পৌষ মাসের মাঝ রাত। তুহিনের মোটর বাইকটা ফাঁকা রাস্তায় প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলেছে। শোঁ শোঁ করে চোখ মুখের ওপর আছড়ে পড়ছে হিমশীতল বাতাসের ঝাপটা। ছুটন্ত বাইকে তুহিনের কাছে শীতটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তুহিনের পরনে থাকা লেদার জ্যাকেট, জিন্সের প্যান্ট ফুঁড়ে ফুঁড়ে ঠাণ্ডা বাতাস সূঁচের মতো গায়ে বিঁধছে। তুহিনের পায়ে জুতো, হাতে হাতমোজা, মাথা কান এবং গলা একটা উলের মোটা মাফলার দিয়ে পেঁচানো বলে তবু কিছুটা রক্ষে। তা না হলে বোধহয় ঠান্ডায় জমে যেত।
তুহিন লেবুখালি গ্রাম থেকে তাদের রূপাতলির বাড়িতে ফিরছে। প্রায় ত্রিশ বত্রিশ কিলোমিটারের পথ। লেবুখালি গ্রামে তুহিনের বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি। তুহিনের বড় বোনের ননদের আজ বিয়ে হয়েছে। সেই বিয়েতে অংশগ্রহণ করতেই তুহিন লেবুখালি গিয়েছিল। কথা ছিল রাত দশটার মধ্যেই বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। গ্রামের বিয়ে বলে কথা, রাত দশটার জায়গায় রাত একটা বেজে যায়।
অনেক রাত হয়ে গেছে দেখে তুহিনের বোন তুহিনকে থেকে যেতে বলেছিল। তুহিন রাজি হয়নি। সরগরম বিয়ে বাড়িতে রাত কাটানো মানে ঘুম হারাম করা। এটা নিশ্চিত, ও বাড়ির কেউ আজ রাতে এক ফোঁটাও ঘুমোতে পারবে না। এছাড়া কাল সকাল সাড়ে নয়টায় তুহিনের একটা ইম্পর্টেন্ট ক্লাস আছে। তুহিন হাজী আব্দুল কাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। বিয়ে বাড়িতে থেকে গেলে সকালের ক্লাসটা মিস হত। বিয়ে বাড়িতে সারাদিন অনেক হাসি তামাশা, আমোদ ফূর্তি, ছোটাছুটি হয়েছে। তুহিন এখন খুবই ক্লান্ত। সে এখন চাইছে যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে পৌঁছে, নিজের পরিচিত বিছানায় গরম লেপের ভেতর ঢুকে পড়তে। শীত যতটা সে হিসেবে কুয়াশা নেই বললেই চলে। অনেক দূর পর্যন্ত বাইকের হেড লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ তুহিন বেশ চমকে উঠল। রাস্তার মাঝ বরাবর কুচকুচে কালো রঙের মোটাসোটা একটা বেড়াল নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। বেড়ালটা স্থির চোখে সোজা বাইকের হেড লাইটের দিকে তাকিয়ে আছে। হেড লাইটের আলোয় বেড়ালটার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। তুহিন বাইকের গতি কমিয়ে ফেলল। বেড়ালটার একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে যেতেই বেড়ালটা অলস ভঙ্গিতে রাস্তার পাশে নেমে গেল। তুহিনের মনে একটা ভাবনা ঢেউ খেলে গেল – ওর দাদীজান বলতেন, ‘ নিশুতি রাইতে পথের মইধ্যে কালা বিলই দেহা খুবই অলক্কুনে’। দাদীর বলা কথা মনে করে তুহিন নিজের মনেই একটু হাসল। আগেকার দিনের মানুষের কত ধরনেরই না
কুসংস্কার ছিল! ফাঁকা রাস্তায় ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে তুহিনের বাইকটা একটানা ছুটেই চলেছে। তুহিন ‘সাধুর বটতলা ‘ নামক জায়গায় পৌঁছে গেছে। এখানে রাস্তার পাশে অনেক দিনের পুরানো একটা কবরস্থান রয়েছে। বর্তমানে কবরস্থানটা বোধহয় পরিত্যক্ত। তুহিন কবরস্থানের পাশ ঘেঁষে ছুটছে। অনেক দূর থেকেই হেড লাইটের আলোয় চোখে পড়ল কবরস্থানের গেটের সামনে সাদা রঙের বোরখা পরা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মহিলার কোলে সাদা কাপড়ে পেঁচানো পোঁটলার মতো যেন কি একটা। মহিলা হাত উঁচিয়ে তুহিনকে বাইক থামানোর জন্য ইশারা করছে।
তুহিন মহিলার সামনে গিয়ে বাইক দাঁড় করাল। অমনি তুহিনের নাকে ধাক্কা মারল আতর, লোবান, কর্পূরের মিশ্র তীব্র গন্ধ। মহিলার মুখ নেকাব দিয়ে ঢাকা। এমনকি চোখদুটোও দেখা যাচ্ছে না। মহিলা কেমন যেন পাথরের মূর্তির মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মহিলার বেশভূষা আর আতর, লোবান কর্পূরের গন্ধে তুহিনের প্রচণ্ড অস্বস্তি হতে লাগল। তুহিন অস্বস্তি মিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ” থামালেন কেন আমায়? কি দরকার বলুন? ” বাইকটা স্টার্ট অবস্থায় রয়েছে বলে প্রশ্নগুলো গলা উঁচিয়ে করতে হল। মহিলা কেমন রুক্ষ ধাতব কন্ঠে আদেশের মতো করে বলল, “আপনি তো বেলায়েতপুর বড় রাস্তা হয়ে যাবেন। আমাকে আপনি বেলায়েতপুর বড় রাস্তার মোড়ের মাথা পর্যন্ত নিয়ে চলুন”।
তুহিন বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ” আপনি এত রাতে এখানে কেন এসেছিলেন? “মহিলা তার কোলে সাদা কাপড়ে প্যাঁচানো পোঁটলাটা দেখিয়ে বলল, ” এই বাচ্চাটাকে দাফন করার জন্য নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখি কবরস্থান বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ নেই। তাই আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি”। তুহিনের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল এইবার। এতক্ষণ সে ভালভাবে লক্ষ্য করেনি, মহিলার কোলে থাকা যেটাকে সে এতক্ষণ একটা পোঁটলা বলে মনে করেছে, সেটা আসলে একটা ছোট বাচ্চার কাফনে পেঁচানো লাশ। লাশটার গা থেকেই আতর, লোবান আর কর্পূরের গন্ধ ভেসে আসছে। তুহিন কিছুটা ভীত গলায় বলল, ” আপনি একা একজন মেয়ে মানুষ, এত রাতে লাশ দাফন করতে এসেছেন, এসব কি বলছেন আপনি?”
মহিলা উত্তরে বলল, ” আমাদের বাড়িতে কোনও পুরুষলোক নেই। আমার বোনের দুই মাস বয়সী এই বাচ্চাটা আজ রাতে মারা গেছে। মরা বাচ্চা তো আর ঘরে ফেলে রাখা যায় না। তাই আমিই দাফন করতে নিয়ে এসেছিলাম”। তুহিনের কাছে মহিলার কথা কেন জানে মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। যত যা-ই হোক, এত রাতে একা একটা মেয়েমানুষ লাশ দাফন করতে কিছুতেই কবরস্থানে আসতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনও ফন্দিফিকির সাজিয়েছে। আজকাল প্রায়ই পেপারে দেখা যায়, একদল সঙ্ঘবদ্ধ দুষ্টচক্র গভীর রাতে, যাত্রাপথে লাশ সাজিয়ে, অসুস্থ রোগী দেখিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে দাঁড় করিয়ে, অটোরিকশা, ট্যাক্সি ক্যাব, প্রাইভেট কার, মোটরবাইক ছিনতাই করে। এই মহিলাও বোধহয় সেরকম কোনও চক্রের সদস্য।
তুহিন তাই কঠিন স্বরে মহিলাকে বলল,” আমায় মাফ করবেন। আমি আপনাকে সঙ্গে নিতে পারব না” বলে বাইকের গিয়ার তুলতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মহিলা থমথমে গলায় বলে উঠল, ” এই গভীর রাতে, একটা বাচ্চার লাশ সহ একটা অসহায় মহিলাকে তুই একা ফেলে চলে যাচ্ছিস, এর ফল ভাল হবে না। সামনে তোর অনেক বিপদ”। তুহিন কবরস্থানের সীমানা ছেড়ে একটানে অনেক দূর চলে এল। কিন্তু তার মনের ভেতর মহিলার বলা শেষ কথাগুলোয় কেমন খচখচ করতে লাগল সামনে তোর অনেক বিপদ সামনে তোর অনেক বিপদ সামনে তোর অনেক বিপদ তুহিনের মনে ভাবনা জাগল, মহিলাকে সে যা ভেবেছে, মহিলা হয়তো তাই নয়। হয়তো মহিলা সত্যি সত্যিই বিপদগ্রস্ত, অসহায়। সে বোধহয় কাজটা ঠিক করল না।
মহিলাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসাই বোধহয় উচিত ছিল। তুহিন বাইক ঘুরিয়ে আবার কবরস্থানের দিকে যেতে লাগল। অনেক দূর থেকেই হেড লাইটের আলোয় মহিলাকে দেখতে পেল সে। মহিলা এখনও কবরস্থানের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এ কি করছে মহিলা! সে বাচ্চার লাশের গা থেকে কাফনের কাপড়টা খুলে ফেলছে। সত্যিই ছোট্ট একটা বাচ্চার লাশ। তবে বাচ্চাটা আজ রাতে মারা যায় নি। মারা গেছে অন্তত দুই-তিন দিন আগে। কারণ লাশটা কেমন ফোলা ফোলা আর ফ্যাকাসে। মহিলা কাফনের কাপড়টা সম্পূর্ণ খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল।ফুলে ঢোল হওয়া বাচ্চার উলঙ্গ লাশটার হাত-পা শক্ত হয়ে রয়েছে। মহিলা তার দু-হাতে বাচ্চার লাশটার পায়ের নলা দুটো ধরে, উল্টিয়ে ঝুলিয়ে প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় দু-দিকে হ্যাঁচকা টান দিল। হ্যাঁচকা সেই টানে লাশটার দুই উরুর সংযোগ স্থল থেকে কাঁধ পর্যন্ত ছিঁড়ে দুই ভাগ হয়ে গেল। ছেঁড়া দুই ভাগের এক ভাগের সাথে যুক্ত রইল গলা সহ বাচ্চার মাথাটা। ছেঁড়া দুই খন্ড দিয়ে টপটপ করে ঝরতে লাগল জমাট বাঁধা থিকথিকে কালচে রক্ত।
মহিলা এবার মুখ থেকে নেকাবটা খুলে ফেলল। এ কি দেখছে তুহিন!!! মহিলার ভয়ঙ্কর বীভৎস একটা মুখ। চোখের জায়গায় চোখবিহীন দুটো গাঢ় অন্ধকার কোটর। নাকের জায়গায় পাশাপাশি দুটো ফুটো। ঠোঁটের আবরণহীন উন্মুক্ত মুখ ভর্তি সূঁচালো দাঁতের সারি। বীভৎস চেহারার নারী, ছিঁড়ে দুই ভাগ করে ফেলা বাচ্চার লাশটার একটা ভাগ মুখে তুলে চপাচপ করে খেতে লাগল। বাচ্চার লাশটার গা থেকে বের হওয়া পচা কালচে রক্তে মহিলার মুখ, হাত, সাদা বোরখা মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। আর সহ্য করা যায় না। এ কি সত্যি না কোনও দুঃস্বপ্ন! তুহিনের বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা ধড়াস ধড়াস করে লাফাতে লাফাতে ফেটে যাবার উপক্রম হলো। এত শীতের মাঝেও সে ঘেমে নেয়ে উঠেছে। বাইকের মুখ ঘুরিয়ে সে ঝড়ের গতিতে ছুটতে লাগল।
কবরস্থানের এলাকা ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছে তুহিন। এখনও তার বাইকটা ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে। মনে হচ্ছে সে যেন শূন্যে ভেসে ছুটছে। সে কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। এ কি দৃশ্য দেখল সে!!! যা দেখেছে তা কি সত্যি না বিভ্রম? হঠাৎই বাইকটা ঘড় ঘড় শব্দ তুলে কয়েকটা ঝাঁকুনি খেয়ে স্টর্ট বন্ধ হয়ে গেল। রাস্তার একপাশে বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে আবার স্টার্ট করার জন্য চেষ্টা করতে লাগল তুহিন। বাইকের তেলের ট্যাঙ্কিতে রিজার্ভ তেল ঠিকমতো আছে। প্লাগেও ময়লা জমেনি। অন্য কোনও সমস্যাও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কিছুতেই বাইকটা স্টার্ট নিচ্ছে না। কিকারে কিক করতে করতে তুহিনের পা ব্যথা হয়ে গেল। বাইকটা যে একেবারেই স্টার্ট নিচ্ছে না তা নয়। মাঝেমাঝে ঠিকই স্টার্ট হচ্ছে কিন্তু গিয়ার তুলে রানিং করতে চাইলেই রানিং না হয়ে স্টার্ট বন্ধ হয়ে ,যাচ্ছে।
বাইকটা স্টার্ট হবার পর গিয়ার তুলে রানিং করতে গিয়ে যখন স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন যদি তুহিন বাইকের পেছনে নজর করত, তাহলে সে দেখতে পেত – তার বাইকের পেছনের চাকাটা দুটো ছোট ছোট হাত টেনে ধরছে। ছোট বাচ্চার কনুই থেকে ছেঁড়া দুটো ছিন্ন হাত। তুহিন যখন বীভৎস চেহারার সেই মহিলাকে বাচ্চার লাশটা ছিঁড়ে দুই ভাগ করে খেতে দেখে বাইক ঘুরিয়ে পালিয়ে এসেছিল, তখন সেই মহিলা তুহিনকে পালাতে দেখে বাচ্চার লাশটার হাত দুটো কনুই থেকে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। অমনি হাত দুটো জীবন্ত প্রাণীর মতো পিলপিল করে তুহিনের বাইকের পেছনে ছুটতে শুরু করে।
বাইকের পেছনে ছুটতে ছুটতে এই পর্যন্ত পৌঁছনোর পর হাত দুটো বাইকটার নাগাল পেয়ে যায় এবং পেছনের চাকা টেনে ধরে বাইকটা থামিয়ে দেয়। এখনও স্টার্ট তুলে রানিং করতে চাইলে পেছনের চাকা টেনে ধরছে ছিন্ন হাতদুটো। তুহিন যখন বাইক থেকে নেমে, বাইকের সামনে পেছনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সমস্যা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, তার আগেই হাত দুটো অতি দ্রুততার সাথে পিলপিল করে রাস্তার পাশের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে। তুহিনের চোখে ফ্যাকাসে ছিন্ন হাতদুটো ধরা পড়ছে না। আধ ঘন্টা ধরে অনেক প্রচেষ্টা কৌশল খাটিয়ে গায়ের ঘাম ছুটিয়েও বাইকটার আর স্টার্ট তোলা সম্ভব হল না তুহিনের পক্ষে। নিরাশ হয়ে সে হাল ছেড়ে দিল। বাইক রেখে রাস্তার মাঝ বরাবর দাঁড়াল তুহিন, যদি এই পথে কোন বাস ট্রাক বা অন্য কোনও যান রূপাতলির দিকে যায়, সেটাকে থামিয়ে লিফট চাওয়ার উদ্দেশ্যে। নীরব নির্জন একটা জায়গা। চারদিক খাঁ খাঁ করছে।
আকাশে কৃষ্ণপক্ষের মরা চাঁদ। চাঁদের আলোয় রাস্তার দুপাশে যতদূর দেখা যায় শুধু ধূ ধূ ফসলের ক্ষেত। তুহিন পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। ফোন করে বাড়িতে জানাবে, বাইক নষ্ট হয়ে সে পথের মাঝে আটকা পড়েছে। কি আশ্চর্য! মোবাইল সেটটাও কখন যেন পকেটেই বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। তুহিন অনেক টেপাটেপি করল কিন্তু ফোনটা আর অন হলো না। বোধহয় চার্জ ফুরিয়ে গেছে। অথচ বিয়ে বাড়ি থেকে রওনা দেবার আগেও ফুল চার্জ ছিল। তুহিনের বুকের ভেতর এখনও ধকধক করছে। সে কি দৃশ্য দেখে এসেছে!!! তা কি এত সহজে ভোলা যায়! এখানে এসে বাইক খারাপ হয়ে গিয়ে আবার এই দুর্ভোগ! তার ওপর মোবাইলটাও কাজ করছে না। আজ রাতে কপালে আরও কত কি লেখা আছে কে জানে! এর চেয়ে বিয়েবাড়িতে থেকে গেলেই হত। একটা রাত না ঘুমোলে আর কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত! নিজের ওপরই এখন নিজের রাগ বাড়ছে তুহিনের।
তুহিনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দূর থেকে দুটো হেডলাইটকে এদিকে ছুটে আসতে দেখা গেল। তুহিন সঙ্গে সঙ্গে গা ঝাড়া দিয়ে দু হাত তুলে যানটাকে থামতে ইশারা করল। যানটা এসে একেবারে তুহিনের সামনে দাঁড়াল। একটা ট্রাক। ট্রাকে ট্রাকের ড্রাইভার এবং ড্রাইভারের পাশের সিটে দুজন রোগা চেহারার হেলপার বসে। তিনজনের গায়েই সাদা রঙের পাঞ্জাবি টুপি পরা। আজব দৃশ্য! পাঞ্জাবি টুপি পরা ট্রাক ড্রাইভার হেল্পার সাধারণত দেখা যায় না। ড্রাইভার লোকটা জানলা দিয়ে মাথা বের করে বলল, “কি সমস্যা? গাড়ি থামালেন কেন?” লোকটার গলার স্বরটা যেন কেমন রসকষহীন রুক্ষ।চোখদুটো জবা ফুলের মতো লাল। পাথরের মতো স্থির চোখের মণি। বোধহয় নেশাটেশা করেছে।
তুহিন অসহায় গলায় বলল, ” ভাই, আপনারা কতদূর যাবেন? আমার বাইকটা নষ্ট হয়ে গেছে, আমাকে যদি সঙ্গে নিয়ে যেতেন”। ড্রাইভার লোকটা তেমনিই রুক্ষভাবে বলল, ” আমরা রূপাতলী পেট্রোল পাম্প হয়ে ঝালকাঠির দিকে যাব। ” তুহিন বলল, ” আমায় রূপাতলী পেট্রোল পাম্পের সামনে নামিয়ে দিলেই হবে”।” ওঠেন তবে”, এই বলে ড্রাইভার হেল্পার দুটোর দিকে তাকিয়ে বলল, ” তোরা যা, মোটর সাইকেলটা পেছনে উঠিয়ে দিয়ে নিজেরাও পেছনে বসে থাক গে”। তারপরই তুহিনের দিকে তাকিয়ে ডাকল, ” আইসেন, আমার পাশে আইসে বসেন”। ট্রাক ছুটে চলেছে। ড্রাইভারের পাশের সিটে তুহিন বসে আছে।
ট্রাক ড্রাইভার, হেল্পার এদের সাথে কথা বলে, এদের সংস্পর্শে এসে বীভৎস দৃশ্যটা দেখে পাওয়া ভয়টা অনেকটাই কেটে গেছে তুহিনের। অবশ্য এদের কাছে সে সেই ভয়ানক দৃশ্যটার কথা বলেনি। বললে এরা আবার তার সম্পর্কে কি মনে করবে কে জানে, তাই না বলাই ভাল। চলন্ত ট্রাকে ড্রাইভারের পাশের সিটে মাথা এলিয়ে নিজের অজান্তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল তুহিন। হঠাৎ ট্রাকটা থেমে যাওয়ায় তার ঘুম ভেঙে গেল। আশপাশে তাকিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল সে কোথায় এসে পৌঁছেছে। না রূপাতলী পেট্রোল পাম্পে পৌঁছয়নি, অন্য কোথাও। রাস্তার দু’পাশে ঘন অন্ধকার। রাস্তার বাম পাশ ঘেঁষে ট্রাকটা দাঁড় করানো। তুহিন হতচকিত দৃষ্টিতে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, ” এখানে ট্রাক থামালেন কেন?” ড্রাইভার কেমন কাটাকাটা গলায় বলল, ” ট্রাকের পেছনে একটা লাশ আছে। সেই লাশটা এই কবরস্থানে দাফন করা হবে”।
তুহিন আতঙ্কিত গলায় থতমত খেয়ে বলল, ” লাশ! কবরস্থান! এর মানে কি? আপনাদের ট্রাকে লাশ এল কোথা থেকে? ড্রাইভার তুহিনের আতঙ্কিত চেহারা দেখে একটা শুকনো হাসি দিল। সেই হাসি দেখে তুহিনের গা শিরশির করে উঠল। যেন কোনও মৃত মানুষের হাসি। মুখের হাসি মিলিয়ে যেতেই ড্রাইভার লোকটা থমথমে গলায় বলল, ” লাশ, কবরস্থান – শুনে এত ভয় পাচ্ছেন কেন? সবাইকেই তো একদিন লাশে পরিণত হয়ে কবরস্থানে যেতে হবে। এই ট্রাকে খানপুরা থেকে একটা লাশ আনা হয়েছে এই কবরস্থানে দাফন করার জন্য। লাশটা দাফন হয়ে গেলে পর আপনাকে রূপাতলী পৌঁছে দেব। চলেন এখন সবাই মিলে লাশটা দাফন করে আসি”।
তুহিন আর কি করে, দুরুদুরু বুকে ড্রাইভারকে অনুসরণ করে ট্রাক থেকে নামল। ড্রাইভারের সাথে ট্রাকের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ট্রাকের পেছনে অন্তত বিশ পঁচিশজন লোক। একটি লন্ঠন। লন্ঠনের আলোয় দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেকের গায়ে সাদা ধবধবে পাজামা -পাঞ্জাবি -টুপি। সবাই মিলে ধরাধরি করে ট্রাক থেকে লাশের খাটিয়া নামাচ্ছে। বাতাসে আতর, লোবান আর কর্পূরের তীব্র গন্ধ ভাসছে। তুহিন ভেবে কুল পাচ্ছে না, সে কি করে ঘুণাক্ষরেও টের পেল না, এটা একটা লাশ বহনকারী ট্রাক। আর ট্রাকের পেছনে এতগুলো লোক আছে। বোধহয় লোকগুলো অতিরিক্ত রকম চুপচাপ স্বভাবের বলেই সে তাদের অস্তিত্ব টের পায়নি।
লাশের খাটিয়া কাঁধে নিয়ে সবাই মিলে গোরস্থানের দিকে এগোতে লাগল। তুহিন থ হয়ে ভাবতে লাগল, এ কোথাকার গোরস্তান কে জানে? তবে ভয়ানক দৃশ্যটা দেখা সেই ‘ সাধুর বটতলা’র গোরস্থান নয়। কারণ সেই গোরস্থানের সামনেটা অন্যরকম। বাস্তবিক এটা সেই ‘ সাধুর বটতলা’রই পরিত্যক্ত গোরস্থান। তারা এখন গোরস্থানটার পেছনের গেটের সামনে রয়েছে বলে রাতের অন্ধকারে তুহিন ঠিক চিনতে পারছে না। তুহিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ড্রাইভার লোকটা তার পাশে এসে বলল, ” দাঁড়িয়ে রয়েছেন ক্যান? চলেন লাশটা দাফন করে আসি। একজন মৃত মানুষকে দাফন কাফন করা তো সকলের দায়িত্ব”।
সবার সাথে তুহিনও গোরস্থানের ভেতর ঢুকল। নির্দিষ্ট স্থানে যেখানে নতুন কবরটা খোঁড়া হয়েছে সেখানে গিয়ে কাঁধ থেকে খাটিয়া নামিয়ে, দুজন লোক নেমে পড়ল কবরের ভেতর। ধরাধরি করে খাটিয়া থেকে লাশ নামানো হলো কবরে। লাশ কবরে শুইয়ে লাশের মুখের কাপড় সরিয়ে ফেলা হলো শেষবারের মতো মৃতের মুখটাকে সকলকে দেখানোর উদ্দেশ্যে। অন্য সবার মতো তুহিনও ঝুঁকে লাশের মুখটা দেখতে লাগল। কম বয়সী একটি যুবক ছেলের মুখ। মুখটা কেমন পরিচিত পরিচিত লাগছে। কোথায় যেন এই মুখটা তুহিন দেখেছে। কোথায় দেখেছে? কোথায় দেখেছে? কোথায়???
ভাবতে ভাবতে মনে পড়তেই তুহিন প্রচন্ডরকম শিউরে উঠল। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল ভয়ের শীতল স্রোত। বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা লাফাতে লাফাতে গলার কাছে উঠে আসতে চাইল। বিস্ফারিত চোখদুটো যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। লাশের ওই মুখটা তুহিনেরই। তার নিজেরই লাশ সেটা। প্রতিদিন আয়নায় শেভিং করার সময় সে এই মুখটাকেই দেখে। না, কোনও সন্দেহ নেই, এ তার নিজেরই মুখ। লাশের মুখ থেকে চোখ তুলে তুহিন ভীতসন্ত্রস্ত চোখে অন্য সবার দিকে তাকাল। কি আশ্চর্য! সবাই কেমন অস্বাভাবিক রকম চোখ বড় বড় করে স্থির দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। সবার চেহারায় কেমন একটা নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি।
তুহিন চোখ ঘুরিয়ে ভীত চোখে আবার কবরের ভেতর লাশের দিকে তাকাল। কি অবাক কান্ড। তার চোখের সামনে ধীরেধীরে বাতাসে মিলিয়ে গেল লাশটা! তুহিনের বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা ধড়াস ধড়াস করে প্রচন্ডভাবে লাফাচ্ছে। পাংশু মুখে সে আবার মুখ তুলে লোকগুলোর দিকে তাকাল। লোকগুলো এক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। লোকগুলোর চোখ থেকে মণি গায়েব হয়ে বেড়ালের চোখের মতো জ্বলে উঠেছে। ট্রাকের ড্রাইভার – হেল্পার, তাদের সবার চোখও একইরকম। তুহিনের ভীত বিহ্বল চেহারা দেখে লোকগুলো হঠাৎ একসঙ্গে বিকট অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। হাসির শব্দে আকাশ পাতাল কেঁপে উঠল। হাসতে হাসতে লোকগুলোর ঘাড়ের ওপর মুন্ডুটা সামনে থেকে পেছনে ঘুরতে লাগল। যেন প্রতিটা লোকের মুণ্ডু ঘাড়ের ওপর আলাদাভাবে বসানো।
বাঁচতে হলে আর এক মূহুর্তও এখানে নয়। পালাতে হবে। ঝেড়ে দৌড় লাগাল তুহিন। পেছনে সকলের মিলিত হাসির শব্দও তাড়া করতে লাগল। তুহিন রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে উন্মাদের মতো। কৃষ্ণপক্ষের শেষ রাতের ম্লান চাঁদের আলোয় কাঁটা ঝোপঝাড়, জঙ্গল মাড়িয়ে, হাঁচড়ে পাঁচড়ে ছুটেই চলেছে। ঝোপঝাড়, জঙ্গলে হোঁচট খেয়ে পড়ে হাত পা ছড়ে যাচ্ছে, সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ না করেই ছুটে চলেছে তুহিন । তার মনে তখন একটাই ভাবনা, গোরস্থানের সীমানা অতিক্রম করে তাকে পালাতে হবে।
দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ কিসের সাথে যেন পা হড়কে ছিটকে একটা গভীর গর্তের ভেতর পড়ে গেল তুহিন। গাঢ় অন্ধকারে গভীর একটা গর্ত। গর্তের মধ্যে লম্বালম্বি ভাবে সটান হয়ে পড়ল সে। বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে। গর্তটা থেকে ওঠার মতো জোর আর তার গায়ে অবশিষ্ট নেই।
ততক্ষণে সাদা পোশাকধারী ভয়ঙ্কর চেহারার সেই লোকগুলো চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরেছে। লোকগুলোর হাতের লন্ঠনের আলোয় বোঝা গেল এতক্ষণ যেটাকে সে গর্ত মনে করেছে, সেটা আসলে নতুন খোঁড়া সেই কবরটা। বিশাল গোরস্থানের সীমানার মধ্যে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে ছুটতে ঘুরে ফিরে তুহিন নতুন খোঁড়া কবরটার ভেতরেই ছিটকে পড়েছে।
তুহিন কবরের ভেতর থেকে ” বাঁচাও….বাঁচাও” বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু তার গলা দিয়ে ঘোঁত ঘোঁত করে একজাতীয় শব্দ ছাড়া আর কিছুই বেরোচ্ছে না। আর লোকগুলো গম-গম করে আকাশ পাতাল ফাটিয়ে সমস্বরে হাসতে হাসতে ধীরেধীরে তুহিনকে মাটি চাপা দিয়ে দিচ্ছে।