সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে জমজমাট অন্ধকার। দেবকুমার বুঝতে পারল সে পথ হারিয়ে ফেলেছে—বন্ধু রজতের বাড়ি খুঁজে বার করা একেবারেই অসাধ্য। কত চেষ্টাই তো করল সে! কিন্তু রজতের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পথ সে খুঁজে বার করতে পারল না । মনে মনে জেগে ওঠে তার শত অনুতাপ। রজত তাকে বারণ করেছিল। সে বলেছিল বারবারই, “শোনো দেবকুমার, এসব পাহাড়ে জায়গা একেবারেই ভালো নয়, এখানে-সেখানে কত বিপদ ওৎ পেতে বসে আছে! কাজেই বিকেল পাঁচটা না বাজতেই ফিরে এসো !” সে তখন হেসেছিল বিদ্রুপের হাসি! একটা শক্ত-সমর্থ জোয়ান ছেলে সে, পাহাড়ে পথ বলেই কি তার বিপদ হবে? সে কি পাঁচ বছরের কচি ছেলে যে তাকে সহজেই কেউ বিপদে ফেলতে পারে? তখন এমনি কত কথাই তার মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন ? এখন যে বাচ্চা ছেলের মতোই সে পথ হারিয়ে ফেলল ? এখন কোথায় সে যাবে? কেই বা তাকে আশ্রয় দেবে? হ্যাঁ, ঐ যে দূরে একটা আলো দেখা যায় না?
দেবকুমারের আশা হল, নিশ্চয়ই ঐখানে কোনো বসতি আছে, ওখানে গেলে সে নিশ্চয়ই একটু আশ্রয় পেতে পারে।
দেবকুমার জোরে পা চালিয়ে দিল। মিনিট দশেক পরেই দেখা গেল, এক প্রকাণ্ড বাড়ি তার সুমুখে দাঁড়িয়ে। বাড়িটি জীর্ণ পুরাতন হলেও বুঝতে কষ্ট হয় না যে এককালে এর পেছনে ছিল বিরাট ধনীর কোনো ইতিহাস! বিরাট সিংহ-দরজা—লৌহ-ফটক। তারই মাথায় মিট্মিট্ করে একটা আলো জ্বলছে। অর্ধ-উন্মুক্ত ফটকের এক কোণে একখানি চেয়ারে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক উপবিষ্ট। পরম নিশ্চিন্ত মনে তিনি হুকো হাতে ধূমপানে ব্যস্ত। দেবকুমারের পায়ের শব্দে চমকিত হয়ে তিনি তার আধখোলা চোখ দুটি ভালো করে খুললেন ও একটু সোজা হয়ে বসলেন।
“দেখুন, আমি বড় বিপন্ন। পথ হারিয়ে ফেলেছি। আজ রাতের মতো আপনার এখানে একটু আশ্রয় প্রার্থনা করি।”
দেবকুমারের কথায় অসহায় মিনতি ঝরে পড়ে।
ভদ্রলোক একবার দেবকুমারের আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিলেন। তারপর কোনো কথা না বলে পাশের একটি ছোট বোতামে চাপ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভিতরে কোথাও ঝন্ঝন্ করে ঘণ্টা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবয়সী এক পরিচারিকা সেখানে উপস্থিত হল। ভদ্রলোক ঠিক তেমনিভাবে তামাক খেতে খেতেই নীরবে দেবকুমারকে দেখিয়ে তাকে ভিতরে নিয়ে যেতে ইঙ্গিত করলেন। দেবকুমার পরম কৃতজ্ঞভাবে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরিচারিকার পেছনে পেছনে ওপরে যাওয়ার সিঁড়িপথে অন্তর্হিত হয়ে গেল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ দেবকুমার বুঝতে পারে না তার ঘুম ভাঙল কেন! নিশুতি অন্ধকার রাত, কিন্তু কেমন একটা থমথমে ভাব!
সে তার বালিশের তলা হতে টর্চটি টেনে বার করতে যায়। কিন্তু মনে হল তার খাটসুন্ধু গোটা বিছানাই যেন মেজে হতে উঁচু হয়ে উঠেছে! কি এ?
দেবকুমার বসতে চেষ্টা করল বিছানার ওপর। কিন্তু বসতে গেলেই পড়ে যায়, আবার সে লুটিয়ে পড়ে বিছানার ওপরেই। কারণ, সমস্ত খাটখনি তখন প্রায় তিন হাত উঁচুতে শূন্যে উঠে গেছে! দেবকুমার ভীত-সন্ত্রস্ত ভাবে শেষ পরিণতি লক্ষ করতে লাগল! সহসা ধপ করে খাটখানি পড়ে গেল। প্রচণ্ড শব্দে দোতলার মেজে থরথর করে কেঁপে উঠল। মনে হল, কোনো মত্ত হস্তী বুঝি তার মাথা দিয়ে খাটখানা ঠেলে ফেলে দিলে! পরক্ষণেই একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া! মুহুর্তে শীতে কেঁপে ওঠে দেবকুমার! হঠাৎ কার একটা মৰ্মভেদী নিঃশ্বাস তার মুখে এসে লাগে! কিন্তু এত ঠান্ডা। নিঃশ্বাস কি কখনো কারো এত ঠান্ডা হয়? এ যেন বরফের ছুরি। দেবকুমার না-জানি কোন এক অজানা ভয়ে কখন তার চোখ অনেকটা বন্ধ করেই ফেলেছিল! কিন্তু আসলে সে তো ভীরু নয়। সাহসী বলে তার রীতিমতো সুনামই ছিল। কাজেই তার সমস্ত জড়তা ও ভয় সে এইবার দূরে ঠেলে ফেলে দেয়, পূর্ণ বিস্ফারিত চোখে তাকায় সে। কিন্তু চাইতেই—ও কি? খোলা জানলায় একখানা বীভৎস মুখ, সে মুখে এক তিলও মাংস নেই, সাদা ধবধবে হাড়ের মুখ..নাক-চোখের জায়গায় তিন-তিনটে গর্ত, দুঠোঁটের জায়গায় দুসারি দাঁত বেরিয়ে আছে। এক মুহুর্তের জন্যে দেবকুমারের মাথাটা ঘুরে গেল, তার চোখ দুটি আপনা হতে বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ একটা বিশ্ৰী হাসির শব্দে চমকে ওঠে দেবকুমার…কিন্তু এ কি? কোথায় সে বীভৎস মুখ? এত বড় বিস্ময়কর ঘটনাকেও ছাপিয়ে আর একটা বিভীষিকা ফুটে উঠল তার চোখের সামনে। সে দেখে, দুটি করুণ চোখ—সুন্দরীর চোখই তাকে বলা যায়—একান্ত মিনতি-মাখা,— দেবকুমারের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে আছে! দেবকুমারের বুকের রক্ত মুহুর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়! কে যেন একরাশ বরফের ছোপ তার দেহমনে বুলিয়ে গেল! চোখ তার বন্ধ করে দেবকুমার—ভয়ে বা বিস্ময়ে। পরক্ষণেই আবার সে চোখ মেলে তাকায়। কিন্তু তখনো সেই চোখ—ঠিক তেমনিভাবে—তারই মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। তার এক ঝলক ঠান্ডা নিঃশ্বাস দেবকুমারের কপালে এসে বুঝি কাঁপুনি জাগিয়ে তোলে। সহসা—একটা প্রচণ্ড শব্দ! সজোরে দরজাটা কে খুলে ফেলল। পরক্ষণেই একটা প্রকাণ্ড জোয়ান লোক ঝড়ের বেগে ঘরে ঢোকে। ঢুকেই সে এক লাফে মহিলার দিকে এগিয়ে এল। তারপর মুহুর্তমধ্যে তার চুল ধরে টেনে তাকে মাটিতে ফেলে দিল! আর্তনাদ করে উঠল সেই বিপন্ন মহিলা। কিন্তু পরক্ষণেই সেই জোয়ান লোকটার হাতে চক্চক্ করে ওঠে একখানি শাণিত ছুরি আর সহসা স্তব্ধ হয়ে গেল মহিলার কণ্ঠস্বর। দেবকুমারের চোখের সম্মুখে রক্তের নদী বয়ে যায়! মহিলার রক্তাক্ত দেহ তার মাঝখানে। দেবকুমার সে দৃশ্য আর দেখতে পারে না—ভয়ে সে চোখ বন্ধ করল! কতক্ষণ সে এইভাবে ছিল বলা যায় না—কিন্তু কি এক বিচিত্র শব্দে চমকিত হয়ে আবার সে চোখ মেলে চায় !—
ওঃ! কি ভয়ঙ্কর! নিহত মহিলার চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। কি তার উত্তাপ আর কি তার জ্যোতি! সমস্ত ঘরে যেন আগুন জ্বলে উঠেছে! আর সেই আগুনের মাঝখানে রক্ত-সমুদ্রে সেই সুন্দরী মহিলা! তার সর্বদেহ রক্তমাখা, বুকের একপাশ দিয়ে তখনো বয়ে চলে ফুটন্ত রক্তস্রোত! দেবকুমার স্তব্ধ, হতবাক! কিন্তু কিসের আকর্ষণে সে চোখ তার ফেরাতে পারল না, মন্ত্ৰমুগ্ধ শিকারের মতো সে যেন শিকারির চোখে চোখ মিলিয়ে ঠিক তেমনি ভাবেই তাকিয়ে রইল! মহিলা হিংস্র দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকায়, ঠোঁট তার কেঁপে ওঠে। না-জানি কোন অভিসম্পাত সে বিলিয়ে দেয় অত্যাচারী পৃথিবীর বুকে!
সহসা দূরে কেন অসংখ্য পদশব্দ?—দূর হতে কাছে, ক্রমশই আরো কাছে, কে জানে কত লোকজনের পদশব্দ নৈশ স্তব্ধতা ভারী করে তোলে!
দেবকুমার বুঝতে পারে, একজন দুজন নয়, অসংখ্য লোক—হিংস্র শিকারির মতো বাড়িতে ঢুকে পড়েছে! তাদের হৈ-হল্লা ও অস্ত্রের ঝঞ্জনায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, সমস্ত পৃথিবী যেন দারুণ ভয়ে তার চোখ বন্ধ করে ফেলল! বুক কেঁপে ওঠে দেবকুমারের! কিন্তু সে বুঝি চিৎকার করবার শক্তিটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে! হঠাৎ কিসের বিজয়-উল্লাসে সমস্ত আকাশ-বাতাস ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল! সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে ঝড়ের মতো ঘরে ঢোকে একপাল যমদূত—সকলেই সশস্ত্র ভয়ঙ্কর! কিন্তু তাদের পুরোভাগে সেই মহিলার হত্যাকারী নৃশংস ব্যক্তি। হিড়্ হিড়্ করে টেনে তাকে ঘরে নিয়ে এল যমদূতের দল। তারপর তার দেহের সর্বত্র এলোপাথাড়ি চলে অসংখ্য অস্ত্রাঘাত। ছোরা, তলোয়ার, শড়কি-বল্লম তাকে প্রায় ভূমিতলে গেঁথে ফেলে। মহিলার ফুটন্ত রক্তের সঙ্গে তার সদ্যোনিঃসৃত রক্ত মিশে একাকার হয়ে গেল! “হাঃ! হাঃ! হাঃ! হাঃ!”—একটা বীভৎস অট্টহাসিতে মহিলা উল্লসিত হয়ে ওঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে কোথা হতে বুঝি বা ছাদ ফুঁড়ে টুপটাপ ঝরে ঝরে পড়তে লাগল কতকগুলি কচিকাচা ছেলেমেয়েদের রক্তমাখা ছিন্নশির ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আর্তনাদ ও উল্লাসের চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে যায়, আর ঠিক সেই মুহুর্তে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে সেই বিশাল বাড়িখানির ভিত পর্যন্ত কেঁপে ওঠে।
প্ৰলয়-দোলায় কেঁপে ওঠে দেবকুমারের সমস্ত খাটখানি, টগবগে ফুটন্ত রক্ত তার কপালে ও মুখে ছিটকে এসে লাগে! কয়েকটা ভয়ঙ্কর হিংস্র যমদূত গোটাকয়েক বীভৎস কঙ্কাল সহ অবশেষে দেবকুমারের দিকেও তেড়ে এল! ভয়ে শিউরে উঠল দেবকুমার! দু’হাত মাথায় তুলে সে প্রাণপণে চিৎকার করে ওঠে, “বাঁচাও ! বাচাও!”—
জ্ঞান যখন হল, তখন সে দেখে, তার বন্ধু রজত ও একজন ডাক্তার তার পাশে বসে! ভাবতে চেষ্টা করে সে, কোথায় সে আছে আর কেমন করে এল ? চোখ চাইতে পারে না সে। অবশেষে ধীরে ধীরে মনে আসে তার সব কিছু। কিন্তু বুঝতে পারে না, নিশীথের সেই ভয়ঙ্কর প্রাসাদে ওরা দুজনই বা এল কখন আর কেমন করে এল! “কেমন করে এল?”—সম্ভবত তার বুকের ভাষা মুখে ফুটে বেরিয়েছিল একটু জোরেই।
রজত বলে, “হ্যাঁ ভাই, এ প্রশ্ন তোমার মনে জেগে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। সংক্ষেপে বলছি শোনো—
অনেক রাতে তুমি যখন ফিরলে না, তখন আমার এই ডাক্তার বন্ধুটিকে নিয়ে তোমায় খুঁজতে বেরেই। এ বাড়িটা আমার বাড়ি হতে প্রায় মাইল তিনেক দূর। এর কাছাকাছি আসতেই তোমার একটা আর্তনাদ আমাদের কানে আসে। আমরা তখুনি টর্চ হাতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ি। এসে যা দেখলুম, তাতে আর আশা হয়নি যে তোমাকে জীবন্ত ফিরে পাব। দেখি, তুমি এই খাটের ওপর পড়ে আছ, কিন্তু মাথা তোমার মাটিতে ঝুলছে! আর তোমার নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে!—” বাধা দিয়ে দেবকুমার বলে, “কিন্তু ওরা সব গেল কোথায়? সেই নিহত মহিলা, বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কাটা মাথাগুলি—সেই রক্তনদী—রক্তস্রোত—” “থামুন,” বাধা দিয়ে বলেন ডাক্তারবাবু, “ওকথা আর ভাববেন না দেবকুমারবাবু। এ বাড়িটা ভূতের বাড়ি, যা-কিছু আপনি দেখেছেন, সবই ভৌতিক ব্যাপার দেখেছেন। আসলে কিছুই সত্য নয় —” “কিন্তু মিছামিছি এমন একটা—”
দেবকুমারের কথায় বাধা দিয়ে বলে রজত, “মিছামিছি কিছুই নয় দেবকুমার। অনেক দিন আগে এক ধনী জমিদার তার স্ত্রীর ওপর বিরক্ত হয়ে অতি নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু তিনিও হাতে হাতে তার সাজা পেয়ে গেছেন। মহিলার আত্মীয়-স্বজন যারা, তারা একদল ভাড়াটে গুন্ডা লেলিয়ে এবাড়ির সবাইকে কচুকাটা করে গেছেন। সেই থেকে এবাড়ি পোড়ো বাড়ি বলেই বিখ্যাত। কেউ এখানে থাকে না।