খাগড়া ছড়ি। বাংলাদেশের অন্যতম একটি পার্বত্য অঞ্চল। মূলত এটি একটি আদিবাসী প্রধান এলাকা। তবে বাঙালিরাও বাস করে এখানে। ইদানিংকালে এখানকার পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে এক ধরণের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।যার একমাত্র কারণ ভয়ঙ্কর বিভত্স কাটা লাশ! সে লাশ এতটাই বিভত্স যে, সাহসী মানুষদেরও ভয়ে ফিট হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। এমন কি মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও নেহাৎ কম নয়! কেননা, কেউই তা দেখে ঠিক থাকতে পারছেনা। কারো বা দেখার পর উচ্চমাত্রায় জ্বর এসে পড়ছে। আবার কারো বা ভয়ে আঁতকে উঠে বাইরে বেরুনোই বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে এরকম কাটা লাশ প্রায়ই পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের ঐ নির্জন পথটায়। আজ পাহাড়িদের একজন মরছেতো কাল মরছে বাঙালিদের একজন । এ নিয়ে পাহাড়ি বাঙালি বিবাদও এখন তুঙ্গে। কিন্তু কে বা কারা এর সাথে সম্পৃক্ত তার কোন সূত্রই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা । এ অঞ্চলের পুলিশেরাও ভয়ে এ নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করতে চাইছেনা । চাইবেই বা কি করে ! এনিয়ে টানা তিন তিনবার টহল দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে সে এলাকায়। আর প্রতিবারই টহলরত পুলিশদের কাটা লাশ বিভত্স হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে পরদিন সকালে। দিনের বেলা কোন সমস্যাই নেই । কিন্তু যখনি সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের শুরু হয় , তখনি জমে উঠে কাটা লাশের মরণ খেলা! ভয়ে তাই সাধারণ মানুষেরা সন্ধ্যার পর আর কিছুতেই বের হচ্ছেনা বাড়ির বাইরে । সে যত জরুরী কাজই হোকনা কেনো!
সারাক্ষণই বিরাজ করছে একটা ভয়ঙ্কর গলা শুকিয়ে যাওয়া আর শরীরের রক্ত জমে উঠা বিভত্স কাটা লাশের আঁতকে উঠা আতঙ্ক। সন্ধ্যা হলেই বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে রক্ত পিপাসু মানব খেকু ধানবের অবিরাম পথ চলার ধুম ধাম শব্দ। রাত হলেই মনে হয় , ঐ বুঝি শোনা যাচ্ছে কোন অসহায় মানুষের তীব্র আর্তনাদ আর গোঙানির সুকরুণ সুর ! সকালে চোখের সামনে পড়ে আছে ভয়ঙ্কর কাটা লাশ ! ভাবতেই কেমন যেন গায়ের সমস্ত লোম ঝাড়া মেরে খাড়া হয়ে যায়!
চলমান এ থমথমে কাহিনীর তড়িৎ নিরসন কল্পে পুলিশ প্রশাসন তাই চরম চাপের মধ্যে রয়েছে । এ নিয়ে তাদেরকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রির কড়া সমালোচনার তোপেও পড়তে হয়েছে কয়েকবার । কাজেই এর আশু সমাধানকল্পে সম্পূর্ণ দায়ভার ছেড়ে দেয়া হয়েছে গোয়েন্দা বিভাগের উপর । তারাই এখন শেষ ভরসা । এদিকে এরকম পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মত কেবল একজনই পরীক্ষিত ব্যক্তি রয়েছে । আর সে হল বর্তমান প্রজন্মের সবচেয়ে সফল আর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারি এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত , এ দেশের অহংকার – ডিটেক্টিভ ইমু হাসান । কাজেই ডাক পড়ল তার । দায়িত্বটা তাকে দিতেই সে এটাকে তার ক্যারিয়ারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করল । যত দ্রুত সম্ভব এর রহস্য উদঘাটনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজ রাতেই খাগড়া ছড়ির উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়তে চাইল ও । সাথে নিল তার বিশ্বস্ত সহচর অটো ভয়েসচ্যাঞ্জ মেশিনটাকে।
ডিটেক্টিভ ইমু হাসানকে কে না চেনে! তার জয় জয়কার আজ সারা বিশ্বজুড়ে। ক্রিমিনাল থেকে শুরু করে সাধু সন্ন্যাসী সবার কাছেই সে এক পরিচিত মুখ। তার নাম শুনেনি এরকম লোক খুঁজতে গেলে মাথার চুল গণার মতই অবস্থা হবে। তাই ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছদ্মবেশ ধরার। তবে যে সে বেশ নয়, একেবারে পুরো চেহারাটাই পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেভাবে কিছু চতুর ক্রিমিনালেরা তাদের ক্রাইমের রাজ্য বিস্তার করে বেড়াচ্ছে সমস্ত বিশ্বজুড়ে। তো পরিকল্পনা মাফিক এমন একজন মানুষের বেশ ধরল, যে কি-না মাসখানেক আগে এই খাগড়া ছড়িতেই নির্মমভাবে কাটা লাশের শিকার হয়েছে। নাম আশফিক মাহিন অন্তু। একজন সাহসী ক্রাইম রিপোর্টার ছিল সে। খাগড়া ছড়ি এসেছিল চরম এ নৈরাজ্যের তরতাজা সংবাদ জনসম্মুক্ষে তুলে ধরবে বলে। কিন্তু আসার দিন রাতে স্বয়ং তাকেই খবরের কাগজের শিরোনাম হয়ে বিভত্স কাটা লাশের আদলে চলে যেতে হয়েছে না ফেরার দেশে। ইমুর সাথে ওর চমত্কার বন্ধুত্ব ছিল ওর। কাছের এ প্রিয় বন্ধুটিকে এরকমভাবে হারাতে হবে তা কোনদিন ভাবতেও পারেনি সে। এজন্য অবশ্য ইমুকে দ্বৈত বেশ গ্রহণ করতে হয়েছে। রাতের জন্য একটা আর দিনের জন্য আরেকটা। দিনের বেলা তাকে স্থানীয় এক মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে। ইমু যেহেতু মাদ্রাসা ছাত্র,তাই একাজে তার তেমন কোন সমস্যাই হচ্ছেনা। কন্ঠস্বরের ব্যাপারেও সমস্যা হচ্ছেনা ভয়েস চেঞ্জ মেশিনটা সাথে থাকার কারণে।
রাত ১২ টা বাঁজতে আর ১০ মিনিট বাকি। অমাবস্যার রাত। কাজেই বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার । এমনিতেই কাউকে চেনার উপায় নেই এরকম অন্ধকারের মধ্যে । তার উপর ইমু আবার কুচকুচে কাল রঙের লম্বা একটা গাউন জড়িয়ে নিয়েছে সারা শরীরে। মাথায় পড়ে আছে কাল রঙের একটি ক্যাপ । কিন্তু নিজের যেন কোন কিছুই দেখতে বিন্দুমাত্র সমস্যা না হয়, তার জন্য চোখে লাগিয়ে নিয়েছে বিশেষ ধরণের একটি পাওয়ার ল্যান্স । এরপর সকলের অগুচোরে মসজিদের হুজুরা খানা থেকে বের হয়ে সোজা পথ চলতে লাগল ঐ স্থানটার দিকে, যেখানে প্রায়ই জ্যান্ত মানুষকে চোখ কপালে উঠা কাটা লাশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় । সত্যিই ইমুর সাহস আছে বলতে হবে । যেখানে অন্যকোন মানুষ প্রকৃতির ডাকে সাঁড়া দেয়ার জন্যেও বাইরে বেরুতে সাহস করেনা, সেখানে সে এরকম একটা ভয়ঙ্কর ঘুটঘুটে অমাবস্যা রাতে একেবারে একলা একজন মানুষ ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর মুখোমূখি হতে ! আসলে যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় বিরাজ করে, তাদের আর দ্বিতীয় কোন ভয় গ্রাস করতে পারেনা ।
ইমু ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। আর ধুপ ধাপ শব্দ হচ্ছে তার পায়ের কাল রঙের বোটের আঘাতে । সে শব্দগুলি এমনি অদ্ভূত আর ভয়ঙ্কর সুরে ছড়িয়ে পড়ছিল যে, ঘুমন্ত পশু- পাখীরাও ভয়ে শিউরে উঠছিল । মাঝে মাঝে ঝুলন্ত বাঁদুরেরা বিকট ভয়ালো শব্দ করে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টায় অন্য কোথাও উড়ে যাচ্ছিল । শিয়ালেরা ভয়ঙ্কর আর্তনাদে কুঁকড়ে উঠছিল। কুকুরের দল চুপসানো ঘেউ শব্দ করে দৌড়ে পালাচ্ছিল। কিন্তু এতসব ভয়ের রাজ্যেও ইমু আজ নির্ভয়। তার মনে শুধু একটাই ভাবনা কখন সে ঐ কাটা লাশের জায়গাটায় পৌঁছুবে ! আর কিছু অসাধারণ রহস্যকে টেনে ছিঁড়ে দিনের আলোর মত ফকফকে পরিষ্কার করে দিবে । সে লক্ষ্যেই পাহাড়ি উঁচু নিচু ঝোপ ঝাড় বেষ্টিত পথ পেরিয়ে ইমু শুধু এগিয়ে যাচ্ছে আর এগিয়ে যাচ্ছে !
বেশ ক্ষাণিকটা পথ যাওয়ার পর ইমু এসে পৌঁছুল সেই মরণ রাজ্যে । যেখানে ভুল করেও একবার কেউ এসে পড়লে আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারে না । জায়গাটা খুবই ভুতুরে । উঁচু পাহাড়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করা একটা সরু রাস্তা এটা । চারিদিকে ঝোপ ঝাড়ে ঘেরা । ইমু এবার পরনের কাল বেশ ছেড়ে পাহাড়ের এমন একটি জায়গায় উঠে এল, যেখান থেকে চতুর্দিকেই অনায়াসে নজর রাখা যায়। তবে ইচ্ছে করলেই যে কেউ উঠে আসতে পারবেনা বলে জায়গাটা খুব নিরাপদ। খুব শক্ত সামর্থ্য ব্যক্তিরও বেশ কষ্টই হবে এখানটায় উঠে আসতে। ইমু বিদেশে এরকম জায়গায় কি করে খুব সহজেই চড়া যায় তার প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। তাই এখানে উঠে আসতে ওর বেশি সময় বা কষ্ট কিছুই হয়নি। তবে জায়গাটা একটু প্রশস্ত। কয়েক কদম করে পায়চারি করার ব্যবস্থাও রয়েছে।
সারা দেহে কাল বেশ থাকায় যদিও ইমুকে এতক্ষণ দেখাই যাচ্ছিল না, কিন্তু এবার তাকে যে বেশে দেখা যাচ্ছে তা নিতান্ত আঁতকে উঠারই মত। একেবারে ধবধবে সাদা কাপড়ে ঘেরা মাথা থেকে পা পর্যন্ত ! চেহারায় সদ্য যখমের চিহ্ন। মনে হচ্ছে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে । দাতগুলোও লম্বা লম্বা ধারালো মতন ঠেকছে । এই বুঝি একবার ছোট হচ্ছে আবার বড় হচ্ছে । চোখ দুটো সাদা মার্বেলের মত লাগছে । তাছাড়া চারপাশটায় একটু পর পর কোথা থেকে যেন ধোঁয়ার মতন কিছু একটা ভেসে বেড়াচ্ছে । দেখা মাত্রই যে কেউ ভূত ভেবে ভুল করতে পারে । এরকম ভূতুরে শরীর আর ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে ইমু অপেক্ষা করছে আর ভাবছে, কখন সে দেখতে পাবে এখানটার কাটা লাশের সেই আসল রহস্য । তবে তার সতর্ক দৃষ্টি আশপাশটায় নজর রাখতে বিন্দুমাত্রও ভুল করছে না । কান দুটোও জাগ্রত ওয়াচম্যানের মতই কর্তব্য পালনে ব্যস্ত রয়েছে ।
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ করেই যেন কানে ভেসে এল একটা জোরালো আর্তচিত্কার । ইমু কিছু বুঝে উঠার আগেই আওয়াজটা শূন্যে মিলিয়ে গেল । তত্ক্ষণাত চোখের ল্যান্স পাওয়ারটা বাড়িয়ে নিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে । যেদিক থেকে শব্দটা ভেসে এসেছিল ঠিক সেদিকটায় । কিন্তু নাহ ! কিছুই দেখতে পেলনা । আশে পাশে একটা ঝিঁ ঝিঁ পোকাও নেই বলে মনে হল তার । শুধু দূর থেকে, বহু দূর থেকে একটা বয়স্ক পেঁচা ডেকে উঠল একটু পর । মনে হয় সে বেচারাও শুনতে পেয়েছে শব্দটি ।
এভাবে অনেকক্ষণ কেটে গেল । কিন্তু আর তেমন কিছুই ঘটলনা । এদিকে ভোর হয়ে এল বলে । কিন্তু যে প্রত্যাশা আর কৌতূহল নিয়ে ইমু এখানটায় এসেছিল তার বিন্দুমাত্রও পূরণ হয়নি । তাই সিদ্ধান্ত নিল, এখানে আর বসে থেকে লাভ নেই । আযানের আগেই তাকে মসজিদে ফিরতে হবে । তাই পাহাড় থেকে নেমে এল নিচে । একেবারে সরু রাস্তাটায় । যেখানটায় কাটা লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায় । এরপর সামনে এগুনোর জন্য যেই পা টা বাড়াতে চাইল, ওমনি অনুভব করল কেউ একজন তার পেছন থেকে কাঁধে হাত রেখেছে । ইমু এবার চাতুর্য্যের সাথে এমনভাবে হেসে উঠল যে, মনে হয় সে শব্দ শুনে সেখানকার বৃক্ষগুলোও ভয়ে কেঁপে উঠল । কিন্তু হাতটা যেন তবুও সরছে না । কোন শব্দও করছেনা কেউ ।
ইমু ঘাড়টা পেছনে ঘুরাতেই অবাক ! এখানেতো কেউই নেই ! আর কেউ ছিল বলেওতো মনে হচ্ছে না ! যদি কেউ সত্যিই হত , তাহলে এত দ্রুত কোথায় মিলিয়ে গেল ! আর কেনইবা মিলিয়ে গেল ? নিশ্চয়ই এটা মনের ভুল । হ্যা , তাই হবে । অনেক সময় এরকম হয় । যখন মানুষ কোন বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে, তখন এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক । কিন্তু ইমুর মন কেন যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছেনা এই সহজ সরল যুক্তিটি । তার কেবল মনে হচ্ছে , একেবারে ভুল আন্দাজ করেনি সে । কারণ ইমুর অনুভব ক্ষমতা নিতান্ত কম নয় । তার ঘ্রাণ শক্তি যেমন ট্রেইন্ড ডগিদেরকে (প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গোয়েন্দা কুকুর) হার মানায় , তেমনি অনুমানও হয় প্রায় শতভাগ নির্ভুল । আসলে তার গুণের সবই আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত । তিনি যেন তাকে গোয়েন্দা হওয়ার জন্যই এভাবে বানিয়েছেন । আল্লাহ যাকে দয়া করেন , তাকে এরকমই অতুলনীয় করে গড়ে তুলেন । কিন্তু যারা বুদ্ধিমান, তারাই কেবল আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে । আর যারা মূর্খ, তারা অবাধ্যতা করে স্বীয় মেধা আর মননশীলতাকে নিয়ে ।
ইমু কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেনা কেন এমনটি হল । এদিকে এ নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করার সময়ও নেই তার কাছে । একটু পরেই আযানের সময় হয়ে যাবে । কাজেই এখনি ফিরতে হবে হুজুরা খানায় । কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই তাকে ফিরে যেতে হবে সেখানটায় । তাই আর একমুহূর্তও সময় নষ্ট না করে এগিয়ে চলল মসজিদ পানে । কিছুদূর এগুতেই আবার কানে এল একটা ফ্যাচফ্যাচ শব্দ । মনে হল কয়েকজন লোক কিংবা কয়েকটি বড় বড় প্রাণীর দল এই বুঝি ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল । চোখে লাগানো ল্যান্সটার পাওয়ার পুরোপুরি এক্টিভেট থাকলেও কাউকেই দেখতে পেলনা সে । শুধু লক্ষ্য করল, ছোট ছোট ঝোপের পাতা গুলো কেমন যেন দোল খাচ্ছিল বহুদূর পর্যন্ত । “কি হচ্ছে এসব ? যতসব ভূতুরে কান্ড-কারখানা ! এসব করে কি আর ডিটেক্টিভ ইমু হাসানকে ভয় দেখানো যাবে !” নিজেকে নিজেই কথাগুলো বলে হালকা মুচকি হেসে উঠল সে । কিন্তু পথ চলা থামাল না ।
এদিকে মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেবের প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়েছে । যে সে ব্যথা নয়, একেবারে পেট কামড়ানো ব্যথা । বুঝতে পারল বাইরে যেতে হবে । ভেতরটা ক্লিয়ার না করে আর থাকা যাচ্ছেনা। কিন্তু একা একা বাইরে বেরুতেও সাহস পাচ্ছেননা। কাটা লাশের কথা মনে হলেই অন্তরটা কেমন যেন হুঁ হুঁ করে উঠছে। এদিকে ব্যথার সাথে সাথে পেটের ভিতরটা থেকে যেন ভূর্…র..ভূর….করে গা জ্বালা করা শব্দেরা মিছিল করে বেরিয়ে আসছে আর বলতে চাইছে- “আমাদের দাবি মানতে হবে, এখনি খালি করতে হবে”। এ যেন মহা বিপদে পড়া গেল! বাইরে বেরুলে মরার ভয় আর ঘরে থাকলে কাপড়-চোপড় নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়! “এখন কি করি! এখন কি করি! “এভাবে বিড়বিড় করতে করতে অবশেষে নিরুপায় হয়ে ডাকতে শুরু করল ইমাম সাহেবকে। “ভাগ্যিস! ওনার ঘর আর আমার ঘরটা একসাথে তোলা।” একটা মাত্র ঘর। মাঝখানে আড়াআড়িভাবে বেড়া দেয়া। এটা ভেবে কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুয়াজ্জিন সাহেব । আর ওহ…ও..আহ..অ..শব্দ করে অনবরত ডেকে চলল। কিন্তু ইমু তখনো ফিরেনি তার হুজুরাখানায়।
এত ডাকা ডাকির পরেও ইমাম সাহেব কিছুতেই উঠছেন না দেখে মুয়াজ্জিন সাহেবের কেমন একটা সন্দেহ হল । তিনি ভাবলেন ,” ইমাম সাহেব কি তাহলে ঘরে নেই !” ইচ্ছে করছিল একবার বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখবেন। কিন্তু তা বোধ হয় আর হয়ে উঠবেনা । কারণ পেটের চাপ এমনভাবে বেড়ে গেছে যে , তিনি আর সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছেন না । এখনি বাইরে না বেরুলে এখানেই হয়তো হয়ে যাবে আসল কাজটা । তাই সব ভয় ভীতি ভুলে গিয়ে তাড়া তাড়ি করে দরজা খুলে যেই বাইরে পা রাখলেন , অমনি একটা বিকট চিত্কার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন । বোধ হয় জ্ঞান হারিয়েছেন। ইমু কাছে এসে শিউর হয়ে নিল । যাক ভালই হয়েছে । এ সুযোগে বর্তমান বেশটা চেঞ্জ করে আগের বেশটা পড়ে নেয়া যাবে । কিন্তু এর আগে বেচারাকে বিছানায় শুইয়ে যাই । বড় ভয় পেয়েছে মনে হয় ।
মুয়াজ্জিন সাহেবকে তার বিছানায় রেখে ইমু এবার নিজের ঘরে ঢুকল । একটু পরেই আবার ইমামি বেশে বেরিয়ে এল। এদিকে আযানের সময় হয়ে গেছে । কাজেই হাতে একটু পানি নিয়ে মুয়াজ্জিন সাহেবের চোখে মুখে ছিটিয়ে দিল সে। পানির ছোঁয়া পেয়ে আস্তে আস্তে চোখ খুললেন তিনি । চোখ খুলেই আবার একটা চিত্কার করে বসলেন ,” ভূউ…ত ! ও রে আল্লাহরে ! আমারে বাঁচান রে ! আমি এইডা কি দেকলাম রে !” ইমু বার বার বুঝাতে চেষ্টা করল । কিন্তু ওনি যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না এই মুহূর্তে । ইমু এবার জোরে ধমক দিয়ে উঠল । বেচারা মুয়াজ্জিন আবার অজ্ঞান হয়ে গেল । গায়ে হাত লাগাতেই বুঝা গেল , প্রচন্ড জ্বর এসে পড়েছে ওনার । হয়তো একটু বেশিই ভয় পেয়েছেন । এবার কাথাটা উপরে ভালোভাবে জড়িয়ে দিয়ে নিজেই আযান শেষ করল ইমু । তবে কাটা লাশের ভয়ে ফজর আর ইশার নামাযে মুসল্লি হয়না বললেই চলে ।
ফলে এ দু সময় ইমু আর মুয়াজ্জিন সাহেব এ দুজনকেই নামাযে দাঁড়াতে হয় । যাও পাশের বাড়ির এক বয়স্ক মুরব্বি মাঝে মধ্যে আসেন । কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তিনিও আসবেন না । এদিকে মুয়াজ্জিন সাহেবও হিতাহিত জ্ঞান শূন্য । আজ তাই একাই নামাযে দাঁড়াতে হল ইমুকে ।
এদিকে ভোরের আলো ফুটতেই সেই পাহাড়ি পথে , কাটা লাশ পাওয়ার জায়গা দিয়ে এক পাহাড়ি লোক তার কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল । হঠাৎ রাস্তার পাশে ঝোপের আড়ালে কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গেল সে। কাছে আসতেই এমন জোরে এক চিত্কার মারল যে , সাথে সাথে আশ পাশের লোকজন সব জমা হয়ে গেল । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল , কাউকেই দেখতে পেল না তারা । এ সময় তাদের মধ্য থেকেও একজনের চোখ গেল ঐ ঝোপের আড়ালে । আগ্রহ নিয়ে সেও এগিয়ে গেল । কিন্তু এ কি কান্ড ! এ লোকটিও বিকট একটা শব্দ করে রাস্তা থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল । উপস্থিত সকলে এবার সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গেল । কেউ কেউ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগল , “আইজও কোন কাডা লাশ পইড়া আছে নিশ্চয়ই ! ওরে বাপরে ! এহনি ভাগি রে ! এমন ভয়াবহ দৃশ্যের চাইতে মরণও ভালা !” বলে চলে যেতে উদ্ধত হল তারা । কিন্তু এদের মধ্য থেকে সাহসী একজন বলে উঠল , “আপনেরা থামেনতো ! না দেইখাই বাবাগো , মাগো বইলা কান্দন লাগাইছেন । আগে আমারে একবার দেকতে দেন আসল ঘটনাডা কি ।” বলেই সাহস করে ঝোপটার কাছে আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে লাগল লোকটি । বাকিরা দূর থেকে ভয়ালো চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে । কাছে যেতেই এ লোকটিও ওমাগো বলে দুহাতে কান চেপে ধরে তীব্র এক চিত্কার দিয়ে উঠল । এরপর উল্টো পথে এমন এক দৌড় লাগালো , যে রাম রাম করে পালালো। এ ঘটনা দেখে বাকিরাও যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল ।
ইমু এদিকে মুয়াজ্জিন সাহেবের শিয়রের পাশে বসে মাথায় জল পট্টি লাগাচ্ছে । আর মুয়াজ্জিন সাহেব জ্বরের ঘোরেও ভূত ভূত বলে ফোঁপাচ্ছেন । মাথায় এত জল পট্টি লাগানোর পরেও জ্বর কমার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। ইমু এবার ক্ষাণিকটা বিচলিত হয়ে পড়ল , যে তাকে ওরকম ভয়ঙ্কর বেশে দেখতে পেয়েই লোকটির আজ এ অবস্থা । তার জন্য যেহেতু এরকম হয়েছে , সেহেতু সারিয়ে তোলার দায়িত্বও তার। যেভাবেই হোক , সারিয়ে তাকে তুলতেই হবে । মনে মনে একপ্রকার পণ করে বসল ও । তাই যত ধরণের চিকিত্সা বিদ্যা তার জানা ছিল , একে একে সব প্রয়োগ করে ফেলল । কিন্তু নাহ ! কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা । আসলে এটাতো ভয় থেকে আসা জ্বর ! তাই হয়তো কোন টোটকাই কাজে আসছে না । এমন সময় তার মনে হল , বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট পল ডেমনের কথা । তিনি বলেছিলেন , “ভয় পাওয়া রোগির একটাই চিকিত্সা – আর তা হল , আরেকবার ওরকম ভয় দেখানো । এরপর নিজের আসল রূপটা তার কাছে পরিষ্কার করে দেয়া । তাহলেই ব্যাস ! রোগি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে ।” কিন্তু এখানেও ঝামেলা । যদি এখনি মুয়াজ্জিন সাহেবের কাছে নিজের আসল রূপটা প্রকাশ করে দেয় ইমু , তাহলে হয়তো যে উদ্দেশ্যে এখানে আসা- তা অসমাপ্তই রয়ে যাবে । কারণ কাজ হয়ে যাওয়ার আগে কারো কাছেই নিজের আসল পরিচয়টা প্রকাশ করতে চায়না ও । তাই বিকল্প ব্যবস্থা ভাবতে হবে ।
অবশেষে অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করল , ঐ ফর্মূলাটাই ব্যবহার করবে । তবে একটু অন্যভাবে । এরপর নিজের ঘর থেকে একটা রাক্ষুসে মুখোশ বের করে নিয়ে এল । এবার মুয়াজ্জিন সাহেবের মাথার পাশে বসে মুখোশটা পরে নিয়ে একটা অদ্ভূত সুরে নাম ধরে ডাকতে শুরু করল । মুয়াজ্জিন সাহেব তখনো আবল তাবল বকে যাচ্ছেন । হঠাত্ একটা অদ্ভূত কন্ঠে নিজের নাম শুনতে পেয়ে বড় বড় চোখ করে তাকালেন । ওনি তখন উপরের দিকে মুখ করে সোজা চিত্ হয়ে শোয়া । কাজেই তাকানো মাত্রই চোখ গেল ইমুর দিকে । ওমাগো করে আরেকটা চিত্কার দিয়ে তত্ক্ষণাত্ শোয়া থেকে উঠে বসলেন । এরপর দুটো হাত জোর করে মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে অর্ধ স্বরে অস্পষ্টভাবে বলতে লাগলেন , “ভূউ….ত ভা…ই..রে ! মা..ফ কইরা দেন !” এসময় ইমু মুখ থেকে মুখোশটা খুলে মুয়াজ্জিন সাহেবকে আলতো করে একটা হাতে ঠিক ডান কাঁধটায় স্পর্শ করে তার চেনা সুরে ডেকে উঠল , “মুয়াজ্জিন সাহেব ! মুয়াজ্জিন সাহেব!” হঠাৎ চেনা সুর শুনতে পেয়ে যেন একটু সাহস ফিরে পেলেন তিনি। এরপর মাথাটা উঁচু করে ইমুর দিকে তাকিয়েই কিঞ্চিৎ শব্দ করে কেঁদে ফেললেন । ইমুও ওনাকে জড়িয়ে ধরে ডান হাতটা পিঠে চাপড়ে চাপড়ে সান্তনা দিতে লাগল । ইমু বুঝতে পারল , ওনি এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছেন আর জ্বরটাও প্রায় একেবারেই নেই ।
এদিকে কাটা লাশের জায়গা থেকে ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়া লোকেরা বিষয়টি জানালো স্থানীয় প্রধানকে । তিনি সবকিছু শুনে থানায় খবর দিলেন । থানা থেকে পুলিশের লোকেরা এলে , গ্রামের কয়েকজন সাহসী যুবককে সাথে নিয়ে সবাই মিলে হাজির হল সেখানে । এরপর আস্তে আস্তে কয়েকজন মিলে সেই ঝোঁপের কাছাকাছি এলে দেখতে পেল বিশাল দানবাকৃতির এক রাক্ষস পড়ে আছে । তবে মরে গেছে না বেঁচে আছে তা বুঝার কোন উপায় নেই । পরীক্ষা করার জন্য যে কাছে যাবে , এরকম সাহসও কারো হচ্ছেনা । কারণ- রাক্ষসটা কেমন যেন বিচ্ছিরি টাইপের । যেমন ভয়ালো তেমনি কুতসিত্ দেখতে । পুলিশের প্রধান লোকটি এর মাঝে বলে উঠল ,” তাহলে, এই রাক্ষসটাই হল আসল রহস্য ! যে কি-না কাটা লাশের মহানায়ক ! এ-ই তাহলে এতদিন এ এলাকায় ত্রাস ছড়িয়েছে ! কিন্তু এটাকে এখন কি করা যায় ?” পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন বলে উঠল , “এরে পরথমে মোডা রশি দিয়া ভালা কইরা বান্ধা হোক । তারপর সবাই মিইলা ইচ্ছা মত শোধ নেওয়া যাইব । বেডা আমাগোর কম ক্ষতি করেনাই ! যারে পাইছে তারেই মাইরা ফেলছে নির্মমভাবে । তার উপর আবার পাহাড়ি-বাঙালি বিবাদ বাড়াইছে । এ বেডারে একটা উচিত শিক্ষা দিতেই হইব ।” এদের কথায় অন্যসব লোকেরাও চিত্কার করে সমর্থন জানাল । তখন পুলিশ প্রধান সবাইকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইল , “কিন্তু এ বেটা এখানে এমন করে পড়ে গেল কিভাবে ?” কেউ একজন বলে উঠল , “মনে হয় পাও ফইসকা !” – “তা হতে পারে !” উপস্থিত সকলে সম্মতি জানাল । যাই হোক , পুলিশের লোকেরা সহ সকলেই হাফ ছেড়ে বাঁচল ।” যাক বাবা ! এতদিনে তাহলে আসল রহস্যটা উদঘাটন হল !”
এদিকে লোক মুখে ইমুর কানে খবরটা গেলে , যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছুটে এল সে । এসে খুব ভাল করে রাক্ষসটাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল , “ভাইসাহেবেরা ! মনে হচ্ছে এটা খুবই হিংস্র প্রজাতির রাক্ষস । আর এও বুঝা যাচ্ছে যে , এটা এখনো মরেণি । ফিট হয়েছে মাত্র । তাই আপনারা কেউ এর কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন না । আমি আপনাদের ভালোর জন্যই বলছি , আপনারা একে আমার হাতে তুলে দিন । আমার এক সূফি চাচা আছেন , যিনি রাক্ষসদেরকে পোষ মানিয়ে রাখেন । আপনারা অনুমতি দিলে আমি একে আজই শহরে চাচার কাছে নিয়ে যেতে পারি । এতে এ বেটার পাশাপাশি এর যারা সঙ্গি সাথী আছে , সবাই আমার চাচার অনুগত হয়ে যাবে । আর আপনারাও নিরাপদে চলা ফেরা করতে পারবেন ।” ইমাম সাহেবের কথা শুনে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল তাই হবে । কিন্তু বাধ সাধল পুলিশ প্রধাণ। সে বলল , “এটা এখন আইনানুগ ব্যাপার । এত সহজেতো একে আপনার সাথে নিতে দেয়া যায়না ।” – “বেশ ! তাহলে আপনারাও চলুন আমার সাথে ।” একথা বলার পর পুলিশদের আর কিছু বলার সুযোগ থাকল না । এরপর রাক্ষসটাকে একটা বিরাট কফিনে ভরে তালাবদ্ধ করে নিয়ে চলল শহরে ।
এদিকে ইমু সুযোগ বুঝে শহরের গোয়েন্দা অফিসারকে কি করতে হবে না হবে তা বুঝিয়ে বলে দিয়েছে আগেই । তিনিও কথামতো এক কামিল সূফির বেশ ধরে জায়গা মতো অবস্থান নিলেন । বেশ কিছুক্ষণ পর রাক্ষসটাকে নিয়ে সূফি বাবার কাছে পৌঁছুলে , ইমু সবার আগে তার কাছে এসে কানে কানে কি যেন বলল । সাথে সাথে বন্ধ চোখ খুলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি । এরপর ভয়ঙ্কর এক চাহনি দিলেন পুলিশ প্রধানের দিকে । কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভয়ানক সুরে বলে উঠলেন , “তুই মরবি ! এখনি মরবি ! বাঁচতে চাইলে পালা ! রাক্ষসটাকে কফিনসহ রেখে এখনি পালা ! যদি বাঁচতে চাস ! তো এখনি পালা ! কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান ফিরে পাবে সে । কাজেই বাঁচতে চাইলে পালা ! আর আমাকে আমার কাজ করতে দে !” সূফি বাবার কথা শুনে সব পুলিশেরাই ভয় পেয়ে গেল । তাই আর
একমুহূর্তও দেরি না করে কফিনটা যত তাড়া তাড়ি সম্ভব নামিয়ে ভাগা দিল তারা । আসলে পুলিশ প্রধান বাইরে থেকে সাহস দেখালেও ভিতরে কিন্তু একদম কাঁচা ! মনে হল সেই সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছে ।
পুলিশের লোকেরা সব চলে গেলে তালা খোলা হল কফিনের । পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গোয়েন্দা অফিসার জিজ্ঞেস করল, “এখন এ রাক্ষসটাকে নিয়ে কি করা হবে স্যার ?” ইমু একটু মুচকি হেসে চুপ করে রইল । কিছুই বলল না । গোয়েন্দা অফিসার বুঝতে পারল , নিশ্চয়ই এতে কোন ক্লু রয়েছে । তাই আর নতুন কোন প্রশ্ন না করে চুপচাপ দেখে যেতে লাগল আসলে কি হয় । ইমু এবার কফিনের চারপাশটা একবার প্রদক্ষিণ করে অফিসারকে বলল একটা ধারাল ছুরি এনে দিতে । অফিসার তাই করলে ইমু রাক্ষসটার ঠিক পেটের দিকটায় ছুরিটা হালকা একটু ঢুকিয়ে উপরের দিকে টেনে তুলল । সাথে সাথে ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা ! কুতসিত্ রাক্ষসটার ভিতর দেশে দেখা গেল আরো একটা ফর্সা চামড়ার আস্তরণ । পুরো চামড়াটা ছাড়ানোর পর আসল রহস্য উদঘাটন হল । আসলে এ কোন রাক্ষস নয় । এ নিতান্তই একজন মানুষ । তবে বড় বেশি স্থূলকায় এবং লম্বা সাইজের । তাই উপরে আলগা চামড়া লাগিয়ে খুব সহজেই রাক্ষসের বেশ ধরতে পেরেছে ।
এদিকে এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও লোকটি এখনো জ্ঞান ফিরে পায়নি । ইমু এবার সব বুঝতে পারল । সে রাতে তার কাঁধে যে হাত রেখেছিল , এ নিশ্চয় সে-ই হবে । ইমুর ঐ রকম ভয়ঙ্কর রূপ দেখেই হয়তো ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিল । যাই হোক , এ বেটাকে এখন জ্ঞান ফিরানো দরকার । তাই হাতে একটু পানি নিয়ে লোকটির সমস্ত চোখে মুখে কয়েকবার ছিটা দিয়ে দিল সে । পাঁচবারের মাথায় এরূপ করার ফলে লোকটির জ্ঞান ফিরে এল । জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখ বন্ধ করেই ভয়ে কুঁকড়াতে কুঁকড়াতে বলতে লাগল , “ভূত ভাই ! আমারে মাফ কইরা দেন । আমারে জানে মাইরেন না । দোহাই লাগে আপনার ! আমারে জানে মাইরেন না । আমি কথা দিতাছি , আমি আর এই কামে থাকমুনা ।” ইমু এবার অভয় দিয়ে বলে উঠল , “আপনার কোন ভয় নেই । আপনি নিশ্চিন্তে চোখ খুলতে পারেন । আর আমরা কোন ভূত নই । আপনারই মত সাধারণ মানুষ ।” লোকটি এবার আস্তে আস্তে চোখ খুলে চোখের সামনে দেখতে পেল দুজন মাওলানা সাইজের ব্যক্তি দাঁড়িয়ে । সেইসাথে এও বুঝতে পারল , ওনাদের কাছে যে এর আসল রূপ ধরা পড়ে গেছে । তাই নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করল , “আপনারা ?”
এদিকে ধরা পড়া লোকটার কাছ থেকে সবকিছু জেনে নিয়ে ইমু আজ রাতে আবার সেই রহস্য ঘেরা কাটা লাশের মর্মান্তিক জায়গাটার দিকে ছুটে চলল । আর বার বার আওড়াতে লাগল লোকটার রহস্যময় কথাগুলো । কিন্তু নিজ চোখে সবকিছু দেখার আগে আর এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পাচ্ছেনা সে । নাহ ! যে করেই হোক , আজ রাতের মধ্যেই রহস্যের চূড়ান্ত সমাধান করতে হবে তাকে । এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে সে । কাজেই খুব সতর্ক হয়ে গেল ইমু । পুরো ঘটনাটার সুরাহা না করা পর্যন্ত কাক পক্ষিও যেন কিছু টের না পায় সে পদ্ধতিই গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিল সে । কাজেই দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যাওয়া খুবই সংকীর্ণ আর ঝোপ ঝাড় বেষ্টিত উঁচু নিচু পথ ধরে অতি সন্তর্পনে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল সামনের দিকে । গজ শতেক যাওয়ার পর হঠাৎ থমকে দাঁড়াল । “একি ! সামনে যাওয়ার জন্যেতো আর কোন পথই দেখা যাচ্ছেনা ।” একটু বিচলিত হয়ে গেলে চোখ বুঁজে আবার মনে করার চেষ্টা করল লোকটার কথাগুলো ।
কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে অদ্ভূত রকমের কিছু অঙ্গ ভঙ্গি করতে দেখা গেল তাকে । এরপর পাহাড়ের গায়ে হাতরে হাতরে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল ও। হঠাৎ একটা জায়গায় এসে থেমে গেল তার হাত । এখানে সুতার মত কিছু একটা লম্বালম্বিভাবে চোখে পড়ল তার কাছে । দেখতে সুতার মত মনে হলেও এটা কিন্তু মোটেও সুতা নয় । খুবই শক্ত আর মজবুত লোহার পাত এটি । তবে আশ্চর্যের বিষয় হল এখানে কেবল মাত্র একটি লোহার পাত নয় ! দু দুটি পাতলা লোহার পাতের এক সাবলিল সমন্বয়ে তৈরি এটি । এই পাত দুটিকে বিচ্ছিন্ন করেই ভিতরে প্রবেশ করতে হবে ইমুকে । কেননা এটাই কেবল একমাত্র প্রবেশ পথ এ গুপ্ত আস্তানাটির ।
ইমু পকেট থেকে একটা অতি সূক্ষ্ম ফিতার মত চওড়া আর ছোট স্কেল সাইজের ন্যায় আকৃতির একটি চাকুর মত জিনিস বের করে পাত দুটির মাঝখানে ছোঁয়াতেই একেবারে কোন রকম শব্দ না করে মানুষ ঢোকার মত একটি প্রবেশ পথ তৈরি হয়ে গেল । ইমু ভিতরে ঢুকতেই আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেল প্রবেশ পথটি । ইমু একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে একটা পা সামনে ফেলে আরেকটা পা ফেলার চেষ্টা করতেই আতঁকে উঠল । “একি ! সামনে যে সামান্য ব্যবধান রক্ষা করে অনেকগুলো গভীর গর্ত সুসজ্জিত ! আর একটু হলেই বুঝি প্রাণ পাখি উড়ে যেত !” তাই মনে মনে আল্লাহর কাছে লাখ কোটি শুকরিয়া জ্ঞাপন করে অতি সাবধানতার সাথে এক এক করে গর্তগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল সে । এভাবে কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল আস্তানার প্রধান ফটক । কাজেই ফটকে কিছুক্ষণ কান পেতে ভিতর থেকে কিছু শোনার চেষ্টা করল । কিন্তু কিছুই শুনতে পেলনা সে । তাই আর দেরি না করে কায়দা মাফিক ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল
ভিতরে ঢুকার পর প্রথমে ইমু যা প্রত্যক্ষ করল তা রীতিমত চমকে উঠার মত । একটি কাঁচ ঘরে অসংখ্য ভয়াবহ বীভত্স লাশের স্তূপ । তবে এখনো তরতাজা । মনে হয় মেডিসিন দিয়ে রাখা হয়েছে । এরপর আরেকটু এগুতেই দেখতে পেল একটা ঘরে কিছু লোক মিলে কয়েকজন অজ্ঞান ব্যক্তির শরীরে কি যেন একটা ইঞ্জেকশনের মত পুশ করছে । কিছুক্ষণ পর দেখা গেল ইঞ্জেকশনকৃত লোকদের জায়গায় কেবল তাদের পরিহিত কাপড় চোপর পড়ে আছে । আর লোকগুলো উধাও । আসলে এটা এমনি ইঞ্জেকশন যা কারো শরীরে একবার পুশ করে দিলে টানা সাতদিন পর্যন্ত তাকে আর চোখে দেখার কোন জো থাকেনা । তবে তারা কিন্তু অন্যদের ঠিকই দেখতে পায় । কিন্তু নিজের বিবেক বুদ্ধি বলতে তার আর কিছুই করার থাকেনা । তারা তখন হয়ে যায় অন্যের ইশারার গোলাম । আর এ সুযোগটাই কাজে লাগায় ক্রিমিনালেরা । তাদেরকে দিয়ে ইচ্ছে মত ক্রাইম করিয়ে নেয় ওরা । আর কাটা লাশের ঘটনা ! এটাও তাদের একটা সাজানো খেলা ।
এর মূল রহস্য হল , এরা বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা উপায়ে রেলে কাটা পড়া মৃত ব্যক্তিদের বীভত্স লাশ সংগ্রহ করে জমা করে । ইমু একটু আগে যে লাশগুলো দেখল , তার সবই ঐভাবে সংগ্রহ করা । তবে প্রশ্ন হল- কেন তারা এরূপ করতো ? এর কেবল একটাই উত্তর । আর তা হল তারা যখন পাহাড়ি ঐ নির্জন পথটি থেকে কয়েকজন করে মানুষকে ধরে নিয়ে যেত তখন তাদেরকে যেন খোঁজাখুজির চেষ্টা না করা হয় তাই তাদের বদলে ঐ সংগ্রহকৃত লাশগুলোকে তাদের পরিহিত পোষাক পড়িয়ে ফেলে রাখা হতো । যাতে করে মানুষেরা মনে করে কোন দেও দানব এদেরকে এরকম নির্মমভাবে খুন করে ফেলে রেখেছে । ফলে তারা তাদের অপরাধের সম্রাজ্য নির্বিঘ্নে বিস্তার করতে সুচতুর এ পদ্ধতিকে বেছে নিত । এতকিছু ইমু কিছুতেই জানতে পারতোনা । যদিনা সেদিন রাতে ঐ ভূয়া ধানবটা ইমুর ভয়ালো রূপ দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়ে ধরা না পড়তো । হঠাত্ বাইরে থেকে কারো ভিতরে প্রবেশ করার লক্ষণ টের পেয়ে ইমু চট করে সুবিধা মত একটা জায়গায় লুকিয়ে পড়ল । এসময় ভিতরে ঢুকল কয়েকজন স্যুট টাই পড়া লোক । বুঝা গেল এরাই হল আসল মদতদাতা । কাজেই আর একমুহূর্তও দেরি না করে সব ঘটনা জানিয়ে পাশের থানার ওসিকে প্রয়োজনীয় ফোর্স সমেত এসে এখনি জায়গাটা ঘীরে ফেলতে বলে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিল ও। এরপর প্রায় ঘন্টাখানেক পরে একটা ফিরতি ম্যাসেজ পেয়ে ইমু আস্তানা থেকে বাইরে বেরিয়ে এল ।
এ মুহূর্তে গোপন আস্তানার চতুর্দিক থেকে পুলিশ বাহিনী ঘীরে রেখেছে । তাছাড়া এলাকাবাসিও খবর পেয়ে চলে এসেছে বিপুল উত্সাহ নিয়ে । আসলে আজ একটা অদ্ভূত রহস্য উন্মোচন হতে যাচ্ছে সবার সামনে । তাই এরকম একটি ঘটনার সাক্ষি হয়ে থাকার জন্যেই সবাই এত উত্সাহ নিয়ে এই রাতের বেলাতেই ছুটে এসেছে । যাই হোক , ইমু এবার মাইক দিয়ে ভিতরে অবস্থানরতদেরকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাল । প্রথমে ক্রিমিনালগুলো কিছুই বুঝতে পারেনি । কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারল তারা বন্ধি । আর তাদের বাঁচার কোন পথই খোলা নেই । কাজেই আর কোন ফন্দি না এঁটে এক এক করে আত্মসমর্পণ করল সবাই । আর এভাবেই সকলের সামনে ভয়ঙ্কর কাটা লাশের বীভত্স রহস্যের প্রকৃত দ্বার দ্বিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল । সবাই বুঝতে পারল এটা কোন ভূত প্রেত কিংবা দেও দানবের কান্ডকারখানা নয় । এটা কতগুলো ক্রিমিনালের সুপরিকল্পিত কাহিনীর প্রতিফলন মাত্র?
সমাপ্ত