মিজোরামের আতঙ্ক

মিজোরামের আতঙ্ক

নিতেন পাথুলে, চম্ফাইয়ের একজন পৈথে উপজাতী। দুটি দোকান আছে শহরে তার। এখানের যোগাযোগ ব্যবস্থা ততটা উন্নত নয়। চম্ফাই থেকে সামান্য আইজল যেতেই প্রায় এক প্রহর কেটে যায়। নিজ গ্রাম থেজাওয়াল থেকে চম্ফাই পৌঁছতেও তাকে বেশ বেগ পোহাতে হয়। আপনাদেরকে চম্ফাই সম্বন্ধে কিছু বলে নিই, চম্ফাই দক্ষিন-পূর্ব ভারতের মিজোরাম প্রদেশের মায়ানমার সীমান্তবতী একটি ছোট্ট শহর।

রাজধানী আইজল থেকে বেশি একটা দুরে নয়। ছোট্ট এ জনপদ ঘিরে রয়েছে গাছ-গাছালি ঘেরা বন, বিভিন্ন বন্য প্রানি আর বিস্তীর্ন পাহাড়ী এলাকা। এ এলাকায় বিভিন্ন উপজাতির মানুষ রয়েছে। বাঙালী বলতে গেলে ১% ও হবেনা, তুলনামূলকভাবে বৌদ্ধ ধর্মের লোকসংখ্যা এখানে অধিক। আরো আছে খৃষ্টান আর কিছু সংখ্যক মুসলিম। মিজোরামের অন্যান্য শহরগুলো যেমন লুংলেই, কোলাসিব, মামিত, আইজল, সাইহা ইত্যাদি শহরগুলোর মত চম্ফাই একদমই জনবহুল নয়। এখানের অধিকাংশ মানুষ বনজ সম্পদ আর ঝুম চাষের উপর নির্ভরশীল। স্বল্পসংখ্যক মানুষ আছে যারা অন্যান্য উপায়েও জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। লুসাই আর পৈথে উপজাতির লোক সর্বাধিক এ অঞ্চলে।

নিতেন নিজ ব্যবসা পরিচালনা করতে নিত্যই থেজাওয়াল থেকে চম্ফাই আসা যাওয়া করেন। দীর্ঘ ২২ বছর হল একাই তিনি সব কিছু দেখাশোনা করছেন। এখন সময় এসছে নিজ ছেলেকে সবকিছু গুছিয়ে দেয়ার। তার একটি মাত্রই ছেলে, সীয়ান। বয়স ২৫ ছুঁই ছুঁই। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গত বছর হল গ্রাজুয়েশান কমপ্লিট করেছে সে। এখন নিজেই কিছু করার চিন্তা করছে। বাবার খেয়াল ছেলেকে ব্যাবসা গুছিয়ে দিয়ে একটু আরাম করার।

হারিকেনের আলোয় পথ চলাটা খুব বিরক্তিকর, এ আলোয় দুরবর্তী কোন কিছু আবছাভাবেও বোঝা অসম্ভব প্রায়। দেখতে চাওয়াটা আরও বিড়ম্বনার বটে। তার উপর পাহাড়ী আকাবাকা পথ। ভারি বর্ষনে পাহাড়ের মাটি ধ্বসে অনেক জায়গায় ভেজা মাটির উঁচু ঢিবি তৈরী হয়েছে, পা পড়লেই দেবে যায়। মাটিগুলো একপ্রকার এমন আঁঠালো যে, পা একবার পড়লে তুলে আনতে বেশ বেগ পোহাতে হয়। এক হাতে সাইকেল আর এক হাতে হারিকেন ধরে বাজারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সীয়ান। ওকে চম্ফাই যেতে হবে, ওর পিসি এসছেন লুংলেই থেকে। তাকে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু তার আগে থেজাওয়াল বাজার পর্যন্ত পৌছুতেই ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

রাস্তার এমন বিদিগিচ্ছিরি অবস্থা জানলে সাইকেলটা আর কষ্ট করে বইতে হতনা। অর্ধেক পথ এসে আবার পিছন ফিরে যাওয়াটা সম্পূর্নই বোকামি। থেজাওয়াল থেকে গাড়িতে যেতে হবে চম্ফাই। ভারি বর্ষন হলেও আকাশে এখন মেঘের ছিটেফোটাও নেই। তারাগুলো বেশ উজ্জল হয়ে জ্বলছে, আকাশটা যেন এক নৈস্বর্গিক রুপ নিয়েছে। নাগেশ্বরের বাগানটা এখন বোঝা যাচ্ছে। গাছগুলো দুর থেকে দেখলে একদম ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগে। ভীত হতে অন্ধকারে এর চেয়ে বেশি কিছুর দরকার হয়না যেখানে রাস্তার পাশে এমন নাগকেশরের বাগান থাকে, একরকম ভয় পেয়ে বসে। পাহাড়ীদের কাছে এই গাছ অশুভ। সীয়ান খুব ভাল করেই জানে এই বাগানটি মোটেই সুবিধার না, তাছাড়া বাগানে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা সীয়ানের মাথায় ভালভাবেই গাঁথা আছে।

কিন্তু এই মূহুর্তে ও বিভৎস সে ঘটনা স্মৃতি থেকে তাড়াতে পারছেনা। ঘটনাটা মনে আসলো তাও একদম বাগানের সামনে এসেই, প্রতিবার অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হচ্ছে সে। তিনদিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা সিয়ানের বিস্ময়ের দরজাকে আরও প্রসারিত করছে। ব্যাপারটা নিয়ে ও অনেক ভেবেছে, কিন্তু কোন হিসেবই মেলাতে পারেনি। বাগানটা বেশ বড়, ভেতরের দিকে প্রায় আধ-কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ব্যাপ্তি রয়েছে এর। তবে মূল রাস্তা থেকে এটি প্রায় গজ পঞ্চাশেক দুরে অবস্থিত, যে কারনে তারার ক্ষীন আলোতেও বাগান বরাবর উপরের দিকে তাকানোয় গাছগুলো বেশ বোঝা যাচ্ছে। কোথাও একটি শেয়াল ডেকে উঠল। খুবই সতর্কতার সাথে সীয়ান পথ চলছে। দলবেধে শেয়ালের আক্রমন মোটেই অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয় এ জায়গায়। থেজাওয়ালের এই রাস্তাটি সন্ধে নাগাদই অন্ধকার আর নির্জন হয়ে যায়, একরকম যেন ভয়ঙ্কর নির্জনতা ধারন করে। এলাকাবাসী ৭-৮ টার মাঝেই ঘরে ফিরে যায়। এখানে রাতের পর একা একা সচরাচর কেউ চলাফেরা করেনা।

এই নাগেশ্বরের বাগানটিতেই গত পরশু একটি মেয়ের লাশ পাওয়া যায়। শুধুমাত্র গলার ডানদিকটা বাদে আর কোন উল্লেখযোগ্য চিহ্ন পাওয়া যায়নি লাশের দেহে। কিছু একটা যেন গলার ডানপাশের মাংসটি কামড়ে তুলে নিয়েছে। ক্ষতে কামরের চিহ্ন পাওয়া গেছে। লাশটিকে পরে মিজোরামের আইজলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এখন আবার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে ভানটাওয়াঙের জলপ্রপাতের কাছেও নাকি আরেকটি লাশ পাওয়া গেছে, যার অবস্থা হুবুহু এই মেয়েটির লাশের মতই। অর্থাৎ গলার ডানদিকে মাংসহীন। আর জলপ্রপাতটিও খুবই নির্জন এলাকায়। কি এক অশুভ আতঙ্কে নাকি লোকজন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পাইন গাছগুলো পার হয়ে যাচ্ছে সীয়ান। থেজাওয়ালের দোকানঘরগুলোর প্রদীপের আলো দেখা যাচ্ছে। একটু থেমে ঘড়ি দেখে নিলো সে। সাড়ে সাতটা সবে। সাইকেলটাকে আপাতত রাইসিমার দোকানেই রাখল।

সীয়ানের বাল্যবন্ধু প্রদীপের দিদিমা রাইসিমা। ছোটবেলা থেকেই সীয়ানকে বেশ মায়া করেন বৃদ্ধা। প্রায়শই এইসময় সীয়ানকে তিনি চম্ফাই যেতে দেখেন। কি ব্যাপার সীয়ান চম্ফাই যাচ্ছ নাকি? জি হ্যা, লুংলেই থেকে পিসি এসে বসে আছেন বাবার দোকানে। বাবা ফোন দিয়ে আসতে বললেন। ওহ আচ্ছা আচ্ছা! তা দাদু শুনলাম তুমিও নাকি কাল চৈরো করবে? কে বলল তোমায়? শুনেছি আমি। ওহ! একটু সখ হল তাই নাম লেখালাম আরকি, আর আছিইবা কয়দিন। আচ্ছা দাদু আমি তাহলে আসি এখন। ঠিক আছে! ঠিক আছে! তুমি আসো একসাথেই তবে ফিরবো। যেতে যেতে সীয়ানের আওয়াজ ভেসে এলো, আচ্ছা আচ্ছা! চৈরো হচ্ছে পাহাড়ীদের একটি ঐতিহ্যবাহী নৃত্যবিশেষ, এটা বির্ভিন্ন মৌসুমি উৎসবে পাহাড়ীরা পরিবেশন করে থাকে। কাল লুসাই উপজাতির পোয়াল কুট বা ফসল কাটার উৎসব, আমরা বাঙালীরা যাকে নবান্ন উৎসব হিসেবে জানি।

থেজওয়ালের একটি দোকানও খোলা নেই। নিস্তব্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই বোঝা যাচ্ছে। রাইসিমার দোকানটিও খোলা থাকার কথা নয়। ভালোই হয়েছে এই জল কাদায় আর সাইকেলটি বয়ে বেড়াতে হবেনা। নিশ্চয়ই সেটা ভেতরেই তালা বদ্ধ আছে। সাথে আছে পিসি, পিসতুত বোন সুকি। আলো বিহীন উঁচু নিচু আর কাদায় ভরা পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়াটা মুশকিল হয়ে পড়বে। বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে সীয়ান। আলোর যোগাড় হলেও এদের নিয়ে ভালোই বেগ পোহাতে হবে। রাস্তায়তো অনেক কাঁদা হবে সীয়ান! তুমি কি আলো এনছো? হ্যা পিসি এনেছি, কিন্তু রাইসিমা দোকান বন্ধ করে চলে গেছে।

আমি ভেবেছি তাড়াতাড়িই ফিরতে পারবো, কিন্তু আমাদের এতো দেরি হয়ে যাবে এটা ভাবিনি। তো এখন? অন্ধকারে এই আলোবিহীন কিভাবে পথ চলব? চিন্তা করোনা পিসি, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তোমরা এখানটায় একটু বসো, আমি আলোর ব্যবস্থা করছি। রাত ৯টা সাড়ে ৯টা অব্দি বাজার ঘুমিয়ে গেলেও মানুষ ঘুমায় ঢের দেরি করে। একটা দোকানিকে ডেকে সিয়ান আলো নিয়ে ফিরে এলো। বাঁধ সাধলো কাদা, কিন্তু উপায়হীন। এই কাদা পেরিয়েই যেতে হবে সবাইকে। চলো পিসি এবার রওনা দেয়া যাক, হ্যা চলো। খুবই সতর্কতার সাথে সবাই হেটে চলেছে, মাঝে সাঝে এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়েও দেখে নিচ্ছে প্রত্যেকে। ইদানিংকালে এই পথ যে কতটা ভয়ঙ্কর আর বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে সেটা তিনজন মানুষের মাথায় ভালভাবেই গাঁথা আছে। সীয়ানের পিসিও শুনেছে এখানে নাগেশ্বরের বাগানে এক মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে।

আর তাও ভয়ংকর কিছুর আক্রমনে। কয়েকটি শেয়াল ডেকে উঠল, আশেপাশেই হবে হয়ত কোথাও। কিন্তু ভয়ের ব্যাপার সেটা না, শেয়াল আক্রমন করে দলবেঁধে তবে একের অধিক মানুষ একসাথে থাকলে ওরা তা করেনা। ভয়টা অন্যকিছুতে, তিনজনের কেউ জানেনা কে কতটা ভাবছে অথবা ভাবছেনা সে অজানা ভয় নিয়ে। পাইনের গাছগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে সবাই, আকাশে চাঁদের আলো খুব ক্ষীন, তারাগুলো জ্বল জ্বল করছে তবু ভিষন অন্ধকার, একরকম কিছুই বোঝার যো নেই। সিয়ানের পিসি এ গাঁয়েরই মেয়ে, ছোট থেকে বড় হয়েছে এখানটিতেই। এই বড় হয়ে ওঠা অব্দি এমন কোন ঘটনা নেই যা সে জানেনা, আদপে এমন উল্লেখযোগ্য ঘটনা অথবা কোন ভীতিকর ঘটনাও এ গাঁয়ে ঘটেনি। কিন্তু ইদানিংকালের ঘটনাগুলো তাকে ভিষন ভীত করে তুলেছে। তাই নিজ গাঁয়ে এসেও সে খুব ভয়ে ভয়ে পথ চলছে যেটা সে কখনোই করেনা, সে পার্থক্য সিয়ান আর সুকি ভালভাবেই বুঝতে পারছে। তোমার বাবা এখন কটায় ফেরেন? হঠাৎ পিসির প্রশ্নে একটু পিছন ফিরে ঘুরলো সিয়ান।

এইতো পিসি ১০টা নাগাদ বাবা চলে আসেন, বলতে বলতে আবার পথ চলতে শুরু করল। মায়ের শরিরটা এখন কেমন? এখনকি হাটতে পারেন? হ্যা দাদু এখন বেশ সুস্থ আছেন। কালকেও দেখলাম হাটতে হাটতে দিব্যি চলে গেছেন পরিমলদের বাসায়। একসাথে হাটার জন্য একটু থেমে নিল সিয়ান। নাগকেশরের বাগানের কাছে এসে গেছে ওরা। চারিদিকে একটা ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ বিরাজ করছে, তবে আকাশ আর মাটির যে একটা প্রকৃতিগত সামঞ্জস্য থাকে, আকাশ ভরা তারা, চাঁদের আলো, ধুলোর পথ সব মিলিয়ে পরিবেশ যে এক নৈসর্গীক গ্রাম্য রুপ নেয় সেটা এখন নেই। জল কাদার জন্য যা পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। হঠাৎ সুকি অনুভব করল ওর হাতে কারো হাতের স্পর্শ, কিন্তু মা’তো বামপাশে ওর থেকেও খানিক দুরে রয়েছে, আর সিয়ানকেও দেখা যাচ্ছে সামনে হারিকেন হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এটা কার হাত ধরে আছে সুকি? আরেকটু ভালভাবে অনুভব করার চেষ্টা করল সে, ব্যাপারটা ভ্রম না অন্যকিছু।

কিন্তু স্পষ্ট যেন উপলব্ধি করতে পারল তার হাত ধরে আছে অন্য একটি অদৃশ্য হাত। তবু বেখেয়ালী ভাবেই সে ব্যাপারটি ভাবছে, যে কারনে এখনও সে সজ্ঞান আছে, তার মনে হচ্ছে সে হয়ত ঘোরের মাঝে আছে, অথবা হাত জমে যাওয়ায় এমনটি লাগছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই হাতটি জোরে ঝাড়া দিল, নাহ হাত ছাড়া যাচ্ছেনা। বরং আরো শক্ত করে তার হাতটি চেপে ধরছে ঐ অদৃশ্য হাত। এবার সজোরে চিৎকার দিয়ে উঠল সুকি। ওর চিৎকার শুনে সাথে সাথে হ্যারিকেনটি ওর দিকে ঘুরালো সিয়ান। হাত দুটো জড়ো করে ভিষন কাপা কাপছে মেয়েটি, ভয়ে দুচোখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কি হয়েছে সুকি? মেয়ের দু-কাঁধে ঝাড়া দিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল মাংথিলি। অমনভাবে চিৎকার দিয়ে উঠলি কেন? মা মা এখানে এখানে। আঙুল দিয়ে নিজের ডানপাশ ইশারা করছে সুকি। কি এখানে? আমার হাত ধরে আছে। হাত? কিসের হাত? আমার সাথে সাথে কিছু একটা হেটে চলছিল আমার হাত ধরে, হা হয়ে আছে সুকির হাতের কাছে আলো ধরে সিয়ান, সাদা চামড়ায় একদম স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আঙ্গুলের ছাপগুলো।

যেহেতু রাস্তার চারপাশটা একদম ফাঁকা, সে হিসেবে কোন মানুষও যদি এটা করে থাকত তবে তার এত দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা না। সুতরাং কারোরই বুঝতে বাকি রইলনা কিসের পাল্লায় পড়েছে তারা। সিয়ান আলোটিকে একবার চারদিক ভালোভাবে ঘুরিয়ে দেখে নিল। কোন কিছুই নজরে এলোনা। সুকিকে সাহস দেয়ার যেমন কোন উপায় নেই ওদের তেমনি নিজেরাও নিজেদের বুঝ দেয়ার ভাষা নেই, কি করেইবা থাকবে? স্পষ্ট আঙুলের ছাপ দেখা যাচ্ছে সুকির হাতে। তার উপর কে ধরল, মানুষ না অন্যকিছু, আবার সাথে সাথে উধাউ। সবকিছুই ভয়কে দানা বাঁধিয়ে দিয়েছে বেশ। মা মেয়ে দুজনই খুব কাঁপছে, সিয়ান বুঝতে পারছে ব্যাপারটি। বুদ্ধের নাম জপতে জপতে পা বাড়িয়ে চলল সবাই। সিয়ান বেশ সাহসি ছেলে, ও যখন কোন ভয়ের মুখোমুখি হয় ও বুঝতে পারেনা আসলে ও ভয় পাচ্ছে কিনা। ভয়টা আসলে অন্যকিছু যেখানে নিজেকে সামাল দেয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য, সীয়ান এক্ষেত্রে তাঁর বিপরীত।

এর স্পষ্টতা ও নিজেকে স্থির রাখার মাঝে পেয়েছে। পাশাপাশি ঘেঁসে হেটে চলছে তিনজন, নাগেশ্বরের বাগান পার হয়ে গেছে সবাই। সিয়ান ভাবতে পারেনা ওর বাবা এত রাতে কি করে চম্ফাই থেকে থেজওয়াল আসেন, যদিও ৪/৫ জন একসাথে থাকে, তবুও এই সময়টা খুব খারাপ এটা সবাই জানা সত্বেও। হঠাৎ চোখের সামনে দিয়ে কিছু একটা দৌড়ে চলে গেল। শেয়াল না বেড়াল বোঝা গেলনা। সুকি আরো শক্ত করে সিয়ানের হাত চেপে ধরল। বড় কৃষ্ণচুড়ার গাছটি পার হয়ে যাচ্ছে ওরা। ছিমছিমে অন্ধকার আর নিরব নিস্তব্ধ রাতে পাহাড়িরা চলতে অভ্যস্ত। অন্ধকারে ক্ষীনতম আলোও তাদের কন্টকাকীর্ণ, ঝোপ-জঙ্গল আর পাহাড়ের পর পাহাড় পথ চলতে বিন্দু পরিমানও বেগ এর কারন হয়না। তারা যেমন পরিশ্রমি তদ্রুপ কঠোরও, তাই বলে ভয়হীন নয়। লোকমুখে শোনা যায়, মিজোরামে একসময় হিন্দু রাজা রাজেন্দ্র বর্মন খুবই প্রতাপের সঙ্গে রাজত্ব করতেন। পাহাড়ীদের উপর তার অত্যাচারের কোন সীমা ছিলনা।

তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বেশিরভাগ পাহাড়ীই মিজোরাম ছেড়ে পার্শবর্তী জনপদগুলোতে চলে যায়। আজও পাহাড়ীরা কারও দ্বারা অত্যাচারীত হলে ওই রাজার নাম নিয়ে তাকে শাপ দিয়ে থাকে। জনশ্রুতি আছে, কামাখ্যা দেবী নাকি এই স্থানকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। বড় কোন দূর্ঘটনা এখানে কামাখ্যা দেবীর অভিশাপেরই ফল, এটাই পাহাড়ীদের বিশ্বাস। বেশ ঢালাও করে কামাখ্যা দেবীর পূজাও হয় এখানে প্রতি বৎসর। পাহাড়ীরা কুসংস্কারে অন্ধবিশ্বাসী। তাই বলে সবকিছুই যে ধারনার ভুল সেটা বলললে উচিৎ বিচার করা হবেনা তাদের প্রতি। পরিমলদের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসছে সবাই। একহাতে কাপড়কে মাটি থেকে উঁচিয়ে ধরে আরেক হাতে সীয়ানের হাত শক্ত করে ধরে বেশ তোড়জোড় করে হাটছে মাংথিলি। যেন তাকে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সীয়ান, কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়। মাংথিলি সীয়ানের সাথে সমানভাবে চলতে চাইছেন কিন্তু বেচারি পেরে উঠছেননা। সুকির হাতে হারিকেন দিয়ে তার পিছু পিছু চলছে দুজন।

এক হাতে ব্যাগ আরেক হাতে পিসিকে ধরে পথ চলতে সীয়ানকেও বেশ দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কুকুরগুলো একসাথে হয়ে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠছে, যেন কিছু দেখতে পেয়েছে। সুকি আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আরেকটু হলেই সীয়ানের হাতে দুলতে থাকা ব্যাগের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যেত। কি হল সুকি দাঁড়িয়ে গেলে কেন? যাও এগিয়ে যাও, এইতো এসে গেছি। আমার ভয় করছে, আলোটা তুমি ধর সীয়ান। আরে ঐতো বাড়ি দেখা যাচ্ছে, কুকুরগুলো আমাদের দেখেছে তাই ওভাবে ডেকে উঠছে। এগুলো আমাদের পাড়ার কুকুর, ভয় পাওয়ার কিছু নেই ওগুলো কামড়াবেনা, যাও যাও। সন্দেহকে গোপন করে সুকিকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করল সীয়ান। কুকুরগুলো আরো জোরে জোরে ডেকে উঠছে। সীয়ান বুঝতে পারছে ওগুলো কিছু একটা দেখেছে, নয়ত সবগুলো কুকুর এভাবে একজায়গায় এক হয়ে ডেকে ওঠার কথা না। ব্যাপারটা ওর কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছেনা।

বাড়ির টিলা বেয়ে সবাই উপরে উঠছে। খুবই পিচ্ছিল হয়ে আছে বাড়ির রাস্তা, বেশ কষ্ট করে উঠোন পর্যন্ত আসলো সীয়ান, এক হাতে ব্যাগ আর এক হাতে পিসিকে ধরে। ঠিক উঠোনের মাঝখানে এসে একটু হাফ ছেড়ে নিল সে। উবু হয়ে দুই হাটু ধরে দরজা খোলার জন্য মাকে ডাক দিল। বেশ পরিশ্রম হয়ে গেছে। পিছন ফিরে ঘুরতেই পরক্ষনেই আস্তে করে যেন মাংথিলি কাদার মাঝে ঢলে পড়ল। মাকে নিথর হয়ে পড়ে যেতে দেখে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো সুকি। সীয়ানও বেশ অবাক হয়েছে পিসিকে এভাবে বেহুশ হয়ে পড়ে যেতে দেখে। পিসির ঘাড়টা কোনমত নিজের ডানহাতে তুলে নিয়ে চেঁচিয়ে মাকে ডাকছে দরজা খোলার জন্য সীয়ান। ভাঙা দরজার ফাক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে, বাইরে এসে সবাই ধরাধরি করে থানসীমাকে ঘরে নিয়ে গেল।

কিরে নিতেন, এবার দোকানটা বন্ধ করে আয় ? এগারোটা বাজতে চলল। অধুল খুবই অবাক হয়েছে আজ নিতেনকে এতটা সময় দোকান খোলা রাখতে দেখে। সবসময় নিতেনই ওদের সবাইকে ডাকাডাকি করে বাড়ির পথ ধরে। আজ অধুলই সবাইকে এক করেছে। একটু বস তোরা, আমি ময়ঙের মালগুলো রেডি করে বন্ধ করছি। তোর ছোকড়াটা কোথায় ? ওকেতো অনেক আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিরে, সুখন, পিজুস, মৈত্রাং ওরা কোথায় ? নেপাল এর দোকানে চা খাচ্ছে। পড়শু ময়ঙ পালইর মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান, নিতেন এর দোকান থেকে যাবতীয় খরচা-পাতি নিচ্ছে। চম্ফাইয়ে নিতেন এর এই দোকানটিই সবথেকে বড়।

শুধু বড় বলে নয়, দোকানের মালামালের গুনাগুনে সারাদিনই তার দোকান সমাগম থাকে কাস্টমারের ভীড়ে। বাইশটি বছর ধরে চম্ফাইয়ে ব্যবসা করছে নিতেন, কোনদিন গায়ে পড়ে কারো সাথে রেশারেশির কোন ঘটনা নেই তার। বেশ নামডাক হয়েছে এই চম্ফাইয়ে লোকটির। চম্ফাইয়ের দক্ষিনে আদুর পালই পশ্চিম বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতিও সে। থেজাওয়াল থেকে তারা মোট পাচজন এসে চম্ফাইয়ে ব্যবসা করে। প্রত্যেকের বাড়িই এঘর আর ওঘর। সুখন আর মৈত্রাং নিতেন এর চাচাত ভাই। পিজুস দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। আর অধুল তার ভাইপো কিন্তু রক্তের নয়, তবে বয়সে সমবয়সী। কিরে হল তোর ? হ্যা চল। দোকান বন্ধ করে এবার বাড়ির পথ ধরল সবাই। এত রাতে কেউ হেটে হেটে থেজাওয়াল যাবেনা এটা সবারই জানা আছে। তবু একটি গাড়ি আছে যেটা ওরা নিজেরাই চালিয়ে নিয়ে যাবে।

এটা নিজেরাই ম্যানেজ করে নিয়েছে। এতে ঝামেলাও আছে বেশ, এই পাঁচজনের মাঝে সকালে যে আগে চম্ফাই আসবে সে গাড়িও সাথে নিয়ে আসবে। আর যাত্রিও নিয়ে আসতে হবে। এভাবেই ওরা প্রায়শই আসে যায়। এছাড়া কোন উপায় নেই। আর এত রাতে গাড়িবিহীন থেজাওয়াল যাওয়াও অসম্ভব প্রায়। গাড়ি চালাচ্ছে পিজুস। যেন রাতের স্বর্গ পথে নেমে যাচ্ছে সবাই নিজ নিজ ঠিকানায়। খুবই আয়েশ করে একটি সিগারেট ধরাল সুখন, এ সময় এটা যথার্থই সুখময়। সাথে সাথেই সুখনকে আরেকটি সিগারেট ধরাতে বলে ওর সিগারেটটি নিয়ে নিল নিতেন। দুই পাশে পাহাড়, খানা-খন্দকবিহীন রাস্তা, আকাশে তারার মেলা যেন অন্যরকম সুখ অনুভব করছে মৈত্রাং। কিন্তু হঠাৎই তার কিছু একটা ভেবে যেন চৈতন্যোদয় হল। বেশ ভীত লোক বেচারা। গতকালই ওর ছেলে ফিরে এসেছে ভানটাওয়াং থেকে। একটা রিসোর্টে কাজ করত পিয়ন হিসেবে। ছেলের মুখেই শুনেছে, ভানটাওয়াং আর নাহুথিয়ালের লোকজন নাকি নিজেদের ঘড়বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে।

প্রতিদিন রাতে নাকি ওরা কিসব ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনতে পায় নিজেদের ঘরের আশেপাশে। দু দুটি মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে আজ দুইদিন হল। এদিকে গতকালই আরেকটি মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে উলজঙ্ঘাতে। মেয়েটির সারা শরীর ছিল একদম রক্তশূন্য। একটি কাল্পনিক ছবি যেন ভেসে উঠল মৈত্রাং এর চোখে আর অমনিই তার পুরোটা শরীর একটা ঝাড়া দিয়ে উঠল, পাশেই বসা ছিল নিতেন। ওকে এভাবে কেঁপে উঠতে দেখে আশ্চর্য হল। কিরে কি হয়েছে ? কিছু দেখেছিস টেখেছিস নাকি ? নাহ! কিন্তু কেমন যেন বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। কিসের বিপদ ? শুনিসনি ভানটাওয়াং আর নাহুথিয়ালের অবস্থা ? তা শুনেছি বৈকি। কিন্তু তুই কি বিপদ টের পেলি? আমাদের এলাকাতেও একই ঘটনা ঘটল। এগুলো আসলে কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছিনা। খুব ভয়ে আছিরে। আমার ছেলেটাও ফিরে এসেছে। ওদের রিসোর্টটাও নাকি বন্ধ করে দিয়েছে। তাই নাকি? আরে হ্যা। তবেতো ঘটনা খুবই গুরুতর। আমার ভয়টা ওখানে না। আমাদের ঘরেওতো মেয়ে আছে।

বুঝতে পারছিস তুই কিছু ? শুধু মাত্র মেয়েগুলাই কেন এভাবে মারা পড়ছে ? আচ্ছা এটাতো কোন জন্তুর কাজ হবেনা, নয়ত অমন করে একপাশে মাংস তুলে রেখে যেতনা। পুরোটাই সাবাড় করে যেত। সুখনের অমন কথায় ফের শরীরটা ঝাড়া দিয়ে উঠে মৈত্রাং এর। অমন করে বলিশনা ভাই। সেটা যাকিছুই হোকনা কেন ওটা যে শুধু মেয়ে মানুষ ধরে নিয়ে যায় এটা স্পষ্ট। কোন এলাকার কাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কোথায় মেরে ফেলে রাখে কোন খবর আছে? আমার কিন্তু এসব সুবিধের ঠেকছেনারে। কিছু একটা করা উচিৎ আমাদের। আমার মেয়েটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। যুবতি মেয়েগুলোই বাসা বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। তোর কি মাথা খারাপ নাকি? আর মেয়ে কি তোর একাই, আর কারো নেই? আমার ঘরেও দু দুটো মেয়ে আছে। সুখনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো মৈত্রাং। একটা পরাজিত চাহনি নিয়ে মুখটি ঘুরিয়ে বলতে শুরু করল, তোরা যে যাই বলিস সাবধান থাকা ভাল।

দরজায় টোকা পড়তেই ভিতর থেকে জবাব এল, খুলছি। সাথে সাথে জবাব শুনেই বুঝতে পারল নিতেন, জেগে আছে মানতি। কিন্তু এত রাত অব্দি জেগে থাকার কথা নয়। ভেতরে ঢুকে কিছুটা আশ্চর্য হল, সবাই জেগে আছে। সুকি বিছানায় শোয়া, ওর মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কি হয়েছে ওর? হঠাৎ করে জ্বর উঠেছে, জবাব দিল সীয়ানের মা। ওষুধ টষুধ কিছু খাইয়েছ? হ্যা খেয়েছে। আমাদের গ্রামের বাতাস ভালো ঠেকছেনা ভাইজান। মাংথিলির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করল নিতেন, কেনো কি হয়েছে? পথে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা খুলে বলল মাংথিলি।

তারপর আমি জ্ঞান হারাই, সুকির শরীর কাপিয়ে জ্বর আসে। নিতেনের মনে এবার মৈত্রাং এর কথাগুলো ভালভাবে দাগ কাটল। মৈত্রাং এর ধারনা তবে সত্যিই। কিন্তু কোথাও যেন চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ হচ্ছে। সবাই শুনতে পেল অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আওয়াজ দিচ্ছে, সবাই এক হও সবাই এক হও। দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নিতেন। সীয়ানও বাবার পিছু নিল। অনেক কান্নাকাটি আর চিৎকার চেচামেচির আওয়াজে বোঝাই যাচ্ছেনা কি ঘটেছে আসলে। সুখনের বাড়ি থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ আসছে। দ্রত এগিয়ে গেল সুখনের ঘরের দিকে। পিজুষকে দেখেই নিতেন জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে এখানে? মৈত্রাং ঠিকই বলেছিলরে, সুখনের ছোট মেয়েটাকে পাওয়া যাচ্ছেনা। বলিস কি? আরে হ্যা, সুখন খেতে বসলে পালির মা পালিকে পানি আনতে পাঠায়। অনেকক্ষন দেরি হওয়ায় জোরে জোরে হাকডাক করেও ওর খবর পাওয়া যায়না।

তারপর সুখন বের হয়ে তন্ন তন্ন করে খোঁজ করে। কিন্তু পালিকে কোথাও পায়না। এর পরই আমরা ছুটে আসি সুখনের চিৎকার চেচামেচি শুনে। সুখন কোথায়? পাড়ার লোকদের নিয়ে মেয়েকে খুজতে গেছে। এইদিকে আয়। কোথায়? আরে আয়না আমার সাথে, একটা জিনিস দেখাই তোকে। পাকের ঘরের কাছে বড় বড় পায়ের ছাপগুলো স্পষ্ট দেখতে পেল সীয়ানও। বুঝলি এবার? অবাক দৃষ্টিতে নিতেন বলে চলল, এতো খুব ভয়ংকর জানোয়ার হবে। তার মানে সত্যিই আমাদের গায়ে অশুভ কিছুর ছায়া পড়েছে। সেতো অনেক আগেই। পিযুষের চোখের দিকে চাইল নিতেন। যেনো পৃথিবীর সব আতংক ওর চোখে বিরাজ করছে। কিন্তু এই আপদ আসলো কোত্থেকে? কোত্থেকে আবার, বন্ধ কর কামাক্ষা দেবীর পূজো? তোমরাইতো সায় দিয়েছিলে কামাক্ষা দেবী সন্তুষ্ট হয়েছেন।

তিনি প্রসাদ গ্রহন করেছেন আরও কত কি। আলোটিকে পায়ের ছাপের কাছে নিয়ে গেল নিতেন, পায়ের ছাপটি বেশ বড় আর একদম মানুষের পায়ের মতন কিন্তু তিনটি আঙুলের ছাপ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ সেটা যে প্রানীই হোক না কেন তার পায়ে আঙুল রয়েছে মাত্র তিনটি। কি ভেবে সীয়ানকে বাড়ি ফিরে যেতে বলল নিতেন। এদিকে গায়ের লোক সব জড়ো হয়ে গেছে। কেউ কেউ নাকি হঠাৎ হঠাৎ দৌড়ে ছুটে যেতে দেখছে কিছু একটা ঝোপে ঝাড়ে। এই মূহুর্তে একটি শিয়ালও খুব বড় ধরনের আতংক ছড়াতে যথেষ্ট। সীয়ান ভেবে পায়না মেয়েদেরকেই কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পুরুষ মানুষদের কেন কিছু করেনা এই জানোয়ার। কি এর রহস্য? ভাবতে ভাবতেই মাথা তুলে দেখল বাড়ির সামনের বাঁশঝাড় দেখা যাচ্ছে। ওদিকে টর্চের আলো মারতেই একদম জমে গেল। যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক অপ্সরা দাড়িয়ে আছে বাঁশঝাড়ের ধারে। মুখ বেয়ে ঠোট বেয়ে নেমে পড়ছে রক্তের ধারা। যেন সীয়ানকে ডাকছে এক অদৃশ্য প্রেমের মোহে, আমার ঠোট থেকে এ সুধা তুমিও পান কর।

চল আমরা অমর হই। প্রায় এক মিনিটের মত সীয়ান শরীর নাড়াতেই পারেনি। হারিয়েছিল কোন এক অদৃশ্য মোহে। মেয়েটি এগিয়ে আসতেই সীয়ান চেতনা ফিরে পেল। ভয় কাকে বলে এখন হয়ত ও উপলব্ধি করতে পারছে কিন্তু নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে ও। মেয়েটি সীয়ানের মুখোমুখি এসে দাড়াল। ওর চারপাশ একবার চক্কর দিয়ে ফের মুখের সামনে এসে দাড়াল। খুবই সতর্কভাবে একটা একটা করে বোতাম খুলে ফেলল সীয়ানের শার্টের। বিন্দু পরিমানও যেন নড়তে পারছেনা সীয়ান। তারপর শার্ট দিয়ে নিজের মুখে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করে নিল মেয়েটি। ফের রক্তমাখা শার্টটি সীয়ানের দিকে দিল। অবাক হয়ে সীয়ান সবকিছু দেখছে। দুটো চোখা দাত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেয়েটির। সীয়ান মুখ খুলতে চাইছে কিন্তু পারছেনা। গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছেনা।

আ….উ…করে চেষ্টা করছে কিন্তু তার স্বর যেন আটকে রেখেছে কেউ। কি? কথা বলতে চাইছ আমার সাথে? মেয়েটির মুখে শব্দ শুনে চোখদুটো বড় হয়ে যায় সীয়ানের। আমি তোমাকে চিনি, তুমি সীয়ান। ক্ষতি করবনা তোমার, ভয় পেওনা। তোমার সাথে অনেক কথা আছে। নাগেশ্বরের বাগানে এসে অর্ষনি বলে মৃদু আওয়াজে আমাকে ডেকো, আমি এসে যাবো।

কেউ তোমার কিছু করবেনা। আর চাইলেও আমাদের কেউ কোন পুরুষ মানুষের ক্ষতি করতে পারবেনা। কারন আমাদের যে কেউ কোন পুরুষকে স্পর্শ করবে সাথে সাথেই তার বিষযন্ত্রনা শুরু হয়ে যাবে। আর এতেই তার মৃত্যু ঘটবে। আমরা শুধু মোহন্ধ করে রাখতে পারি তোমাদের। যে কারনে তুমি চাইলেও আমার সাথে কথা বলতে পারছনা। আমার দৃষ্টি দিয়ে তোমায় আমি বন্দি করেছি। তোমার সাহস আছে। অপেক্ষায় থাকব তোমার। বলেই মেয়েটি জঙ্গলে হারিয়ে যায়।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত