বাড়ির পাশেই শশ্মান ঘাট। তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মরা নদী। মরা নদী নাম কারন। লাশ পুড়ানোর পর ঐ নদীতে লাশের কয়লা ,কাঠ সব ঐ টাতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। প্রতি দিন শত শত লাশ সেখানে পুড়ানো হয়। বাতাসের সাথে লাশ পুড়ানোর গন্ধ আমার কাছে পুরোনো কিছু না।
শশ্মানের পাশ দিয়ে আসি বলে মা প্রত্যেক দিন বুক পকেটে লাল শস্য দিয়ে দেন। লাল শস্য নাকি ভূতেরা প্রথমিক ভয় পায়। এলাকার নাম করা নেশাখোর জগৎ আলী প্রত্যেকদিন সেখানে বসে নেশা করে। উনার মতে শশ্মানঘাটে নেশা করলে নাকি নেশা জমে ধরে। আমারো নেশা করতে খুব ভাললাগে। সাথে যদি কোনো পার্টনার পাই ? তাই লে তো আর কথাই নাই।
সেদিন রাতে সাইকেল নিয়ে বাসায় আসছিলাম। গ্লাস কোম্পানিতে চাকরি করি। প্রত্যেকদিনই লেট হয়। কিন্তু আজ একটু বেশি ই লেট হয়েছে ফিরতে । রাত আনুমানিক ৩ টা । শশ্মানের কাছ থেকে বাসায় যেতে মাত্র ১০ মিনিট লাগে। সাইকেল চালিয়ে যখন শশ্মান টার বরাবর আসলাম, তখনই চোখে পড়লো কারা যেন লাশ পুড়াচ্ছে। হালকা বাতাসে লাশের পুড়া গন্ধ ও নাকে ঠেকলো। কিন্তু অন্যান্য লাশের গন্ধ আর এই লাশ টা পুড়ানোর গন্ধ সম্পূর্ন আলাদা। হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ আসছিলো শশ্মান ঘাট থেকে। আমি আনমনে সাইকেল নিয়ে শশ্মান পাড় হচ্ছি। হঠাৎ কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকলো।
রাহুল আরে ও রাহুল কে? আরে আমি তর জগত চাচা। কই থেকে এলি? ও চাচা তুমি? আমি তো,,,হাহাহ আমি তো কি? ভয় পেয়ে গেছিলি? হ। তা এতো রাতে আপনি এখানে? আর বলিস না নেশা টা চাপছিলো তাই গাঞ্জার পোটলা টা নিয়া আইয়া পড়লাম। ও আচ্ছা , তাইলে যাই আমি , থাকেন আপনি। এতো তাড়া কিসের রে তোর? আয় আমার সাথে একটু গল্প করে যা। ব্যাপার টা কি? আগে জগত আলী তার পাশে গেলেই পাগলা কুত্তার মতো ব্যবহার করতো। কিন্তু আজকে এমন আদর করে কাছে টানছে ?
এসব ভাবতে ভাবতে, হঠাৎ দেখলাম জগত আলী আমার হাত ধরে শশ্মানের রাস্তায় ডুকলো। আয় ঐ বেল গাছটার নিচে বসে মাল বানাই? একি বলেন চাচা? ঐ বেল গাছ তো ভালো না। কিসব আত্মা টাত্মা নাকি আছে? ধূর বেডা, তুই এই যুগের মানুষ হইয়া আত্মা বিশ্বাস করস? মালের কথা শুনে আর মাথা ঠিক থাকলো না। কারন মাল চাই এখন আমার। আর কিছু বললাম না। চাচার পিছে পিছে বেল গাছের কাছে গেলাম। সামনে পা বাড়িতেই কেমন যেন লক্ষন রেখার মতো আগুন জ্বলে উঠলো।
ও মাগো,,কিরে কি হলো? না চাচা আমি কেমন যেন আগুন দেখতে পেলাম। দেখলাম জগত চাচার চোখ যেন কেমন করে লাল হয়ে উঠলো। আবার পলকেই নাই। আচ্ছা তোর পকেট কি লোহা, শস্য টস্য আছে রে? (জগত চাচা) হ সকালে মা লাল শস্য দিয়া দিসিলো। আগে কইবি না? এখনই ফেলে আয় সামনের পুকুরটায়। আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও পকেটের সব শস্য ফেলে আসলাম পুকুরে। কিন্তু শস্য ফেলার সাথে সাথেই ঐ শশ্মানে যে লাশ পুড়ানো হচ্ছিল ঐটার অস্তিত্ব হঠাৎ করেই মুছে গেল। একটু আগেও এখানে ২০ -২৫ জন মানুষ ছিলো কিন্তু এখন কেউ নেই। কই গেলো সব? আমি দৌড়ে জগত চাচার কাছে আসলাম। চাচা চাচা এইমাত্র এখানে লাশ পুড়াচ্ছিলো? ওরা কই গেল? হাহাহাহা? লাশ কখন পুড়াচ্ছিলো? তোর মাথায় ভূত চাপছে তাই উল্টা পাল্টা দেখতাসস। আয় আয় বস গাঞ্জা বানাই।
জগত আলীর হাসির শব্দে শশ্মানের দারোয়ান ফজলু মিয়া উঠে এলো। ঐ ডাও নামকরা নেশাখোর। তাছাড়া যারা কবর শশ্মানে কাজ করে তারা নাকি নেশা না করলে ঐ সব কাজ করতে পারে না। ফজলু মিয়া এসেই জগত চাচার পাশে বসলো । জগত আলী আমার হাত ধরে টেনে উনার পাশে বসালো। আমি আবার শশ্মানের চুলাটার দিকে তাকালাম। সবই ঠান্ডা। একটা বাঁশের পাতাও নড়ছে না। হঠাৎ করেই জোড়ে এক বাতাস দিলো। সব ধুলো বালি এসে আমার চোখে মুখে । চোখে সব অন্ধকার দেখছিলাম। ও হ্যাঁ এলাকার মেম্বার শশ্মানে একটা লাইটের ব্যবস্থা করেছিলো যার জন্য সবকিছু আলোকিত থাকতো সবসময়।চোখে ধুলো পড়ায় আমি অন্ধের মতো হয়ে গেলাম। ও জগত চাচা আমি কিছু দেখছি না গো। আলো জ্বালাও তোমরা।
ধুলো পড়েছে মনে হয় তোর চোখে , যী যা যা ঐ নদীতে হাত মুখ ধুয়ে আয় , আমরা বানাইতাছি। ( পাশ থেকে ফজলু মিয়া বলে উঠলো) আমি আর দেরী না করে বেল গাছ গুলো ধরে ধরে নদীতে নামলাম। পানি মুখে ছিটিয়ে দিতেই , পানির গন্ধ নাকে ঠেকলো। কেমন যেন মরা গরুর গন্ধ। বমি চলে আসলো আমার । সামনে তাকাতেই দেখি ৪-৫ টা মরা গরু ভেসে আসছে আমার দিকে। আর মাছি ভন ভন করছে গরু গুলোর উপরে। আমি এক প্রকার দৌড়েই উপ্রে উঠে আসলাম। জগত আলী আর ফজলু মিয়া বেল গাছের নিচে বসে মাল বানাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ২-১ টা টান দিয়েই বাসায় যেতে হবে।হঠাৎ কারো ফিসফিসানি কানে আসতেই দাড়িয়ে গেলাম। শশ্মানঘাটের লাইটের আলো এ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে , ফজলু মিয়া আর জগত চাচা মারামারি করছে। আর বলছে ঐ আমি কিন্তু কলিজাটা নিমু, আর তুই রক্ত। জগত চাচার হাতের নখ ইয়া বড় হয়ে গেছে। ফজলু মিয়ার মুখ থেকে রক্ত ঝরছে।
এসব কি দেখছি আমি? এক মূহুর্তেই জন্য মনে হলো আমি ভুল দেখছি। চোখ কচলিয়ে আবার তাকালাম। হ্যা সত্যি ই সব, আগে যা দেখেছি । বেল গাছের আড়ালে থাকাত ওরা আমার দেখতে পায় নি। তখনই মনে হলো আমার পকেটে শস্যের নাই।কিরে ওখানে দাড়িয়ে আছিস কেন? আয় আয় বস। আমি ভয়ে ভয়ে ওদের কাছে গেলাম। ওমনি ফজলু মিয়া চোখ দিয়ে জগত আলীকে কি যেন ইশারা দিলো। ঠিক ঐ মূহুর্তে জগত চাচা বললো,,রাহুল বাবা গিয়ে দেখতো চুলার পিছনে আংটা(কয়লা) পাওয়া যায় কি না? ম্যাচ হারাই গেছে, এখন আগুন ছাড়া ধরমু ক্যামনে।
আমি বাধ্য ছেলের মতো চুলার পিছনে যেতে লাগলাম আর কান পেতে শুনতে লাগলাম ওরা কথা বলে? যা শুনলাম তা শোনার জন্য মোটেই তৈরী ছিলাম না। ফজলু মিয়া বলে উঠলো। আরো ৫ মিনিট বাকি আযান পরার। তোর মনে নেই? আযানের ৩ মিনিট আগে ওরে খাইতে হইবো। না হইলে আমরা শক্তিশালী আত্মা হইতে পারুম না। আমি কোনো রকমে চুলার পাশে এসে বসলাম । ১ মিনিট যেতে না যেতেই জগত চাচা ডেকে উঠলো, ওরে রাহুল আয় , ম্যাচ পাইছি। বুঝলাম ওটা ওদের চাল। চুপ করে বসে রইলাম। আর ১ মিনিট বাকি আযানের। হাতের ঘড়িটায় দেখলাম ।
হঠাৎ পেছন থেকে ফজলু মিয়া রক্তবর্ণ চোখ আর রক্ত মিশ্রিত লালা ঝরিয়ে ঝরিয়ে আমার ঘাড় চেপে ধরলো। জগত চাচা আমার বুকের বাম পাশে লম্বা নখ দিয়ে আছড় দিলো। দুজনই একসাথে হাসছে। আমি এই সুযোগে এক ঝটকায়, ফজলুর হাত সরিয়ে দিলাম ভৌ দৌড়। পেছনে তাকিয়ে তাকিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম। যত দৌড়াচ্ছি ততই ফজলুর হাত লম্বা হচ্ছে। ক্রমশই আমার দিকে এগুচ্ছে। হঠাৎ কোনো কিছু তে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। ওমনি ফজলু এক হাত আমার ডান পা ধরে ফেলেছে। টানতে টানতে প্রায় ওদের কাছে নিয়ে এলো। ওমনি মসজিদের মাইকে আযানের শব্দ ভেসে আসলো। পেছন থেকে হাত টাও সরে গেছে।
জগত আর ফজলুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। দুজনেই চিৎকার দিয়ে আমার নাম নিচ্ছে। আমি আর দেরী না করে , দৌড়াতে দৌড়তে শশ্মানের রাস্তা পার করেই জ্ঞান হারালাম। সকালে জ্ঞান ফিরতেই দেখি এলাকার বিশিস্ট তান্ত্রিক আসাদ সাওর কাছে শুয়ে আছি। পাশে মা বাবা দাড়িয়ে আছে। তা বাবা তুমি ঐ শশ্মানের রাস্তায় শুয়ে ছিলা কেন? আজ্ঞে চাচা , ঐ জগত চাচা আছে না? উনি রাতে বাড়ি ফিরার সময় আমারে নিয়া গেছিলো শশ্মানে। কি কইলা তুমি?
হা চাচা, ঐ জগতই বেশ জোড় বাঁচা বাইচ্চা গেসস বাপ। কাল সকালেই তো ঐ ফজলু আর জগতের লাশ নদীতে পাইছি আমরা। এরপরে বেল গাছের নিচে দাফন করছি সবাই মিলে। আমি উঠে বসতে ই আমার বুক পকেট থেকেই ৩-৪ টা শস্যের দানা বেরিয়ে এলো লাল শস্য।