রাইলান শেখ পথ চলতে মোটেই কষ্ট হচ্ছে না । সব কিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে । এবং এই পরিস্কার দেখা যাওয়া নিয়েই রাইনাল শেখের যত চিন্তা । সুন্দর বনের এই জায়গাটা অন্যান্য যে কোন জায়গা থেকে অনেক বেশি গভীর । এখানে দিনের বেলাতেও ঠিক মত আলো প্রবেশ করে না । আর এখনও রাতের বেলা । তাহলে সব কিছু এতো পরিস্কার কিভাবে দেখা যাচ্ছে ?
রাইনালের মনের ভেতরে একটা কুঁ ডেকে উঠলো । এই এলাকাটা অন্যান্য শিকারীরা এড়িয়ে চলে বলতে গেলে । সুন্দরবনের এই এলাকা নিয়ে তাদের ভেতরে অদ্ভুদ ভয় কাজ করে । অনেকেই নাকি এর আসে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা মেয়েকে দেখতে পেয়েছে । সেই সাথে অদ্ভুদ এক জন্তু । জন্তুটার মাত্র একটা চোখের কোটর আছে ঠিক কপালের মাঝ খানে । কিন্তু সেখানে কোন চোখ নেই । আগে নাকি চোখ ছিল তবে জন্তুটা চোখটা হারিয়ে ফেলেছে । চোখের কোটরের জায়গায় একটা সীমাহীন শূন্যতা আর কালো অন্ধকার থাকে । আর মেয়েটার চোখ দিয়ে আগুন বের হয় । প্রায় রাতে মেয়েটা আর জন্তুটা বাইরে বের হয় সেই হারানো চোখে সন্ধানে ।
রক্তলাল সেই চোখ যারা যারা এদের দেখেছে তারা কেউই নাকি খুব বেশি দিন বাঁচে নি । রাইনাল এসব কিছু বিশ্বাস করে না । ওর শিকারের জন্য এদিকেই ফাঁদ পেতে রাখে । ফরেস্ট অফিসারেরা এদিকে খুব একটা আসে না তাই ফাঁদ গুলো হারায় না । অন্যান্য পোচারদের ফাঁদ গুলো প্রায়ই হারিয়ে যায় ।
রাইনাল শেখ আরও একটু এগিয়ে গেল । প্রতি পদক্ষেপের সাথে সাথেই আলোর তীব্রতা বাড়ছে । আলোর উৎসের দিকে এগিয়ে চলছে সে । তবে তার মন বলছে এখনই এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ । কিন্তু তীব্র এক কৌতুহল তাকে পেছনে চলে যেতে দিল না । আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতেই একটা তীক্ষ চিৎকার শুনে রাইনাল শেখের বুকটা কেঁপে উঠলো ।
চিৎকার টা শোনার সাথে সাথেই যে কথাটা সবার আগে মনে পড়লো সেটা হল হল “উলডা” । রাইনাল শেখের দাদার মুখেও সে এই প্রাণীর কথা শুনেছে । কেউ নাকি কোন দিন এই জন্তুকে দেখে বেঁচে থাকতে পারে না । কেউ কেউ সাথে সাথেই মারা যায় আবার কেউ কেউ কয়েক দিনের ভেতরে । যারা সুন্দরবনের ভেতরে চলাচল করে তাদের অনেকেই কেবল চিৎকারই শুনেছে । যারা দাবী করেছে তারা দেখেছে নিজের চোখে তারা খুব বেশি দিন বাঁচে নি । মারা গেছে কয়েক দিনের মাঝে ।
রাইনাল শেখ স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো । একট আগের কৌতুল তার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে । এখন সেখানে তীব্র এক ভয় এসে বাসা বেঁধেছে । রাইনাল শেখ চাইছে এখনই এখন থেকে চলে যেতে কিন্তু পারছে না । তার পা যেন নরম মাটিতে আটকে গেছে । কেউ যেন তাকে আটকে ফেলেছে ।
আরও কয়েক মুহুর্ত পরে রাইনাল শেখ তাকে দেখতে পেল । চারিপাশে আলো যেন আরও একটু বৃদ্ধি পেয়েছে । আরও যেন স্পষ্ট হয়েছে চারিদিকে দৃশ্য তবে এই গভীর রাতে সেই আলো কোথা থেকে আসছে রাইনাল শেখ সেটা বুঝতে পারলো না । যখন সে দৌড়াতে যাবে তখনই তার চোখের কোনে কিছু একটা ধরা দিল । সামনের বড় গাছটার আড়াল থেকে মেয়েটি বের হয়ে এল । ঠিক তার পেছন পেছন কালো চিতার মত দেখতে একটা অদ্ভুদ জন্তু ।
মেয়েটির পুরো শরীরের দিকে চোখ বুলালো তীব্র আতংঙ্ক নিয়ে । পরনে তার কোন পোষাক নেই, এদিক ওদিকে বনের লতাপাতা কিছু লেগে আছে । তীব্র আলোতে শরীরের রংটা রাইনাল শেখ ধরতে পারলো না । মেদহীন আকর্ষনীয় শরীর মেয়েটার তবে রাইনাল শেখের সেদিকে কোন লক্ষ্য নেই । তার চোখ কেবল মেয়েটার মুখের দিকে। মেয়েটার চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে । সেই আগুনে সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে যায় । মুখের তীব্র হিংস্রতার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় ।
এরই মাঝে পাশের প্রাণীটা আবারও ডেকে উঠলো । রাইনাল শেখের বুকটা আবারও কেঁপে উঠলো । জন্তুটার দিকে তাকিয়ে দেখে রাইনাল শেখের ভয় যেন আরও একটু বেড়ে গেল । চিতার যেমন মুখের সামনে দুটো চোখ থাকে এই প্রাণীটার সেরকম কিছু নেই । তার বদলে ঠিক মাঝ বরাবর চোখে কোটর । তবে সেখানে এখন কেবল গাঢ় শূন্যতা দেখা যাচ্ছে যা প্রাণীটাকে আরও ভয়ংকর করে তুলেছে ।
রাইনাল শেখ আর থাকতে পারলো না । তীব্র একটা চিৎকার দিয়ে পেছন ঘুরে দৌড়াতে লাগলো । কোন দিকে যাচ্ছে বনের আরও গভীরে যাচ্ছে নাকি বাইরের দিকে যাচ্ছে সেদিকে তার কোন লক্ষ্যই রইলো না । তার কেবল মনে হতে লাগলো তাকে দৌড়াতে হবে । এই মেয়ে আর সাথেই ভয়ংকর প্রাণীটা থেকে দুরে যেতে হবে !
রাইনাল শেখ দৌড়াতে থাকে !
ট্রলারের ইঞ্জিনটা এক ভাবে আওয়াজ করেই চলেছে । অন্যান্য ট্রলারের মত ভটভট করে নয়, মৃদ্যু ভাবে । সাধারন কোন মাছ ধরা কিংবা গোলপাতা বহনকারী কোন ট্রলার নয়, বিশেষ ভাবে অভিজানের জন্য তৈরি করা ট্রলার । তবুও এই নির্জন বনে আওয়াজটা বেশ ভাল ভাবেই শোনা যাচ্ছে ।
ট্রলারের উপরে একটা শক্তিশালী ফ্লাশ লাইট জ্বালছে । ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে ! কোন কিছু খুজছে । তন্বী ভাল করেই জানে ওরা যার খোজে এসেছে তাকে এই ফ্ল্যাশ লাইটের আলোতে কিছুতেই খুজে পাওয়া যাবে না।
-লাইট টা বন্ধ করে দিন !
তন্বী চিৎকার করে বলল ছাদের বসা লোকটাকে । লোকটার নাম তন্বীর জানা নেই । কেবল জানে লোকটা সারা দিন পান চিবায় । ঠোঁট মেয়েদের মত লাল হয়ে থাকে সব সময় ! লাইটটা নিভে এল ।
আর ঠিক তখনই গর্জন টা শোনা গেল ।
খুব যেন কাছেই !
সুন্দর বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আওয়াজ । আজ কদিন থেকেই তন্বী আওয়াজটা শুনে আসছে । রাত হলেই এই আওয়াজটা শোনা যায় মাঝে মাঝে । রাত হলেই রাজা মশাই বাইরে বের হন ।
প্রথম যেদিন শুনে ছিলো ভয়ে ওর আত্মা যেন দেহ থেকে আলাদা হয়ে গেছিলো, এমন ভাবে কবে চমকে ছিলো তন্বী নিজেই জানে না । দেশে বিদেশের অনেক চিরিয়াখানাতেই ওর যাওয়া হয়েছে । সেখানে অনেক প্রকার বাঘও দেখেছে, তাদের গর্জনও শুনেছে কিন্তু সেই গর্জনের সাথে এই গর্জনের কোন মিল নেই, এই গর্জনের তুলনা হয় না । এখনও তন্বীর বুকের মাঝে কেমন একটা কাঁপন শুরু হয় । তবে ও সেটা খুব জলদিই সামলে নিতেও শিখে গেছে এই কদিনে ।
তাকিয়ে দেখে আবারও লাইট জ্বলে ওঠেছে । জামসেদ আলী এগিয়ে এসে বলল
-আফা জ্বালান থাকুক । তাইলে মামা কাছে আইবো না । আন্ধার থাকলে ফাল দিয়া ট্রলারে উঠতে পারে ।
তন্বী জানে মামা বলতে জামসেদ আলী কাকে বুঝিয়েছে । এই কদিনে সুন্দরবনের অনেক কিছুই সে জানে । যেমন বনের ভেতরে সুন্দরবেনর লোকজন কখনও বাঘ শব্দটা উচ্চারন করে না । মামা বলে । তন্বী বলল
-পাড় থেকে এতো দুর লাফ ফিয়ে আসতে পারবে ?
-কন কি আফা ! এই পাড় থেকে ঐ পাড়ে চইলা যাইতে পারবো !
তন্বী কিছু বলতে গিয়েও বলল না । খালটা আসলেই খুব বেশি চওড়া নয় তবুও একটা অবাক না হয়ে পারলো না!
জামসেদ আলী এই বনেরই মানুষ । ফরেস্ট অফিসারের লোক ছিল আগে । যদিও এখন অবসর নিয়েছে তবে মাঝে মাঝে সুন্দরবনের ঘুরতে আসা মানুষদেরকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ করে থাকে । তার সাথে আরও বেশ কিছু লোক আছে । সবাইকেই ভাড়া করা হয়েছে । ওদের জন্য আরও একটা লঞ্চ দাড়িয়ে আছে আরও কিছুটা দুরে । বনের ভেতরে লঞ্চ নিয়ে আসা সম্ভব না তাই রাতে যখন ওরা বের হয় তখন ট্রলার নিয়ে বের হয় ।
তন্বী একভাবে বনের দিকে তাকিয়ে আছে । কদিন থেকেই এই ব্যাপারটা ওকে অদ্ভুদ ভাবে টানছে । রাত হলেও গাঢ় অন্ধকারের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে । মনে হচ্ছে এই বনের ভেতরেই এমন কিছু আছে যার জন্যই এতো দুরে আসা । এভাবে বনের ভেতরে ঘুরে বেরানো । ওর দুচোখ কেবল খুজতে থাকে সেই প্রাণীটাকে । কানটা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাক অদ্ভুদ কিছু শোনার জন্য । যখন কোন আওয়াজ শুনে চট করে তাকায় জামসেদ আলীর দিকে । বোঝার চেষ্টা করে আওয়াজটা সামসেদ আলীর পরিচিত কি না । তন্বীর কাছে তো সবই অপরিচিত আওয়াজ !
তন্বী পেছনে রাফায়েল এসে দাড়ালো । ট্রলারের গতি ততক্ষনে থেমে কমে এসেছে । রাফায়েলের দিকে না তাকিয়েই তন্বী বলল
-কেন জানি দিন দিন হতাশ হয়ে যাচ্ছি !
রাফায়েল বলল
-কেন ?
-আর কবে ? আজকে নিয়ে ৮ দিন আমরা এরকম বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছি । যে জিনিসটার খোজে এসেছি তার দেখা পাওয়া তো দুরের কথা টিকি টাও দেখতে পারি নি । এমন কি সেই অদ্ভুদ আলোরও খোজ পাই নি । আদৌও কি পাবো?
রাফায়েল বলল
-তোমার মন কি বলছে? পাবো আমরা?
-আমাকে যে পারতেই হবে ।
-তাহলে আমাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই । যে কাজে এসেছি সেই কাজের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেতে হবে !
-আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন ? না মানে এভাবে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়ানো উদ্দেশ্যহীন ভাবে !
-উদ্দেশ্যহীন ভাবে তো নয় । আমাদের তো একটা উদ্দেশ্য আছে । আছে না ?
তন্বী কিছু না বলে রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে রইলো । সেখানে একটা আস্থা রাখার ছায়া খুজে পেল । আসলেই ওর সাথে যদি আজকে রাফায়েল না আসতো তাহলে এতো দুরে কি আসতে সাহস পেত ? যে মানুষটার উপর এতো ভরশা ছিল সেই মানুষটাই ওর সাহায্যের সময় পাশে পায় নি । এমন কি একটাবার পেছন ফিরেও তাকায় নি । অন্য দিকে যে মানুষটাকে ঠিক মত চিনেও না সেই মানুষটা ওর সব ঝামেলা নিজের করে নিয়ে ওর পাশ দাড়িয়ে আছে ।
ট্রলারটা একেবারে থেমে গেছে । কিনারের একটা গাছের সাথে আটকে বেঁধে রাখা হয়েছে ট্রলারটাকে । সবাই নিচে নামার জন্য প্রস্তুত । ট্রলারে থাকবে দুজন পাহারের জন্য । আর তন্বীদের সাথে যাবে মোট ৫ জন । সামনে দুজন থাকবে । পেছনে দুজন । আর একজনের হাতে থাকবে ব্যাগটা । এই ব্যাগের জিনিসটা ফেরৎ দেওয়ার জন্যই তন্বী আজকে এতো দুর এসেছে ।
এখন মাঝে মাঝে নিজের কাছেই অবাস্তব লাগে ওর । ওর কোন দিনই এসবে বিশ্বাস করতো না । কিন্তু যখন ঘটনা ওর বাবার সাথেই হল আর পরিবারের ইতিহাস ও জানতে শুরু করলো তখন ওর মাথায় আর কিছু আসে নি । ওর কেবল নিজের বাবাকে বাঁচানোর কথাই মাথায় এসেছে । যেটা ওর কাছে সঠিক মনে হয়েছে সেদিকেই পা বাড়িয়েছে। কারো কথা শোনে নি ।
এমন কি বিছানায় পড়ে থাকা ওর বাবারও প্রবল আপত্তি ছিল এই অভিযানে আসার ব্যাপারে । কোন আপত্তিই তন্বীকে আটকে রাখতে পারে নি । কিন্তু যখন শাহেদ ওকে ফিরিয়ে দিল তখন তন্বী কিছু দিশেহারা বোধ করছিলো । তন্বীর আশা ছিল আর কেউ ওর পাশে না থাকলেও শাহেদ ঠিক ঠিকই ওর পাশে থাকবে । কিন্তু সব কিছু শোনার পর শাহেদ অদ্ভুদ ভাবেই না করে দিল !
তখন বারবার মনে হচ্ছিলো ও কি আসলেই পারবে নাকি পারবে ? একা একা ওর পক্ষে কি সম্ভব । কিন্তু আজকে ৮ টা দিন ঠিক ঠিক কাটিয়ে দিল এই অজানা পরিবেশে । এখনও সামনে কতদিন কাটাতে হবে তন্বীর তা জানা নেই ।
তন্বীর বাবা রাকিবুদ্দিন আহমেদ বিয়ের করেছিলে একদম অল্প বয়সে । রাকিবুদ্দিন আহমেদের বয়স যখন মাত্র ১৯ বছয় তখনই তন্বীর জন্ম হয় । এতো জলদি বিয়ে করারটা কেবল তন্বীর বাবার ভেতরেই না বরং ওদের বংশের সব পুরুষের মধ্যেই রয়েছে । তন্বীর দাদা বিয়ে করেছিলেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে । এই দিক দিয়ে তন্বীর দাদার বাবা ছিলেন সবার থেকে এগিয়ে । তিনি বিয়ে করেছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে ।
সবার ভেতরেই বিয়ে করার একটা তাড়াহুড়া ছিল। এর পেছনে আরও একটা কারন ছিল । তন্বীদের পরিবারে কোন ছেলে খুব বেশি দিন বাঁচে নি । সবার বয়স ৪০ পার হতে না হতেই সবাই মারা পড়েছে । এবং সবার মারা গেছে একই ভাবে । মারা পরার ধরনটাও একেবারে অন্য রকম । সব কয়জনের বেলাতে যে জিনিস টা ঘটেছে সেটা হল ঘুমের ভেতরে চিৎকার করে ওঠে । স্বপ্নে অদ্ভুদ দর্শন এক প্রাণী তার পায়ে কামড় দিয়ে ধরেছে । প্রাণীটার কোন চোখ নেই। মুখটা অনেকটাই বাঘ আর কুমিরের সংমিশ্রন । মুখটা একটু লম্বা এবং সামনে তিনটা বড় বড় দাঁত । দুই চোখের জায়গায় কেবল একটা ফাঁকা স্থান । দেখে মনে হয় যেন ওখানে প্রাণীর চোখ ছিল । কেউ তুলে নিয়েছে ।
সেই স্বপ্ন থেকে জেগে উঠতেই সবার পায়ে একটা কাঁমতের দাগ দেখা যেত । তিনটা বড় বড় দাঁতের ছাপ স্পষ্ট । তারপর সপ্তাহ খানেকের ভেতরেই সেখানে পঁচন শুরু এবং সেই পঁচন সারা শরীরে পৌছাতে পৌছাতে আরও মাস খানেক । পরের মাসের ভেতরেই সে মারা যেত । তন্বীদের পরিবারের সবাই ঠিক এই ভাবেই মারা গেছে । অর্থ্যাৎ স্বপ্নে সেই প্রাণীটার কামড় খাওয়ার ঠিক দুই মাসের মধ্যেই মারা যেত সেই পুরুষটি । সবাই ঠিক এভাবেই মারা গেছে।
এখনও পর্যন্ত তন্বীর বাবা রাকিবুদ্দিন আহমেদ সবার থেকে বেশি বছর বেঁচে আছে । বর্তমানে তার বয়স ৪১ বছর । এবং তিনি নিজেও মৃত্য পথযাত্রী । গত সপ্তাহে তিনি সেই প্রাণীটিকে স্বপ্নে দেখেছেন এবং স্বপ্নের ভেতরেই সেই প্রাণীটির কামড় খেয়েছেন !
তন্বী জানতো ওকে কি করতে হবে । কিন্তু এতোদিন ওর বাবার কারনেই ও কিছু করতে পারে নি । সেই অভিশপ্ত চোখটাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ও অনেকবারই ওর বাবাকে বলেছে কিন্তু ওর বাবা সেটা কানে তুলেন নি । তিনি যে বিশ্বাস করতেন না তেমন কিছু না তবে সেই চোখটা ফেরৎ দেওয়ার কোন উপায় তার জানা ছিল না । তিনি সেটা চাইতেনও না ।
কিন্তু যখন সেই অভিশাপটা সত্যি হতে চলল তখনও তন্বী আর কিছুতেই কারো কথা শুনতে রাজি হল না ! আর ওর বাবারও সেই অবস্থা ছিল না যে ওকে বাঁধা দিবে। তন্বী ওর বাবাকে কথাটা বলতেই বাবা কেবল চিৎকার করে উঠলো । বলল
-তুমি কি বুঝতে পারছো কি বলছো ?
-খুব ভাল করে ।
-না । তুমি বুঝতে পারছো না । এর সাথে কেবল আমাদের পরিবারের অভিশাপই, আমাদের সৌভাগ্যও জড়িত।
কিছু সময় তন্বীর বাবা চুপ করে রইলো । কিছু যেন মনে করার চেষ্টা করছে ।
তন্বী বলল
-বাবা প্রতিবার ঐ প্রাণীটা তার চোখটা নিতে আসে । তোমরা কেন বোঝ না । বড় দাদীর কাছে শুনেছি বড় দাদা কিভাবে কষ্ট পেয়ে মরেছে । তবুও সেটা দিতে ফেরৎ দিতে দেয় নি । তারপর দাদা এরপর তুমিও ঠিক একই ভাবে আচরন করছো । কি দরকার এতো টাকা পয়সার । কোন দরকার নেই ।
তন্বী কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল
-বাবা, আমার কিছুই দরকার নেই । তুমি বীহিন আমার কিছু দরকার নেই । যে টাকা পয়সা আমার বাবাকে আমার কাছ থেকে দুরে নিয়ে যায় সেই টাকা পয়সা সেই সৌভাগ্য আমার দরকার নেই ।
তন্বীর মুখে কথাটা শুনে রাকিবুদ্দিন আহমেদ একটু শান্ত হয়ে এলেন । মেয়েকে কাছে ডেকে একটু এদর করে দিলেন ! তন্বী বলল
-আর এটার মালিক তো একদিন আমি হবই তাই না ? সো আমি ঠিক করবো এটা দিয়ে আমি কি করবো । এভাবেই তো বংশ পরাম্পরায় এটা তোমার কাছে এসেছে । তারপর তোমার মাধ্যমে আমার কাছে আসবে ! তাই না ?
রাকিবুদ্দিন আহমেদ মেয়ের দিকে তাকালেন । তার এতোটুকু পিচ্চি কিভাবে কথা বলছে, ভাবতেই পারছেন না তিনি। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন যে মেয়ে সেটা ভাবছে সেটা করবেই । তিনি বাঁধা দিতে পারবে না।
তন্বীও মুখে আর কিছু না বললেও মনে মনে ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল । যা ভেবেছে সেটা সে করবেই । তাকে তা করতেই হবে । তন্বী কার কাছে যাবে সেটাও ঠিক করে ফেলল । এই বিপদে শাহেদ তাকে ফিরিয়ে দিবে না নিশ্চয়ই !
জামসেদ আলী ট্রলার থেকে নামলো সবার আগে । তার পেছনে আরও দুজন । এরপর রাফায়েল তারপর তন্বী। খানিকটা পানিতেই পা ফেলতে হয়েছে । কাঁদায় পা একটু ডেবে ডেবে যাচ্ছে । দু সপ্তাহ আগে এমন একটা ব্যাপার তন্বী কল্পনাও করতে পারতো না আর আজ কদিন থেকে কি চমৎকার ভাবেই পানি মাটি কাদায় মাখামাখি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।
তন্বীর পায়ে বড় গাম বুট পরা । জিন্সের প্যান্ট টা একেবারে ভেতরে ঘুকে গেছে বুটে । নিরাপত্তার জন্য ওদিক দিয়ে একটু টেপ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে । কোন ভাবেই যেন জোক ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে ।
চারিদিকে বনের নিরবতা । তবে ট্রলার থেকে যতটা নিচ্ছুপ মনে হচ্ছিলো বনের ভেতরে ততটা নিশ্চুপ নয় । একটা মিহি আওয়াজ চলছে। নাম জানা কোন পোকার দল যেন ডেকেই চলেছে । তন্বী এর আগেও ঝিঝি পোকার ডাক শুনেছে । এই ডাকটা ঐ রকম নয় । কিছুটা ভিন্নতা আছে ।
তন্বী পেছনে তাকিয়ে দেখে গার্ডদের দুজন কেমন নিজেদের ভেতরে ফিসফাস করছে । তন্বী জামসেদ আলীর দিকে তাকিয়ে বলল
-কোন সমস্যা ?
রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেও চুপ করে এদিকে তাকিয়ে আছে । চুপ করে কি যেন ভাবছে । কিছু যেন বোঝার চেষ্টা করছে ।
তন্বী এই মানুষটাকে ঠিক বুঝতে পারছে না ।
যখন প্রথমবার দেখেছিলো তখনও বুঝতে পারে নি সে আসলে কেমন প্রকৃতির মানুষ !
জামসেদ আলীর হাতে শক্তি শালী টর্চ জ্বলছে । অন্যান্য দিনের মত আজকেও সেই সবার সামনে থাকবে । বাকি দলটা তাকে অনুসরন করবে ! এমন ভাবেই প্রতিদিনের অভিযান চলে । খুজে চলা হয় সেই অজানা প্রাণীটার ।
তন্বী আর রাফায়েল, দুজনের কাছেই জিপিএস ট্রাকার আছে । খুব সহজেই ওরা সামনে এগোতে পারবে এবং একই ভাবে ফিরে আসতে পারবে তবে বন জঙ্গলের কথা বলা যায় না । কেবল মাত্র মেশিনের উপর ভরশা করাটা বোকামী হবে । তাই অভিযান দলের প্রধান একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি, জানসেদ আলী ।
জামসেদ আলী বলল
-ওরা আসলে খুব কাছেই বাঘের ডাক শুনেছে । তাই একটু ভয় ভয় পাচ্ছে ।
একটু আগে ডেকে ওঠা বাঘের কথাই ওরা বলছে । বাঘের ডাকটা আসলেই খুব কাছে ছিল । মনে হচ্ছিলো যেন বাঘটা এক বারে হাত দুরুত্ব রয়েছে । ডাকার সময় তন্বী নিজের শরীরের ভেতরেই সেটা অনুভব করতে পারছিল।
রাফায়েল বলল
-তাহলে কি করতে চান ?
জামসেদ আলী কিছু বলার আগেই তন্বী বলল
-ওরা না যেতে চাইলে না যাক । আমরা গত ৮ দিন থেকে এই বনের ভেতরে খোজ চালিয়ে যাচ্ছি । ওদের ছাড়া কোন সমস্যা হবে না । এখানে আসলে তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না আর হবে বলেই মনে হয় না ! ওদের কে ট্রলারে থাকতে বলুন ।
একটা মেয়ে তাও আবার শহুরে মেয়ে এতোটা সাহস দেখাচ্ছে অন্য দিকে ওরা এই বনের ভেতরে থেকে যেতে ভয় পাচ্ছে এই ব্যাপারটা মনে হয় ওদের গায়ে বেঁধে গেল । গার্ড দুজন আর কথা বলল না । ওদের কে রেখে সামনে এগিয়ে গেল ওরা । যেন একটু আগে কিছুই হয় নি এমন একটা ভাব ।
গত দিন গুলোর মত আজও তন্বীদের অভিযান শুরু হল । নির্জন বনের ভেতর দিয়ে প্রথম যেদিন চলছিলো তন্বীর প্রতিটা ধাপে ধাপে মনে হচ্ছিলো এই মনে হয় কিছু একটা ওকে কামড় দিবে । এই বুঝি বাঘ চলে আসলো । কাছে দুরে মাঝে মাঝেই ডাক ভেসে আসতো আর তন্বী বারবারই লাফিয়ে উঠতো । তবে সেটা এখনও অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে ।
ঘন্টা দুয়েক চলার পরেই ওদের থামলো । লাইট জ্বালিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো জামসেদ আলী । কিছু যেন ঠিক বুঝতে পরেছে। আরও ভাল করে বললে তার অভিজ্ঞ মন বলছে কিছু একটা ঠিক নেই । রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে দেখে ও যেন কিছু একটা টের পেয়েছে । হাতের বড় রাইফেলটা শক্ত করে ধরে রেখেছে ।
তন্বী লক্ষ্য করলো যে শব্দটা একটু আগেও ছিল সেটা একদম নেই । একেবারে যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে । কিছু একটা বিপদ ঘটতে চলেছে । তন্বী পকেট থেকে ছোট রিভলবার টা বের করে আনলো ।আনলক করে অপেক্ষা করতে লাগলো কি আসে তার জন্য ।
তন্বীকে মোটামুটি মাঝখানে রেখে বাকি ছয়জন বৃত্তাকারে বন্দুক উঠিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ।
চারিদিকে ঘুরঘুটে অন্ধকার । কেবল মাত্র ফ্লাশ লাইটের আলো যেদিকে যাচ্ছে সেটার কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে তবে পুরো বনটুকুর প্রায় সব টুকুই অন্ধকার হয়েই রয়েছে ।
ডান দিকে একটু খুট করে আওয়াজ হল । মনে হল যেন কারো পায়ে চাপ পরে কোন ডাল যেন ভাঙ্গলো । সাথে সাথেই সবার বন্ধুকের নল সেদিকে ঘুরে গেল । গুলি করতে সবাই প্রস্তুত । কয়েক মুহুর্ত কোন কিছুই ঘটলো না । ওরা বন্দুক তাক করে রইলো ।
যখন মনে হল কিছু নেই ওদিকে, ঠিক তখনই সে সামনে এল ! রাজকীয় ভঙ্গিতে সামনে এসে হাজির !
তন্বী নিজের এই প্রথম এমন কিছু দেখতে পেল । ফ্লাশ লাইটের আলোতে ক্ষণিকের জন্যই দেখতে পেল ডোরা কাটা প্রানীটাকে । স্বচোক্ষে এতো বড় বাঘ সে আরও আগে দেখেছে কি না সে জানে না । তবে কয়েক সেকেন্ডের জন্য । বাঘ মামা ঝোপ থেকে এক লাফে ওদের সামনে চলে এল । ওর সবাই এতোই অবাক হয়ে গেল যে বন্দুক তুলে গুলি করতেও ভুলে গেল । তারপর ঠিক যেভাবে এসেছিলো সেই ভাবেই একজন গার্ডদের ঘাড় কামড়ে নিমিষের ভেতরেই গায়েব হয়ে অন্য পাশে ।
বাঘটা চলে যেতেই যেন সবার টনক নড়লো । কয়েকবার বন্ধুকের গুলি চলল কিন্তু আর কারো কোন হদিস পাওয়া গেল না, না বাঘের না, সেই গার্ডের ।
তন্বী কেবল বিমূঢ় হয়ে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো ঝোপটার দিকে । কি হল যেন এখনও ঠিক মত বুঝতে পারছে না । চোখের সামনে একজনের মৃত্যু যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ।
তন্বীকে কেবল একভাবে তাকিয়ে রইলো শাহেদের দিকে ।
-তুমি কি বলছো এসব ?
শাহেদ খুব স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল
-ঠিকই বলছি ।
-কিন্তু তুমি ?
-তুমি যা আমাকে করতে বলছো সেটা স্রেফ পাগলামী ! আর কিছু না । এসবে আমি বিশ্বাস করি না ।
-কিন্তু …… মাই ড্যাড ইজ ডাইয়িং । তুমি দেখেছো । দেখো নি ?
তন্বী তাকিয়ে দেখলো শাহেদ ওর দিকে ঠিক তাকাচ্ছে না । কিছু যেন লুকোচ্ছে ! ওর দিকে আরেকবার চোখ পড়তেই তন্বী চট করেই ব্যাপারটা ধরে ফেলল । তারপর বলল
-তুমি ভয় পেয়েছো তাই না ?
-মানে ? কিসের ভয় ?
-এই যে আমার পরিবারের সাথে যুক্ত হলে আমাকে বিয়ে করলে আমার বাবার মত তুমিও মারা যাবে তাই ?
শাহেদ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে তারপর বলল
-হ্যা ! আমি ভয় পাচ্ছি ! এই আধুনিক যুগে এসে আমি এসব বিশ্বাস করি না কিন্তু না করে পারছিও না । আমি এতো জলদি মরতে চাই না কোন ভাবেই ।
-ভয় পেও না । তুমি মরবে না । তুমি আমাদের রক্তের কেউ নও । মরলে আমি মরবো । ঐ প্রানীটার সাথে আমাদের পরিবারের সমস্যা তোমার নয় !
-বলা যায় ? তোমার পরিবারের পুরুষেরা মরছে । আমি তোমাকে বিয়ে করলে তোমার পরিবারের পুরুষ হব আমি । তুমি না । তাই আমি রিস্ক নিতে চাই না ।
তন্বী কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । শাহেদের উপর রাগ হওয়ার উচিৎ কিন্তু ওর নিজের উপর রাগচচ্ছে । রাগ হচ্ছে এমন একজনকে ও ভালবেসেছিলো যে কি ওর বিপদের সময় এগিয়ে না এসে বরং ওকে ফেলে চলে যাচ্ছে । তন্বী বলল
-তাহলে তো হয়েই গেল । ভাল থাকো !
তন্বী চলে এসেছে আর ফিরে যায় নি ওর কাছে । মনের ভেতরে একটা সুক্ষ আশা ছিল যে শাহেদ হয়তো ওর কাছে ফিরে আসবে তবে সেটা আর হয় নি । শাহেদ আর আসে নি । তখন থেকেই তন্বীর মাথায় কেবল একটা চিন্তাই কাজ করছে যে শাহেদ যদি না যায় ওর সাথে তাহলে ও কি পারবে একা একা এতো দুর যেতে । শাহেদের ভরশাতেই ছিল । ও পাশে থাকলে কাজটা হয়তো আরও সহজ হয়ে যেত আরও বুকে আরও শক্তি পেত । কিন্তু এখন ?
তন্বী জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে দুর করে দিল । ওর নিজের বাবা তাই কেউ আসুক কিংবা না আসুক কাজটা ওকেই করতে হবে । দরকার হলে একাই করতে হবে । তবুও তন্বীর মনটা খারাপ হয়েই রইলো । যাওয়ার সব ব্যবস্থা প্রায় হয়ে গেছে । লঞ্চ ট্রলার সব ঠিক করা হয়ে গেছে । ঠিক এই সময়ে শাহেদ মানা করে দিল।
তাবুর ফাঁক গলে বিকেলের মরা রোদ এসে গায়ে পড়ছে । তন্বী চোখ মেলে কিছুটা সময় তাকিয়েই রইলো বাইরে দিকে । কেমন বিষণ্ণ লাগছে নিজের কাছে । বনের নানা জায়গা থেকে নানা শব্দ ভেসে আসছে । চারিদিকে নিস্তব্ধ হয়েও যেন নিশ্চুপ নয় । বনের এই ব্যাপারটা তন্বী ইদানিং খুব ভাল লাগছে । কদিন আগেও এই পরিবেশ টা ওর ঠিক সহ্য হত না কিন্তু এখন মানিয়ে নিয়েছে । প্রথমবার যখ জঙ্গলে এসেছিলো তখন এই ব্যাপারটা মোটেই সহ্য হত না । এতো নিস্তব্ধতা ভাল লাগতো না । তারপর জামসেদ আলী ওকে আরও গভীর ভাবের মনযোগ দিতে বলেছে । বন কখন নিশ্চুপ নয়, এর একটা নিজেস্ব ভাষা আছে আছে নিজের কিছু আওয়াজ । তন্বী নিজ থেকেই সেই আওয়াজ খুলো খোজার চেষ্টায় করে এসেছে । প্রথম প্রথম না পা পারলেও পরে ঠিক পরে ঠিক ঠিক সেগুলো টের পাওয়া শুরু করেছে । এর জন্য কেবল দরকার একটা সুস্থির মন ।
তবে গত কালকের ঘটনার পর থেকেই তন্বীর মন স্থির নেই । কিভাবে চোখের সামনে একটা মানুষকে ধরে নিয়ে গেল। জামসেদ আলীকে কাল রাতেই বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিলো । এমন আচরন স্বাধারনত মামারা করে না । এই বাঘটা কেন করলো সেটা বুঝতে পারলো না । তবে তার থেকে বেশি চিন্তা করছে তন্বী নিজে । কেবল এক পলকের জন্য গতকাল রাতে বাঘটার সাথে ওর চোখাচোখী হয়েছিল । অন্যেরা কি দেখেছে সেটা তন্বী জানে না তবে তন্বীর বাঘের চোখ দুটো মোটেই স্বাভবিক লাগে নি ।
রাতের অন্ধকারে যেন চোখ দুটো ওকে কিছু বলার চেষ্টা করছে । কিছু যেন সাবধান করার চেষ্টা করছে ।
রাফায়েল একটু দুরে বসে কি যেন ভাবছে । ছেলেটার দিকে তাকিয়ে তন্বী কি সব ভাবতে লাগলো । ছেলেটা ওর কিছুই হয় না । অথচ ওর জন্য এতো দুরে চলে এসেছে । এমন না যে অন্যেরা যেমন এসেছে টাকার জন্য রাফায়েলও এসেছে টাকার জন্য সে কিছুই বলে নি । কেবল বলেছে সে আসবে । তার নিজেরই নাকি দরকার আছে । কি দরকার আছে সেটা অবশ্য তন্বী জানতে চায় নি । অবশ্য সে যে লাইনের লোক তার দরকার থাকতেই পারে ।
জামসেদ আলীকে আসতে দেখে তন্বী উঠে বসলো । গত কালকের ঘটনার পর থেকে সবাই কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। কাছে আসতেই জামসেদ আলী বলল
-আফা একটা সমস্যা হইছে ?
-কি সমস্যা ?
-ওরা আর কেউ বনের ভেতরে যাইতে চাইতেছে না । কাইকার ঘটনায় ডরাইছে ।
তন্বী নিজেই এমন কিছু ভাবছিলো । সে বলল
-ওদের আজ থেকে যেতেও হবে না ।
জামসেদ আলীকে খানিকটা অবাক হতে দেখা গেল । সে তন্বীর কাছ থেকে এই কথা আশা করে নি । তন্বী বলল
-আমি চাই না আমার কারনে আর কারো প্রাণ যাক । আপনি ঐ ছেলেটার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করবেন এখান থেকে যাওয়ার পর । এখন থেকে তার পরিবারের সব দায়িত্ব আমার । তবুও ক্ষতিপূরন হবে না আমি জানি ! আর আজকের পর থেকে কেবল আমি যাবো । আপনি যদি যেতে না চান আপনাকেও যেতে হবে না । আমার কাছে জিপিএস ট্রাকার আছে । আমি পথ হারাবো না । সবাই ট্রলারেই থাকবে ! ট্রলারে থাকতে তো কারো সমস্যা নেই, নাকি ?
-না তা নাই ।
-তাহলে তাই রইলো !
জামসেদ আলী হাসল খানিকটা । বলল
-আপনে আপনি খুব জেদী আছেন ! চিন্তা কইরেন না আমি আছি আপনের সাথে । আর ঐ ভাইজানও যাইবো আমি নিশ্চিত !
জামসেদ আলী রাফায়েলের দিকে ইঙ্গিত করলো । তন্বী ফিরে তাকালো রাফায়েলের দিকে । ছেলেটা এখন ছোট খালের পানিতে পা নামিয়ে কি যেন করছে । রাফায়েল যে ওর সাথে থাকবে সেটা তন্বীও জানে । ছেলেটার মধ্যে অদ্ভুদ কিছু আছে । কিন্তু কি আছে সেটা ও এখনও ধরতে পারে নি । প্রথম দিন দেখা হওয়ার মতই সে এখনও রহস্যময়ই রয়ে গেছে ।
বাবার দিকে কিছুটা তাকিয়ে থেকেই তন্বীর কান্না চলে এল। দিনদিন তার অবস্থা খারাপের দিকেই যাচ্ছে। ওর হাতে আর বড় জোড় মাস খানেক সময় আছে। এর ভেতরেই ওকে যা করার করতে হবে। ঐ চোখটাকে ফেরৎ দিতে হবে আসল মালিকের কাছে। তাহলেই হয়তো অসুখটা সেরে যাবে। হয়তো অভিশাপ থেকে ওদের পরিবার মুক্তি পাবে। সব কিছু নির্ভর করছে চোখটা ফেরৎ দেওয়া নিয়ে। কিন্তু ও পারবে তো সেটা করতে? যদি না পারে তাহলে বাবাকে হারাতে হবে চিরো দিনের জন্য।
রাকিবুদ্দিন আহমেদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলিলেন
-শাহেদের কি খবর?
তন্বী শান্ত কন্ঠে বলল
-ভাল।
-সত্যি ভাল?
তন্বী বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর মনে হল ওর বাবা সব কিছু জানেন। তার ধারনাকেই সত্যি প্রমান করে দিয়ে রাকিবুদ্দিন বললেন
-তুই কি আরেকবার ভেবে দেখবি? শাহেদ যদি না যায় তোর সাথে তাহলে তুই একা একা……
তন্বী উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল
-আমি যাবোই এবং একাই যাবো। আমার কারো সাহায্য দরকার নেই।
রাকিবুদ্দিন আহমেদ নরম কন্ঠে বললেন
-মারে, তুই যেখানে যেতে চাইছিস সেখানে একা একা তুই যাবি কিভাবে?
তন্বী বলল
-আমি পারব বাবা। তুমি চিন্তা কর না।
-আচ্ছা এটা নিয়ে আমি কথা বলব না তবে তোকে আমি একা যেতে দেব না।
-ম্যানেজার সাহেব তো যাচ্ছে আমার সাথে। বাবা পুরো লঞ্চ ভাড়া করে যাচ্ছি।
-কিন্তু আসল জায়গাতে তো এরা যাবে না। যাবে?
আসল জায়গা বলতে রাকিবুদ্দিন সাহেব কোন জায়গা বুঝিয়েছে সেটা তন্বীর বুঝতে কষ্ট হল না। রাকিবুদ্দিন আহমেদ বললেন
-আজকে রাতে তোর ম্যানেজার চাচা তোকে পুরান ঢাকায় একজনের কাছে নিয়ে যাবে। এসব অলৌকিক আর অতিপ্রাকৃত বিষয়ে সে অনেক কিছু জানে। মানুষ এসব নিয়ে বিপদে পড়লে সে সাহায্যও করে। আজকে এপোয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়েছে তোর। তার সাথে গিয়ে দেখা কর।
তন্বী খানিকটা অবাক হয়ে বলল
-এরাও এপোয়েন্টমেন্ট দেয়!
রাকিবুদ্দিন বলল
-এ সবার থেকে আলাদা। আমি আগে একবার গিয়েছিলাম। আমি চিনি একে। ভরশা করার মত মানুষ। ও তোর সাথে গেলে কোন অতিপ্রাকৃত কিছু তোর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত হব।
তন্বী বলল
-এটা কে? এর কথা তো আগে কোন দিন বল নি? ভুতের ওঝা?
রকিবুদ্দিন হাসলো। বলল
-বলতে পারিস! তবে কাজের লোক।
সন্ধ্যা নামার আগেই তন্বী নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে লাগলো। সুন্দরবনে একেবারে টুপ করে অন্ধকার নামে। নিমিষের মধ্যে সব কিছু অন্ধকার হয়ে যায়।
সব জিনিস পত্র আবার ট্রলারে উঠানো হচ্ছে। আজকে দুইদিন তারা প্রধান লঞ্চে যায় নি। অবশ্য খবর পাঠানো হয়েছে। সেখানে তন্বীদের ম্যানেজার সাহেব রয়েছে। তিনি তন্বীর সাথে ট্রলারে আসতে চেয়েছিলেন তবে তন্বী বাঁধা দিয়েছে। বলেছে সবার এক সাথে বিপদে পরার দরকার নেই। আমরা যাচ্ছি যদি কোন বিপদে পড়ি তাহলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি থাকবেন। মূল লঞ্চ আর ট্রলারের মাঝে নিয়মিত যোগাযোগ থাকবে। লঞ্চ থেকে ঢাকার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে।
দেখতে দেখতে ট্রলারের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠলো। তন্বী নিজের কাধে জিনিস পত্র নিয়ে নিয়েছে। ট্রলারে ওঠার আগে শেষ বারের মত দেখে নিল কিছু ফেলে যাচ্ছে কি না। কখন যে পেছনে রাফায়েল চলে এসেছে সে লক্ষ্য করে নি। ঘুরতে ধাক্কা লেগে গেল।
-সরি।
রাফায়েল প্রতি উত্তরে কিছু বলল না। দোষটা যেন ওরই আর ওরই সরির কথা। রাফায়েল বলল
-কালকের পর তুমি একদম চুপ হয়ে গেছ।
-হওয়াটাই কি স্বাভাবিক না? আমার জন্য একটা মানুষ মারা গেল।
-তোমার জন্য না।
-হ্যা আমার জন্যই তো।
-দেখ বিপদের কথা জেনেই কিন্তু সবাই এসেছে। আর এই এলাকাতে বাঘের হামলা খুবই স্বাভাবিক। এটা সবাই জানে। নিজেকে দোষ দেওয়া বন্ধ কর।
-এটা স্বাভাবিক ছিল না। ঐ বাঘটা মানে বাঘের চোখ….. । তন্বী কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ও নিজেই পুরোপুরি নিশ্চিত ভাবে কিছু জানে না। রাফায়েলকে কি বলবে। রাফায়েল বলল
-তবে কাল রাতে কিছু একটা স্বাভাবিক হয় নি। আমি ঠিক ধরতে পারছি না। বাঘটা চাইলে তোমাকে নিয়ে যেতে পারতো, তুমিই সব থেকে কাছের আর সহজ টার্গেট ছিলে কিন্তু তোমাকে না নিয়ে রইসকে নিয়ে গেল।
তন্বী বলল
-আমাকে সাবধান করতে এসেছিল বাঘটা?
রাফায়েল ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-অথবা হুমকি দিতে! চলে যাওয়ার হুমকি?
ঠিক তখনই ট্রলারের ইঞ্জিন গর্জে উঠলো। জামসেদ আলী সবাইকে ট্রলারে উঠে পড়তে বলল। আজকে তারা আরও গভীরে যাবে। জায়গাটা ইন্ডিয়ান বর্ডারের কাছে তবে এদিকটা কোন সীমানা দেওয়া নেই। আর বেশ দুর্গমও বটে। মধু কিংবা গোলপাতা পাওয়া যায় না এদিকে তাই মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে।
তন্বী আর রাফায়েল দুজনেই ট্রলারে উঠে পড়লো। ট্রলারটা চলতে শুরু করলেই তন্বীর মনে হতে লাগলো আজকে কিছু ঘটবে। আজকে রাতে কিছু ঘটবেই। অজান্তেই ব্যাগ প্যাকের একটা নির্দিষ্ট জায়গাতে হাত চলে গেল ওর। দেখে নিল অভিশপ্ত জিনিসটা জায়গা মত আছে কি না।
কতটা সময় তন্বী বসে আছে তন্বী নিজেও জানে না । নিজের মাথার ভেতরে কেবল বাবার কথাই ঘুর পাক খাচ্ছে । শাহেদের কথাটাও বারবার ঘুরে ফিরে আসতে চাইছে । জোর করেই চিন্তা গুলো এক পাশে সরিয়ে রেখে তন্বী তাদের ম্যানেজার আলমগীর মৃধার দিকে তাকালো । লোকটা কেমন নিশ্চয় হয়ে বসে আছে । যদিও চোখ খোলা তবে তন্বীর কেন জানি মনে হল মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছে । চোখ খোলা রেখেই ঘুম দিয়েছে ।
তারা সেই রাত এগারোটা থেকে এখানে বসে আছে । আমলগীর মৃধা তাকে যেন একটু আগে আগেই এখানে নিয়ে এসেছে । তন্বীর মাথায় এটা ঢুকছে না যে কেন তারা ভেতরে যেতে পারছে না । যদি বাসার ঠিকানা জেনেই থাকবে তাহলে একটু আগে ঢুকলে সমস্যা কোথায় ?
কিন্তু আলমগীর মৃধা পরিস্কার ভাবেই বলেছে যে সময়ের এক মিনিট আগেও যাওয়া যাবে না । গেলে বিপদ হতে পারে । তিনি নিজেই জানি একবার বিপদে পড়েছিলেন । তন্বী আর কোন কথা বলল না । সামনের দিন গুলোর কথা ভাবতে লাগলো । কিভাবে কি করবে কিভাবে জিনিসটা ফেরৎ দিবে সেটা নিয়ে ভাবতে লাগলো । বারবার তার মনে কেবল একটা কথাই আসছে সেটা হল সেই প্রাণীটাকে সে খুজে পাবে তো । দেখা গেল সে সুন্দরবনের এদিক থেকে ওদিক ঘুরে বেড়ালো অথচ যেটা খুজতে বের হয়েছে তার সাথে দেখাই হল না । তখন ? হাতে ওর বেশি সময়ও নেই । ওর বাবার অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে । বড় জোর আর একমাস সে টিকে থাকতে পারবে । এখনও পায়ে পচন ধরে নি তবে সেটা ধরবে খুব জলদি ! এই সময়ের ভেতরে সেই প্রাণীটাকে খুজে বের করতেই হবে !
-চল যাওয়া যাক !
আলমগীর মৃধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল কথাটা । তারপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি এখানেই অপেক্ষা কর । আমাদের একটু সময় লাগতে পারে । ঠিক আছে !
-জি স্যার !
তন্বী কোন কথা না বলে দরজা ঠেলে বের হয়ে এল । ওরা পুরান ঢাকার একটা বাসার সামনে রয়েছে । একতলা ছোট্ট একটা বাসা । অন্ধকারের মাঝেও বাইরের দেওয়ালে একটা অযত্নের ছাপ দেখা যাচ্ছে । অবশ্য ওরা এসেছে একজন ভুতের ওঝার কাছে । এর থেকে আর কি বা আশা করা যেতে পারে ! তন্বী এর থেকে আর কিছু বেশি আশাও করে নি ।
আলমগীর মৃধা দরজা ঠেকে ভেতরে প্রবেশ করলো । তার পেছন পেছনই তন্বী প্রবেশ করলো । একটা উজ্জল আলো তন্বীর চোখকে খানিক সময়ের জন্য ধাধিয়ে দিয়ে গেল । খানিকটা অবাকই হয়ে গেল ভেতরের সাজ সজ্জা দেখে । এমনটা আশা করে নি । আর সব থেকে বেশি অবাক হচ্ছে ভেতরের আয়তন থেকে । বাইরে থেকে মনে হয়েছিলো বাড়িটা ছোট হবে কিন্তু কেবল ড্রায়িং রুমটার আয়তনটা ওদের বাসা থেকে বড় মনে হচ্ছে !
ড্রয়িংয়ের দুই ধারে দুই সেট সোফা সেট । দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ দামী । আর ডান দিকের দেওয়ালে একটা বড় এলইডি টিভি চালু হয়ে আছে । সোফার উপর আধ শোয়া হয়ে একজন ২৫/২৬ বছরের যুবক টিভি দেখতে । টিভিতে এনিম্যাল প্লানেট চালু করা রয়েছে । ওদের কে আসতে দেখেও টিভি থেকে চোখ সরালো না । মনে হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ন কিছু দেখছে ।
তন্বী খানিকটা বিরক্ত হল । অবশ্য সেটা প্রকাশ করলো না । ওর এসব চিন্তা করে লাভ নেই । তবে একটু যে অবাক হয় নি সেটা ও বলবে না । এই টাইপের মানুষের বাসায় এমন আধুনিক সরঞ্জাম থাকতে পারে কিংবা এমন ভাবে সাজানো গোছানো থাকতে পারে এটাও তন্বী ভাবতে পারে নি ।
-বসুন আলমগীর সাহেব । আপনার সাহেব কেমন আছেন ?
টিভির পর্দা থেকে মুখ না তুলেই ছেলেটা বলল । আলমগীর সাহেব প্রায় সাথে সাথেই বলল
-আছে । তবে খুব বেশি ভাল না ! অবস্থা দিন দিন খারাপ যাচ্ছে ।
ছেলেটা বলল
-আমি তাকে আগেই সাবধান করেছিলাম । আগে যদি ফেরৎ দিয়ে দিতো তাহলে এই দিন হয়তো আসতো না!
এবার ছেলেটা ওদের দিকে ফিরে তাকালো । সরাসরি তন্বীর দিকে । চোখের উপর চোখ পড়তেই তন্বীর বুকের ভেতরে একটা অদ্ভুদ অনুভুতি হল । মনে হল ছেলেটা যেন ওর সব কিছু জেনে গেছে মুহুর্তেই । এতো তীক্ষ চোখ কারো হতে পারে তন্বীর সেটা জানা ছিলো না । তন্বী নিজের চোখ সরিয়ে নিতে চাইলো কিন্তু পারলো না । ছেলেটা যেন ওকে আটকে ফেলেছে । তন্বীর দিকে তাকিয়ে বলল
-বস ! দাড়িয়ে কেন ?
তন্বী কোন কথা না বলে বসে পড়লো । সেই সাথে এটাও বুঝতে পারলো ওরা যার সাথে দেখা করতে এসেছে, এই মানুষটা সেই জন । অবাক না হয়ে পারলো না । ও ভেবেছিলো মানুষ নিশ্চয়ই মাঝ বয়সী হবে । কাঁচা পাকা চুল থাকবে সেই সাথে আজব পোষাক পরা থাকবে । কিন্তু তার বদলে এ দেখি এলইডি টিভিতে এনিম্যাল প্লানেট দেখছে !
তন্বীর দিকে তাকিয়ে ছেলেটা বলল
-অবাক হয়েছো আমাকে দেখে ?
তন্বী কিছু না বলে কেবল মাথা ঝাকালো । ছেলেটা ওর এই মাঠা ঝাকানো দেখে বেশ মজা পেল যেন । বলল
-সবাই হয় । যাক সেটা কথা না । কবে যাওয়ার প্লান করেছো । সব ঠিক ঠাক ?
-হ্যা । আমরা পরশুদিন রওনা দিন । সব তৈরি ।
-তুমি কি জানো কি খুজতে তুমি যাচ্ছো ?
দুঃখ জনক হলেও সত্যি তন্বীর কাছে এই প্রশ্নের কোন পরিস্কার উত্তর নেই । কেবল জানে ওদের পূর্ব পুরুষের কেউ সুন্দরবনের এক ঘীন জঙ্গলের একটা প্রাণীর থেকে তার লাল চোখ তুলে নিয়ে এসেছিলো । যার যার ফলে তাদের পরিবারের উপর সৌভাগ্যের সাথে সাথে দুর্ভাগ্যও নেমে এসেছে । এখন তাকে সুন্দরবনে যেতে হবে । সেই সাথে সেই প্রাণীটাকেও খুজে বের করতে হবে । তার পূর্বপুরুষ যেখানে যেখানে গিয়েছিলো সেই খানে যেতে হবে । তবুও নিশ্চিত না প্রাণীটাকে খুজে পাওয়া যাবে কি না । আদৌও প্রাণীটা এখনও বেঁচে আছে কি না এসব তার কিছুই জানা নেই ।
ছেলেটা বলল
-তাহলে এই অভিযান যে সফল হবে কিংবা তোমার বাবাকে যে বাঁচানো যাবে সেটার কি কোন গ্যারান্টি আছে ?
তন্বী বলল
-তাই বলে কি ঘরে চুপ করে বসে থাকবো ? এভাবে আমার বাবাকে মরে যেতে দিবো ?
ছেলেটা কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল
-তবে তোমার জন্য সুসংবাদ । সুন্দরবনের মৌয়াল আর চোরাচালানকারীদের মাঝে এখনও এই মিথটা কিন্তু আছে । তাদের অনেকেই নাকি একটা চোখ বিহীন প্রাণীকে দেখেছে । তবে যারাই দেখেছে তাদের কেউ খুব বেশিদিন বাঁচে নি। আর সেই প্রাণীটার সাথে আরও একজনকে দেখা গেছে সব সময় । আগুন চোখের এক নারীকে !
তন্বী বলল
-আপনি কিভাবে জানেন এসব ?
-আমি কিভাবে জানি সেটা মূল বিষয় না । মূল বিষয় হচ্ছে আমি জানি । আর খুব সম্প্রতি একজন তাদেরকে দেখেছে ।
এই বলে ছেলেটা নিজের হাতের রিমোর্ট চাপ দিল । টিভিতে স্ক্রিন পালটে গেল সাথে সাথে । প্রথমে কিছুটা সময় অন্ধকার হয়ে আবার আলো দেখা গেল । একটা গ্রামের কোন বাড়ির । দেখেই বোঝা যাচ্ছে গরিব কোন মানুষের বাসা । মাটির ঘরের বারান্দায় দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে একটা লোক বসে আছে । চোখে শূন্য দৃষ্টি । তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছুই যেন দেখছে না ।
তন্বী মানুষটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । ছেলেটা বলল
-এর নাম রাইনাল শেখ । সুন্দরবনে অবৈধ ভাবে ফাঁদ পেতে ছোট খাটো প্রাণী ধরে বাজারে বিক্রি করে, মাঝে মাঝে গাছ কেটে চুরি করে । গত মাসের দুই তারিখে রাতের বেলা রাইনাল শেখ সুন্দর বনের অনেক গভীরে চলে যায় । এমন একটা জাগয়া যেটা সবাই এড়িয়ে চলে । ফরেস্ট অফিসার থেকে শুরু করে পোচার পর্যন্ত সবাই । কিন্তু রাইনাল শেখ সেখানে হাজির হয় । রাতের বেলা তক তীব্র আলো দেখতে পায় সে । কিছু দুর যাওয়ার পরেই সেই অদ্ভুদ প্রাণী আর তার মালকিনের সাথে দেখা হয়ে যায় রাইনাল শেখের । সেদিন রাতে সে কিভাবে গ্রামে ফিরে এসেছে সেটা সে বলতে পারে না । যে কয়জন তাকে দেখেছে তারা বলছে রাইনাল শেখ নাকি উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়াচ্ছিলো কেবল । কোন দিকে তার কোন লক্ষ্য ছিল । আসার পর থেকেই কেবল বলে চলেছে সে কি দেখেছে ! অন্য কারো কথা শুনছে না কেবল নিজে বিড়বিড় করে বলেই চলেছে একই কথা !
তন্বী সত্যি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে । এখানে আসার কোন ইচ্ছেই ছিল না তার । তার বাবা বলেছিলো সুন্দরবনে কোন অতিপ্রাকৃত বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য এই মানুষটা তার সাথে যাবে । কিন্তু এখানে এসে ভাবেও নি এটা শুনতে পাবে !
ছেলেটা আবার বলল
-তারপর দুদিন পরে রাইনাল শেখের সেই বিড়বিড় করাও বন্ধ হয়ে যায় । কেবল একভাবে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে । তার এক সপ্তাহ পরে মারা যায় সে ! সুতরাং কতটা বিপদের মধ্যে তুমি যাচ্ছো বুঝতে পারছো তো ?
তন্বী বলল
-যতই বিপদ হোক আমাকে যেতেই হবে ।
-আচ্ছা তোমার যা ইচ্ছে । বুঝতেই পারছি মানষিক ভাবে এমন বিপদের মাঝে যাওয়ার জন্যই তুমি এসেছো !
তারপর বেশ কিছুটা সময় কেউ কোন কথা বলল না । একটা সময়ে এসে তন্বী বলল
-আপনার নাম এখনও আমার জানা হয় নি !
ছেলেটা এবারও হাসলো । বলল
-আমিও তোমার নাম জানতে চাই নি ?
-আমার নাম আপনি জানেন । আপনার নাম এমন কি আপনার ব্যাপারে কিছুই আমি জানি না । আব্বু বলেছে আপনাকে আমার সাথে যেতে । আমি জানিও না আপনি যেতে রাজি হবেন কি না । হলেও কেন হবেন কিংবা আপনাকে কি পরিমান পেমেন্ট করতে হবে সেটাও আজকে ঠিক করতেই আমি এখানে এসেছি !
-পেমেন্ট ? আমি যতদুর জানি খুব মোটা টাকা খরচ করেই তোমার অভিযান ঠিক করা হয়েছে । সবাইকেই অনেক টাকা দেওয়া হচ্ছে ।
-হ্যা । ঠিকই শুনেছেন। আপনিও বলে ফেলুন আপনি কত চান !
ছেলেটা হাসলো আবারও । বলল
-অনেক টাকা রয়েছে তোমার আমি জানি । তোমার বাবার পরে তোমার হাতে এতো টাকা এসে যাবে যে তুমি অনেক কিছু করতে পারো।
-আমার এসব কিছু দরকার নেই । আমার কেবল আমার বাবাকে দরকার !
ছেলেটা কিছুটা সময় তন্বীর চোখের দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো । যেন বোঝার চেষ্টা করছে সে আসলেই সত্যি কথা বলছে কি না । তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল
-বুঝলাম । আমাকে কিছু দিতে হবে না । তবে কাজটা হওয়ার পরে তোমাকে একটা কাজ করতে বলবো । চাইলে তুমি করতে পারো আবার নাও পারো সেটা তোমার ইচ্ছে । এখন কাজের কথায় আসা যাক । কোন কিছু খোজার আগে আমাদের আগে জানতে হবে আসলে আমরা কি খুজতে যাচ্ছি । এবং সেটা খোজার আসল উপায় নি । তুমি তো কেবল লোকজন নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছো ! কি খুজতে হবে কাকে খুজতে হবে সেটাও ঠিক মত পরিস্কার না তোমার কাছে !
তন্বী বলল
-আপনার কাছে তো পরিস্কার ! এই জন্যই আপনাকে সাথে নেওয়া হচ্ছে !
ছেলেটা আবারও কিছুটা সময় তন্বীর দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর উঠে দাড়ালো । বলল
-খানিকটা সময় বস এখানে । আমি কিছু নিয়ে আসি, সেটা দিয়ে তুমি বুঝতে পারবে আমরা কোথায় যাচ্ছি !
ছেলেটা ওদের সামনে দিয়ে ভেতরের দিকের একটা ঘরে চলে গেল । তন্বী আবারও চারিদিকে দেখতে লাগলো । রাইনাল শেখের ভিডিওটা দেখার পরে তার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে তার বাবাকে এবার সে বাঁচাতে পারবে । এখনও যখন এমন কিছু আছে তার মানে সেই প্রাণীটাও আছে । তাকে সে খুজে বের করবেই ।
আলমগীর মৃধার দিকে তাকিয়ে দেখলো ভদ্রলোক কেমন ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে ।
-কি হয়েছে আঙ্কেল ? আপনাকে এমন কেন দেখাচ্ছে ?
-এমনি ! আসলে প্রতিবার যখন এখানে আসি তখন আমার মনের ভেতরে কেমন যেন কু ডেকে ওঠে । জাগয়ার সাথে ঠিক মানিয়ে নিতে পারি না।
তন্বী জানে ওর বাবার সাথেই ম্যানেজার আলমগীর এখানে আসতেন। বাবার অনেক বিশ্বাসী আর ভরশার লোক এই আলমগীর মৃধা । আলমগীর মৃধা বলল
-তা মা তুমি রাফায়েলের চোখে চোখ রেখে কিভাবে কথা বলছো সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি । ওর চোখ দেখেছো ?
এতো সময় পরে তন্বী ছেলেটার নাম জানতে পারলো । রাফায়েল । বেশ অদ্ভুদ নাম ! এদেশে এমন নামের কাউকে সাধারনত দেখা যায় না !
আরও কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই রাফায়েল ঘরে ঢুকলো । এবার হাতে বেশ মোটা একটা বই । বইটা টিটেবিলের সামনে রাখতে রাখতে বলল
-দেখা যাক আমার কার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে যাচ্ছি !
রাফায়েল বই খুলল !
সুন্দর বনের এতো গভীরে বাইরে থেকে কোন মানুষ আসে না । খুব কম মানুষ এই গ্রামের খোজ জানে তবে সবাই এখানে আসতে ভয় পায় । আর জানলেও রাস্তা এতো দুর্গম যে কেউ এখানে আসে না । আসতে পারেও না । না আসার পেছনে অবশ্য আরও একটা কারন আছে । সবাই এই গ্রাম সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছে । এই গ্রামের উপরে নাকি কো অপদেবতার আশির্বাদ আছে । সে নাকি এই গ্রামকে রক্ষা করে চলে । এই গ্রামে কখন আধার নামে না । দিনের আলোর মত পরিস্কার থাকে সব সময় । বাইরের মানুষ এখানে আসুক সেটা সে পছন্দ করে না !
আর গ্রামের মানুষদেরও বাইরে যাওয়ার খুব একটা দরকার পড়ে না । নিজেদের আহার তারা নিজেরাই উৎপাদন করে করে । বনের পশু শিকার করে, খাল নদী ভর্তি মাছ । কোন অসুবিধা হয় না ! গ্রামে সবাই খুব সুখে শান্তিতে থাকে ! কিন্তু আজকে গ্রামের ভেতরে সবাই খুব গম্ভীর হয়ে আছে । সবার মুখই থমথমে । মেয়েরা গান গায় বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করে । কিন্তু আজকে সবাই চুপ করে আছে । কেউ যেন কোন কথা বলছে না । সবাই চিন্তিত !
গ্রামের সব থেকে জোয়ান ছেলে লোবান গ্রামের সর্দারের দিকে তাকিয়ে বলল
-আমাদের গ্রামের জন্য ব্যাপারটা ভাল হল না !
সর্দার তাকালো লোবানের দিকে । তারপর বলল
-আমিও একটু চিন্তিত কিন্তু ব্যাপারটা আমি কিভাবে সামলে দেব । তোমার কি মনে হয় লোকটাকে ঐভাবে ফেলে আসলেই ভাল হত । মানুষটা মারা যেতে পারতো ।
-মারা গেলে আমাদের কি ? এখন সে যদি আমাদের জন্য বিপদ নিয়ে আছে তখন কি হবে ? একবার ভেবে দেখেছেন?
-হুম ! সেটাই ভাবছি !
-একবার ক্যাডেজোর কথা ভেবে দেখেছেন ? সে কি ক্ষুণ্ণ হবে না ? তখন ?
এই গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে বাইরের মানুষে এই গ্রামে আসলে সেটা ক্যাডেজোর ঠিক পছন্দ করে না । তখন সে এই গ্রামের মানুষের উপর বিভিন্ন আপদ বিপদ দেয় । তাই সবাই এটা খেয়াল রাখে যে বাইরে থেকে কেউ যাতে এই গ্রামে না আসতে পারে না ।
বাইরের সব কিছু শুনে এসে সর্দারের মেয়ে আদ্রিয়ানা নতুন আগন্তকের পাশে এসে বসলো । একটা লোকটা জ্ঞান ফিরেছে কিছু সময় আছে । সেই জানতে চেয়েছে সে কোথায় এবং কোন গ্রামে আছে । আজকে আদ্রিয়ানার জন্য লোকটাকে এখানে সবাই নিয়ে এসেছে । প্রতিদিনের মত সবাই যখন বনের ভেতরে শিকারের অভিযানে বের হয়েছিলো তখনই একটা একটা খালের পাশে এই লোকটাকে পড়ে থাকতে দেখে । সবাই তাকে ফেলে আসতেই চেয়েছিলো কিন্তু আদ্রিয়ানার জন্য পারে নি । একে তো সে সর্দারের মেয়ে তার উপর সামনে সেই গ্রামের সর্দারনী হবে । তার কথা কেউ অমান্য করতে পারলো না । লোকটাকে গ্রামে নিয়ে এল ।
লোকটাকে আদ্রিয়ানার ফেলে আসতে মন বলে নি । এখন সেই লোকটার দেখা শুনা করছে । তাকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছে । কিন্তু আদ্রিয়ানার হিসাবে একটু ভুল ছিল । সে যাকে কেবল মাত্র একজন সাধারন মানুষ বলে মনে করেছিলো সে আসলে অন্য একটা উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রামে এসেছিলো । গ্রামের মানুষ সেটা বুঝতে একটু দেরি করে ফেলল । গ্রাম যখন ঘুমিয়ে ছিল তখনই তাদের উপর হামলা হল । যেই গ্রামের লোকজন বাঁধা দিতে এল তারা কেবল প্রাণ হারালো ।
আদ্রিয়ানা কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । তার তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে ভুল মানুষকে তুলে নিয়ে এসেছে । তার ভুলের কারনেই গ্রামের আজকে সবাই মারা পরছে । সবাই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ।
গ্রামকে নিশ্চিন্ত করে দলটা গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে হাজির হল । সবার সামনে সেই মানুষটা যাকে কি না আদ্রিয়ানা বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছিলো । সে অনেক দিন থেকেই এই চোখটার পেছনে পড়ে আছে । এমন একটা চোখ যার ভেতরে লুকিয়ে আছে চমর সৌভাহ্যের প্রতীক । অনেক খোজ খবর আর প্রতীক্ষার পর সে জানতে পেরেছিলো চোখটা কোথায় আছে !
ক্যাডেজোর মুর্তির ভেতরে এই চোখটা আছে যেটা সে অনেক দিন খুজছিলো ।
যখন ক্যাডেজোর মুর্তি থেকে চোখটা খুলে নেওয়া হচ্ছিলো তখনও আদ্রিয়ানার দেহে প্রাণ আছে সে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মানুষটার দিকে । যাকে সে বিশ্বাস করে সাহায্যের জন্য নিয়ে এসেছিলো । তীব্র একটা আক্রোশ বোধ করলো সে কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না । মনে মনে অভিশাত দিল তাকে সে ছাড়বে না । কেবল তাকেই কেন তার পরবর্তি সব বংশধরকেও এই পাপের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে !
গতদিন ঘন্টা ধরে তারা হেটেই চলেছে । সামনে জামসেদ আলী মাঝে তন্বী এবং সবার শেষে রাফায়েল । রাতের জঙ্গল ঘুরঘুটে অন্ধকার । তিনটা ফ্ল্যাশ লাইটের আলো সেই অন্ধকারকে যেন আরও বেশি করে তুলেছে । ফ্ল্যাশ লাইটের আলো ছাড়া আর কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না । কোন মতে সামনে এগিয়ে চলছে তারা । কোথায় যাচ্ছে তাদের কারোই ধারনা নেই ।
জামসেদ আলীও এদিকটা খুব একটা আসে নি । তার দীর্ঘ্য কর্ম জীবনে খুব অল্প সময়ের জন্যই সে এদিকে এসেছে । দিনের বেলা হলে হয়তো পথঘাত চিনতে পারতো কিন্তু এই রাতের বেলা বলে কিছুই ঠিক মত বোঝা যাচ্ছে না । তাদের সাথে জিপিএস আছে বলে যে পথে এসেছে সেই পথে ফিরে যেতে পারবে সেটা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হচ্ছে না !
গতদিনের ঘটনার পর তাদের সাথে থাকা লোকজনের অনেকেই ভয় পেয়ে গেছে । তারা বনের ভেতরে আসতে চাইছিলো না । তারা ভেবেছিলো হয়তো তাদের না যাওয়া দেখে সবাই আবার ফিরে যাবে । কিন্তু যখন দেখলো তন্বীরা ঠিকই বনের ভেতরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে তখন তারা খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেল । কয়েকজন তাদের সাথে যেতে তৈরি হয়ে গেল । কিন্তু তন্বী গতদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে যে আর কেউ তার জন্য মারা পরবে না । তাই ওদেরকে ট্রলারেই থাকতে বলল । আর বলল যে যদি সকালের ভেতরে তারা কেউ ফেরৎ না আসে তাহলে যেন তারা তাদের খুজতে বের হয় । এর আগে কেউ ট্রলার থেকে যেন না নামে !
জামসেদ আলী বলল
-আফা মনি ! আর মনে হয় যাওয়া ঠিক হইবো না । কিছুই তো ঠাওর করতে পারি না !
-সমস্যা নেই । আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে । আমার মন বলছে সামনে কিছু একটা আমরা দেখা পাবোই । এতো দুর এসেছি আর কিছু দুর যাওয়া যাক !
এই কথা শেষ করতে পারে নি ঠিকই রাফায়েল তাদেরকে থামতে বলল । ও যেন কিছু একটা আচ করতে পেরেছে । বলল
-এখানে একটু দাড়াও !
তন্বী তাকিয়ে দেখলো জামসেদ আলীও কেমন এদিক ওদিক মাথা নাড়াচ্ছে । কিছু যেন একটা বুঝতে পেরেছে । তন্বী বলল
-কি হয়েছে ? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না ।
জামসেদ আলী বলল
-আফা মনি ! মামা আসে পাশেই আছে । দেখেন না সব বদলাইয়া গেছে ।
তন্বী একটু মনযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো । সত্যিই তাই । একটু আগেও চারিদিক থেকে কত রকম আওয়াজ আসছিল কিন্তু এখন একদম সব চুপ হয়ে গেছে । যেন সবাই খুব ভয় পেয়েছে কারো আগমনে ।
ওদিন জনই তিনজনের দিকে পিঠ করে খুব সতর্ক হয়ে এদিক ওদিন তাকাতে লাগলো । বাঘটা নিশ্চয়ই আসে পাশের কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে । এখনই লাফ দিয়ে পড়বে ওদের সামনে । জামসেদ আলী আর রাফায়েল রাইফেল তাক করে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে । কিছু যেন বোঝার চেষ্টা করছে । তন্বীর হাতে একটা রিভালবার ! তাদের চোখের দৃষ্টি খুজতে থাকে বাঘটাকে !
ঠিক সেই সময়েই বাঘটা পাশের একটা ঝোপ থেকে এসে উদয় হল । যেদিক টা তন্বী রয়েছে ঠিক সেই দিকে । এক লাফে এসে দাড়ালো তন্বীর সামনে ! তন্বী প্রস্তুত ছিল তবুও সে কিছুই করতে পারলো না । অন্ধকারের ভেতরেও বাঘটা জ্বলতে থাকা চোখ তন্বীর চোখের উপর পড়লো । বাঘটা যেন ওকে হিপনোটাইজ করে ফেলেছে । ও গুলি চালাতে পারলো না । বুঝতে পারলো ওর দিন শেষ হয়ে এসেছে । গতদিন সেই গার্ডটাকে বাঘটা যেভাবে নিয়ে গিয়েছিলো এখন তাকেও ওভাবে নিয়ে যাবে !
কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল । রাফায়েল আর জামসেদ আলী তন্বীকে ছাপিয়ে সামনে এগিয়ে আসতে গেল । তাদের লক্ষ্য বাঘটাকে গুলি করা । ঠিক সেই সময়ে বাঘটাও লাফিয়ে পড়লো ।
তবে যা সবাই ভেবেছিলো তেমন কিছুই হল না । বাঘটা ওদের কে কামড় না দিয়ে এক সাথেই যেন তিনজন কে নিজের মাথা দিয়ে ধাক্কা দিল । প্রকান্ড শরীরের ধাক্কা খেয়ে তিন জনই যেন উড়ে গিয়ে পড়লো কিছু দুরে ! জামসেদ আলী খুবই অবাক হল । সুন্দর বনের বাঘ এরকম আচরন করেই না । তাহলে এই বাঘটা একম কেন করলো ?
তন্বী ধাক্কা খেয়ে অন্য দুজন থেকে একটু দুরেই গিয়ে পড়েছে । মাটি নরম থাকার কারনে খুব একটা ব্যাথা পায় নি । তবে যখন উঠে দাড়ালো তখন তাকিয়ে দেখলো বাঘটা তখনও তার দিকেই তাকিয়ে আছে । জামসেদ আলী আর রাফায়েল তখনও উঠে দাড়াতে পাড়ে নি । তিনটে ফ্ল্যাশ লাইট তিন দিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে । তন্বীকে এবার তীব্র আতঙ্ক পেয়ে বসলো ! আর কিছু চিন্তা না করে সে পেছনে ঘুরেই দৌড়াতে শুরু করলো অন্ধকারে । কানের কাছে ক্ষীণ স্বরে ভেসে এল একটা চিৎকার !
-দৌড়িও না নাআআআআআ
কিন্তু তন্বীর সেদিকে লক্ষ্য নেই । তার বুক ভর্তি আতঙ্কের কাছে কারো কোন উপদেশ কাজে এল না । ঠিক তার একটু পরেই পরপর দুটো গুলির আওয়াজ শুনতে পেল সে তারপরই তীব্র এক বাঘের গর্জন । তবে সে দৌড়ানো থামালো না । সে দৌড়াতেই থাকলো !
কত সময় তন্বী দৌড়িয়েছে সে বলতে পারবে না । একটা সময় এতোটাই হাপিয়ে গেল যে মাটিতে পড়ে গেল । জোরে জোরে দম নিতে লাগলো । মনে হতে লাগলো যেন এখনই বুকটা ফেলে যাবে ! মাটির উপর ভাল করে বসে পেছনের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেল কিছুটা । পানি খাওয়ার পর নিজেকে খানিকটা সুস্থির মনে হল ।
ওভাবে দৌড়ে আসার আগে তন্বীর আরও একটু ভাবা দরকার ছিল । জিপিএসটার দিকে তাকিয়ে দেখলো সেটা প্রথমে যেখানে লক করেছিলো সেখানেই আছে । কয়েকবার ঝাকাঝাকি করলো কিন্তু কোন লাভ হল না । আবারও তার মনে একটা ভয় জেকে বসলো । একটু আগের ভয়টা ছিল সেটা ছিল বাঘের আতঙ্ক আর এখনকার ভয়টা হচ্ছে এই অন্ধকার জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলা !
তন্বী ঠিক করলো সকাল না হওয়া পর্যন্ত ও এখানেই বসে থাকবে । এখান থেকে একটুও নড়বে না ! আগে সকাল হোক তারপর এখান থেকে যাবে ! কিন্তু তখনই একটা অদ্ভুদ ব্যাপার লক্ষ্য করলো সে । একটু আগেও বনের চারিপাশ টা ঘুরঘুরে অন্ধকার ছিল । কিছু দেখা যাচ্ছিলো না । কিন্তু হঠাৎ করেই যেন তন্বীর চারিপাশটা আলোকিত হতে শুরু করেছে । তন্বী আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ খোজার চেষ্টা করলো কিন্তু বনের গাছের জন্য আকাশটা দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে ।
তাহলে আলো আসছে কোথা থেকে ।
তন্বীর সামনের দিকে তাকালো। আলোর পরিমানটা যেন সেখানেই বেশি। অর্থাৎ যে উৎস থেকে আলোটা আসছে সেটা সামনের দিক থেকেই। তন্বীর এক জায়তেই বসে থাকার সিন্ধান্তটা বদলে ফেলল। তার এখন সামনে যেতে ইচ্ছে করছে। একবার মনে হল যেখানে বসে আছে সেখানেই বসে থাকে। সামনে কি বিপদ আসবে কে জানে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল সামনে হয়তো কোন উপজাতির গ্রাম আছে। সেখানে আগুন জ্বালানো আছে। আলো সেখান থেকেই আসছে ।
তন্বী উঠে দাড়ালো। ব্যাগটা নিজের কাধে জড়িয়ে সামনের দিকে এগুতে লাগলো! যতই সামনে যেতে লাগলো আলোর পরিমান যেন ততই বাড়তে লাগলো । কোন আগুন থেকে এই আলো এসেছে বলে তন্বীর মনে হল না । আলোর ধরনটা অন্য রকম ! একেবারেই অন্য রকম ! তবুও তন্বী এগিয়েই চলল। সামনে কি আছে ওকে দেখতেই হবে !
তন্বী আর কিছু ভাবতে পারছে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে তাকে এখন সামন যেতে হবে। আলোর উৎসের দিকে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। দেখতে হবে সামনে কি আছে।
তন্বী এগিয়ে চলল। পায়ে পায়ে আরো সামনের দিকে। যতই এগিয়ে যেতে লাগলো চারিদিকের আলোর পরিমান যেন আরও বাড়তে লাগলো। এক পর্যায়ে আর মনেই হল না এখন গভীর রাত। বরং মনে হতে লাগলো যেন এখন দিনের বেলা।
তন্বী আলোর উৎসটা খুজতে লাগলো কিন্তু কোথা যে আলোটা আসছে সেটা ও বুঝতেই পারছে না। ওর মনে হচ্ছে আলোটা যেন প্রতিটি গাছ গাছের ডাল আর পাতা থেকেই বের হয়ে আসছে।
আলো নাকি সকল অস্বস্তি, সকল অমঙ্গল দূর করে দেয় কিন্তু তন্বীর কাছে আলোটাকে কেমন অশুভ মনে হচ্ছে। খুব ভয়ংকর কিছু আছে যেন এই আলোতে। পায়ে পায়ে আরও কিছু দূর যেতেই তন্বীকে থমকে দাড়াতে হল। ওর থেকে দু তিনশ গজ দুরেই একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার পরনে প্রায় কিছুই নেই কিন্তু সেদিকে তন্বীর চোখ গেল না। তন্বী তাকিয়ে আছে মেয়েটির জলন্ত চোখের দিকে। মেয়েটি তীব্র এক ঘৃণা নিয়ে তন্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন চোখের দৃষ্টি দিয়েই তন্বীকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড় খাড় করে দিবে।
তন্বী কি করবে ঠিক বুঝতে পারলো না। ঠিক সিদ্ধান্ত নিতেও পারছে না। রাফায়েল ওকে বলেছিল এই সুন্দরবনের কোন গ্রামের মানুষকে ধ্বংস করে তার পূর্ব পুরুষের একজন এই অশুভ চোখটা ছিনিয়ে নিয়েছিল। সেই গ্রামের মানুষ এক পশুর দেবতার আরাধনা করতো। তার মাথার ঠিক মাঝখানে ছিল সেই চোখ। এই মেয়ে কি সেই গোত্র কিংবা গ্রামের কেউ। কিন্তু সেই দেবতার মূর্তি কোথায়। চোখটা তো সেখানেই রেখে আসতে হবে।
তন্বীর একবার মনে হল সে মেয়েটাকেই চোখটা দিয়ে দেয় কিন্তু কিভাবে দিবে? তন্বী ভয়ে ভয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো একবার। তারপর যখনই কিছু বলতে যাবে তখনই মেয়েটা একটা তীব্র চিৎকার দিয়ে উঠল। সে চিৎকার এতোই তীব্র ছিল যে তন্বীর মনে হল তারা মাথার ভেতরে কেউ যেন একটা তীরের ফলা ঢুকিয়ে দিল। কিছু সময় পরে অনুভব করলো ওর নাক দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু হয়েছে। তীব্র আওয়াজ ওর মস্তিস্ক নিতে পারছে না। এরপর মেয়েটা যদি আরেকবার চিৎকার দেয় তাহলে হয়তো তন্বী জ্ঞান হারিয়ে পড়বে।
তন্বীর মনে হল আর এখানে থাকাটা নিরাপদ হবে না। ওকে এখন এখান থেকে দূরে পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তার আগেই তন্বী সেই ভয়ংকর প্রাণী টাকে দেখতে পেল। এতো সময় কেবল মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে ছিল বলেই হয়তো প্রাণীটাকে সে লক্ষ্য করে নি।
আয়তনে একটা কালো চিতা বাঘের থেকে আরও একটু বড় হবে। মুখ আর নাকও অনেকটা চিতা বাঘের মতই কিন্তু চোখ?
তন্বী অবাক হয়ে দেখলো চোখের জায়গাতে কিছুই নেই। সেখানে কেবলই সীমাহীন শূন্যতা। আলোর মাঝেই মনে হল সেখাতে খানিকটা গর্তের মত রয়েছে অথচ সেটা পরিস্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে না। বরং তার বদলে সেখানে খানিকটা ধোয়াসা ভাব বিরাজ করছে। তন্বী যেন ঠিক মত নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে।
প্রাণীটা আস্তে আস্তে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। চোখ না থাকলেও তন্বীর বুঝতে কষ্ট হল না যে প্রাণীটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে ঝড়ে পড়ছে তীব্র এক আক্রোশ আর ঘৃণা।
প্রাণীটা প্রথমবারের মত হুংকার দিল। তন্বীর কেবল একটা কথাই মনে হল যে পৃথিবীর কোন প্রাণীর এমন ডাক হতে পারে না। আর এখানে থাকা যাবে না। এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে।
তন্বীর মনের কথা টের পেয়েই যেন পশুটা ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো দ্রুত। ওর উপর ঝাপিয়ে পড়বে। তন্বী দৌড়াতে চাইলো কিন্তু তার পা যেন মাটির সাথে আটকে আছে। একটুও নড়তে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন ওকে নড়তে দেওয়া হচ্ছে না। অবশ্য নড়তে পারলেও খুব একটা লাভ যে হত তা নয়। পশুটা যত দ্রুত এগিয়ে আসছে তন্বী কিছুতেই সেই গতির সাথে পেড়ে উঠতো না। ঠিকই সে তন্বীকে ধরে ফেলতো।
তন্বী পশুটাকে ওকে লক্ষ্য করে লাফ দিতে দেখলো। তন্বী প্রাণীটার উড়ন্ত অবস্থায় ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখলো, এই তীক্ষ্ণ দাঁত বের হয়ে গেছে। এখনই ওর গলা কিংবা ঘাড় কামড়ে ধরবে।
তন্বী আর কিছুই যেন ভাবতে পারছিলো না। তন্বীর কেবল মনে হল ও ওর জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌছে গেছে। ওর কিছুই করার নেই। চোখ বন্ধ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যাবে ঠিক তখনই চোখের কোনে যেন কিছু একটা ধরা পড়লো। তারপর পরই রাতের নিরবতা ছাপিয়ে রাইফেলের গর্জন শোনা গেল খুব কাছ থেকেই। তন্বী দেখতে পেল লাফ দিয়ে এগিয়ে আসা পশুটা যেন মাঝ পথেই কিছুর সাথে ধাক্কা খেল তারপর ছিটকে পড়লো এক পাশে।
তন্বী বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখে রাইফেল হাতে জামসেদ আলী দাঁড়িয়ে। তার কাধটা লাল হয়ে আছে। সেখানের জানাটা এখনও যেন রক্তে ভেজা কিন্তু তাতে তার গুলি চালাতে মোটেই অসুবিধা হচ্ছে না। জামসেদ আলীর ঠিক পাশের রাফায়েল দাঁড়িয়ে। তবে ওর হাতে রাইফেল নেই। ওর চট করে মাটিতে বসে পড়লো হাটু গেড়ে। তারপর দ্রুত সেখানে কি যেন আকতে শুরু করলো।
তন্বী এদিকে তাকিয়ে দেখে সেই পশুটা আবার উঠে পড়েছে। গুলিতে যেন তার কিছুই হয় নি। জামসেদ আলী আবারও রাইফেল তাক করলো তার দিকে। তবে গুলি করলো না। রাফায়েল তার কাজ শেষ করে এনেছে। সে জামসেদ আলীকে চোখের ইশারায় গুলি করতে মানা করলো। তারপর ছুরি বের করে নিজের হাতের তালুর উপর একটা পোঁচ দিল। সাথে সাথে সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়লো সেই মাটির উপর। একটু আগে যেখানে সে কি যেন আঁকছিল। তারপর।মুখ দিয়ে কিছু যেন বলল আর সাথে সাথেই সেই রক্ত মাখা হাতটা চেপে ধরলো মাটিতে।
তন্বী দেখলো সেখান থেকে যেন কিছু একটা বের হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পরলো মুহুর্তের ভেতরে। সাথে সাথে সেই মেয়ের তীব্র চিৎকার কানে এল তার। মাথার ভেতরে আবারও সেই তীব্র যন্ত্রনা শুরু হল তন্বীর। জ্ঞান হারানোর আগে তন্বী দেখলো যেভাবে বিদ্যুৎ চলে ঠিক তেমন ভাবে ধপ করে যেন চারিপাশের আলো নিভে গেল। গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল চারিপাশ।
তন্বী চোখ খুলে দেখে একটা জ্বলন্ত আগুনের কুণ্ডলির পাশের সে শুয়ে আছে । তার থেকে একটু দূরে রাফায়েল বসে আছে ওর দিকে মুখ করে তাকিয়ে । মুখে একটু চিন্তার ছাপ ! ওর চোখ খোলা দেখে ছেলেটার মাঝে যেন একটু স্বস্থির ছাপ দেখতে পেল । ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো একটু !
আগুনের আলোতে সেই হাসি তন্বীর কাছে অদ্ভুদ সুন্দর মনে হল । এতো সময় ছেলেটাকে একবারও হাসতে দেখেছি । তার উপরে ছেলেটার চোখে সেই তীক্ষ দৃষ্টি নেই । ওর চোখ মেলে তাকাতেই রাফায়েল বলল
-কেমন লাগছে এখন ?
তন্বী উঠে বসতে বসতে বলল
-ভাল ।
-ওভাবে জঙ্গলের ভেতরে কেউ দৌড়ায় ? যদি হারিয়ে যেতে ?
তন্বী কোন কথা না বলে কেবল একটু হাসলো । রাফায়েল বলল
-এবার থেকে আর কখনই এমন কাজ করবে না । যত বিপদই আসুক আমাদের একসাথে থাকতে হবে । মনে থাকবে!
তন্বী মাথা ঝাকালো । তারপর বলল
-জামসেদ চাচা কই ?
-উনি গেছে সামনে দেখতে । আমরা সম্ভবত পথ হারিয়ে ফেলেছি । আর আমাদের জিপিএসও কাজ করছে না । জামসেদ আলীও এদিকে আসে নি । সেও পথ চেনে না !
-এখন ?
-দেখা যাক ! যখন তিনজনে একসাথে আছি তখন সমস্যা হবে না !
এই কথা বলতে বলতেই টর্চ হাতে এক ঝোপের ভেতর থেকে জামসেদ আলীকে আসতে দেখা গেল । তিনি এসে বসলেন তাদের সামনে । তন্বী দেখতে পেল জামসেদ আলীর কাঁধের কাছে কেমন একটা কালচে দাগ হয়ে আছে । রক্তের ডাক সেটা বুঝতে তন্বীর কষ্ট হল না । তন্বী সেদিকে তাকিয়ে আছে দেখে জামসেদ আলী বলল
-মামা আচড় দিছে ! তেমন কিছু না !
-আই এম সরি ! আমার ওভাবে দৌড়ানো ঠিক হয় নি ।
-না না ঠিক আছে । এখন আমাদের সামনের দিকে যাইতে হইবো ।
রাফায়েল তাকিয়ে আছে ওদের দিকে আছে । তারপর বলল
-সামনে কি দেখলেন ?
-সামনে একটা খাল আছে । পানি কম । পার হওয়া যাবে হেটেই । তবে একটা অদ্ভুদ ব্যাপার হচ্ছে খাল টা একটু যেন অদ্ভুদ ।
-কেমন ?
-মনে হচ্ছে খাল টা ঠিক স্বাভাবিক না । প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি মনে হল না । মনে হল কেউ যেন তৈরি করেছে । আর খালের ওপাড়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না ঠিক মত । ওপাশে ঠিক কি আছে সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না । তবে একটা ফটকের মত কিছু একটা দেখা যাচ্ছে অন্ধকারের ভেতরে । সব চেয়ে অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে ফটকটা খানিকটা কুকুরের আকৃতিতে তৈরি ।
কথাটা শুনেই বাকি দুজনেই চমকে উঠলো ।
-আমাকে ওখানেই যেতে হবে । আমাদের ওখানেই যেতে হবে ।
জামসেদ আলী বলল
-সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে হত না ?
-না । সকালে সেটা নাও থাকতে পারে । আমাদের মোটেই অপেক্ষা করাটা ঠিক হবে না ।
জামসেদ আলী আর কোন কথা বলল না । উঠে দাড়ালো । তন্বীও উঠে দাড়ালো । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সময় রাত একটার কিছু বেশি বাজে । এখনও অনেকটা রাত বাকি আছে । আস্তে আস্তে সব কিছু গুছিয়ে নিতে শুরু করলো ওরা ।
যখন রওনা দিবে তখন রাফায়েল বলল
-এবার যাই হোক না কেন খবরদার আমাদের কে ছেড়ে কোথাও যাবে না । মনে থাকবে তো ?
তন্বী মাথা ঝাকালো । তার মনে থাকবে । তারপর আবার তিনজন রওনা দিল ।
হাটতে হাটতে খালটার কাছে পৌছাতে ওদের আরও আধা ঘন্টা সময় লেগে গেল । খালটার উপরে টর্চের আলো ফেলে দেখে ওরা পানি ঘোলা আর শান্ত । খালটা খুব বেশি প্রসস্থ না । যারা হাই জাম্প দিতে জানে তারা এক লাফে খালটা পার হয়ে যেতে পারবে ! তবে ওরা পারবে না ।
ওরা তিনজনই কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো সেই পানির দিকে । চারিদিকের সব পরিবেশ কেমন যেন অস্বাভাবিক ঠেকছে তন্বীর কাছে । মনে হচ্ছে কেউ ওদের দূর থেকে লক্ষ্য করছে ।
আর খুব বেশি চিন্তা না করেই ওরা পানিতে নেমে পড়ল । পানিতে নামতেই পানি কোমড় পর্যন্ত চলে এল । তন্বীর মনে হল আরেকটু গেলেই হয়তো পানি গলা পর্যন্ত হয়ে যাবে । কিন্তু যখন মাঝখানে এল তখন তন্বীর মনে হল যেন আস্তে আস্তে সেটা গভীরতা কমছে । খালের ওপাড়ে উঠে এল ওরা ।
সেই কুকুর মুখী গেট টার সামনে আসতেই সবার ভেতরেই আবারও সেই অচেনা অনুভুতি হতে লাগলো । ওরা কেউ জানে না গেটের ওপাশে কি আছে । গেট টার ভেতরে দিয়ে জামসেদ আলী টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করলো । কিন্তু আলো সেই গেটের ভেতর দিয়ে গিয়েই আটকে আছে । মনে হচ্ছে যেন কোন দেওয়ালে সেই আলো আটকে গেছে । ওরা তিন জনই একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ী করতে লাগলো । গেটটা ওদের থেকে কয়েক হাত দূরে । শক্তিশালী টর্চের আলো কিছুতেই সেই অন্ধকার ভেদ করে সামনে যেতে পারছে না ।
জামসেদ আলী আর তন্বীকে পেছনে রেখে রাফায়েল সামনে এগিয়ে গেল । গেটের নিচ দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো তারপর অন্ধকারের ভেতরে হারিয়ে গেল । তন্বীর মনে হল রাফায়েলকে চিৎকার করে যেতে মানা করে কিন্তু তত সময়ে দেরী হয়ে গেছে । রাফায়েল অন্ধকারের ভেতরে হারিয়ে গেছে । তন্বী আর জামসেদ আলী দুজনেরই টর্চ লাইট তখনও সেই গেটের দিকেই তাক করা !
তন্বী কয়েকবার ডাক দিল । ওর মনে হতে লাগলো রাফায়েল বুঝি এবার হারিয়ে যাবে । ও যে রাফায়েলের পেছনে ছুটে যাবে সেও সাহস হচ্ছে না । একবার জামসেদ আলী দিকে আরেকবার গেট টার দিকে তাকাতে লাগলো । । ওদের দুজনের চোখেই খানিক্তা দ্বিধা কাজ করছে । যাবে কি যাবে না । যখন ওরা দুজনেই চোখে চোখে ঠিক করে ফেললো যে ওরা রাফায়েলের পেছনে যাবে ঠিক সেই সময়ে রাফায়েল গেট দিয়ে বের হয়ে এল । ওদের দিকে তাকিয়ে বলল
-ভেতরে কিছু একটা যেন ঠিক নেই ।
তন্বী বলল
-মানে ? কি ঠিক নেই ?
-বুঝতে পারছি না । তবে কিছু একটা আছে কিন্তু আমি কিছু দেখতে পারছি না । যেন মনে হচ্ছে কেউ ভেতরের জিনিস গুলোর উপরে একটা কালো পর্দা দিয়ে দিয়েছে ।
-তাহলে ?
-ভেতরে গিয়ে লাভ নেই । ভেতরটা একদম অন্ধকার । কিছু করা যাবে না । অন্য কোন পথ বের করতে হবে ।
রাফায়েল গেটের সামনে বসে গেল । কি যেন মন্ত্র পড়তে শুরু করলো । প্রায় ঘন্টা খানেক চেষ্টা করার পরেও কোন লাভ হল না । টর্চের আলো গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো না। তার মানে কোন লাভই হল না ।
তন্বী অসহায়ের মত সেদিকে তাকিয়ে রইলো । এতো কাছে এসেও কিছু করা যাচ্ছে না । এতো কাছে এসে যদি ফিরে যেতে হয় তাহলে ও কিভাবে নিজের মন কে বোঝাবে ? ওর খুব কান্না আসতে লাগলো । চোখ দিয়ে এক ফোটা পানিও গড়িয়ে পড়লো ।
ঠিক সেই সময়ে তন্বীর মনে হ ওর কানের খুব কাছ দিয়ে যেন যেন কিছু একটা চলে গেল । একটা বাতাস । চট করে এক পাশে ফিরে তাকালো । অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই যেন সে দেখতে পেল না । মাথা ঘোরাতেই আবারও সেই একই কেউ যেন ওর কানের খুব কাছ দিয়ে চলে গেল । ওর কানে কানে ফিস ফিস করে কিছু বলল যেন ।
তন্বী বুঝতে পারলো না প্রথমে । ঠিক তারপরই বুঝে গেল সেই বাতাস টা কি বলার চেষ্টা করছে । সে দ্রুত চলে গেল রাফায়েলের পেছেন । রাফায়েলকে থামতে বলল । রাফায়েল ওর দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকাতেই তন্বী বলল
-আমি জানি কি করতে হবে ।
-কি করতে হবে !
তন্বী আর কোন কথা না বলে পেছনে ব্যাগ থেকে সেই ছোট ব্যাগটা বের করলো । যার ভেতরে যত সমস্যা চাবি রয়েছে । সেই লাল রংয়ের পাথরের চোখটা । সেটা ব্যাগ থেকে বের করতেই চারিপাশে কেমন যেন আলোড়ন শুরু হয়ে গেল । হঠাৎ শান্ত কোন বাগানের ভেতরে যেন বড় কোন যন্তু ঢুকে পড়েছে । সবাই যেন জেগে উঠছে ।
তন্বী সেই চোখটা নিয়ে গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই ওরা তিনজন অবাক হয়ে দেখলো গেটের ওপাশে কোন অন্ধকার নেই । দিনের আলোর মত পরিস্কার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে । গেটের ওপাশে একটা পুরো গ্রাম দেখা যাচ্ছে ! নিশ্চুপ কোন গ্রাম যেন এখনও ওদের আওয়াজ পেয়ে কেউ বের হয়ে আসবে !
ওরা গেট দিয়ে গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করলো !
তন্বীর কাছে মনে হল ও যেন হঠাৎ করেই কোন স্বপ্নের জগতে ঢুকে পড়েছে। ঘুরঘুটে অন্ধকার জঙ্গলের ভেতর থেকে হঠাৎ করেই চলে এসেছে সাজানো গোছানো কোন গ্রামের রাস্তায়।
তন্বী আরেকবার পেছন ফিরে তাকালো। গেটের ওপাশে এখনও সেই নিকষ কালো অন্ধকার দেখা যাচ্ছে। আর এখানে দিনের আলোর মত পরিস্কার সব কিছু। যেন ভর দুপুরে কোন নির্জন গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করেছে তারা। গ্রামের মানুষজন দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমাচ্ছে। এখনই ওদের আওয়াজ পেয়ে বের হয়ে আসবে।
তন্বী এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো । গ্রামটা একদম জীবন্ত মনে হচ্ছে । তন্বীর বারবারই কেবল মনে হচ্ছে এখনই মাটির ঘরের দরজা খুলে কেউ বের হয়ে আসবে । ওদের কে জিজ্ঞেস করবে ওরা কারা, এখানে কি করছে ? তবে তন্বীর কাছে সব কেমন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে । এখানে এমন ভাবে কোন গ্রাম থাকার কথা না ! রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে দেখে সে একটা ঘরের দেওয়া ধরে কি যেন পরীক্ষা করছে । মনযোগ দিয়ে দেখছে সেদিকে !
তন্বী বলল
-কি দেখছেন ?
রাফায়েল ওর দিকে ফিরে তাকালো । ওর মুখ দেখে তন্বীর মনে হল রাফায়েল কিছু নিয়ে যেন চিন্তিত ! রাফায়েল বলল
-এলাকাটা অন্য রকম । আমি অনেক জায়গায় গেছি অনেক কিছু দেখেছি কিন্তু এমন কিছু কোনদিন দেখি নি । দেওয়া গুলো দেখতে স্বাভাবিক মনে হলেও আসলেও এগুলো অনেক পুরানো । এতো পুরানো যে এভাবে টিকে থাকার কথা না । কিভাবে দাড়িয়ে আছে সেটাই বুঝতে পারছি না ।
এই কথা বলতে বলতে রাফায়েল সেই বাসাটার দেওয়া হাত দিল । সেই সাথে সাথেই একটা অদ্ভুদ ঘটনা ঘটলো । যেমন তাসের ঘরের হাত দিলেই সেটা ভেঙ্গে পড়ে ঠিক তেমন ভাবি সেই মাটির ঘরটা মুহুর্তের ভেতরে ভেঙ্গে পড়লো । একেবারে মাটির সাথে মিশে গেল । তিন জনের প্রত্যেকেই চমকে উঠলো ।
তন্বীর তখনই মনে হল ওদের চারিপাশে যা কিছু আছে সব কিছুই অবস্থাই এমন । এমন ভাবেই সব কিছু ভেঙ্গে পড়বে ।
রাফায়েল বলল
-সাবধান ! কিছু হাত দিও না । এই উচু উচু গাছ গাছালিও না !
সবাই সামনে হাটতে লাগলো । ওরা সামনে কি খুজছে সেটা কেউ জানে না । তবে যার জন্য এসেছে সেটা সামনেই কোথাও আছে
ওর হাতে এখনও সেই লাল চোখটা রয়েছে । চোখটা যেন আরও উজ্জল হচ্ছে । যতই সামনে এগোচ্ছে ততই সেটা উজ্জল হচ্ছে । গ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে তারা । যেন আরও গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করছে । যতও এগুচ্ছে ততই যেন ঘর বাড়ি কমছে আর বড় বড় গাছ গাছালি বেড়েই চলেছে । সেই সাথে অবাক হয়ে লক্ষ্যকরছে ওরা খানিকটা উপরের দিকে উঠছে । এমন কেন হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছে না । সুন্দরবনের এলাকাটা এতো উচু হওয়ার কথা না কোন ভাবেই । কিন্তু একটা বাক ঘুরতেই ওদের তিনজনকেই অবাক হতে হল । ওদের সামনে একটা ছোটখাটো পাড়ারের মত উচু স্থান ।
তিনজনই খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে । সব থেকে অবাক হয়েছে জামসেদ আলী । এতোদিন ধরে সে এই এলাকাতে রয়েছে । তার নিজের জানা নেই এমন কোন জায়গা এখানে থাকতে পারে । তন্বীও কম অবাক হয় নি। সুন্দরবনের ভেতরে এতো বড় পাহাড় থাকলে সেটা বাইরের মানুষজনের চোখে পড়বে সেটা হবার কথা না । কেবল রাফায়েল খানিকটা গম্ভীর ভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইলো ।
তন্বী বলল
-কি হচ্ছে এসব ?
জামসেদ আলীও বলল
-এমুন জায়গা যে এইখানে ছিল সেইটাই তো জানি না ! কিছু বুঝতাছি না !
রাফায়েল কেবল বলল
-যা দেখছো সেটা সত্যি ভাবার কোন কারন নেই । ভুলে যেও না আমরা একটা অস্বাভাবিক জায়গাতে আছি । তবে এখানে খুব বেশি সময় থাকা উচিৎ হবে না !
ঠিক সেই একটা রক্ত হিম করা চিৎকার শোনা গেল । তিনজনই পেছনে ঘুরে তাকালো সাথে সাথেই । সেই চোখ বিহীন প্রাণীটা ওদের পেছনে দাড়িয়ে আছে !
চোখ নেই তবুও তন্বীর মনে হল ওদের দিকে একটা তীব্র ঘৃণা নিয়ে সেয়া তাকিয়ে আছে । আস্তে আস্তে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো । জামসেদ আলী বন্দুক তাক করে এগিয়ে যেতেই রাফায়েল মানা করলো । আস্তে আস্তে পেছন দিকে হাটতে ইশারা করলো । সবাই তাই করতে লাগলো । উচু পাহাড়ের পথ ধরেই তিন জন পেছন দিক দিয়ে হাটতে লাগলো । আস্তে আস্তে প্রাণীটা এগিয়ে আসছে ।
এক পর্যায়ে প্রাণীটা ওদের লক্ষ্য করে দৌড়াতে শুরু করলে । প্রাণীটাও ওদের পেছনে পেছন পেছন আসতে লাগলো। সেই সাথে তীব্র চিৎকার করেই চলেছে । একটা সময় ওরা তিনই আবিস্কার করলো সামনে আর ওদের যাওয়ার মত কোন পথ নেই । পাহাড় দিয়ে আটকে গেছে । সেখান দিয়ে সামনে যাওয়ার কোন পথ নেই ।
সেই প্রাণীটাও এসে থামলো ওদের পেছনে । এটো সময় প্রাণীটা ওদের উপর একটুও হামলা করে নি । চাইলে হয়তো ধরে ফেলতে পারতো তবে প্রাণীটার লক্ষ্য ছিল ওদেরকে এখানে তাড়িয়ে নিয়ে আসা ।
ওরা যেখানে এসে থেমেছে সেখান থেকেই উঠে গেছে খাড়া পাহাড়টা । এটা পার হওয়া কোন ভাবেই সম্ভব না । আটকে গেছে । পাহাড়ের ঠিক গা ঘেসেই একটা বেদীর মত দেখা যাচ্ছে । সমান বেদীর উপরে একটা ছোট কুকুরের মত প্রাণীর মুর্তি । যে প্রাণীটা ওদের তাড়া করে নিয়ে এসেছে এটা যে ই প্রাণী সেটা চিনতে কষ্ট হল না । এই প্রাণীটার চোখের সাথে ফাঁকা মত স্থান দেখা যাচ্ছে । কাউকে বলে দিতে হল না তবে তন্বী ঠিক জানে ওর হাতের লাল রংয়ের চোখটা সেই জায়গাতে ঠিক ঠিক বসে যাবে !
তন্বী তাকিয়ে দেখলো রাফায়েল আবারও সেই মাটিতে কিছু আকাঝুকি করতে শুরু করলো । তখনই পাশ থেকে একটা মিহি অথচ ঠান্ডা গলায় কেউ বলে উঠলো
-এবার আর কোন লাভ হবে না !
তিনজনই এক সাথে ঘুরে তাকালো সেই দিকে । একটু আগের প্রাণীটার সাথের সেই মেয়েটা ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । তবে মেয়েটার পোষাক আগের মত নেই । তার বদলে মেয়েটার পরনে সাদা আলখাল্লার মত একটা ধোলা পোষাক ! মুখে একটা শান্ত অথচ কঠিন ভাব রয়েছে ।
রাফায়েল কিন্তু মেয়েটার কথা শুনলো না । ঠিকই মাটিতে যা করছিলো তাই করলো । হাতের ব্যান্ড এইড টা খুলে সেখানে থেকে কয়েক ফোটা রক্ত ফেলল । তারপর আগের মত মাটিতে থাবা দিতেই একটা ধুলোর বাতাস যেন চারিদিকে ছড়িয়ে পরলো । কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো আগের মত মেয়েটা আর সেই প্রাণীটা গায়েব হয়ে গেল না। যেখানে ছিল সেখানেই দাড়িয়েই রইলো ।
মেয়েটি আবারও বলল
-বলেছিলাম আমি । লাভ হবে না । আগের টা তোমার এলাকা ছিল কিন্তু এটা আমার এলাকা । এটা ক্যাডেজোর নিজের এলাকা । এখানে বাইরের কোন কিছু কাজ করবে না ।
তন্বী বলল
-দেখ আমরা কোন কিছু চাই না । কেবল আমার বাবাকে বাচাতে চাই । এই দেখো এটা আমি ফেরৎ দিতে দিতে এসেছি !
মেয়েটার আসার পর থেকেই তার চোখ তন্বীর হাতের সেই লাল রংয়ের চোখের দিকে ছিল । সেটা থেকে একটা তীব্র আলো ঠিকড়ে বের হচ্ছে । মেয়েটা বলল
-১১তম প্রজন্ম ! এর আগে ১০ জন মারা গেছে । তোমার বাবা ১১ নম্বর !
তন্বী কাতর কন্ঠে বলল
-আমার বাবার তো কোন দোষ নেই ।
আমাদের কি দোষ ছিল ? আমাদের পুরো গোত্রের কি দোষ ছিল ? তোমার পূর্ব পুরুষ নিজের লোভের কারনে আমাদের পুরো গ্রামকে ধ্বংস করে দিয়েছে । আমাদের উপর ক্যাডেজোর যে আশির্বাড ছিল সেটাকে অভিশাপে রূপান্তর করেছে । ক্যাডেজোর মুর্তি ওর চোখ ছাড়া থাকার ফলে পুরো গ্রামের উপর অভিশাপ নেমে আসে । যে আমাদের রক্ষা কর্তা ছিল সেই হয়ে গেল আমাদের ভক্ষক ! তোমার পূর্ব পুরুষের হামলার পরে আমরা যারা বেঁচে ছিলাম আস্তে আস্তে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলেছে এই ক্যাডেজো । আমাকে মেরে ফেলেও যেতে দেয় নি । আটকে রেখেছে এই গ্রামেই । আমাদের সবাইকে আটকে রেখেছে ! এতো গুলো বছর !
এই লাইনটা বলার সাথে সাথে ওরা অবাক হয়ে দেখলো আসে পাশ থেকে আরও অনেকে সেখানে আসতে শুরু করেছে । সবাই এসে জমা হচ্ছে । মনে হচ্ছে পুরো গ্রাম জেগে উঠেছে ।
মেয়েটি আবার বলল
-তোমার বাবাকে মরতে হবে । তোমাকেও মরতে হবে !
সাথে সাথেই গ্রামের সবাই এক সাথে বলে উঠলো মরতে হবে মরতে হবে । মরতে হবে !
পুরো এলাকাটা যেন একই আওয়াজে গমগম করে উঠলো ।সবাই এক সাথেই বলে চলেছে মরতে হবে মরতে হবে !
এটার জন্যই যেন সেই হিংস্র প্রাণীটা অপেক্ষা করছিলো । তন্বীকে লক্ষ্য করেই সে লাফ দিল । ওকে আক্রমন করবে। জামসেদ আলী তৈরি ছিল । বন্দুক দিয়ে সরাসরি গুলি করলো । প্রাণীটা যেন কেবল একটা ছিটকে গিয়ে পাশ পড়লো তবে সেটার কিছুই হল না যেন । আবারও তন্বীর উপর হামলা করতে প্রস্তুত। এবা গুলোটা করলো রাফায়েল।
এদিকে পুরো গ্রামের মানুষ এক সাথে চিৎকার করেই চলেছে মরতে হবে মরতে হবে মরতে হবে !
তন্বী কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না । তবে ওর মনে হচ্ছে রাফায়েল আর জামসেদ আলীর বন্দুকের গুলি প্রাণীটাকে আটকে রাখতে পারবে না । ওর উপর সেটা হামলা করবেই । রাফায়েলের দিকে তাকাতেই রাফায়েল বলল
-জলদি চোখটা ঐ মুর্তির চোখে বসাও ।
ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলো সে। সোজা দৌড় দিল সেই মুর্তির বরাবর। চোখটা সেই ফাঁকা চোখের স্থানে বসাবে ঠিক সেই সময় সেই তীক্ষ একটা চিৎকার তন্বীর মস্তিস্কে আঘাত করলো। পরমুহুর্ত সে আবিস্কার করলো চিৎকার কেবল একটা না পুরো গ্রামের মানুষ যেন একযোগে চিৎকার করে চলেছে। যেটা তন্বীর মাথার ভেতরে সরাসরি গিয়ে আঘাত করছে ।
চোখটা বন্ধ হয়ে এল । আর মনে হয় পারবে না ! এতো কাছে এসে পরাজিত হয়ে গেল ও । চোখ বন্ধ হতেই বাবার চেহারাটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে । ওর বাবা মারা যেতে চলেছে । হয়তো ও নিজেও মারা যাবে ! ছোট বেলা থেকেই বাবা ওকে কতই না আদর করে এতো বড় করেছে । এতো কাছে এসে তাকে মরে যেতে দিবে ।
তন্বী চোখ মেনে তাকালো । তীক্ষ চিৎকারটা এখনও চলছে তবে সেটার দিকে আর লক্ষ্য দিল না । বারবারই মনে হতে লাগলো ওকে পারতেই হবে । পাশে পড়ে থাকা চোখটা মুর্তির ঠিক জায়গা মত বসিয়ে দিল । একটা তীব্র ধাক্কা যেন খেল তন্বী । যেন চোখটা মূর্তিতে বসার সাথে সাথেই কিছু একটা তীব্র ভাবে আঘাত এসেছে চারি দিকে ।
পুরো গ্রাম বাসীর চিৎকারও থেমে গেছে সাথে সাথে । তন্বী উঠে দাড়াতে দাড়াতে তাকিয়ে দেখে আসে পাশে আর কোন মানুষ নেই ওরা ছাড়া । তবে সেই প্রাণীটা ঠিকই আছে । প্রাণীটার চোখের জাগয়াতে এখন একটা লাল চোখও দেখা যাচ্ছে । হিংস্র ভাব নিয়ে সে এগিয়ে আসছে তন্বীর দিকে । রাফায়েল আর জামসেদ আহমেদ পরে আছে এক পাশে । প্রাণীটা এগিয়ে আসছে ওর দিকে ।
তন্বী কি করবনে । পকেট থেকে রিভালবারটা বের করে আনলো । ও জানে কিছুই হবে না প্রাণীটার এই গুলো খেয়ে ! গুলি করতে যাবে ঠিক সেই সময় কেউ যেন ওর কানে কানে বলে দিল, মুর্তিটাকে ধ্বংস করো !
কয়েক মুহুর্ত কোন কিছু করলো না সে । তারপর ঠিক যখন একদম কাছে চলে এসেছে প্রাণীটা তন্বী রিভালবারের নলতা মুর্তির দিকে ফেরালো ! তারপর চোখ বন্ধ করে টেনে দিল ট্রিগার !
তারপর আবার ! যতগুলো গুলি ছিল সব কটা !
যখন চোখ খুলল দেখলো মুর্তিটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে । আসে পাশে কোন প্রাণী নেই । কেউ নেই । তবে সব কিছু কেমন যেন ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে ।
পাহাড় গাছ পালা ঘরবাড়ি সব কিছু !
তন্বী কি করবে খুজে পেল না । রাফায়েলের দিকে দেখে রাফায়েল ওকে চৎটকার ডাকছে । তন্বী কিছু সময় বিমূঢ় হয়ে তাকিয়েই রইলো সেদিকে । কি করবে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না । একটা সময় দেখলো রাফায়েল ওকে ওর হাত ধরে টান দিল । তারপর দৌড়াতে শুরু করলো । জামসেদ আলী আগে আগে দৌড়াচ্ছে । পেছনে পেছনে ওরা । আর পুরো গ্রামটা জুড়ে যেন ধ্বংস লিলা চলছে । সব কিছু ভেঙ্গে পড়ছে । এই গ্রামটা ছিল দেবতা ক্যাডেজার আশির্বাদের ফল । মুর্তি নেই চোখও নেই তাই সেই আশির্বাদও নেই । সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ! ওরা যদি সঠিক সময়ে গ্রাম থেকে বের হতে না পরে তাহলে ওরা গ্রামের সাথে মাটিতে মিশে যাবে !
ঐতো চলে এসছে । গেট টা দেখে যাচ্ছে ! ওরা দৌড়াতেই থাকে ! দৌড়াতেই থাকে । যে কোন মূল্যেই হোক গেট দিয়ে বের হতেই হবে !
🔶পরিশিষ্টঃ🔶
রাকিবুদ্দিন সাহেব তন্বীর দিকে তাকিয়ে বললেন
-শাহেদ তোর সাথে দেখা করতে চাইছে । কাল অফিসে এসেছিলো ।
তন্বী বাবার দিকে তাকিয়ে বলল
-কোন শাহেদ বাবা ?
রাকিবুদ্দিন হেসে ফেললেন । বললেন
-এভাবে বলিস না । ছেলেটা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে ।
-ভাল কথা ! আমিও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি । আর পেরেছি বলেই তাকে আর চিনবো না বলে ঠিক করেছি !
–তো জীবনে কাউকে তো চিনতে হবে ?
–তা চিনে নিয়েছি তো ।
রাকিবুদ্দিন সাহেব আর কোন কথা বললেন না । তন্বী কার কথা বলছে সেটা সে ভাল করেই জানে । এও জানে সেটা কোন ভাবেই সম্ভব না । মেয়েটার উপর কোন কথা বলতে পারেন না এখন তিনি । নিজের জীবনের পরোয়া না করে কিভাবে মেয়েটা একা একা সেই কোথায় চলে গেল কেবল তাকে বাঁচানোর জন্য । এমন মেয়েকে কিছু বলা যায় !
(সমাপ্ত)