পেঁয়াজের খোসা ছড়াতে ছাড়াতে মিতুমাসি বলল, “আর কিছু না, খেদ একটাই। ভূত কখনও দেখলাম না।”
মা মন দিয়ে মাছের চপ ভাজছিল। মাসির কথা শুনে হেসে ফেলল, “কী যে বল, ভুত দেখনি। যেন, রাক্ষস খোক্ষস দত্যিদানো সব দেখেছ!”
বাটনা বাটতে বাটতে সবিতাদি মুখ খুলল, “ভূত আছে গো! সেবার আমি যখন মাঝরাত্তিরে ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছিলাম, ওম্মা গো! আমার পাশ দিয়ে একটা কী যেন…বেঁটে মত…”
মা থামিয়ে দিল, “আঃ, তাড়াতাড়ি করো সবিতা, লোকজন চলে আসবে তো!”
আলোচনাটা বেশিক্ষণ চলতে পারল না। নিমন্ত্রিতরা আধঘন্টার মধ্যে চলে আসবেন। গরম গরম লুচি ভাজতে হবে। কাজেই ভূতের প্রসঙ্গ উপস্থিত থমকাল। আসলে এই মেঘলা দিন, ঝোড়ো হাওয়া, সব মিলিয়ে ভূত ভূত গন্ধ ছড়াচ্ছিল। বুলুর জন্মদিনটা বরাবর বৃষ্টি, নয়তো মেঘলা থাকে। শ্রাবনে জন্ম কিনা! বুলু বলল, “এমন দিনেই খিচুড়ি খেতে হয়।”
“তা হয়। তবে যেতিস জলপাইগুড়িতে, তবে বুঝতিস কী আনন্দ বর্ষায় । তার সঙ্গে ভূতের গল্প। তবে গল্পই, সত্যি ভূত আর দেখলাম কোথায়!” মিতুমাসি দুঃখ করে।
“মা, তুমি ভুত দেখেছিলে না?” বুলু উৎসাহে কাছে ঘেঁষে আসে।
“আমি? ও, ওটা ? বুঝলে দিদি, সেবার বুলু ওর বাবার সঙ্গে শোভাবাজারে পুজো দেখতে গেছে। বাড়িতে আমি একা। ওদের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে জানালা খুলে দেখতে গেছি ওরা এল কিনা। ওমা, দেখি একটা লোক। ঝাঁকড়া মাথা। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তো ভয়ে … বুঝতেই পারছ! সাহস করে কে রে -কে রে, করে বারান্দার আলো জ্বেলে দেখি সুপুরি গাছটা।”
“তাহলে আমার কথা বলি,” মিতুমাসি গুছিয়ে বসেন, “আমার বাড়ির পাশে যে গলিটা, সেখানে মোটাসোটা একটা লোক হিন্দিতে গান গাইছিল। লালুরাম যেই না বলেছে – এই, কোন হ্যায় রে তুই? ওমা, কোথায় কী? কেউ নেই কোত্থাও! এ কথা শুনে কত দিন তো দাঁড়ালাম গলির সামনে। ধুর! কিচ্ছু নেই। তাছড়া বিরবিটি পুল বলে একটা পুল আছে, শুনেছি ,গভীর রাতে একটা মেয়ে ছুটে এসে জলে ঝাঁপ দেয়। নাকি ঝপাং করে শব্দও হয়। কে জানে সত্যি না মিথ্যে!” মাসি চোখদুটো মোছে। ভুত না দেখতে পাওয়ার দুঃখ, নাকি পেঁয়াজের ঝাঁঝ? ভাবে বুলু। ওর মনটা খারাপ হয়ও। কে ওরা? কেন এদের মনে এত দুঃখ?
“বুলু, নতুন জামা পরে নাও,” মা ডাকছিল।
“বুলু, তোমার ফ্রেন্ডরা এসে গেছে,” বাবার গলা পেল বুলু।
এরপর তো অন্য জগত। সেখানে ভূত বলে কিছু নেই। আছে কেবল বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। টেবিলটেনিসের তুখোড় খেলুড়ে জয়, ক্লাসের ফার্স্ট বয় শাক্য, গায়ক মৃদু, নিলাব্জ, দারুণ আঁকিয়ে গহন, … সবাই ক্যারম আর গেমে মেতে উঠল। এরপর খাওয়াদাওয়া। সোমকাকা, ডাক্তার আঙ্কেল, সঙ্কামনি, পিসি, দিদু, রাজনদা, হাসছে, খাচ্ছে, গল্প করছে। মা জোর করে মাংস প্লেটে তুলে দিতেই রাজনদা মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে বলে উঠল, “ডিও না, ডিও না, আর পাব্বনা।”
দিপু কাকিমা এতগুলো মিষ্টি খেল! সোমকাকা “এক পিস মাংস-” বলেও প্লেট ভরে নিলেন। সোনামাসি “আজকাল আর খেতে পারি না” বলে দুবার লুচি নিল।
দশটা বাজতেই বাড়ি ফাঁকা। বৃষ্টিটাও ধরেছে। মা ঘরদোর গোছাতে গোছাতে বলল, “যা বুলু, খাওয়াটা বেশি হয়েছে। বারান্দায় পায়চারি কর।
বাবা বলল, “হ্যাঁ। খাওয়ার পর হাঁটা ভালো। সাহেবদের একটা কথা আছে জানিস? আফটার লাঞ্চ রেস্ট আ হোয়াইল, আফটার ডিনার ওয়াক আ মাইল।”
বাহ্! বেশ তো কথাটা! বাবার মত বড় হলে ও কি সব কথা জানতে পারবে?
“কেন জানবিনা? আরে, জানতে জানতেই তো বড় হয় মানুষ! বড় থেকে বুড়ো,” মিতুমাসি আরাম করে চেয়ারে বসল। বসতেই চেয়ারটা ‘ও মাগো’ বলে উঠল। স্পষ্ট শুনল বুলু। আসলে মিতুমাসির ওয়েট খুব বেশি। মা বলছিল বাবাকে, “কত বলি, মিতুদি দূরে নাহয় না-ই গেলে। পাড়ার স্লিমিং পয়েন্ট নামের জিমে তো যেতে পার! শরীরে মেদ থাকা মোটেই ভাল নয়। অসুখ করে। মিতুদি শুনবে? বলে কিনা-‘ওকথা বলিস না। জিমে গেলেই খাওয়া বন্ধ। বাঁচবো কী করে?’”
আজ বুলু নিজের চোখে দেখেছে কী পরিমাণ খেল মিতুমাসি। যাক বাবা। এসব শুনলে মা আবার বকবে- “ছিঃ বুলু, কারও খাওয়ার সময় নজর দিতে নেই।”
বুলু বোঝে না মানুষ দু’রকম কথা বলে কেন! মিতুমাসির ওয়েট লস হওয়াই তো উচিত।
“নজর দিলে শরীর শুকিয়ে যায়,” বলছিল রিকির দিদু। সেদিন রিকির বেড়াল চিনি যখন মাছ ভাত খাচ্ছিল, রিকিদের কাজের মাসি কড়কড় গলায় বলেছে, “বাপরে বাপ! কেমন টাউ টাউ করে খাচ্ছে দেখ!” তখন রিকির দিদু গোমড়া মুখ করে বলেছিল, “ওভাবে বলবে না কলামনি, ওতে নজর লাগে। চিনি রোগা হয়ে যাবে তো!”
আজ একটু আগেই বেশ বৃষ্টি হয়ে গেছে। মেঘ ডেকে টেকে পরে কী বৃষ্টি ! বাড়ির পেছনের বাগানে নিশ্চয় জল জমে গেছে। ব্যাঙ ডাকছে। ঠিক ওদের পাড়ার নার্সারি স্কুলের নাম ধরে ডাকছে -কিডস কেন! কিডস কিড কিড কিডস কেন! বৃষ্টির ছাঁট আসছিল বলে জানালা বন্ধ করে রেখেছে মা। কাচের জানালার বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেমন নিঝুম নিঃসীম বাগানটা! এতক্ষণ বাড়িতে লোকজন ছিল, বাড়ি ভরে ছিল আলোতে, কথায়। এখন ঝট করে থমকে গেল সব। পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে গেছে যেন। কেবল বাসনপত্রের ঘ্যাচ্যাং খাচাক আওয়াজ। কেউ অনেক বাসন নাড়াচাড়া করছে। মনে হয় সবিতাদি।
বাড়ির সামনের রাস্তাতে জল জমে আছে। মেঘের ফাঁক দিয়ে অল্প আলো আসছে। এই অস্পষ্ট আলোতে ভয় ভয় করছিল বুলুর। চারদিক বড় রহস্যময়। কিছু নেই অথচ কেমন যেন ছায়া ছায়া, ভুতুড়ে। বারান্দায় আলো ছায়ার কারিকুরি। চাঁদ বড্ড ফ্যাকাশে। মেঘের ছায়া গায়ে মেখে কেমন অন্যরকম চেহারা হয়েছে চাঁদের। মাঝেমাঝে কালো মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে চাঁদ। তখন চারপাশ অন –ধ –কা-র! ভয় ভয়! ফের মেঘমাখা চাঁদ আবছা!
দ্রুত হাঁটছিল বুলু। অনেকটা দূরে চলে এসেছে বাড়ি থেকে। এই ছায়া ছায়া আলোতে গাছগুলোর নীচ দিয়ে যেতে যেতে কেমন কেমন লাগছিল ওর। ক্লাস এইটে পড়ে, ভয় কীসের? আসলে সেই মোটাসোটা অবাঙালি ভূতের গল্প, সেই মেয়েটার জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়া… শিরশির করছিল মেরুদন্ডটা। চুলের গোড়ায় কার যেন ঠান্ডা আঙুল। বুলু সোজা হাঁটে। সোজা হেঁটে বাড়ির বারান্দায় উঠবে ও। ভয় কীসের?
চারপাশ বড় নিস্তব্ধ। কেবল বহুদূর থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছে। আজ কি কোনও উৎসব? আর ঠিক এই সময়, ঝাউগাছের গোড়া ঘেঁষে একতাল কালো কালো অন্ধকার টুকরো টুকরো হয়ে উঠে দাঁড়াল।
বুলুর চিৎকারটা পেটের ভেতরে পাক দিয়ে দিয়ে উঠছিল । গলা খুলে বাইরে আসতে পারছিলনা ।
রোগা কালো কালো, মেঘমাখা শরীরে সরু সরু লম্বা হাতপাগুলো নড়বড় করতে করতে এগিয়ে আসছে। কে? কে? বুলু অজ্ঞান হচ্ছে না কেন? একটা নয়, দুটো নয়, ঝাউগাছের পেছন থেকে, ভ্যাটের পেছন থেকে বেরিয়ে আসছে টুকরো টুকরো অন্ধকার, জ্বলজ্বলে চোখ…
এক মুহূর্তের জন্য সাহস ফিরে পেল বুলু। সব শক্তি জোটবদ্ধ করে বিকৃত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “কে?”
ক্যাঁ ক্যাঁ করে একটা রাতজাগা পাখি উড়ে যায়। সেই অসীম অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কেঁপে ওঠে বুলু।
ছায়া ছায়া অন্ধকারগুলো আর এগিয়ে আসছে না। বুলুর থেকে হাত পাঁচ- ছয় দূরে অন্ধকারের টুকরোগুলো দাঁড়িয়ে। হঠাৎ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কে হেঁচে উঠল। চ্যাঁ চ্যাঁ করে বলল, “আমরা ব্রিজের নীচের বস্তির ছেলে।”
আবার রক্ত বইছে শরীরে। পা দুটো ফাঁক করে দাঁড়ায় বুলু। গাঢ় শ্বাস নেয়। চারদিকে বড় শান্তি , বড় আনন্দ ।
“কী চাই?”
“তোমাদের আজ খুব খানাপিনা হয়েছে। লুচির গন্ধ! ফেলানি ছড়ানি আছে?”
সর্দিতে নাক বন্ধ। বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগিয়েছে ঠিক। কারো উদোম গা। তেল সাবানহীন শরীর থেকে বোঁটকা গন্ধ বের হচ্ছে। বুলু আঙুল তুলে দেখাল, “ওইখানে দাঁড়া।”
পেছন দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকলো বুলু। কিচেন ফাঁকা। সবিতাদি এখনও বাইরে কলপাড়ে বাসন মাজছে। একটা বড়ো খবরের কাগজের ওপর খাবারগুলো ডাঁই করল বুলু। লুচি, মাংস, চপ, মিষ্টি…সব। তাড়াতাড়ি করতে হচ্ছে। কেউ এসে বাধা দেওয়ার আগেই যা করার করতে হবে।
আবার আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। বৃষ্টি আসছে। ছায়া শরীরগুলো নাচতে নাচতে চলে গেছে যেদিকে, বুলু কখনও ওইদিকে যায়নি। কোনওদিনও না।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরল বুলু। মিতুমাসিকে একটা নতুন খবর দিতে হবে। ভূত দেখেছে বুলু। জ্যান্ত ভূত। সত্যিকারের। অথচ ভয় নয়, কষ্ট হচ্ছে …