মদিনার অদুরের জ্বীন পাহাড়

মদিনার অদুরের জ্বীন পাহাড়

তুরস্ক, মিসর, আলজিরিয়া, মরক্কো শেষ করে অবশেষে ঢুকলাম সৌদি আরবে। ধর্মীয় এ দেশের “ওয়াদি জ্বীন” তথা জ্বীন পাহাড় দেখার খুব সুখ ছিল আমার। কারণ দেশে থাকতেই শুনেছিলাম, মদিনা সন্নিহিত এলাকায় নাকি এমন এক পাহাড় আছে, যেখানে কোরানে বর্ণিত জ্বীনদের বসবাস এবং তারা ঐ পাহাড়ের দিকে যা কিছু যায় বা যেতে চায়, তাকেই ঠেলে দেয় বিপরীত তথা মদিনা শহরের দিকে।

মক্কা উম্মুল কুরআা ভার্সিটিতে কর্মরত ভাইপো শিবলি ৪ মার্চ/২০১৭ নিজে ড্রাইভ করে নিয়ে গেল আমাদের ‘ওয়াদি বায়দা’ এলাকার বর্ণিত ওয়াদি জ্বীন পাহাড়ের দিকে। মরু প্রধান সৌদি আরব মুলত শুষ্ক হলেও ওয়াদি বায়দা-তে পকুরের মত জলাশয় দেখলাম, যার চারদিকে প্রচুর খেজুর গাছ। ওয়াদি জ্বীনের কাছাকাছি সড়কে অনেক মানুষের জটলা দেখলাম, যারা পরীক্ষা করছে রাস্তায় পানি ও বোতল ফেলে।

হ্যা, আমরাও নিজেরা অংশ নিলাম এ পরীক্ষাতে এবং আমাদের মক্কার জলভর্তি “সাফা পানির বোতল” বিস্ময়করভাবে প্রবল গতিতে উপরের দিকে ছুটলো। মদিনা অবস্থানরত বরিশালের রবিন বোতল খুলে পানি রাস্তায় ফেললো এবং নিজ চোখে দেখলাম পানি নিচের দিকে না গিয়ে উপরের দিকে গড়াচ্ছে। মনে প্রশ্ন জাগলো শক্তিশালি কোন ম্যাগনেট পাহাড় থাকতে পারে মদিনা তথা উঁচুর দিকে। কিন্তু চৌম্বকীয় আবেশে কি পানির বোতল টানবে নিজের দিকে?

শিবলি বললো, এবার গাড়ি রাখবো নিউট্রলে দেখবেন গাড়ির কি হয়! এবং তাই করলো সে। ক্রমশ গাড়ি উপরের দিকে উঠতে থাকলো। গতি বাড়তে থাকলো গাড়ির কিন্তু গিয়ার নিউট্রলেই রইলো। ক্রমে ৮৫-কিমি গতি উঠলো গাড়ির কিন্তু এক্সিলেটরে চাপ দিলোনা সে। ব্রেক করে থামাতে বললাম তাকে। আবার পেছনে ঢালুর দিকে ফিরলাম। ঢালুর দিকে নামতে গাড়িকে ১ম/২য় গিয়ার চালাতে হলো, এক্সেলেটর চাপতে হলো জোরে। বস্তুবাদি আমি এর ব্যাখ্যা বুঝতে পারলাম না একটুও! : সৌদি আরবের ভয়ংকর ও বিস্ময়কর এ স্থানের নাম – ওয়াদি জ্বীন ! ওয়াদি জ্বীন মদিনা শহরের আল বায়দা মরুদ্যান উপত্যকায় অবস্থিত, পৃথিবীর বিস্ময়কর স্থানগুলির মধ্যে একটি । যদিও সৌদি সরকারের কঠোর নীতি কারণে এই দর্শনীয় স্থানটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজরে তেমনভাবে আসেনি ।

ওখানে নাকি কোন স্থানীয় সৌদি ট্যাক্সি চালক যায়না কারণ সৌদিরা ওয়াদি জ্বীন এলাকায় যেতে ভয় পায় । শ্রীলংকা, পাকিস্তানি, ইন্ডিয়ান ও বাঙালি অনেক ট্যাক্সি চালকরা যায় প্যাসেঞ্জার নিয়ে । মদিনার আল বায়দা উপত্যকাটি মসজিদে নববীর উত্তর পশ্চিম দিকে প্রায় ৩০-কিমি দুরে অবস্থিত। এলাকাটি কালো বড়বড় ভয়ংকর পাহাড় ঘেরা। ২০০৯-২০১০ সালের দিকে সৌদি সরকার ‘ওয়াদি জ্বীন’ নামক স্থান দিয়ে একটি সড়ক বানানোর পরিকল্পনা করে এবং হাজার হাজার শ্রমিককে কাজে লাগায়। কিন্তু কাজ ৩০-কিলোমিটার পর্যন্ত করার পর সমস্যা শুরু হয় । হঠাৎ নাকি দেখা গেল, কাজ করার যন্ত্রপাতি আস্তে আস্তে ওপরের দিকে তথা মদিনা শহরের দিকে অটোম্যাটিক যাওয়া শুরু করে দিয়েছে ।

যেন কেউ যন্ত্রপাতিগুলো মদিনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পিচ ঢালাই করার জন্য বড় রোড রোলারগুলো বন্ধ থাকলেও, আস্তে আস্তে তা উপর দিকে উঠতে থাকে এবং মদিনা শহরের দিকে নিজে নিজে চলতে শুরু করে। এসব দেখে কর্মরত শ্রমিকরা ভয় পেয়ে যায় । তারা কাজ করতে অস্বীকার করে । মাত্র ৩০-৪০ কিঃমিঃ রাস্তাটি করার পর কাজ বন্ধ হয়ে যায় । রাস্তাটি ২০০ কিঃমিঃ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু শ্রমিকরা প্রচণ্ড ভয় পাওয়ায় এবং এই রাস্তায় গাড়ি এক্সিডেন্ট হতে পারে এই ভেবেই এখানেই কাজ সমাপ্ত করা হয় । অনেকেই বলেন, রাস্তায় গাড়ি বন্ধ করে গিয়ার নিউট্রালে রাখলে ক্রমশ ১২০-কিমি রেও স্পিডে গাড়ি চলতে থাকে এখানে জ্বীনদের কারণে!

স্থানিয় সৌদিরা মনে করে, ওয়াদি জ্বীনে গাড়ি নিয়ে গেলে, জ্বীনরা গাড়ি ঠেলে মদিনার দিকে পাঠিয়ে দেয়। অন্ধবিশ্বাসে, ভয়ে কিংবা নিরাপত্তাজনিত কারণে সৌদি পুলিশ ঐ এলাকায় সন্ধ্যার পর কোন দর্শনার্থীতে প্রবেশ করতে দেয়না। তবে সকাল থেকে প্রাক-সন্ধ্যা পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ ঐ পাহাড় দেখতে, সড়কে বোতল/পানি ফেলে গতি পরীক্ষা করতে ও গাড়ির গতি পরীক্ষা করতে সমবেত হয়। শোনা কথা এই যে, রাতে নাকি স্থানীয় লোকজন “গায়েবি আওয়াজ” শোনে যে, “এটা আমাদের বসতি। এখানে তোমরা এসোনা। মদিনার দিকে চলে যাও”! অবশ্যই এসব আওয়াজ কে কখন শুনেছে তেমন লোকজন পাওয়া যায়নি। সবই “গায়েবি আওয়াজ”!

প্রাক ইসলাম যুগের আরবের মানুষরা জ্বীন নামক এক প্রকার অশরীরি জীবে বিশ্বাস করতো, যারা মরুভূমিতে প্রাণি ও মানুষদের ভয় দেখাতো কিংবা বেপথে পরিচালনা করতো। ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের অন্তত কয়েক শত বছর পূর্বে প্রাচীন আরবে জ্বীনের আরাধনা প্রচলিত ছিল বলে নৃতত্ত্ববিদেরা প্রমাণ পেয়েছেন। পালমাইরার নিকট বেথ ফাসিল থেকে প্রাপ্ত আরামিক লিপিতে “জিনায়ে” কে “ভাল এবং ফলপ্রসূ ঈশ্বর” হিসেবে সম্মান জানানো হয়েছে। এই ব্যাপারে বিতর্ক আছে যে, “জিনায়ে” শব্দটির থেকে আরবি জ্বীন শব্দের উৎপত্তি। কোরান এবং ইসলাম ও প্রাক-ইসলাম যুগের সাহিত্যে অসংখ্যকবার জ্বীনের উল্লেখ ইঙ্গিত দেয় যে, জ্বীনের অস্তিত্বে বিশ্বাস প্রাক-ইসলামিক বেদুইন ধর্মে বেশ প্রভাবশালী ছিল।

জ্বীন শব্দটি যে আরামিক থেকে আগত তা খৃষ্টানরা প্যাগান ঈশ্বরদের ডেমন আখ্যা দেয়ার মাধ্যমে সে ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, যা পরবর্তীতে আরবিয় লোকগাঁথায় প্রাক-ইসলামিক যুগে প্রবেশ করে। জুলিয়াস ওয়েলহসেন পর্যবেক্ষণ করেন যে, এই ধরণের আত্মারা জনশূন্য, অন্ধকার ও নোংরা পরিবেশে বিরাজ করে, যেখানে সচরাচর এদের ভয় পাওয়া হয়। প্রচলিত মতে, মানুষকে এদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলতে হয়। যদিও এদের বাস্তব অস্তিত্ব প্রশ্নস্বাপেক্ষ।

হাদিসে জ্বীনেরা গর্তে বসবাস করে ও গোবর এবং মৃত পশুর হাড় তাদের খাদ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন অনুসারে জ্বীন জাতি মানুষের ন্যায় আল্লাহ সৃষ্ট অপর আরেকটি জাতি, যারা পৃথিবীতে মানব আগমনের পূর্ব থেকেই ছিল এবং এখনো তাদের অস্তিত্ব রয়েছে। তবে মানুষের চোখে তারা দৃষ্টিগ্রাহ্য নয় কিন্তু জ্বীনরা মানুষদেরকে দেখতে পায়। তাদের মধ্যেও মুসলিম এবং কাফির (নাস্তিক!) ভেদ রয়েছে। তাদের আয়ু মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। তারা ৩০০ বছর বয়সে যৌবনপ্রাপ্ত হয়। ঈমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে, জ্বিন জাতি তাদের অবয়ব পরিবর্তন করতে পারে। প্রাচীন সেমাইট জাতির জনগণ জ্বীন নামক সত্ত্বায় বিশ্বাস করতো।

তাদের মতানুসারে, নানাপ্রকারের জ্বীন পরিলক্ষিত হয় যেমন, ঘুল (দুষ্ট প্রকৃতির জ্বীন যারা মূলত কবরস্থানের সাথে সম্পর্কিত এবং এরা যেকোন আকৃতি ধারণ করতে পারে), সিলা (যারা আকৃতি পরিবর্তন করতে পারতো) এবং ইফরিত (এরা খারাপ আত্মা)। এছাড়া মারিদ নামক এক প্রকার জ্বীন আছে যারা জ্বীন দের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। প্রাচীন আরবদের মতে জ্বীনরা আগুনের তৈরি। কুরআন এবং হাদীসের মতে, জিনদের তৈরি করা হয়েছে ধোঁয়াবিহীন আগুন (আরবি শব্দ- ‘নার’) হতে। ‘নার’ শব্দটির কয়েকটি অর্থ আছে। ইবনে আব্বাসের (রাঃ) মতে, নার বলতে অগ্নিশিখার শেষ প্রান্ত বোঝানো হয়েছে। অন্য অনেকে মনে করেন, এর মানে হচ্ছে বিশুদ্ধ আগুন।

আবার নার মানে জাহান্নাম। আবার কেউ কেউ একে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ বা অন্য কোনো তরঙ্গ-জাতীয় অস্তিত্ব বলে থাকেন। ইসলামী বিশ্বাস মতে, জিনদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির আগে। বলা হয়েছে, মানবজাতির আবির্ভাবের আগে জিনরাই এই পৃথিবীতে রাজত্ব করত। পরে অবাধ্যতার অপরাধে এদেরকে উৎখাত করা হয়েছে। তাই বর্তমানে এরা পৃথিবীতেই নির্জন স্থানসমূহে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে। কালী উপাসক বৈদিক কাপালিকদের মত ইসলামে “জ্বীন সাধক” রয়েছে।

বস্তুবাদি আধুনিক তরুণরা এ পাহাড়ের কাহিনিকে আজগুবি ভ্রান্ত (Hoax) ঘটনা মনে করে। ওয়াদি জ্বিন এলাকার বিপরীতগামিতাকে তারা নিউটনের ‘অভিকর্ষতার সূত্র’ অনুসরণে ঘটে বলে যুক্তি দিতে চেষ্টা করে।

বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। যাতে সে বলতে চেয়েছেন যে, “ওয়াদি-ই-আল বায়দা” উপত্যকাটি পাহাড় দিয়ে এমনভাবে ঘেরা, যাতে উপত্যকায় দাঁড়িয়ে মনে হবে যে, উপত্যকার ঢালটি মদিনার বিপরীতমুখী। আর তাই যখন থেমে থাকা কোনো গাড়ি আপনা আপনি রাস্তার ঢালের বিপরীতে মদিনা অভিমুখে চলতে শুরু করে, তখন বিস্ময়ে অবাক হওয়ারই কথা।

প্রকৃতপক্ষে রাস্তাটি কিন্তু মদিনা অভিমুখেই ঢালু। এটা ওয়াদি জ্বিন এলাকায় দাঁড়িয়ে জটিল ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণে আসলে বোঝা যায়না। যেমন চলন্ত ট্রেনে বুঝতে পারিনা আমরা স্থান ও ট্রেনের গতি। তার প্রবন্ধে সে বলেছে, ওয়াদি জ্বীনের অবস্থান আসলে 24°43’21.65″N 39°26’57.67″E, যার উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ৯২৭ মিটার। কিন্তু মদিনার উচ্চতা গুগল ম্যাপ অনুসারে ৬২১ মিটার। সুতরাং ৯২৭ মিটার উচ্চতা থেকে পানি ৬২১ কিমির দিকে গড়িয়ে যাবেই যৌক্তিকভাবে।

আমি বস্তুবাদি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হলেও ভূবিজ্ঞানী নই। তাই বিষয়টা ঠিক ঢুকছেনা এ অগভীর মস্তিস্কে। কিন্তু চোখের সামনে আমি দেখেছি পানি, জলসহ জলের বোতল ওপরের দিকে উঠতে। গাড়ি ৮০ কিমি স্পিডে চলতে দেখেছি নিউট্রাল অবস্থায় বিনা এক্সেলেটরে।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত