মূর্তি

মূর্তি

আমি এই গল্পটি শুনেছি তরফদার সাহেবের মুখে। তরফদার সাহেবের পুরো নাম আজিজ তরফদার। তিনি আমার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন আমার ছেলেবেলার বন্ধ আনিসের সাথে। আনিস একটু পাগলা গোছের, তার সাথে যারা মেশে তারাও হয় একটু পাগলা গোছের, না হয় তার চাপে খানিকটা পাগলা গোছের হয়ে যায়। যে রাতে সে তরফদার সাহেবকে আমার বাসায় নিয়ে এলো সে রাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছিল। এরকম বৃষ্টিতে সুস্থ মানুষও খুব বাড়াবাড়ি দরকার না থাকলে ঘর থেকে বের হয় না। আনিস মাঝরাতে এই বৃষ্টি ভেঙে তরফদার সাহেবকে নিয়ে আমার বাসায় চলে এলো। দরজা খুলে তাকে দেখে আমার আঁতকে ওঠার কথা ছিল; কিন্তু আনিসকে দেখে আমি কখনো আতকে উঠি না। একবার সে রাত দুটোর সময় একজন কাপালিক সন্ন্যাসীকে নিয়ে হাজির হয়েছিল, শুধু তাই নয় আমার কাছে গাঁজা ছিল না বলে সেই সন্ন্যাসী আমাকে তার চিমটা দিয়ে খোঁচা মারার চেষ্টা করেছিল। সেই তুলনায় আজিজ তরফদার অত্যন্ত ভদ্রমানুষ এবং মাঝরাতে ভিজে চুপসে হাজির হয়ে তার লজ্জার সীমা ছিল না। ব্যাপারটির মাঝে যে কোনো অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে আনিস অবশ্য সেটা ধরতেই পারল না, আমাকে দেখে উল্লসিত হয়ে বলল,ইকবাল। তোর কাছে তরফদার সাহেবকে নিয়ে এসেছি।

তরফদার সাহেব বিব্রতভাবে বললেন, আমি এত রাতে আসতে চাচ্ছিলাম না, কিন্তু আনিস কোনো কথা শুনল না। আমি বললাম, এটি কোনো ব্যাপারই না। আপনি মাথা ঘামাবেন না।

আনিস বলল, তুই যে পুলিশের সাথে কুস্তি করেছিলি সেই গল্পটা বলেছিলাম তরফদার সাহেবকে। শুনে এত হাসলেন যে ভাবলাম তোকে দেখিয়ে নিয়ে যাই!

আমি আমার জীবনে অনেক কিছুই করেছি, একটা দুইটা কাজকে বীরত্বের কাজ হিসেবেও চালিয়ে দেওয়া যায়; কিন্তু আনিস আমার সম্পর্কে কিছু বলতে হলে একজন পুলিশের সাথে হাতাহাতি করে এক রাত্রি হাজতবাসের গল্পটি দিয়ে শুরু করে। আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, শুধু আমাকে দেখানোর জন্যে বৃষ্টির মাঝে উনাকে টেনে আনলি?

আনিস দাঁত বের করে হেসে বলল, শুধু সেজন্যে আনি নি। বৃষ্টির রাতে কফি খেতে খেতে জমাট আড্ডা মারার ইচ্ছে করছে।

তোর হাতের কফি একেবারে ফাৰ্টক্লাস। আর তরফদার সাহেব হচ্ছে প্রাক্তন আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট নেতা! এমন সব গল্প । জানেন শুনলে হাঁ হয়ে যাবি।

তরফদার সাহেব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, আনিস বাধা দিয়ে বলল, আগেই হাঁ করে দাঁড়িয়ে গেছিস কেন। শুকনো তোয়ালে ফোয়ালে কিছু নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি-

আমি তোয়ালে নিয়ে ফিরে এসে দেখি তরফদার সাহেব আমার টেবিলের ওপর রাখা পাথরের মূর্তিটার দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছেন, আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী চমৎকার হাতের কাজ! দেখে মনে হয় দক্ষিণ আমেরিকার।

আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ, মেক্সিকো থেকে এনেছি।  ইনকাদের কোন এক রাজার মূর্তি।

তরফদার সাহেব তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে মূর্তিটি হাত দিয়ে খুব সাবধানে স্পর্শ করলেন, দেখে মনে হলো তিনি যেন মূর্তি নয়। একটি জীবন্ত মানুষকে স্পর্শ করছেন। আমি বললাম, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে হাত দিয়ে দেখছেন এটা বেঁচে আছে কি না, তরফদার সাহেব চমকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি সত্যিই তাই দেখছিলাম। মূর্তি নিয়ে একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমার জীবনে, সেই থেকে কোনো মূর্তি দেখলেই আমি হাত দিয়ে টুয়ে দেখি।

কী দেখেন?

তরফদার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, দেখি মূর্তিটা জীবন্ত কি না। আমি জানি কথাটা খুব আজগুবি শোনাচ্ছে, কিন্তু আনিস হাতে কিল দিয়ে বলল, বৃষ্টিরাতের জন্যে একেবারে পারফেক্টইকবাল, তোর কফি চাপা তাড়াতাড়ি।

তরফদার সাহেব দুর্বলভাবে একবার আপত্তি করার চেষ্টা করে বেশি সুবিধে করতে পারলেন না। মধ্যরাতে যখন তুমুল বর্ষণে বাইরের পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে তখন ঘরের মাঝে কফি খেতে খেতে তরফদার সাহেব যে গল্পটি বলেছিলেন সেটি এরকম- তার নিজের ভাষাতেই বলা যাক।

আমি তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে, পুলিশের কয়েকটা মামলা ফুলছে। কিছু মামলা সত্যি কিছু বানানো। অনেক গ্রাম ঘুরে আমি দিনাজপুরের একটি সাঁওতাল পল্লীতে আশ্রয় নিয়েছি। পার্টি থেকে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে কোথায় থাকব, ছোট একটা কুঁড়েঘরে

থাকি, দিনের বেলা ঘর থেকে বের হই না। আমাকে দুইবেলা খাবার এনে দেয় একজন বুড়ো সাওতাল। কুচকুচে কালো গায়ের রং, মাথার চুল শণের মতো সাদা। অনেক বয়স মানুষটার, কিন্তু শরীর পাথরের মতো শক্ত। আমার কোনো কাজকর্ম নেই– অনেক বই নিয়ে এসেছি সেগুলো বসে বসে পড়ি। বুড়ো সাঁওতাল প্রথম যখন আমাকে দেখে মনে হয় আমার সম্পর্কে একটা অবিশ্বাস ছিল আদিবাসী মানুষের জন্যে যেটা খুবই স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে সেই অবিশ্বাসটা দূর হয়েছে এবং শেষের দিকে মনে হয় আমাকে সে একটু পছন্দই করা শুরু করেছিল। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস  করল, সারাদিন তুমি কী পড় বাবু?

আমি বললাম, বই।

কিসের বই? কী লেখা আছে বইয়ে?

আমি হেসে বললাম, কত কী লেখা আছে সে তো বলে শেষ করা যাবে না। ইতিহাসের বই আছে, বিজ্ঞানের বই আছে, ধর্মের বই আছে বুড়ো সাঁওতাল উৎসুক মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে একটু এগিয়ে এসে বলল, তোমার কাছে কি পিশাচের বই আছে?

আমি অবাক হয়ে বললাম, পিশাচ?

আমি হেসে ফেলতে যাচ্ছিলাম; কিন্তু বুড়োর চোখেমুখে বিচিত্র এক ধরনের কৌতুহলের চিহ্ন দেখে হাসি গোপন করে মুখ গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করলাম, পিশাচের কী। জানতে চাও?

এই কেমন করে পিশাচের হাত থেকে বাঁচা যায়?

তোমাকে কোনো পিশাচ যন্ত্রণা দিচ্ছে?

বুড়ো একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এখনো দিচ্ছে না, কিন্তু দেবে। আমি জানি দেবে।

তুমি কেমন করে জান?

বুড়ো মেঝেতে পা মুড়ে বসেছিল, খানিকক্ষণ দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল তারপর হাতের লাঠিটা দিয়ে খানিকক্ষণ পিঠ চুলকে বলল, পিশাচটা আমার কাছে আছে।

আমি অবাক হয়ে বুড়োর দিকে তাকালাম। ভূতপ্রেত পিশাচের গল্প কে না শুনেছে – কিন্তু সব গল্পেই এই সব ভূতপ্ৰেত পিশাচ হঠাৎ হঠাৎ এসে দেখা দিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। এই প্রথম একজনকে দেখলাম যে দাবি করছে পিশাচটা তার কাছে আছে। আমি হাসি গোপন করে মুখে প্রয়োজনীয় গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললাম, তোমার কাছে একটা পিশাচ আছে?

হ্যাঁ।

কী করে পিশাচটা?

এখন কিছু করে না। দেখে তোমার মনে হবে একটা মূর্তি।

আসলে মূর্তি না?

না।

তুমি কেমন করে জান?

এটা আমাকে দিয়েছে আমার গুরু। আমার গুরু আমাকে বলেছে এটা পিশাচ।

আমি একটু হেসে বললাম, তোমার শুরু হয়তো তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছে।

মিথ্যে? বুড়ো সাঁওতালটা আমার দিকে খুব অবাক হয়ে তাকাল আর তার সেই দৃষ্টির সামনে আমি কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেলাম। মিথ্যে বলাবলির ব্যাপারটি এরা মনে হয় এখনো শিখে ওঠে নি। আমি থতমত খেয়ে বললাম, তোমার গুরু কেমন করে জানে এটা পিশাচ?

বুড়ো মাথা নেড়ে বলল, আমার গুরু পিশাচসিদ্ধ ছিলেন। তার গুরু আরো বড় পিশাচসিদ্ধ ছিলেন।

পিশাচসিদ্ধ হলে কী হয় আমি জানি না, তারা কেমন করে পিশাচকে বশ করে তাও জানি না। সত্যি কথা বলতে কী পিশাচ জিনিসটা কী আমার সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই। বুড়ো সাঁওতালের কাছে আমার সেটা নিয়ে শিক্ষা শুরু হলো। সে আমাকে জানাল পিশাচ এক ধরনের অপদেবতা। অপদেবতাদের মাঝে উচ্চশ্রেণী-নিম্নশ্রেণী আছে, ভালো-খারাপ আছে, শান্ত এবং খেপাও আছে। পিশাচ সে হিসেবে খুব নিম্ন শ্রেণীর, মানুষের শুধু ক্ষতি করতে চায়। তার গুরু এরকম একটা পিশাচকে ধরে আটকে রেখেছেন। এদের আটকে রাখার নানারকম নিয়মকানুন আছে, তার একটা হচ্ছে মূর্তির মতো তৈরি করে রাখা। ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন, মানুষের মৃতদেহ থেকে হাড়-চামড়া নিয়ে তৈরি করতে হয়। ব্যাপারটা বিপজ্জনকও। কারণ মূর্তিটাকে

ঠিক করে সংরক্ষণ করে না রাখলে পিশাচ বের হয়ে যেতে পারে। বুড়ো খুব একাগ্রভাবে গম্ভীর মুখে আমাকে পিশাচ সংরক্ষণের নিয়মকানুন বলে যাচ্ছিল। তার বিশ্বাস কিংবা তার গুরুর কোনোরকম অসম্মান না করে আমি সাবধানে জিজ্ঞেস করলাম, এমন কি হতে পারে না যে পিশাচটা এখন নেই, মূর্তি থেকে বের হয়ে চলে গেছে?

বুড়ো সাঁওতাল মাথা নাড়ল, হতে পারে; কিন্তু সেটা বোঝা যায়।

কেমন করে বোঝা যায়?

মূর্তিটার পরিবর্তন হয়, হাত-পা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নড়ে, খুব আস্তে আস্তে-এক দুই মাস সময় লাগে। সময় সময় মুখের চেহারার পরিবর্তন হয়। বয়স বাড়ে।

বুড়োর কথা শুনে আমার শরীর হঠাৎ কেমন জানি শিরশির করে উঠল। ব্যাপারটি দীর্ঘদিনের লালিত কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষ চাঁদে গিয়েছে, তাদের তৈরি মহাকাশযান সৌরজগৎ পার হয়ে যাচ্ছে, এই যুগে পিশাচের গল্প বিশ্বাস করা খুব অন্যায় ব্যাপার। কিন্তু কেন জানি না গভীর অরণ্যের পাদদেশে বুপড়ি কুঁড়েঘরে উবু হয়ে বসে থাকা একজন বুড়ো সাঁওতালের মুখে এই পিশাচের গল্প শুনে আমার কেমন জানি ভয় করতে লাগল। আমি দুর্বল গলায় বললাম, তুমি আমাকে পিশাচটাকে দেখাতে পারবে?

বুড়ো একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, তুমি দেখতে চাও?

কেন, কোনো অসুবিধে আছে?

না, অসুবিধে নাই। তবে দেখার নিয়মকানুন আছে। পিশাচটাকে রাখতে হয় মাটির নিচে, কাঠের বাক্সে, সেটাকে মন্ত্র লেখা কাপড় দিয়ে মুড়ে রাখতে হয়। তুমি যদি দেখতে চাও আমি মাটি খুঁড়ে বের করতে পারি।

তুমি সেটা কোথায় পুতে রেখেছ?

আমার বাড়ির পেছনে।

ঠিক আছে আমি যাব, আমার তো দিনে বের হওয়া বারণ, আমি রাত্রিবেলা বের হব।

বুড়ো মাথা নাড়ল, বলল, আমি তোমাকে সামনের পূর্ণিমায় নিয়ে যাব।

গল্পের এই পর্যায়ে এসে তরফদার সাহেব একটু থামলেন।
খানিকক্ষণ নিজের আঙুলগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা
করে বললেন, পূর্ণিমা আসার আগেই বুড়ো সাঁওতালটা মারা গেল।
আমরা সাঁওতালদের নিয়ে কাজ করছিলাম, পার্টি থেকে
নির্দেশ ছিল তাদের সংগঠিত করার। কিন্তু মানুষগুলো সহজ -সরল,
রাজনীতির জটিল ব্যাপরগুলোও তাদের নিজেরদের মতো সহজ
সরল করে বুঝে নেয়; সেটাই হলো কাল। পুলিশের সাথে মুখোমুখি
সংঘর্ষ হলো। অনেক সাঁওতাল মারা গেল, তাদের বাড়িঘর
জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো।

আমি নিজেও বেশ কিছুদিন বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালাম।
বেশ কিছুদিন পর, অবস্থা একটু শান্ত হলে আমি সেই
সাঁওতাল পল্লীতে ফিরে এলাম। তখন সেখানে কেউ নেই, পরিত্যক্ত
একটা গ্রাম। আমার সাথে ছিল পরিচিত একটা সাঁওতাল ছেলে,
তাকে নিয়ে সেই বুড়ো সাঁওতালের বাড়ি খুঁজে বের করে বাড়ির
পেছনে গেলাম। অল্প কিছুদিন আগেও সেটা ছিল ঝকঝকে
তকতকে, এ কয়দিনেই সেটা বুনো গাছগাছালিতে ভরে উঠেছে।
আমি জায়গাটা ভালো করে লক্ষ করতেই কোনার দিকে একটা
জারুলগাছের নিচে চোখ পড়ল। অনেক পাথর সেখানে ছোট
একটা পিরামিডেরে মতো গ্রুপ করা ছিল, পাথরগুলো সরাতেই
দেখা গেল নিচে ঝুরঝুরে মাটি। মাটিগুলো সরাতেই তার নিচে
পাওয়া গেল একটা ছোট কাঠের বাক্স। বাক্সটা ওপরে তুলে
আনলাম, সঙ্গের সাঁওতাল ছেলেটা খুব কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে
ছিল, তার ধারণা হলো বুড়ো সাঁওতালটা নিশ্চয়ই আমাকে তার
গোপন সোনাদানার কথা বলে গিয়েছে, আমি সেটা বের করছি।
কাঠের বাক্সটা যখন বের করা হয়েছে তখন সূর্য ডুবে
আবছা অন্ধকার নেমে আসছে। নির্জন পরিত্যক্ত একটা
পোড়াবাড়ি, গাছের নিচে রহস্যময় একটা অন্ধকার, সেখানে
আমরা বিবৰ্ণ একটা কাঠের বাক্স নিয়ে বসে আছি, পুরো
ব্যাপারটাতেই কেমন জানি একটা গা ছমছম করা ভয়ের ব্যাপার
আছে। আমি আমার পকেট-ছুরিটা বের করে সাবধানে চাঁড় দিয়ে।

বাক্সের ঢাকনা খুলে ফেললাম, সাথে সাথে আমার স্পষ্ট মনে হলো
ভেতরে কী যেন ছটফট করে নড়ে উঠল। আমি হঠাৎ করে চমকে পেছনে সরে গেলাম, সাঁওতাল ছেলেটা শক্ত করে তার লাঠিটা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আমি চুপচাপ খানিকক্ষণ বাক্সের ভেতরে তাকিয়ে রইলাম, পুরনো কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা যত্ন করে রাখা আছে। আমি সাহস করে কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটা তুলে আনলাম, পরিষ্কার মনে হলো হাতের মাঝে জিনিসটা আবার নড়ে উঠল। আমি সেটাকে মনের ভুল বলে গা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলাম। তারপর সাবধানে কাপড়টা সরাতে থাকি, যখন জিনিসটার ওপর থেকে কাপড়টা সরে গেছে-ভেতর থেকে একটা অবিশ্বাস্য রকমের কুৎসিত মূর্তি উঁকি মেরেছে-তখন সাঁওতাল ছেলেটা হঠাৎ একটা অমানুষিক চিৎকার করে লাফিয়ে পেছনে সরে গেল। দূরে দাঁড়িয়ে সে আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ফেলে দাও-ফেলে দাও-ওটা─

আমি আরেকটিু হলে ফেলেই দিতাম, কিন্তু এতদিনের শিক্ষাদীক্ষা রাজনৈতিক অনুশাসন বিজ্ঞানের বিশ্বাস সব মিলিয়ে নিজের ভেতরে একটা গোঁ এসে গেল। সাঁওতাল ছেলেটার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললাম, কেন ফেলে দেব?

ছুঁলে তুমি মরে যাবে। ওটা পিশাচ─

আমি ছুঁলে মরে যাব?

হ্যাঁ। মরে যাবে─

আমার ভেতরে তখন একটা লোকদেখানো সাহস তৈরি হয়েছে। মূর্তিটা এক হাতে ধরে রেখে অন্য হাত সেটার কাছে নিয়ে বললাম, এই দেখ আমি এটা ছুঁইছি─

ছেলেটা চিৎকার করে উঠল এবং আমি সেটা অগ্রাহ্য করে মূর্তিটাকে ছুঁয়ে ফেললাম। একটা মূর্তি যেরকম শক্ত, প্রাণহীন, শীতল হওয়ার কথা মূর্তিটা সেরকম নয়-এটা কেমন যেন উষ্ণ এবং ছোঁয়ামাত্র আমার শরীর কেমন যেন চমকে উঠল, মনে হলো ভয়ংকর একটা অশুভ কাজ করে ফেলেছি। আমি অবিশ্যি সাঁওতাল ছেলেটাকে কিছুই বুঝতে দিলাম না, মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বললাম, আমি কি মরে গেছি?

ছেলেটা তখনো অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মূর্তিটাকে কাপড় দিয়ে জড়িয়ে বাক্সের ভেতরে রেখে বাক্সের ডালাটা বন্ধ করে দিয়ে বললাম, এখন হয়েছে?

ছেলেটা তখনো অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মূর্তিটাকে কাপড় দিয়ে জড়িয়ে বাক্সের ভেতরে রেখে বাক্সের ডালাটা বন্ধ করে দিয়ে বললাম, এখন হয়েছে?

ছেলেটা দূরে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তুমি এটা কী করবে?

আমি নিয়ে যাবো।

না বাবু, নিও না। অনেক বিপদ হবে তোমার হোক। আমি বাক্সটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সাঁওতাল ছেলেটা অনেক অনুনয়-বিনয় করল, কিন্তু আমি তার কথা শুনলাম না।

সে রাতে আমি বাক্সটা খুললাম না। বাসায় গিয়ে ভালো করে গোসল করে রাতে ঘমাতে গিয়েছি। একটু পরে পরে ঘুম ভেঙে গেল-শুধু মনে হলো ঘরে বুঝি কিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুম হলো ছাড়া ছাড়াভাবে আর একটার পর আরেকটা দুঃস্বপ্ন দেখে গেলাম। ভয়ংকর ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন! চিৎকার করে জেগে উঠলাম কয়েকবার।

ভোরবেলা দিনের আলোতে বাক্সটা খুলে ভেতরের মূর্তিটা খুব ভালো করে পরীক্ষা করলাম। নিঃসন্দেহে মূর্তিটা মানুষের দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা ওঁজে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে, একটা হাত দিয়ে নিজের দুটি হাঁটু, অন্য হাত দিয়ে মাথাটা ধরে রেখেছে। মানুষের স্বাভাবিক বসার ভঙ্গি এটা নয়। মূর্তিটা অস্বাভাবিক কুৎসিত, মানুষের মতো নাক-চোখ-মুখ সবই আছে, কিন্তু তবু মানুষের স্বাভাবিক রূপটা পায়নি। মূর্তিটা খুব বড় নয়, খুব বেশি হলে এক ফুট উঁচু হবে। এই আকারের একটা পাথরের মূর্তি যত ভারি হওয়ার কথা এটা সেরকম ভারি নয়। আবার খুব হালকাও নয়। মূর্তিটা কিসের তৈরি বলা খুব মুশকিল, মাথায় চুল রয়েছে, খুব ভালো করে লক্ষ করলে শরীরেও লোম দেখা যায়। মনে হয় কেউ বুঝি সত্যিকার একজন বিকৃত দেহের মানষকে কোনোভাবে চেপে ছোট করে ফেলেছে। মুখের দিকে তাকালে একই সঙ্গে কেমন যেন ঘৃণা এবং ভয় হয়। আমি মূর্তিটাকে খুব ভালো করে পরীক্ষা করে আবার কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে আবার কাঠের বাক্সে বন্ধ করে ফেললাম।

গল্পের এ পর্যায়ে এসে তরফদার আমার কাছে অনুমতি নিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, সাঁওতাল ছেলেটার ভবিষ্যদ্বাণী যে আমার ওপর বিপদ নেমে আসবে, কথাটা পরের দিন সত্যি প্রমাণিত হলো। ঘুম থেকে উঠে দেখি পুলিশ বাসা ঘেরাও করে ফেলেছে। আগে এক-দুবার এরকম পরিস্থিতিতেও উদ্ধার পেয়েছি-এবারে পেলাম না , পুলিশ এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেল। আমরা যারা বামপন্থী : রাজনীতি করি আমাদের জন্যে দেশের আইনকানুন মমতাহীন। তাই আমি দীর্ঘদিনের জন্যে জেলে আটকা পড়ে গেলাম।

জেলে আমি আগেও থেকেছি, খুব কষ্টের জীবন। মজার ব্যাপার হলো বড় বড় জিনিসের জন্যে লোভ হয় না, কিন্তু একটা পানের দোকান থেকে একশলা সিগারেট কিনে আগুন লাগানো একটা ঝুলন্ত দড়ি থেকে সিগারেটে আগুন ধরানোর জন্যে প্রাণ আইচাই করতে থাকে! সারাদিন পার্টির অন্য লোকদের সাথে কথাবার্তা বলে জেলের মাঝে দিন কেটে যায়। রাত গভীর হলে যখন নিজের ছোট জায়গাটাতে ঘুমাতে যাই তখন চোখে ঘুম আসে না, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ফুপিয়ে কাঁদি।

যাই হোক এভাবে প্রায় সাত বছর কেটে গেল। সাত বছর অনেক সময়। একাকী বসে চিন্তা করার জন্যে এরকম দীর্ঘ সময় সবাই পায় না। সাত বছরে নিজের ভেতরেও অনেক পরিবর্তন হলো। ভাবলাম যদি ছাড়া পাই জীবনটা নতুন করে শুরু করব। পুরো দেশে পরিবর্তন নয় নিজের কাছাকাছি যদি কোনো পরিবর্তন আনতে পারি সেই যথেষ্ট। অবিশ্বাস্য ব্যাপার-ঠিক তখন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেলাম।

প্রথম বেশ কিছুদিন মুক্তির আনন্দ ভোগ করে পার্টিকে জানালাম আমি কিছুদিন সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিশ্রাম চাই। পার্টি রাজি হলো। আমি তখন একটা কলেজে চাকরি নিয়ে মফস্বল একটা শহরে চলে এসেছি। নদীর তীরে ছবির মতোন একটা কলেজ। প্রথম কয়েক সপ্তাহ কলেজের সেক্রেটারির বাসায় থাকলাম, একট গুছিয়ে নিয়ে ছোট একটা বাসা ভাড়া করে আমি শহর থেকে আমার জিনিসপত্র নিয়ে এলাম। জিনিসপত্র বলতে অবিশ্যি বেশির ভাগই হচ্ছে বই-ঘরের দেয়ালে সেলফ তৈরি করে একটা একটা করে বইয়ের বাক্স খুলছি, হঠাৎ দেখি বুড়ো সাঁওতালের সেই পিশাচের বাক্স। বুকটা ধক করে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে আমার কৌতুক মেশানো এক ধরনের কৌতুহল হলো। আমি বাক্স খুলে মূর্তিটা বের করে আমার টেবিলের ওপর রাখলাম। সাত বছর আগে দেখেছিলাম-তখন একটা হাত দিয়ে হাঁটু দুটি ধরে রেখেছিল, অন্য হাত ছিল মাথার ওপর; এখন বিচিত্র উপায়ে দুটি হাতই নিচে নেমে এসেছে। শুধু তাই না, মাথাটা একটু নিচু হয়ে নেমে এসেছে, মুখের ভঙ্গিটা মনে হলো দুঃখী। মাথায় কালো চুল ছিল এখন সেগুলো শণের মতো সাদা। শুধু তাই নয়, মনে হলো শরীরের চামড়া বুড়ো মানুষদের মতো কুঞ্চিত। গত সাত  বছরে এই আমি যেটুকু বুড়ো হয়েছি তার থেকে অনেক বেশি বুড়ো হয়েছে মূর্তিরূপী পিশাচটা। আমি যেরকম জেলখানায় আটকা পড়েছিলাম এ পিশাচটাও সেরকম আটকা পড়েছিল তার বাক্সে। আশ্চর্য, যা বেটা পিশাচ! আজ থেকে তোকে আর বাক্সের ভেতরে থাকতে হবে না-তুই থাকবি আমার টেবিলের ওপর!

সেই থেকে মূর্তিটা আমার টেবিলের ওপর থাকে-কেউ বেড়াতে এলে দেখে খুব অবাক হয়, কেউ ঘেন্নায় নাক সিটকায়, কেউ ভয় পায়, কিন্তু এর বেশি কিছু নয়। এভাবে আরো বছর দুয়েক কেটে গেল, এ মূর্তিটার যে একটা ভয়ের ইতিহাস ছিল। সেটাও আমার মনে রইল না। এরকম সময় একদিন আমার কাছে বেড়াতে এলো আমার কলেজ জীবনের বন্ধু ফয়েজ আলি। অনেকদিন তার সাথে দেখা নেই, লোকমুখে খবর পেয়েছি সে নাকি চা বাগানের ম্যানেজার। সে বিয়ে করেছে বলে শুনেছিলাম, যখন আমার সাথে দেখা করতে এসেছে তখন দেখতে পেলাম তার দুটি ছেলেমেয়েও আছে। ছেলেটি ছোট, বয়স দশ। মেয়েটি বড়, তার বয়স চৌদ্দ সারাজীবন রাজনীতি করে নানা ধরনের মানুষের সাথে মিশেছি। কিন্তু এ দুজন ছেলেমেয়েকে দেখে আমি আবিষ্কার করলাম যে আমি কখনো বাচ্চাদের সাথে মিশিনি এবং তাদের সাথে কীভাবে মিশতে হয় জানি না। তাদের মানসিক পরিপক্কতা কতটুকু সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। কোনো জিনিস বোঝার ক্ষমতা তাদের বড়দের থেকে বেশি, কিন্তু জীবনের জটিলতা সম্পর্কে তারা আশ্চর্যভাবে উদাসীন। আমার আগ্রহের জন্যেই হোক আর ছেলেমেয়ে দুজনের কৌতুহলের জন্যেই হোক খুব কম। সময়ের মাঝেই তাদের সাথে আমার খুব ভাব হলো। আমাদের কথাবার্তার একটা বড় অংশ দখল করে রইল আমার টেবিলে রাখা মূর্তিটা।

ছেলেটি যার নাম কাজলআমার বাসায় ঢোকার দশ মিনিটের মাঝে জিজ্ঞেস করেছিল, চাচা তুমি এত বিচ্ছিরি একটা মূর্তি টেবিলে সাজিয়ে রেখেছ কেন?

আমি কিছু উত্তর দেবার আগেই মেয়েটি, যার নাম শাওন তার ভাইকে বলল, তোর কাছে এটা শুধু বিচ্ছিরি লাগছে?

কাজল মুখ কুঁচকে উত্তর দিল, বিচ্ছিরি না তো কী?

শাওন বলল, এটা যেটুকু বিচ্ছিরি তার থেকে অনেক বেশি । আশ্চর্য। এটা এত আশ্চর্য একটা মূর্তি যে এটা যে বিচ্ছিরি তাতে কিছু আসে যায় না।

মেয়েটার উত্তরটা আমার খুব পছন্দ হলো। আমি বললাম, তুমি ঠিকই বলেছ, মূর্তিটা খুব আশ্চর্য। সবকিছু শুনলে তোমরা আরো অবাক হয়ে যাবে।

পৃথিবীর সব মানুষই গল্প শুনতে পছন্দ করে, ছোটরা সেটা প্রকাশ করতেও এতটুকু সংকোচ করে না, তখন তখনই দুজনেই আমাকে ধরে বসল গল্প শোনার জন্যে।

আমি তখন তাদের এ মূর্তিটার পূর্ব ইতিহাস শোনালাম এবং দুজনেই মোটামুটি হতবাক হয়ে গেল। ছোট বাচ্চাদের গল্পে কোনোরকম কৌতুহল নেই এরকম ভান করে আমার বন্ধু ফয়েজ এবং তার স্ত্রী দুজনেই গল্পটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল। গল্প শেষ হবার পর ফয়েজ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, সত্যিই এ মূর্তিটা হাত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়েছেন?

আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ সরিয়েছে। আমি জেলে যাবার আগে এটার হাত ছিল মাথার ওপরে, এখন নেমে এসেছে।

ফয়েজের স্ত্রী শুকনো গলায় বলল, সত্যি?

তার মানে এটা সত্যিই পিশাচ?

শাওন হো-হো করে হেসে উঠে বলল, মা তুমি সত্যিই এত বোকা। পিশাচ কোথেকে আসবে।

শাওনের মা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, তোর চাচা কি তাহলে মিথ্যা কথা বলেছে:

মিথ্যা কথা বলবেন কেন? এ মূর্তিটা পাথরের তৈরি না-নরম একটা জিনিসের তৈরি, যেটা আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে-মাধ্যাকর্ষণ বলে সেটাকে।

আর চুল? ছোট ভাই কাজল বলল, চুল যে সাদা হয়ে গেল?

সেটা তো আরো সহজ! পৃথিবীতে কোনো পাকা রং নেই-এমন একটা জিনিস দিয়ে চুল তৈরি করেছে যেটার রং উঠে সাদা হয়ে যায়!

আমি মেয়েটার বুদ্ধি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সত্যি সত্যি পুরো জিনিসটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যাপারটাকে ভৌতিক

হবার কোনো প্রয়োজন নেই। যে মানুষটি এই মূর্তিটা তৈরি করেছে সে দক্ষ কারিগর এবং অসম্ভব বুদ্ধিমান —এর বেশি কিছু নয় । আমার বন্ধু ফয়েজ তার ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে। আমার এখানে সপ্তাহখানেক ছিল। সবাইকে নিয়ে সময়টা বেশ কেটেছে। যতক্ষণ বাসায় থেকেছি বাচ্চাগুলো মূর্তিটার আশপাশে ঘুরঘুর করেছে, যাবার দিন আমি শাওনকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি মূর্তিটা নিতে চাও?

সাথে সাথে শাওনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, কিন্তু সে নিজেকে কষ্ট করে সংবরণ করে বলল, না না চাচা, আমি চাই না।

আমি বললাম, দেখ এটা উপহার দেবার মতো কোনো জিনিস না, তাই আমি জোর করতে পারব না। কিন্তু তুমি যদি চাও এটা নিতে পার।

সত্যি?

কিন্তু আপনি যে এত কষ্ট করে জোগাড় করেছেন।

আমি মোটেও কষ্ট করে জোগাড় করি নি। কৌতুহল ছিল বলে জোগাড় করেছিলাম, এখন কৌতুহল মিটে গেছে, তুমি নিতে পার। তোমার কৌতুহল মিটে গেলে তুমি অন্য কাউকে দিয়ে দিও।

শাওনের মা-বাবা ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ করলেন না, কিন্তু আমি মূর্তিটাকে ভালোভাবে । প্যাকেট করে ছোট একটা বাক্সে ভরে দিলাম।

যেদিন ফয়েজ আর তার স্ত্রী-ছেলেমেয়েকে টেনে তুলে দিয়ে ফিরে এলাম । সেদিন এত মন খারাপ হলো বলার নয়। রাতে বিছানায় শুয়ে আমার কেমন একাকী লাগতে লাগল। শুধু মনে হতে লাগল, আমারও যদি শাওন আর কাজলের মতো একটা মেয়ে আর ছেলে থাকত!

মাস ছয়েক পরের কথা। একদিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরে এসে দেখি একটি চিঠি এসেছে, খামের ওপর অপরিচিত হাতে ঠিকানা লেখা। খামটা খুলে দেখি ভেতরে শাওনের লেখা ছোট একটা চিঠি। চিঠিটা পড়ে খুব মন খারাপ হয়ে গেল, কারণ এক জায়গায় লিখেছে ইকবাল চাচা, কেন জানি আমার মনে হচ্ছে আমি আর বাঁচব না। আমার কিছু একটা হয়েছে যেটা কোনো ডাক্তার ধরতে পারে নি। আমি দিনে দিনে দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। দিনরাত আমার

বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার খুব মন খারাপ হয়ে থাকে তাই আমি শুয়ে শুয়ে সবাইকে চিঠি লিখছি…

আমি শাওনের চিঠিটা হাতে নিয়ে দীর্ঘসময় বারান্দায় বসে রইলাম। মনে হলো আমার বুকের ভেতর কিছু একটা ছিড়ে যাচ্ছে। কী করব বুঝতে না পেরে আমি ভেতর ছটফট করতে লাগলাম। সন্ধ্যেবেলা সেক্রেটারি সাহেবের বাসা থেকে ফোন করার চেষ্টা করলাম। চা বাগানে ফোন নেই। তাই ফোন করতে হলো আমার অন্য এক বন্ধুর কাছে, সেও পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারল না। তবে সেও নাকি শুনেছে শাওনের ব্লাড ক্যানসারের মতো কিছু একটা হয়েছে।

রাতে আমি দীর্ঘ সময় বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলাম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মাঝরাতে হঠাৎ থানার পেটা ঘড়িতে বারোটা ঘন্টা বাজলে আমি চমকে বিছানায় উঠে বসলাম, আমার হঠাৎ পিশাচ মূর্তিটার কথা মনে পড়ল। এটা কি হতে পারে যে সেই পিশাচটা শাওনের জীবনীশক্তিকে ধ্বংস করে । দিচ্ছে। সত্যিই সেটা অশুভ একটা প্ৰেত, সত্যিই সেটা মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দেয়-বুড়ো সাঁওতাল প্রায় এক যুগ আগে যেটা আমাকে বলেছিল।

আমি অতিপ্রাকৃত কোনো জিনিস বিশ্বাস করি না, কিন্তু তবুও আমি পরদিন কলেজে ছুটি চেয়ে একটি চিঠি দিয়ে ফয়েজের টি গার্ডেনের উদ্দেশে রওনা দিলাম।

টি গার্ডেনটা শহর থেকে বেশ দূরে। বাস থেকে নেমে দীর্ঘপথ রিকশা করে গিয়ে বাকিটুকু হেঁটে যেতে হলো। আমি যখন ফয়েজের বাসায় পৌঁছলাম তখন সেন্ধ্যে হয়ে গেছে। আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র। তার অস্পষ্ট আলোতে চা বাগানের উঁচু নিচু টিলাকে অপার্থিব জগতের একটা দশ্য বলে মনে হচ্ছিল। শহর থেকে দরে নির্জন একটা টিলার ওপরে ছবির মতো বাসা। আমাকে দেখে একজন কাজের ছেলে বাসায় খবর দিতে গেল এবং কিছুক্ষণের মাঝেই ফয়েজ বের হয়ে এলো। তার চেহারায় এক ধরনের ক্লান্তি-চোখের কোণে কালি, মুখে অসহায় বিষন্নতা। আমাকে দেখে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, ইকবাল, এসেছিস।

হ্যাঁ। শাওনের শরীর ভালো নেই খবর পেয়ে মনটা খুব ছটফট করতে লাগল-

ভালো হয়েছে এসেছিস। মেয়েটা তোর কথা খুব বলে।

কী হয়েছে শাওনের?

ফয়েজ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জানি না। সত্যি কথা বলতে কী কেউই জানে না। ব্লাড ক্যান্সার মনে করে কিমোথেরাপি শুরু করেছিল, মেয়েটা তখন আরো দুর্বল হয়ে গেল।

ফয়েজ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আমাকে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলল, কেমন করে শুরু হয়েছে, ডাক্তার কী বলেছে, কী চিকিৎসা হয়েছে-সবকিছু। এখন বিদেশে নেওয়ার চেষ্টা করছে, ছুটি চেয়ে দরখাস্ত করেছে, কিন্তু শাওনের শরীর এত বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে যে ভয় হচ্ছে বেশি দেরি না হয়ে যায়। ফয়েজের কথার মাঝে তার স্ত্রী এলো। তাকে দেখে মনে হলো এই অল্প কয়দিনেই বয়স অনেক বেড়ে গেছে। কাজলকেও দেখলাম মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার জন্যে যে চকলেটের প্যাকেটটা এনেছি সেটা খুব শখ করে খুলে একটা চকলেট বের করে হঠাৎ সেটা খাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। আমি দেখলাম খুব সাবধানে একবার চোখ মুছে নিল। নিশ্চয়ই শাওনের কথা মনে পড়েছে।

শাওন ঘুমোচ্ছিল বলে আমি তখন তাকে দেখতে গেলাম না। ফয়েজ আমাকে তাদের গেস্ট রুমে নিয়ে গেল। আমি জামাকাপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে নিলাম। টি গার্ডেনে ম্যানেজারদের বাসাগুলো হয় খুব চমৎকার। এক সময় নিশ্চয়ই বিদেশি সাহেবরা থাকত। কারণ ঘরের মাঝে রয়েছে ফায়ার প্লেস-তাছাড়া ঘরটি বিশাল, ভঁচু ছাদ, বড় জানালা। জানালা খুললেই দেখা যায় বিস্তৃত চা বাগান। আমি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে চা বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কুয়াশায় ঢাকা চা বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মন গভীর বিষগ্নতায় ভুবে যেতে লাগল।

রাত্রে খাবার পরে আমি শাওনকে দেখতে গেলাম। সে তার ঘরে বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে ছিল, অসম্ভব শুকিয়ে গেছে, কিন্তু তবু তার চেহারায় এক ধরনের লাবণ্য রয়ে গেছে। আমাকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ইকবাল চাচা, আমি মরে যাচ্ছি!

আমার বকের ভেতরে ধক করে। উঠল, কিন্তু আমি মুখে সেটা প্রকাশ হতে দিলাম না। সে খুব একটা মজার কথা বলেছে— এরকম ভঙ্গি করে বললাম, অসুখ হলেই মানুষ যদি মরে যেত। তাহলে সারা পৃথিবীতে মানুষ থাকত সাঁইত্রিশ জন।

শাওন হেসে ফেলে আবার মুখ বিষন্ন করে বলল, আমি কিন্তু সত্যি মরে যাব। আমি জানি।

দূর বোকা মেয়ে! আমি গিয়ে তার মাথায় হাত রেখে বললাম, যখন তোমার বয়স হবে তিরানব্বই তোমার সাতচিল্লশটা নাতি-নাতনি হবে-তখন তুমি মরবে, তার আগে না।

না ইকবাল চাচা।

আমি শাওনকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমি এসেছি তোমাকে ভালো করে দিতে।

শাওন কেমন এক ধরনের জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকাল, বলল, সত্যি?

আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে বললাম, সত্যি। তোমাকে ভালো করে তারপর আমি যাব।

আমার সাথে কথা বলে সত্যি সত্যি শাওন একটু উৎফুল্ল হয়ে উঠল। শাওনকে উৎফুল্ল হতে দেখে কাজলও খুশি হয়ে উঠল। আমি শাওনের বিছানায় বসে দড়ি কাটার ম্যাজিক দেখালাম, বেকুব পাকিস্তানির গল্প বললাম, আমার ফাজিল ছাত্রদের কীর্তি শোনালাম এবং কথা বলতে বলতে হঠাৎ মনে পড়েছে এরকম ভান করে বললাম, আমার বন্ধু কোথায়?

বন্ধু? শাওন অবাক হয়ে বলল, কোন বন্ধু?

মনে নেই? তোমাকে যে দিয়েছিলাম পিশাচ বন্ধু!

ও! সেই মূর্তিটা! আছে। আমার টেবিলে ছিল, জায়গা হয় না। বলে নিচে নামিয়ে রেখেছে।

কাজল বলল, কাচের বাক্স তৈরি করেছে আপু দেখতে এখন আরো ভয়ানক লাগে! একদিন হয়েছে কী শোন- কাজল তখন কীভাবে তার বন্ধুদের এই মূর্তিটা দেখিয়ে ভয়  দেখিয়েছিল তার গল্প বলতে শুরু করে। আমি তার গল্প শুনতে শুনতে টেবিলের কাছে নিচু হয়ে মূর্তিটা খুঁজতে থাকি। একপাশে কিছু বইয়ের আড়ালে ঢাকা পড়েছিল, বইগুলো সরাতেই আমি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম, মূর্তিটা হঠাৎ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

মুখে জ্বর ধূর্ত একটা হাসি, ঠোঁটগুলো লাল এবং যেটা আগে কখনো লক্ষ করি নি -মুখের ভেতর কালচে সাপের মতো একটা জিব। চোখগুলো সব সময়ে আধবোজা ছিল, এখন হঠাৎ মনে হলো সেগুলো খুলে এসেছে, স্থির একটা দৃষ্টিতে সেটা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মূর্তিটা দেখে আমার বুকের ভেতরে হঠাৎ যেন কিছু একটা নড়ে যায়। আতঙ্কে আমার শরীর কেঁপে উঠল এবং আমি প্রায় জোর করে নিজেকে শান্ত করে উঠে দাঁড়ালাম।

ততক্ষণে কাজলের গল্প শেষ হয়েছে, আমি যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু হেসে বললাম, আমার বন্ধুটি ভালোই আছে তাহলে!

শাওন কোনো কথা না বলে স্থির এক ধরনের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম, মূর্তিটা আমার ঘরে নিয়ে রাখি কয়েক দিন?

শাওন কোনো উত্তর দিল না। আমি নিচু হয়ে মূর্তিটা তুলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসি। বুকের কাছে ধরে রেখেছিলাম বলেই কি না জানি না আমার নাকে হঠাৎ এক ধরনের চাপা দুৰ্গন্ধ এসে লাগে, মনে হচ্ছে এই মূর্তিটা থেকেই বের হচ্ছে।

আমি ঘরের টেবিলে মূর্তিটা রেখে ঘুরে দাঁড়ালাম। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, আমার কেমন জানি ভয় ভয় করতে থাকে। আমি শেষ পর্যন্ত সাহস করে মূর্তিটার দিকে তাকালাম এবং হঠাৎ মনে হলো সেটা একটু নড়ে উঠল। আমি চমকে উঠে তীব্র দৃষ্টিতে মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হতে লাগল আবার বুঝি সেটা নড়ে উঠবে কিন্তু সেটা আর নড়ল না। নিশ্চয়ই আমার মনের ভুল! কিন্তু যতবার আমি সেটা থেকে চোখ সরাই ততবারই মনে হয় সেটা একটু নড়ে ওঠে, খুব বেশি নয়; কিন্তু চোখে ধরা পড়ার জন্যে যথেষ্ট।

রাত্রি এগারটার দিকে বাসার একজন মানুষ এলো আমার ঘরে ফায়ার প্লেসটি জ্বালিয়ে দিতে। আমি শুধু সিনেমায়-টিভিতে মানুষকে ফায়ার প্লেস স্বালাতে দেখেছি সত্যি সত্যি যে এখানে কেউ ফায়ার প্লেস জ্বালাতে পারে জানতাম না। ঘরের মাঝে আগুন জ্বলছে ব্যাপারটা আমার কাছে কেন জানি অস্বাভাবিক মনে হয়। আমি একটু ইতস্তত করছিলাম, লোকটা বলল, স্যার এখানে রাত্রে অসম্ভব ঠাণ্ডা পড়ে। এটা জ্বালিয়ে দিলে আরামে ঘুমাবেন।

আমি বললাম, এখন তো সেরকম ঠাণ্ডা নেই।

তা নেই, কিন্তু ভোররাতের দিকে চারদিক বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

আমি আর আপত্তি করলাম না, লোকটা ফায়ার প্লেসটি জ্বালিয়ে দিল। সাথে সাথে সারা ঘরে আগুনের একটা নরম উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে। আমি খানিকক্ষণ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আমার টেবিলের কাছে ফিরে এলাম, সেখানে পিশাচের মূর্তিটি অত্যন্ত দূর মুখভঙ্গি করে বসে আছে।

রাত্রে আমার ঘুমাতে ঘুমাতে খুব দেরি হয়, আজকেও সেরকমই হবে ভেবে আমি বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা হালকা উপন্যাস নিয়ে বসেছি রগরগে কাহিনী ট্রেনে, বাসে পড়া যায় বলে শুরু করেছিলাম এখন শেষ করে দেব বলে ভাবলাম। দু-এক পৃষ্ঠা পড়তেই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল, ঘরে ফায়ার প্লেস ছিল বলে ঘরে অন্ধকার নেমে না এসে এক ধরনের আধিভৌতিক আলো খেলা করতে থাকে। ফায়ার প্লেসে আগুনের শিখা নড়ছে। সেই আলোতে ঘরে বিচিত্র এক ধরনের লম্বা লম্বা ছায়া পড়ে এবং সেই ছায়া আগুনের শিখার সাথে সাথে নড়তে থাকে।

আমি কী করব ভাবতে ভাবতে নিচে নামতেই দরজায় ফয়েজ এসে দাঁড়াল, বলল, ইকবাল, ঘুমিয়ে গেছিস?

না। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল।

হ্যা। আজকাল প্রায়ই চলে যাচ্ছে। আমাদের টি গার্ডেনের নিজস্ব ডায়নামো আছে, এমনিতে অসুবিধে হবার কথা নয়। তবে অনেক রাত হয়ে গেছে, আজ মনে হয় সেটা চালাবে না। এই মোমবাতিটা রাখ।

আমি মোমবাতিটা নিয়ে ফায়ার প্লেসের উপরে রেখে বললাম, ফায়ার প্লেসের আগুনে বেশ দেখা যাচ্ছে, মোমবাতি না
হলেও ক্ষতি নেই।

তা ঠিক।

এখন তো আমিও আছি, কিছু দরকার হলে বলিস।

ফয়েজ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বলব।

আমি বিছানায় শুয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না, হঠাৎ করে আমার ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেল। ঘুমটি কেন ভেঙেছে আমি জানি না। কিন্তু আমার সমস্ত স্নায়ু মুহুর্তে ঘুমের সমস্ত অবসাদ ঝেড়ে ফেলে একেবারে টান টান হয়ে রইল। আমার কেন জানি মনে হতে থাকে খুব অশুভ কিছু একটা ঘটছে। সেটি কী আমি জানি না। কিন্তু আমার সমস্ত চেতনা সেটার জন্যে প্রস্তুত হয়ে রইল। ফায়ার প্লেসের আগুন কমে সেখানে এখন একটা গনগনে লাল আভা তার স্নান আলোতে ঘরে আবছা অন্ধকার। ঘুমানোর সময় ঘরে যেরকম একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছিল এখন সেটা নেই, সারা ঘর হিমশীতল। আমার সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমি বিছানা থেকে নামতেই নাকে একটা অস্বস্তিকর গন্ধ পেলাম, পচা রক্তের অসুস্থ একটা গন্ধ। গন্ধটা কোথা থেকে আসছে কে জানে। আমি ফায়ার প্লেসের আগুনটা একটু চাগিয়ে দিতে গেলাম, কাছেই একটা সুচালো লোহার রড রাখা ছিল, সেটা দিয়ে খুঁচিয়ে দিতেই একটা আগুনের শিখা দপ দপ করে জুলে উঠে ঘরে লালাভ একটা আলো জ্বলে ওঠে। আমি ঘুরে টেবিলের দিকে তাকালাম এবংহঠাৎ আমার সমস্ত শরীর জমে গেল, টেবিলে কাচের বাক্সটি খালি, মূর্তিটা সেখানে নেই।

আমি আজীবন কঠিন বাস্তবতায় মানুষ হয়ে এসেছি, অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃতিক জিনিস আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু সেই মুহুর্তে হঠাৎ কেন জানি আমি নিঃসন্দেহ হয়ে গেলাম পিশাচটি প্রাণ পেয়ে শাওনের ঘরে গেছে। যদি আমি কিছু না করি ভয়ংকর একটা কিছু ঘটে যাবে। আমি ফায়ার প্লেসের আগুন খোঁচানোর রডটি হাতে নিয়ে ঘর থেকে পা টিপে টিপে বের হলাম।

আমার ঘরটি একটা হলঘরের সাথে লাগানো। সাথে একটা করিডোর। আমি করিডোর ধরে হাঁটতে থাকি আর সাথে সাথে আমার নাকে আবার সেই পচা গন্ধটা এসে লাগে। আমি পা টিপে টিপে শাওনের ঘরে এলাম, সাবধানে দরজা স্পর্শ করতেই সেটা খুলে গেল, সাথে সাথে আমার নাকে বোটকা দূষিত গন্ধটি আবার এসে ধাক্কা দেয়। আমি শাওনের ঘরে এসে ঢুকলাম, ঘরটি হিমশীতল। শাওনের বিছানার কাছে একটা ব্যাটারি চার্জার লাগানো বাতি জ্বলছে, সেটা অন্ধকারকে দর না করে আরো কেমন যেন বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম, মশারির কাছে গিয়ে উকি দিতেই আমার সমস্ত শরীর আতঙ্কে শিউরে উঠল। বিছানায় তার মাথার কাছে কুৎসিত লোমশ একজন মানুষ বসে। আছে, মুখে পৈশাচিক এক ধরনের হাসি, চোখ দুটি অঙ্গারের মতো জ্বলছে। সেটি আমার দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকাল। মনে হলো দৃষ্টি আমার ভেদ করে সেই সমস্ত শরীর চলে গেল।

আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। নিজের ভেতরে একটা ভয়াবহ আতঙ্ক এসে ভর করেছে। তবুও দুই হাতে শক্ত করে লোহার রডটি নিয়ে এগিয়ে গেলাম। শাওনকে বাঁচিয়ে প্রাণীটাকে আঘাত করার মতো কিছু একটা জিনিস সম্ভবত আমার মাথায় কাজ করছিল। কিন্তু হঠাৎ হুটোপুটির মতো একটা শব্দ হলো আমি দেখলাম প্রাণীটি সেখানে নেই। মনে হলো ঘরের মাঝে কিছু একটা ছুটোছুটি করছে, কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না। টেবিলটা নড়ে উঠল হঠাৎ, সেলফ থেকে দুটো বই নিচে এসে পড়ল, শাওনের বিছানাটা হঠাৎই কেঁপে উঠল। আমি দুই হাতে শক্ত করে লোহার রডটা ধরে রেখে দাঁড়িয়ে থাকি। যে জিনিসকে চোখে দেখা যায় না তাকে আঘাত করা যায় কি না সেটা একবারও আমার মাথায় এলো না। ঘরের দরজা হঠাৎ হুট করে খুলে গেল। সাথে সাথে ঘরের সব হুটোপুটি থেমে গেল।

আমি শাওনের কাছে ছুটে গেলাম। তার গলার কাছে খানিকটা রক্ত, আমি তার হাত স্পর্শ করে বুকের কাছে মাথা নামিয়ে আনলাম। দেখলাম। খুব ধীরে ধীরে তার বুক উঠছে-নামছে, সে নিঃশ্বাস নিচ্ছে— এখনো বেঁচে আছে শাওন।

আমি মশারি নামিয়ে শাওনের ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরের দিকে ছুটে এলাম। দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই দেখি টেবিলের ওপর কাচের বাক্সটাতে মুর্তিটা আবার ফিরে এসেছে। আমি দুই হাতে লোহার রডটা ধরে মর্তিটার দিকে এগিয়ে গেলাম। ফায়ার প্লেসের আগুনে স্পষ্ট দেখলাম এর মুখের পাশে রক্ত লেগে আছে, মূর্তিটা আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার জিবটা বের করে তার মুখের রক্ত চেটে খেয়ে নেয় একবার।

অমানুষিক আতঙ্কে আমি তখন কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। লোহার রডটা ওপরে তুলে আঘাত করতেই ঝন ঝন করে কাচের বাক্সটা ভেঙে গেল। মূর্তিটা তখন টেবিলের ওপর স্থির হয়ে বসে আছে, আমার মনে হতে থাকে এটি আসলে কোনো মূর্তি নয় এটা মূর্তিমান বিভীষিকা— যেভাবেই হোক এটাকে আমার ধ্বংস করতেই হবে। আমি আবার লোহার রডটা তুলে এটাকে আঘাত করতে গেলাম। হঠাৎ মূর্তিটা টেবিল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার হাত বিশাল আকার নিয়ে আমার দিকে ছুটে আসে। আমি অন্ধের মতো  চোখ বন্ধ করে আঘাত করলাম, ভয়ংকর একটা আর্তনাদ শুনতে পেলাম। হঠাৎ দেখি মূর্তিটা ছিটকে ফায়ার প্লেসের আগুনের মাঝে গিয়ে পড়েছে। মাংসপোড়া বিশ্রী গন্ধে ঘরটা কলুষিত হয়ে গেল। চড়চড় শব্দ করে পুড়তে থাকে মূর্তিটা। আমি দেখতে পাই তার মাঝে সেটা কিলবিল করে নড়ছে।

ফয়েজ আর তার স্ত্রী যখন নেমে এসেছে তখন ফায়ার প্লেসে মূর্তিটার বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। আমার ঘরে এসে ফয়েজ ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ইকবাল? আমি লোহার রডটা নিচে রাখতে রাখতে বললাম, ঘরে বাদুড় না কী যেন ঢুকেছিল, মারতে গিয়ে ভুল করে মূর্তিটাকে মেরে বসেছি! ছিটকে গিয়ে পড়েছে আগুনে—

ফয়েজের স্ত্রী বলল, ভালো হয়েছে পুড়েছে আপদ! কী বিশ্রী গন্ধ বের হয়েছে দেখেছ?

আমি কোনো কথা বললাম না। ফয়েজ বলল, বিকট একটা চিৎকার শুনতে পেলাম-

আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমি নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে করেছি! হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গিয়ে মাথার ঠিক নেই—

ফয়েজের স্ত্রী বলল, শাওনকে দেখে আসি।

আমি বললাম, হাঁ এত। চেচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেছে চল।

শাওনের ঘরে গিয়ে দেখি সে বিছানায় চুপচাপ বসে আছে।

আমাদের দেখে বলল, তোমরা এত রাতে কী করছ?

তার মা বলল, তোকে দেখতে এলাম।

শাওন হেসে বলল, ভালো করেছ মা। আমার কী মনে হচ্ছে
জান?

কী?

আমি ভালো হয়ে যাব।

আমি একটু বিছানা থেকে উঠি?

ফয়েজ ভয় পাওয়া গলায় বলল, পারবি উঠতে?

পারব বাবা।

ফয়েজ এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল, শাওন তাকে ধরে উঠে দাঁড়াল। ফয়েজের স্ত্রী হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে বলল, সে কী, তোর গলায় রক্ত কিসের?

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, মশা! নিশ্চয়ই মশা চা বাগানের মশা রক্ত খেয়ে ঢোল হয়েছিল, শাওন নিশ্চয়ই ঘমের মাঝে মেরে বসেছে।

তরফদার গল্প শেষ করে থামলেন, আমি আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বললাম, তারপর শাওনের কী হলো?

ভালো হয়ে গেল?

হ্যাঁ। অনেকদিন আগের কথা। এখন বিয়ে হয়ে গেছে। ভালো আছে শাওন।

তাকে কোনোদিন বলেছেন গল্পটা?

না বলি নি। এরকম আজগুবি একটা গল্প বলার ইচ্ছে করে না।

আনিস ঘাড় বাঁকা করে বলল, তাহলে আমাদের যে বললেন?

তোমাদের বলেছি মাঝরাতে, যখন বাইরে ঝুমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে, একটা ভুতুড়ে আবহাওয়া, ভালো গল্পই ভুতুড়ে শোনায় তাই! কাল ভোরে তোমরা ভাববে, তরফদার সাহেব কী গাঁজাখুরি গল্পই না করতে পারে! কী, ভাববে না?

আমি মাথা নাড়লাম, মনে হয় ভাবব।

****************************************(সমাপ্ত)***********************************

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত