তিথির সঙ্গে আমার পরিচয় রমনা পার্কে । ছোট ফুপার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি মৎস্য ভবনে তার অফিসে । তিনিই আমাকে দেখা করতে বলেছেন । অনেকদিন যাবৎ একটা চাকরির জন্য ধরনা দিচ্ছিলাম । এই হবে ; এই হচ্ছে করে বছর চলে যাচ্ছে; কিন্তু চাকরি হচ্ছে না । ফাঁকে আজ এটা কর ; তো কাল ওটা নিয়ে আয় । এই করে নানান কাজ আমাকে দিয়ে দিব্যি করিয়ে নিচ্ছেন ফুপা ফুপি দু’জনই । গরিবের বউ যেমন সবার ভাবী হয় । তেমনি আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কারো একটি বেকার ছেলে থাকলে সেও সবার সম্পতি হয়ে যায় । আমার অবস্থাও তাই ।
গতরাতে ফুপি বাসায় ফোন করে আমাকে সকাল ১১টার সময় ফুপার সঙ্গে তার অফিসে দেখা করতে বলেছেন । বাবার ধারনা ফুপা আমার চাকরির খোঁজে জান দিয়ে দিচ্ছেন । শুধু মাত্র আমার অযোগ্যতার কারনেই চাকুরী হচ্ছে না । বাবা আজ প্রায় বছর খানেক হলো প্যারালাইসট হয়ে বিছানায় । বাম পা,হাত একেবারে নাড়াতে পারেন না । মেজাজ ও তাই প্রায়ই চড়ে থাকে। আমি কিছু করতেও পারছিনা । বলতেও পারছি না ।
আমি ফুপার অফিসে চলে এসেছি সকাল পৌনে ১১টায় । কিন্তু এসে শুনি ফুপা মিটিং এ ব্যস্ত । আমাকে ২টার পর দেখা করতে বলেছেন । বাকী সময়টুকু কি করি?
ফুপার অফিস থেকে বেড় হয়ে রমনা পার্কে ঢুকে গেলাম । এ সময়টাতে পার্কের পরিবেশ বেশ শান্ত থাকে । সকালের স্বাস্থ্য-সচেতনদের চাপটা কমে যাওয়ায় পার্কেটা বেশ নিরিবিলি হয়ে পরে । আমি হাঁটতে হাঁটতে লেকের পারে এসে পরি । মাথার ভেতর চিন্তা আছে খালি একটা বেঞ্চ দেখে লম্বা ঘুম দেবো । তারপর ফুপার সঙ্গে দেখা করে অন্য করণীয় ঠিক করা যাবে । লেকের পাড়ে একটা জটলা চোখে পড়লো । আমার কৌতুহল বরাবর বেশি । কাছে গিয়ে আমি কি হচ্ছে দেখার জন্য উকি দিলাম । শাড়ী পরা ফর্সা করে একটা মেয়ে বসে আছে বেঞ্চিতে । তার সামনে বিশাল আকৃতির একটা কালো রং এর কুকুর মাটিতে মুখ লম্বা করে শুয়ে আছে । এতো বড় কুকুর সাধারনত দেখা যায় না । কুকুটাই মানুষের কৌতুহলের কারন । আমি বরাবর ওপর দিকের একটি বেঞ্চিতে শুয়ে পড়লাম । উদ্দেশ্য কি হয় দেখা । কখন যে ঘুমিয়ে পরে ছিলাম বলতে পারবনা । চোখ খুলে দেখি মেয়েটা আমায় ডাকছে ।
আকাশ কালো হয়ে আছে । খুব সম্ভব বৃষ্টি হবে । আমি উঠে বসে বললাম ,
– আপনি ? আমার চোখে মুখে বিস্ময় ।
-আমাকে একটু কোথাও পৌছে দেবেন ? আমি এখানকার কিছু চিনি না । মেয়েটি বিনয়ের সঙ্গে বললো ।পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই বিশাল আকৃতির কুকুরটি ।
আমি বললাম – কোথায় যাবেন ?
-আমি জানিনা । নিরাপদ কোথাও । মেয়েটি খুব আস্তে আস্তে বললো । আমি অবাক হলাম এ মেয়ে বলে কি ? এটা কোন কথা হলো ? আমি ঘড়ি দেখলাম আড়াইটা বাজে । ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলাম । আজ খবর আছে । ফুপা নিশ্চয়ই চৌদ্দ গোষ্টি উদ্ধার করবে ।
-আপনি বলুন কোথায় যাবেন আমি আপনাকে পৌচ্ছে দেবো । আমি শোয়া থেকে উঠতে উঠতে বললাম । মেয়েটি অসম্ভব সুন্দরী । টানা টানা চোখ । কমলা ফর্সা গায়ের রং । আমি উপেক্ষা করতে পারছি না।
-আমার নাম তিথি । আমি আসলে এখানে নতুন । কাউকে চিনি না । কাউকে বিশ্বাস ও করতে পারছিনা । তাই বলছিলাম আপনি যদি একটু উপকার করতেন ।
মেয়েটির কথায় বিনয় ঝরে পরছে । এমন বিনয়ের সুরে বহুদিন কেউ কথা বলেনি আমার সঙ্গে । তাই মনে মনে ঠিক করলাম আমি মেয়েটিকে সাহায্য করবো ।
-কিন্তু আমার তো একটু কাজ আছে। মানে আমাকে এখনই ফুপার অফিসে যেতে হবে। আমি হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম ।
-কোন অসুবিধা নেই । আপনি আপনার কাজ আগে শেষ করুন তারপর না হয় আমাকে হেল্প করবেন।
-বেশ চলুন তা হলে । বলে ; আমি কুকুরটির দিকে তাকালাম । আমাকে তাকাতে দেখে মেয়েটি বললো।
এটা আমার কুকুর । ওর নাম রন । কোন ভয় নেই । আমার উপর কেউ আঘাত না করলে ও কিছু বলবেনা । আমরা হাঁটতে শুরু করলে কুকুটিও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগলো । কিছু বলতে হলো না ।
এমনিতে ফুপার অফিসে ঢুকতে হলে নানান রকমের ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। একজন পাশ দেখে তো অন্য জন ফোন করে । আরেকজন বসিয়ে রাখে নানান যন্ত্রনা । কিন্তু আজ কিচ্ছু লাগলো না । আমরা বিনা বাঁধায় ভেতরে ঢুকে গেলাম । সেই সঙ্গে আমি বেশ অবাক হলাম ।
এখন ফুপার তেমন কোন ব্যস্ততা নেই । দেখে মনে হলো তিনি বেশ ফুর ফুরা মেজাজে আছেন । আমি মেয়েটিকে রিসিপসনে বসিয়ে ফুপার রুমে গেলাম । ফুপা কি জানি লিখছিলেন । ফুপা আসবো বলতেই;
তিনি মাথা তুলে বললেন – আরে এসো এসো । তোমার জন্যই তো বসে আছি । বসো । কি খাবে বলো ? আমি কিছু না বলতেই তিনি বললেন – তা হলে বস । আমি হাতের কাজটা শেষ করে তোমার সঙ্গে বসছি । ফুপা লিখছেন । আমি বসে আছি তার সামনের চেয়ারে । অফিসটা বেশ পরিপাটি করে গুছানো । সরকারী অফিসারদের অফিস যেমন হয়।
ফুপা বেল বাজাতেই । পিয়ন আসলো । তিনি লেখা কাগজটা তাকে দিয়ে বললেন এটা পরিমল বাবুকে দিয়ে দাও ।
তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন – তো মিয়া জগলু কি খবর ? বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘুরছো খুব । মেয়েটি কে হে বাবা? তিনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন । আমি তাকিয়ে দেখলাম ফুপার বাম পাশে রাখা সিসি টিভিতে তিথি মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে ।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম । কোন রকম বললাম ।
না ! মানে !
-আরে মানেটানে রাখো । এখন তো তোমাদেরই বয়স । আনন্দ ফুর্তি করো । আমাদের মতো বুড়ো হলে আর সময় পাবে না । তোমার ফুপিকে দেখনা ? সারা দিন পীর ফকির নিয়ে আছে । ফুপি আবার কোন এক ফকিরের মুরিদ হয়েছেন । প্রতি শনিবার তিনি ফকির বাবার কথা মতোন রোজা রাখেন ।
ফুপার কথা বার্তায় আমি বেশ অবাক হলাম । তিনি এভাবে কোনদিন আমার সঙ্গে কথা বলেনি । আজ কি হলো !
– তা ওকে ওখানে না বসিয়ে রেখে ভেতরে নিয়ে আসো । আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও । ফুপা সিসি টিভিতে তিথির দিকে তাকিয়ে বললো ।
-না । মানে । আমি কিছু বলতে চাইলাম ।
-আরে যাও । যাও ; নিয়ে আসো । ফুপা আমায় তারা দিলেন ।
এমন সময় কিছুক্ষন আগে আসা সেই পিয়নটি ভেতরে এসে ফুপাকে একটি কাগজ দিলো । ফুপা তাতে সাইন করে লোকটির হতে দিয়ে বললো রিসিপসনে বসা ম্যাডামকে ভেতরে নিয়ে আসো । আমি আর কিছু বললাম না ।
বাসায় ফিরেছি সন্ধ্যা ৭টায় । তিথিকে নিয়ে বেশ কয়েকটি হোটেলে গিয়েছি । ওর থাকার ব্যব্স্থা করবার জন্য । কিন্তু কোন লাভ হয়নি । কোথাও ওর পছন্দ হয়নি । তার উপর সঙ্গে এতো বড় একটা কুকুর নিয়ে কেউ হোটেলে থাকতে দিতে রাজি হলো না । শেষমেশ বাসায় নিয়ে এলাম । মনে মনে ভাবলাম আমার ছোট বোন লাবনির সঙ্গে আজকের রাতটা থাক । কাল কোন মহিলা হোস্টেলে ব্যবস্থা করে দেবো ।
বাসায় ঢুকে দেখি ফুপি বাবার ঘরে বসে আছে । আমাদের বাড়ীটা এল সেপটের একতলা । লম্বা করে একটানা ঘরগুলো তৈরি । কর্ণারের রুমটাতে বাবা মা থাকেন । তারপরটায় লাবনি । আর প্রথমটায় আমি আর আমার ছোট ভাই তমাল । এক পাশে রান্না ঘর অন্য পাশে বার্থরুম । সামনে প্রায় পাঁচ ফিট খোলা জায়গা । সেখানে সারি করে তিনটে নারিকেল গাছ । তার ফাঁকে ফাঁকে নানান জাতের ফুলের গাছ । বাগানের গাছ গুলো লাবনির হাতে লাগানো। কয়েক টাতে আবার ফুলও ফুঁটেছে ।
বাসায় ঢুকতেই তিথির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে লাবনি আমাকে হাত ধরে ওর ঘরে নিয়ে গেল । তিথি বাহীরে দাঁড়িয়ে আছে ।
-ভাইয়া তুমি মনে হয় উনাকে নিয়ে ফুপার অফিসে গিয়েছিলে ?
আমি হ্যাঁ বললাম । তারপর লাবনি যা বললো তা হলো । ফুপি নাকি সন্ধ্যার পর বাসায় এসে উঠেছে । এবং মা বাবাকে বলছে আমি নাকি কোন মেয়ে নিয়ে ঘোরা ফেরা করছি । সংসারের প্রতি কোন খেয়াল নাই । বংশের মান-সম্মান ও নাকি মাটিতে মিশে গেলো । উনি কাউকে মুখ দেখাতে পারছেন না । নিজ ভাইয়ের ছেলে এমন হবে তিনি তা কল্পনাও করতে পারেননি । এখন উনার মেয়ে তিশা ,লাবনিকে কি ভাবে বিয়ে দিবেন ? কোন ছেলে আর এ বংশে বিয়ে করবে ?
আমি হেসে লাবনিকে সব খুলে বলায় ও বললো ভাইয়া কোন সমস্যা নেই । তিথি আপু আমার সঙ্গে থাকতে পারবে । বলে ঘর থেকে বেড় হয়ে এসে ও তিথিকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল ।
আমি বাবার রুমে ঢুকলাম । ফুপি বাবার ঘরে বসে কাঁদছেন। মা দাঁড়িয়ে আছেন বাবার কাছে খাটে আলতো করে হেলান দিয়ে।
-ঐ যে তোমাদের গুনধর পুত্র এসেছে । আমাকে ঢুকতে দেখে শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে ফুপি বললেন ।
-আহা: ফুপি আপনি কি শুরু করেছেন । মেয়েটি বিপদে পরেছে তাই সাহায্য করছি । এর মধ্যে অন্য কোন কিছু নাই। আপনি শুধু শুধু কান্না কাটি করছেন । আমি বিরক্ত হয়ে বললাম ।
-তুই বললেই হলো অন্য কোন কিছু নাই ? জলজ্যান্ত একটা মেয়ে নিয়ে সারা শহরের পার্কে , পার্কে , হোটেলে , হোটেলে ঘুরে এখন বাসায় এনে তুলেছিস । আবার বলছিস অন্য কিছু নাই ? আমাদের বোকা মনে করেছিস ? বল মেয়েটি কে ?
-মা ; মেয়েটা বিপদে পড়েছে । ঢাকাতে ওর থাকার কোন জায়গা নেই । তাই হোটেলে গিয়েছিলাম ও থাকার ব্যবস্থা করতে । তোমরা যা মনে করছো উনি সেরকম মেয়ে নন ।
-আমাদের চিনাতে হবে না তোকে ; কে কেমন মেয়ে । ভাইয়া তোমরা কি করবে কর আমি এর শেষ না দেখে বাসায় ফিরছি না । ফুপি আবার কাদঁতে লাগলেন । বাবা কোন কথা বলছেন না । চুপ করে শুয়ে আছেন । তার মাথা কাঁপছে।
-সালমা যখন বলছে তুই মেয়েটিকে অন্য কোথাও রেখে আয় বাবা । মা বললেন ।
-কোথায় রাখবো ? আজকের রাতটা তিথির সঙ্গে থাকুক কাল না হয় কোন মহিলা হোস্টেলে রেখে আসবো । আমার বোন যদি এ রকম বিপদে পড়তো আমি কি তাকে সাহায্য না করে পারতাম মা ? তোমরা ই কি পারতে তাকে বাসা থেকে বেড় করে দিতে । আমার লাবনির সঙ্গে কথা হয়েছে । ওর বলেছে ওর মেয়েটি থাকায় ওর কোন অসুবিধা হবে না ।
-আমি মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবো বলে ফুপি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন ।
আমি মাকে পুরো ঘটনা খুলে বললাম । কিছুক্ষন পর ফুপি তিথি আর লাবনিকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন । আমার দিকে তাকিয়ে বললেন । এ্যই তুই একটু বাইরে যা । ফুপি হাসছেন । একহাত দিয়ে ধরে আছেন তিথির হাত । আমি আবাক হলাম ; এবং হাপ ছেড়ে বাঁচলাম যাক আপাততো সমস্যার সমাধান হয়েছে । আমি আমার ঘরে এসে খাটে পা ঝুলিয়ে শুয়ে পরলাম । আসার সময় দেখলাম বারান্দায় কুকুরটি বসে আছে । বাদল আমাদের কাজের ছেলেটা কুকুরটিকে বিস্কুট দিচ্ছে । কিন্তু কুকুরটা কিছু খাচ্ছে না । আমি বাদলকে চা দিতে বললাম।
সে রাতেই আমার আর তিথির বিয়ে হয়ে গেলো । ফুপির এক কথা , এমন মেয়ে হাজারে একটা । আমার মতো নিবোর্ধের শত জনমের ভাগ্য এমন মেয়ে বউ হিসাবে পাওয়া ।
তিথির ঘটনা হলো বাবা মা মারা যাবার পর ও মামা মামির কাছে মানুষ । মামা এক বুড়োর সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করছে বলে মামী ওকে গোপনে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন । লাবনি আর তমাল মিলে আমাদের বাসর ঘর সাজিয়ে দিয়েছে । ফুলের গন্ধে কেমন মাতাল মাতাল লাগছে । বাসায় বেশ খাবার দাবার রান্না বান্না হয়েছে । ফুপা আর তিশাও এসেছে । তিশাকে আজ বেশ মলিন মনে হলো । আমার সাথে কোন কথা বলেনি। শুধু একবার ঘরে এসে বললো । আমাকে একবার বলতে পারতে । আমি কারো পথের কাটা হতাম না । আমি হাসলাম । বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে উঠলো । তিথির সারা শরীরে অলন্কার । আমি বেশ অবাক হলাম । ও কে জিজ্ঞেস করলাম এতো গয়না কোথায় পেলে ? ও হেঁসে বললো আমার মা আমার জন্য রেখে গিয়েছিল । আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি । এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো । ভাইজান ঘুমিয়ে পড়েছেন ?বাদলের গলা । আমি দরজা খুলে দিতে ও একটা ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকলো । তাতে এক গ্লাস দুধ আর বিস্কটের একটা প্যাকেট রাখা । বাদল চলে যেতেই তিথি উঠে দাঁড়ালো । আমি দরজা বন্ধ করে খাটে এসে বসলাম । তিথি দুধের গ্লাসটি আমার হাতে দিয়ে হেসে বললো নাও নতুন জীবন শুরু করো। আমি হাসলাম । নিজের হাসি নিজের কাছে কেমন বোকা বোকা মনে হলো । দুধ খাওয়া শেষ হতে তিথি আমাকে বললো চোখ বন্ধ করো ।
-আমি বললাম কেনো ?
-আহা : করো না । আমি দু হাতে চোখ বন্ধ করলাম । ও বললো কিচ্ছু দেখবে না বলে দিলাম । আমি চোখ বন্ধ করে আছি এদিকে মনে হচ্ছে যুগ যুগ সময় চলে যাচ্ছে । আমি তাকাবার জন্য চোখ খুলবো এমন সময় তিথি বললো –
– এবার চোখ খোল । আমি চোখ খুললাম । আমার সামনে তিথি দাড়িয়ে আছে । ওর শরীরে কোন কাপড় নেই । ডিম বাতির আধো আলোয় ফর্সা ধবধবে শরীর দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম । তিথি আমাকে বুকে টেনে নিল । আমার মনে হলে আমি গভীর অতলে তলিয়ে গেলাম ।
কখন যে ঘুমিয়েছি মনে নেই । হঠাৎ একটা খস খস একটা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল । মনে হল কে যেন মেজেতে পা ঘষে ঘষে ঘরের ভেতর এ মাথা ও মাথা হাঁটছে । কিন্তু তাকিয়ে দেখি কেউ নেই । হয়তো মনের ভুল হবে । তিথির দিকে তাকালাম । ও গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে । ঘন ঘন শ্বাষ ফেলছে । কেমন যেন মায়া মায়া লাগল । ঠিক যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা । রাতের ঘটনাটা মনে করতে চেষ্টা করলাম । কিন্তু পারলাম না । আমি চাদরটা ওর গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে বিছানা থেকে নামলাম পানি খাব বলে । টেবিলের ওপর পানি আর জগ । আমি পানি ঢেলে খাচ্ছি হঠাৎ কেন যেন মনে হলো তিথি আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমি চকিত পেছন ঘুরলাম । নাহ্ ও ঘুমাচ্ছে । আমি বার্থরুম থেকে এসে শুয়ে পড়লাম । তিথির বুক থেকে কাপরটা সরে গেছে আমি আবার তা ঠিক করে দিচ্ছ এমন সময় মনে হলো কে যেন বারান্দায় ঠিক ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া শব্দটার মতো পা টেনে টেনে হাঁটছে । এতো রাতে কে হাঁটবে ? ঘড়িতে বাজে রাত ৩টা ২ । আমি উঠে গিয়ে একটানে দরজা খুলে ফেললাম । না । কেউ নেই । কুকুরটা আমার দরজার সামনেই বসে আছে । দরজা খুলতে দেখে মুখ তুলে তাকালো আমার দিকে । কয়েক মুহুতের জন্য মনে হলো ওর চোখ দুটো যেনো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে । আমি দরজা বন্ধ করে এসে শুয়ে পরলাম ।
ভোরে মার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গলো । চোখ খুলে দেখি মা আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আমায় ডাকছে আর বলছো খোকা দেখে যা বউ মা কি করেছে । উঠ উঠ । তারাতারি উঠ । আমাকে উঠাবার জন্য টানতে লাগলেন । আমি ভয় পেয়ে গেলাম । কি আবার করলো ? মার মুখে হাসি দেখে কিছুটা আস্তত্ব্য হলাম । আমি বিছানা থেকে উঠে –
উঠে মার পিছু পিছু বাবার ঘরে এসে দেখি বাবা খাঁটে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন । কেউ ধরে নেই । তিথি বাবার পায়ে কি যেন মালিশ করছে ।আমি ঢুকতেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসল অসম্ভব সুন্দর হাঁসি। আমি মুগ্ধ হলাম । ওকে গতকালের চেয়ে আজ আরো বেশি সুন্দর মনে হলো । লাবনি বললো ভাইয়া দেখ ভাবি বাবাকে ভাল করে দিয়েছে। বাবা উঠে দাঁড়ালেন । আমি ছুটে গেলাম ধরার জন্য । তিনি হাতের ইশারা দিয়ে আমাকে ধরতে না করলেন । এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে হাঁটতে লাগলেন । খুশিতে আমার লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করলো । আমি ; মা ; লাবনি কেঁদে ফেললাম । বাবা বিরবির করে বলতে লাগলেন চমৎকার অতি চমৎকার ।
তিথি এ বাড়ীতে আসার পর বেশ কয়েকটি উপাধি পেয়েছে । তার মধ্যে লাবনি দিয়েছে কুকুর রাণী । আর তমাল ডাকছে মান্ডা কবিরাজ বলে । আর আমি লাজ লজ্জার উর্ধ্বে উঠে কখনও জান কখনও বা জানু বলে ডাকছি । মহা আনন্দে কাটছে আমাদের দিন ।পুরো পরিবারটি আনন্দে হাসছে । সন্ধ্যার পর ছাদে বসে সবাই মিলে গাইছি চাঁদের হাসির বাঁধ ভেংছে উছলে পরে আলো ….। এর মধ্যে ফুপার সাথে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে । মৎস অধিদপ্তরে সহকারী পরিদর্শক হিসাবে আমি আগামি মাসে যোগদিচ্ছি । ফুপু এসেছিলেন তার ফকির বাবাকে নিয়ে । বাবাকে দেখে গেছেন । আমি বাসায় ছিলাম না । বেচারা খুব একটা খুশি হতে পারেনি আমাদের বাড়ীতে নাকি শয়তানের আছড় লেগেছে । ফুপুও তার কথায় বিরক্ত হয়ে ফকির বাড়ীতে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে । তিথির দিকে নাকি বার বার কেমন করে তাকাছিল আর বির বির করে কি সব দোয়া কালাম পড়ছিল । সেদিন যতোক্ষন ঐ ফকির ব্যাটা বাসায় ছিল তিথির কুকুরটাও নাকি ততোক্ষন বেশ অশান্তু হয়ে ছিল । এরও আগে দু’তিন বার ফুপু ঐ ফকিরকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছেন । কিন্তু এবার মনে হয় শেষ আসা । তিথির কারিশমার কাছে ব্যাটার সব কেরামতি ফেল । তমাল তো বলই ফেলেছি ভাবির কেরামতিতে ব্যাটার ঈষা হচ্ছে । তাই তারা তারি ভেগেছে । যাবার আগে কুকুরটাকে তারাতে বলেছে । বলেছে সব নাশ হয়ে যাবে । সাবধান । সাবধান ।
মা সামান্য ভয় পেলেও সবাই খুব হেসেছি । তিথির দিকে কেমন করে নাকি তাকাচ্ছিল শুনে আমার রাগ লেগেছিল। কুকুরটার প্রতি বাদল ও বেশ বিরক্ত । বেশ কয়েকবার আমাকে এসে বলেছে- ভাইয়া কুকুটা আমাকে দেখে কেমন জানি করে । মনে হয় কামরাতে আসবে । ভাইয়া একটু ভাবিকে বলে ওকে শান্ত করে দেন না ।
আমিও খেয়াল করেছি ব্যাপারটা । বাদলকে দেখলেই কুকুটা গরর…গরর… একটা শব্দ করে । আমি বলেছি তুই তো ভাবিকে বল ।
আমাদের কাছে প্রথম দু:সংবাদটা আসে ২১ তারিখ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টার সময় । আমি তখন বাহীরে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি এমন সময় তিশার ফোন । ফুপা নাকি অফিসে অসু্স্ত হয়ে পরেছে । তাই ও আমাকে একটু ফুপার অফিসে যেতে বললো । আমি দিরি না করে সঙ্গে সঙ্গে ফুপার অফিসে ছুটলাম ।
ফুপার অফিস পুলিশের গাড়িতে , সাংবাদিকে একাকার হয়ে আছে । কাউকে ভেতরে ডুকতে দেওয়া হচ্ছে না । আমি পরিচয় দিতে একজন আমাকে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলো । ফুপার রুমে ঢুকে দেখি ফুপাকে মাটিতে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে ।ফুপার মাথাটা একদিকে কাত হয়ে আছে । জ্বিবটা সামান্য বেড় হয়ে আছে । চোখ দুটো খোলা। ফুপা আত্ম হত্যা করেছে । সকালে পিয়ন রুমে ঢুকে দেখে ফুপা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে । ফুপার রুমটাতে এসি থাকা সত্বেও ফুপা নাকি দু’দিন আগে ফ্যান লাগিয়েছিল ।কাউকে কাউকে বলতে শুনলাম । ফুপা নাকি দুর্নীতে গলা পযন্ত ডুবে ছিলেন । ফুপার সেই পিয়নটা আমাকে ডেকে নিয়ে বললো – আপনার সঙ্গে আসা সেই কুকুরওয়ালা ম্যাডাম এসেছিলেন আজ সকালে । তিনি বেড় হয়ে যেতে স্যার আমার কাছে চা চাইলেন । আমি যখন চা দিয়ে এলাম স্যারকে তখন খুব মনমরা দেখতে পেলাম । কিছু হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে স্যার মাথা নেড়ে না করলেন। তারপর ছোট স্যারের কাগজ নিয়ে স্যারের রুমে ডুকে দেখি স্যার ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছেন । তিথির এসেছিল শুনে আমি বেশ অবাক হলাম । তিথি তো সারা সকাল আমার সঙ্গে তবে ও কখন এখানে এলো ? নিশ্চই পিয়নটা ভুল দেখেছে । আমি নিশ্চিত হবার জন্য জিজ্ঞেস করলাম কুকুরটা সঙ্গে ছিলো ? কেননা তিথি কোথাও কুকুরটা ছাড়া যায় না । পিয়ন মাথা নেড়ে না করলো । আমি মনে মনে ঠিক করলাম এ ব্যাপারে তিথিকে কিছু বলার দরকার নেই । শুধু শুধু বেচারী মনে কষ্ট পাবে।
পুলিশ ব্যাপারটা তদন্ত করছে । আজিমপুরে লাশ দাফন করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল । ফুপুর অবস্থা খুব খারাপ । মা আর লাবনি ফুপুর বাসায় চলে গেছেন । রাতে সেখানেই থাকবে । গোসল করে কোন রকম খেয়ে আমি শুয়ে পরলাম । রাতে ঘুমাতে পারলাম না ঠিক মতো । সারা রাত্রি মনে হলো । কে যেন ঘরের ভেতর পায়চারি করছে । দু’একবার দেখার চেস্টা করেও কিছু দেখতে পেলাম না । রাতে ফুপাকে স্বপ্ন দেখলাম । আরো দেখলাম তিথির কুকুরটা আমাকে তারা করছে আমি ভয়ে ছুঁটছি তো ছুঁটছিই । কোথাও আশ্রয় পাচ্ছি না । ছুটতে ছুটতে আমি একটা বাড়ীতে ঢুকে পরলাম । সেখানে ফুপির সেই ফকির বাবাকে দেখতে পেলাম । সাদা কাপড় পরা দরবেশের মতো একজনকে ঘিরে সবাই বসে আছে । সাদা কাপড় পরা লোকটি আমাকে তার পাশে বসতে বললো । আমি বসে পরলাম । লোকটি আমার হাতে কিছু একটা দিলো । আমি হাত মুঠ করে রাখলাম । মনে হলো আমার হাতের মুঠোর ভেতর গরম কয়লা দিয়ে দেওয়া হয়েছে । আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো । আমি চোখ খুলে দেখি তিথি আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে ।কুকুরটা ঘরের ভেতর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে । চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেড় হচ্ছে । যেন তিথির হুকুমের অপেক্ষায় আছ হুকুম পেলেই আমাকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে । আমি ভয়ে জ্ঞান হারালাম ।
ফুপা মারা যাবার ঠিক পনেরো দিনের মাথায় সকাল বেলা মার হৈই ছৈই এ ঘুম ভাঙ্গলো । সকাল থেকে নাকি বাদলকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । বাদল তো কখনও এমন করে না । সেই ছোট বেলা থেকে ও আমাদের সঙ্গে আছে । কাউকে না বলে দোকানেও যায়না । বাদল রান্না ঘরেই শোয় । গতরাতে ও যেখানে শুয়েছিল । বিছানা পত্র তেমনিই আছে । বাহিরে বের হবার গেটেও তালা দেয়া । তা হলে ও গেল কোথায় !
আমি মাকে বললাম- আছে হয়তো আশে পাশে কোথাও । চলে আসবে । তুমি চিন্তা করো না তো মা । বলে আমি আবার শুয়ে পরলাম । তিথিকে দেখলাম মার সাথে নাস্তা বানাচ্ছে ।
আবারও চেচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গলো । এবার বেশ বিরক্ত হলাম । বাইরে এসে দেখি পাশের বাসায় একটি ছেলে হাত নেড়ে নেড়ে সবাইকে কি যেন বলছে । কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বললো জগলু ভাই দেখে যান ; দেখে যান । ছেলেটা বাসা থেকে বেড় হয়ে গেল । আমি আর তমাল ছুটলাম ও পেছন পেছন । আমাদের বাসার কিছুটা সামনে হাতের বাম পাশে যে ডাস্ট বিনটা আছে , ওটার কাছে একটা জটলা দেখতে পেলাম । কাছে গিয়ে যা দেখলাম । তাতে আমার মৃত্যু হলে অবাক হতাম না । ডাস্টবিন এর মধ্যে বাদল এর কাটা মাথা পরে আছে । আমার মাথা ঘুরে উঠলো। বমি পেয়ে গেলো । কোন রকম তমাল এর গায়ে ভর দিয়ে বাসায় ফিরলাম ।
দুপুর নাগাত অন্য একটি এলাকায় বাদল এর দেহের অন্যান্য অংশ পাওয়া গেল । বাসায় পুলিশ এসেছে । আমাদের সবাইকে থানায় যেতে হবে । যতোই বলছি আমরা কিচ্ছু জানিনা । এস আই নাসির তা মানছে না । আমাদের বাসার ছেলে আমরা কেন মারবো । তাও আবার এমন ভয়াবহ ভাবে । সাথে থাকা পাতলা মতো একটা সেপাই বলছে স্যার থানাতে নিয়ে প্যাদানি দিলে শুর শুর করে সব বেড় করে দেবে । বাসায় মানুষের ভিড় উপচে পরছে । কি করবো বুঝতে পারছিনা । এলাকার কয়েকজন মুরুব্বী ও আছেন । তারা আমাদের হয়ে কথা বলছেন । আমাদের বাড়ীর ছেলেকে আমরা কেন মারবো ? কিন্তু এস আই নাসির এক কথা আমরা এর সঙ্গে কোন না কোন ভাবে জড়িত । আমরাই খুন করে বাহীরে ফেলে দিয়ে এসেছি । তাই আমাদের থানায় যেতেই হবে । কোটই প্রমান করবে আমরা খুনি না সাধু ।
মা আর লাবনি সকাল থেকে কেঁদে চলেছে । বাবা কিছু বলছেন না । যা কিছু করার আমিই চেস্টা করছি ।এস আই এর সঙ্গে চিল্লাচিল্লির একপর্যায় তিথি বের হয়ে এলো ঘর থেকে ।
-আপনি পেয়েছেন কি ? যা ইচ্ছা তাই করবেন ? টাকা খাওয়ার ফন্ধি করছেন ?
না ?
তিথি রেগে মেগে বললো কথা গুলি । ওর কথায় এস.আই নাসিরের শরীরে যেন আগুন লেগে গেলো ।
চিৎকার করে বললো এ্যই মেয়ে চুপ । একদম চুপ । আমি তিথিকে থামাতে গেলাম । তিথি আমাকে সরিয়ে দিয়ে বললো । -কেন সত্যি কথায় শরীরে ফোস্কা পরেছে ? একটা ফোন করবো শরীরে আর পুলিশের কাপড় থাকবে না । রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করবি । তিতির এ জাতিয় কথায় আমি বেশ অবাক হলাম ।
-কর কর তোর কোন বাপেরে ফোন করছি কর । এস.আই লাঠি নিয়ে তিথির দিকে তেরে গেল । আমি ভয় পেয়ে গেলাম । আবার না মেরে বসে ।
তিথি সত্যি সত্যি ফোন করে বললো – নে কথা বল ; আমার বাবার সাথে কথা বল । ছাগল কোথাকার ? এস.আই তিথির হাত থেকে ফোনটা একরকম ছিনিয়ে নিলো ।
তরপর খুব ভাবের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো কে বলছেন ? আমি এস.আই নাসির বলছি । কয়েক মিনিটের মধ্যে নাসিরের চেহারায় পরির্বতন চলে এলো ।
-জ্বী স্যার । ইয়েস স্যার । কোন সমস্যা নেই স্যার । ভুল হয়ে গেছে স্যার । ক্ষমা চাচ্ছি স্যার । আর কোন দিন হবে না স্যার । আমি এখনই মাপ চাচ্ছি স্যার । স্যার ; স্যার ভুল হয়ে গেছে । নাসির মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে । আবারও আমি বেশ অবাক হলাম । তিথির এমন কোন পাওয়ারফুল আত্মীয়ের কথা তো ও কখনও বলেনি আমাকে । যার কথায় এস.আই নাসিরের মতো লোকের মুখে ফেনা উঠে যায় । তখনই মনে হলো আমি আসলে তিথি সর্ম্পকে তেমন কিছু জানিনা । নাসির ফোনটা তিথির হাতে দিয়ে । আমাদের সবাইকে আরো একধাপ অবাক করে দিয়ে ওর পা জড়িয়ে ধরলো । ম্যাডাম আমার ভুল হয়ে গেছে । মাপ করে দিন ।
তিথি রাগে কাঁপছে । ফর্সা শরীর লাল হয়ে গেছে । কোন রকম পা ছাড়িয়ে বললো । এই মুহুর্তে বাসা খালি করে দিতে এবং প্রকৃত খুনিকে খুঁজে বের করতে তা না হলে খুব খারাপ হবে । বলে ও আর দাঁড়ালো না ভেতরে চলে গেলো । পুলিশ দল তারা হুরো করে বাড়ী থেকে বেড় হয়ে গেলো । যাবার আগে অন্য সবাইকে যারা এতোক্ষন মজা দেখছিল সবাইকে বাসা থেকে বের করে গেট বন্ধ করে দিয়ে গেল । হঠাৎ করেই বাড়ীটা নিরব হয়ে গেলো ।
রাতে বাসায় পায়ের শব্দ বেড়ে গেছে । কে যেন বারান্দার এ মাথা ও মাথা হেঁটে বেড়ায় । আমি বেশ কয়েকবার দেখতে চেষ্টা করেও কাউকে দেখতে পাইনি । এখন শব্দটা শুধু আমিই শুনিনা । মা , লাবনি ,তমাল সবাই শুনতে পায়। বাড়িতে কেমন একটা ভৌতিক পরিবেশ বিরাজ করছে । কয়েক দিন যাবত লক্ষ্য করছি তিথি সারাক্ষন কেমন চুপ চাপ হয়ে থাকে । জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না । কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে ও । খুব একটা বাসার বাহীর বেড় হতে চায় না ।
আমি মনে করেছি বাদল এর মৃত্যুটা সবার মনে বেশ দাগ কেটে গেছে । মা তো সব সময়ই কাঁদেন । এর মধ্যে ফুপি ফোন করে ছিলেন । তিনি নাকি আজকাল কি সব উল্টা পাল্টা দেখছেন । প্রায় রাতেই নাকি দেখেন ফুপা ড্রয়িংরুমে বসে আছে । তিনি আবার ফকিরের কাছে খুব যাতায়াত করছেন । দু’তিন জন ফকির বাসা পাহারা দিচ্ছে । ফুপাকে নাকি শয়তান মেরেছে । মা আর লাবনিকে নাকি আরো কি সব বলেছেন । আমার সঙ্গে কথা বলতে চান । বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন । আমি যাবো যাচ্ছি করেও শেষ পর্যন্ত আর যাইনি ।এসব ভুত পেতে আমি বিশ্বাষ করি না। আসলে ফুপুর বাসায় যাবার মতো সময়ও পাইনি । আমি কাজে যোগ দিয়েছি । ৯টা ৫টা অফিস করছি । নতুন চাকরী অনেক কাজ । কিন্তু কেমন যেন এলো মেলো হয়ে যাচ্ছে সব কিছু । তাল মেলাতে পালছি না ।
রাত বাজে ১ট কি দুইটা হবে । লাবনি শুয়েছিলো বিছানায়। হঠাৎ বারান্দা থেকে সেই পায়ের শব্দ ভেসে এলো। লেংচে লেংচে কেউ হাঁটছে । আজ দেখতেই হবে কে প্রতিদিন এভাবে হাঁটে। একবার মনে হলো বাবা নাতো ? কিন্তু এতো রাতে বাবা কেন হাঁটবে ?লাবনি বিছানা থেকে উঠে পরলো । কেউ বারান্দার ওপর প্রান্ত থেকে হেঁটে হেঁটে এদিকটায় আসছে । পাশের বিছানায় তমাল ঘুমাচ্ছে লাবনি কয়েকবার তমালকে ডাকল। কিন্তু তমালের গভীর ঘুমে আচ্ছন । লাবনি বিছানা ছেড়ে দরজার কাছে গেল। যতোটা সম্ভব শব্দ না করে আলতো করে খুলে ফেললো দরজার উপড়ের দিকের ছিটকিনি ।তারপর অপেক্ষায় থাকলো দরজা পর্যন্ত শব্দটা আসার । শব্দটা একটু একটু করে এগিয়ে আসছে । লাবনি আপেক্ষা করছে । ওর শরীর কেমন জানি অজানা এক ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে । দরজার কাছে শব্দটা আসতেই ও একটানে খুলে ফেললো দরজা। প্রায় সাথে সাথে বারান্দার জ্বলতে থাকা লাইটা নিবে গেল । লাবনি ভয় পেলেও দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। চোখে অন্ধকারটা সয়ে আসতেই ও দেখতে পেল । ঠিক ওর দরজার সামনের ফ্লরে কুকুরটা বসে আছে তার ঠিক পাশে বসে আছে তিথি আর তিথির গা ঘেষে বসে আছে বাদল । তিনজন মাথা নিচু করে কিছু একটা খাচ্ছিল। দরজা খোলার শব্দে এক সঙ্গে সবাই মুখ তুলে তাকালো লাবনির দিকে। ভয়ে লাবনির মনে হলো ও মরে যাবে। বুক হাপারের মতো লাফাচ্ছে । ফ্লরের দিকে চোখ যেতেই লাবনি স্পস্ট দেখতে পেলো এক- দেড় বছরের একটা বাচ্চা ছেলের দেহ পরে আছে । সেটাতে কামর বসিয়ে খাচ্ছে তিন জন । তিথি লাবনির চোখে চোখে তাকালো। তিথির বুকের উপড়টা ভেসে যাচ্ছে রক্তে । ঠোট বেয়েও রক্ত ঝরছে । বাকী দু’জন কচমচ করে বাচ্চাটাকে খাচ্ছে। লাবনির হাত দু’টো যেন দরজার সঙ্গে আটকে আছে । ও চিৎকার করতে চেষ্টা করে পারলোনা। মুখ দিয়ে মৃদু গরগর শব্দ ছাড়া আর কিছু বেড় হলো না । তিথি মাটি থেকে শূন্যে ভাসছে । একটা আঙুল তুলে লাবনি কে কোন শব্দ করতে নিষধ করলো । তিথি ভাসতে ভাসতে ওর দিকে আসতেই লাবনি এক পা দু পা করে পিছিয়ে গেল। তিথি ও লাবনির সাথে সাথে ওর রুমে ঢুকে গেল ।এবং সাথে সাথে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। আর প্রায় সাথে সাথেই একটি আত্মচিৎকারে রাতের নিস্তব্দতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিলো ।
পরের দিন লাবনিকে পাওয়া গেল ওর ঘরে ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় । আমাদের সবার পাগল হবার মতো অবস্থা। ফুপি এসেছেন । আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছেন তোর বউকে এখুনি তারা । ও একটা ডাইনী সবাইকে শেষ না করে ছাড়বে না । তুই কাল অবশ্যই আমার বাসায় আসবি । লাবনিকে আজিমপুরে দাফন করে এসে দেখি মা বাবা দুজনকেই ফুপি নিয়ে গেছেন । সন্ধ্যা নাগাত তমালও চলে গেল । পুরো বাড়িতে আমি কেমন যেন একলা হয়ে গেলাম । তিথি কিন্তু বেশ স্বাভাবিক । যেন কিছুই হয়নি । দু’একবার মনে হয় গুন গুন করে গান গাইতে শুনলাম । গোছল করে এসে দেখি – কুকুরটি আমার ঘরে খাটের কাছে বসে আছে । আর লাবনি খাটে বসে ওর মাথায় হাত বুলাচ্ছে । আমি কপাল কুচঁকে চিৎকার করে উঠলাম -ও’টা ঘরের ভেতর কেন ? কি পেয়েছো তুমি ? বেড় করো বেড় করো । আমি কুকুরটাকে মারার জন্য কিছু খুঁজতে লাগলাম । আমার হঠাৎ চেচামেচিতে কুকুরটা গরগর করে উঠলো। একবার তাকাল তিথির দিকে । যেন হুকুম পেলেই আমাকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
তিথি মুখের কেমন একটি ভঙ্গি করে ইশারা করতেই কুকুরটি ঘর থেকে বেড় হয়ে গেল । তিথিও দরজা টেনে দিয়ে ঘর থেকে বেড় হয়ে গেল ।
লাবনির জন্য বুকের ভেতটা কেমন করে উঠলো । আমি কেঁদে ফেললাম । লাবনি আমার বোন ।আমার বোন – তুই কেন এভাবে চলে গেলি ! বুকের ভেতটা মোচড়াতে লাগলো । কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে পারবো না । ঘুম ভাঙ্গল পায়চারির শব্দে । কারা যেন ফিসফিস করে কথাও বলছে । আমি বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে গেলাম ।দরজা বাহির থেকে বন্ধ । আমি খুলতে চেষ্টা করেও পারলাম না । বারান্দা থেকে কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসছে ।আমি দরজা খুলতে না পেরে জানালা খুলতে চেষ্টা করলাম । তাও পারলাম না । ছিটকিনি ধরে টানাটানি করতে করতে আঙুল কেটে রক্ত বেড় হয়ে এলো । আমি সেদিকে ভ্রক্ষেপ করলাম না । অনেকক্ষন টানাটানি করার পর জানালাটা সামান্য ফাঁক করা গেল । আমি তা দিয়ে বাহীরে তাকালাম । বাহিরটা কেমন আন্ধকার । কিন্তু তারপরও আমি লাবনিকে স্পশ্ট দেখতে পেলাম । জালানা দিয়ে তিথির পেছনটা দেখা যাচ্ছে । আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি । লাবনির পাশেই বাদল দাঁড়িয়ে আছে । মনে হল কেমন যেন কালো হয়ে গেছে । চোখ দু’টো যেন কোঠোর থেকে বেড় হয়ে আসতে চাইছে । জ্বীহবাটা কুকুরের মতো লকলক করছে । ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত আমার শিরদাড়া বেয়ে নেমে গেল । আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম । কি করবো কোন কিছু চিন্তা করতে পারছি না । হঠাৎ লাবনির চোখ পড়লো আমার দিকে । ও আঙুল দিয়ে আমায় দেখিয়ে কিছু একটা বললো । মুর্হুতে তিথি পেছন ফিরে তাকালো । আমি চোখের পলকে সড়ে গেলাম । বিছানায় এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পরলাম । যেন আমার মুখ দেখা না যায় । বিছানায় শোয়া মাত্র দরজা খুলার শব্দ পেলাম । বেশ বুঝতে পারলাম সবাই ঘরের ভেতর ঢুকেছে । খাটের কাছে সবাই এসে দাঁড়াল । আমি মরার মতো পরে আছি ।
তিথি আমার পা ধরে নাড়া দিলো । আমি অনুভব করলাম ঠান্ডা একটা হাত আমার পা ধরে নাড়াচ্ছে । বাদল লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে এল । তারপর কুকুরের মতো হামাগুরি দিয়ে আমার মুখের কাছে মুখ এনে শুকতে লাগলো । খাটের আরেক পাশে এসে লাবনি আমাকে উল্টে দিল । আমি টের পেলাম ও’র শরীরে অসম্ভব জোর । তিথি আমার বুকের উপর উঠে বসেছে । আমি বুঝতে পারলাম ঘুমের ভান করে পরে থেকে কোন লাভ হবে না । ও’র দিকে তাকালাম ।তারপর বললাম ছাড় ছাড় আমাকে শয়তানী । তিথি হাসছে । ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে বেড় হয়ে এসেছে দুটো ধারালো দাঁত । আমি ওকে বুকের উপড় থেকে সড়াতে চেষ্টা করলাম । কিন্তু পারলাম না । বিশ্রী একটা গন্ধে ভরে গেছে ঘর । তিথি আমার গলার কাছে ওর মুখ নিয়ে আসছে । আমি প্রাণপন চেস্টা করছি নিজেকে বাঁচাতে । কিন্তু হাত পা এক ফোঁটা নাড়াতে পারছিনা । আমার দম ভারী হয়ে আসছে । মনে হলো আমি মরে যাবো । বুকের উপড় যেন পাথর চেপে বসেছে ।
ঠিক এমন সময় ঘরের ভেতর ঢুকলো ফুপিসহ আরো কয়েক’জন ফকির । তারা একত্রে চিৎকার করে উঠলো ছাড় ছাড় বলছি শয়তান । ছাড় । এক জন কিছু পানি ছুড়ে মারলো । লাফ দিয়ে তিথি নেমে গেল আমার বুকের উপর থেকে । লাবনি ,বাদল ,কুকুটাও লাফিয়ে পরলো মাটিতে । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একজন বল্লম জাতীয় কিছু একটা ঢুকিয়ে দিলো কুকুটির পেটে । ফিনকি দিয়ে রক্ত বেড় হয়ে এলো । কয়েক ফোঁটা আমার চোখে মুখে পড়লো । লোকটি শরীরের সব শক্তি দিয়ে কুকুরটাকে চেপে ধললো মাটির সঙ্গে । কয়েটা জোরে ঝাকি দিয়ে কুকুরের শরীরটা স্হির হয়ে গেল ।
তিথি বাতাসে ভাসছে । ওর দিকে সবাই পানি ছুড়ে মারছে আর বলছে যা , যা । তিথি ভয়ন্কর ভাবে শব্দ করছে । লাবনি আর বাদলকে কয়েক জন ঘিরে ফেলেছে । সবাই বেশ জোরে জোরে বিভিন্ন আয়াত পড়ছে আর পানি মারছে। শরীরে পানি পরার সঙ্গে সঙ্গে ওদের মুখ যন্ত্রনায় বিকৃত হয়ে যাচ্ছে ।
সাদা দাঁড়ি ওয়ালা একজন দু’মুঠো মাটি ছুড়ে দিতেই মাটিতে তিথিকে ঘিরে একটি আর লাবনি আর বাদলকে ঘিরে আরেকটি দুটো র্সাকেল হয়ে গেল । তারপর উনি বললেন – তোর খেলা শেষ । তুই আর এ রেখা থেকে বেড় হতে পারবিনা ।
-তোদের সবাই কে মেরে ফেলবো । ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলবো । কুত্তার বাচ্চারা কেউ বাচঁবি না। সব মরবি শুয়োরের জাত । তিথি অসভ্য ভাষায় গালাগালি করছে । পরক্ষনেই আমার দিকে তাকিয়ে সেই আগের নরম কন্ঠ স্বরে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো জগলু আমার জান আমাকে বাঁচাও । জান ওরা সব শয়তান আমাকে বাঁচাও । আমাকে বাঁচাও । সাদা দাঁড়িওয়ালা আমাকে পেছনে টেনে এনে বললো – খবরদার ওর কথায় কান দেবে না । তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে বললো তোর খেলা শেষ । তিনি নিজ মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন । তারপর বিরবির করে দোয়া পড়তে পড়তে দু’মুঠো মাটি ছুঁড়ে দিতেই । তিথি ,লাবনি, বাদল এর শরীরে আগুন ধরে গেল । কয়েক মুর্হুতের মধ্যে জ্বলে উঠা আগুনে পুড়ে তিথি,লাবনি ,বাদল কয়লা হয়ে গেল । কুকুরটাকে তিনি পুড়িয়ে ফেলতে বললেন । দু’জন টেনে বাহীরে এনে কুকুরটার শরীরে আগুন দিয়ে দিলো । তিথি ; লাবনি ,আর বাদলের ছাইগুলো একজন একটা কাচের বোয়মে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেড় হয়ে গেলো । দাঁড়িওয়ালা আমার শরীরে এক মুঠো মাটি ছিটিয়ে দিয়ে এক বোতল পানি ঢেলে দিতেই আমি জ্ঞান হারালাম ।
পরিশেষ : কেউ খেয়াল করলো না । সবাই যখন জগলুদের বাড়িটি থেকে জগলুকে সহ বেড় হয়ে গেলো । ঠিক তখন দুটো নারিকেল গাছের মাঝখানে বসে আছে একটি দুই কি তিন বছরের মেয়ে । অবিকল তিথির মতো দেখতে। আর তার পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্র একটি কালো রঙ এর কুকুর ।