জীবনে সেদিন যে অদ্ভুত রোমাঞ্চকর ঘটনাটা ঘটে গেল সেটা কিছুতেই আর ভুলতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে – এ কি কখনো সম্ভব? ডোডো কি এখনও আমায় মনে রেখেছে?
আর তখনই মনে হয়েছে – মনে না রাখবেই বা কেন? আমিই কি ওকে ভুলতে পেরেছি?
তখন আমি ইস্কুলে পড়ি। মফস্বল শহর। আমাদের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে মিশনারি সাহেবদের বেশ বড়ো একটা হাসপাতাল ছিল। খাস ইউরোপিয়ান সাহেব ডাক্তাররা সপরিবারে সেখানে থাকত। ওই সাহেবপল্লীটাকে এখানকার লোকে বলত মিশন। কারো বড় রকম অসুখ করলে লোকে বলত – মিশন হাসপাতালে নিয়ে যাও। সেরে উঠবেই।
আমার বাবা ছিলেন নামকরা ডাক্তার। সেই সূত্রে হাসপাতালের সাহেব ডাক্তারদের সঙ্গে আমার বেশ খাতির ছিল। তাঁরা প্রায়ই বড়দিনে, ইংরেজি নববর্ষে, ছেলেমেয়েদের জন্মদিনে আমাদের নেমন্তন্ন করতেন। বাবা-মা’র সঙ্গে আমিও ঘোড়ার গাড়ি চেপে সাহেবদের বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে যেতাম। ওঁদের মধ্যে বাবার বেশী বন্ধুত্ব ছিল ম্যাকলার্ন সাহেবের সঙ্গে। মেমসাহেবও ছিলেন খুব মিশুকে। তিনি চাইতেন আমরা যেন প্রায়ই ওঁদের বাড়ি বেড়াতে যাই। সেইজন্য বিশেষ বিশেষ দিন ছাড়াও আমরা ম্যাকলার্ন সাহেবের বাড়ি যেতাম।
এই বাড়িতেই ডোডোর সঙ্গে আমার ভাব হয়। আমারই সমবয়সী ডোডো। সাহেব-বাচ্চা। সাদা ধবধবে রঙ, কোঁকড়ানো কটা চুল, চোখের মণি নীলচে। ভারি সুন্দর দেখতে। কিন্তু তাকে সবসময়েই কেমন যেন বিষন্ন মনে হতো। পরে জেনেছিলাম – ডোডো ম্যাকলার্নদের নিজের কেউ নয়। ওঁদের কোনো আত্মীয়ের ছেলে। মা-বাপ মরে গিয়েছিল বলে এঁরাই ওকে লালনপালন করছেন। ডোডোর সঙ্গে আমার এমন ভাব হয়ে গিয়েছিল যে প্রায়ই ওর কাছে যেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু তখন আমি ছেলেমানুষ। একা যেতে পারতাম না। মা-বাবা যখন যেত শুধু তখনই ওর সঙ্গে দেখা হতো। একদিন ওঁদের বাড়ি গিয়েছি। তখন সন্ধে হয় হয়।
“গুড ইভনিং ডক্টর ম্যাকলার্ন!” বলে বাবা হাসতে হাসতে আমাদের নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। ম্যাকলার্ন সাহেবও তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে “গুড ইভনিং” বলে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। কিন্তু সেদিন ম্যাকলার্ন সাহেব কি একটা ব্যাপার নিয়ে হাসপাতালের হেড কম্পাউন্ডার চৌধুরী সাহেব আর অন্য এক কম্পাউন্ডারের সাথে খুব বিরক্ত হয়ে কথা বলছিলেন। আমরা গিয়ে পড়াতে ম্যাকলার্ন সাহেব ওদের সরিয়ে দিয়ে বাবার সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। ওঁরা বহুদিন বাংলাদেশে থাকতে থাকতে বাংলা কথা খুব ভালো বুঝতে পারতেন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথাও বলতে পারতেন।
যাই হোক আমি ডোডোকে খুঁজছিলাম। বিরাট কম্পাউন্ডওলা বাড়ি। অনেক ঘর। তার সঙ্গে টানা হাসপাতাল। ও যে কোথায় আছে! খুঁজতে খুঁজতে বাগানের ধারে ছোট ঘরটায় ওকে পেলাম। দেখি এই গরমেও ডোডো গলায় মাফলার জড়িয়ে চুপচাপ বসে আছে। আমাকে দেখে ও তো খুব খুশি। কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কি অসুখ করেছে?” ও বলল, “হ্যাঁ। টনসিল সেপটিক হয়ে গেছে। অপারেশন হবে”। যদিও তখন শুনতাম টনসিল অপারেশন খুব বিপজ্জনক ব্যাপার, তবু বন্ধুকে সাহস দিয়ে বললাম, “ভয় কি? বাড়িতে বড় বড় ডাক্তার” ডোডো ম্লান হেসে বলল, “না, অপারেশনের জন্য চিন্তা করছি না”। “তবে? এমন চুপচাপ বসে কেন তাহলে?” ও হঠাৎ আমায় থামিয়ে দিয়ে কিছু একটা শোনার জন্য কান পাতল।
ড্রয়িংরুমে তখন বাবার সঙ্গে ম্যাকলার্ন সাহেবের কথা হচ্ছিল। সাহেব বেশ উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন, “হাসপাতাল থেকে প্রায়ই যদি এত দামি দামি ওষুধ চুরি হয়ে যায় তাহলে আমার অবশ্যই স্টেপ নেওয়া উচিত, বলুন”। বাবা বললেন, “আপনি কাউকে সন্দেহ করেন?” “সন্দেহ! না, এরা সবাই পুরনো লোক। শুধু শুধু কি করে সন্দেহ করি বলুন!” ডোডো আমার দিকে ফিরে এবার আমার হাতটা ধরে বলল, “অপারেশনের জন্য নয়, মনটা আমার খুব খারাপ হয়ে আছে বন্ধু”।
“কেন?” ডোডো তখনই কিছু বলল না। কি যেন ভাবতে লাগল। একটু পরে বলল, “কারো নামে লাগাতে নেই। ক্রাইস্ট তাতে দুঃখ পান। তবু আমার মনে হয় – যে দুষ্টু লোক, যে পরের ক্ষতি করে, যে চোর – তাকে ধরিয়ে দিলে অন্যায় হবে না। ক্রাইস্ট নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করবেন। তুমি কি বলো?”
বললাম, “নিশ্চয়ই। কিন্তু… তুমি কার কথা বলছ?” ও তখন খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে আমার হাতটা ধরে বলল, “ওই যে শুনলে আঙ্কল ওষুধ চুরির কথা বলছিলেন। রোজ রোজ হাসপাতাল থেকে ওষুধ চুরি হয়। সেই ওষুধ বাজারে বিক্রি করে দেয় চড়া দামে”। “কে?” বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম আমি, “কে এ কাজ করে?”
ডোডো বলল, “চোর যে কে আঙ্কল তা ধরতে পারছেন না। তবে ওঁর সন্দেহ কম্পাউন্ডারকেই। কিন্তু কম্পাউন্ডার তো অনেক জনই – মিঃ চৌধুরী, মিঃ মন্ডল, মিঃ বিশ্বাস, মিঃ গুঁই” ডোডো একটু থামল। তারপর বলল, “তাছাড়া এখানকার যে হেড ক্লার্ক তাকেও আঙ্কলের সন্দেহ। কিন্তু বন্ধু, প্রকৃত চোর যে কে, আমি তা জানি”, বলতে বলতে উত্তেজনায় ও আমার হাতটা চেপে ধরল। “তুমি জানো!” “হ্যাঁ”। “তো আঙ্কলকে বলছ না কেন?”
“কি করে বলব তাই ভাবছি, আর মনে মনে দুঃখ পাচ্ছি। সে মানুষটা খুবই পুরনো লোক, আমাদের সকলেরই নিজের লোকের মতো। আমি তাকে খুবই শ্রদ্ধা করতাম “। “তুমি ঠিক জানো, সেই লোকটাই হাসপাতালের ওষুধ চুরি করে বাইরে পাচার করে?” “Yes!” খুব জোর দিয়ে কথাটা বলতে গিয়ে ও কেশে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে গলার ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ল।
একটু সামলে নিয়ে বলল, “আজই দুপুরবেলা একা একা হাসপাতালের দিকটায় ঘুরছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে ওষুধের ঘরের কাছে যেই এসেছি অমনি জানলার ফাঁক দিয়ে দেখি “কথা শেষ হলো না। হঠাৎ ডোডো চমকে উঠে বলে উঠল – “Who is there? কে ওখানে?”
সঙ্গে সঙ্গে ওদিকে তাকাতেই আমার নজরে পড়ল ওদিকে বাগানের দিকের জানলার পাশ থেকে কেউ যেন চট করে সরে গেল। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভয়ে ভয়ে বললাম, “চোর?”
ডোডো বলল, “বোধহয়। আমাদের কথা শোনার চেষ্টা করছিল”। তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলল, “চলো, ভেতরে গিয়েই বসি”। এর দু’দিন পর ডোডোর অপারেশন হলো। অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। আমি তো মা-বাবাকে নিয়ে সেদিনই বিকেলে ডোডোকে দেখতে গেলাম।
ডোডোর জ্ঞান ফিরেছে। ওর সর্বাঙ্গ চাদর দিয়ে ঢাকা। ডোডো শুধু একবার তাকাল। সে চাউনি দেখে বুঝলাম ও চিনতে পেরেছে। কিন্তু কষ্ট লাগল যখন দেখলাম ওর হাত-পা লোহার খাটের সাথে বাঁধা।
নার্স বলল, “ও ভালোই আছে”। পরের দিন বেলা দশটা। ইস্কুল যাবার জন্য রেডি হচ্ছি, বাবা শুকনো মুখে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে আর মা’কে একসঙ্গেই দুঃসংবাদটা দিলেন – ডোডো কাল গভীর রাতে মারা গেছে।
আজ এতকাল পরেও আমার মনে আছে, সেদিন আমি চিৎকার করে বলেছিলাম – “মারা যায়নি। ওকে মেরে ফেলা হয়েছে”। বাবা আমাকে ধমকে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, “পাগল নাকি? অত বড় হাসপাতাল। ম্যাকলার্ন সাহেবের বাড়ির লোক। মেরে ফেললেই হলো! আর কেন-ই বা মারবে?”
বাবাকে কিছু বলতে পারিনি তখন। কিন্তু মাকে সব বলেছিলাম। ডোডো স্বচক্ষে চুরি করতে দেখে ফেলেছিল কাউকে। কিন্তু তার নাম বলবার আগেই ওকে থেমে যেতে হলো চিরদিনের মতো। কিন্তু আমার মা’ও সেদিন দশ বছরের ছেলের কথা বিশ্বাস করেনি। বলল, “তাছাড়া, কেউ খুন করেছে বুঝতে পারলে সাহেব ছেড়ে দিত?”
যুক্তি অবশ্য অকাট্য। তারপর আর তাই ও নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু অনেকদিন পর কলকাতার কর্মজীবনের মাঝে মাঝে যখন ডোডোর কথা মনে হতো তখনই ভাবতাম – সত্যিই কি ওর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল? না কি ওকে খুন করা হয়েছিল?” হ্যাঁ, সাহেব বাড়ির কেস। খুন সন্দেহ হলে সহজে ছেড়ে দিত না ঠিকই। কিন্তু এ’ও মনে রাখতে হবে – ডোডো ওঁদের নিজেদের কেউ ছিল না। সেজন্য হয়তো যতটা তলিয়ে দেখা উচিত ছিল, ততটা দেখেননি। প্রায় চল্লিশ বছর পর আবার একদিন দেশে আসার সুযোগ হলো আমার। সাহেবরা এখন আর নেই। তবে জায়গাটার নাম এখনও মিশন হয়েই রয়েছে। এখানে এখন একটা ইস্কুলও গড়ে উঠেছে। সেই ইস্কুলে রবীন্দ্র জন্মোৎসব অনুষ্ঠানে আমায় সভাপতি হতে হয়েছে।
আমি যেতেই যিনি আমায় সাদর অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এলেন তাঁর বয়স প্রায় আশি। সাদা ধবধবে চুল, চোখে পুরু লেন্সের চশমা। ইনিই সেই চৌধুরী সাহেব যিনি হাসপাতালের হেড কম্পাউন্ডার ছিলেন। বর্তমানে তিনি এই স্কুলের প্রেসিডেন্ট। পুরনো ব্যক্তিদের মধ্যে সেই ক্লার্কবাবুটিও এখনো বেঁচে আছেন। তবে দুঃখের কথা, তাঁর ছেলেটি তাকে অবশ্য চিনতাম না একটা খুনের মামলায় জেল খাটছে শুনলাম।
খুনের কথা শুনেই আমার মনটা ছ্যাঁত করে উঠল। ডোডোর কথা মনে পড়ে গেল। সে যাকে চুরি করতে দেখেছিল তার নামটা প্রকাশ করে যেতে পারেনি। তার আগেই মরতে হয়েছিল তাকে। সে কি তবে ওই ক্লার্কবাবুরই কাজ? নইলে তাঁর ছেলে খুনি হয় কি করে?
সভা শেষ হতে রাত হয়ে গেল। খাওয়াদাওয়া করে যখন শুতে গেলাম তখন দশটা বেজে গিয়েছে। আমার শোবার ব্যবস্থা হয়েছিল ম্যাকলার্ন সাহেবের বাড়িতেই। বাড়িটা যদিও পুরনো তবু এই একটা ঘরই মোটামুটি ভাল অবস্থায় ছিল। জানলা বা দরজায় কোনো খিল ছিল না, তবে দরজায় লোহার ছিটকিনি টিকে ছিল কোনওরকমে। যাক, তা-ই যথেষ্ট । বাড়িতে ইলেকট্রিকের কোনো ব্যাপার ছিল না। তবে উদ্যোক্তারা একটা লণ্ঠন দিয়ে গিয়েছিল। দরজায় ছিটকিনি টেনে লন্ঠনে তেল কতটা আছে দেখছিলাম, ঠিক এইসময় কে যেন দরজায় শব্দ করল – ঠুক-ঠুক-ঠুক।
বুকটা কেন কে জানে ধড়াস করে উঠল। “কে?” হাঁক পাড়লাম। “শুয়ে পড়লেন নাকি?” বাইরে থেকে গলা ভেসে এলো। “না, যাই”। বলে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দেখি চৌধুরী সাহেব এক হাতে টর্চ আর অন্য হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি আবার এত রাতে?” উনি হাসলেন। বাঁধানো দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল। “না, দেখতে এলাম কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা। বুঝতেই পারছেন প্রেসিডেন্টের অনেক দায়িত্ব “। “না, না কিছুমাত্র অসুবিধে নেই”। “বেশ, খুশি হলাম”, বলে বৃদ্ধ চৌধুরী সাহেব আবার একটু হাসলেন। “ভয়টয় পাবেন না তো?” হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন চৌধুরী। আমি হেসে বললাম, “কিসের ভয়?”
“এই আর কি পুরনো সাহেব বাড়ি তো!” “না চৌধুরী সাহেব, ভূতের ভয় আমি পাই না। তাছাড়া এ বাড়ি আমার চেনা। তবে যদি আমার সেই ছেলেবেলার বন্ধু ডোডোর প্রেতাত্মা দেখা দেয়”এতকাল পরেও ডোডোর কথা শুনে বৃদ্ধের মুখটা কিরকম যেন হয়ে গেল। ঢোক গিলে বললেন, “ডোডোকে মনে আছে?” “নিশ্চয়ই”, আমি বললাম, “ওকে কি আমি ভুলতে পারি? ওই তো ওই লম্বা ঘরটার একেবারে শেষ দিকের বেডে ও মারা গিয়েছিল, তাই না?”
“হ্যাঁ!, বলেই বৃদ্ধ পিছু ফিরলেন। তারপর টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে রাস্তায় গিয়ে নামলেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত ওঁর লাঠির শব্দ শুনতে পেলাম – ঠুক..ঠুক…ঠুক…ঘুম আসছিল না আমার। কেবলই ডোডোর কথা মনে পড়ছিল। তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল না তাকে খুন করা হয়েছিল? খুন করলে কে-ই বা তাকে খুন করল? এ রহস্য তাহলে চিরদিনই অমীমাংসিত থেকে গেল। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। তখন কত রাত জানি না, হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল।
মনে হলো, ঘরের মধ্যে কোনো পাখি যেন ডানা ঝাপটাচ্ছে। সেই শব্দেই ঘুমটা ভেঙে গেছে আমার। ঘুমটা ভেঙেই টের পেলাম মাথাটা বেজায় ঘুরছে। শুধু মাথা ঘোরাই নয়, সেইসঙ্গে গলাতেও কিরকম একটা যন্ত্রণা টের পেলাম। ঢোক পর্যন্ত গিলতে পারছি না। মনে হচ্ছে কেউ যেন ছুরি দিয়ে আমার গলাটাকে দু আধখানা করে কেটে দিয়েছে।
আমি ভয়ানক ভয় পেলাম। এ আমার কি হলো? গলায় শুধু ব্যথাই নয়, সেইসঙ্গে অনর্গল লালা পড়ে আমার জামা ভিজিয়ে দিচ্ছে। হাত দিয়ে মুখ মুছতে গেলাম, পারলাম না। টের পেলাম হাতদুটো শক্ত করে বাঁধা খাটের সাথে। শুধু হাতই নয়, আমার পুরো চাদরঢাকা শরীরটাই লোহার খাটের সাথে শক্ত করে কে যেন বেঁধে রেখেছে! আমি আমারও ভয় পেলাম। মনে করতে চেষ্টা করলাম এ অবস্থা আমার কি করে হলো? কে এ কাজ করল?
চোখ মেলে তাকালাম। দেখি ঘরে একটা অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে। লক্ষ্য পড়ল সামনের দেওয়ালের দিকে। দেখি দেওয়ালের গায়ে ঝুলছে একটা মস্ত বড় ঘড়ি। আশ্চর্য! এই ঘড়িটা কখন এলো এ ঘরের দেওয়ালে? রাতে শোবার সময় তো এই ঘড়িটা ছিল না দেওয়ালে! মান্ধাতা আমলের এই বিশাল ঘড়িটা কে কখন টাঙিয়ে রাখল ঘরের দেওয়ালে! ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় রাত দুটো।
এবার নজর ঘুরল পাশের দেওয়ালের দিকে। দেখি সেখানে ঝুলছে পঞ্চম জর্জের একটা বিশাল প্রতিকৃতি। খুব চেনা চেনা লাগল ঘরের এই হঠাৎ বদলে যাওয়া পরিবেশটা। ছোটবেলায় কোথায় যেন দেখেছি এই ছবিটা, এই ঘড়িটা ঘাড়টা একটু তুলে এবার পুরো ঘরের পরিবেশটা দেখতে চেষ্টা করলাম এবার। কিন্তু ও কি? ঘরের মধ্যে এত সার সার লোহার খাট কোথা থেকে এলো? এ যেন মনে হচ্ছে আমি কোনো হাসপাতালে শুয়ে আছি! আর ওই খাটগুলোর ওপর সার দিয়ে দিয়ে ওরা কারা শুয়ে আছে? যেন সব মৃত’রা শুয়ে আছে ওইভাবে!
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। নিরুপায় হয়ে এদিকওদিক তাকাচ্ছি। ভালো করে কিছু নজরেও পড়ছে না। সব কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা দেখাচ্ছে চোখে। এমনকি কোনো ডাক্তার, কোনো নার্স’কেও চোখে পড়ছে না। এদিকে, টের পাচ্ছি প্রবল তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। মনের এমন অবস্থা, এক টুকরো বরফ হলেও স্বস্তি পাই। কিন্তু কাকে ডাকব, আশেপাশে কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না! এমন সময় দেখলাম কে যেন দরজা ঠেলে ঢুকল! মনে মনে স্বস্তি পেলাম। আঃ! তবু একজন জীবন্ত মানুষ দেখলাম এতক্ষণে! কিন্তু আমি ওকে ডাকব কি করে, আমি যে কোনো কথাই বলতে পারছি না!
তারপরেই দেখি লোকটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। খুব চেনা চেনা লাগতে লাগল লোকটাকে। লোকটা যত কাছে আসছে, একটু একটু করে চিনতে পারলাম ওকে। ম্যাকলার্ন সাহেবের বাড়িতে এঁকে প্রায়ই দেখি। চৌধুরী সাহেব। হাসপাতালের হেড কম্পাউন্ডার।
ক্রমশ তিনি আমার খাটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু ও কি? ওনার হাতে যে একটা সিরিঞ্জ দেখছি! কি করবেন উনি আমায় ওই সিরিঞ্জটা দিয়ে? ইঞ্জেকশন দেবেন নাকি?
চৌধুরী সাহেব আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। বাঁধন খুলে আমার বাম হাতটা আস্তে আস্তে তুলে ধরলেন। আমি যথাসম্ভব করুণ চোখে তাঁর দিকে তাকালাম। ওঁকে বোঝাতে চাইলাম – please push slowly। দয়া করে আস্তে আস্তে দেবেন।
কিন্তু উনি যখন আমার হাতে ছুঁচটা ফোটাচ্ছেন তখন ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ওঁর দু’চোখে কি ভয়ঙ্কর দৃষ্টি! বুঝতে পারলাম না উনি অমন করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? তারপরই উনি পুরো সিরিঞ্জের ছুঁচটা আমার হাতে ফুটিয়ে দিলেন আর সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত সমস্ত শিরা উপশিরাগুলো যেন ঝনঝন করে উঠল।
তা-র-প-র তারপরের কথা জানি না। সম্ভবত আমি এরপর চেতনা হারিয়ে ছিলাম। পরে লোকমুখে যা শুনেছি তা-ই লিখছি। তখন সবে সূর্য উঠবে উঠবে করছে, ইস্কুলের দারোয়ান দেখল, স্কুলের প্রেসিডেন্ট চৌধুরী সাহেব লাঠি হাতে ম্যাকলার্ন সাহেবের বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। এত ভোরে প্রেসিডেন্ট বাবু বেরোন না। নিশ্চয় কোনো জরুরি দরকারে যাচ্ছেন বলে দারোয়ানও এগিয়ে গেল।
দারোয়ান দেখল যে ঘরে আমি শুয়ে ছিলাম, সেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে চৌধুরী সাহেব কড়া নাড়ছেন আর বলছেন -“আর কত ঘুমোবেন মশাই? উঠুন, চা নিয়ে আসছে!” দারোয়ান দূরে দাঁড়িয়ে আমার ঘরের দরজা খোলার শব্দ শুনল। তারপরেই কি হলো হঠাৎ চৌধুরী সাহেব ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন – ” ডোডো…ডোডো…!”
বলেই তিনি প্রাণভয়ে ছুটতে লাগলেন। দারোয়ান তো অবাক। চৌধুরী সাহেব ঘরের দরজায় এমন কি দেখলেন যাতে এত ভয় পেয়ে গেলেন? ডোডো’ই বা কে? আর বুড়ো মানুষটি যেভাবে ছুটছেন ভাবতে ভাবতে দারোয়ান দেখল চৌধুরী সাহেবের হাত থেকে লাঠিটা ছিটকে পড়ে গেল। কিন্তু তবু চৌধুরী সাহেব বাড়ির দিকে ছুটছেন। তাঁর সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, চোখ-মুখ লাল।
“বাবু, দাঁড়ানবাবু দাঁড়ান” বলতে বলতে দারোয়ান ছুটে গেল ওঁর কাছে। সেইসময় চৌধুরী সাহেবের একপাটি চটি খুলে গেল। আর তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়লেন রাস্তার ওপর। সেই যে পড়লেন আর উঠলেন না।
ততক্ষণে ভিড় জমে গিয়েছে। চৌধুরী সাহেবের বডিটা তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ওরা এসে দাঁড়াল ম্যাকলার্ন সাহেবের বাড়ির কাছে, যে বাড়িতে আমি রাত কাটাচ্ছিলাম। ওরা দেখতে চেষ্টা করল, বাড়ির ভেতর কি দেখে চৌধুরী অত ভয় পেলেন? না, ঘরের মধ্যে ভয় পাবার মতো তো কিছুই নেই। আমি যেমন ঘুমোচ্ছিলাম তেমনই ঘুমোচ্ছি।
ওরা খুব আশ্চর্য হলো। প্রথমত, আমি যেখানে ঘুমিয়ে তাহলে ভেতর থেকে দরজা কে খুলে দিল? দ্বিতীয়ত, আমাকে দেখে ভয় পাবার কি কারণ ছিল? তৃতীয়ত, ডোডো বলে যদি কারোর প্রেতাত্মাকে তিনি দেখেই থাকেন তাহলে হঠাৎ আজ কেন? তিনি তো এ বাড়িতে অনেকবারই একা একা যাতায়াত করেছেন।
এসব রহস্যের কোনো মীমাংসা আমিও করতে পারিনি। তবে চলে আসবার সময় ওই ঘরের কোলঙ্গায় একটা জিনিস দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে যখন ঘরে রাত্রিবাস করার জন্য ঢুকেছিলাম তখন কোলঙ্গায় ওটা ছিল না। জিনিসটা আর কিছুই নয়, একটা পুরনো ভাঙা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ।
( সমাপ্ত)