অফিস থেকে ফিরেই লিভিং রুমে ঢুকে গায়ের কোটটা খুলে সোফার ওপরে ফেলে বসে পরলো ফারহান। গলার টাইটা ঢিল করে দিয়ে শরীরটাকে এলিয়ে দিলো সোফার ওপরে । অফিসে আজকে অনেক খাটুনি হয়েছে। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর কোটটা নিয়ে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলো । শার্ট প্যান্ট খুলে যথাস্থানে রাখলো। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসেই ঝপাৎ করে শুয়ে পড়লো নরম বিছানার ওপরে । আজ বাইরে থেকেই খেয়ে এসেছে। খাওয়ার বালাই নেই আজ । বাড়িতে ও ছাড়া আর কেউ থাকেনা । সব কাজ ওকে একাই করতে হয়। চাকরিটা নতুন পেয়েছে ও। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদে । বেশ ভালো বেতন। তাছাড়া থাকার জন্য এই দোতলা কটেজটা দেওয়া হয়েছে তাকে । আশেপাশে আর কোনো বাড়িঘর নেই। বেশ নিরিবিলি। জায়গাটা বেশ পছন্দ হয়েছে ওর। তবে একটা সমস্যা আছে এখানে । কাজের লোক পাওয়া যায়না । তাতে বেশি একটা সমস্যা নেই । ও নিজের কাজ নিজে করতেই ভালোবাসে । তবে সমস্যা হলো রান্না নিয়ে । একজন রান্না করার মানুষ পেলে বেশ উপকার হতো ওর । তবে নেই যখন, তখন কি আর করার । নিজের রান্না নিজেই করে ও। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে খেয়ে আসে।
এর আগে এখানে রফিক নামের এক ভদ্রলোক চাকরি করতো । লোকটা নাকি নিজেই এই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে । লোকটা রিজাইন করার কারণেই ফারহান চাকরিটা পেয়েছে । কিন্তু ফারহান ভেবেই পাচ্ছেনা কোনো সমস্যা ছাড়া লোকটা এতো সুন্দর চাকরিটা ছেড়ে দিলো কেনো । এর থেকে ভালো কোনো চাকরি পেয়ে যে এটা ছেড়েছে তাও নয়, ফারহান শুনেছে লোকটা তার গ্রামের বাড়িতে যেয়ে ফুলের চাষ শুরু করেছে । সাধারণ ফুলের চাষ করার জন্য এতো সুন্দর একটা চাকরি ছেড়ে দিবে? হয়তো অন্য কোনো কারণ ও থাকতে পারে, যেটা জানেনা কেউ । তাছাড়া এই দুনিয়ার কতো মানুষের কতো যে মর্জি সেটা জানেনা কেউ । এসব নিয়ে আর ভাবতে চাইলো না ফারহান । আলিশাকে ফোন দেওয়ার জন্য টেবিলের দিকে হাত বাড়ালো ফোনটা নেওয়ার জন্য । ঠিক এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠলো ল্যান্ডফোনটা । সেদিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হলো সাকিব । টেবিল ঘরিটার দিকে তাকিয়ে দেখলো ন’টা বাজে তখন । ফারহান ভেবে পাচ্ছেনা এই ল্যান্ডফোনে তাকে কে ফোন দিলো । এখানে আসার পর থেকে একবারও ব্যবহার করেনি ফোনটা । তাহলে কে ফোন দিলো ওকে? অফিস থেকে দেইনি তো? তা হবে কেন? অফিসে তো ওর সেল ফোনের নাম্বার দেওয়া আছে । সেখান থেকে ফোন দিলে তো ওর সেল ফোনে দেওয়ার কথা । ল্যন্ডফোনে না । তাহলে কে দিলো?
ও এসব ভাবছে আর এদিকে সমানে ফোন বেজেই যাচ্ছে ।
ফোনের দিকে তাকালো ফারহান । ধুর! এতোকিছু ভাবছি কেনো আমি । “মনে মনে বলল সে । ফোনটা তুললেই তো বুঝতে পারবো কে ফোন দিয়েছে ।
রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকালো ফারহান । হ্যলো বলার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো যান্ত্রিক একটা কন্ঠস্বর । “থ্রি ওয়ান, ওয়ান জিরো, টু জিরো ওয়ান এইট”। “এই সংখ্যা গুলো বলতে লাগলো কন্ঠস্বরটা । বিরক্ত হয়ে রিসিভারটা রেখে দিলো ফারহান । নিজের সেলফোনটা নিয়ে ফোন দিলো আলিশার কাছে । দুবার রিং হতেই রিসিভ করলো আলিশা । কথা বলা শুরু করলো ওর সাথে ।
সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে পরিচয় ওদের । তারপর বন্ধুত্ব । এখন অবশ্য দুজন দুজনকে ভালোবাসে তবে মুখ ফুটে বলতে পারেনা কেউ কাউকে । ফারহান ভেবেছে সামনের জন্মদিনে মনের কথাটা জানিয়ে দিবে আলিশাকে । আলিশাও নিশ্চয় না করবে না । কারণ আলিশাও যে ওকে পছন্দ করে সেটা খুব ভালো করেই জানে ফারহান ।
আলিশার সাথে কথা শেষে ল্যাপটপটা নিয়ে বসলো সে । অফিসের কিছু কাজ করে ঘুমিয়ে পড়লো । অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো সকালে । ব্রেকফাস্ট নিজেই তৈরি করলো । সেটা খেয়ে নিলো । রেডি হয়ে রওয়ানা হলো অফিসের উদ্দেশ্যে । প্রতিদিনকার মতো আজও সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকলো । সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হবার সময় আলিশা ফোন দিলো । একসাথে ডিনার করার বাইনা ধরলো সে । রাজি হয়ে গেলো ফারহান । বাসায় যেয়ে নিজেকেই রান্না করতে হতো ফারহানের । আলিশার সাথে বাইরে থেকে ডিনার করলে রান্না করার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে সে । আলিশার বাসার সামনে থেকে তাকে তুলে নিলো ফারহান । একটা নামীদামি রেস্টুরেন্টে যেয়ে ডিনারটা সেরে নিলো । ফেরার পথে আলিশাকে তার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে নিজের কটেজে চলে আসলো সে । সিড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে মোবাইলের স্ক্রিনে দেখলো সাড়ে আটটা বেজে গেছে । দ্রুত ওপরে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে । আজ মনটা বেশ ভালো ওর । আসোলে আলিশার সাথে ডিনার করার কারণে একটু বেশিই ভালো লাগছে ওর । বেডরুমে যেয়ে বিছানার ওপরে বসে পড়লো । কোলের ওপরে একটা বালিশ নিয়ে ল্যাপটপটা রাখলো সেখানে । প্লে লিস্টের প্রিয় গানগুলো শুনতে লাগলো । এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে উঠলো ল্যান্ডফোনটা । ভ্রু কুচকে বিরক্তি প্রকাশ করলো । একবার ভাবলো ফোনটা তুলবেনা । পরক্ষনেই ভাবলো দরকারী কোনো ফোন ও তো হতে পারে । একটা মুহুর্ত দ্বিধা করে রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকালো সে । আবার সেই যান্ত্রিক কন্ঠস্বরটা । সেই একই কথা, আসোলে কথা নয় সংখ্যা বলছে, গতোকাল যেগুলো বলেছিলো । “থ্রি ওয়ান, ওয়ান জিরো, টু জিরো ওয়ান এইট । মেজাজ বিগড়ে গেলো ফারহানের । এই রাতে এমন মজা করার কোনো মানেই হয়না । আছাড় দিয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো সে । সব রাগ যেনো ওই রিসিভারের ওপরেই ঝরে পড়লো । নিজের সেলফোনটা নিয়ে বাড়িতে ফোন করলো সে । বাব-মা, ছোটবোন, সবার সাথে কথা বলল । মেজাজ ঠিক হয়ে গেলো আবার । সকালে অফিসে যাওয়ার পথে ফোন কোম্পানিকে একবার ফোন করে বিষয়টা জানানোর কথা চিন্তা করে ঘুমিয়ে পড়লো সে । প্রতিদিনকার মতো অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো । রেডি হয়ে গেলো অফিসে । তবে গতরাতের কথা বেমালুম ভুলে গেলো । যার কারণে ফোন কোম্পানিকেও আর ফোন করা হলো না । সারাদিন অফিসের কাজ করার পর সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলো । আজ আর বাইরে থেকে খেয়ে আসেনি । রান্না করে খেতে হবে আজ । ফ্রেশ হয়ে নিয়ে রাইস কুকারে ভাত চড়িয়ে দিয়ে বেডরুমে এসে বসলো একটু বিশ্রাম করার জন্য । হঠাৎ টেবিল ঘড়িটার দিকে নজর গেলো তার । ন’টা বাজতে আর মাত্র দুই মিনিট বাকি । ওর কেন জানি মনে হলো আর দু’মিনিট পরেই ফোনটা বেজে উঠবে । রিসিভ করতেই শুনতে পাবে সেই যান্ত্রিক কন্ঠস্বরটা । এমন সময় দূরে কোথাও একটা শেয়াল আর্তনাদ করে উঠলো । নিজের অজান্তেই কেপে উঠলো ফারহান । আতংকে । তবে কিসের আতংক সেটা বুঝতে পারলো না । ওর ঘোর ভাঙতেই টেলিফোনটা বেজে উঠলো;- “ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং । সেই শব্দে আতকে উঠলো ফারহান ।
ফারহান খুব সাহসী । ভূত প্রেতে ভয় পায়না সে । তবে কেনো জানি এখন ওর খুব ভয় লাগছে । কিসের জন্য লাগছে সেটা বুঝতে পারছেনা । ওই টেলিফোনটান জন্য? এটা ভাবতেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোটের কোণে । একটা সাধারণ টেলিফোনের জন্য ভয় পাবো আমি? “ধুর কী আবোলতাবোল ভাবছি । আসোলে সারাদিন কাজ করতে করতে মাথাটা গেছে আমার ।
ফারহান এসব ভাবছে আর এদিকে টেলিফোনটা একবার রিং শেষ হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বাজা শুরু করেছে । রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকালো ফারহান । সেই যান্ত্রিক কন্ঠস্বরটা । একই সংখ্যা বলে যাচ্ছে । প্রতিদিন যেটা বলে । ফারহান এটা আগে থেকেই জানতো, তাই অবাক হলো না । তবে আজ আর রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো না সে । ভাবলো কন্ঠস্বরটা কি কি বলে আজ সব শুনবে । কন্ঠস্বরটা বলতে থাকলো;- ” থ্রি ওয়ান ওয়ান জিরো টু জিরো ওয়ান এইট । তারপর কিছুক্ষণ থেমে যেটা বলল সেটা শুনে হতবাক হয়ে গেলো ফারহান । “বিওয়্যার অফ ডেঞ্জার । ‘বিপদ থেকে সাবধান থেকো । “বিড়বিড় করে বলল ফারহান । কীসের বিপদ? ভেবে পেলো না । ঠিক এমন সময় তার সেলফোনটা বেজে উঠলো । আলিশা ফোন করেছে । আলিশাকে টেলিফোনের বিষয়টা বলল ফারহান । যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলে বিষয়টা কাটিয়ে গেলো আলিশা । বলল ফোন কোম্পানিকে বললেই ওরা বেপারটা দেখবে । যান্ত্রিক ত্রুটি থাকলে ঠিক করে দিবে সেটা । আলিশার কথায় যৌক্তিকতা খুঁজে পেলো ফারহান । সেও ভাবলো, হয়তো কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে এমনটা হচ্ছে । এটা নিয়ে আর ভাবলো না সে । ঘুমিয়ে পরলো । মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো বাজে একটা স্বপ্ন দেখে । দেখলো ভয়ংকর চেহারার একটা মেয়ে গলা টিপে ধরছে ওর । দম আটকে মারা যাচ্ছে সে ।
টেবিলের ওপর থাকা গ্লাসের পানিটুকু খেয়ে আবার শুয়ে পরলো সে । রাতে একটু বেশিই ভেবেছে । তাই হয়তো এমন স্বপ্ন দেখেছে । “নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো । তারপর আবার ঘুমিয়ে পরলো । প্রতিদিনকার মতো অফিসে গেলো আজ ও । যাওয়ার পথে ফোন কোম্পানিকে ফোন করে গতরাতের বিষয়টা বলল । কোম্পানি থেকে তাকে জানালো আজই তারা লোক পাঠাবে । কোনো সমস্যা থাকলে সেটা ঠিক করে দিয়ে আসবে । চিন্তামুক্ত হলো ফারহান । সন্ধ্যায় যখন অফিস থেকে ফিরছিলো ফারহান, তখন ফোন কোম্পানি থেকে ফোন দেওয়া হলো তাকে । তারা জানালো গত একমাস যাবত তার টেলিফোনটা ডেড ছিলো । সুতরাং কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি কিংবা কেউ ফোন করে ফাজলামি করার প্রশ্নই আসেনা । তারা আরো জানালো, তার ফোনটা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে । এখন থেকে সচল সেটা ।
শেষের কথাগুলো কানে তুললো না ফারহান। একটা প্রশ্নই এখন সে ভাবছে, “ফোন যখন ডেড তাহলে প্রতিদিন ঠিক রাত ন’টায় তাকে কে ফোন করতো?
উত্তর খুঁজে পেলো না ফারহান বাইরে থেকে ডিনার করে বাসায় ফিরলো সে। সবকিছু গুছিয়ে বেডরুমে যখন ঢুকলো আটটা পঞ্চাশ বাজে তখন । টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছে সে। জানে আর দশ মিনিট পরেই সেই অদ্ভুত ফোনকলটা আসবে। ঠিক রাত ন’টায় ক্রিং ক্রিং করে উঠলো টেলিফোনটা।
সঙ্গে সঙ্গেই রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকালো ফারহান। সেই একই কন্ঠস্বর। একই কথা। রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো সে। গভীর ভাবনা চলছে তার মাথায়। কেউ কী তাকে সাবধান করছে? আর এই নাম্বারগুলোই বা কী?
নাম্বারগুলো নিয়ে একটার পর একটা সাজাতে শুরু করলো সে। শেষে যে সংখ্যাটা পেলো সেটা অনেকটা এরকম; ” ৩১১০২০১৮। সংখ্যাটা খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো সে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেলো ফারহানের মাথায় । “৩১” মানে এটা কোনো তারিখ। আর “১০” এটা কোনো মাস। ইংরেজিতে ১০ম মাস হলো অক্টোবর। আর “২০১৮” তো চলতি সাল। সবশেষে দাঁড়ায়, চলতি বছরের ৩১শে অক্টোবর। আরে এটাতো আমার জন্মদিন। “বলে উঠলো ফারহান।
তারমানে ৩১শে অক্টোবর আমার কোনো বিপদ হবে? তাহলে কী এই ফোনকলটা সেই আসন্ন বিপদ থেকে সাবধান করছে ওকে? সেটা কীভাবে সম্ভব? যে এই ফোনকলটা করছে সে কীভাবে জানলো ৩১শে অক্টোবর আমার বিপদ হবে? এমন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ফারহানের মাথায় । কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছেনা সে।
অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করেনা ফারহান । কিন্তু পৃথিবীতে এমন হাজারো অলৌকিক ঘটনা আছে যেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি আধুনিক বিজ্ঞান, সে বিষয়ে খুব ভালোভাবেই অবগত আছে সে। তাহলে এই ফোনকলটাও কী তেমনি এক অলৌকিক কিছু? নাহ! এসব কী ভাবছি আমি? নিশ্চয়ই কেউ আমার সাথে মজা করছে। “ভাবলো সে।
কিন্তু যখন ফোন ডেড ছিলো তখন কীভাবে ফোনকলটা আসতো? “নিজেকে প্রশ্ন করলো সে। কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না।
এসব নিয়ে আর ভাবতে চাইলো না সে। অফিসের অনেক কাজ পড়ে আছে। আগামীকাল সেগুলো করতে হবে। অনেক খাটুনি হবে সারাদিন। সুতরাং এখন ঘুমানোই বেটার । যেই ভাবা সেই কাজ। ঘুমিয়ে পরলো সে। কিন্তু আজকেও গতরাতের মতো একটা দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো তার। সেই একই স্বপ্ন। ভয়ংকর চেহারার একটা মেয়ে গলা টিপে ধরছে তার। বিষয়টাকে আজও পাত্তা দিলো না সে । ভাবলো, আজ কয়েকদিন অনেক বেশি খাটুনি যাচ্ছে তার ওপর, তাছাড়া অনেক বেশি চিন্তা করছে। তাই হয়তো এমন উদ্ভট স্বপ্ন দেখছে।
এর মাঝে অফিসের কাজে দুই দিনের জন্য শহরের বাইরে পাঠানো হলো তাকে । শহরে ফিরলো আবার ৩০শে অক্টোবরে। অফিসের কাজ গুছিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে গেলো। এই দুইদিন বাইরে থাকায় ফোনকলটার কথা ভুলেই গিয়েছিলো সে। কিন্তু বাড়িতে ঢুকতেই সেটা আবার মনে পড়লো তার। অজানা আতংক গ্রাস করলো তাকে। ডিনার শেষে বেডরুমে যখন ঢুকলো সাড়ে আটটা বাজে তখন। ল্যাপটপটা নিয়ে প্রিয় একটা গান প্লে করে দিলো। আগামীকাল জন্মদিন তার। কি কি করবে সেটাই ভাবতে থাকলো। এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে উঠলো টেলিফোনটা । অজানা আতংকে আতকে উঠলো ফারহান। যেনো ওই ফোনকলটা ওকে মেরে ফেলবে। বাজুক টেলিফোন। আজ আর ওটা ধরবো না। রিসিভারটা তুললো না সে । কয়েকবার ক্রিং ক্রিং করে বন্ধ হয়ে গেলো সেটা। ওটা বন্ধ হতেই যেনো হাফ ছেড়ে বাচঁলো ফারহান । এমন সময় কাছে কোথাও একটা নেকড়ে আর্তনাদ করে উঠলো। সেটার শব্দ শুনে আতকে উঠলো ফারহান। এখানে তো কোনো নেকড়ে নেই। তাহলে কিসে ডাকলো এমন করে? “ভাবলো সে । পরক্ষনেই ভাবনাটা উড়ে গেলো যখন টেলিফোনটা আবার বাজতে শুরু করলো। কাঁচি দিয়ে টেলিফোনের লাইনটা কেটে দিলো সে । রাগে না ভয়ে বোঝা গেলো না । কিন্তু থামলো না ওটা । রিসিভার না তোলা সত্বেও সেই সংখ্যাগুলো বলতে লাগলো যান্ত্রিক কন্ঠস্বরটা । এবার অনেক বেশি ভয় পেয়ে গেলো ফারহান। এসি চলা সত্বেও দরদর করে ঘামছে সে। হার্টবিট এমন পর্যায়ে পৌছুলো, আন্দাজ করলো এখন ওটা শান্ত না হলে বুক ফেটে বেড়িয়ে আসবে।
এক পর্যায়ে রিসিভারটা তুলে আছাড় মারলো সে। শক্ত মেঝেতে পরে কয়েক টুকরো হয়ে গেলো সেটা। কিন্তু বন্ধ হলো না। যান্ত্রিক কন্ঠস্বরটা একই ভাবে সেই সংখ্যা গুলো আওড়াতে লাগলো। শেষে আরকটা বাক্য; “বিওয়্যার অফ ডেঞ্জার। যার অর্থ, “বিপদ থেকে সাবধান থাকো।
এবার টেলিফোন থেকে নয়, পুরো ঘরজুড়ে শোনা গেলো কন্ঠস্বরটা। সেই সাথে ইলেকট্রনিক বাতিগুলোর জ্বলানেভা। বিছানার ওপরে শুয়ে পরলো ফারহান । বালিশ দিয়ে মাথা চেপে ধরলো । কিন্তু থামলো না ওটা। একভাবে চলতে থাকলো। যখন থামলো রাত বারোটা বাজে তখন। ঠিক এই সময় ফারহানের সেলফোনটা বেজে উঠলো । আলিশা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করে কানের কাছে ধরলো ফোনটা। “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ” ওপাশ থেকে বলল আলিশা । থ্যা-থ্যাংকস । কাপা কাপা কন্ঠে বলল ফারহান। বিদ্ধস্ত কন্ঠস্বর। আলিশা সেটা ঠিকই ধরে ফেললো। জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে?
ফারহান এক মুহুর্ত দ্বিধা করে আলিশাকে সব খুলে বলল। সব শুনে আলিশা বলল, “সারাদিন অনেক খাটুনি গেছে তোমার ওপর দিয়ে। এইজন্য হয়তো হ্যালুসিনেসন হচ্ছে। কিন্তু কথাটা মানতে পারলো না ফারহান। তবে কিছু বললও না।
এই শোনো, কাল আমরা সারাদিন ঘুরবো। সকাল সকাল রেডি থেকো তুমি। “আলিশা বলল। আচ্ছা ঠিকাছে। “কোনোরকমে কথাটা বলে ফোন রেখে দিলো ফারহান। ঘুমিয়ে পরলো। সকালে ঘুম ভাঙলো আলিশার ফোনে। ফোনটা রিসিভ করতে করতেই কেটে গেলো। ফারহান দেখলো সাতাশটা মিসডকল উঠে রয়েছে। সবগুলোই আলিশা দিয়েছে। দ্রুত কল ব্যাক করলো সে। আলিশা বলল দ্রুত বের হও তুমি ।
দ্রুত রেডি হয়ে নিজের গাড়িটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো ফারহান। আলিশাদের বাসার সামনে থেকে তাকে তুলে নিয়ে গেলো। সারাদিন ঘুরলো দুজনে মিলে।
পার্কে বসে আছে দুজনে। পকেট থেকে ডায়মণ্ডের রিংটা বের করলো ফারহান। আলিশার আঙ্গুলে পড়িয়ে দিলো সেটা। ঠিক এমন সময় গুলি ফোটার শব্দ হলো। মুহুর্তের মাঝে মাটিতে ঢলে পড়লো ফারহান।
দীর্ঘ একমাস হাসপাতালে থাকার পর আজ রিলিজ পেলো ফারহান। ভাগ্য ভালো থাকায় গুলিটা ওর বুকে না লেগে পেটে লেগেছিলো । নাহলে মারা-ই পরতো। পুরো একমাস ওর পাশে থেকেছে আলিশা। একটা মুহুর্তের জন্য ওকে ছেড়ে যায়নি । আজও এসেছে একিটা ফুলের তোড়া নিয়ে। আলিশা আর ফারহান মিলে ফারহানের কটেজে ফিরলো। ওকে কটেজে নামিয়ে দিয়েই চলে গেলো আলিশা। বলে গেলো রাতে আবার আসবে। প্রথমে নিজের বেডরুমে ঢুকলো ফারহান। টেলিফোনটা কয়েক টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে। যেমনটা একমাস আগে রেখে গিয়েছিলো সে। প্রথমেই ফোনের ভাঙা অংশগুলো একজায়গায় করে রাখলো ফারহান । সত্যিই সেই ফোনকলটা সতর্ক করে দিয়েছিলো ওকে । একটা প্রশ্নের উত্তর সে কোনোভাবেই পেলো না। এই ফোনকলের রহস্য কী?
হ্যা, এটার উত্তর রফিক সাহেব দিতে পারে আগে এখানে যে ছিলো। এখন রফিক সাহেবকে খুঁজে বের করতে হবে।
পরদিন সকালে উঠেই অফিসে গেলো সে । অফিসের ডকুমেন্টারি থেকে রফিক সাহেবের ফোন নাম্বার খুঁজে পেলো সে । সাথে গ্রামের ঠিকানাও। তখনি ফোন করলো সে। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোন তুললো কেউ । রফিক সাহেব ফোন ধরেছে।
তারপর রফিক সাহেবকে সবকিছু খুলে বলল সে। সব শুনে রফিক সাহেব বলল; ওই কটেজে একটা অলৌকিক শক্তির বসবাস যেটা বিপদের আগে ফোনকলের মাধ্যমে কটেজের মালিককে সতর্ক করে দেই। আমাকে অনেক বিপদের হাত থেকে বাচিয়েছে সে। ওই অলৌকিক শক্তিই আমাকে এই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে যেয়ে ফুলের চাষ করতে বলেছিলো। ওর কথামতোই আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে এসে ফুলের চাষ শুরু করেছি। মনে রেখো ও কিন্তু তোমার বন্ধু। কোনো বিপদ আসলেই তোমাকে আগে থেকে জানিয়ে দিবে। আর ফোনটা আজই ঠিক করে ফেলো তুমি।
রফিক সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দিলো ফারহান। সেদিনই কটেজে ফিরে ফোনটা ঠিক করে ফেললো সে। কয়েকদিন আর কোনো ফোন এলো না। হয়তো সামনে কোনো বিপদ নেই। এর মাঝে আলিশার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো ফারহানের। ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখে।
আস্তে আস্তে ফোনকলটার কথা ভুলে গেলো ফারহান। তবে মাঝে মাঝে রাত ন’টার সময় অজানা আতংক গ্রাস করে তাকে।
সেদিন অফিস শেষ করে বাসায় ফিরলো ফারহান। বেডরুমে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলো। এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে উঠলো টেলিফোনটা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ঠিক ন’টা বাজে তখন। হার্টবিট বেড়ে গেলো ফারহানের। কাপা কাপা হাতে রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকালো ফারহান। গমগম করে উঠলো সেই যান্ত্রিক কন্ঠস্বরটা। বলতে লাগলো; “টু ফাইভ, ওয়ান টু, টু জিরো ওয়ান এইট। কিন্তু শেষের কথাগুলো শুনে আতকে উঠলো ফারহান। শেষের কথাগুলো বাংলা করলে যেটা দাঁড়ায়, তা হলো; ” আলিশাকে বিয়ে করো না।
সমাপ্ত