
আসিস কোন পথ দিয়ে ?
বাবু বাড়ীর পেছনে একটা সংক্ষিপ পথ আছে ।
চল আমাদের দেখিয়ে দিবি ।
বাবু তেনারা আমাকে মেরে ফেলবেন । নগেন কান্না করে উঠে । আমার মায়া লাগে । আহারে অভাবে পরে মানুষ কি না করে ।
তোর কোন চিন্তু নেই । তুই শুধু এখন শুধু আমাদের পথটা দেখিয়ে দে । তুই চলে যাবার পরে আমরা চলে যাবো । কেউ বুঝতে পারবে না তুই আমাদের পালাতে সাহার্য্য করেছিস ।
বাবু তেনারা আমাকে মেরে ফেলবেক্ষন ।
না দেখালেও মেরে ফেলবে । আমি সিনেমার বিলেনদের মতো হেসে বললাম ।
নগেন এর পেছন পেছন গিয়ে আমরা সংক্ষিপ্ত পথটা দেখে এলাম । বাড়ির পেছনের প্রাচিরের দেয়াল মাঝ খান দিয়ে ছোট্র একটা পায়ে হাটার রাস্তা চলে গেছ দূরে একটা গ্রামের দিকে । ফিরে এসে যটপট ব্যাগগুলো কাধে নিয়ে যেই না ঘর থেকে বেড় হতেছি , অমনি শুরু হলো প্রচন্ড বেগে বাতাস । মনে হলো ; আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে । আমরা ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে দিলাম । তোজা বললো -নিখিলেস আমাদের বাধা দিচ্ছে নাতো ?
না । ভুলে যাসনে এটা বৈশাখ মাস । মনে হয় কালবৈশাখি ঝড় শুরু হয়েছে । রন্জু জানালাটা একটু ফাঁক করে বাহিরে তাকাল । আমিও দাড়ালাম ওর পাশে । বাহিরে তাকিয়ে দেখি প্রচন্ড বাতাসে পুকুরের পাশের নারিকেল গাছ গুলো যেন একেবারে ভেংগে পড়তে চাইছে । ঘরের ভিতর হুর হুর করে বাতাস ডুকছে । পর পর প্রচন্ডে শব্দ করে দুটো বাজ পরলো । পুরো বাড়িসহ আমরা কেঁপে উঠলাম । আমি জোরে জোরে পড়তে লাকলাম -লাইলাহা ইন্তা আন্তা … জোয়ালমিন ।
যখন ঝড় থামলো তখন অনেক রাত হয়ে গেছে । হেমন্ত এসে দরজায় কড়া নাড়লো । আমরা দু’টো লোহার রড যোগার করে দরজার পেছনে লুকিয়ে রেখেছি । এছাড়া আমাদের কাছে আত্মরক্ষার জন আর কিছু নেই । অনেকক্ষন দরজা নোক কড়ার পর রন্জু দরজা খুলে দিল । দরজা খুলার আগে ও আমাদের বললো খবরদার ওরা যেন বুঝতে না পারে আমরা সব যেনে গেছি । হেমন্ত ভেতরে ডুকে বললো -নমস্কার বাবুরা ।
সারাদিন ছিলেন কোথায় হেমন্ত বাবু । রন্জু হেমন্তকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে উঠলো ।
-বাবুর সঙ্গে গিয়েছিলাম বাবু । আপনাদের কোন অসুবিধা হয়নিতো ।
না , সুবিধা ও খুব একটা হয়নি । খালি বাড়িতে কারইবা ভাল লাগে বলুন ?
আমি দু:খিত বাবু । লোকজন কম হওয়ায় এমনটা হয়েছে ।
তা নিখিলেসের বউ কে ও তো কোথাও পেলাম না । কোথা থেকে এক লোক এসে খাবার দিয়ে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল । তারপর শুরু হলো এই বিচ্ছিরি ঝড় ।
ঠাকুরান ও গিয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে । হেমন্ত রন্জুর সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে ।
তা কৈই নিখিলেস ? ওকে ডাকেন কথা বলি ।
কর্তা নেডি হয়ে তবেই আসবে । আপনাদের কিছু লাগলে বলেন আমি লোক বলে দিচ্ছি ।
না কিছু লাগবে না ।
ঠিক আছে বাবু আমি তা হলে আসি । বলে হেমন্ত চলে গেল । রন্জু দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে বললো -মনে হয় কিছু বুঝতে পারেনি ।
এখন কি করবি ? তোজা জিজ্ঞেস করলো ।
শোন রাতে কোন অবস্থাতেই পালাতে পারবো না । কোন মতে আজকের রাতটাও এখানে পাড় করে দিতে হবে । সকাল পর্যন্ত যদি বেঁচে থাকি তখন দেখা যাবে । বলে রন্জু খাটে পা ঝুলিয়ে বসে পরলো ।
অনেক রাত করে নিখিলেস এলো । সাদা ধূতি আর পান্জাবি পরে আছে । সারাদিন না থাকার জন্য অনেক দু:খ প্রকাশ করলো । আরো বললো কয়েকটা দিন তোদের বউ দিদি কে নিয়ে যেতে হবে । তোরা আরামে থাক । কোন সমস্যা হবে না । তোজা চলে যাবার কথা বলতেই নিখিলেসের চোখ দু’টো লাল হয়ে উঠলো -বললো কেন ? কেন যাবি ? এখানে কি অসুবিধা হচ্ছে তোদের ? রন্জু বললো কোন অসুবিধাই হচ্ছে না । বরং শহরের যান্ত্রিক জীবন থেকে অনেক আরামে আছি । তুই আমাদের নিয়ে চিন্তা করিস না । রন্জুর কথায় নিখিলেসের মুখে হাসি ফিরে এলো – সাদা চকচকে দাঁতগুলো বেড় করে ও বললো এই না হলে বন্ধু । আমাদের কথার মাঝখানে যথারিতি নিখিলেসের বউ শরবত নিয়ে এলো । আমরা শুধু সৌজন্য রক্ষার জন্য আমি আর রন্জু গ্লাস গুলো নিয়ে মুখে দিলাম । তোজার দিকে তাকিয়ে দেখি ওর পুরো গ্লাস সাবার করে দিয়েছে । হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে ও বললো – বউদি দারুন শরবত বানিয়েছেন , একেবারে শরবতে এপি । নিখিলেসের বউ রন্জুর দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো । তোজার উপড় আমার কেমন ঘা জ্বালা করে উঠলো । নিখিলেসরা চলে যাবার সাথে সাথে আমি তোজার মাথায় চাটি মেরে বললাম তুই এভাবে শরবত খেলি কেনো ?
তোজা শুতে শুতে বললো -বারে , খাবার জিনিষ খাবো না ?
ওতে যদি কিছু মেশানো থাকে ? এমনিতেই ক্যামন রক্তের মতো মনে হয় । দেখলেই শরীর গিনগিন করে উঠে । আমি ঘরের ভেতরই থুতু ফেললাম ।
কৈই আমার তো ভালই লাগলো । তোজা শুয়ে পরলো । রন্জু চুপচাপ কি যেন ভাবছে আমি ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে কোন জবাব না পেয়ে কাধ ধরে নাড়ালাম -কি রে , কি ভাবছিস ?
হুম !
কি ভাবছিস ? আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম ।
ভাবছি আমাদের নিয়ে নিখি’র প্লানটা কি ? যদি মেরে ফেলে চাইতো তবে সহজেই মেরে ফেলতে পারে । কিন্তু তা না করে আমাদের যখন বাঁচিয়ে রেখেছে তখন বুঝতে হবে আমাদের নিয়ে নিশ্চই ওর কোন প্লান আছে ।
আমার ও তাই মনে হয় ; নিশ্চই কোন না কোন প্লান আছে ।
কি আর প্লান হয়তো আমাদেরও ভুত বানিয়ে ফেলবে । তারপর একসাথে সারা জীবন এখানে কাটিয়ে দেবো ,বলে তোজা খেক খেক করে হাসতে লাগলো ।
তোর খুব সাহস হয়েছে বলে মনে হচ্ছে -আমি তোজার দিকে তাকিয়ে বললাম ;
নিখির বউটা দেখেছিস দোস ! যোস না ?
এই শালার কাছে কেউ মানুষ ,ভুত – প্রেত নিরাপদ না । বলে রন্জু তোজাকে একটা ঘুষি মারলো ।
কেন তোমার মোনালিসার দিকে তো তাকাই নাই ; তয় তোমার জ্বলে কেন ?
শালা ওর দিকে তাকিয়ে দেখ না একবার , আমি না মোনাই তোকে জুতা মারবে ।
আব্বে যা । দূরে গিয়া মর ; গন্ধ লাগে । বলে তোজা সড়ে গেল । হঠাৎ ওদের দু’জনের এই খুনসুটি আমার কাছে অনেক ভাল লাগল ।
রন্জু তোজার উপরে উঠে ওকে ছোট ছোট ঘুসা মারছে । তোজা হাসতে হাসতে বলছে -ঠিক আছে ; ঠিক আছে দোস্ত তোকে মরতে হবে না নিখিলেস মরুক আর ও’র বউকে নিয়ে আমি ফুতি করি । তোজা হাসতে লাগলো ।
হঠাৎ বারান্দা থেকে ঝুম ঝুম শব্দ ভেসে এলো । আমি ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম -চুপ ! শুন বারান্দায় কে যেন হাঁটছে ;
আসলেই বারান্দা থেকে নুপুরের শব্দ ঝুম ঝুম ভেসে এলো । মনে হলো কে যেন অতি সঙ্গেপনে পা ফেলে ফেলে এদিকটাতেই এগিয়ে আসছে । আমরা তিন জন মুখ চাওয়া চায়ি করলাম । রন্জু লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে সোফাটা দরজায় দিয়ে দিল । তারপর দরজায় কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল । আমি আর তোজা গিয়ে ওর পাশে দাড়াঁলাম । নুপুরের ঝুম ঝুম শব্দটা দরজায় কাছে এসে কিছু সময় থেমে আবার বারান্দার অন্য পাশে চলে গেল । আমার হঠাৎ ভয় লেগে গেলো । রন্জুর দিকে তাকিয়ে দেখি ও হাতে একটা রড তুলে নিয়েছে । আমি কিছু বলতে গেলে ও হাত ঠোটের কাছে নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করে হাত দিয়ে পেছনে সড়ে যেতে বললো । আমি ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলাম কি করবি ? তোজার হাতে রডটা দিয়ে রন্জু দরজা থেকে আস্তে সোফাটা সড়িয়ে ফেললো । ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে আসছে । আমি ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছি । একহাত দিয়ে তোজার ঘাড় খামছে ধরে আছি । সোফা সড়িয়ে রন্জু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো । এদিকে নুপুরের শব্দটা বারান্দার অন্য প্রান্ত থেকে আবার আমাদের দিকে আসতে লাগলো । আমার সারা শরীর হিম হয়ে আসছে । বুক ধকধক করছে । দোয়া দুরুত পড়তে গিয়ে এলো মেলো করে ফেলছি । রন্জু দেয়াল থেকে মশালটা নামিয়ে এক হাতে নিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল , তারপর নুপুরের শব্দটা দরজা বরাবর আসতেই -একটানে খুলে ফেললো দরজা । কয়েক মুর্হুতের জন্য মনে হলো কে যেন চট করে বাতাসে মিশে গেল । আমরা বারান্দায় নেমে এক প্রান্তু থেকে অন্য প্রান্তু পর্যন্তু তাকালাম । অন্ধকারে কাউকে দেখতে পেলাম না । রন্জু বললো চল -সামনে গিয়ে দেখি ; আমি ওর হাত টেনে ধরে বললাম – কোন দরকার নেই । ভেতরে আয় । ঘরে ডুকে দরজা বন্ধ করে সোফাটা দরজার সামনে দিয়ে দিলাম ।
বিছানায় বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বলতে পরবো না ; হঠাৎ ঝাকুনিতে ঘুম ভাংলো – চোখ খুলে তাকাতেই রন্জু বললো, তোজা কৈই ? তোজা কৈই ।
আমি চট করে বিছানার দিকে তাকালাম যেখানে তোজা শুয়ে ছিল । দেখি বিছানা শুন্য । তোজা নেই । এদিকটায় তাকাতেই দেখি দরজা জানালা হাঁট করে খোলা । জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে । বাতাসে দেয়ালে মশালটা নিভু নিভু করছে । রন্জ ঝট করে বিছানা থেকে নেমে । লোহার রডটা হাতে নিলো । আমি ওর গা ঘেষে দাঁড়ালাম , মশালটা নিয়ে আয় বলে রন্জু ছুটে গেল বারান্দার দিকে । বারান্দায় গিয়ে দেখি তোজা বারান্দার শেষ মাথা দিয়ে সিঁড়িতে নেমে যাচ্ছে । রন্জু ডাক দিলো তোজাম্মেল । তোজা ফিরেও তাকালো না । আমরা বুঝলাম ও ঘোরের মধ্যে হাঁটছে । আমি আর রন্জু ছুটতে লাগলাম আমরা যখন বারান্দার শেষ মাথায় পৌছালাম তোজা তখন আমদের জানালার সামনের খোলা জায়গাটাতে চলে গেছে । ওর সামনে সামনে ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে পেছন ফিরে হাটছে নিখিলেসের বউ । আমরা ওকে ডাকতে ডাকতে পেছন পেছন ছুটলাম । আমাদের দেখে নিখিলেসের বউ মুখ বিকৃত করে গরররর করে উঠলো । নিখিলেসের বউ পাতলা একটা গাউন পরে আছে । বাতাসে গাউনটা পতপত করে কাঁপছে । মুখের দু’পাশ দিয়ে লালা গড়িয়ে পরছে । মনে হলো আমাদের ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফে
গল্পের বিষয়:
ভৌতিক