স্টেশনের নাম হরিয়ান

স্টেশনের নাম হরিয়ান

আমার যাওয়ার কথা ছিলো রাজশাহী জংশনে কিন্তু এত কাছে এসে এভাবে আটকে পড়বো তা কখনোই ভাবিনি। রাজশাহী এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ট্রেনে আর পনেরো মিনিটের পথ। কিন্তু বাগড়া দিলো ভাঙাচোরা রেলপথ। কি যেন একটা রাজনৈতিক গন্ডগোলের ফলে বেশ খানিকটা রেলপথ উপড়ে নেয়া হয়েছে। আমাদের ভাগ্য খুব ভালো যে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই খবর পেয়ে গেছি। নইলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো। খবরটা একদম শেষমূহুর্তে এসেছে। আর পাঁচ মিনিট এদিকওদিক হলেই সর্বনাশ হয়ে যেতে বাকি থাকতো না। উত্তরবঙ্গের গরমের নামডাক আছে শুনেছি । ট্রেন থামার পর সেটা টের পেলাম হাড়ে হাড়ে। দরদর করে ঘামছি।

ট্রেন থামার কিছুক্ষণের মধ্যেই পঙ্গপালের মতন মানুষজন ট্রেন থেকে হুড়মুড় করে নেমে এসে দাঁড়ালো প্ল্যাটফর্মে। ছোট স্টেশনটাতে এত লোকের ভীড় যেন ঠিক মানাচ্ছে না।

এরা সবাই রাজশাহী যাবে। ভীড়ের মধ্যে থেকে নানা জনের নানান মত ভেসে আসছে কানে। কেউ বলছে এই পোড়া দেশের নেতাদের কথা , তাদের সাগরেদদের এসব কুকীর্তির কথা । কেউ বলছে গোটা দেশটাই তো উচ্ছন্নে যাচ্ছে ওদের কল্যাণে। এসব নিয়ে কথা হতেই হতেই আস্তে আস্তে ভীড়টা যেন কমে যেতে শুরু করেছে সেটা টের পেলাম। কারণটা জানার জন্য এক যাত্রীকে প্রশ্ন করতেই সে জানালো লাইন ঠিক হতে অনেক দেরী হবে। এমনকি আজ রাত কাবার হয়ে যেতে পারে। কাজেই সবাই যারযার মতন রাস্তা দেখছে। মোবাইলটা উঁচিয়ে দেখলাম রাত বাজে ১২ টা। শহর বেশি দূরে নয় কিন্তু এখন এখান থেকে কিভাবে শহরে যেতে হবে সেটাই তো জানিনা। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দলে দলে সবাই স্টেশন ছেড়ে যেন পালিয়ে বাঁচলো। যেন সুনামি আসছে আর সবার নিরাপদ আশ্রয় দরকার।

আমি ভাবলাম আগে ভীড়টা কেটে যাক। তারপর আমি ধীরেসুস্থে বের হবো। শহরের কাছে যখন এসেই পড়েছি তখন ঠিকই পৌঁছে যাবো। আগে যাদের তাড়াহুড়া তারা ফিরুক।

আমার যেতে হবে বন্ধুর মেসে । অনেকদিন পর ঘুরতে যাচ্ছি। ও বলেছে রাজশাহী জংশনের কাছেই ওর মেস। কাজেই আমি যত রাতেই পৌঁছাই না কেন ওর তাতে তেমন সমস্যা নেই। স্টেশনে বসার জায়গাটা চমৎকার। সেখানে বসে পড়লাম । এতক্ষণে খেয়াল করলাম স্টেশনের নামফলকটা। সাদা ফলকে কালো কালি দিয়ে লেখা “হরিয়ান।”লেখার সময় কালো কালির খানিকটা ছটা গিয়ে পড়েছে “ন” এর নীচে। ওটা আর সম্ভবত সময়ের অভাবে ঠিক করা হয়নি।

ছোট্ট একটা স্টেশন । রাতের আবছা অন্ধকারে আশেপাশের এলাকা যতটা চোখে পড়ছে মনে হচ্ছে মফঃস্বল শহরে এসে পড়েছি। কিছুদূর পরেই যে একটা বড় শহর আছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে না।

ভীড় ইতিমধ্যে অনেকটা কমে গেছে। একটা ভিক্ষুক, একজন ফেরিওয়ালা আর টিকেট চেকার ছাড়া তেমন কেউ নেই আশেপাশে। টিকিট চেকার আর ফেরিওয়ালা যাওয়ার পথ ধরবে এখন। ভিক্ষুককে দেখে মনে হলো প্ল্যাটফর্মে রাত কাটানোই তার অভ্যাস। তারমধ্যে কোন তাড়া নেই।

পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে বেশ আয়েশ করে ধরালাম । একটা টান দিয়ে এক রাশ ধোঁয়ায় সামনের পরিবেশটা ভরিয়ে দিয়ে বন্ধুকে ফোন দিলাম।

ও ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো
“স্টেশন থেকে বামে হাঁটতে থাক, আমি আসছি।”
বলেই ফোনটা রেখে দিলো। গর্দভটাকে বোঝাতেই পারলাম না আমি আটকে আছি অন্য স্টেশনে। আবার ফোন দিয়ে লাভ নেই। বরং একেবারে পৌঁছে ওকে ফোন দেবো। সিগারেটটা শেষ করে উঠবো ভাবছি তখন মনে হলো স্টেশন মাস্টারের কাছে শহরে ঢোকার পথের খোঁজ নিয়েই বের হই। তার রুমে ঢুকে দেখি সে চেয়ারে বসে ঢুলছে। তাকে আর জাগাবো কিনা ভাবছি এমন সময় ট্রেনের হুইসেলের শব্দে চমক ভাঙলো। বের হয়ে দেখি ট্রেন ছেড়ে দেবে দেবে ভাব । এরইমধ্যে লাইন কখন ঠিক হয়েছে কে জানে । এত বিকট শব্দেও স্টেশন মাস্টারের ঘুম ভাঙলো না দেখে খানিকটা অবাকই হলাম। বেচারা বোধহয় খুব বেশি ক্লান্ত। আমি চটজলদি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। একরকম দৌড়ে গিয়েই ট্রেনে উঠে পড়লাম । হরিয়ান থেকে রাজশাহী যাবার এই সামান্য পথটুকুতে আর বিকল্প যানের দরকার পড়ছে না।

আমি সাতপাঁচ না ভেবে একটা ঝাড়া দৌড় দিলাম ট্রেনের উদ্দেশ্যে। তারপর এক লাফে উঠে পড়লাম একটা কামরায়। কোন বগি সেটা খেয়াল করিনি। উঠে হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । মনে মনে যে একটা পুলক বোধ করিনি তা কিন্তু নয়। যারা নেমে গেছে তাদের সবাইকে বোকা মনে হতে লাগলো । আর নিজেকে মনে হতে লাগলো এই ট্রেনের রাজা। শুধু সেই দূরের ইঞ্জিনে ট্রেনের ড্রাইভার বসে ট্রেনটা চালাচ্ছে। আর কেউ নেই আশেপাশে। মনের ভেতরে হালকা একটা খারাপলাগা কাজ করতে লাগলো এই ভেবে যে আর বেশি পথ বাকি নেই । অন্তত ঘন্টাখানেক এভাবে না যেতে পারলে এই আনন্দ স্থায়ী হবে না। খানিকক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই মনে হলো আরে ভেতরে তো এখনো যাওয়াই হয়নি। আমার জন্য অপেক্ষা করছে সারি সারি সিট। সব যেন আলাদাভাবে আমার কান কানে বলছে আসুন স্যার আমার আসন গ্রহণ করুন। যেন ওরা নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া করতে চাইছে আমাকে কোথায় বসাবে সেটা ঠিক করে দেবার জন্য। আমি কামরায় ঢুকতেই যেন প্রথমে উজ্জ্বল আলোর ছটায় চোখ ধাধিয়ে গেলো। তারপর ধীরেধীরে স্বাভাবিক হলো কামরার আলো। হঠাৎ করে এই বাইরের আবছা আলো থেকে উজ্জ্বল আলোয় আসায় এই অবস্থা।

সামনের দিকে তাকাতেই মনটা বাচ্চা ছেলেদের মতন আনন্দে ভরে উঠলো । ইচ্ছা করলো একবার চিৎকার করে দৌড় দিয়ে কামরার এক মাথায় যাই আবার ওপাশটা ছুয়েই আবার ফিরে আসি। আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে একবার দেখে নিলাম। হুম। সবাই নেমে গেছে। কেউ নেই। ঠোঁটের কোণায় একটা দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠলো। আমার বয়সী একটা ছেলে এরকম বাচ্চাদের মতন বগির ভেতর ছুটোছুটি করছে দেখে কেউ কিছু বলার নেই তাহলে। মানুষ বোধহয় ক্লান্তির শেষে একটু একা সময় পেলেই এসব হাস্যকর কাজে মন দেয়। হলপ করে বলতে পারি লোকসমাগম থাকলে আমি কখনো এই কাজ করার সাহস পেতাম না।

হঠাৎ ট্রেনের হুইসেলের শব্দ শুনে টনক নড়লো। এই রে! রাজশাহী চলে এলাম নাকি? আর কি দৌড় দেয়া হবে না? অন্তত স্টেশনে নামার সময় কামরার ওপাশের দিক দিয়ে তো নামি। তাই আশেপাশে না তাকিয়ে মোটামুটি মধ্যম গতি নিয়ে একটা দৌড় লাগালাম। ট্রেনের গতি যেন আমার দৌড়ের গতির সাথে তাল রেখে বেড়ে গেলো। সেদিকে প্রথমে খেয়াল করিনি। ওপাশে পৌঁছে বুঝলাম হুইসেলের শব্দ হয়েছে অন্য কোন কারণে। আপাতত আশেপাশে কোন জংশনের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।

লাইনের দুই ধারে সারি সারি গাছ। শেষবার যখন রাজশাহী এসেছিলাম এরকম গাছ দেখেছিলাম কি? না মনে হয়। অবশ্য সেটাও পাঁচ বছর আগে । এতদিনে হয়তো খানিকটা বনায়ন হয়েছে। অসম্ভব তো আর কিছু নয়। আর ওসব নিয়ে শুধু শুধু মাথা ঘামাচ্ছি কেন । দু পাশের দৃশ্য তো বেশ মনোরম । শুধু একটা ব্যাপারে হালকা খটকা লেগেই রইলো। এই বরেন্দ্র অঞ্চলে ঝাউগাছ এলো কি করে! নাকি আমার চোখের ভুল । সে যাই হোক । যখন টের পেলাম যে গন্তব্যে পৌঁছাতে আরো দেরী আছে তখন সেই শিশুসুলভ ভাবটা আবার তাজা হয়ে গেলো। দরজা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশে কৃষ্ণপক্ষের ভাঙা চাঁদ দ্বীপ্তি ছড়াচ্ছে স্বমহিমায়।

কতদিন এমন অখন্ড মনোযোগ দিয়ে চাঁদ দেখিনা বলতে পারবো না। আজ যেন চাঁদের রুপোলী আলোর ছটা তীর্যকভাবে আমার শরীরকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। সেই স্নিগ্ধ আলোয় স্নান করে আমার মনটা হয়ে উঠছে চনমনে। আমি আর যেন যুবক বয়সে আটকে নেই। সত্যি সত্যিই ফিরে গেছি সেই শিশু বয়সে । আমি আবার দৌড় লাগালাম। এবার আগের চেয়ে আরো দ্রুত গতিতে। ইংরেজীতে একটা কথা আছে যার সরাসরি বাংলা করলে দাঁড়ায় ” এমনভাবে নাচো যেন মনে হয় অন্য কেউ তোমায় দেখছে না।”

আমার এই কামরায় তো আসলেই কেউ নেই। কাজেই সামান্য যে জড়তাটুকু ছিলো সেটা ভুলে আবার দৌড় দিলাম কামরার উল্টোদিকে।

মন শিশুর হলে কি হবে দেহটা তো যুবকের। আটঘন্টা জার্নি করে সত্যিই ক্লান্ত ছিলাম । তাই অল্পতেই হয়রান লাগছে। পরিবেশের কারণে সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। ভাবলাম একটু টয়লেটের বেসিন থেকে মুখে একটু পানির ঝাপটা দিয়ে এসে কোন একটা সিটে বসে পড়ি। পুরো কামরাটাই তো এখন আমার। যেখানে ইচ্ছা বসবো। তাছাড়া আর বড়োজোর পাঁচ মিনিট লাগবে জংশনে পৌঁছাতে। স্টেশনে পৌঁছানোর সময় যদি কেউ দেখে একটা যুবক কামরার এ মাথা থেকে ও মাথা ছুটোছুটি করছে তাহলে পরেরদিনের ট্রেনেই আমাকে পাবনা পাঠানোর ব্যাবস্থা করা হবে।

কিন্তু টয়লেটের দরজা টান দিতে গিয়ে দেখি ভেতর থেকে আটকে রাখা হয়েছে। তারমানে এতক্ষণ ট্রেনে আমি ছাড়াও আরো লোক ছিলো । ভাগ্য ভালো সে এতক্ষণে বের হয়নি। নইলে কি যে লজ্জাজনক অবস্থায় পড়তে হতো কে জানে। কিন্তু যেই ভেতরে থাকুক সে এতক্ষণ এখানে করেছে কি?

সে কি পণ করেছে যে এই যত দেরীই করুক এই ট্রেনেই সে রাজশাহী ফিরবে। নাকি লোকটা খুব অসুস্থ। হয়তো বারবার টয়লেটে যেতে হচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে না থেকে দরজার কাছের সিটেই বসলাম । ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে আছি। পকেট থেকে ফেসিয়াল টিস্যু নিয়ে মুছলাম। ট্রেনের হুইসেল শুনলাম আবার। এবার আর কোন ভুল নেই । নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছি। কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছে দেখি ট্রেন আগের গতিতেই চলছে আর আশেপাশে শহরের কোন চিহ্নই নেই। তাড়াহুড়োয় ভুল ট্রেনে উঠে পড়লাম না তো। নাহ! সে তো সম্ভব না। ট্রেন এক নাম্বার লাইনে ছিলো। অন্য কোন ট্রেন কিভাবে আসবে। তাছাড়া আন্তঃনগর বা লোকাল যে ট্রেনই আসুক সব তো রাজশাহীতে গিয়েই থামবে।

কারণ ওটাই শেষ স্টেশন । এটাও হতে পারে যে আমি সময়ের হিসাবে ভুল করেছি। হয়তো বেশি সময় যায়নি। যদিও মাঝে একবার ট্রেনের গতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছিলো এখন তা অনেকটা কম। এসব সাতপাঁচ ভাবছি এমন সময় খেয়াল হলো কামরার উল্টোদিকেও তো একটা টয়লেট আছে।

আমি ওখানে যেতে পারি। কিন্তু এবার গিয়েও আশাহত হতে হলো । ওটাও ভেতর থেকে বন্ধ করা। মনে মনে বেশ বিরক্ত হলাম। এই দুইজন আসলে কে রে বাবা। এরা কি আসলেই যাত্রী না শুধু টয়লেট ব্যাবহার করতেই ট্রেনে উঠেছিলো । এসব চিন্তা মাথায় আসতেই মনে হলো নিশ্চিত নেশাখোরদের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছি। ফাঁকা ট্রেনে সুযোগ বুঝে এরাও উঠেছিলো আমার মতন । এখন হতে পারে ওরা দুজনেই নেশার ঘোরে পড়ে আছে টয়লেটের কোন এক কোণে। আমি আর দরজায় ধাক্কাধাক্কি না করে সোজা চলে গেলাম পরের কামরায়। যাক এটাতে অন্তত খালি থাকবে টয়লেট। কিন্তু না। এখানেও একই অবস্থা। এদিকে ট্রেনের স্বাভাবিক গতির ফলে যে বাতাসটা জানালা দরজা দিয়ে এর আগেও ঢুকছিলো সেটা যেন বন্ধ হয়ে গেছে। গরমটা আচমকা বেড়ে গেছে। শরীর থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। মনে একটা জেদ চেপে গেলো।

দরকার হলে একদম শেষের কামরায় যাবো। এই গরম আর সহ্য হচ্ছে না। দুনিয়ার সব নেশাখোর দলবেঁধে এই ট্রেনে চেপে বসেছে নাকি?

ওদিকে পরের স্টেশনের কোন খবরই নেই । যেন অনন্তকাল ধরে আমি ছুটে চলেছি কোন অজানা অচেনা গন্তব্যে । ট্রেনের ঝকঝক শব্দটা কানে আসছে একটা নির্দিষ্ট ছন্দে। এক কামরা থেকে আরেক কামরায় যেতে যেতে খেয়াল করতে লাগলাম আমি বাদে অন্য কেউ উঠেছে কিনা ট্রেনে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। শেষে এক কামরা পরেই একটা টয়লেট খোলা পাওয়া গেলো। তড়িঘড়ি হাতমুখে পানি দিয়ে কিছুটা ধাতস্ত হলাম। রাজশাহীর গরমে নাকি অহরহ হিট স্ট্রোক হয় মানুষের । আজ অনেকদিন পর এসে সম্ভবত আমি সেটার কবলেই পড়েছি। এই

রাতেরবেলাও কি গরম। বাইরের বাতাসটাও মুখে এসে লাগছে চিমনির গরম ধোঁয়ার মতন । টয়লেটের কাজ সেরে সিটে এসে বসতেই ট্রেনের ভেতরের সব বাতি একসাথে নিভে গেলো। একি ঝামেলা! ট্রেনের মধ্যেও লোডশেডিং ! এবার খুব অধৈর্য হয়ে পড়লাম। খানিকটা একাকীত্ব আর অদ্ভুত বিষণ্ণতা ভর করলো মনের ওপর।

অন্ধকার ব্যাপারটাই যেন কেমন। মনের যত আজগুবি চিন্তার প্রজেকশন হাউজ যেন। এই যেমন কিছুক্ষণ আগেও যে ট্রেনের কামরাগুলো নিজের চোখে একদম খালি দেখেছি সেগুলোও দেখে মনে হচ্ছে যাত্রীতে ঠাঁসা । সবার চোখ যেন আমার দিকেই তাক করা। সব স্থির দৃষ্টি আমার দিকেই নিবদ্ধ। যেন ট্রেনে একা উঠে আমি যে ভুলটা করেছি তাই সেই অপরাধের শাস্তি খুঁজতে আমায় পর্যবেক্ষন করছে সবাই।

উফ! কল্পনার শক্তি যে কত প্রখর তা টের পাচ্ছি। কোথায় আশেপাশে তো কেউ নেই। থাকার কোথাও নয়। ট্রেনের হুইসেল শুনলাম আবার। ড্রাইভার ঠিক কোন খুশিতে কিছুক্ষণ পরপর হুইসেল বাজাচ্ছে কে জানে। কোন সিগনাল নেই কোন স্টেশন নেই শুধুশুধু রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করার চেষ্টা।

কিছুতেই যেন সময় কাটছে না। ভাবলাম ফোনে কারো সাথে কথা বলি। ফোন বের করে আনলক করতেই সময়ের দিকে চোখ পড়লো । আর বেশ অবাক হয়েই দেখলাম হরিয়ানে নামার পর যে সময়টা দেখেছিলাম তার থেকে এক মিনিট এদিকওদিক হয়নি । আমার মোবাইল নষ্ট হয়ে গেলো নাকি। চার্জ কমে যাওয়ায় মাঝেমধ্যে কিছু যান্ত্রিক গোলযোগ দেখায় মাঝেমধ্যে। সময়ের গন্ডগোলটা হয়তো সেখান থেকেই। হাতঘড়িটাও রেখে এসেছি। কাজেই আসল সময়টা দেখা যাচ্ছে না। ওদিকে নেটওয়ার্কের বারগুলোও ফাঁকা। কত বাজে বা কোথায় কল দেবো এসব ভেবে কূল কিনারা করে উঠতে পারলাম না। মোবাইলটা এখন একটা প্লাস্টিকের বক্স ছাড়া আর কিছুই না তাই আবার পকেটে পুরে দিলাম।

কোন একটা গন্ডগোল তো ঘটেছে লাইনে। নইলে এত দেরী তো হওয়ার কথা নয় । ঠিক কোন ব্যাপারটা ঘটে চলেছে আমার দৃষ্টির আড়ালে। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আবার। আরে । ঐতো সামনেই একটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম দেখা যাচ্ছে। পৌঁছে গেছি বোধহয়। কিন্তু যত গতিতেই ট্রেন এগিয়ে যাক না কেন স্টেশনের নাগাল যেন পাচ্ছে না। যেন ট্রেনের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে স্টেশন ও এগিয়ে যাচ্ছে। এমন ভ্রম হয় মরুভূমিতে । পানির আশায় অনেকদুর চলার পর মনে হয় ওটা পানির উৎস নয় মরীচিকা। স্টেশনটা দূর থেকে দেখেই কেমন পরিচিত বলে মনে হচ্ছে কিন্তু মোটেই রাজশাহী জংশন বলে মনে হচ্ছে না। হরিয়ান আর রাজশাহীর মধ্যে এরকম আরেকটা স্টেশন আছে বলে তো আমার জানা নেই। নতুন স্টেশন নাকি? হতে পারে।

কিন্তু যে স্টেশন চোখে দেখা যাচ্ছে তার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না কেন? সময় কি কোন কারণে থেমে গেলো? সামান্য একটু এগিয়ে গেছি মনে হলো। এবার স্টেশনের নামফলকটা চোখে পড়লো। আর চোখে পড়তেই আমি আঁতকে উঠলাম! নিজের মনকে আশ্বস্ত করতে চাইলাম। ভাবতে চাইলাম ভুল দেখছি । কিন্তু না। ট্রেন অনেকটা এগিয়েছে। ইঞ্জিনের সামনের লাইটের আলোয় স্পষ্টভাবে পড়া যাচ্ছে স্টেশনের নাম। সেখানে লেখা “হরিয়ান!”

কোন ভুল নেই । স্টেশনে নেমে আশপাশটা দেখে নিয়েছিলাম। নামফলকে কালো কালিটা সাদা ফলকে খানিকটা ছড়িয়ে পড়ছিলো । সেটাও একইরকম আছে। আমার ট্রেন এতক্ষণ আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে একই জায়গায় ফিরিয়ে আনলো কিভাবে? আমি যখন ট্রেনে উঠি তখন ইঞ্জিনের মুখ ছিলো হরিয়ান থেকে রাজশাহীর দিকে। আমি আবার হরিয়ানে ফিরছি কিভাবে? ট্রেনের গতি কমেছে। আরেকটু পর থামবে । আবছা আলোয় দেখলাম প্ল্যাটফর্মে শুধু একজন লোক ময়লা কাঁথা জড়িয়ে বিড়ি টানছে। এই লোকটা সেই ভিক্ষুক। ট্রেনের ওঠার আগে যাকে দেখছিলাম। তার আশেপাশের ধোঁয়ার জাল। সে আমায় দেখতে পেয়েছে কিনা জানিনা। তবে তার বিড়ির আগুন প্রতি টানে ধক করে জ্বলে উঠছে। ছড়িয়ে পড়ছে ধূম্রজাল।

আমি হতভম্ভের মতন তাকিয়ে আছি। ট্রেন থামলো। আমি নামবো কিনা ভাবছি। এই ট্রেনে এমন অদ্ভুত যাত্রা হবে কখনোই ভাবতে পারিনি। এই ট্রেন আর আদৌ রাজশাহী ফিরবে কিনা সে বিষয়েও আমি যথেষ্ট সন্দিহান। সব চিন্তাভাবনা করে ট্রেন থেকে নামবো স্থির করেছি ঠিক তক্ষুনি আবার বিকট শব্দে বেজে উঠলো হুইসেল। আর আচমকা ট্রেনের গতি এমনভাবে বেড়ে গেলো যে আমি লাফ দেবার মতন সাহসটুকু পেলাম না। কোন স্বাভাবিক ট্রেনের গতি এত দ্রুত গতিতে বেড়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এ কোন বিপদে এসে পড়লাম আমি! নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। দরজা থেকে কামরার ভেতরে ঢুকতেও ভয় করছে এখন।

আমার ঠিক পেছনেই যেন অনেক লোকের ভীড়। তারা সবাই নিঃশব্দে আমার পেছনে এসে জড়ো হয়েছে। আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু তাদের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ধক করে কানে এসে লাগছে। এখন আর নিজেকে একা মনে হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে এই অদ্ভুত ট্রেনের প্রতিটা কামরায় লোক আছে । তারা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে ভাবছে এই অনাহূত অতিথিকে নিয়ে ওরা কি করবে।

মোবাইলটা আবার বের করলাম পকেট থেকে। ভাবলাম ফ্ল্যাশলাইট্ টা জ্বেলে নিলে হয়তো ভয়টা কমবে। কিন্তু সেটাও হলো না। মোবাইল হ্যাং করেছে। আর চলবে না।

আমি উদাসভাবে বাইরে তাকালাম। মনে কিঞ্চিত আশার সঞ্চার হলো। ঐতো আরেকটা স্টেশন দেখা যাচ্ছে। এটা রাজশাহী না হয়ে যেতেই পারেনা। কিন্তু আমার আশা নির্মভাবে আঘাত পেলো আবার। দুশ্চিন্তায় আমার একটা হাত আপনাআপনি চলে এলো মাথার ওপর। নিজের মস্তিষ্কের ওপর আর যেন ভরসা করা যাচ্ছে না। আমি আবার দেখতে পাচ্ছি সেই একই স্টেশনের নাম। সেই সাদা ফলক কালো অক্ষরের ছাপ। ছিটিয়ে পড়া কালিতে স্পষ্ট বাংলায় লেখা “হরিয়ান!”

আমি যেন পাগল হয়ে যাবো! ট্রেন আবার থামলো । আগের ঘটনাগুলো আবার ঘটলো। এই ধারাবাহিকতা কখন থামবে আমি জানিনা। ঘটনার পুনরাবৃত্তি আরো কতবার হবে তাও জানিনা। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি যে ট্রেন থামলেও আমাকে নামতে দেয়া হবে না।

আমার শরীর অসাড়, প্রায় অচল হয়ে গেছে। মন হয়ে গেছে স্থবির। চিন্তাভাবনার শক্তিটুকু হারাতে বসেছি। কেন যে সবার সাথে তখন স্টেশন থেকে বের হয়ে গেলাম না। গেলেই বেঁচে যেতাম এই ভূতুড়ে ট্রেনের কর্মকান্ড থেকে। এবার একটা নতুন ব্যাপার ঘটলো।

ট্রেনের ভেতরের আলো আবার জ্বলে উঠেছে। আমি তখনো দরজায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু একি, বাইরের দৃশ্যে এমন আমূল পরিবর্তন কেন? রেললাইনের দুপাশে দেখা যাচ্ছে ধ্বংসাবশেষের পর ধ্বংসাবশেষ। যেন অতীতের দিকে আমায় টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে এই ট্রেন।

বর্তমানের যাত্রী আমি যেন অতীতের গহীনে ডুব দিতে যাচ্ছি। খেয়াল করে দেখলাম অদ্ভুত এক নির্লিপ্ততা ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে আমায়। সময় যত এগোচ্ছে বা পিছিয়ে যাচ্ছে আমার নির্লিপ্ততা ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।

আশেপাশের ঘটনাগুলো আর আমায় স্পর্শ করতে পারছে না। এরইমধ্যে আরো একবার পার করেছি হরিয়ান স্টেশন। সেই ভিক্ষুককে আবার দেখেছি। সে আগের মতন আর বিড়ি টানছে না। শুধু যেন বিড়ির ঈষৎ কমলা আগুন প্রতিস্থাপিত হয়েছে তার চোখগুলোতে। সেগুলো থেকে যেন ঠিকরে বের হচ্ছে সেই আগুন। যার কাছে শেষবারের মতন সাহায্য চাইবো ভেবেছিলাম তার এই মূর্তি দেখে মত পাল্টাতে বাধ্য হয়েছি। সবটা ছেড়ে দিয়েছি নিয়তির ওপর।

ট্রেন যেন আমায় নিয়ে বৃত্তাকারে চক্কর দিচ্ছে গোটা হরিয়ান স্টেশন। এই যাত্রা সময়ের কোন নিয়ম মানেনা, পার্থিব কোন নিয়মে এর রুচি নেই।

পকেটের ফোনটা হুট করে বেজে ওঠায় চমকে উঠেছিলাম। দেখি আমার বন্ধু ফোন দিয়েছে। একটা ক্ষীণ আশার আলো মনের কোণে জ্বলে উঠলো। এবার বোধহয় আমি মুক্ত হতে পারবো এই হরিয়ান চক্র থেকে। ফোন রিসিভ করে আমি কিছু বলার আগেই বন্ধু বলে উঠলো

“কামরায় ঢুকে তোর সিটে তো তোকে পেলাম না। ট্রেন তো ঘন্টাখানেক লেট করেছে দেখছি। অন্যদের মতন আগেই নেমে গিয়েছিস নাকি?”

আমি কোনোমতে তোতলাতে তোতলাতে বললাম
” আ… আ….আমি না ভুলে অন্য একটা ট্রেনে উঠে পড়েছি রে… আমায় তুই উদ্ধার কর” কথাটা ঠিকমতন শেষ করার আগেই বীপ করে একটা শব্দ করে ফোনটা কেটে গেলো। আমি পাগলের মতন আবার ডায়াল করলাম ওর নাম্বারে। কিন্তু এবার নেটওয়ার্ক তখনকার মতন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে । ট্রেনের ভেতরটা যেন কাদের দীর্ঘশ্বাসের শব্দে ভারী হয়ে উঠলো। যেন কষ্টটা শুধু আমার না ট্রেনের ভেতর যাদের অস্তিত্ব কল্পনা করেছি তারাও আমার শোকে আফসোস করছে।

আমার বুকটাও ভয় আর কষ্টের একটা সম্মিলিত অনুভূতিতে ভারী হয়ে এলো। কোথায় যাচ্ছি আমি অথবা আমরা! এই ট্রেনের উদ্দেশ্য আসলে কি? আর কে কে পড়েছে এই ফাঁদে? আমরা কি আর কোনদিন পালাতে পারবো না? আমাকে এভাবে বন্দি করে কার কি লাভ হবে! যতবার স্টেশনের নামটা চোখের সামনে আসছে ঠিক ততবার ঘৃণায় দুঃখে মনটা বিষিয়ে যাচ্ছে। আমি টের পাচ্ছি এ চক্রের শেষ নেই। অনন্তকালের দেখা আমি পাবো না হয়তো। এই ট্রেন হয়তো নশ্বর নয় । কিন্তু আমি তো নশ্বর!

রাত বারোটা । হরিয়ান স্টেশনে থেমে আছে রাজশাহীগামী ট্রেন। সামনে রেললাইনের কাজ চলছে। বেশিরভাগ যাত্রী লাইন ঠিক হতে দেরী হবে শুনে অন্য রাস্তা ধরেছে। স্টেশনে নেমে এক ভিক্ষুকের সাথে অনেকক্ষন আলাপ করে হরিয়ান স্টেশনে মাঝেমধ্যে ঘটে যাওয়া ভূতুড়ে ঘটনার বর্নণা শুনছিলো তানভীর। ওর তেমন তাড়া নেই। গাঁজাখোর ভিখারীর আজগুবি গল্প শুনে সময় ভালোই কেটেছে তার। এই স্টেশনে নাকি এক ছায়া ট্রেনের আবির্ভাব ঘটে মাঝেমধ্যেই , সেই ট্রেন নাকি যাত্রী উঠিয়ে বারবার চক্কর দেয় হরিয়ান স্টেশনে। সেই ট্রেন থেকে নাকি নামা যায় না আর! মুক্তির নাকি কোন পথ নেই! এসব শুনে খুব হাসি পাচ্ছিলো তানভীরের মতন আধুনিক ছেলের। সে এসব গাঁজাখুরি গল্পে বিশ্বাস রাখে না।

তবে অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ মাঝেমধ্যে ওর কাছে অসহ্যকর বলে মনে হয়। এরকম ট্রেনে উঠে যদি সত্যিই নিরুদ্দেশ হওয়া যায় তবে মন্দ কি! এসব ভাবতে ভাবতে ট্রেনের বিকট হুইসেলের শব্দ শুনতে পায় তানভীর। দেরী না করে লাফিয়ে উঠে পরে ট্রেনে। পুরো ট্রেনে সে একা। ভাবতেই মনটা জুড়িয়ে যায় তার। হরিয়ান চক্রে যুক্ত হয় আরো একটা শিকার!

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত