জর্জিয়ার আতংক
সাভানাহ নদীর ধারের ওকভিলের বাড়িটায় থাকতেন ওয়ালসিংহাম নামের এক কৃষক। ওটা পড়েছে আমেরিকার জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে। ওয়ালসিংহাম মোটেই কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন না। কাজেই শুরুতে বাড়িকে ঘিরে যেসব ছোটখাট ঘটনা ঘটতে লাগল, ওগুলোকে বদ প্রতিবেশিদের সাজানো নাটক বলে ধরে নিলেন। তবে যতই দিন গড়াতে লাগল অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। পরিবারের লোকেরা রাতে বিছানায় যেতে না যেতেই অত্যাচার বাড়ে। ঘরের দরজায় করাঘাত হয়, বেল বাজে আর বিনা কারণে চেয়ার উল্টে পড়তে থাকে। বাড়িতে একটা কুকুর আছে। বুদ্ধিমান ম্যাস্টিফ কুকুরটাকে সবাই ডাকে ডন সিজার নামে। এক দিন দেখা গেল হল ঘরে ঢোকার মুখের করিডোরে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড চেঁচাচ্ছে সে, রাগে শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেছে, আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দেয়ালের দিকে। তারপরই লাফ দিয়ে সামনে এগুল। কিন্তু ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার করে মাটিতে পড়ল ওটা। মনে হলো যেন নিষ্ঠুর এক জোড়া হাত তাকে ধরে আছাড় মেরেছে। পরীক্ষা করে দেখা গেল কুকুরটার ঘাড় ভেঙে গেছে।
এদিকে বাড়ির বিড়ালটার সঙ্গে যেন অশরীরীটার একটা চমৎকার বোঝাপড়া হয়ে গেছে। ঘর ঘর শব্দে আনন্দ প্রকাশ করে সদরদরজা দিয়ে ঢোকে সে, মনে হয় যেন কোনো আগন্তুককে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে, যে তার পিঠে আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তারপর দেখা যায় লাফিয়ে একটা চেয়ারে উঠে, আনন্দে তাতে শরীর ঘষছে।
যতই দিন গড়াতে লাগল রাতের বেলা ততই বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগল অশরীরীটা। ওটার যন্ত্রণায় ঘুমানো অসম্ভব হয়ে উঠল বাড়ির বাসিন্দাদের পক্ষে। চেঁচামেচি, গোঙানি, উৎকট হাসি, বীভৎস চিৎকার এমনই নানা শব্দে অস্থির হয়ে উঠলেন তারা। কখনো শব্দ আসে বাড়ির নীচ থেকে আবার কখনো শোনা যায় ছাদ থেকে। এক রাতে বাড়ির ছোট্ট মেয়ে এমেলিয়া টয়লেটে গিয়েছে। হঠাৎ মনে হলো আলতোভাবে একটা হাত রেখেছে কেউ তার কাঁধে। হাতটা মা কিংবা বড় বোনের মনে করে সামনে আয়নার দিকে তাকাল। কিন্তু সেখানে কারো প্রতিবিম্ব পড়ল না সে ছাড়া। কিন্তু চোখের কোন দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেল প্রশস্ত, পুরুষালি একটা হাত তার কাঁধের ওপর বিশ্রাম নিচ্ছে। মেয়েটির চিৎকারে বাড়ির বাকি সবাই ছুটে এল। কিন্তু তারা যখন এল হাতের কোনো চিহ্ন নেই।
আরেকদিন হালকা বৃষ্টির পর মি, ওয়ালসিংহাম বাগানে হাঁটছিলেন। হঠাৎ পাশেই কারো পায়ের ছাপ নজরে পড়ল। খালি পায়ের একজন লোকের পায়ের ছাপগুলো এভাবে এগিয়েছে, মনে হয় অদৃশ্য কেউ তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে।
স্বাভাবিকভাবেই ওয়ালসিংহামরা বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কথা-বার্তা বলছিলেন। তবে এর মধ্যে এক রাতের একটা ডিনার পার্টির মাঝখানে এমন একটা ঘটনা ঘটল, স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজ হলো তাদের জন্য। চড়া একটা গোঙানির শব্দ শোনা গেল ওপর থেকে। তবে এসব এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, ওয়ালসিংহামরা কিংবা তাঁদের অতিথিরা কেউই একে গুরুত্ব দিলেন না। কিন্তু তারপরই একজনের নজর পড়ল টেবিলের সাদা চাদরটার ওপর রঙিন একটা বিন্দু বড় হচ্ছে আস্তে আস্তে। মনে হচ্ছে যেন ছাদ থেকে ফোটায় ফোঁটায় কোনো তরল পদার্থ টেবিলটার ওপর পড়ছে। তরলটা দেখতে রক্তের মত হওয়াতে আতংক নিয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে রইলেন সবাই। দু-তিনজন তোকসহ মি. ওয়ালসিংহাম ওপরের তলার কামরাটার দিকে উঠে গেলেন, বীভৎস এই তরল পড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে। কামরাটায় ঢুকে যেখান থেকে তরল পড়ছে মনে হচ্ছে সেখানকার কার্পেট সরিয়ে নীচের কাঠের মেঝে উন্মুক্ত করলেন। জায়গাটা একেবারেই শুকননা, পাতলা ধুলোর আস্তরণ পড়ে আছে। কিন্তু নীচের টেবিলে রক্তের মত তরলটা ঝরে যাচ্ছে আগের মতই। একসময় টেবিলের ওপর গোলাকার একটা প্লেটের আকার নিল লাল পদার্থটা। তারপর বন্ধ হয়ে গেল, তরল পড়া। পরের দিন রসায়নবিদরা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন রঙিন তরলটা মানুষের রক্তই ছিল।
এরপর আর এই বাড়িতে থাকার মত অবস্থা থাকল না ওয়ালসিংহামদের। দেরি না করে পাততাড়ি গুটালেন তাঁরা। এরপর রীতিমত বিখ্যাত তথা কুখ্যাত হয়ে গেল বাড়িটা। নানা জায়গা থেকে লোকজন, আসতে লাগল ওটাকে দেখতে। তবে কেউই ওটাতে উঠতে রাজি হলো না। প্রথম যিনি এখানে রাত কাটানোর সাহস দেখালেন তিনি সাভানাহর হোরেস গান। বন্ধুরা বাজি ধরে, এই বাড়িতে তিন-চার ঘণ্টা থাকতে পারবেন না তিনি কোনোমতেই। আর তাদের শিক্ষা দিতে গিয়েই নিজের বিপদ ডেকে আনলেন ভদ্রলোক।
পরদিন অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হলো গানকে। বেশ কষ্ট করে জ্ঞান ফিরানো হল তার। কিন্তু স্বাভাবিক হলেন না তিনি। বিছানায় পড়ে রইলেন। আর দুর্বল কণ্ঠে ঘোষণা করলন যদি আবার হাঁটা-চলা করার অবস্থায় ফেরেন তবে পৃথিবীর সব সম্পদ দিলেও ওই অভিশপ্ত বাড়িতে আর কোনো রাত কাটাতে রাজী নন।
ধীরে ধীরে তার অভিজ্ঞতাটা বলার মত সুস্থ হয়ে উঠলেন হোরেস গান।
আঁধার নামার পর একটা কামরায় বাতি ধরানোর জন্য আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু দেখলেন সেটা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিবারই শীতল একটা দমকা হাওয়া ম্যাচের কাঠি নিভিয়ে দিচ্ছে। এসময় একবার তার ইচ্ছা হলো বাজিটাজির গুষ্টি কিলিয়ে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে। কিন্তু তারপরই মাথায় এল এতে বন্ধুদের কী পরিমাণ ঠাট্টা-মস্করা সইতে হবে তাকে। আর এটা মনে পড়তেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন।
কিছুটা সময় নিরুপদ্রবে কাটল। এমনকী একটু তন্দ্রাভাবও চলে এল তাঁর।এসময়ই হঠাৎ বাড়ির নীচ থেকে জোর একটা চিল্কারে সচকিত হয়ে উঠলেন। যন্ত্রণায় নাকি ক্রুদ্ধ হয়ে চিৎকারটা করেছে কেউ বুঝতে পারলেন না। তারপরই সিঁড়ি বেয়ে কারো ওঠা-নামার, আর এক কামরা থেকে আরেক কামরায় ছুটে বেড়ানোর পদশব্দ পেলেন। মোটামুটি ঘণ্টাখানেক থাকল আওয়াজটা। তারপর যেমন শুরু হয়েছে তেমনি হঠাৎ থেমে গেল। সব কিছু এখন একেবারে শান্ত। হোরেস গ্রেনের শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। তারপরই তাঁর উল্টো পাশের দেয়ালে সাদা একটা বিন্দু দেখলেন। ওটা বড় আর উজ্জ্বল হতে হতে সাদা আগুনের একটা চাকতির আকার নিল। তারপরই আতংক নিয়ে আবিষ্কার করলেন আলোটা আসছে একজন মানুষের মাথা থেকে। কিন্তু মাথাটার নীচে কোনো শরীর নেই। একজন মানুষের মাথা সাধারণত যে উচ্চতায় থাকে এই উচ্চতায় দেয়াল ঘেঁষে ধীরে ধীরে চলেছে ওটা। বিকট মাথাটা একজন বুড়ো মানুষের মনে হলো, যদিও ওটা নারীর না পুরুষের তা বোঝা মুশকিল। লম্বা, ধূসর চুল জবজব করছে, গাঢ় রক্তে। কপালের গভীর,দগদগে একটা ঘা থেকে বের হচ্ছে ওগুলো। গালগুলো বসা। গোটা চেহারাটা যেন অবর্ণনীয় কষ্ট আর যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি। চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে মুখটা। চোখের মণি জোড়া যেন তাকিয়ে আছে মি. গানের দিকে। আতংকে বাক্যহীন হয়ে পড়েছেন তিনি, এমনকী চিৎকার করে কেঁদে উঠতেও পারছেন না। একসময় মাথাটা অদৃশ্য হলো, তবে শব্দ চলতে লাগল। মনে হচ্ছে যেন কয়েকজন লোক মিলে চিল্কার করছে আর এর চোটে বাড়িটা কাঁপতে শুরু করেছে। চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে গোঙানি আর চিৎকার। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে কানে পীড়া দেওয়া ঝনঝন শব্দ। যেন ওপরতলা থেকে টিনের জিনিস ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে নীচে।
আর সহ্য করা সম্ভব না। এবার পালাতে হবে, ভাবলেন গান। অপার্থিব জিনিসগুলোকে এড়ানোর আশায় আস্তে আস্তে দেয়ালের পাশ ধরে এগুতে লাগলেন। দরজার কাছে প্রায় পৌঁছে গেছেন এমন সময় কে যেন তাঁকে পায়ের গোড়ালি ধরে মেঝেতে ছুঁড়ে মারল। তারপর বরফশীতল এক জোড়া হাত চেপে বসল তাঁর গলার ওপর। অদৃশ্য হামলাকারীর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মরণপণ লড়লেন গান। কিন্তু জোরে ওটার সঙ্গে পেরে উঠলেন না, উল্টো গলার ওপর চাপ বাড়ল।
পরদিন সকালে হোরেস গানকে যখন বন্ধুরা খুঁজে পেল তখন তার গলা কালো হয়ে আছে, সেখানে ধারাল নখের লম্বা লম্বা আঙুলের ছাপও ফুটে আছে।
জর্জিয়ার এই বাড়ি নিয়ে আরো নানান রকম ভীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে মানুষের। কেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে মি. ওয়ালসিংহাম পরে মনে করতে পেরেছিলেন যখন প্রথম বাড়িতে আবাস গাড়েন তখন কিছু হাড়গোড় খুঁজে পেয়েছিলেন। তবে ওগুলো জন্তু-জানোয়ারের হাড় মনে করে ফেলে দিয়েছিলেন আস্তাকুঁড়ে। কারো কারো ধারণা ওই হাড়গুলোর মালিকের আত্মাই এখন এই বাড়িটায় এত সব কাণ্ড ঘটাচ্ছে। তবে তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার লোকেরও অভাব হয়নি। আর তাই। জর্জিয়ার এই ভুতুড়ে বাড়ির রহস্যও ভেদ হয়নি।
শয়তানের বাড়ি
সিংগাপুর শহরে রহস্যময় একটা বাড়ি আছে, যেটা অনেক সিংগাপুরিয়কেই দারুণ আকর্ষণ করে। তারা একে শয়তানের বাড়ি নামে পরিচয় করিয়ে দিতেই পছন্দ করে। পাহাড়ের চূড়ায় একটা বাংলো এটি। সরু একটা রাস্তা উঠে গেছে বাংলোটার দিকে। যতদূর জানা যায়, বাড়ির মালিক পরিবারের সবাইকে কুঠার দিয়ে খুন করে, পরে নিজে আত্মহত্যা করেছিলেন। তারপর থেকেই এটা পরিণত হয় হানাবাড়িতে। পাশেই ঘোড়ার একটা আস্তাবল। লোকে বলে বাড়ির মত আস্তাবলটাও অভিশপ্ত আর ভুতুড়ে। কখনো সিংগাপুর বেড়াতে গিয়ে যদি বাড়িটার কাছে যান তবে দেখবেন, রোমাঞ্চপ্রিয় সিংগাপুরিয়দের কেউ কেউ নুড়ি বিছানো পথ ধরে গাড়ি নিয়ে চলেছে ওটাকে এক নজর দেখার জন্য। তবে সাধারণত গাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে কিছুটা দূর থেকে বাড়িটা দেখে চলে আসে তারা। তবে সবাই তাদের মত বুদ্ধিমান নয়। এদের একজনেরই কাহিনি এটি।
এক রাতে দারুণ উত্তেজনাকর একটা পার্টি শেষে বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণী ঠিক করল শয়তানের বাড়িটাতে একটা চক্কর দেবে। নুড়ি বিছানো রাস্তা দিয়ে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গাড়ি দাঁড় করাল তারা। তারপর গাড়ির হেডলাইট জ্বেলে, বাড়িটা দেখতে লাগল। একপর্যায়ে ভিতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না তা নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু হলো তাদের মধ্যে। ক্রমেই চেঁচামেচিতে রূপ নিল তর্ক। শেষমেশ বাড়িটাতে ঢোকাই স্থির হলো।
হৈ হল্লা আর চিৎকার করতে করতে গাড়ির থেকে বের হয়ে এল তারা। তারপর দৃঢ় পায়ে এগুলো সদর দরজার দিকে। এসময় দলের মেয়েদের সাহস একটু একটু করে টলতে শুরু করল। গাড়িতে ফিরে যেতে চাইল তারা। তবে ওটাকেও যেন এখান থেকে অনেক দূরে মনে হলো।
আর তাদের ভয় পেতে দেখে ছেলেরা আরো দৃঢ়সংকল্প হয়ে উঠল। ছেলেদের একজন হঠাৎ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ল। তারপরই তার পিছনে দরজাটা আটকে গেল।
বেশ কিছুক্ষণের জন্য মৃত্যুনীরবতা নেমে এল। আকস্মিক এই ঘটনায় বাকি দুটো মেয়ে আর ছেলেটা কী করবে বুঝতে না পেরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
তারপরই চিৎকার শুনল।
কী করবে বুঝে উঠতে পারল না তারা। ও কি তাদের ভয় দেখাতে এমনটা করছে?
আবার চিৎকারটা শোনা গেল। এবার পরিষ্কার হয়ে গেল আতংকিত মানুষের টানা চিৎকার এটা।
দৌড়ে ভিতরে ঢুকল তারা। দরজাটা শুধু ভেজানো ছিল। তারপরই দেখল তাদের বন্ধুটি মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর শরীর মোচড়াচ্ছে, মনে হয় যেন প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে তার। মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়ে এসেছে। তাদের দেখে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, সাহায্য করো। আমি তলিয়ে যাচ্ছি। দয়া করে আমাকে তোল! তলিয়ে যাচ্ছি।
দ্রুত তাকে তুলে গাড়িতে নিয়ে আসা হলো। আতংকে চেঁচামেচি শুরু করেছে সবাই। ভাগ্য ভাল তাদের একজনের এক পাদ্রীর খবর জানা ছিল।
পাদ্রীকে পাওয়া গেল। তিনি বন্ধুটিকে অশুভ প্রভাব মুক্ত করতে পারলেন। তবে পুরোপুরি না। কারণ এরপর থেকেই আচার-আচরণ কেমন যেন বদলে যায় তার।
কারো কারো ধারণা কোনো একটা দল কালো জাদুর চর্চা করে শয়তানের বাড়িতে। সপ্তাহের কোনো রাতে প্রার্থনা আর নানান খারাপ জিনিসের চর্চা হয় এখানে। তবে কাউকেই ওই বাড়িতে যেতে বাধা দেওয়া হয় না। এদের একজন জানিয়েছে একবার এমন কৌতূহলের বশে এর ভিতরে ঢুকে আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। ভিতরে পা দিয়েই নজরে পড়ে বাড়ির প্রধান হলে জ্বলন্ত মোমবাতির মাঝখানে আলখেল্লা পরা এক লোক বসে আছে। খুব সম্ভব সেই দলটির নেতা। আর দেখার সাহস হয়নি তার, দ্রুত বেরিয়ে আসে শয়তানের বাড়ি থেকে।
রক্তাক্ত চড়
এই অভিজ্ঞতাটি হয় ইংল্যাণ্ডের সম্রান্ত পরিবারের বিবাহিত এক নারীর। উনিশ শতকের শেষদিকে ঘটনা এটা। ঘটনাটি ঘটার বেশ কয়েক বছর পরে এটা বর্ণনা করেন তিনি। তবে জানান এটা এতটাই দাগ কেটেছে মনে যে এক বিন্দু মলিন হয়নি এর স্মৃতি। তার সবসময়ই মনে হয়েছে কেবল গত রাতেই এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডটি হয়েছে। ভদ্রমহিলার ভীতিকর এই অভিজ্ঞতা শুনব আমরা তার মুখ থেকেই।
একবার আমার এক বান্ধবীর বাড়ি গেলাম বেড়াতে। পুরানো ধাচের একটা বাড়িতে থাকে তারা। আলো-বাতাস ঢুকতে পারে
এমন বিশাল সব হল আর করিডোর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর সবখানে। কী একটা অনুষ্ঠান ছিল। ইতিমধ্যে তাই অতিথিতে ভরে গেছে বাড়িটা। তাই আমার জন্য বরাদ্দ হলো এক তলার বিশাল একটা কামরা। লম্বা, টানা বারান্দার শেষে ওটা। কামরাটা বেশ আরামদায়ক। বিশাল আর উষ্ণ। তবে কেন যেন পরিবেশটা ভাল লাগল না। সত্যি কথা বলতে গোটা বাড়িটাই আমার মধ্যে ভয়ের একটা অনুভূতির জন্ম দিল। কী কারণে তা বলতে পারব না।
খুব তাড়াতাড়ি যেন শোবার সময় হয়ে গেল। বান্ধবী মোমবাতিসহ আমার যা যা দরকার সব ঠিকমত আছে দেখে শুভরাত্রি জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের তলায় উঠে গেল।
পোশাক কেবল অর্ধেক বদলেছি এমন সময় দেখলাম কামরার দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। যেন একটা হাত চুপিসারে সতর্কভাবে চাপ দিচ্ছে এতে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আমার চোখের সামনে পুরোপুরি মেলে গেল দরজাটা, কিন্তু ওপাশে কেউ নেই। স্বস্তির একট নিঃশ্বাস ফেললাম। নিশ্চয়ই দমকা হাওয়া। হলওয়ে দিয়ে নেমে এসেছে। ভাবলাম আমি। ঘাবড়ে যাওয়ার জন্য মনে মনে নিজেকে আচ্ছাসে শাসন করলাম। আবার দরজা লাগিয়ে কাপড় ছাড়তে শুরু করলাম।
বেশিদূর এগুতে পারলাম না, তার আগেই আমাকে চমকে দিয়ে আবার খুলে গেল দরজাটা। আগেরবারের মতই ধীর ও শান্তভাবে। আবার দোর লাগিয়ে পোশাক ছাড়তে লাগলাম। এবার কাজটা শেষ করে রাত্রিবাসটা গায়ে চাপাতে পারলাম। আর এসময়ই আতংকিত হয়ে আবিষ্কার করলাম তৃতীয়বারের মত খুলতে শুরু করেছে দরজাটা। আগের মতই নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে। একসময় পুরোপুরি খুলে গেল। একটু একটু ভয় লাগলেও ঘটনাটা তদন্ত করে দেখা স্থির করলাম। মোমবাতিটা হাতে নিয়ে হল-এ বের হয়ে এলাম। তারপর সদর দরজার দিকে রওয়ানা হলাম। বড়জোর তিন কি চার কদম এগিয়েছি এমন সময় আমার হাতের মোমবাতিটা নিভে গেল। মনে হলো যেন হঠাৎ কোনখান থেকে একটা দমকা বাতাস ছুটে এসেছে ওটাকে নিভিয়ে দেওয়ার জন্যই। খুব একটা খুশি হতে পারলাম না। কারণ ম্যাচ রেখে এসেছি আমার কামরায়। কিন্তু রোখ চেপে গেছে আমার। অন্ধকারেই এটার একটা শেষ দেখার প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম। কাজেই অন্ধকার পথ ধরে এগুতেই লাগলাম। বাম হাতে ধরা নেভা মোমবাতি, আর ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছি পাথরের দেয়ালের স্পর্শ পাওয়ার জন্য।
মোটামুটি অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছি এমন সময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড হলো। মনে হলো যেন শীতল, ভেজা একটা কিছু আমার বাম গালে চড় কষেছে। হাত দিয়ে গাল স্পর্শ করতেই ভেজা ভেজা ঠেকল। একমুহূর্তের জন্য দোটানায় পড়লাম। তারপর আবার হাঁটতে লাগলাম। একসময় সদর দরজার সামনে চলে এলাম। ওটা বন্ধ এবং তালা আটকানো। তারপর অন্ধকারে পুরো হলটা ঘুরে কিছু পেলাম না। ফিরে চললাম আমার কামরার দিকে। এখনো আগের মতই এক হাতে মোমবাতি, এবং আরেক হাত বাড়িয়ে দেয়ালের স্পর্শ পাচ্ছি। হলের মোটামুটি অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়েছি এমন সময় আবার মুখে সেই শীতল, ভেজা হাতের চড় খেলাম। এবার চড়টা পড়ল ডান গালে। গাল স্পর্শ করতেই আগের মতই দেখলাম ওটা ভেজা।
আতংক পেয়ে বসল আমাকে। অন্ধকারে যত দ্রুত সম্ভব পা চালালাম নিজের কামরাটার দিকে। পৌঁছেই দরজা আটকে ওটার সামনে একটা চেয়ার রাখলাম বাড়তি নিরাপত্তা হিসাবে। এবার হাতড়ে হাতড়ে ম্যাচ বাক্সটা খুঁজে নিলাম। তারপর মোমবাতি জ্বেলে আয়নার দিকে তাকালাম, মুখের কী অবস্থা দেখার জন্য।
আয়নায় যা দেখলাম তা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। আমার দু-গালে রক্তের দুটো লম্বা রেখা। ভয়ে, আতংকে কিছুক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। পরের ঘটনা পরিষ্কার মনে নেই। শুধু আবছাভাবে মনে আছে আমার চারপাশ ঘিরে আছে উদ্বিগ্ন কিছু চেহারা আর ফিসফাস শব্দ। তারপরই জ্ঞান হারালাম।
এই রাতের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল আমার।
অবাঞ্ছিত অতিথি
এক সিংগাপুরিয় কিণ্ডারগার্টেন শিক্ষিকার জীবনের অভিজ্ঞতা শুনব এবার আমরা।
তোয়া পেয়োহর যে ফ্ল্যাটটাতে আমরা থাকতাম সেখানে বেশ কয়েকবার এক অশরীরীর সঙ্গে দেখা হয় আমার। গোড়ার দিকে ওটা রীতিমত আতঙ্কিত করে ফেলে আমাকে। তবে পরে অবশ্য আর ওটাকে খুব একটা কেয়ার করিনি।
প্রথম এর উপস্থিতি ফাঁস হয় আমার কাছে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি। মাঝারি আকারের একটা বাসায় থাকতাম আমরা। ভিতরের কামরা আর ডাইনিং রুমটার থেকে হল রুমটা আলাদা করা। আমার ছোটবোনেরও তখন ওলেভেল পরীক্ষার বেশি বাকি নেই। দুজনে ডাইনং রুমে পড়তাম। একদিনের ঘটনা। রাত প্রায় একটা পর্যন্ত পড়ালেখা আর গল্পগুজবে মশগুল থাকলাম আমরা। আমাদের ব্লকের সামনেই একটা সরু রাস্তা আর পিছনে একটা কার পার্কিং। কাজেই মাঝে মাঝে গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া রাতটা মোটামুটি সুনসানই বলা চলে।
পড়ালেখা শেষ করতে করতে দেখা গেল টেবিল মোটামুটি বই-পত্র আর অন্য সব জিনিসের পাহাড় জমে গেছে। সাধারণত আমার বোনই বেশি তৎপর। দেখা যায় আমাদের চারপাশে জমা হওয়া জিনিসগুলো ও-ই পরিষ্কার করছে। কিন্তু এই রাতে দুজনেই এতটা ক্লান্ত হয়ে পড়লাম যে বই-পত্র টেবিলের ওপর রেখেই, যে শোবার ঘরটায় থাকি সেটায় চলে গেলাম।
ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল আমার। মনে হলো হলরুমে একটা শব্দ শুনেছি। তবে ঘরের কেউ শব্দটা করেছে ভেবে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল ছয়টার দিকে বিছানা থেকে উঠলাম। শুরুতে কিছু টের পেলাম না। কিন্তু একটু পরেই আমার বোন বলল, ধন্যবাদ। যাক জীবনে অন্তত একবার আমার অপেক্ষায় না থেকে জিনিস-পত্তরগুলো গোছগাছ করে ফেলেছ তুমি।
সে কী বলছে বুঝতে পারলাম না। যখন তার কথার মানে জানতে চাইলাম তখন ডাইনিং রুমের খালি টেবিলটা দেখিয়ে দিল। একবার ভাবলাম প্রশংসাটা হজম করে ফেলব। তারপরই কৌতূহল জাগল। তাহলে কাজটা করল কে? পরে আব্দু-আম্মু ঘুম থেকে উঠলে জানতে চাইলাম তারা কেউ করেছে কিনা। তবে যা ভেবেছিলাম তাই, তারাও বইগুলো সরায়নি। পরে বুঝতে পেরেছিলাম এর মাধ্যমে রহস্যময় ঘটনাগুলোর শুরু হলো কেবল।
কিছু দিন পরের কথা। এক রাতে আব্দু-আম্মু আর বোনসহ বাড়ি ফিরছি। এসময়ই ওপরে আমাদের ফ্ল্যাটের দিকে দৃষ্টি চলে গেল। জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কালো, লম্বা একটা ছায়াকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। মাথার ওপরে হাত জোড়া, গ্রিল ধরে রেখেছে। বোনের দিকে তাকিয়ে বললাম সম্ভবত ভাইয়া বাসায় আছে, আমাদের দেখছে সে। কিন্তু আমার বোন ওপরে তাকিয়ে বলল, কই, আমি তো কিছুই দেখছি না।
কিন্তু আমি তাকিয়ে ঠিকই তাকে দেখতে পেলাম। এটা বলতেই আম্মু বলে উঠলেন, আজে-বাজে কথা বোলো না। আলো না জ্বেলে রান্না ঘরের জানালায় কেন তোমার ভাই দাঁড়িয়ে থাকবে?
যখন বাসায় পৌঁছলাম সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। প্রতিটি কামরা খুঁজে দেখলাম আমি আর আমার বোন, যদি ভাইয়া লুকিয়ে আমাদের সঙ্গে মজা করার চেষ্টা করে এই ভেবে। সে বাসায় ফিরল বেশ রাত করে। কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞেস করলে বলল কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বের হয়েছিল। কয়েকদিন বাদে তার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারি ঠিকই বলেছে ও।
আরেকদিনের কথা। বাসায় আমি একা। ফ্ল্যাটের মাঝখানের ডিভাইডারের দেরাজ পরিষ্কার করতে লাগলাম। হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই মনে হলো কে যেন আমাকে দেখছে। কী কারণে জানি না ওপরে তাকালাম। জায়গামতই তাকিয়েছি। কারণ মুহূর্তের জন্য ওটাকে দেখলাম। ডিভাইডারটার ওপর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে একটা গাঢ় ছায়া।
চেঁচিয়ে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে শোবার ঘরের দরজা দিয়ে ছুটে অদৃশ্য হলো ওটা, যেন আমাকে ভয় পেয়েছে। এখানে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে পাশের বাসায় চলে এলাম। ফিরলাম বাড়ির অন্যরা আসার পর। ঘটনাটি খুলে বলতেই আমাকে নিয়ে রীতিমত হাসাহাসি শুরু করল তারা। বলল সবই নাকি আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা।
তবে তাদের ধারণা পাল্টাল যখন আমার খালাতো বোন মালয়েশিয়ায় থাকা তার এক বান্ধবীকে নিয়ে আমাদের বাসায় এল। তার বান্ধবীটি একজন সাইকিক। আর এসেই বললেন এই বাড়িতে একটা অশরীরী আছে। অথচ তাকে আমার অভিজ্ঞতাগুলো বলিনি আমরা কেউই।
বললেন এখন ওটাকে দেখেছেন তিনি। হল রুমের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য আমাদের চোখে কিছুই নজরে এল না। তারপর জানতে চাইলেন আমরা এমন কোনো নারীকে চিনতাম কিনা, যিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় সবসময় সাদা কাপড় পরতেন।
শুরুতে ভাবলাম আব্দুর ফুপুর কথা বলছেন। যখন আব্দুর বয়স কম ছিল তখন তিনিই তাঁর দেখাশুনা করতেন। কিন্তু তখনই জানা গেল বাবার ফুপু কখনোই সবসময় সাদা কাপড় পরতেন না। কাজেই রহস্যময় অশরীরীর পরিচয় বের করা গেল না। খালাতো বোনের বান্ধবীটি জানালেন আত্মাটা হল ঘরের অপর কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। তবে সে সামনে আসতে নারাজ। পাছে আবার তিনি ওটাকে চলে যেতে বলেন। তবে এটাও বললেন আত্মাটা খারাপ স্বভাবের না। আর ওটা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু কে চায় বাড়িতে একটা আত্মা পুষতে, তা সে ভাল হোক, কি মন্দ?
তবে এটা ঠিক যতদিন ওই বাড়িতে ছিলাম সে আসলেই তেমন কোনো ঝামেলা করেনি। আমি ওটাকে দেখেছি সবচেয়ে বেশি। তবে ধীরে ধীরে বাড়ির অন্য সদস্যরাও অশরীরীটার অস্তিত্ব টের পেতে শুরু করল। কারণ তাকে নিয়ে তাদেরও কিছু অভিজ্ঞতা হয়।
এক রাতে কিচেনের দিকে মুখ করে পড়ছিল আমার বোন।
বাড়ির বাকিরা তখন ঘুমিয়ে কাদা। এসময় শুনল কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। শুরুতে খুব চাপা গলায়। যদিও সে নিশ্চিত ডাকটা শুনেছে, তারপরও এই বলে নিজেকে বোঝাল, এটা নিশ্চয়ই তার কল্পনা। আবার পড়ায় মন দিল সে।
তারপর আবার শুনল। এবার চড়া গলার, কর্কশ একটা কণ্ঠ। ঠিক পিছনেই ওটা। আর তার নাম ধরে ডাকছে। পিছনে না
তাকিয়ে এক ছুটে বেড রুমে চলে এল আমার বোন। রাতে ঘুমাল সে মাথার ওপর বেডশিট চাপিয়ে।
আব্দু-আম্মুও একসময় ওটার উপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত হলেন। মাঝে মাঝে রাতে হল ঘর থেকে আওয়াজ আসলেও এটাকে তেমন পাত্তা দেননি তাঁরা। কিন্তু এক রাতে এমন পরিষ্কার শব্দ শোনা গেল যে সন্দেহ রইল না সেখানে কেউ আছে।
সে রাতে শোবার ঘরেই রইলেন তাঁরা। ওটা কী দেখতে বের হলেন না। কারণ আমরা সবাই গিয়েছিলাম আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায়। তার মানে বাড়িতে তারা ছাড়া আর কেউ থাকার কথা নয়। আর তাই অযথা হল ঘরে গিয়ে অশরীরীর মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি নেননি।
আমি সাইকিক নই। কিংবা আমার এ ধরনের কোনো ক্ষমতাও নেই। আর ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর এ ধরনের কিছু ঘটেছে কমই। তারপরও এখন যদি বলি অস্বাভাবিক কিছু টের পেয়েছি কংবা অদ্ভুত কোনো কাহিনি শুনেছি, আব্দু-আম্মু তা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।
অশরীরীর আতংক
১৮৯১ সালের বসন্তে ফ্রান্সের লি পোর্টের এক বাড়িতে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয় এক অশরীরী। খনি এলাকার কাছেই বাড়িটার অবস্থান। অনেক সময় এই এলাকাটায় হাজার দুয়েক লোকেরও সমাগম হয়। তবে প্রেতাত্মাটা নানান কাণ্ড-কীর্তি করে বেড়ালেও ওটাকে দেখেছে এমন দাবি করেননি কেউ। বাড়ির বাসিন্দাদের এভাবে পিটিয়েছে ওটা যে চেহারায় কালশিটে পড়ে গিয়েছিল কারো কারো। পুলিশকেও বিষয়টি জানানো হয়। ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন এমন অনেকের মুখ থেকে ঘটনাটা শোনেন তাঁরা। আঁটঘাট বেঁধে রহস্যের সমাধানেও নামে। মানুষের হাত থাকতে পারে এমন সব ধরনের সম্ভাবনা যাচাইবাছাই আর অনুসন্ধান করেন। কিন্তু এর পিছনে রক্ত-মাংসের কোনো মানুষ জড়িত এটা বের করতে ব্যর্থ হন।
একটি ঘটনা বলা যাক। বাড়ির আলোকিত তিনটি কামরায় তেরোজন লোক বসে ছিলেন। এদের কয়েকজন বেশ কিছুটা সময় ধরে সময় কাটানোর জন্য তাস খেলছিলেন। তবে তাদের শান্তিতে থাকতে না দেওয়ার পণ করেছিল কিছু একটা। কারণ পুরো সময়টা জুড়ে বাড়ির নানা প্রান্ত থেকে অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসতে লাগল। একবার মনে হলো বাড়ির প্রধান সিঁড়ি পথ ধরে সেনাদের একটা দল হুড়মুড় করে নেমে আসছে। দেয়ালে ঝুলানো ছবিগুলো গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই ভয়ানকভাবে দুলতে শুরু করল। তারপর দেয়ালে প্রচণ্ড ধাক্কার শব্দ শোনা গেল। আবার মনে হলো বন্ধ দরজা আর জানালাগুলোর ওপর কিছু দিয়ে দুম দুম করে বাড়ি দিচ্ছে কেউ। শব্দটা অনেকটা কাপড়ে পেঁচিয়ে বিশালাকার কোনো হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে যেমন মনে হবে তেমন।
দু-বার একতলার একটা কামরা কালিগোলা অন্ধকারে ডুবে গেল, অথচ বাইরে সূর্য অবিরাম আলো ঢেলে যাচ্ছে। আরেকবার কয়েকজন মানুষ এখানে উপস্থিত হলেন আসলেই ভৌতিক কোনো ব্যাপার ঘটে নাকি পরীক্ষা করে দেখার জন্য। মাঝরাতের ঠিক আগে বাড়ির সব বাতি হঠাৎ নিভে গেল। সেই সঙ্গে চারপাশ থেকে শোনা যেতে লাগল চিল্কার আর বিকট হাসি। বিশেষ করে খালি কামরাগুলো থেকে আওয়াজ এল সবচেয়ে বেশি। যারা তখন বাড়িতে উপস্থিত থাকলেন তাঁর অদৃশ্য কারো হাতে বেদম মার খেলেন। শুধু তা-ই না, সিঁড়ি থেকে কালির বিশাল একটা বোতল ছুঁড়ে মারা হলো।
এই অস্বাভাবিক ঘটনার উৎস আবিষ্কারের জন্য সব ধরনের চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। মাঝখানে কয়েক মাসের জন্য এই ধরনের অস্বাভাবিক কীর্তি-কলাপ বন্ধ ছিল। তারপর আবার শুরু হয়। এরপর থেকে বিরতি দিয়ে চলতেই থাকে। কি একবার ঢুঁ মেরে আসবেন নাকি ফ্রান্সের এই ভুতুড়ে বাড়িতে?
টু লেট
বেশ অদ্ভুত এই বাড়িটার কাহিনি শুনিয়েছেন আয়ারল্যাণ্ডের মি. ই, বি. লেসি। বালক বয়সে তিনি থাকতেন শহরতলীতে। প্রতিদিন সকালে ডাবলিন শহরের স্কুলে আসতে হত তাকে। এসময় এমন একটা রাস্তা দিয়ে আসতে হত যেখানে নিঃসঙ্গ একটা বাড়ি পড়ে। ওটা খালি পড়ে থাকত অনেক সময়ই। কোনো ভাড়াটে আসার পর কয়েক মাস পরেই দেখা যেত বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন তাঁরা। তারপর বাড়ি ভাড়ার নোটিশ ঝুলত। এভাবে কয়েক মাস খালি থাকার পর হয়তো নতুন ভাড়াটে আসত। তবে কাউকেই পাকাপাকিভাবে খুব বেশিদিন থাকতে দেখেননি এখানে। আট-ন বছর এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটল। মাঝে মাঝেই তার মনে প্রশ্ন জাগত বাড়িটাতে ভাড়াটে থাকে না কেন? একদিন এক বন্ধুকে প্রশ্নটা করতে সে জানাল এটা হানাবাড়ি হিসাবে বদনাম কামিয়েছে।
কয়েক বছর পরের কথা। একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন লেসি। এসময়ই একদিন এমন একজন মহিলার সঙ্গে ব্যবসায়িক কাজে দেখা করার প্রয়োজন পড়ল, যিনি ওই মুহূর্তে হানাবাড়িটাতে বসবাস করছেন। ব্যবসা নিয়ে আলাপের এক পর্যায়ে মহিলাটি জানালেন বাড়িটি ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। এমনিতেই এই বাড়িটা নিয়ে লেসির আগ্রহের শেষ নেই। কাজেই এমন একটা সুযোগ পায়ে ঠেলবেন তা কী করে হয়। ভদ্রমহিলাকে অনুরোধ করলেন এই বাড়িটার ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর যতটুকুন জানা আছে, বললে হেসির কৌতূহল মিটত। ভদ্রমহিলা খুশি মনেই বললেন। কাহিনির মূল রস অক্ষুন্ন রাখার জন্য মহিলাটির বর্ণনাই আমরা তুলে ধরছি পাঠকদের সামনে।
বছর চল্লিশেক আগে উইল করে এক ভদ্রলোককে দেওয়া হয় বাড়িটা। এখানে খুব বেশিদিন থাকতে পারেননি। কারণ তারপরই হঠাৎ পাগল হয়ে যান। একটা পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেওয়া হলো তাঁকে। তারপর ভদ্রলোকের এজেন্ট এক মহিলাকে ভাড়া দিলেন বাড়িটা। গোড়ার দিকে অস্বাভাবিক কিছুই ঘটল না। কয়েক মাস পর এক সকালে রান্নাঘরের পিছনের কামরাটায় ঢুকে আবিষ্কার করলেন বাড়ির ছাদের হুকে একটা দড়িতে ঝুলছে রাঁধুনি। এর কিছুদিনের মধ্যে মহিলাটি বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
তারপর কিছুদিন খালি পড়ে থাকে বাড়িটা। তারপর আবার টু লেট ঝুলানো হয়। আর একজন মহিলা তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হয়। একরাতে, একটার মত বাজে তখন, একজন কনস্টেবল টহল দিচ্ছেন, এমন সময় বাড়ির ভিতর থেকে সাহায্য চেয়ে চিৎকার শুনলেন। তারপরই দেখলেন হানাবাড়ির নারী তত্ত্বাবধায়ক জানালার কড়িকাঠ যত শক্ত করে সম্ভব আঁকড়ে ধরে আছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ তাকে পিছন থেকে টানছে। কনস্টেবল মহিলাটিকে বললেন ভিতরে গিয়ে হলের দরজা খুলে তাঁকে ঢুকতে দিতে। কিন্তু মহিলাটি আবার কামরাটায় ঢুকতে অস্বীকৃতি জানাল। এবার কনস্টেবল বেশ শক্তি প্রয়োগ করে দরজা খুলে ফেলতে পারলেন। তারপর মহিলাটিকে টানতে টানতে হলরুমে নিয়ে এলেন। কিন্তু তখনই আবিষ্কার করলেন পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে তত্ত্বাবধায়ক।
আবার খালি হলো বাড়িটা। ঝুলল টু-লেট। এবার এক মহিলা ভাড়া নিলেন পাঁচ বছরের জন্য। কিন্তু কয়েক মাস থেকেই তালা লাগিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। বন্ধুরা কেন ওটা ছেড়ে দিলেন জানতে চাইলেন তাঁর কাছে। জবাবে ভদ্রমহিলা বললেন নিজে এখানে থাকা কিংবা অন্য কাউকে এখানে থাকতে দেওয়ার চেয়ে বরং এর পাঁচ বছরের ভাড়া পরিশোধ করতে রাজি আছেন তিনি। তবে কেন এই বাড়ি ছাড়লেন এ সম্পর্কে কিছুই বললেন না।
আমার মনে হয় এরপর এই বাড়িতে উঠি আমি। আঠারো মাস আগে তিন বছরের জন্য এটা লিজ নিই। ইচ্ছা ছিল ভাড়া দিয়ে কিছু রোজগার করব। কিন্তু এখন এই আশা ছেড়ে দিয়েছি। কারণ কেউই এক-দু সপ্তাহর বেশি থাকে না। কেন বাড়িটা ছেড়ে যাচ্ছে এ সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো কারণ দেখায় না কেউই। তবে এটা বলেছেন, আমার দিক থেকে কোনো ধরনের ত্রুটি খুঁজে পাননি তারা। বরং কী কারণে যেন বাড়ির কামরাগুলো পছন্দ করতে পারছেন না। অথচ কমরাগুলো, আপনি চাইলে দেখতে পারেন, বড়সড় আর আলো-বাতাসপূর্ণ। আমি নিজেও ভূতে বিশ্বাস করি না। এখানে কিংবা অন্য কোথাও অস্বাভাবিক কিছু দেখিনি আমি। তবে যদি জানতাম এর হানাবাড়ির দুর্ণাম আছে তবে কখনো এটা ভাড়া করতাম না।
বেয়াড়া আত্মা
পনেরো বছরের ফিলিপ নিজের জন্য এক কাপ কফি এবং দাদি সারাহর জন্য এক কাপ চা বানিয়েছে। দুই হাতে কাপ দুটো নিয়ে দাদির কামরায় ঢুকল সে। আর ঢুকেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা ধূসর-সাদা ধোয়ার মেঘ যেন দাদিকে ঘিরে আছে। আজকের আবহাওয়াটা চমৎকার হলেও কামরার ভিতরে খুব শীত শীত লাগছে। বাইরে রোদ, তবে এই কামরাটা এত ঠাণ্ডা হলো কীভাবে, অবাক হয়ে ভাবল ফিলিপ। পায়ের শব্দ পেয়ে দাদি মুখ তুলে তাকিয়েছেন। অপার্থিব একটা মেঘ চারপাশ থেকে তাঁকে ঘিরে আছে দেখে থ হয়ে গেলেন সারাহও। চট করে উঠে দাঁড়ালেন, তবে ধোঁয়ার মেঘটা ঘিরেই থাকল।
এখানেই শেষ হলো না। বাড়ির সব কিছুর উপর সাদা গুঁড়োর একটা স্তর পুরু হয়ে পড়ে থাকতে দেখল তারা। এমনকী নিজের কফি এবং দাদির চায়ের ওপরও ওই একই গুঁড়ো আবিষ্কার করল ফিলিপ। তার ফুপু মেরি রান্না ঘরে ঢুকলেন আবর্জনাগুলো পরিষ্কার করতে। কিন্তু এখানে মেঝের ওপর প্রচুর পানি জমে আছে। কিন্তু রান্না ঘরের কোনো কল খোলা নেই। এত পানি তবে এল কোথা থেকে, অবাক হয়ে ভাবলেন মেরি। এদিকে মেঝেতে আরো পানি আসছে। কিন্তু মেঝেটাতে কোনো গোলমাল নেই। আশপাশে কোনোখান থেকে পানি চুইয়েও পড়ছে না। পানির কাজ করা লোকেদের খবর দিয়ে আনা হলো। কিন্তু তারাও পানির উৎস খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়ে চলে গেল।
এই ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৬ সালের আগস্টের কোনো এক দিনে। ইংল্যাণ্ডের ইয়র্কশায়ারের পনটারাক্ট নামের এক গ্রামে। খুব পুরানো, ছোট্ট একটি গ্রাম এটি।
এদিন সন্ধ্যা সাতটার দিকে আরো অদ্ভুত সব কাণ্ড-কীর্তি শুরু হল বাড়িতে। ফিলিপ আর তার দাদি টিভি দেখছে তখন। রান্না ঘরে চা পাতা আর চিনি ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেল। তারা যখন অবাক হয়ে দৃশ্যটি দেখছে তখন আপনাআপনি চা পাতার বাক্স মেঝেতে পড়ে গেল। বাড়ির কোনোখান থেকে বিস্ফোরণের চড়া একটা শব্দ শোনা গেল। বিষয়টা কী তদন্ত করতে হলের দিকে দৌড়ে গেল ফিলিপ। সেখানে কাউকেই দেখতে পেল না। তবে আরেকটা আশ্চর্য বিষয় নজর কাড়ল তার। সিঁড়িতে রাখা মাটির টবটা খালি, আর এর গাছটা শূন্যে ভাসছে। সাড়ে নটার দিকে ফিলিপকে নিয়ে তার কামরায় ঢুকলেন দাদি। এখানকার জিনিসপত্র রাখার খোপ, কাপড় সব কিছু যেন মাতালের মত টলছে।
গ্রামের সবচেয়ে নামকরা ওঝা অলিভার ডোনাল্ডকে ডেকে আনা হলো রাত দুটোর দিকে। কিছুই নজরে পড়ল না তার। বললেন, যদি সত্যি কোনো ভূত বাড়িতে আস্তানা গেড়ে থাকে তবে এর কোনো না কোনো চিহ্ন থাকবে, যেমন কিছু ছবি আপনা আপনি ছিঁড়ে যেতে পারে। তার কথা শেষ হতে না হতেই প্রিচার্ড দম্পতির ছবি দেয়াল থেকে মাটিতে পড়ে গেল। ছবিটা ঠিক মাঝখান থেকে দু-ভাগ হয়ে গেল, মনে হয় যেন ধারাল কোনো ছুরি দিয়ে দু-টুকরো করে ফেলা হয়েছে।
মেয়ে ডায়নাসহ মি. ও মিসেস প্রিচার্ড যখন একটা বনভোজন থেকে বাড়িতে ফিরে এলেন তখন বাড়িতে এমন সব কাণ্ড-কীর্তি ঘটে গেছে বিশ্বাসই করতে চাইলেন না তারা। পরের দু-বছর কিছুই ঘটল না। সব কিছু চলল স্বাভাবিক নিয়মেই।
অচেনা এই ভূত বা আত্মা যখন আবার সরব হয়ে উঠল তখন ফিলিপের বয়স সতেরো, আর ডায়নার চোদ্দ। বছরটা বদলেছে, তবে মাসটা সেই আগের মতই আগস্ট।
শুরুতে ফিলিপ আর ডায়নার কামরার জিনিসপত্র মাটিতে পড়তে লাগল। পরের চোটটা গেল মাটির টবগুলোর ওপর দিয়ে। একটার পর একটা ভাঙতে লাগল ওগুলো। বাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্র কোনো কারণ ছাড়াই লাফিয়ে ওপরে উঠে, তারপর নীচে পড়তে লাগল। ডায়নার কামরার জানালাটা আপনা আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ল। রুমে রাখা একটা বুরুশ উড়ে এসে মেয়েটির নাকে লাগল। তবে নাকে একটা দাগও পড়ল না। সবচেয়ে অস্বস্তিকর ব্যাপার হলো অশুভ আত্মাটা সমস্ত ঘটনা ঘটাতে লাগল যখন ডায়না বাড়িতে থাকে তখনই। ঘরের বাতিগুলো আপনা আপনি নিভে যায় মাঝে মাঝেই।
স্থানীয় গির্জার এক পাদ্রীকে ভূতটাকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হলো প্রিচার্ড পরিবারের পক্ষ থেকে। ওই ভদ্রলোক, রেভারেণ্ড ডেভি যখন বাড়িটাতে এলেন এসব ঘটনাকে গাল-গপ্পো বলেই ধরে নিলেন। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই এসব ভুতুড়ে কাজ কারবারে বিশ্বাস না রেখে উপায় থাকল না। একপর্যায়ে পাদ্রী নিজেই ভয় পেয়ে গেলেন। কামরার কোনায় থাকা বাতির স্ট্যাণ্ডটা হঠাৎ বিনা কারণে লাফিয়ে উঠল। ভিতরের একটা কামরা থেকে ধপাস একটা শব্দ হলো। মনে হলো যেন ভারি কোনো টেবিল উল্টে পড়েছে। যখন কামরাটায় ঢুকল সবাই, দেখল কাপ, পিরিচ মেঝেতে পড়ে আছে। তবে একটাও ভাঙেনি।
বাড়িটাকে ভূতের কবল থেকে মুক্ত না করেই চলে যেতে বাধ্য হলেন রেভারেণ্ড ডেভি। এই ঘটনার পর আরো বেশি জ্বালাতন শুরু হলো। সম্ভবত পাদ্রী ডেভির ব্যর্থতা একে আরো উৎসাহী করে তুলেছে। এদিন রাতে ডায়না যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, কামরার বাতি নিভে গেল। সেলাইয়ের একটা মেশিন রাখা ছিল হলরুমে। স্ট্যাণ্ডসহ উড়ে এসে ডায়নার বুকের ওপর বসে গেল ওটা। অনেক চেষ্টা করেও নড়ানো গেল না। তবে ডায়না যন্ত্রটার কোনো ওজন অনুভব করছে না বুকে। কিছু সময় পর ওজনটা টের পেল সে, এবার যন্ত্রটাকে সরানো গেল।
অশুভ এসব কাণ্ড-কারখানা চলল টানা অনেকগুলো দিন। কখনো গোটা বাড়িটা অদ্ভুত একটা সুগন্ধে ভরে যায়, কখনো পাওয়া যায় বদ গন্ধ। প্লেট, পিরিচ চড়া শব্দে মাটিতে পড়ে। গোটা বাড়িতে শোনা যায় ড্রামের দ্রিম দ্রিম শব্দ, আশপাশের লোকেরাও আতঙ্কে তটস্থ হয়ে উঠল। বেশ কয়েকবার ডায়নাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো তার বিছানা থেকে।
১৯৬৮ সালে আশ্চর্য এই ঘটনার খবর এল সংবাদপত্রে। শুধু ইয়র্কশায়ার নয় ইংল্যাণ্ডের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকেরা গ্রামটিতে ছুটে আসতে লাগল, ভূতটার কাজ-কারবার দেখার জম্য। এমনকী তারা ওটার একটা নামও দিয়ে ফেলল, মি, নোবডি। আর প্রিচার্ডরা একে ডাকেন ফ্রেড নামে।
যতদূর বোঝা যায় বাড়ির সব কিছু উল্টে দেওয়া দারুণ পছন্দ মি. ফ্রেডের। জিনিসপত্র শূন্যে ভাসিয়ে ভারি মজা পায় সে। আর সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ডায়না। তাকে জ্বালাতন করতে পারলেই যেন খুশি হয় সবচেয়ে বেশি। তবে মন্দের ভাল, কখনো আঘাত করেনি ওটা ডায়নাকে।
আরেকবার প্রিচার্ডদের গোটা পরিবার একত্র হয়ে ভূতটার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল। এর জবাবে ফ্রেড ওপরের তলা থেকে সমানে জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারতে লাগল নীচে। মনে হলো যেন বৃষ্টির মত জিনিস পড়ছে ওপর থেকে।
আরেকটা ঘটনা ঘটল একজন অতিথির সামনে। ডায়নার ফুপু মউডি পিয়ার্স এসেছিলেন তাদের সঙ্গে থাকতে। তবে ভূত বা আত্মা-ফাত্মায় তার বিশ্বাস নেই। সময়টা শীতকাল, আর ঘরের সবাই একটা আগুনের চারপাশ ঘিরে বসে ছিল। হঠাৎ ঘরের বাতিগুলো নিভে গেল। আগুনের আলোতে সবাই দেখল ফ্রিজের দরজা খুলে গিয়ে দুধ ভর্তি একটা জগ শূন্যে ভেসে ভেসে আসছে। তারপর নিজে নিজে জগটা খালি হলো মিসেস মউডি পিয়ার্সেও মাথায়।
এর একটু পরেই মিসেস পিয়ার্সের হাতের দস্তানা জোড়া অদৃশ্য হলো। যখন ঘুমাতে গেলেন, কোনখান থেকে যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে হাঁজির হলো দস্তানাদুটো। স্তোত্র গাইতে শুরু করলেন মিসেস পিয়ারস। দস্তানাজোড়া এভাবে নড়তে শুরু করল, যেন কোনো অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করছে অদৃশ্য কেউ। কয়েকদিন বাদে যেটা ঘটল এমন ঘটনার নজির আর পাবেন কিনা সন্দেহ। এক সন্ধ্যায় প্রিচার্ডদের গোটা পরিবারটাই বারান্দায় বসে গল্পে-সল্পে মশগুল হয়ে আছেন। এমন সময় বন্ধ দরজা দিয়ে একটা ডিম এভাবে বেরিয়ে এল, যেন বা এখানে কোনো দরজার অস্তিত্বই নেই। শূন্যে কিছুক্ষণ ভেসে থাকার পর মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল ডিমটা। তবে ওটা থেকে এমন একটা গন্ধ বের হতে লাগল, মনে হলো জিনিসটা ডিম না সেন্টের বোতল। উঠে গিয়ে ফ্রিজের দরজা খুললেন মিসেস প্রিচার্ড। একটা ডিম খোয়া গেছে। ফ্রিজ থেকে সবগুলো ডিম বের করে একটা ঝুড়িতে রাখলেন তিনি। তারপর ঝুড়িটার ওপর বসে পড়লেন। তবে এতে কোনো কাজ হলো না। একটু পর আরেকটা ডিম উপস্থিত হলো বারান্দায় এবং মাটিতে পড়ে ভাঙল। আরো একটা ডিম নিখোঁজ হলো ঝুড়ি থেকে। একটার পর একটা ডিম শূণ্যে ভেসে এসে মাটিতে আছড়ে পড়তে লাগল। একসময় খালি হতে হতে ঝুড়িতে আর একটা ডিমও রইল না।
কাছের এক চার্চের পাদ্রী ফাদার হাড়সনের কাছ থেকে পবিত্র পানি আনাল প্রিচার্ডরা। তারপর পুরো বাড়িতে ছিটিয়ে দেওয়া হলো ওই পানি। ভূতটাকে বাড়ি ছাড়া করার জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হলো। কিন্তু এর ফলাফল হিসাবে ছাদ থেকে বৃষ্টির ফোটার মত পানি পড়তে লাগল নীচে। সম্ভবত ভূতটা এটা করে বাড়ির লোকেদের দেখিয়ে দিল পবত্র পানিকে ভয় পায় না সে।
এদিন আরো দুটো ঘটনা ঘটল। ডায়না চুল আঁচড়াচ্ছিল। টেবিল থেকে একটা ড্রয়ার বেরিয়ে এসে কামরার এক কোণের দিকে ছুটে গেল। হলে ঝুলানো ধাতব ক্রসটা উড়ে এসে ডায়নার কোমরে লেগে রইল। মনে হলো যেন ডায়নার কোমরটা একটা চুম্বক, যেটা ক্রসটাকে আকর্ষণ করেছে। ওটাকে ছাড়ানোর জোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো ডায়না। আতংকিত হয়ে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। তবে সে বের হওয়ার আগেই ক্রসটা মাটিতে পড়ে গেল। ক্রসটা কোমরের সঙ্গে আটকে থাকার চিহ্ন অনেক দিন পর্যন্ত থাকল তার শরীরে।
আগস্ট, ১৯৬৬ থেকে মে, ১৯৬৯ পর্যন্ত ভুতুড়ে এসব কাজকারবার হয় প্রিচার্ডদের বাড়িতে। এসময়টায় তাদের প্রতিবেশীরা বাড়িটাকে একটা আলো ঘিরে থাকতে দেখে। কিন্তু আলোটাকে মোটেই সাধারণ আলো মনে হয়নি। এসময়টায় আশপাশের বাড়িগুলোর থেকে বিদ্যুতের বিলও অনেক কম এসেছে তাদের।
আরেকদিনের ঘটনা। ডায়না কিচেনে কফি বানাচ্ছে। হঠাৎ বাতি নিভে গেল। মিসেস প্রিচার্ড একটা টর্চ আনতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এর পরপরই ডায়নার আতংকিত চিৎকার শুনলেন। দৌড়ে এসেই ভয়াবহ একটা দৃশ্য দেখলেন। সিঁড়িতে পড়ে আছে ডায়না। তার সোয়েটার এমনভাবে কেঁটে-ছিঁড়ে গেছে মনে হচ্ছে যেন শক্তিশালী কিছু একটা ওপরতলা থেকে টেনেহিচড়ে নীচে নামিয়েছে তাকে। বাড়ির সবাই দৌড়ে এল তার সাহায্যে। ডায়নার পাশেই সিঁড়িতে হুড়মুড় করে পড়লেন তারা। পরে মেয়েটার গলায় পাওয়া গেল রহস্যমৃয় আঙুলের চিহ্ন।
১৯৬৯-এর মে মাসের শেষ সপ্তাহে শেষবারের মত দেখা দিল, ভূতটা। কিচেনের মেঝেতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সময় একে পরিষ্কার দেখলেন বাড়ির লোকেরা। প্রতিবেশীরা বাড়ির সব জায়গায় রসুনের কোয়া ছড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিল প্রিচার্ডদের। তারা তাই করলেন। এরপর থেকে আর দেখা দেয়নি ভূতটা।
এই অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো নিয়ে অনেক তদন্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন গ্রামটার যেখানটায় এখন প্রিচার্ডদের বাড়ি ১০৯০-১৫৩৯ সাল পর্যন্ত এখানে একটা গির্জা ছিল। ওই গির্জার এক পাদ্রীকে রাজা অষ্টম হেনরির নির্দেশে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। আট বছরের এক বালিকাকে ধর্ষণ করার অপরাধে এই শাস্তি হয় পাদ্রীর। পাদ্রীকে ফাঁসিতে ঝুলানোও হয় এখন যেখানটতে প্রিচার্ডদের বাড়ি এর সীমানার মধ্যে।
তবে পনটারফ্রাক্ট গ্রামের এই ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তি নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তারা কোনোভাবেই হিসাব মিলাতে পারেননি, এত দিন বাদে ১৯৬৬ সালে কেন পাদ্রীর আত্মা হঠাৎ সরর হয়ে উঠল। আর একটা প্রশ্নেরও উত্তর মিলল না। সেটা হলো, ওটা পবিত্র পানিতে ভয় পেল না একটুও, অথচ রসুনের কোয়া ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটা ছেড়ে দিল। কী এর কারণে কে জানে?