লোকটার সাথে প্রথম দেখা কালীপূজোর ঠিক আগের দিন সন্ধেয়। বেশ মনে আছে শান্তুর। কালীপূজোর আগের দিন বলেই একটু তাড়াহুড়ো ছিল। বাড়ি যাওয়ার পথে ফাটাকেষ্টর ঠাকুরটা দেখে যাবে। তা পাথুরে গির্জার পিছনের রাস্তাটায় বসে এক ভাঁড় ফুটন্ত চা আর দুটি লেড়ো বিস্কুট খেতে কতই বা সময় লাগে? সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর ওইটুকু না হলে চলেনা শান্তুর। এরপর আবার শেয়ালদা থেকে বাদুড়ঝোলা ট্রেনে অন্যের বেল্ট কিম্বা জামার হাতা আঁকড়ে ধরে সেই রানাঘাট অব্দি চলো। কেউ কেউ আবার দিব্যি ওই নিরেট ভিড়ের মধ্যে দিয়েই গলে গিয়ে বেশ হ্যান্ডেল জাপটে ধরে ঘুমিয়ে পর্যন্ত পড়ে! পিছনের পকেটের চিরুনিটা অব্দি খোয়া যায়না তাদের। কি জানি বাবা–হাওয়া দিয়ে তৈরি বোধহয়।
সেই কথাই হচ্ছিলো মোহনদার সাথে। মোহনদা ধোঁয়া-ওঠা কেতলিতে দু’মুঠো চায়ের গুঁড়ো ছেড়ে দিয়ে বিজ্ঞভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললো “আরে ওদের হল বহুদিনের প্রাক্টিস। ওই লাইনে দেখ হয়তো ক্লাইভের আমল থেকে ডেলী প্যাসেঞ্জারি করছে। তোমার তো সবে কয়েকমাস হল। একটা বছর যেতে দাও, তুমিও দিব্যি লায়েক হয়ে উঠবে।”
তা ঠিক। মফস্বলের ছেলে শান্তু। অফিস টাইমের কলকাতার সাথে এখনো সড়গড়ো হতে পারেনি। সাত মাস হল চাকরি হয়েছে, এর মধ্যে একবার মানিব্যাগ খোয়া গেছে, একবার সাইডব্যাগে ব্লেড মেরেছে, সেদিন তো আসার পথে অত ভাল টিপিনবাক্সটা যে কি করে গায়েব হয়ে গেল! গেল তো গেল, দুপুরে মায়ের হাতের আলুর পরোটা ছেড়ে শেষে ঝালমুড়ি চিবোতে হল। সেই থেকে টিপিন আনাই ছেড়ে দিয়েছে শান্তু। এখন কি সুন্দর ডালহৌসীর ফুটপাথ থেকে ফ্রায়েড রাইস, দইবড়া আর কি কি সব ভাল ভাল খাবার খায়।
“মোবাইলটা নেহাত হাতে শক্ত করে ধরে থাকি বলে রক্ষে। নইলে এদ্দিনে ওটাও যেত – বুঝলে মোহন দা?”
“আরে এই তো সেদিন আমার ভগ্নীপতির অত শখের মোবাইল ভিড় ট্রেনে কে হাপিস করে দিল – অথচ সামনের বেঞ্চিতেই নাকি কে একজন নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে, বুকপকেটে আলগোছে মোবাইল রাখা, দিব্যি কিছুই হলোনা।”
এতক্ষণ বেঞ্চের অন্ধকার কোণটায় বসে জুলজুলে চোখে মন দিয়ে শুনছিল লোকটা। এমন সময় বলে উঠলো, “ভিড়ের কথাই যদি বলেন মশাই তা ভিড় হয় বটে শেয়ালদার দক্ষিণের শাখায়। ডায়মন্ড হারবার থেকে আসছেন আমার রাঙামাসীমা। সঙ্গে একগাদা মোটঘাট, হাতে ঝোলানো টিপিনকারিতে ওখানকার ভাল গুড় এক সের নিয়েছেন। ছেলেদের বাবা খেতে ভালবাসে। তা ট্রেনে সে কি ভিড়। ছুঁচ গলবার জায়গা নেই। রাঙামাসীমা কোনোরকমে ঠেলাঠেলি করে একদিকে সাইড হয়ে টিপেটুপে সব দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন – না বাবা মালপত্র যেখানকার যা সব ঠিকই আছে। এখন নিশ্চিন্তে স্টেশন ক’টা পার হলেই হয়। ট্রেনে লোক উঠছে তো উঠছেই। ওঠার পর এত লোক সেঁধোচ্ছে কোথায় সেটাই আশ্চর্যি! কামরা তো এতক্ষণে ছাদ অব্দি ভরে যাওয়ার কথা। ওরই মধ্যে যে বেগুনি শাড়ি আর সোনার হার পরা তিন মণ ওজনের মহিলা ঝুড়ির উপর বসে কি করে বেমালুম ফটাস জল খাচ্ছেন তা দেখলে তাজ্জব হতে হয়। তা এসব ভাবতে ভাবতেই সোনারপুর এসে গেল। আবার একপ্রস্থ ধাক্কাধাক্কি করে নেমে দেখেন শাড়ির পাড় ছিঁড়ে ফালাফালা, একটা বোঁচকা কম মনে হচ্ছে আর হাতে শুধুই হ্যান্ডেল, নিচ থেকে গুড়শুদ্ধু টিপিনকারি কে খুলে নিয়ে চলে গেছে। বেগুনি শাড়ি দিব্যি সোনার হার পরে পাশ দিয়ে সহানুভূতির হাসি হেসে চলে গেল। রাঙামাসীমা অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।”
এখন গল্প শুনতে বসলে শান্তুর দেরি হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি দাম মিটিয়ে হাঁটা লাগিয়েছে, দেখাদেখি রাঙামাসীমার বোনপো সেই লোকটাও উঠে পড়লো। ধর্মতলা থেকে ৫-নং ট্রামটা বেরিয়ে গেছে তখন, শান্তু ছোটাছুটি করে ট্রামে উঠে সুবিধামতন একজায়গায় বসে হাঁফ ছেড়ে দেখে সেই লোকটা কখন উঠে বেশ তার পাশের জানলার ধারের সীটটা দখল করে বসে আছে। শান্তুকে দেখেই একগাল হাসলো। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হলোনা। লোকটা তো তার পরেই বেরোলো, ট্রামে উঠলো কখন? এইবার ভাল করে দেখলো শান্তু। রোগা, কালো, একহারা চেহারা, কপাল জুড়ে একটা পুরনো কাটার দাগ, খয়েরি ডোরাকাটা ইস্তিরি-না-করা জামা আর ঢলঢলে কালো প্যান্ট পরা। লিকলিকে গোঁফ, টেরিকাটা চুল। মনে মনে হাসি পেল শান্তুর। এরকম ভাবেও আজকালকার দিনে কেউ চুল কাটে! এরকম চুল তো সেই তার বড়জ্যাঠার আমলে ফ্যাশন ছিল বোধহয়।
একটা অমায়িক হাসি হেসে লোকটা বলতে শুরু করলো, ‘আর বোলোনা ভাই, কলকাতার রাস্তাঘাটে যাতায়াত করা এখন এত ঝকমারি হয়ে গেছে। আগে কি ভাল ব্যবস্থা ছিল। হারুর দোকানে কচু্রি খেয়ে মুখ মুছে একটা পান গুঁজে ট্রামে উঠতাম, উঠেই এক ঘুমে রাস্তা কাবার। আর এখন সবসময় খেয়াল রাখো কে আড় চোখে তাকাচ্ছে, কে পকেটের কাছে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, কে ফাঁকা বাসে গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো – যত্তসব!”
শান্তু জানলা দিয়ে কালীপূজোর আলো দেখছে। ফাটাকেষ্টর ঠাকুর কি আদৌ দেখা হবে? যা ঢিকিস ঢিকিস করে এগোচ্ছে ট্রামটা।
গায়েপড়া লোকটা একঘেয়ে গলায় বকেই যাচ্ছে। “কলকাতায় নতুন, না? চায়ের দোকানে দেখেই বুঝেছি। তা মাথার কাছটা অমন টিবলি হয়ে আছে কেন? ধাক্কা লেগেছে নাকি?”
আলগোছে শান্তু মাথার কাছ টায় হাত বোলালো। পরশুদিন লেগেছে, আজও কি ব্যাথা। “ওই শেয়ালদা স্টেশনে একটা ঠেলার গায়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছিলাম আর কি – তেমন কিছু না।”
“অফিস যাওয়ার সময় নিশ্চয়?”
শান্তু মুখ নিচু করে হাসলো। কনুইএর ছা্লও উঠে গেছে সেটা আর বললোনা।
“না ভাই তুমি দেখছি একেবারে আনাড়ি। আরে এরকম ভাবে চললে তো – না দিনকাল এত বদলে গেছে, তাও লোকজন বদলালো না – মায়ের এক ছেলে নিশ্চয়?”
এবারও শান্তু মুখ নিচু করে হাসলো।
“আরে চলো চলো স্টপেজ পেরিয়ে গেল তো। ফাটাকেষ্টর কালী দেখবে না?”
বলে প্রায় হ্যাঁচকা টানে শান্তুকে চলন্ত ট্রাম থেকে হাত ধরে কলেজ স্ট্রীট বাটার মোড়ে নামিয়ে দিল লোকটা। বলতে নেই শান্তু একটু ভিতু। নিজে নিজে সে কখখনো এভাবে নামার সাহস করতো না। কিন্তু কই এই তো বেশ নামলো অথচ গায়ে আঁচড়টিও লাগলো না!
“আপনি কি করে জানলেন আমি ফাটাকেষ্টর কালী দেখবো?”
“আরে এ আর এমন কি কথা? বলছিলে না চায়ের দোকানে? আর এদ্দুর এসে মা কালীকে আজকের দিনে পেন্নাম না করে চলে যাব তা কি হয় নাকি? কি যে বলো ভাই।”
লোকটার কেমন বেশ একটা মাতব্বর ভাবভঙ্গি। শান্তু একটু ঘাবড়ে গেল। চোর-ডাকাত নয় তো রে বাবা!
ঠাকুর দেখা হল, পেন্নাম করা হল। শান্তু ছোট্ট করে একটু মনস্কামনাও করে নিলো। এর পাশের কোন গলিতেই নাকি অপূর্ব হিঙের কচুরি বানায়, লোকটা ধরে নিয়ে গেল শান্তুকে খাওয়াতে। গলির মধ্যে গলি, তার মধ্যে কানাগলি। ঝুপসি ঝুপসি বাড়ি এ ওর গায়ে হেলান দিয়ে কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছে। ভাঙা খড়খড়ির মধ্যে দিয়ে চটা ওঠা দেওয়ালে কবেকার হলদে হয়ে যাওয়া ক্যালেন্ডার আর তার পাশের তাকে গোল করে পাকানো তেলচিটে মশারি দেখা যাচ্ছে। তারই বাইরের রোয়াকে জরাজীর্ণ দুলালদা বিশাল কড়াইএ কচুরি ভাজছে। মনকেমন করা গন্ধে বাতাস ম ম করছে। শান্তু লোভে পড়ে একটু বেশিই খেয়ে ফেললো। তারপর পাশের গলিতে চা খেতে খেতে লোকটা কত গল্প করলো।
“এই পাড়াতেই জীবনটা কেটেছে বুঝলে ভাই? তখন এই ঝুরঝুরে বাড়িগুলোরই কি বাহার।
“এখন থাকেন কোথায়?”
“ওই তোমার সাথে যেখানে দেখা হল তার আশেপাশেই।”
শান্তু অবাক হয়ে ভাবলো। ডালহৌসী চত্বরে আবার কারোর বসতবাড়ি আছে নাকি? ধুর ওটা তো অফিসপাড়া।
“আরেক ভাঁড় চা হবে নাকি হে? এরা কিন্তু বেশ করে – আর তাছাড়া – সত্যি কথা বলতে কি – অনেক কাল পর কারোর সাথে কথা বলে একটু আরাম পাচ্ছি।”
শান্তু ঘড়ি দেখলো। না – এখনো হাতে সময় আছে কিছুটা। আর চা-টাও কিছু মন্দ না। লোকটাও না। লোকটার নাম সনাতন মুৎসুদ্দী। মাথার কাটা দাগটা চোখের পাশ দিয়ে কপাল বরাবর উঠে গেছে। কি করে হল কে জানে, সেলাইটাও ভাল করে হয়নি বোধহয় তখন, জায়গাটা কেমন যেন হয়ে আছে। দেখলে গা শিরশির করে। পুলিশের ফেরা্রি আসামী নয় তো রে বাবা! অথচ কথাবার্তায় কি আলাপী, কি বন্ধুত্বপূর্ণ আন্তরিক ব্যাবহার। অবশ্য খুনে গুণ্ডাদের তো এমনই হয় শোনা যায়। শেষে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তাকে আজ রাতে মায়ের সামনে নরবলি দেবে না তো!
এই রে! শান্তু একটা ঢোক গিললো। পেটটা কেমন খালি খালি লাগছে না? এই ভর সন্ধেবেলা টিমটিমে আধা-অন্ধকার গলি – যদি রাস্তা চিনে আর শেয়ালদা ফিরতে না পারে – তাড়া করলেই বা কোথায় পালাবে? কিন্তু লোকটার দেখা গেল সেরকম কোন ইচ্ছা নেই – দিব্যি এই গলি দিয়ে ওই গলি দিয়ে শর্টকার্ট করে শান্তুকে আমহার্ষ্ট স্ট্রীটের মোড়ে এনে তুললো।
“এত গলিঘুঁজি মনে রাখেন কি করে?”
“ধুৎ এটা কোনো একটা ব্যাপার হল? আরে সব গলিরই একটা নিজস্ব পরিচয় আছে। এই যে ধর ওই গলিটা – ওই গলিটার মুখে এলেই তুমি হিংএর একটা মনমাতানো সুবাস পাবে। আবার ধর এর পাশের গলিটা কিন্তু আবার কানাগলি, একটু নজর করলেই শেষ মাথায় নন্দীদের বাড়ির কারুকার্য করা থামগুলো চোখে পড়বে। মোড়টা পেরিয়ে বাঁহাতের বাঁকা গলিটার মুখে আবার যত কাপ্তেন ছেলের আড্ডা। অবশ্যি শহরটা চোখের সামনে এমন বদলে যাচ্ছে, আমিও মাঝেমধ্যে কেমন দিশাহারা হয়ে যাই। বছরখানেক পরপর আসি তো, প্রতিবারই দেখি কিছু না কিছু ঠিক বদলে গেছে।”
“কেন – বছরখানেক পর পর কেন? অন্য সময় কোথায় থাকেন?”
“আরে কি বলব ভাই – আমাদের যা কাজ না তাতে মরলেও নিষ্কৃতি নেই, বুঝলে? এই বছরে একটা দুটো পালা-পার্বণে যা একটু রেহাই মেলে। তখন আসি এ্রদিকটায়, পুরনো পাড়ায় একটু ঘুরে যাই।”
“ডালহৌসীর দিকে কোথায় থাকেন বুঝলাম না। ওখানে তো শুধু সারি সারি অফিস!”
“আরে ওখানেই খাপে-খোপে আমরা কয়েকজন থাকি হে। আর সত্যি কথা বলতে কি এই শেয়ালদার দিকটায় আর তো জায়গা সঙ্কুলান হয় না। নিত্যিদিন নতুন নতুন পাবলিক আসছে। কে ট্রেনের খদ্দের, কে বাসের, কে আবার সটান কোন গঙ্গার ঘাট বেয়ে উঠে এলো। পাথুরে গির্জার দিকটা একটু বেশি সাবেকি বলে সেখানে নতুন বাবুরা অত ভিড় করেন না। তা আমাদের কয়েকজনের মিলেমিশে ওদিকে দিব্যি হয়ে যায়।”
অ – তা ভদ্রলোক মনে হছে ডালহৌসীর দিকে কোনও খাবারের দোকানের কর্মচারী। সত্যি তো এই দু চারটে দিনে অফিসপাড়া ছুটি থাকলে তবেই না একটু ফাঁক পাবেন। ধুৎ শান্তু মিথ্যে কেমন সন্দেহ করছিলো। মন থেকে এই বাদুড়ঝোলা ভয়গুলো যে কবে যাবে।
এর মধ্যে একবার আবার মিষ্টিপান খাওয়া হল। এদিক ওদিকে ঘুরে আরো দু-চারটে ঠাকুর দেখা হল। লোকটা মহা আড্ডাবাজ। শান্তুর মনটা যে কখন গল্পের টানে লোকটার বুকপকেটে ঢুকে পড়েছে, কিছু বোঝাই গেলোনা। মোটকথা মেলা গল্পগাছা করে শান্তু যখন শেয়ালদা স্টেশনে এসে পৌঁছালো তখন ভয়াবহ ব্যাপার। লাস্ট ট্রেন নাকি কখন চলে গেছে। মানে! এখন তো হাতঘড়িতে সবে ৭-৪০ বাজে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো শান্তু। সত্যিই তো কত রাত হয়ে গেছে, রাস্তায় লোক কম, আওয়াজ কম। এতক্ষণ কোথায় ছিলো সে? কিছুই বুঝতে পারেনি। তাহলে কি ঘড়িটা বন্ধ হয়ে আছে সেই সন্ধে থেকেই? কখন বন্ধ হয়ে গেল? এতক্ষণ – এতক্ষণ গল্পে গল্পে কেটে গেল – খেয়ালই নেই তার! শান্তুর তো মাথায় হাত। এবার কি হবে, কি করে বাড়ি ফিরবে, মা চিন্তা করবে, যদি আজ রাতে ফিরতে না পারে – তবে কি, তবে কি ফুটপাথে বসে কাটাবে? যদি গুণ্ডায় ধরে? যদি মাস্তানে এসে টাকা চায়? তার জন্মদিনে পাওয়া নতুন মোবাইল – সেটাও কি নিয়ে নেবে? আর যদি না দিলে তাকে ছুরি মারে? কি নখ উপড়ে নেয়? বাবা গো! রাশি রাশি আতঙ্ক ঝুপ ঝুপ করে এসে শান্তুর মনে বেমালুম ঝুলে পড়লো। শান্তু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। একটা বস্তাভর্তি ঠ্যালা দড়াম করে মেরে বেরিয়ে গেলো। শান্তু ছিটকে পড়লো মেঝের উপর। লোকটা ছুট্টে এসে ধরে ওকে দাঁড় করিয়েই এক ধমক “আরে অমন দিশাহারার মত একবার এদিক একবার ওদিক করে হাঁটো কেন? ওইজন্যই তো ধাক্কা খাও। যখন হাঁটবে গটগট করে কোনো একদিকে হাঁটবে। ঠেলা বা লোক এলে ছোট্ট করে পাশ কাটিয়ে যাবে।”
“এখন কি হবে? বাড়ি যাব কি করে সনাতনদা? স্টেশন থেকেও তো রাত্রিবেলা বার করে দেবে।” শান্তু অসহায়ের মত লোকটার হাত চেপে ধরলো।
“আরে তুমি তো দেখি রামভিতু ছেলে। আরে পুরুষ মানুষ, এমন ফ্যাঁচফ্যাঁচে হলে চলে নাকি হে? ট্রেন ফেল করেছো তো কি হয়েছে, ছেলেধরা ধরে আরবদেশে চালান করে দেবে নাকি? চলো চলো আমার সাথে এক জায়গায় চলো দেখি।”
কি জানি, এই লোকটা নিজেই একটা ছেলেধরা নয় তো? কিম্বা চোরের সর্দার? কিম্বা হয়ত ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে কিডনি খুবলে নিলো? এই তো সেই কখন থেকে কথার ফাঁদে ভুলিয়ে শান্তুকে আটকে রেখেছে। কত কিছুই তো আজকাল কাগজে পড়ে শান্তু। বলতে গেলে মাই শান্তুকে পড়ে পড়ে শোনায়। আর সাবধান করে। ওরে শান্তু রাস্তাঘাটে অচেনা লোকের সাথে ভাব করবিনা, নিজের নাম-ধাম জাহির করবিনা, গণ্ডগোল দেখলে মটকা মেরে সরে পড়বি, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে পান-বিড়ি খাবিনা, সিনেমা দেখে চুলের ফ্যাশন করবিনা – আরো কত কি হ্যানাত্যানা। এখন মনে হচ্ছে মায়ের কথা শুনলেই হত। কি মরতে যে এই লোকটার খপ্পরে পড়লো, নয়লে এতক্ষণে দিব্যি বাড়ি চলে গিয়ে পোষা বিড়ালটাকে আদর করতে পারতো। মা মাগো –
“আরে ধুর কি ভাবছো এতক্ষণ ধরে বলত? আরে আমি চোর–ছ্যাঁচড় নইরে বাবা। চোর হলে না সেই কখন তোমার মানিব্যাগ মেরে হাওয়া হয়ে যেতুম। ও অভ্যেস তো আর শুধু জন্মে যায়না। যেভাবে মানিব্যাগ পকেটের মধ্যে খামচে ধরে থাক – সবাই ধরতে পারে মানিব্যাগ আছে। ওইজন্যই তো লোপাট হয়। মানিব্যাগ বড় ব্যাগটায় রেখে বড় ব্যাগটা বুকের সামনে এনে শক্ত করে ধরে থাকবে, দেখ তো কার সাধ্যি চুরি করে?”
না শুধুমুধু লোকটাকে চোর ভাবছিল। চোর কি আর আগে থেকে নিজের সম্পর্কে সাবধান করে দেয়? আর সনাতনদা তাকে কত ভালবাসছে। আর তার ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে, তাতে সনাতনদার কি দোষ? কেমন নিজের হাতে তার চুল ঠিক করে দিল। যাওয়াই যায় সঙ্গে।
“আর এত ভয় পাও কেন বল তো হে? পকেটমারের ভয়, গুণ্ডার ভয়, বাসে চাপা পড়ে মরবে তার ভয়, কুকুরে তাড়া করবে – ভয়, আখের রস খেয়ে ন্যাবা হবে – ভয়, আছাড় খেয়ে পড়েছো বললে লোকে হাসবে – তাতেও ভয় – সবকিছুতেই ভয়। জানো – মানুষ ভয়টাকে যতটা ভয় পায়, আসল জিনিসটাকে ততটা নয়? আসল জিনিসটা তোমার ঐ ভয়ের চেয়ে অনেক কম ভয়াবহ, বুঝলে? ঐ ভয় করতে করতেই দেখবে একদিন কবে মরে ভূত হয়ে গেছো – আর তখন বলা যায়না – দেখবে নিজেকেই হয়তো নিজে ভয় পাচ্ছো।”
বকাঝকা খেতে খেতেই গলি তস্য গলি দিয়ে যে নড়বড়ে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালো দুজনে সেটা একটা ছাপাখানা। জগুদা জগুদা বলে ডাকতেই এক খান নাদুসনুদুস আহ্লাদী ভদ্রলোক এক গাল হাসি হেসে থপ থপ করে বেরিয়ে এলেন। “আরে সনাতন ভায়া যে, তা সঙ্গে এটি কে? নতুন পাবলিক বুঝি? এর আবার কি কেস? না— কোথাও তো কোন ফাটা ছেঁড়া দেখছি না – তা ফলিডল খেয়েছে নাকি?”
ফলিডল? না না সে তো কচুরি খেয়েছে – আর চা।
“আরে না না – ভালো করে দেখ একবার।”
কি দেখলো কে জানে জগুদা। কিন্তু চোখ চকচক করে উঠলো। শান্তুর আবার দম বন্ধ হয়ে গেল। এই ছাপাখা্নার ঝুপসি অন্ধকারে আবার গুমখুন করবে না তো! আর তারপর হয়তো ছাপাখানার মেঝেতেই পুঁতে দিল। হায় হায় – মা গো মা তুমি কোথায়? মা —
জগুদা কিন্তু খুব রগুড়ে লোক দেখা গেল। সারা মুখে হাতে ছোপ ছোপ কালি। “আরে আমরা হলাম গিয়ে যাকে বলে ছাপাখানার ভুত – বুঝলে হে? এই কালি মাখামাখি হয়েই থাকতে হয় আর কি।”
তারপর সে কি গল্প – যেন শান্তু কতদিনের চেনা। জগুদার মাথার পিছন দিকটা কেমন যেন থ্যাবড়া মতন, সামনে থেকে বোঝা যায়না।
জগুদা লক্ষ করলো – “আরে সে কি বলবো, এই ঠিক এইখানটায় বসে কাজ করছি, আমার তিন বছরের ভাইপো চিন্টুটা টলমল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ করে ছাদ থেকে একটা চাঙড় খুলে পড়লো। আমি চিন্টুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম। চাঙড়টা এসে পড়লো ঠিক আমার মাথার এই খানটায়। ব্যাস – হয়ে গেল, এই যে দাগ দেখতে পাচ্ছ – যাকগে চিন্টুর কিছু হয়নি, এইটাই আসল – চিন্টু আমাদের এখন বেশ লায়েক হয়েছে বুঝলে সনাতন।”
পাশের দোকান থেকে গরম গরম হাতরুটি আর মাটির ভাঁড়ে করে ডিম তড়কা এনে তিন জনে গুছিয়ে খাওয়া হল। তারপর আবার এক রাউন্ড করে চা। জগুদাই করলো, ছাপাখানার মধ্যেই ব্যবস্থা আছে। এদের দেখা গেল সব আড্ডা মারার মুড। খুব গল্প হল, বেশিরভাগই পুরনো দিনের গল্প। এরই মধ্যে আবার এক পীস অদ্ভুত ছেলে এল। লম্বা জুলপি, টেরিকাটা চুল, এই মাঝরাতেও গগলস পরা, সিড়িঙ্গে চেহারা, সবচেয়ে অদ্ভুত গলাটা এমন লিকলিকে লম্বা যেন কেউ টেনে লম্বা করে দিয়েছে। পরেছে একটা ঝলঝলে সিল্কের খুনখারাপি রঙের জামা, তার উপরে আবার গায়ে মাথায় একগাদা কুমড়ো সস পড়ে মাখামাখি অবস্থা।
“জগুদা শীগগিরি একটা ন্যাকড়া দাও তো। আরে দেখ না, চাউমিন খেতে গেলুম, তো সসের বোতল উল্টে পড়বি তো পড় আমার ঘাড়ে। আমার সাধের চুলটা অব্দি নষ্ট হয়ে গেল। কোনো মানে হয়! এদিকে আবার নাইট শোর ফিলিমটা শুরু হয়ে যাবে – কি যে করি – দূর ছাই।”
জগুদা ন্যাকড়া এগিয়ে দিতেই সে বিদ্যুৎগতিতে পরিষ্কার হয়ে গেল। তারপর অতি যত্নে চুল আঁচড়ে পকেট থেকে এসেন্স বার করে মেখে নিল।
জগাদা ব্যাজার মুখে বললো “ওহ – এই ফটিকটাকে না আর মানুষ করা গেলো না। সেই ফিলিমস্টার হওয়ার জন্য হেদিয়ে মরলো। স্বভাব যায়না মলে। এখন আবার চাউমিন খেতে শিখেছে। চুল আঁচড়াচ্ছে দেখো, যেন কুঁচবরণ কন্যা, মেঘবরণ চুল – ওহ ছেলে আমাদের উত্তমকুমার হবে।”
“আরে দূর কোন উত্তমকুমারের যুগে পড়ে আছো! এখন হল শাহরুখ খান – বুঝলে শাহরুখ খান – বলিউড কি বেতাজ বাদশা।”
“হ্যাঁ তুই ওই নিয়েই থাক – জ্যাঠা ছেলে কোথাকার। এত ঝুললি এই করতে গিয়ে তাও শিক্ষা হলোনা।”
ছেলেটা ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। তার আবার সিনেমা মিস হয়ে যাবে কিনা। এত রাত্রে কোন হলে সিনেমা চলছে সেটাও একটা প্রশ্ন। যাকগে।
রাত্তিরবেলা ছাপাখানায় কি সব অদ্ভুত আওয়াজ হয়। উঁচু উঁচু ছাদ, কিসব ঝুলকালিতে অন্ধকার হয়ে আছে, জানলা দিয়ে রাস্তার মিটমিটে হলুদ আলোয় কে সব ঝাপসা মতন ঘুরে বেড়াচ্ছে, দূরে কারা সব জানি হল্লা-চিৎকার করছে, বোমের আওয়াজ, বাজির সোঁ সোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর মাঝে মধ্যে দু একটা কুকুর করুণ সুরে কেঁদে উঠছে। এই গলিটা কোথায়, আজকের রাতেও আশেপাশে কোনো লোক নেই, এমন কি ছাপাখানাতেও জগুদা ছাড়া আর কাউকে দেখলো না। কি গা-ছমছমে পরিবেশ। অন্য সময় হলে শান্তু মরে গেলেও এই জায়গায় থাকতো না। কিন্তু এখন তো সনাতনদা আছে, জগুদা আছে, পেটভর্তি ভাল ভাল খাবার, জগুদার প্রাণখোলা হাসি চারিদিকে ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসছে। শান্তুর চোখ বুজ়ে এল আস্তে আস্তে। ঘুম, গভীর ঘুম।
কখন রাত পেরিয়ে গেছে, সনাতনদা কাঁধে নাড়া দিয়ে ডাকছে। শান্তু ধড়মড় করে উঠে বসল। বাইরের অন্ধকার একটু পাতলা হয়েছে, কাক ডাকছে, গরম চায়ের গন্ধে ঘর ভর্তি। চা খেতে খেতেই সনাতনদা তাড়া লাগালো। “তাড়াতাড়ি কর হে, আর বেশি সময় নেই হাতে।” কিসের এত তাড়া ঠিক বোঝা গেলো না। এদের সঙ্গে তো দিব্যি সময় কাটছিলো। সনাতনদা বোধহয় মনের কথা বুঝতে পারলো। ওকে নিয়ে বাইরের রাস্তায় এসে মুখটা কেমন দুঃখী দুঃখী করে দাঁড়িয়ে রইলো। একটু দূরে চায়ের দোকানের ঝাঁপটা সবে খুলতে শুরু করেছে। আকাশ একটু ফিকে হচ্ছে, কোথায় যেন ভোরের আজান দিচ্ছে।
সনাতনদা বিষণ্ণ গলায় বললো “শান্তু আমরা হলাম জলের দাগের মতো বুঝলে? জলের দাগ দেখেছো তো? শানের উপর জল দিয়ে একটা দাগ টানবে, একটুক্ষণ থাকবে, তার পর হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। আমরাও তেমন, এই একটা রাত – তারপরে ভোরের আলো ফুটলেই মিলিয়ে যেতে হবে।”
“মানে?”
“মানে – মিলিয়ে যেতে হবে। আহা ছোটোবেলায় মা-দিদিমার কাছে রং-বেরঙের গল্প শোনোনি? সেই যাদের ছায়া পড়েনা, উল্টো দিকে পা, কর্পুরের মত উবে যায় – এই আমি, জগুদা – ফটিক – আমরা হলাম গিয়ে সেই তারা – মানে যাকে বলে ভূত।”
“ভূ-ভূ-ভূ-ত?” শান্তুর গলা শুকিয়ে কাঠ।
“আরে এতে এত ঘাবড়ে যাওয়ার কি আছে হে?” জগুদা কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাগ রাগ গলায় চেঁচিয়ে উঠলো “সারা রাত তো আমাদের সাথে রইলে, তোমাকে কামড়েও দিইনি, ঘাড়ও মটকাইনি, রক্তমাখা জামা পরে ভয়ও দেখাইনি। ভুত নিয়ে এত আজগুবি গপ্পো যে কোত্থেকে গজায়! আর তোমরাও বটে – সেগুলো শুনে শুনে আর যত হাবিজাবি ফিলিম দেখে আমাদের কি না কি রাক্ষস-খোক্কস ভাবো – যত্তসব।”
শান্তু ভ্যাবলা চোখে সনাতনদার দিকে তাকিয়ে আছে। সনাতনদার কাটা দাগ বরাবর মাথাটা কেমন খুলে যাচ্ছে মনে হচ্ছে, মাঝখান দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। সেটা লক্ষ্য করে সনাতনদা একটু ফিচেল হাসি হেসে বললো “এই রকম একটা ভোরবেলাতেই দুধ নিয়ে ফিরছি, একটা বাস ছিটকে ফেলে দিলো ফুটপাথে। মাথাটা দু ফাঁক হয়ে গেলো। দিব্যি মরে গেলাম। মরা ইস্তক চেষ্টা অনেক করছি বুঝলে, কিন্তু পুরোটা আবার কিছুতেই জোড়া লাগেনা, আঠাটা পুরনো হয়ে গেলেই খালি খালি খুলে আসে – কি যে মুশকিল না!”
শান্তুর পাটায় আর জোর নেই, সারা গায়ে আর কোথাওই কোনো জোর নেই।
“ও কি, ও কি অমন ল্যাগব্যাগ করছো কেন হে? আচ্ছা ভিতু ছেলে তো! দেখ কাণ্ড–”
বলতে বলতেই সনাতনদার মাথাটা আদ্ধেক খুলে ঝুলে পড়লো আর সেই সঙ্গে শান্তুও ফিট হয়ে সোজা রাস্তায়।
চায়ের দোকানদার যখন জল-টল দিয়ে শান্তুর জ্ঞান ফেরালো তখন সকালের নতুন আলো রাস্তা ছুঁয়েছে। দূরে, বেশ কিছুটা দূরে একটা কোণাচে বাড়ির আবছা অন্ধকারে দুটো মূর্তি ওর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত নাড়ছে, একজন অন্য হাত দিয়ে মাথাটা ধরে রেখেছে। আস্তে আস্তে আলো সেই দিকে এগোলো আর মূর্তিদুটোও ঐ ঠিক কর্পুরের মতোই উবে গেল চোখের সামনে থেকে।
তারপর শান্তু কি ভাবে বাড়ি ফিরলো সে শান্তুও জানেনা। এটাও জানেনা ঘড়িটা আবার আপনাআপনিই কখন ঠিক সময় দিতে শুরু করলো।
পরে গিয়েছিল শান্তু ওই দিকটায়। দুলালদা র দোকানের কোনো অস্তিত্বই নেই। কবে উঠে গেছে। চায়ের দোকানটাও। নন্দীদের বাড়ির খয়াটে থামের তলায় এখন ডালমুট-ঝুরিভাজা বিক্রী হয়। তবে হ্যাঁ, ছাপাখানাটা আছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ওই ছাপাখানার চিন্টু বলে একটা ছেলের সাথে এখন শান্তুর বেশ ভাব হয়ে গেছে। শান্তুদের অফিসের বিল বই হ্যানাত্যানা ছাপিয়ে দেয়। না – সনাতনদা কিম্বা জগুদার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তবে শান্তু নিশ্চিন্ত – পরের বছর ভূত চতুর্দশীর দিন ওই কচুরির গন্ধ-মাখা গলির সামনেটাতে গেলেই দেখা হয়ে যাবে সনাতনদা র সাথে।
এখন শান্তু আর ভয়ও পায়না। ভয়গুলো সব সেদিনই সনাতনদা আর জগুদার সাথে রোদের ছোঁয়া লেগে কোথায় যেন উবে গেছে। এখন আড্ডা-টাড্ডা মেরে লাস্ট ট্রেনে গেটের সামনে ঝুলে হাওয়া খেতে খেতে বাড়ি ফিরতে দিব্যি মজা লাগে। সেই তাদেরকে ও দেখে মাঝেমধ্যে – দুর্ভেদ্য ভিড়ের মধ্যে বেঞ্চে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে ঘুমোচ্ছে কিম্বা এর তার গায়ে ভর দিয়ে দেশলাইকাঠি দিয়ে খুদে চিরুনি পরিষ্কার করছে। গায়ের উপর দিয়ে লোক চলে যাচ্ছে – কোনো বিকার নেই। কি করেই বা থাকবে – জলের দাগ সব। শান্তুর দিকে তাকিয়ে কেউ কেউ আবার মিচকি হাসে। ও হ্যাঁ – ফটিককেও একদিন দেখেছিল শান্তু – ট্রেনেই। সেদিন রাতের লোকালটায় কাঁঠালবোঝাই ভিড়, যদিও শান্তু জানলার ধারে সীট পেয়েছে। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে গেটে রাশি রাশি লোক ঝুলছে আর পিছনদিকে ফটিকও – ফিল্মি কায়দায় শুধু একটা পা কোনোরকমে লাগিয়ে রেখে দুই হাত দিয়ে চুল ঠিক করছে। এই রে – পাশের সীটের মহিলা দেখলেই তো এখন মুচ্ছো যাবেন – তারপর চিৎকার চেঁচামিচি – জল আনো রে, বাতাস করো রে।
শান্তু কটমট করে তাকাতেই ফটিক এক হাত জিভ কেটে খপ করে হাতল ধরে ফেললো। তারপর ঠিক ফ্যাকফ্যাক করে হাসলো। শান্তুও হেসে ফেললো। না – কড়িকাঠ থেকে রামঝোলান ঝোলার পরেও ফটিকটা আর মানুষ হলোনা।
(সমাপ্ত)