পায়ের হালকা ঠোক্কর লাগল মুকুলের। ইটের টুকরো থাকলে যেমন লাগে। আজ মুকুলের বেজায় তাড়া। kolom অফিসে পৌঁছতে হবে সকাল ন’টার মধ্যে। আই টি অফিসগুলোতে কাজের চাপ বেশি। মুকুলের আবার ডবল কাজ। অফিসের কাজ যেমন থাকে, তেমন বাড়ির কাজও আছে। সে কলকাতায় একা থাকে। তাকেই সব করতে হয়।
লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দু’বছর হল জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় এসেছে মুকুল। পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করেছিল। কাজ পেয়ে গিয়েছে নামী এক আই টি কোম্পানিতে। চাকরি ভাল পেলেও কলকাতায় থাকার জায়গা নিয়ে ছিল সমস্যা। মুকুলদের বাড়ি জলপাইগুড়ির এক গ্রামে। সেখানেই বাবা থাকেন। মা মারা গিয়েছেন পাঁচ বছর হয়ে গেল। মুকুল যখন জলপাইগুড়ি শহরে এসে স্কুল, কলেজে লেখাপড়া করেছে তখন থাকত বোর্ডিং আর হোস্টেলে। কলকাতায় চাকরি করতে এসে প্রথমে থেকেছে পেয়িং গেস্ট হয়ে। বছরখানেক হল সল্টলেকে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। একতলায় দু’কামরার ফ্ল্যাট। ইচ্ছে করেই একটু বড় ফ্ল্যাট নিয়েছে যাতে বাবা মাঝে-মাঝে এসে থাকতে পারেন। সল্টলেক থেকে তার অফিস যাতায়াতেও সুবিধে।
মুকুল যতই বাড়ি ভাড়া নিক, মুকুলের বাবা বিজনবাবু একজন ঘরকুনো মানুষ। চট করে নিজের গ্রাম ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকতে চান না। রাতে বাড়ির বিছানায় শুয়ে ঝিঁঝিঁর ডাক না শুনলে তাঁর নাকি ঘুম হয় না। ভোরবেলায় বাড়ির পুকুর ঘাটে দাঁতন নিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁকানি না শুনলে তাঁর নাকি ঠিকমতো ঘুম ভাঙে না।
মুকুল রাগারাগি করে। বলে, “বাবা ঘুম পাওয়া আর ঘুম ভাঙা নিয়ে এত চিন্তা কোরো না। ক’দিন কলকাতায় এসে থেকে যাও। আমি তোমাকে টেপরেকর্ডারে ঝিঁঝিঁর ডাক আর হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁক শোনাব।”
বিজনবাবু ছেলের রাগ সামলানোর জন্য বলেন, “যাব-যাব। আগে তুই গুছিয়ে নে।”
মুকুল বলে, “গুছিয়ে নেওয়াই আছে। দুটো ঘরের ফ্ল্যাট নিয়েছি। রান্নার দিদি আছেন। তোমায় কিছু করতে হবে না।”
বিজনবাবু হেসে বলেন, “সেটাই তো চিন্তা। কিছু না করে বসে থাকলে শরীরটা তো একেবারে যাবে। এখানে তাও স্কুলের মাস্টারি থেকে রিটায়ার করে বাগান করি।গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়াই। তোর কলকাতায় কী করব? গাড়ির হর্ন শুনে কান ঝালাপালা করব আর পথের ধুলো, ধোঁয়া খেয়ে খকখক করে কাশব?”
মুকুল বিরক্ত হয়। এত জেদ করলে চলে? মা চলে যাওয়ার পর মানুষটাকে সামলানো কঠিন হয়ে গিয়েছে। মুকুলের চিন্তাও হয়। একা থাকেন। শরীরটাও ভেঙে গিয়েছে। তার উপর মনের দিক থেকে ভদ্রলোক একজন পুরনো দিনের মানুষ। ছেলে তথ্যপ্রযুক্তি অফিসে কাজ করলে কী হবে, নিজে মোবাইল ফোন, কম্পিউটারের ধারকাছ দিয়ে যান না। ফলে কলকাতা থেকে নিয়মিত তাঁর খোঁজখবর নেওয়াটা একটা সমস্যা। মুকুল একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিল। বিজনবাবু সেই ফোন আলমারিতে তুলে রেখেছেন।মুকুল দেশে গিয়ে রাগ দেখাল।
“বাবা, তুমি মোবাইল আলমারিতে রেখে দিয়েছ কেন?”
বিজনবাবু শান্তভাবে বললেন, “ও বড় গোলমেলে জিনিস। নম্বর টিপলে বেশির ভাগ সময়ই দেখি কুক কুক করে। তুই কথা বললে, অর্ধেক কথাই যায় ভেসে। ধর বললি, “এই শনিবার বাড়ি আসব না’। না-টা ভেসে গেল। আমি শুনলাম, এই শনিবার আসব। ব্যস, শনিবার সকালে গাছ থেকে ডাব পেড়ে, পুকুর থেকে মাছ তুলে ঠায় বসে রইলাম।”
মুকুল বলে, “উফ বাবা, এটা তো নেটওয়ার্কের সমস্যা। ঠিকমতো লাইন পাওয়া যায় না। ফোন কী দোষ করল?”
বিজনবাবু হেসে বলেন, “কোনও দোষ করেনি। সে অতি ভাল ছেলে। কিন্তু আমি বুড়ো মানুষ তারে সামলাতে পারি না।”
মুকুল বলল, “তা হলে, আমি তোমার খবরাখবর নেব কীভাবে? অত দূরে থাকি। চিন্তা হয়।”
বিজন বাবু হেসে বললেন, “দুর বোকা ছেলে, চিন্তার কী আছে? তোকে মাঝে-মাঝে তো চিঠি লিখি। তুইও লিখবি।”
বিজনবাবু সত্যি ছেলেকে মাঝেমধ্যে চিঠি লেখেন। কলকাতার অফিস থেকে বাড়ি ফিরে মুকুল মাসে একটা-দুটো করে পোস্টকার্ড পায়। চার-পাঁচ লাইনের চিঠি। মামুলি কথা।
“কেমন আছ? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করবে। রাত জাগবে না। আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না, আমি ভাল আছি। সবজি বাগানে এবার ফলন খুবই ভাল হয়েছে। বিশেষ করে পুঁই শাক আর লাউ। বাড়িতে এলে দেখতে পাবে।”
বাবার চিঠি পেয়ে মুকুল অবাক হয়। এই যুগেও কেউ চিঠি লেখে! লোকে শুনলে বিশ্বাস করবে না। তবে মানুষটার হাতের লেখা ভারী সুন্দর। নির্ভুল বানান। কাটাকুটি নেই। স্কুলে দীর্ঘদিন মাস্টারি করবার গুণ। তার উপর আবার ফাউন্টেন পেনে লেখা। ঝরনা কলম। কালি ভরে লিখতে হয়। এই ধরনের কলমের ব্যবহার তো আজকাল উঠে গিয়েছে।
মুকুল এখন এসেছে বাজারে। লন্ড্রিতে জামাকাপড় দিয়ে স্টেশনারি দোকান থেকে বিস্কুট, কফি কিনেছে। তারপর বাড়ি ফেরবার পথে পায়ে ঠোক্কর খেয়েছে।
প্ৰথমে পাত্তা না দিলেও দ্বিতীয় ঠোক্করে নীচের দিকে তাকাল মুকুল। যেন ইচ্ছে করে পায়ের সামনে এসে পড়ল ! না, ইটের টুকরো নয়, রাস্তায় ধুলো মেখে পড়ে আছে একটা কলম! ফাউন্টেন পেন!
রাস্তায় টাকা-পয়সা, দামি জিনিস পড়ে থাকলেও অনেকে হয়তো ফিরেও তাকাবে না, কিন্তু একটা কলম পড়ে থাকতে দেখলে লেখাপড়া জানা যে-কোনও মানুষই থমকে যাবে। মুকুলও থমকাল। নিচু হয়ে কলামটা তুলল। কার এটা? কালো রং, গোলগাল রাশভারী চেহারা। গায়ে সোনালি বর্ডার। ক্লিপের রংও সোনালি। এদিক-ওদিক তাকাল মুকুল। কেউ কি দেখছে? না, কেউ দেখছে না। নিজের জামাতেই ধুলো মুছে ঢাকনাটা খুলে ফেলল। সকালের রোদ পিছলে পড়ল সোনালি নিবে। ঝকমক করছে। যেন বুদ্ধি ঝলসে উঠছে! আহা! ভারী সুন্দর। কলম যে এমন সুন্দর হয়। মুকুল আগে জানতই না। কিন্তু জিনিসটা নিয়ে এখন কী করবে। সে? রাস্তায় ফেলে দিয়ে যাবে? সেটা ঠিক হবে না। মানুষের পায়ের চাপে, গাড়ির চাকার তলায় দুমড়ে মুচড়ে নষ্ট হয়ে যাবে। তা হলে? না, আর মাথা ঘামালো হবে না। অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কলমটা পকেটে গুজে বাড়ির দিকে পা বাড়াল মুকুল। এখন তো সঙ্গে থাকুক, পরে ভাবা যাবে।
বাড়ি ফিরে টেবিলের উপর কুড়িয়ে পাওয়া কলমটা ফেলে স্নানে ছুটল মুকুল। টেবিলটা অগোছালো। বই-খাতা, অফিসের রিপোর্ট, বাবার পোস্টকার্ড ছড়ানো। সারাদিন অফিসের চাপে কলমের কথা ভুলেই গেল মুকুল। ফোন ধরবার পর্যন্ত সময় ছিল না। মোবাইলটা পকেটে বন্ধ অবস্থায় পড়েছিল। এমন প্রায়ই হয়। অফিস থেকে বেরতে রাত আটটা। সল্টলেকের পথ নির্জন। বড় রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত হাঁটার সময় সকালে পাওয়া কলমটার কথা মনে পড়ে গেল। মনটা খচ করে উঠল। কলমের মালিককে পাওয়া যাবে কী করে? আচ্ছা, বাজারের সামনে যে স্টেশনারি দোকানটা রয়েছে। সেখানে রেখে এলে কেমন হয়? কেউ খোঁজ করতে এলে পেয়ে যাবে। এটাই ভাল হবে। নিশ্চিন্ত মনে তালা খুলে বাড়িতে ঢুকল মুকুল। আলো জ্বালল। মুখ, হাত ধুয়ে, জামাকাপড় বদলে এক মগ কফি বানিয়ে টেবিলের কাছে এল। রোজকার মতো টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বই পড়বে। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালাতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।
কলমের ঢাকনাটা খোলা কেন?
ভ্রুঁ কুঁচকে গেল মুকুলের। কে ঢাকনা খুলল? অফিসে যাওয়ার সময় তো বাড়িতে তালা দিয়ে বেরিয়েছিল। তা হলে? নিজেই ভুল করে খুলে গিয়েছে? মনে পড়ছে না। কে জানে মনের ভুলে হয়তো করেছিল। মনের ভুলে মানুষ অনেক উদ্ভট কাজ করে বসে। কলমের ঢাকনাটা আটকাতে-আটকাতে মুকুল দেখল, পাশে একটা পোস্টকার্ডও পড়ে আছে। কলমের ছায়ায় মিশে আছে যেন। নিশ্চয়ই বাবার পুরনো চিঠি। বইপত্র নাড়াঘাটার সময় সামনে এসে পড়েছে। আগে খেয়াল করেনি, এখন চোখে পড়ল। পোস্টকার্ডটা হাতে তুলল মুকুল। কেমন ভেজা লাগছে। জল পড়েছিল নাকি? চিঠিতে অল্প ক’টা লাইন লেখা, মুকুল কেমন আছিস বাবা? আমার শরীরটা ক’দিন ভাল যাচ্ছে না। মাঝে-মাঝে মাথা ঘোরে। পারলে একবার বাড়ি আসিস।”
মুকুলের হালকা চিন্তা হল। এই চিঠি কি সে আগে পড়েছে? নিশ্চয়ই পড়েছে। মাথা ঘোরার সমস্যা বাবার বহুদিনের। তারপরেও শনিবার গ্রামে যাবে বলে ঠিক করল মুকুল। একটা বই টেনে নিল, কিন্তু মন বসাতে পারল না।
গভীর রাতে মোবাইলের ঝনঝনাতিতে ঘুম ভাঙল মুকুলের। ধড়ফড় করে উঠে বসল। ফোন তুলে দেখল, গ্রামের হরেনকাকা। এত রাতে ফোন!
হরেনকাকা থমথমে গলায় বললেন, “দুপুর থেকে চেষ্টা করেও তোকে ফোনে পাইনি। হয় বলছে সুইচড অফ, নয় বলছে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। আজ সকালে তোর বাবা পুকুরঘাটে বসে কাকে যেন চিঠি লিখছিলেন, হঠাৎই মাথা ঘুরে যায়। পোস্টকার্ড, কলম হাত ফসকে জলে পড়ে। সেগুলো বাঁচাতে গিয়ে উনিও হুড়মুড় করে জলে পড়েন। মাথায় আর বুকে খুব লেগেছে। গ্রামের হেলথ সেন্টারে ভর্তি করিয়েছি, তুই কাল ভোরেই রওনা দে মুকুল…”
ভোরবেলা ব্যাগ গুছিয়ে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল মুকুল। কলমটা তুলে নিল। বাবা যদি বেঁচে থাকেন, কলমটা ফেরত দিতে হবে তো!
(সমাপ্ত)