আমার নাম রুবি।
আপনারা অনেকেই আমার ইতিহাস জানেন।
আমি মা-বাবার এক মেয়ে। একজন রক্তচোষা ঝি-এর হাতে পড়েছিলাম—যাকে “ভ্যাম্পায়ার ওম্যান’ (Vampire woman) বলা হয়। সেই ঝি-টা আঠারো নম্বর শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটে সর্বপ্রথম হানা দিয়েছিল, আমি যখন কলেজে ঢুকেছি। তার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম অতিকষ্টে। তারপর গেলাম হাজারিবাগ রোডে চারবছর পরে। সেখানেও বেনে গিন্নির ঝি সেজে রাসমণি রক্ত চুষতে এসেছিল।
দ্বিতীয় বার রাসমণির হাত থেকে প্রাণটা আমার বাঁচল! কিন্তু মন কালো করে এক বাজপাখি ভয় পাখনা মেলে জেগে থাকে : রাসমণি এখনও বেঁচে আছে। হাজারিবাগ রোড থেকে সেবার কলকাতায় ফিরে গোটা তিনটি মাস বিছানায় পড়েছিলাম। একরাত্রে শয়তানী রাসমণির আক্রমণ জীবন রক্ষা পেলেও শরীর ভেঙে পড়েছিল। ক্ৰমাগত ভয় পেয়ে পেয়ে দেহপাত হয়ে গিয়েছিল। বাবা ডাক্তার লাগিয়ে হাত জোড় করে বললেন, যা যা বলুন সবই করা হবে, শুধু হাওয়া বদল বাদে! ওটি চলবে না।
প্রায় একবছর লাগল আমার সুস্থ হয়ে উঠতে! রাত্রে কেঁপে উঠতাম! ঘুম হতো না! খেতে পারতাম না! অনেক চিকিৎসা ও শুশ্ৰষার পরে আমার দেহমন স্বাভাবিক হল! এর মধ্যে সুশান্ত লেখাপড়া শেষ করে চাকরি নিয়েছে! কেতকী বি. এ পাশ করেছে, বি. টি পড়ছে! খুড়তুতো ভাই মুকুল ও মনীশ দুজনেই বিদেশ চলে গেছে। একজন ডাক্তারি পড়তে, অন্যজন ইঞ্জিনিয়ারিং! আমার সব চেয়ে ছোট ভাই শোভন বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে চলেছে!
আর আমি? রাসমণির ঘটনায় আমি দুবার পড়ায় ভাঙতি দেওয়াতে বেশ দেরি করে এম. এ পাশ করেছি! মনে জোর এনে লেখাপড়াটা আমার শেষ করতে হয়েছিল! শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট ছেড়ে আমরা বালিগঞ্জে রাসমণির ঘটনার পরেই চলে এসেছিলাম। এখন কলকাতার বাসিন্দাই হয়ে গেছি আমরা! দেশ থেকে অবশ্য নিয়মিত টাকাকড়ি আসে জমিদারি থেকে ; সেখানে কাকা কাকিমা দেখাশোনায় আছেন! প্রথমে ইউনিভার্সিটি যেতাম ভয়ে ভয়ে! বাড়ির গাড়িতে সরকারমশাই পৌছে দিতেন রোজ রোজ! তারপর ভয় কমে গেলে শেষের বছরটা একাই যাতায়াত করতাম।
ক্ৰমে ক্ৰমে জীবনে সাহস ও উৎসাহ ফিরে এলো আবার। দেখলাম পৃথিবী কত উজ্জ্বল। সকলে কি আনন্দে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে স্বাধীনভাবে। আমার মতো একটা ভয়ের তাড়া খেয়ে কেউ পালিয়ে নেই। কলেজ স্ট্রিটের দোকানগুলোয় কত আনন্দ, কত উৎসব! মেয়ে, ছেলে নদীর স্রোতের মতোই ভেসে চলেছে আনন্দের টানে। চারদিকের জীবনে উৎসাহ! কবে আমার কি ঘটেছিল, একটা ঘৃণ্য রক্তচোষা স্ত্রীলোক আমার রক্ত চুষে খাবার আশায় দু’দুবার যে আমার পিছু নিয়েছিল, সে কথা কি মনে করে বসে থাকতে হবে ঘরে দোর দিয়ে, খিল লাগিয়ে ? সে তো ব্যর্থ হয়েছেই। আর কেন? এতদিনে মরেই গেছে রাসমণি। সুশান্ত গুলি লাগিয়েছিল ওর পায়ের গোড়ালি ঘেষে লেগেছিল। রক্তের দাগও ছিল পথের খানিকদূর পর্যন্ত। গুলি খেয়েই মরে গেছে ও!
শেষে কলকাতার এক কলেজে কাজ নিলাম। জীবনটা বেশ চমৎকার কেটে যেতে লাগল। পৃথিবীর কোথাও যে ভয় থাকতে পারে ভুলেই গেলাম। সেবার শীতের ছুটি। এমন সময়ে এক সাহিত্য সম্মেলনে হঠাৎ ডেলিগেট হয়ে গেলাম। দেশবিদেশ দেখার ইচ্ছা চিরদিনই ছিল। মধ্যে ভয়ের তাড়া খেয়ে পারতাম না কোথাও যেতে স্বচ্ছন্দে। কিন্তু সে তো বহুদিন আগের কথা। এম. এ পাশ করে স্বাধীন চাকরি নিয়ে আমার যেন সাহসটা ফিরে এলো। দিব্যি স্বাধীন কাজকর্ম করছি। অতগুলো টাকা মাস মাস হাতে পাচ্ছি! ফলে জীবনে শখ মাথা তুলল। এখান-ওখান বেড়াতে শুরু করলাম নিজের পয়সায়।
সরকার মশাই এখন অতিশয় বুড়ো হয়ে দেশে চলে গিয়েছেন। যাবার আগে একটি
উপদেশ আমাকে দিয়ে গিয়েছেন:
‘রুবি মা, সাবধানের বিনাশ নেই।
তাই সাবধান হতে ভুলতাম না প্রায়ই, কিন্তু হাসি পেত আমার পূর্ব জীবনের ভয়ের স্মৃতি মনে পড়ে।
যাই হোক, দল বেঁধে আমরা চারটি অধ্যাপিকা রওনা হলাম দক্ষিণ ভারতে সাহিত্য সম্মেলনে ডেলিগেট হয়ে। এদিকে পূর্বে কেউ আসিনি। আশেপাশে যতটা পারি দেখে নেব স্থির করেই গেলাম।
প্রথম তিন দিন চলল সম্মেলন বড় শহরে। আমরা খুবই ব্যস্ত রইলাম এ তিনটি দিন। তারপর ডেলিগেটের ক্যাম্প বন্ধ হওয়ায় আমরা একটা ছোটখাটো হোটেল খুঁজে নিলাম। এখানে কয়েকদিন থেকে শহরটা দেখে নেব। তারপর পাশের শহরগুলোও যতটা পারি দেখব।
বন্ধুরা বলল, “ভালো হোটেল পেতে হলে আগে ব্যবস্থা করে রাখতে হয়। এখন যা পেয়েছি, এতেই থাকতে হবে। ছোট-গলির মধ্যে একটা দোতলা বাড়ি। পাশে খানিকটা দূরে শহরের যত আবর্জনা ঢালা হচ্ছে। বাড়িটার মধ্যে অবশ্য যথাসাধ্য পরিস্কার রাখা হয়েছে। সামনে ছোট একফালি লনও আছে। একটা ঘর পেলাম। তিনজনের যোগ্য ঘরে আর একটি চৌকি ঢুকিয়ে তাকে চারজনের মতো করে দিয়েছে। পুরো নিরামিষ হোটেল, দক্ষিণ ভারতের সাধারণ চটিশ্রেণীর হোটেলগুলোর মতোই।
সাদা-কাপড় পাতা একটা টেবিল, দুখানা শক্ত চেয়ার ঘরে ছিল। আমরা ঠিক করলাম কোনোমতে কটা দিন এখানেই খাবার আনিয়ে খেয়ে কাটিয়ে দেব। মোটামুটি একটা আস্তানা ঠিক করে শান্তি হল। গলিটা বড় ছোট, এই যা অসুবিধা। পাড়াটাও আর একটু পরিস্কার হ’লে ভালো হতো। গলির শেষে খানিকটা খোলা জায়গা আবর্জনা ফেলে ভরিয়ে রাখা। নিশ্চয় ময়লা ফেলার গাড়ি কোনো এক সময়ে এগুলো নিয়ে যায়। জায়গাটার ওপাশ দিয়ে সরু পায়ে-চলা রাস্তাটা কোথায় গেছে কে জানে?
আমরা শহরটা দেখবার আশায় গলি ছেড়ে অপেক্ষাকৃত বড় রাস্তায় এলাম। এখানে ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যায়। একখানা গাড়ি ভাড়া করে আমরা ঘুরে ঘুরে বেড়ালাম। শহর মন্দ নয়, কিন্তু বড় নির্জন। সাহিত্য সম্মেলনটি এখানে বসবার একমাত্র কারণ এখানকার রাজা প্রচুর অর্থ দিয়েছেন সাহায্যকল্পে। একদল লোক আছে হুজুগে। তারা দক্ষিণ ভারত দেখার লোভে এখানে সভা করতে রাজি হয়েছে। নইলে দল বেধে আসার মতো নয় স্থানটি। যাই হোক, এসেই যখন পড়েছি, তখন ভালো করেই বেড়িয়ে ফিরব। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, জায়গাটি, ভরা ভিখিরি। ‘এখানে এত ভিখিরি কেন?
নন্দা, আমাদের ইংরেজি অধ্যাপিকা, জিজ্ঞাসা করল ‘এ সমস্ত জায়গার লোকেরা বড় গরিব। খেতে পায় না। তাই ভিক্ষে করে বেড়ায়।
বাংলার অধ্যাপিকা মীরা উত্তর দিল।
রেবা সোমকে আমরা ঠাট্টা করে ‘ভীমভবানী’ বলতাম। সে দেহচর্চার ভার পেয়েছিল কলেজে।
রেবা বলে উঠল, ‘একবার আমি এখানে বসলে লোকগুলোকে কাজ করাতাম। ভিক্ষে করে বেড়ানো চলত না।’
আমরা হেসে উঠলাম।
‘তুমি বসে যাও এখানে, ভীম ভবানী। একটা ভালো মতো সার্কাসের দল খোল। বুকে হাতি তোল। পিঠে লোহা ভাঙো।’
রেবা বলল, ‘পারি না নাকি আমি? বুকে হাতি তুলতে না পারলেও আমি দাঁত দিয়ে কতটা ওজন তুলছি আজকাল, দেখছ না ? একটু-একটু করে অভ্যাস করছি। ধীরে ধীরে সমস্ত হবে। কেবল মেয়েদের ড্রিল আর খেলা নিয়ে থাকলে আমার চলবে না! নিজের শরীর গঠনে মন দিতে হবে। বাঙালি মেয়ের বদনাম আছে, তারা দুর্বল। আমি দেখিয়ে দেব। শরীরের বলে ভীমভবানী না হতে পারলেও দাঁতের জোরে পারব।”
পাতলা ছিপছিপে ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাকট্রেস রেবা একসারি ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে হেসে উঠল। ছেলেবেলা থেকেই রেবার দাতে ভয়ানক জোর। সে তাই সারাদিন দাঁতের তোয়াজ নিয়েই থাকে। সকালে উঠেই আর যা হোক না হোক দাঁত মাজবার গরম জল চাই। হিরের মতো ঝকঝকে দাঁত রেবার। দাঁতে ধার ঠিক হিরের মতোই। অনেকদিন সে আমাদের কাছে দাতের কত জোর হতে পারে দেখিয়ে অবাক করে দিয়েছে। দাঁত নিয়ে রেবার মাতামাতি দেখে আমরা অবশ্য যথেষ্ট হাসিঠাট্টা করেছি। হাতপায়ে জোর হয় মানুষের, শরীরে শক্তি হয়। কিন্তু, দাঁত কি করে, শক্ত-সমর্থ হলেই বা অমন স্থান নিতে পারে?
রেবাকে দেখে সাধারণ বাঙালি ঘরের ছোটখাটো একটা মেয়ে বলেই মনে হয়, যেমনটি আমরা পথেঘাটে পাই রোজই। দাঁতের শক্তির জনই আমরা তাকে ‘ভীমভবানী’ বলতাম।
শহরটি মোটামুটি দেখে নিয়ে আমরা এলাম চটিটায় ফিরে। বলে-কয়ে ঘরে খাবার পাওয়া গেল। কানা-উচু পিতলের থালায় দোসা ইডলি, চাটনি। বাটিতে সম্বর, রসম, দহিবড়া একটা করে অমৃতি।
যাই হোক, আমাদের মাছভাত খাওয়া মুখে নূতন ধরনের খাদ্য খারাপ লাগলেও নূতনত্বের আশায় আমরা খেয়ে গেলাম। খাওয়া দাওয়ার পরে সকলে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। কয়েকদিন যাবৎ অতিরিক্ত ঘোরাঘুরি হওয়াতে সকলেই ক্লান্ত ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে মুখ হাত ধুয়ে শাড়ি বদলে নিতে নিতে ঘরে বিকেলের জলযোগ দিয়ে গেল। কফি ও পাকোড়া।
কফির পরে ঠিক হল স্টেশনে গিয়ে ট্রেন দেখে সিট রিজার্ভ করা হবে সাত দিন পরে। এই সাত দিনে এই শহরটিকে কেন্দ্র করে মোটরবাসে পাশের শহরগুলো দেখে নেব। বাসের ভাড়াও সস্তা। যাতায়াতের অসুবিধা নেই। আমাদের কুলিয়ে যাবে। প্রোগ্রাম ঠিক হওয়ার পরে সকলেই শান্তি পেলাম। নন্দা একটা দোকানে জামার কাপড় দেখে এসেছে, সে সেখানে যেতে চাইল। আমিও ঠিক করলাম কেতকীর জন্য জামার একটা কাপড় কিনব। অন্য দুইজন গোবিন্দজীর মন্দিরে আরতি দেখতে চায়। ঠিক হল ওদের মন্দিরে নামিয়ে কাপড়চোপড় কিনে আমরা মন্দিরেই ফিরে আসব।
গাড়ি করে গেলাম বেরিয়ে। রেবা ও মীরাকে মন্দিরে নামিয়ে নন্দার সঙ্গে কাপড়ের দোকানে গেলাম। একটা কিনতে দশটা কিনে ফেলা হল। ফলে খুবই দেরি হয়ে গেল। নন্দা বলল, ‘ওরা যা চটে আছে। এক সঙ্গে বসে আরতি দেখব প্রসাদ খাবো, কথা ছিল। এতক্ষনে ক্ষেপে রয়েছে।
আমি বললাম, ‘আরতি না দেখি ঠাকুর দেখেছি তো। আহা কি বা প্রসাদ। শুকনো নারকেলের টুকরো আর কিসমিস। তার চেয়ে চল, কিছু ভালো মিঠাই কিনে নিয়ে যাই বাজার থেকে। ওরা মিষ্টি পেলে রাগ ভুলে যাবে। যা ব্যবস্থা দেখছি খাবারের হোটেলে। অনেক মিষ্টি কিনে আমরা মন্দিরে গেলাম। তখন আরতির ভিড় নেই। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছড়িয়ে লোকজনেরা। বেশির ভাগ মাদ্রাজি লোক। তারা কেমন শক্ত শক্ত অক্ষরে কথা বলে জটলা করছে। দু-চারজন টুরিস্টও আছে। রাত্রি প্রায় আটটা।
শহরের বড় রাস্তার উপর মন্দিরটা হলেও পাশের সরু গলি পথেও আর একটা বড় ফটক। এই শহরটার বিশেষত্ব এর সরু সরু গলিগুলো। দক্ষিণ ভারতের পথঘাট বড় বড় চওড়া, ঝরঝরে পরিষ্কার। কিন্তু এই শহরটায় সবই উৎকট। গলিগুলোর মধ্যে ভাঙাচোরা বস্তিবাড়িও দেখা যায়। ইচ্ছা করলে শতশত চোর ডাকাত খুনে লুকিয়ে থাকতে পারে। হয়তো বা থাকেও । দেখার জিনিসও বেশি নেই।
গোবিন্দজীর মন্দির তার মধ্যে একটা বস্তু। এখানে নাকি কঠিন কঠিন রোগের ঔষধ মিলে যায়। সেইজন্যে নানা জায়গা থেকে লোকজন ধরা দিতে আসে। মন্দিরের চত্বর ভরে গেছে রোগী ও ডিখিরির দলে। অনেক ধরনের রোগী আছে। ছোঁয়াচে রোগ যাদের, তাদের স্থান পাশের গলির মধ্যে। গোবিন্দজীকে ওখান থেকেও দেখা যায়।
রেবা ও মীরাকে সম্মুখে দেখলাম না। কাজেই খুঁজতে হল। নন্দা বলল, ‘চলে যায়নি। তো আমাদের দেরি দেখে?’ আমি বললাম, কিন্তু কথা ছিল তো যত দেরিই হোক আমাদের, ওরা অপেক্ষা করবে। নূতন শহরে সন্ধ্যার পরে দল বেঁধে না গেলে বিপদ ঘটতে পারে, মেয়েদের বেলায়।’
নন্দা টিপ্পনী কাটল, ‘আর, রাস্তাঘাটের ছিরি দেখলে হয়ে যায়। রাস্তাঘাট তো এ কদিন দেখাই হয়নি। আমরা সভা আর বক্তৃতা নিয়েই ছিলাম। এখন শহর দেখতে বেরিয়ে থান্ডারস্ট্রাক। এমন একটা জায়গায় আসে কেউ? কোনোমতে পাশের শহর দুটো আর পাহাড়টা দেখে নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি, বাবা! দক্ষিণ ভারতে কত না কত ভালো জায়গা। অবশেষে কিনা এলাম এখানে ?’
আমি বললাম, ‘আর দেখাশোনা পয়সায় কুলোনো চাই তো। গোবিন্দজীর মন্দিরে শুনি বিনে পয়সায় থাকতে, খেতে দেয়। তেমন-তেমন বিপদে যদি পড়ি তো এসে এখানেই আস্তানা গেড়ে বসা যাবে। কিন্তু ওরা গেল কোথায়? রেবা আবার যা রাগী দেরি দেখে চটে চলে গেল না তো? ওর ভয়-ডর নেই। মীরাকে টেনে নিয়ে গেছে বোধ হয়।
নন্দা বলল, ‘আবার রাগের মাথায় আমাদের ওপর দাঁতের জোরের না পরখ করে।
আমরা হাসতে হাসতে কিন্তু একটু চিন্তিতভাবে প্রকাগু মন্দিরটার চারদিকে তন্ন তন্ন খুঁজতে শুরু করলা একজন পূজারী শ্রেণীর ব্ৰাহ্মণ আসছিলেন এধারে। আমাদের এমন করে খুঁজতে দেখে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে ছেলেপিলে হারিয়েছে না কি?’
এখানে লোকেরা ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি বলতেও পারে ও বুঝতে পারে। অথচ হিন্দি জানে না। আমরাও ইংরেজি বোঝাবার জন্য থেমে থেমে বলে কাজ চালালাম।
পূজারী বললেন, “কিছুদিন হ’ল মন্দির থেকে বড় ছোট ছেলেমেয়ে চুরি যাচ্ছে। এত বড় মন্দির, এত লোকজন, যে ছেলেধরাকে ধরাও শক্ত। তাই আমরা নিজেরা যাত্রীদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিই।”
‘ছেলেধরা ধরা পড়ে না?’
আমাদের প্রশ্নে পূজারী বললেন, ‘ধরা পড়লে তো একটা গ্যাংকেই ধরে ফেলতে পারতাম।”
‘ছেলেগুলোকে ফিরে পাওয়া যায় না?
‘না। তবে হ্যা, দু’একটির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আমরা শিউরে উঠলাম ‘তবে ছেলেধরা বলছেন কেন? এ তো ডাকাত! গয়নাগাটি কেড়ে মেরে ফেলেছে, ছেলেটি ধরিয়ে দিতে পারে ভেবে। পূজারীর ভাঙা ইংরেজিতে কথা চালাতে কষ্ট হচ্ছিল। তিনি কথা না বাড়িয়ে সরে পড়েছেন।
গায়ের মধ্যে ছমছম করতে লাগল। এত জায়গায় গেছি, দেশ-বিদেশে বেড়িয়েছি, কই, আমার কখনও তো এই রকম মনোভাব হয়নি?
গা যেন ভয়ে ভারী হয়ে আসছে, পা যেন উঠছে না। কেমন একটা চাপা-অৰ্থপূর্ণ ইঙ্গিত আকাশে বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
এদিকে সরে আসায় গোবিন্দজীর মন্দিরের ঝকঝকে উচু চক্ৰচিহ্নের ওপরে দেখলাম রাত্রির আকাশের তারা জ্বলছে একটি দপদপ! লাল হয়ে উঠেছে যেন আকাশটা। তারা চমকে চমকে কাপছে ভয়ে।
চমকানো আর কাপা তারা যেন বলে দিতে চায়, আমিই তোমার অশুভ নক্ষত্র রুবি। তোমার ভাগ্য সেজে আজ এখানে টেনে এনেছি।
জীবনে বহু ভয়ের পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হয়েছে আমাকে। জোর করে নতুন মানুষ হতে হয়েছে। তাই মনকে শক্ত করে ভয়টা ঝেড়ে উঠতে হল আমাকে আজ।
যাই হোক দেখলাম গলির দিকে মুখের কাছে রেবা, মীরা দাঁড়িয়ে আমরা ডাকলাম, ‘ওখানে কেন নোংরার মধ্যে? এদিকে এস।” মীরা ছুটে এলো, ‘বাবা, এতক্ষণে আসা হল! পয়সাকড়ির ব্যাগটা পর্যন্ত নিয়ে গেছ ভুল করে? আমাদের কাছে একটি পয়সাও নেই।
‘কেন? প্ৰণামী দেবে বঝি?’
‘না ভাই, পাথরের দেবতাকে প্রণামী দিয়ে কি করব, যখন চারপাশে এতগুলো মানুষ না খেয়ে মরছে? একটা বাঙালি বুড়ো ভিখিরি দেখলাম। গোবিন্দজীর নাম ডাক শুনে এখানে কিছুদিন হল এসে রয়েছে। বেচারীকে কিছু দিতাম।
“কি রোগ ওর?’
‘এই গলিটায় সাধারণতঃ কুষ্ঠরোগী থাকে। ওর অবশ্য কুষ্ঠ নয়, শ্বেতী।”
ততক্ষণে রেবাও এগিয়ে এসেছে। মীরা বলল, “ওই যে দেখ ভিখিরিটা। আমরা ‘রুবি এখনও এলো না, রুবির কি হল?’ বলছিলাম দেখে যেচে এসে কথা বলল। বুড়ো মানুষটা, রোগে, অভাবে কঙ্কালসার হয়ে গেছে। দেশের লোককে এতদূরে দেখে ভারী খুশি হল। এই যে দেখ, এই যে! ‘
দেখলাম ধুতির ওপর মোটা চাদর জড়ানো এক বুড়ো অতিকষ্টে লাঠি ভর দিয়ে ক্ষিধেয় বা রোগে যাতেই হোক, চোখ দুটো জলছে। এতদূর থেকেও বেশ বোঝা যাচ্ছে। মীরা আমাদের হাতের ব্যাগ খুলে কিছু পয়সা বা’র করে নিল।
দয়াময়ী রেবা বলল, “তোমরা কত খাবার এনেছ কিনে। এর থেকে কিছু দিই। বেচারী মাদ্ৰাজী ছত্ৰে পেট পুরে খেতে পায় কি না কে জানে?’
রেবা প্রসাদ পেয়েছিল একটা মাটির সিদুর মাখা সরায়। সে প্রসাদী ফুল রুমালে বেঁধে সরায় চারটে মিষ্টি দিয়ে বুড়োটার হাতে দিয়ে এলো। আমরা নোংরা গলির দিকে এগোলাম না।
রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। গাড়ি কাছাকাছি দেখতে পেলাম। না, যদিও রাস্তা এখনও লোকজনে ভরা।
নন্দা বলল, ‘হোটেল এখান থেকে বেশ দূরে। হেঁটে যাওয়া চলবে না। রেবা বলল, ‘না না। সোজা রাস্তা ধরে গেলে দূর বটে, কিন্তু মন্দিরের পেছনের রাস্তা দিয়ে গেলে খুবই কাছে। রাস্তাটা পড়েছে আবার হোটেলের গলির আবর্জনা ফেলার পতিত জায়গাটায়।
আমি বললাম, ‘তুমি আবার এমন ভূগোল শিখলে কোথা থেকে?’
রেবা উত্তর দিল, ‘আমি মীরাকে বলেছিলাম রুবিরা এখনও এলো না। হোটেলে ফিরব কি করে বেশি রাত হলে? তাই শুনে ওই ভিখিরিটা বলল, কেন মা, হোটেল তো এক পা, এই রাস্তাটা দিয়ে গেলে।’
আমি বললাম, ‘ভিখিরিটার সঙ্গে অনেক গল্প করেছ দেখছি। রেবা অপ্রতিভ , হল
‘মানে, আমরা কথা বলছিলাম কি না, ও কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, তাই শুনেছে। আহা লোকটিকে দেখলে মায়া হয়। নড়বড়ে শরীরটা, নড়াচড়ায় কষ্ট। গলাটা ভাঙা-চাপা। রোগে বসে গেছে বোধ হয়। পুরুষ কি মেয়ে বুঝতেই কষ্ট হয়। বুঝতে পারা শক্ত।
আমরা ধীরে ধীরে আধো অন্ধকারে পা টিপে টিপে গলি ধরে চলতে লাগলাম। রাস্তা সত্যিই অল্প, কিন্তু পথঘাট ভালো জানা না থাকায় আমাদের সময় লাগল আবর্জনা ফেলা জায়গায় পৌছতে।
মীরা নাকে কাপড় টেনে বলল, “উহু হু! দেখছ ছোট ছোট মরা জন্তু পর্যন্ত পড়ে। আছে। এখানে ধাঙড়ও নেই?’
নন্দা বলল, “বিদেশ বিভূই, অত খুঁত-খুঁত করলে চলে নাকি?’ রেবা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। অবাক হয়ে আঙুল দিয়ে একটা জায়গা দেখাল, ‘দেখ, দেখ!’
দেখলাম সেই সরাভর্তি মিষ্টি পড়ে আছে। সিদুর মাখা প্রসাদী সরা। ভুল হওয়ার উপায় নেই। সেই সব মিষ্টান্ন-—বালুসাই, পেড়া অমৃতি, কুমড়োর মেঠাই।
“কি আশ্চর্য! খাবারগুলো এভাবে নষ্ট করল কেন? ভারী অসভ্য তো। মীরা বলল, ‘হয়তো রোগে মিষ্টি খাওয়া বারণ। রেবা যখন দিচ্ছিল তখন কেমন অদ্ভূতভাবে রেবার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। চোখ দুটো যেন জ্বলছিল।’
রেবা বলল, ‘আহা গরীব মানুষ। কত আশা করে রোগ ভালো হবে বলে এখানে গোবিন্দজীর মন্দিরে পড়ে আছে। ভালোমন্দ খাবার দেখে লোভে চোখ জ্বলছিল। ঠোট চাটছিল ঘন-ঘন।
‘তাহলে ফেলে দেবে কেন?’
ফেলে হয়তো দেয়নি। এখানেই রেখে গেছে কোথাও । মন্দির থেকে জায়গাটা এত কাছে যে ঘনঘন যাতায়াত করছে।
‘এমন নোংরা জায়গায় কেউ খাবার রাখে? ফেলেই দিয়েছে। কিন্তু কোথায় গেল ও?’ নন্দা এদিক-ওদিক চেয়ে দেখল।
একধারে পাহাড় সমান উচু আবৰ্জনা। তারি আড়ালে বুড়ো হয়তো গেছে মনে করে আমরা চলে এলাম। কিন্তু আমার কেমন লাগতে লাগল।
পরের দিন ভোরের ট্রেনে আমরা পাশের শহরে একটি পাহাড় দেখতে গেলাম। সেদিন রাত্রিটা ওখানেই কাটিয়ে পরের দিন ফিরলাম।
আজকের প্রোগ্রাম মোটর বাসে নারকেলের আবাদ দেখতে যাওয়া। এটা টুরিস্ট সিজন। টিকিট পাওয়া যাবে না ভেবে আগেই টিকিট কাটা হয়েছে। কিন্তু সকলের যাবার অবস্থা নেই। পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়াতে রেবার পা-টা জখম হয়েছে। চলাফেরা করতে সে পারছে না। আমিও জ্বর নিয়ে ফিরেছি। অতটা উচু পাহাড়ে জিদ করে উঠতে যাওয়া ভুল হয়ে গিয়েছিল।
আমরা নন্দা, মীরাকে জোর করেই বেড়াতে পাঠালাম। ‘টিকিট কাটা হয়েছে। সবাই বসে থাকার মানে হয় না। হোটেলে একরাত আমরা দু’জনে বেশ কাটিয়ে দেব। কাল ভোরেই তো ফিরছ তোমরা।
ওরা ইতস্তত করতে লাগল, ‘রুবির জ্বর। বিদেশে কখনও দলছাড়া হতে নেই। কার ভরসায় রেখে যাব?’ আমি বললাম, কেন, ভীমভবানীর ভরসায় রেখে যাও।
রেবা কাতরাতে কাতরাতে বলল, ‘আর ভীমভবানীর ভরসা নেই। পা’খানা তো গেছেই, ডান হাতটাও নাড়াতে পারছি না।
তবে ম্যানেজারটি বড় ভালো। ডাক্তার ডেকে আনলেন। কতবার খবর নিচ্ছেন। তোমরা চলে যাও। ভয় নেই কোনো। মীরা বলল, ‘আহা, ম্যানেজারের পোষা কুকুর দু’টোর একটা এমন ভাবে মারা গেল। তবুও উনি কত করছেন!
ম্যানেজারের পোষা একটা কুকুর আবর্জনার গাদার পাশে সকাল থেকে মরে পড়ে আছে। গায়ে কামড়ের দাগ। অন্য কুকুরদের সঙ্গে অসম যুদ্ধে তার প্রাণ গেছে বোঝা যায়।
যাইহোক, না-মীরা অনিচ্ছায়ও অবশেষে চলে গেল। আমরা সারাদিন দুজনে ঘরের মধ্যে শুয়ে শুয়েই কাটালাম আর গজগজ করতে লাগলাম বিদেশে এসে অসুখ হয়ে পড়ার ক্ষোভে।
সন্ধার দিকে আমার জ্বর ছেড়ে গেল বটে, কিন্তু শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ল যে, মাথাও তুলতে পারি না। রেবার অবস্থাও তথৈবচ।
রাত্রে তাড়াতাড়ি দুধ পাউরুটি খেয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। বাইরে ঘন অন্ধকার। টিপ টিপ বৃষ্টিও শুরু হয়েছে।
রেবা একবার ঘুমের ঘোরে বলল, ‘বাথরুমের দরজাটা বন্ধ আছে তো?’ পাশের বাথরুমে জমাদারের যাতায়াতের উদ্দেশ্যে একটা বাইরের দিকে দ্বার ছিল। ঘরের সঙ্গে লাগানো বাথরুম।
আমি বললাম, ‘একবার দেখে এলে হত না? সাবধান হওয়া ভালো। কিন্তু উঠে যেয়ে দেখবে কে? শরীরের এমন অবস্থায় নড়াচড়া সম্ভব নয়। পরস্পরকে অনুরোধ উপরোধ করতে করতে আমরা ঘুমিয়েই পড়লাম। ঘুম ভেঙে গেল। আমার ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ মাঝরাত্রে। অনেক রাত্রির বিভীষিকা দক্ষিণ ভারতের সুদুর কোনো এই শহরটার বুকে ফিরে এলো।
হাজারিবাগ রোডের সেই ভয়াবহ রাত্রির একটা লাইন টেনে কে যেন যোগ করে দিল আজ এই মাদ্ৰাজী রাত্রে। গোঁ-গোঁ আওয়াজ করছে রেবা। হাত-পা তার মোটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা খাটের সঙ্গে। নড়বার উপায় নেই একচুল। মুখে তার একগাদা কাপড় গোজা। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। মুখ লাল কপালের শিরা দড়ির মতো শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছে। মাথার কাছের ছোট খোলা জানালা দিয়ে আকাশের আলো আসছে, তাইতে দেখা গেল। আমার অবস্থা?
আমার হাত-পা বাধা নয়, মুখে কাপড় গোঁজা নয়! কিন্তু লোহার মতো শীর্ণ একটা হাতের শক্ত পাতা মুখ চেপে আছে। চোঙার মতো সরু মুখ, টকটকে ঠোট আর দাঁতের সার! আবার রাসমণি!
বাঘ যেমন শিকার চেপে বসে তেমনি রাসমণি আমাকে চেপে বসেছে। সাদা-সাদা পোড়া দাগে ভরা মুখখানা। জলন্ত চোখ কোটরে দপদপ করে অন্ধকারে জুলছে। অনেকটা রোগা হয়ে গেছে রাসমণি বুড়ো বয়সে। কিন্তু মানুষের রক্ত খেয়ে, প্রাণীর রক্ত খেয়ে যার দিন কাটে তার দেহে মানুষখেকো বাঘের শক্তি! আমার কিছুই করবার নেই।
দাঁতে দাঁতে পিষে রাসমণি চাপা গলায় বলল, “তোর ভাই আমাকে খোঁড়া করে দিয়েছে এবার শোধ নেব। ভেবেছিলি মরে গেছি, না? কেমন জব্দ! বুড়ো ভিখিরি সেজে গা-মুখ ঢেকে ভাঙা গলায় কথা বলে ধোঁকা দিয়েছি। দু’দুবার তুই আমার মুখের গ্রাস থেকে পালিয়ে বেচেছিস। এবার তোকে কে বাঁচাবে? তোর রক্তের স্বাদ আমার মুখে লেগে আছে! তোকে শেষ করে তোর বন্ধুটাকে ধরব! ওটার রক্তও মন্দ হবে না!’ রেবা আবার গোঁ-গোঁ করে উঠল। আমার আর নড়বার শক্তি নেই! দুর্বল দেহে রাসমণির আক্রমণের বিরুদ্ধে দুটোর মতো ভেসে গেলাম। রেবার হাত-পা মচকানো, তার ওপর শক্ত বাঁধন। তাই বুঝি কষ্টে গোঁ-গোঁ করছে ও ! অতিকষ্টে চোখ ঘুরিয়ে তাকালাম। গভীর রাত্রে দরজা বন্ধ ঘরে ঘরে। তাই রাসমণি রসিয়ে রসিয়ে শিকারে দাঁত বসাবে। রক্তচোযার হাত থেকে মুক্তির আজ কোনো পথ নেই।
রেবা ওর চোখের সাহায্যে কি যেন বলতে চায়। চোখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নীচের দিকে দেখাতে চেষ্টা করছে। আমার মতো ভয় সে পায়নি ঠিকই। কিন্তু রাসমণিকে তো ও চেনে না!
ভ্যাম্পায়ার রাসমণি ধারালো দাঁতে পৈশাচিক হাসি হাসছে। আমাদের রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই জেনে ওর রক্তলোভ উগ্র হলেও ও রয়ে-সয়ে চেখে চোখে রক্ত চুষে নেবে, বুঝলাম নিঃশ্বাস আমার বন্ধ হয়ে আসছে! এখনি অজ্ঞান হয়ে পড়ব! ভয়ানক ভাবে বিদেশে এখনই দুই বন্ধুর জীবন শেষ হয়ে যাবে। কেউ নেই যে বাঁচাতে পারে। রেবা যেন অসহিষ্ণু হয়ে আবার গোঁ গোঁ করে উঠল। কিছু সে করতে বলছে।
হ্যা, বুঝলাম। আমার তো এদিককার হাতটা খালি আছে। রাসমণি হাঁটু চেপে ওপরের দিকটা ধরলেও কনুই থেকে ডান হাতখানা খালি।
প্রাণপণ চেষ্টায় হাতখানা ভাঙার মতো করে বেকিয়ে এক ঝটকায় রেবার মুখেগোঁজা কাপড়ের তাল খুলে দিলাম ফেলে।
এক মিনিট মাত্র সময় কাটল ।
গগনভেদী চিৎকারে রাসমণি লাফিয়ে উঠল যন্ত্রণায়। রেবার মুখে তার দুইটি হাতের আঙুল কাটা। রক্তে বিছানা ভেসে যাচ্ছে! আমাদের রক্ত নয়-— রাসমণির রক্ত এবার!
চারদিক থেকে সাড়া জেগে উঠল। করিডরে আলো জ্বালা ও আমাদের ঘরে ধাক্কা পড়ার আগেই রাসমণি লাফিয়ে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাথরুম দিয়ে বার হয়ে গেল। এতক্ষণে বুঝলাম যে জমাদারের দরজা আমাদের মনের ভুলে খোলা রেখে আমরা শুয়েছিলাম সেই পথে রক্তচোষা ঘরে ঢুকেছে।
রাসমণির কাহিনি বিচিত্র!
পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে সে বাংলা ছেড়ে বিহার গিয়েছিল। আবার সেই ভয়ে সুদূর মাদ্রাজে পালিয়ে এসেছিল। গোবিন্দজীর মন্দিরে রোগী ও ভিখিরির ভিড়ে নিজের গায়ের সাদা দাগ, খোঁড়া পা নিয়ে দিব্য লুকিয়ে থাকত। মধ্যে মধ্যে যাত্রীদের ছেলেমেয়ে চুরি করে নিজের রক্তপিপাসা মেটাত। হোটেলের আবর্জনার মধ্যে ওর আস্তানা করেছিল রাসমণি। এখানে লোকজন কমই আসত! আবর্জনার পাহাড় জমে আড়ালও হয়েছিল। কুকুর বেড়াল ধরে ধরে এখানে বসেই রক্ত চুষে খেত ; তারপর মৃত দেহগুলো ফেলে রেখে যেত।
রাসমণি রক্তচোষা,
মাংসাশী নয় কি না! এখানে আবর্জনার গাদায় মরা জীবজন্তু কারুর চোখে পড়ত না। ম্যানেজারের কুকুরটিকেও রাসমণি গ্রাস করেছিল। আমাকে এতদিন পরে দেখে ওর রক্তচোষার ইচ্ছা উগ্র হয়ে উঠেছিল। আমাদের গতিবিধির ওপর চোখ রেখে এই আবর্জনার গাদায় লুকিয়ে রাসমণি সুযোগ খুঁজছিল। মন্দির থেকে অতি অল্প সময়ে এখানে ও চলে আসতে পারত।
সেদিন মিষ্টিগুলো ফেলে দিয়েছিল রাসমণি। মিষ্টান্ন দিয়ে ও কি করবে? অমৃত যোগালেও তাতে ওর অরুচি হতো। ওর খাদ্য একটিই—রক্ত! মানুষের রক্ত পেলেই সবচেয়ে ভালো!
এই ভ্যামপায়ারগুলোর বুদ্ধি তীক্ষ্ম হয়। সুযোগ খুঁজে খুঁজে কাজ হাসিল করা রাসমণির পক্ষে অতি সহজ ছিল।
কিন্তু, কি করে বারবার তিনবার আবার ভাগ্য আমাকে ডেকে ওর হাতের মুঠোয় তুলে দিয়েছিল? রাসমণি অস্বাভাবিক বুদ্ধিবলে বোধ হয় বুঝেছিল ভবিষ্যতে আমি কোনোদিন এখানে আসব। তাই ওঁৎ পেতে অপেক্ষায় ছিল।
এতক্ষণে একটি দল আলো নিয়ে, অস্ত্র নিয়ে রাসমণির পেছনে গেছে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভয়ে কাপছি আমার প্রাণরক্ষা কত্রী বন্ধু ভীমভবানী রেবার পাশে বসে। এমন সময়ে দলটি খবর নিয়ে ফিরে এলো রাসমণির। সত্যি সত্যি এবার রাসমণি শেষ হয়ে গেছে। খোঁড়া পা নিয়ে ছুটে পালাতে পারেনি।
আবর্জনার গাদায় হোঁচট খেয়ে পড়েছিল। ম্যানেজারের আর একটি কুকুর ছিল। সেই বুলডগ সঙ্গে সঙ্গে টুটি কামড়ে ঝুলে পড়েছে। তার সঙ্গীটির মৃত্যুর কারণ বলে সে কুকুরের ঘ্রাণশক্তি দ্বারা রাসমণিকেই বুঝে নিয়েছিল। রাসমণির মৃত্যুর বহু পরে জোর করে রাসমণির ছিন্ন গলার নল থেকে তার দাঁত ছাড়াতে হয়েছে। অন্যের গলার নলি ছোঁড়া যার অভ্যাস অবশেষে কুকুরের কামড়ে নিজের গলা ছিড়ে প্রাণ দিল!
এবার আমার গল্প শেষ হয়ে গেছে। এবার তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোও। রাসমণি আর নেই।
(সমাপ্ত)