ল সম্পর্কে জানার আগে আসুন আমরা ভুডু কি তা জানি। “ভুডু” অর্থ স্রস্টা ঈশ্বর কিংবা বিরাট আত্মা। শব্দটির উৎপত্তি ‘ফন’ জাতির কাছ থেকে। এরা ‘ইউই’ সম্প্রদায়ভুক্ত। এই রহস্যময় শব্দের সাথে অনেক গা ছমছমে ভৌতিক ধারণা জড়িয়ে আছে। যেমন নরবলি, রক্তপান ইত্যাদি। ভুডু বলতে আজ অবশ্য ‘হাইতির’ ধর্মকেই বোঝায়। ভুডুর অপর নাম “বনডাই লোয়া”। ভুডুর ঈশ্বর-এর নাম ‘বনডাই’ একেশ্বর। আর ‘লোয়া’ হল আত্মা। লোয়া হল ঈশ্বরের অনুগত। নানা ধরনের লোয়া হতে পারে। যেমন: ভালো, মন্দ, জন্ম, স্বাস্থ ইত্যাদি।
ফন জাতি আদিম সমাজে ‘উইচ-ডক্টর’ বা ‘রোজারা’ (তৎকালীন ডাক্তার) এমন ব্যক্তি ছিলেন, যারা ব্ল্যাক ম্যাজিক জানতেন। অতীন্দ্রিয় শক্তির বলে প্রেতত্মাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। আর প্রেতত্মাদের দিয়ে সম্ভব-অসম্ভব যে কোনো কাজ করে ফেলতে পারতেন খুব সহজেই। সে কারণে ওই সময় রোজারা একাধারে চিকিৎসক, জাদুকর এবং পুরোহিতের ভূমিকা পালন করতেন।
বর্তমানকালেও আদিম-সামাজিক ব্যবস্থায় বসবাসকারীদের মধ্যে উইচ-ডক্টর বা রোজাদের প্রভাব দেখা যায়। আদিম জাতির মধ্যে রোজাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হতো। রোজারা তাদের ডাকিনী বিদ্যা খাটিয়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে পারতেন। চোর বা হত্যাকারী ধরা ও শাস্তি প্রদানে রোজাদের অপরিহার্য ভূমিকা ছিল। এছাড়াও তারা জাদুবিদ্যার সাহায্যে রোগ নির্ণয় এবং এর প্রতিকার করতেন। তারা তাদের শিশুদের রোগাক্রান্ত করতে পারতেন এবং মানুষের মৃত্যুও ঘটাতে পারতেন।
উইচ বা রোজা জানা যায় মানুষের মৃত্যু ঘটানোর জন্য তারা নানা ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। কখনো মানুষের একটি ছোট আকৃতির পুতুল তৈরি করে তাতে পিন বিদ্ধ করতেন। যেমনটি আমরা সিনেমায় দেখে থাকি। আবার কখনো কোনো লোকের চুল বা নখের টুকরো সংগ্রহ করে তা মাটিতে পুঁতে রাখতেন। এগুলো যখন আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেত মানুষটিও ক্রমেই মৃত্যু মুখে পতিত হতো। এ ধরণের ব্ল্যাক ম্যাজিক আমাদের দেশে খুবই প্রচলিত। রোজারা প্রায়ই রোগের চিকিৎসার জন্য গাছ-গাছড়া, লতাপাতা ব্যবহার এবং রোগের সংক্রমণ দূর করার জন্য পানি ব্যবহার করতেন।
কখনো তারা জাদুকরী পাথরসহ পানি ছিটিয়ে দিতেন। তারা জাদুকরী গান, প্রার্থনা এবং আশ্চর্য ভঙ্গিমায় নৃত্য করতেন। এর উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের মনকে প্রভাবিত করা। রোজারা সবসময় রঙিন পোশাক পরতেন। মুখোশ ধারণ এবং মুখমণ্ডল চিত্রিত করতেন। কেউ কেউ পশুর চামড়াও পরিধান করতেন। বস্তুত মানুষকে সম্মোহিত করতেন। আর লোকজন বিশ্বাস করতে বাধ্য হতো যে, তাদের সৌভাগ্যে জন্য রোজারাই দায়ী।
অনেকে ভাবে ভুডু মানেই অশুভ কিছু। আসলে ভুডু সে রকম কিছু নয়। এটি আসলে নানান আদিম সংস্কার ও কৃত্যের আড়ালে থাকা একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। ধারনা করা হয় হয় ১৭১৯ থেকে ১৭৩১ সালে ভুডু চর্চার উৎপত্তি (হাইতিতে)। ভুডু নিয়ে সর্ব প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার নাম “হোয়াইট জম্বি” (1932)। হাজার রকম কিম্ভুতকিমাকার পুতুল আর ভুডু চর্চার নানা উপকরণে সাজানো যুক্তরাষ্টের “নিউ অরলিন্স” শহরের ভুডু যাদুঘর বর্তমানে পর্যটকদের আর্কষনের কেন্দ্রবিন্দু। তবে আফ্রিকায় এর চর্চা অনেক বেশি।
আফ্রিকার ঘানার আদিবাসীরা ভুডু চর্চায় অনেক বেশি ভরসা করে। (ককুজানের) অধিবাসী এ বিদ্যাটির সাঙ্ঘাতিক অনুরাগী। বছরের পর বছর ধরে এমনটিই করে আসছে তারা। শোনা যায়, ভুডুবিদ্যার সাহায্যে নাকি কবরের লাশ জ্যান্ত করে তাকে গোলামের মতো খাটানো যায়। যাদের বলা হয় (ডঙ্কি বা জোম্বি)। নিজের ইচ্ছেমতো তাকে দিয়ে সব ধরনের কাজ করানো যায়। যদিও বিজ্ঞান এমনটি মানতে নারাজ। (শামানের) কাজ মৃত মানুষের আত্মা নিয়ে। কেননা তারা বিশ্বাস করে আত্মায়। শামানকে কেউ বলে জাদুকর, কেউ কবিরাজ। শামান কথাটি এসেছে সাইবেরিয়ার “তুঙ্গুস” ভাষী মেষপালকদের কাছ থেকে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর ভ্রমণকারীরা প্রথম শামানদের ব্যাপারে বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন। জানা যায় যে শামানরা এমন ধরনের মানুষ যাদের রয়েছে অবিশ্বাস্য শক্তি। শামানরা শুধু বিশ্বাস করে আত্মায়। তাদের কোনো দেবতা নেই। তবে তারা শুধু বিশ্বাস করে আত্মায়। তাদের কোনো দেবতা নেই। তবে ভুডু অনুসারীদের বিভিন্ন দেবতা আছে। যেমন (ফ্লিমানি কোকু হলো রোগমুক্তির দেবতা, হেভিও সো হলো, বিদ্যুৎ এবং বজ্রের দেবতা, মেমি ওয়াটা ধনসম্পদের দেবী) ইত্যাদি। দেবতার ওপর তাদের এত বিশ্বাস যে, তারা মনে করে, আগুন তাদের ক্ষতি করতে পারে না। ছুরি দিয়ে পেট কাটলেও তারা ব্যথা পায় না।
তারা বলে, দেবতারা তাদের সব বিপদ থেকে রক্ষা করে। মৃতব্যক্তির আত্মার কাছ থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করে তারা। শামানদের প্রধান বাসস্থান এক সময় সাইবেরিয়া হলেও সোভিয়েতদের অত্যাচারে তারা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। শামান বর্তমানে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের শহরাঞ্চলেও। শামানদের ব্যাপ্তি সাইবেরিয়া থেকে ল্যাপল্যান্ড, বিব্বত, মঙ্গোলিয়া, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা (বিশেষ করে আমাজন এলাকায়) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি ভারতেও বিস্তৃত। পূর্ব ভারতে “সোরা” নামে এক উপজাতি আছে তারা জঙ্গলে বাস করে। এরাও শামান সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। সোরা উপজাতির লোকেরা মৃতের সাথে কথা বলে। তাদের কোনো দেবতা নেই।
আত্মা ছাড়া কোনো দেবতার ওপর তাদের বিশ্বাসও নেই। এরা আত্মাকে বিভিন্ন কাজে লাগায়। ভালো কাজের চেয়ে খারাপ কাজেই বেশি আত্মাদের ব্যবহার করা হয়। তাই ভুডু এক ধরনের অপবিদ্যা। ভুডু অনুসারীরাও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ভুডুবিদ্যাকে। এদের ধারণা যারা ভুডুবিদ্যা জানে, তারা ইচ্ছা করলেই যাকে খুশি তার ক্ষতি করতে পারে। আত্মা দিয়ে মানুষকে ভয় দেখানো ইত্যাদি অনেক কাজ করাতে পারে। তাই যারা একবার ভুডু অনুসারী হয়, তারা আর সহজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না।
ভুডু ডল বলতে আমরা একটি পুতুলকেই জানি, যাকে দিয়ে কালো বিদ্যা করা হয়, জাদুটোনাসহ বিভিন্ন রকম কাজ করা হয়। এমনকি মানুষকে হত্যার মতো জঘন্য কাজও করা হয় ভুডু পুতুল দিয়ে। ভুডুর পুরোহিতের আয়ত্তে রয়েছে অবিশ্বাস্য শক্তি। তবে পুরো ব্যাপারটাই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে জর্জরিত।
পৃথিবীর কেউ কেউ ইচ্ছে করে ভুডু অনুসারী হয়, আবার অনেকেই এটাকে ফ্যাশন হিসেবে করতে চায়। তবে কালো চর্চা কখনোই শুভ কিছু বয়ে আনতে পারে না। বর্তমানে হাইতিসহ অন্যত্র আট কোটি মানুষ ভুডু চর্চা করে। এর বাইরে অনেকের কাছে ভুডু হলো শিল্প।