নাদিরাদের বাসায় যাই না অনেকদিন। বলতে গেলে দেড়বছর। কিছুদিন আগে ওর বাবা মারা গেল। বেচারীর মা মারা গিয়েছিল ওনেক আগেই। মামাদের সাথেও কোন সম্পর্ক ছিল না ওদের। দেড় মাইল দূরে কাকার বাসা ছারা ওদের আর কোন আত্মীয় নাই। নাদিরারা কাকা আমাদের স্কুলের স্যার ছিল। আমরা দুজনেই তার কাছে পড়তাম। খুব স্নেহ করত আমাদের। স্যার আর নাদিরার বাবা দেখতে একইরকম ছিল। তাই ভুলে অনেক বার স্যার কে আংকেল আর আংকেল কে স্যার ডেকেছি। ভাই মারা যাওয়ার পর স্যার নাদিরাদের বাসায়ই থাকছেন।
দীর্ঘদিন পর আসাতে অনেক চেঞ্জ মনে হচ্ছিল ওদের বাড়ি। পুরনো রং ওঠা, ঝোপঝাড়ে ঢাকা। কিজানি আগেও হয়ত এমনই ছিল। ভর সন্ধ্যাবেলা বলে এমন মনে হচ্ছে।মেন দরজা ভিজানো অবস্থায় পেলাম। ছোট্ট একটা বারান্দা পার হতেই বড় শোওয়ার ঘর। ঘরে ঢুকতেই দেখলাম আবছা ভাবে কে যেন শুয়ে আছে। একটু কাছে যেতেই দেখলাম স্যার খালি গায়ে লুঙ্গি পরে শুয়ে আছে। আমিই আগ বারিয়ে কথা বললাম, সালামলাইকুম স্যার। কেমন আছেন? স্যার আবছা গলায় বলল কে? আমি রুমকি। ও তুমি, কখন এলে? এই ত কেবলই, নাদিরা কোথায়? ও একটু বাইরে গেছেন। স্যার এত অন্ধকারে শুয়ে আছেন। লাইট জ্বালাই? না না ! লাইটে আমার চোখ জ্বলে।
একটু অবাক হলাম স্যার ত কখনও এভাবে কথা বলেন না, এমন সে খুবই টিপটপ টাইপের। আজ হঠাৎ এমন উষ্কখুষ্ক। যেন দীর্ঘদদিন গোসল করের না। কেমন যেন স্থির দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি নাদিরার বাবা মানে স্যারের মৃত ভাই য়ের হাস্যউজ্জ্বল ছবির দিকে। অবস্য ভাইয়ের শোকে কাতর হওয়া স্বাভাবিক। এই ভাই ইত তাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে। কিন্তু এত অন্ধকার অসহ্য লাগছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, স্যার আমার খুব খারাপ লাগছে, আংকেল এভাবে মারা গেল, নাদিরার জন্য খুব মায়া হচ্ছে। অনেক আগেই আসতাম কিন্তু পারলাম কই আমাকে থামিয়ে দিয়ে স্যার বলল এতদিন আসনি কেন! অসুস্থ ছিলাম। কিসের অসুখ? ভয় পেয়েছিলাম কিসের ভয়?
স্যার আপনি যুক্তিবাদী মানুষ। এসব বিশ্বাস করবেন না। তবুও বল। নতুন একটা টিউশনি পেয়েছিলাম। লক্ষীপুড়ে। আগে কখনও ঐ এলাকায় যায় নি। ছাত্রের বাড়ি থেকে ফিরার সময় রাস্তায় খুব ভিড় বেরে গেল। ভাবলাম মেন রোড দিয়ে না যেয়ে ভিতর দিয়ে যে রাস্তা গিয়েছে আলীপুরের দিকে, সেদিক দিয়ে যাই। তখন ভর দুপুর বেলা, তিনটা বাজে। লক্ষীপুড়ের ভিতর রাস্তা দিয়ে হাটছি। গলিটা কেমন যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন। ছবির মত দাঁড়ান। নিষ্প্রাণ, নিষ্প্রভ। লোক চলাচল করছে ক্লান্ত ভাবে, কেউ কারও সাথে কথা বলছে না, বাড়িগুল কেমন যেন ফাকা ফাকা। বাচ্চারা পর্যন্ত নিশ্চুপ।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বাতাস এখানে ভারি, জমাট বাধা গুমোট। এমব কি গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না।একটা সাদা মাইক্রো নিশ ব্দে চলে গেল। এউ প্রথম গলিতে কোন যানবাহন দেখলাম। এই রাস্তাটা কি সবাই এড়িয়ে যায়! ক্লান্তি আর অবসাদে পা লেগে আসছিল। এক সময় বামপাশে একটা সাদা ঘর দেখতে পেলাম। কি মনে করে জানালাদিয়ে ভিতরে উকি দিলাম।যা দেখলাম-অপার্থিব অন্ধকার। মাকড়শার জাল যেন বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেমন যেন একটা অনুভূতি হল। হঠাৎ মনে হল ঘরের মধ্যে একটা মানুষের থ্যাতলানো পা। চুপ চুপ করে রক্ত ঝড়ছে এর পরে কি হল? স্যারের কথায় সৎবিদ ফিরে পেলাম। আমার আসলে সেই সময় দৌড় দেয়া অচিত ছিল। কিন্তু আমি পারলাম না।
কেউ যেন আমার মস্তিষ্কে চেপে বসেছিল। সে আমাকে দৌড়াতে দিল না, কেমন যেন ঘোড় লাগা পায়ে হেটে হেটে আলিপুর এলাম। তারপর একটা রিকশায় উঠলাম। আমার চোখে মুখে নিশ্চই কোন পরিবর্তন এসেছিল। নইলে রিকশাওয়ালা আমাকে দেখেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আমাকে অগ্রাহ্য করতে পারল না, তারচেয়েও বড় কথা আমি তাকে ভাড়া না দিয়েই নেমে এসেছিলাম। ঐ সময় আমার ভাড়া বা পার্থিব কোন জিনিস খেয়াল ছিল না। গুটি গুটি পায়ে বাসায় এলাম। ঘরে ঢুকতেই কেমন ভ্যাবসা বাতাসের সাথে বারি খেলাম। খাটে শুতেই মনে হল আরও কেও যেন আছে। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। মার ডাকে ঘুম ভাংল। রাত তখন দেড়টা।
আমাকে মশারী টানাতে বলল। এর মধ্যে আমি নাকি রাত ৯:০০ টায় উঠে সবার সাথে খাবার খেয়েছি। তরকারী পছন্দ হয় নি বলে প্লেটও ভেংগেছি!!! তাই মা রাগ করে মশারী টানিয়ে দেয় নি। কিন্তু এখন অভিমান ভুলে ডাকতে এসেছে। সেই রাতে আমার আর ঘুম এল না। সারাক্ষণ মশারীর ভেতর দাপাদাপি করলাম। বলতে দ্বিধা নেই আমার খুব মরার ইচ্ছে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি খুব খুব অশান্তি র মধ্যে আছি। এর থেকে একমাত্র মৃত্যুই আমাকে মুক্তি দিতে পারে, সারাক্ষণ কষ্টের অনুভুতি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই গ্রহে আমার কেউ নেই, কোন কিছুই নেই, আমি সম্পূর্ন একা, প্রচন্ড একা। সম্পূর্ন ভাবে একাকী শূণ্য একটা জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই পথ। মৃত্যু। কিভাবে মারা যাব। রাস্তায় কোন গাড়ি দেখলেই লাপ দিতে ইচ্চে হচ্ছিল। বারান্দা দিয়ে নিচের রাস্তায় তাকিয়ে থাকলাম। শো শো করে গাড়ি চলছিল।
প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিল তিন তলার বারান্দা থেকে লাফ দিই। কিন্তু বেচে থাকার এক আদিম প্রবৃত্তি থেকে সেই রাতে জীবিত রইলাম। পরের দিব সকালে বাবা যখন হাটতে বের হল মনে হল সিড়ির নিচে কোন এক অদৃশ্য প্রেত কায়া আমাকে ডাকছে। বলছে মারা যাও। উফ!! কি বিভৎস যন্ত্রণা। আর পারলাম না, সোজা ছাদের চাবি নিয়ে চার তলার ছাদে চলে গেলাম। এইবার এখান থেকে লাফ দেব, দেবই। এই চাপা কষ্ট, এই অভিশাপ থেকে চিরতরে মুক্তি। পা থেকে স্যান্ডেল খুললাম। রেলিং এ উঠলাম। লাফ দেব এই মূহুর্তে চোখে পরল বাগানে দেয়াল ঘেষে মাধবী লতা ঊঠেছে। কি সুন্দর স্নিগ্ধ গোলাপি। ঝিরি ঝিরি ভোরের বাতাস বইছে, আমি আর লাফ দিতে পারলাম না, মাথাঘুরে পরে গেলাম।
যখন চেতনা ফিরল দেখলাম আমার মাথায় মা পানি ঢালছে। ছাদ খোলা পেয়ে মা আটকাতে এসেছিল। দেখে যে আমি রেলিং এর কাছে অচেতন। সেইবার আমার একসপ্তাহ জ্বর ছিল। খবর পেয়ে আমার নতুন ছাত্র তার মাকে সাথে নিয়ে এসেছিল। আমি তাদের সব বললাম। ছাত্র টি বলল আমি যে গলি টা দিয়ে এসেছিলাম, অটা ছিল লাশকাটা গলি। দিনের বেলাও সেই পথ দিয়ে কেও যেতে চায় না। আর সেই সাদা ঘরেই লাশ কাটা হয়। কয়েকদিন আগে সেই ঘরে একক আক্সিডেন্ট হওয়া লাশ এসেছিল। ঠিক দূর্ঘটনা নয়,ইচ্ছে করেই আত্মহত্যা করা এক ঋনগ্রস্থ লোক। এই কথা শুনার পর স্যার একটু চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। বলল আর কিছু শোননি? না। আর কিছু বোঝনি? না।
আসলে সেই লোকটি আমিই ছিলাম। এই কথা বলে স্যার হো হো করে হাসতে লাগল। আমি দেখলাম এ স্যার কোথায়! এ যে আংকেল। কি গগন বিদারী হাসির আওয়াজে কান ফেটে গেল। চিৎকার করে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। সেই সময় স্যার আর নাদিরা আমাকে ধরে ফেলল। তারা বাজার করে ফিরছিল।