সিলিংয়ের সাথে ঝুলে আছে লাশটা। গলায় একটা লাল ওড়না প্যাঁচানো। হতভম্ব হয়ে ঝুলন্ত মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে আছে ফাহাদ আর মিথিলা। সকাল সকাল এমন দৃশ্য দেখতে হবে – সেটা দুজনের কেউ-ই কল্পনাও করেনি।
মিথিলার মনে চিন্তার সাইক্লোন বইছে। শিউলি সুইসাইড করলো কেন?
ওর সাথে তো এখানে কেউ-ই কখনো কোন খারাপ ব্যবহার করেনি। ভালোই তো কাজ করছিল!
এর পেছনে নিশ্চয় অন্য কোন কারণ আছে। কিন্তু সেই কারণটা কি?
শিউলি ছাড়া আর কে জানে সেই কারণটা?
“ইশ! শিউলি কে যদি বাঁচিয়ে তোলা যেত! তখন, কি কারণে ও সুইসাইড করল, জানতে পারতাম!”, আনমনে বলল মিথিলা।
“কিছু বললে?”, মিথিলার উদ্দেশ্যে বললো ফাহাদ।
কিছুক্ষণ কোন উত্তর দিলো না মিথিলা। ভাবনার জগতে ডুবে আছে সে। যেভাবেই হোক জানতে হবে শিউলির আত্নহত্যার পেছনের কারণ!
হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো আইডিয়াটা মিথিলার মস্তিষ্কের মধ্যে টোকা দিলো। শিউলির আত্নহত্যার কারণ জানা যাবে – একমাত্র প্লানচেটের মাধ্যমেই!
“আমি প্লানচেট করবো। শিউলি কেন সুইসাইড করেছে – সেটা জানা দরকার।”, ফাহাদের উদ্দেশ্যে মৃদু স্বরে বলে উঠলো মিথিলা। যেন জোরে শব্দ করলে লাশটা বিরক্ত বোধ করবে!
“হুয়াট? তুমি এসব গাঁজাখুরিতে বিশ্বাস করো?”, বিস্মিত হয়ে বললো ফাহাদ।
ছোট্ট এক শব্দে উত্তর দিলো মিথিলা,”অবশ্যই!”
– “আজব! এই ২০১৫ সালে এসে, তুমি প্লানচেটে বিশ্বাস করো! হাস্যকর!”
– “আমি সিরিয়াস,ফাহাদ।”
“অকে। তোমার যা ইচ্ছে করো। আমি নাই এসবে!”,প্রচন্ড বিরক্তির সাথে বাক্যদুটো বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো ফাহাদ।
মনে মনে এবার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো মিথিলা। ও প্লানচেট করবে এবং সেটা আজই। তবে, তার আগে লাশটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার!
[1]
এই মুহুর্থে মিথিলার অবস্থান সাদমানদের অ্যাপার্টমেন্টে। কয়েক মিনিট ধরে এখানকার ড্রয়িং রুমে বসে আছে ও। তবে – বসে বসে সাদমানের জন্য অপেক্ষা করতে মোটেই বিরক্ত লাগছে না। বরং এই ফাঁকে – ভাবনার অতলে আবার ডুব দিলো ও।
মিথিলা যখন হাই স্কুলের ছাত্রী তখন সাদমানের সাথে পরিচয় হয়। ছেলেটা হাই স্কুলে থাকতেই অসংখ্য বিষয়ে অগাধ জ্ঞান রাখতো। তবে – পাঠ্য বইয়ের বাইরের জ্ঞান আহরন নিয়ে ছেলেটা যত আগ্রাসী ছিল – ততটাই অনাগ্রহী ছিল পাঠ্যবই পড়ার ব্যাপারে। ফলস্বরূপ ক্লাসের মোটামোটি শেষ সারির ছাত্রদের একজন ছিল সে। তবে – এজন্য অবশ্য ক্লাসের ফার্স্ট গার্লের সাথে বন্ধুত্ব গড়তে তেমন বেগ পেতে হয়নি। স্কুল লাইফের পর ওদের পথ আলাদা হয়ে গেলেও যোগাযোগ হারিয়ে যায়নি। মিথিলা ম্যাথ নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের পর পরই যোগ দেয় ভার্সিটির লেকচারার পদে। তবে, ততদিনে বিয়ের পিঁড়িতে বসা হয়ে গিয়েছে ওর। আর অন্যদিকে সাদমান দর্শনে অনার্স শেষ করে – চাকরি একটা জুটিয়ে ফেলেছে দ্রুতই।
শিউলির আত্নহত্যার পর প্লানচেটের চিন্তা মাথায় আসতেই – সাদমানের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল মিথিলার। অবশ্য এর কারণও আছে। প্লানচেট সম্পর্কে ও সর্বপ্রথম জানতে পারে – সাদমান এর কাছ থেকেই। সেই স্কুল লাইফেই। তবে – সেটা ছিলো প্রাথমিক ধারণা।
হঠাৎ কলিং বেলটা বেসুরো গলায় বেজে উঠতেই ভাবনায় ছেদ পড়লো। বোধহয় সাদমান এসে পড়েছে। ছেলেটা এখনো ফ্যামিলির সাথেই থাকে। বেলের আওয়াজ শুনে – তাই ওর মা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। হাসিমুখে বললেন,”কে এসেছে দেখ!”
মিথিলাকে দেখে বিস্ময়ে সাদমানের চোখদুটো গোল হয়ে গেল। চিনতে অবশ্য বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি!
“আরেহ! শাকচুন্নি যে!” – সহাস্যে বলে উঠলো সাদমান।
শত দুশ্চিন্তার মাঝেও হেসে ফেললো মিথিলা – “তুই আর বদলালি নাহ!”
“বদলাবোই বা কেমনে বল? কাউকে তো দরকার হয় – জীবনটা পাল্টে দেয়ার জন্য!” – সোফায় বসতে বসতে বললো সাদমান।
“বিয়ে একটা করে ফেল না তো!” – মুখ বেঁকিয়ে বললো মিথিলা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাদমান। তারপর ধীরে ধীরে বললো – “তোহ কেমন আছিস?”
“এইতোহ ভালোই। একটা সমস্যায় পড়ছি রে!”- মাথা নিচু করে বললো মিথিলা।
“তা তো জানিই! বিপদে না পড়লে, এই অধমের বাড়িতে কি আর তোর পা পড়তো! তা সমস্যাটা কি শুনি?” – ভ্রু কুঁচকে বললো সাদমান।
একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মুক্ত করে দিয়ে পরিস্থিতিটা সাদমানের কাছে ব্যাখ্যা করলো মিথিলা। সব শেষে যোগ করলো, “আমার ফাহাদকে সন্দেহ হয় রে। জানিসই তো, আমাদেরটা এরেঞ্জ ম্যারেজ। বিয়েটা আমার অমতেই ছিলো। যাই হোক, জানিস – আমার সন্দেহ হয় – ফাহাদ যদি মেয়েটার সাথে কিছু করে থাকে। আমি ওকে পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করতে পারছি না। তাই ভাবছি – প্লানচেট করবো!”
“তোহ লাশটা কি করলি? পুলিশের হ্যাপায় পড়তে হয়নি?” – সব শুনে কৌতুহলি হয়ে জিজ্ঞেস করলো সাদমান।
– “লাশটা নিয়ে ফাহাদ শিউলির গ্রামে গিয়েছে। মেয়েটার হার্টের প্রবলেম ছিলো। ওর প্ল্যান হলো: মৃত্যুটা হার্ট অ্যাটাক বলে চালিয়ে দিবে। যেহেতু গলায় দড়ি দিছিল, তাই সমস্যা হবে না বোধহয়।
– “আচ্ছা, তোহ আমাকে এখন কি করতে হবে?”
– “তুই জাস্ট আমাকে কিভাবে প্লানচেট করতে হয় – সেটা শিখাই দিবি।”
– “উমমম… দেখ, তুই তো জানসই প্লানচেট হলো আত্নাদের সাথে যোগাযোগের একটা প্রক্রিয়া। কিছুটা প্রাচীন নিয়ম অনুযায়ী প্লানচেট করা সুবিধাজনক। তবে আত্নার সাথে যোগাযোগের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও আছে।”
“আধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো কি?” – কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারল না মিথিলা।
বিজ্ঞের মতো বলা শুরু করলো সাদমান, “অনেকগুলাই আছে। যেমন: EVP হলো হোয়াইট নয়েস ধরার জন্য অর্থাৎ আত্না ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনো রেন্ডম নয়েজ করলে এটা সেই নয়েজ ডিটেক্ট করবে, এমনকি সেটাকে স্পিচেও পরিণত করতে পারে। EMF বা ইলেক্ট্রো-ম্যগনেটিক ফিল্ড ডিটেক্টর যেটা আত্নার অবস্থান নির্ণয়ে সাহায্য করবে। এছাড়াও মোশন ধরার জন্য আছে হাইটেক মোশন ডিটেক্টর। এনভায়রনমেন্টাল চেইঞ্জ ধরার জন্য আরো অনেক যন্ত্রপাতির মধ্যে আছে; রেড সেলোফান, থার্মাল ইমেজিং স্কোপস, স্মল উইন্ডকাইমস, ইনফ্রারেড থার্মাল ডিটেক্টর ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সমস্যা হলো এগুলার দাম অনেক অনেক বেশি!”
হতাশ হয়ে মাথা দুলালো মিথিলা। তারপর আশা নিয়ে বললো,”আর প্রাচীন পদ্ধতি?”
“এটা একদম সোজা। জাস্ট একটা ‘ওইজা বোর্ড’ লাগবে। আর একজন মিডিয়াম। তোর ভাগ্য ভালো যে, আমি কলেজে উঠেই এই বোর্ড সংগ্রহ করছিলাম। যদিও ব্যবহার করিনি কখনো!” – মুচকি হেসে বললো সাদমান।
“তাই? কই দেখি তো!” – ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড কৌতুহল বোধ করলেও সেটা বাইরে প্রকাশ করলো না মিথিলা।
“ওয়েট। এখনই আনছি!” – বলেই সাদমান উঠে গেল।
কয়েক মিনিট পর ফিরে এলো ছোট্ট একটা হার্ট শেপ বোর্ড নিয়ে। বোর্ডটার তিন মাথায় তিনটা চাকা লাগানো। সামনের চাকার সামান্য আগে একটা ফুঁটো। তবে, এই বোর্ডটার বয়স যে কম হয়নি সেটা বোঝা যাচ্ছে – বোর্ডের মোটামোটি করুন দশা দেখে।
একবার ‘ওইজা বোর্ডে’র দিকে আরেকবার সাদমানের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো মিথিলা। সেটা লক্ষ্য করে – তাড়াতাড়ি বললো সাদমান, “ভাবিস না। এটা দেখতে কিছুটা ভাঙা-চোরা মনে হলেও, আমার বিশ্বাস কাজ করবে!”
ভ্রুর সাথে এবার কঁপালও কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো মিথিলা, “কিভাবে কাজ করবে এটা?”
“প্রথমত একজন মিডিয়াম লাগবে – যার উপর আত্না ভর করবে। এই মিডিয়াম তার হাত ওইজা বোর্ডের হার্ট শেপের উপর রাখবে। বোর্ডে যে ফুঁটোটা আছে সেটাতে একটা কলম বা পেন্সিল রাখা হবে। হার্ট আকৃতির বোর্ডের নিচে একটা কাগজ রাখতে হবে। আত্না মিডিয়ামের উপর ভর করার পর – নিজের হাতের উপর মিডিয়ামের কোন নিয়ন্ত্রন থাকবে না। আত্নাকে যে প্রশ্ন করা হবে – মিডিয়ামের হাত দ্বারা আত্না সেটা কাগজে লিখে উত্তর দিবে। আর এটা ছাড়াও ‘ওইজা বোর্ড’-র আরো কয়েকটা ভার্সন আছে। যেমন: এক্ষেত্রে বোর্ডটা দেখতে কাগজের মতো হয়। যেটার প্রথম সার্কেলে ‘A’ থেকে ‘Z’ পর্যন্ত লেটার থাকে এবং দ্বিতীয় সার্কেলে এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যা থাকে। উপরের দিকে ‘ইয়েস’ এবং ‘নো’ অপশন থাকে। তবে, আমরা প্রথম পদ্ধতিটাই ইউজ করতে পারব। যেহেতু – আমাদের হাতে অন্য পদ্ধতির উপকরণ নেই।” – দীর্ঘ একটা লেকচার দিয়ে থামলো সাদমান।
মিথিলা এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শুনছিল। ছেলেটার মস্তিষ্ক আসলেই প্রচুর জ্ঞান বহন করে!
হঠাৎ করে অদ্ভুতভাবেই প্রশ্নটা করলো মিথিলা, “আচ্ছা, তুই কি মনে করিস – আত্নার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব?”
“গাধী! এতক্ষণ তাহলে তোকে এগুলো বললাম কেন?” – সহাস্যে উত্তর দিলো সাদমান।
মিথিলা মাথা দুলিয়ে কি যেন ভাবল। তারপর বললো,”আচ্ছা, আজ রাতেই আমরা প্লানচেটে বসবো!”
[2]
বিরাট রুমটা অনেকটাই অন্ধকারের চাদরে আবৃত। মোমবাতির সামান্য আলো দ্বারা অবশ্য অন্ধকার দূর করাও সম্ভব নয়। তবে, সেটা রুমে অবস্থানকারী তিনজনের কেউ চাচ্ছে বলে মনে হয় না।
ড্রয়িং রুমের মাঝারি সাইজের টি-টেবলের উপর ওইজা বোর্ডটা রাখা। বোর্ডের নিচেই ঢাউশ সাইজের একটা অপসেট পেপার শোভা পাচ্ছে। ওইজা বোর্ডের ফুঁটোটাও খালি রাখা হয়নি। সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে – একটি এইচবি পেন্সিল। টে-টেবলের পেছনে মিথিলা পা গুঁটিয়ে বসে আছে। জেদ করে ও নিজেকেই মিডিয়াম হিসাবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওর ডানে আছে ফাহাদ আর বামে সাদমান।
ফাহাদকে এই যজ্ঞে আনতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। শেষপর্যন্ত অবশ্য মিথিলার জেদের কাছে হারতেই হলো। দুপুরে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয়েছে ওকে। শিউলির বাবা-মাকে হার্ট অ্যাটাক করেছে – বলতেই উনারা অবিশ্বাস করেননি। তবুও ফাহাদ জানাজা-দাফন শেষ করে ফিরে আসার সময় হাজার বিশেক টাকা শিউলির বাবার হাতে গুঁজে দিয়ে এসেছিল। এসব ঝামেলা আর জার্নিতে ওর বেহাল দশা। আর তাই এখন ওকে প্রচন্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
সময়টা এখন মধ্যরাত প্রায়। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলতে চলতে বারোটা স্পর্শ করবে আরেকটু পরই। আইডিয়াটা সাদমানের। তার মতে – একদম বারোটায় প্লানচেট শুরু করলে ভালো হতে পারে।
হঠাৎ ‘ঢংঢং’ শব্দ করে উঠল ড্রয়িং রুমের গ্র্যান্ড ক্লকটা। সাথে সাথেই সাদমানের ইশারা দেখে একটু বড়সড় নিশ্বাস নিয়ে হাতটা ওইজা বোর্ডের উপর রাখল মিথিলা। হাত নামিয়ে রাখতেই অদ্ভুতুড়ে একটা অনুভূতি হলো ওর মধ্যে। প্রচন্ড ব্যাকুল হয়ে মৃত্যুর ওপারের শিউলির উদ্দেশ্যেই যেন বিড়বিড় করে উঠলো ও,”শিউলি, সাড়া দে। প্লিজ। প্লিজ, শিউলি!”
হঠাৎ দমকা হাওয়ার স্পর্শ যেন জমিয়ে দিলো ওদের। তবে, হরর মুভির মতো নিভে গেলো না – মোমবাতিটা। এবার, কেঁপে উঠলো মিথিলা। ওইজা বোর্ডটা নড়তে শুরু করেছে!
বিস্ময়ের সাথে সেটা লক্ষ্য করলো ফাহাদ ও সাদমান। দৃঢ় কিন্তু কম্পিত গলায় প্রশ্নটা করলো সাদমানই, “কে তুমি? শিউলি?”
এবার, ভয়ঙ্করভাবে নড়ে উঠলো ওইজা বোর্ডটা। প্রচন্ড বিস্ময়ের সাথে ওরা দেখলো – খস খস শব্দ করে পেন্সিলটার আগা দিয়ে ওইজা বোর্ডটাই যেন লিখে ফেললো – “হ্যা, আমিই শিউলি।”
মিথিলার দিকে তাকালো ফাহাদ। মেয়েটার চোখদুটো বড় বড় হয়ে আছে। বুক উঠা-নামা করছে অত্যন্ত দ্রুত।
সাহস করে আবারো প্রশ্ন করলো সাদমান, “তুমি সুইসাইড করলে কেন, শিউলি?”
এবারো পেন্সিলটা কাম ওইজা বোর্ডটা লিখে দিলো – “ফাহাদের কারণে!”
হালকা আলোতে লিখাটা পড়তেই থমকে গেল সাদমান। মৃদু স্বরে শুধু জিজ্ঞেস করলো – “কেন?”
বিস্ময়ের ধাক্কাই ফাহাদের প্রতিক্রিয়া হলো আরেকটু পরেই। এক লাফে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল ও। তারপর প্রচন্ড বিস্মিত হওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলো – “মানে কি!”
বসা থেকেই হাত বাড়িয়ে ফাহাদকে থামালো সাদমান। আর কিছু করা থেকে বিরত থাকলেও বসে পড়লো না ও। ইতিমধ্যেই ওইজা বোর্ডটা আবার নড়তে শুরু করেছে!
এবার কাগজটাতে ফুঁটে উঠলো – “ফাহাদের সাথে আমার সেক্সুয়াল রিলেশন ছিলো!”
এইবার আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না ফাহাদ। গলা ফাঁটিয়ে বলে উঠলো – “হোয়াট দ্য ফাক!”
তারপর প্রচন্ড একটা লাথি মেরে দিলো টি-টেবলটার গায়ে। লাথির প্রতিক্রিয়ায় ‘ওইজা বোর্ড’ ছিটকে পড়ে গেলো নিচু টেবিলটা থেকে। আর মিথিলার পেটে গিয়ে আঘাত করলো টেবলটার এক পাশ। মেয়েটা চোখদুটো বড় বড় করে একবার ঘোলাটেভাবে তাকালো ফাহাদের দিকে। তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে ঢলে পড়ে গেলো!
[3]
জ্ঞান ফিরেছে মিথিলার। পাক্কা দেড় ঘন্টা পরে। ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর পরই দ্রুত এগিয়ে এসেছে সাদমান আর ফাহাদ। তারপর দুজনে ধরাধরি করে নিয়ে এসেছে বেডরুমে।
এতক্ষণ ধরে ইন্টারনেটে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছিল ফাহাদ। আর সাদমান নিরবতাকে সঙ্গি করে বসে ছিলো খাটের পাশেই। মেয়েটার জ্ঞান ফিরতেই ফাহাদকে ডাক দিলো সাদমান। তবে, ফাহাদের দিকে এক বারও তাকালো না মেয়েটা। সেটা খেয়াল না করার ভান করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করলো ফাহাদ, “আমি কিছু কথা বলতে চাই। আশা করি, সেই পর্যন্ত তোমরা চুপ থাকবে। শুনো, তোমরা নিসন্দেহে এখন এইসব কাজ-কারবার শিউলির আত্নার বলেই ধরে নিয়েছ। কিন্তু আমি তোমাদের মতো ভাবছি না। আমার প্রথমেই প্লানচেট নিয়ে অবিশ্বাস ছিলো। আর পুরো কাজটা সম্পর্কে আমার প্রথম সন্দেহ হয় – যখন দেখলাম যে, ওইজার বোর্ডের মাধ্যমে তৈরি হওয়া লেখাগুলো শুদ্ধ চলিত ভাষায় লেখা। আমি যতদূর জানি – শিউলি বলতেই গেলে একদম ইলিটারেট ছিলো। তাহলে, তার আত্না কিভাবে ইংলিশ ওয়ার্ড জানে? কিভাবেই বা লিখতে জানে? মরার পর পর কি আত্নাকে শিক্ষিত করা হয়? হাস্যকর! তাছাড়া, শিউলি আমাকে সবসময় ‘মামা’ ডাকতো। তাহলে, ওর আত্না আমাকে ‘ফাহাদ’ নামেই ডাকলো কেন? দেহের মৃত্যুর পর আত্না আদব-কায়দা ভুলে যায় নাকি?
এখন – পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে ক্লিয়ার। আসলে – প্লানচেটের পুরোটাই মস্তিষ্কের ধোঁকা। এর কারণ হলো আমাদের মস্তিষ্কের ‘ইডিয়মোটর ইফেক্ট’। মিথিলার অবচেতন মনের ইচ্ছা ছিল যে, সব কিছুর যেন একটা আশানুরূপ উত্তর পায়। আর ঘটলোও তাই। সম্ভবত – আমাকে নিয়ে ওর এই বাজে সন্দেহটা ছিলো। ওর অবচেতন মনের ভাবনা পেয়ে ওর মস্তিষ্কের মধ্যে বাম পাশের একটি অংশে তৈরী হলো ‘ইডিয়মোটর ইফেক্ট’। ইডিয়মোটর ইফেক্টের ফলে ওর শিরা-ধমনি গুলো সেভাবে নড়তে লাগল, যেভাবে ওর অবচেতন মন চেয়েছিল। ফলে ওইজা বোর্ডে মিথিলার অজান্তেই ওর মনের কথা ফুঁটে উঠলো। আর বাতাসের কারণ ছিলো – পর্দার পেছনের দিকে অজান্তেই খোলা রয়ে যাওয়া জানালা। আমি আমার কথার স্বপক্ষে প্রমাণও দেখাতে পারবো। এখন, প্লিজ মিথিলা এসব ছেলেমানুষি বাদ দাও। সাদমান, তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ। ওকে একটু বুঝাও প্লিজ!” – একটানা দীর্ঘ সময় নিয়ে কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে গেলো ফাহাদ। গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেলো পিপাসায়। পানি খাওয়ার জন্য ঘুরে বেডরুমের বাইরে যাওয়ার সময় মিথিলার মিষ্টি গলা শুনতে পেল ও – “স্যরি, ফাহাদ। ভুল বুঝার জন্য স্যরি। আসলে – শিউলির সুইসাইড মাথাটা গুলিয়ে দিয়েছিল। স্যরিইইই, বেবি!”
মুচকি হেসে বেরিয়ে এলো ফাহাদ।
_পরিশিষ্ট_
ড্রয়িং রুমে পা রেখে চাপা স্বরে অট্টহাসি দিয়ে উঠলো ফাহাদ। সবাইকে ভালোই বুঝ দেওয়া গিয়েছে। অবশ্য শিউলির সাথে ফিজিকাল রিলেশন বেশ কয়েকবার হলেও – ফাহাদ কখনো ভাবতেই পারেনি; মেয়েটা এভাবে সুইসাইড করবে। তবে, সবাইকে বোকা বানাতে পারার জন্য কল্পনায় কয়েকবার নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলো ও।
ড্রয়িং রুমটার বেহাল দশা। রুমের মাঝে উল্টে পড়ে আছে টি-টেবল। যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকটা কাগজ। সেগুলো পাশ কাটিয়ে সোফাসেটের পেছনের দিকে চলে এলো ফাহাদ। এদিকের জানালাটা খোলা। না হয় – হঠাৎ দমকা হাওয়া আসার আর কোন কারণ নেই!
কিন্তু পর্দা সরাতেই থমকে গেলো ও। জানালাটা লক করাই আছে। এমনকি কোন দিক দিয়ে সামান্য ফাঁকও নেই!
হতভম্ব অবস্থায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে থাকা ‘ওইজা বোর্ড’-টার দিকে এগিয়ে এলো ও। এক টানে খুলে নিলো বোর্ডের সাথে লাগানো কাগজটা। সেটাতে লেখা রয়েছে – “প্রতিশোধ হবে। ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ!”
ফাহাদের শিঁড়দাড়া দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে ও – পেছন থেকে এগিয়ে আসছে কেউ!