প্রায় তিন-মাস হতে চলেছে শহরে নেমে এসেছে ভয়ংকর নিস্তব্ধতাl একটা ভূতুড়ে পরিস্থিতি গ্রাস করেছে পরিবেশটাকেl সকলের চোখে-মুখে সু-স্পষ্ট আতঙ্কl সন্ধ্যা নামলেই মরুভূমির মতো জনশূন্য হয়ে যাচ্ছে পুরো-শহরটাl নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে থাকছেনাl
টেলিভিশন চ্যানেল-গুলো ক্রমাগত প্রতিবেদন প্রচার করে চলেছে ‘ খবরে প্রকাশ, গত তিন-মাস ধরে যে মর্মান্তিক সিরিয়াল হত্যা-কান্ড ঘটে চলেছে কোন ভাবেই তার কোন রহস্য-জট উন্মোচন করা যাচ্ছেনাl একের পর এক অতি-সুক্ষ ভাবে ঘটে চলেছে দানবীয় হত্যা-যজ্ঞ! কে সেই ভয়ংকর অপরাধী! কার হিংসার শিকার হচ্ছে মানুষ-জন! তার উদ্দেশ্য-ই বা কি! আমরা জানতে চাই, আমরা চাই এই রহস্যের সমাধান হোকl পুনরায় ফিরে আসুক প্রাণ-চাঞ্চল্য নাগরিক-জীবনেl অনাকাঙ্খিত আর কোন অপ-মৃত্যু চাইনা আমরাl সংশ্লিষ্ট মহলের সু-দৃষ্টি কামনা করছি অনতিবিলম্বেl
সর্ব-প্রথম হত্যা করা হয় শহরের বেশ নামি-দামি ব্যাবসায়ী কে , তারপর একজন ডাক্তারকেl শহরের পাশ দিয়ে যে রেল-লাইন গেছে তার ওপর খুব ভোরে আবিষ্কার করা হয় তাদের পড়ে থাকা নিথর মৃত-দেহl গলার দুই-পাশে ছিলো দুটো গভীর ক্ষতl ধারালো দাঁতের দংশন বলেই মনে হয়েছে ওটা এবং ধারালো নখ দিয়ে বুক চিরে হৃদপিন্ড ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করাl
এরপর, পাওয়া গেলো পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্ম-কর্তার লাশ l হত্যার ধরণ একই-রকমl পুলিশ ব্যারাকের খুব কাছেই পড়ে ছিলো তার দেহ-খানাl অতঃপর, নামে-বেনামে একই ভাবে ঘটে চলেছে একের পর এক হত্যা-কান্ড, একই কায়দায়l আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এর কোন কূল-কিনারাই করতে পারছেনাl পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ কিংবা ডাক-সাইটে গোয়েন্দা সংস্থা-গুলো একেবারেই অন্ধকারে রয়ে গেছেl
অবশেষে, কিছুটা হলেও অবসান হয় এই নারকীয় রহস্যেরl কোথা-থেকে যেন একটা গায়েবি বার্তা পৌঁছে যায় টেলিভিশন চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম-গুলোতে ” আমি দামিনী, বাবা আদর করে ডাকতো মিনি বলেl মাত্র দশম-শ্রেণীতে উঠেছি তখন, কতোই আর বয়স হবে! আমি একটু চঞ্চল বেশিই ছিলাম, খেলা-ধূলা আর ছোটা-ছুটিতেও ছিলাম সেরাl কিন্তু আমার সেই উচ্ছলতা কেড়ে নিলো শকুনের দলl হায়েনার মতো খুবলে-খুবলে খেলো আমার অস্থি-মজ্জাl আমাকে বাঁচতে দিলোনা এই পৃথিবীর বুকেl
সেদিনের কথা ভুলতে পারিনা কোন-ভাবেইl বৈশাখ মাস ছিলোl বিকেল-বেলা যখন স্কুল ছুটি হলো, চারিদিকে ভয়াবহ অন্ধকার করে শুরু হলো প্রচন্ড কাল-বৈশাখী ঝড়l স্কুল থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে অনেক বড় একটা মাঠ পেরোতে হয়l ঝড় বইছে তখন, গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টিও ছিলোl মাঠের ঠিক মাঝ-বরাবর যখনই গিয়েছি আমি, হঠাৎ করেই কয়েকজন মানুষরূপী নরখাদক আমার সামনে এসে হাজির হয়l আমাকে ঘিরে ধরে তারাl আমি গুনে দেখলাম, সংখ্যায় তারা ছয় জনl তারা আমাকে নিয়ে বিভিন্ন অশ্লীল কথা বলতে থাকে ‘ মাল টা কিন্তু কচি! হেভি মজা হবে আজ!’ তারা আমাকে জাপটা ধরে কোলে করে মাঠের পাশেই একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে যায়l আমি আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করতে থাকি ‘ বাঁচাও, কে আছো আমাকে বাঁচাও!’
আমার চিৎকার কারও কানেই পৌঁছেনাl আসলে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বাইরে সে সময় কোন লোক থাকার কথাও ছিলোনাl আর মাঠের আশে-পাশে কোন ঘর-বাড়িও ছিলোনাl তারপর, আমার শেষ-সম্বল সম্ভ্রম-টুকু কেড়ে নেয় ওরা পশুর মতো! একে-একে ছয় জন! উহ ! কি বীভৎস! আমার কথা বলার কোন শক্তি ছিলোনাl শুধু গোংরাতে থাকি আমিl রক্তে ভেসে যায় আমার সারা শরীরl মরার মতো পরে থাকি আমি!
তারপর, আমাকে মৃত ভেবে ওরা সন্ধ্যার দিকে মেইন রাস্তার ধারে ফেলে রেখে চলে যায়l কিছু-ক্ষণ পর একটা গাড়ি থামে আমাকে দেখে, আমি বেশ বুঝতে পারিl গাড়ি থেকে নেমে আসেন এক ভদ্র-লোক, আমার বাবার বয়সীl আমাকে বলেন,” কি হয়েছে তোমার মা? এখানে কি করে আসলে?” আমার কথা বলার শক্তি ছিলোনা, আমি ইশারায় তাকে ঘটে যাওয়া ঘটনা বোঝানোর চেষ্টা করি l উনি বললেন, ”বুঝতে পেরেছি, আমি সব ব্যবস্থা করছিl হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে তোমাকেl আর কোন চিন্তা নেই তোমারl”
একটু হলেও হাফ ছেড়ে বাঁচি আমিl আর ভাবি, বোধহয় সৃষ্টি-কর্তাই তাকে পাঠিয়েছেন আমাকে উদ্ধার করার জন্যেl আবার ভাবি, সত্যিই কি ঈশ্বর বলে কিছু আছে? যদি থেকেই থাকে, তবে তখনই কেন রক্ষা করলো না আমাকে?
ভদ্র-লোক আমাকে তার গাড়িতে তোলেনl কিন্তু! হাসপাতালের কথা বলে তিনি আমাকে তার পরিচিত এক আবাসিক হোটেলে নিয়ে যানl একটা কক্ষে প্রবেশ করেন আমাকে নিয়েl হাসপাতাল কোথায় জানতে চাইলে বলেন,’ তুমি বসো, আমি এখনই ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসছিl’
কিছু-ক্ষণ পরে এসেই আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, বাবার মতো লোকটা! আমাকে বেধেঁ সারা-রাত ধরে ভোগ করেন আমাকে যথেচ্ছা-ভাবেl আমি মূর্ছা যাই বার-বারl
অবশেষে, ভোর-বেলায় গাড়িতে উঠিয়ে একটা হাসপাতালের বারান্দায় আমাকে ফেলে রেখে চলে যানl হাসপাতালের নার্স, আয়ারা মিলে আমাকে ভেতরে নিয়ে যায়l পরে আমাকে ভর্তি করা হয় বিশেষ ইউনিটেl সেই-দিন সন্ধ্যায় কর্তব্য-রত চিকিৎসক আমাকে ডেকে পাঠান তার চেম্বারে, ভিকটিমের যাবতীয় টেস্ট করতে না বলেনl কিন্তু কেন! তিনি বলেন বিপদ তোমার শিরায়-শিরায়! যে বা যারা এই কাজ করছেন তাদের ক্ষমতার কাছে আমার মস্তক নতl তিনি বলেন, এ বিষয়ে যেন কাউকে কিছু না বলি আমি , সেটাই আমার আর আমার পরিবারের জন্য মঙ্গল হবেl
সবশেষে, পুলিশ আসেl বিস্তারিত জানার জন্যে সাথে করে নিয়ে যায় আমাকে থানায়l এবং, রক্ষক-ই যে ভক্ষক আরেকবার প্রমাণ করেন তিনিl তদন্তকারী কর্ম-কর্তাও যে তাদের দলে মিশে আছে সেটা জানতে আমার বেশি সময় লাগেনিl অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালি করে আমায়l বেশ্যা প্রমাণ করার জন্য তখন তিনি তৎপরl বুঝে গেলাম আর কিছুই হবেনাl
তবে যেহেতু মানুষ তাই মানুষের প্রতি একটু আস্থা ছিল, কিন্তু চূড়ান্ত প্রহসন তখনও অপেক্ষা করছিলো আমার জন্যেl ডাক্তার আর পুলিশ মিলে রিপোর্ট তৈরী করেন যে, ‘ধর্ষণের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি , মেয়েটি বেশ্যা বৃতি করে গোপনেl’ তারপর ছেড়ে দেন আমাকেl
তখন আর কোথায়! কার কাছে যাবো আমি! সব হারিয়ে নি:স্ব আমিl মা বাবা ছাড়া যারা পাশে ছিলেন আস্তে আস্তে তারা আমাকে উপেক্ষা করতে লাগলেনl ধীরে ধীরে আমি সামাজিক রীতিনীতি থেকে অবহেলিত হতে শুরু হলামl সেই যন্ত্রনা একদিন বাঁধ ভাঙলl আমি চলে যাই রেল-লাইনের কাছেl অপেক্ষা করতে থাকি রাতের শেষ ট্রেনটার জন্যেl কতো-গুলো নর-পশু বাঁচতে দিলোনা আমাকেl আমি আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হলামl সেই থেকেই প্রেতাত্মা আমি! রক্তের নেশায় উন্মাদ হয়ে যাইl প্রতিদিন মানুষ-রুপি পশুদের রক্ত দিয়ে হাত না রাঙালে শান্তি পাইনা আমিl যুগ-যুগ চলবেই আমার নৃশংসতাl তোমাদের ধরা-ছোঁয়ার অনেক বাইরে আমিl নপুংসুক পুরুষের দল, এখনও সময় আছে সাবধান হও!
প্রেতাত্মা হলেও লজ্জিত আমি প্রজন্মের নিকটl পুরুষ-তান্ত্রিক এই নষ্ট-সমাজে নয় থেকে নব্বই কেউ নিরাপদ নয়l ছোট্ট শিশুকে যখন বাড়িতে নৈতিক শিক্ষা দেয়ার কথা, তখন আমরা তাদেরকে শোনাই সতর্ক-বার্তা’ খুব সাবধান থাকবে, বাবার মতো দেখতে যে শিক্ষক, তার কাছ থেকেl কিংবা, অবিকল কাকুর মতো লোকটার ফাঁদে পড়বে নাl কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ-রুপি পশুদের জন্য আজ গোটা পুরুষজাতি কলঙ্কিতl কি ঘরে, কি বাইরে নারীর নিরাপত্তা কোথাও নেইl তবে ভয় পাবেন না , আমি বাকি পুরুষজাতি কে সন্মান করি, তাদের কোনো ক্ষতি করবো নাl
তবে এটা আমার অগ্নীবার্তা সেই সব মানুষ-রুপি পশুদের জন্য সময় থাকতে নিজেকে শুধরে নে , নচেৎ আমি একটাকেও ছাড়বো নাl রক্ত চাই আমার রক্ত! তোদের কলিজার রক্ত! যতদিন তোরা নারীর ওপর পশুদের মতো আচরণ করবি না , রণে বনে জঙ্গলে আমি পৌঁছিয়ে যাবো তোদের কলিজার রক্ত খেতেl আমি যে তোদের মত নপুংসুক শকুনদের রক্তে আসক্ত হয়ে পড়েছি! একটাকেও ছাড়বো না!