-আচ্ছা ভাইয়া! বাবার কবরটা কী এই কবরস্হানে দেওয়াটা খুবই জরুরী?
-মানে কী? এই কবরস্হানটা আবার কী দোষ করলো?
-না মানে ভাইয়া! ঈমাম সাহেবও কিন্তু জানাজার নামাজ পড়িয়ে আর এই কবরস্হান পর্যন্ত আসেনি! এছাড়া এই গ্রামের মুরুব্বী লোকেরাও কিন্তু এই কবরস্হানে বাবাকে দাফন করতে নিষেধ করেছেন। তাদের মতে এটা একটা অভিশপ্ত কবরস্হান এবং এখানে যাদেরই কবর দেওয়া হয় তাদের আত্মা নাকি কোনদিনই শান্তি পায় না! তাদের আত্মাগুলো আবার তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে চায় ! এবং এক পর্যায়ে তাদের পরিবারে ফিরে এসে পরিবারের বাকি সদস্যদেরও খুন করে তার সাথে করে ওপারের দুনিয়ায় নিয়ে যায়!
-তুই কী পাগল হয়ে গেছিস? তুই না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র?! একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে এতোটা মুর্খের মতো কথা বলছিস কী করে তুই?! এরা গ্রামের মানুষ। এরা এখনো নানান কুসংস্কারে বিশ্বাস করেই জীবন যাপন করে। এরা মুর্খ! তাই এরা এইরকম বোকার মতো অদ্ভুত কথা বলছে! এই অশরীরী আত্মা বলে কিছুই হয় না! এইসবই হলো কুসংস্কার! এই কবরস্থানেই বাবার কবর দেওয়া হবে। আর আমাদের কিছুই হবে না! তাছাড়া এই গ্রামে আর কবরস্হান ইবা কই?! যদিও একটা আছে তাও গ্রামের অনেক ভেতরে। শহর থেকে এসে সেখানে গিয়ে বাড়ে বাড়ে কবর জিয়ারত করাটাও অনেক ভেজাল হবে। তার চেয়ে ভালো এখানেই কবরটা দেওয়া।
এছাড়া বাবার শেষ ইচ্ছাও ছিলো তার মৃত্যুর পর যেনো তার কবর শহরে না দিয়ে গ্রামে দেওয়া হয়। তাই তুই এটা নিয়ে আর এতোটা চিন্তা করিস না। বাবার কবর এখানেই দেওয়া হবে!! আমরা যে কয়জন আছি আমরা সবাই মিলেই কবরটা দিতে পারবো। গ্রামের কাউকেই আর লাগবে না! তুই শুধু দাঁড়িয়ে থাক।
কথা হচ্ছিলো আবির এবং আসিফের মধ্যে। তারা দুই ভাই। তারা দুজনেই স্হায়ীভাবে শহরে বাস করে। আবির পরিবারের ছোট ছেলে এবং আসিফ বড় ছেলে। আবির এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র। আর আসিফ লেখাপড়া শেষ করে বর্তমানে একটা ব্যাংকে কাজ করে। আসিফ বিবাহিত এবং তার একটি ৫ বছর বয়সের মেয়েও আছে। তারা শহরে বাবা-মা এবং ২ ভাই, আসিফের স্ত্রী ও মেয়ে মিলে একটা জয়েন ফ্যামিলিতে থাকতো। কিন্তু হঠাৎই তাঁদের বাবা ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা যান। আর তার বাবার অনেক ইচ্ছা ছিলো তাকে যেনো গ্রামের বাড়িতে কবর দেওয়া হয়। তাই আসিফ এবং আবির তার বাবার লাশ নিয়ে এই গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। শহর থেকে আসিফের এক মামা এবং কিছু বন্ধুও তাঁদের সাথে এসেছেন কবর দিতে । আসিফ এবং আবির জন্মের পর থেকেই শহরে বড় হয়েছে। খুব একটা গ্রামে আসা হয়নি তাঁদের। তাই এই গ্রামটা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে না তারা! তাই কবর দিতে এসে নানান গ্রাম্য মানুষের নানান অদ্ভুত রকমের কথার শিকার হচ্ছেন তারা! তবে এসব কিছুকে ভুলে তারা তাদের বাবাকে কবর দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো গ্রাম থেকে কিছুটা দুরের একটা পুরাতন কবরস্হানে। কিন্তু গ্রামের লোকেদের মতে এটা একটা অভিশপ্ত কবরস্হান। এই কবরস্হানে ১২ বছর ধরে কাউকে
কবর দেওয়া হয় না। এইখানে যাদেরই কবর দেওয়া হয়। তাদের আত্মা আর কোনদিন মুক্তি পায় না। তাদের আত্মা অভিশপ্ত হয়ে যায় এবং তাঁদের পরিবারের মানুষের কাছে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু তাঁদের পরিবার আর তাদের স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করে না এবং তাই এই আত্মাগুলো সেই পরিবারের সদস্যদের খুন করে তার সাথে করে ওপারের দুনিয়ায় নিয়ে যায়। গ্রামের লোকেরা বলেন এই রকম ঘটনা না কী পুর্বেও অনেকবার ঘটেছে। আবির গ্রামের লোকেদের কথা শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। কিন্ত আসিফ কিছুতেই তাঁদের কথা বিশ্বাস করে না। কারণ এই কথাগুলোর সাথে বাস্তবতার সে কোন মিলই খুঁজে পায় না। গ্রামে থাকা তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরাও বাড়েবাড়ে তাঁদের নিষেধ করছিলো যে এই কবর স্হানে যাতে তাঁদের বাবাকে তারা কবর না দেয়! কিন্তু আসিফ তাঁদের কারো কথায়ই কান দেয় না। সে জেদ করেই বসে যে এই কবরস্হানেই তার বাবাকে কবর দিবে সে। এছাড়া শহর থেকে এই
কবরস্হানে আসাটাও সহজ! তাই কবর দেওয়া নিয়ে আসিফের সাথে নানান তর্কে জড়িয়ে তার গ্রামের কোন আত্মীয় স্বজনই তার বাবার দাফন দিতে আসেনি এখানে। এখন সাড়ে তিন হাত গর্তের সামনে শুধু দাঁড়িয়ে আছে আসিফ, আবির, তাদের মামা, আসিফের ৪ জন শহরের বন্ধু এবং ২ জন লোক যারা এই কবরটা খুড়তে এসেছে। আর একটা খাটিয়া রয়েছে যেখানে তাদের বাবার লাশ রয়েছে। লাশটার দাফনের জন্য সবকিছুই প্রায় জোগাড় করা হয়েছে। এরপর যেই তারা দাফনের কাজ শুরু করবে ঠিক তখনি কবর স্হানে একটা পাগলের প্রবেশ। পাগল লোকটাকে দেখে সবাই প্রথমে বেশ ভয় পেয়ে যায়!! পাগলটার পরণে ছিলো শুধু একটা ছ্যাড়া লুঙ্গী আর একটা ছ্যাড়া গেন্জী! পাগল লোকটা দৌড়াতে দৌড়াতে তাঁদের সামনে এসে হাঁজির হলো। এরপর অনেকটা কাঁদতে কাঁদতেই তাঁদেরকে বিনয় করে বলতে লাগলো:
-তোমরা কি মরতে এখানে এসেছো?! তোমরা কি পাগল হয়ে গেছো?! তোমাদের কী নিজেদের জীবনের প্রতি কোনো মায়া নেই?! তোমরা চলে যাও এখান থেকে! এখানে কাওকে কবর দিয়ো না। তাহলে তোমাদের পরিবারের আর কেউ বেঁচে থাকবে না! ও তোমাদের কাউকে বাঁচতে দিবে না ! চলে যাও এখান থেকে! নিজে থেকে অভিশাপকে আহ্বান করো না!
পাগল লোকটার কথা শুনে আবির এবং সবাই বেশ ভয় পেয়ে যায়। এইদিকে আসিফ উল্টো অনেক বেশি রেগে যায়! সে পাগলটাকে ধাক্কা মারতে মারতে কবরস্হান থেকে বের করে দেয়। আর বলে:
-এতোটাই কী খারাপ পরিস্হিতীতে পড়েছি নাকি যে শেষ পর্যন্ত একটা পাগলের উপদেশ আমাদের শুনতে হবে?! আসলেই এইগুলো পাগলের প্রলাপ! চলো তাড়াতাড়ি কবরটা দিয়ে দেই! আকাশের অবস্হা বেশি ভালো না! মনে হয় বৃষ্টি আসবে!
এরপরেই তারা সেই কবরস্হানে তাঁদের বাবার কবর দিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই কবর দিয়ে দেয় দেয় তারা। কিন্তু কবর দেওয়ার সময় আসিফ এক অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করে। যা আসিফ এর আগে কখনো করেনি! আসিফ যখন কবরে নেমে তার বাবার লাশটা মাটিতে রাখে তখন এক অন্যরকম গায়ে শিহরণ আনা অদ্ভুত অনুভূতি তাকে গ্রাস করতে থাকে! কবরে লাশটা রাখার পর যেই লাশটার মুখের উপর থেকে কাফনের
কাপড়টা সড়ায় আসিফ , সে তার বাবার লাশের মুখটা দেখেই অনেকটা ভয় পেয়ে যায়। সে ভাবে বাবার লাশের চেহারাটা তো এতক্ষন এতোটা ভয়ংকর লাগে নি!! স্বাভাবিক একটা লাশের মতোই লেগেছিলো! তাহলে কবরের ভেতর লাশটা রাখতেই এতোটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো কেনো ?! সে এর আগেও অনেক আত্মীয়ের লাশই কবরে রেখেছে। কিন্তু এতোটা ভয়ংকর অনুভূতি তার মনে কখনো জন্ম নেয় নি। কবরে দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ এই বিষয়টা নিয়ে ভাবার পর আসিফ ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করে। সে ভাবলো গ্রামের লোকগুলোর মুখে কবরস্থানটা সম্পর্কে এইরোকম অদ্ভুত কথা শুনার পর হয়তো তার মনেও উল্টা পাল্টা চিন্তা এসে বাসা বাঁধছে!! আসলে সব ঘটনাই হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই ঘটছে! এরপর দ্রুত তারা দাফনের কাজটা শেষ করে! কবর দেওয়ার পর
তারা নিজেরাই মোনাজাত করে আবার তাঁদের শহরের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এইদিকে কবর দেওয়ার পর সবাই স্বাভাবিক ভাবেই কবরস্হান থেকে বেরিয়ে আসলেও আবিরের মনে অনেকটা ভয় কাজ করছিলো। সে কবরস্হান থেকে বের হওয়ার পথে বাড়ে বাড়ে শুধু তার বাবার কবরের দিকে ফিরে ফিরে তাঁকাচ্ছিলো। তার কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো তাকে সেখান থেকে কেউ ডাকছে! সে বেশ ভয় পেয়ে যায়! এরপর সে আর পিছনে ফিরে তাঁকালো না। সবার সাথে সোজা কবরস্হান থেকে বেরিয়ে আসলো। এরপর হঠাৎ তার মনে হলো তাকে কবরস্হানের ভেতর থেকে কেউ ডেকে বলছে:-
-আমায় এই অভিশাপে একা ফেলে রেখে চলে যাস না বাবা! আমায় সাথে করে নিয়ে যা! আমি আবার তোদের সাথে একত্রে থাকতে চাঁই!
আবির কন্ঠটা শুনেই আৎকে পেছনে ফিরে তাঁকালো! কিন্তু সে কাউকেই দেখতে পেলোনো! সে ভাবলো এটা হয়তো তার মনের ভুল ছিলো। সে আসলে এই অদ্ভুত বিষয়টা নিয়ে একটু বেশিই ভাবছে! তাই হয়তো তার মনে এইসব উল্টাপাল্টা চিন্তা ভেসে আসছে! এরপর আবিরও আর কিছু না ভেবে সবার সাথেই শহরে চলে আসলো।
শহরে আসার পর তাঁদের জীবনটা আবার আগের সেই স্বাভাবিক জীবনের মতোই চলতে থাকলো। প্রথমে বেশ কিছুদিন তারা বাবা হারানোর শোকে থাকলেও পরে শহরের ব্যাস্ততায় তারা তাঁদের বাবার কথা কিছুটা ভুলতে সক্ষম হয়! আর গ্রামের লোকদের বলা সেই অদ্ভুত কথা গুলোও তারা আর কেউ মনে রাখে না। শহরের আধুনিক জীবনের কাছে এই অভিশপ্ত কথাগুলো যেনো বড়ই হাস্যকর!
আসিফ, আবির এবং তাঁদের পরিবারের সকল সদস্যেরা স্বাভাবিক ভাবেই দিন কাটাচ্ছিলো। আসিফ রোজ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ব্যাংকে কাজ করতো। আবির রোজ সকাল সকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতো, বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতো, সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে পড়াশোনা করতো। এইভাবে তার দিন কেটে যাচ্ছিলো। আর তাঁদের মা, আসিফের স্ত্রী শম্মী এবং আসিফের ৫ বছরের মেয়ে আনিকা প্রায় সারাদিনই বাঁড়িতে থাকতো। এইভাবেই চলে যাচ্ছিলো তাঁদের দীর্ঘ দিন।
কিন্তু তাদের স্বাভাবিক জীবন আর বেশিদিন স্থায়ী হলো না! ধীরে ধীরে যেনো তাদের জীবনে অস্বাভাবিকতার আবির্ভাব ঘটতে লাগলো!
একদিন দুপুর বেলা আসিফের স্ত্রী শম্মী তার মেয়ে আনিকাকে ঘুম পাড়িয়ে ওয়াশরুমে গোসল করতে গিয়েছিলো। হঠাৎ ওয়াশরুমের ভেতরে থেকেই শম্মী শুনতে পেলো যে, ঘরের ভেতর আনিকা কারো সাথে কথা বলছে আর খিলখিল করে হাসছে! শম্মী প্রথমে বেশ অবাক হলো আর ভাবতে লাগলো! এই দুপুর বেলা আনিকা কার সাথে কথা বলছে?! মা তো পাশের ঘরে ঘুমিয়ে রয়েছে! এছাড়া বাড়িতেতো আর কেউ নেই! আসিফ এবং আবিরও তো বাড়ির বাহিরে আছে।
তাহলে আনিকা কার সাথে কথা বলছে ?! এরপর শম্মী দ্রুত গোসল শেষ করে আনিকার ঘরে দেখতে যায় যে, আনিকা কার সাথে কথা বলছিলো?! কিন্তু ঘরে গিয়ে দেখে আনিকা চুপচাপ ঘুমিয়ে রয়েছে! এইদিকে অন্য ঘরে আসিফের মাও ঘুমিয়ে রয়েছে!! শম্মী পুরো অবাক হয়ে যায়!! কারণ সে একটু আগেও ওয়াশরুম থেকে স্পষ্ট আনিকার খিলখিল হাসির শব্দ শুনেছে! এরপর কিছুক্ষন চুপচাপ এটা নিয়ে ভাবার পর শম্মীর মনে হলো, এটা হয়তো তার মনের ভুল ছিলো! আনিকাতো এখনো ঘুম থেকেই উঠেনি! তাহলে কথা বলবে কিভাবে?! আর হাসবেই বা কখন?! তাই সে এই ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নেয়।
কিন্তু এই ব্যাপারটা আর বেশিদিন স্বাভাবিক থাকে না! কিছুদিন পর এই ব্যাপারটাই শম্মীর রাতের ঘুম কেরে নেয়! কারণ এই ঘটনার পর থেকে আনিকা বেশ অস্বাভাবিক হয়ে যায়! শম্মী প্রায়ই লক্ষ করে যে আনিকা একা একা কারো সাথে কথা বলতে থাকে। আনিকা নিজে নিজে একা একাই কথা বলতে থাকে আর নিজেই হাসতে থাকে। আনিকা এমন ভাবে কথা বলে যেনো মনে হয় তার পাশে অন্য একটা লোক বসে রয়েছে! আর সে আনিকার সাথে গল্প করছে!! যদিও শম্মী আনিকার পাশে কাউকেই দেখতে পায় না! শম্মী এবং আনিকা রাতে এক সাথেই ঘুমায়। মাঝরাতে যেই শম্মীর ঘুম ভাঙে সে লক্ষ করে আনিকা কারো সাথে একা একাই কথা বলছে!! শম্মীকে ঘুম থেকে উঠতে দেখেই আনিকা চুপ হয়ে যায়। আর চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর অভিনয় করে। একটা ৫ বছর বয়সের মেয়ের হঠাৎ এইরকম অদ্ভুত ব্যবহার করাটা মোটেও কোন স্বাভাবিক ঘটনা না। আনিকার এই রকম অদ্ভুত ব্যবহার একমাত্র
শম্মীই লক্ষ করে। বাড়ির আর কারো চোখে এই অদ্ভুত ব্যবহার ধরা পড়ে না। শম্মী প্রথম দিকে এই ঘটনাটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলো। তাই বাড়ির অন্য কাউকে এসম্পর্কে কিছুই বলে না ! কিন্তু ধীরে ধীরে বিষয়টা আরো জটিল হয়ে যাচ্ছিলো। তাই বাধ্য হয়েই আসিফকে এই ঘটনাটা খুলে বলে শম্মী। আসিফ প্রথমে শুনে ঘটনাটা বিশ্বাস করে না! সে ভাবে শম্মীর হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে! নাহলে একটা ৫ বছর বয়সের মেয়ে কি কখনো এই রকম অদ্ভুত ব্যবহার করতে পারে?! আসিফ প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পরে ছুটির দিন গুলোতে আনিকার দিকে লক্ষ রাখতে থাকে। এরপর শম্মীর মতো আসিফও লক্ষ করে যে আনিকা এখন একা একা থাকতে বেশি পছন্দ করে। সে কখনো ছাদে, কখনো নিজের ঘরে শুধু একা একা বসে নিজে নিজেই কথা বলতে থাকে! সে এমন ভাবে কথা বলে যে, মনে হয় তার পাশে অন্য একজন লোক রয়েছে এবং সে তার সাথে গল্প করছে!! এবার বিষয়টা নিয়ে আসিফও শম্মীর মতো বেশ চিন্তায় পড়ে যায়! আসিফ বা শম্মী যখনি আনিকাকে এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন করে, আনিকা সরাসরি এই বিষয়টাকে অস্বীকার করে। সে বলে , তার একা থাকতে ভালো লাগে কিন্তু সে কারো সাথে কথা বলে না!
এরপরে আসিফ এবং শম্মী আরো বেশি চিন্তায় পড়ে যায়! আনিকার এই রকম গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলাটা তাদের আরো বেশি
চিন্তায় ফেলে দেয়। কারণ আনিকা মোটেও এই ধরনের মেয়ে ছিলো না! আর ও একটা বাচ্চা মেয়ে! তাই তারা ভাবে এই বাচ্চা মেয়েটা হঠাৎ এতোটা বদলে গেলো কিভাবে?! এরপর তারা ভাবে আনিকা তার দাদাকে অনেক বেশি পছন্দ করতো। তাই হঠাৎ তার দাদার মৃত্যুর কারণে হয়তো আনিকা মানসিক ভাবে অসুস্হ্য হয়ে পড়ছে! তাই আনিকাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে শম্মী আর আসিফ তাকে একটা শিশু বিশেসজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার অনেক্ষন আনিকার সাথে নানান বিষয় নিয়ে কথা বলে। এরপর আসিফ এবং শম্মীকে জানায় যে, আনিকা পুরোপুরি সুস্হ্য রয়েছে। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা খেলার ছলে এমন একটু-আকটু অভিনয় আর দুষ্টুমী করেই থাকে। যেহেতু তাদের বাড়িতে আনিকার সাথে খেলার মতো সমবয়সী কেউ নেই! তাই হয়তো আনিকা একাকীত্ব দূর করার জন্য এমনটা করে!! এটা কয়েক মাস পর এমনিতেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এছাড়াও ডাক্তার, আনিকার দিকে বিশেষ যত্ন নেওয়ারো পরামর্শ দেয় তাদের। এরপর তারা কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। এরপরেও আনিকার এইরকম অস্বাভাবিক আর অদ্ভুত ব্যবহার একটুও কমে না। তবে শম্মী এবং আসিফ এই বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিতে থাকে।
তারা ভাবে হয়তো একাকিত্বের জন্য সে এমনটা করছে!! এছাড়াও আনিকাকে একটু বেশি করে সময় দেওয়ার চেষ্টা করে তারা!!
এইভাবে দেখতে দেখতে আরো বেশ কিছুদিন চলে গেলো। কিন্তু এরপরেই সবচেয়ে বড় অঘটনটা ঘটলো। সেদিন ছিলো শুক্রবার। আসিফ এবং আবির দুজনেরই ছুটির দিন। তারা দুজনে মিলে সকাল ১০ টার দিকে বাজারে চলে গেলো ঘরের টুকিটাকি বাজার করতে। বাজার করতে করতে তাঁদের প্রায় দুপুর ১২টা বেজে যায়। তারা বাজার করা শেষে যেই বাড়ির উদ্দেশ্যে
রওনা দিবে। ঠিক সেই সময়েই আবিরের মোবাইলে একটা কল বেজে উঠলো। আবির পকেট থেকে মোবাইলটা বের করতেই দেখলো তার মা বাড়ি থেকে কল দিয়েছে। এরপর আবির কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে তাঁর মা কাঁদতে কাঁদতে আবিরকে বলতে লাগলো:-
-আবির! বাবা! তুই তাঁড়াতাড়ি তোর ভাইয়াকে নিয়ে বাড়িতে চলে আয়! বাড়িতে বড় বিপদ ঘটে গেছে। আনিকা মারা গেছে! তোরা তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আয়!
আবির এই কথাটা শুনে পুরোই আৎকে উঠলো!! সে কল ধরার পর মায়ের কাছ থেকে এই রকম কোন কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না! সে কথাটা শুনে প্রায় পাগল হয়ে গেলো!! সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না আনিকা কি করে মারা যাবে?! অনিকাকেতো একটু আগেই মা এবং দাদির সাথে তার বাসায় রেখে এসেছিলো তারা!! এরপর আবির তার ভাই আসিফকে এসম্পর্কে কিছু না বলেই দুজনে দ্রুত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
এরপর আবির কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে তাঁর মা কাঁদতে কাঁদতে আবিরকে বলতে লাগলো:-
-আবির! বাবা! তুই তাঁড়াতাড়ি তোর ভাইয়াকে নিয়ে বাড়িতে চলে আয়! বাড়িতে বড় বিপদ ঘটে গেছে। আনিকা মারা গেছে! তোরা তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আয়!
আবির এই কথাটা শুনে পুরোই আৎকে উঠলো!! সে কল ধরার পর মায়ের কাছ থেকে এই রকম কোন কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না! সে কথাটা শুনে প্রায় পাগল হয়ে গেলো!! সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না আনিকা কি করে মারা যাবে?! অনিকাকেতো একটু আগেই মা এবং দাদির সাথে তার বাসায় রেখে এসেছিলো তারা!! এরপর আবির তার ভাই আসিফকে এসম্পর্কে কিছু না বলেই দুজনে দ্রুত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
এর কিছুক্ষণ পরেই তারা বাড়িতে পৌঁছে গেলো! বাড়িতে পৌছেই তাদের বাড়িতে এতোটা ভীর দেখে আসিফ এবং আবির পুরো আৎকে উঠে! এরপর আসিফ এবং আবির দুজনেই দ্রুত ছুটে বাড়ির ভেতরে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে ভীরটা ক্রমসো বাড়ির পেছন পর্যন্ত গিয়েছে। তাদের বাড়ির পেছনে একটা নতুন বাড়ির কাজ চলছিলো কয়েক দিন ধরেই! সেখানে গিয়ে আবির এবং আসিফ যা দেখলো তা দেখার জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না! তারা দেখলো বাড়ির পেছনের নতুন বিল্ডিং এর পিলারের রডের উপর আনিকা উল্টে পড়ে রয়েছে। বিল্ডিংয়ের সুচালো রড আনিকার শরীর, হৃদপিন্ড ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে! রড পুরো তার বুকের ভেতর দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে আছে। আনিকার পুরো শরীর এবং বিল্ডিং এর পিলার পুরো আনিকার রক্তে ভিজে গেছে! আসিফ এবং আবির দৃশ্যটা দেখে আৎকে মাটিতে বসে পড়লো। তাদের মস্তিস্ক আর শরীর যেনো অবশ হয়ে যেতে লাগলো!!
অন্যদিকে কারো বুঝতে বাকি রইলো না যে আনিকা তাঁদের বাড়ির ছাদ থেকে এই নতুন বিল্ডিং এর রডের উপর পড়ে গিয়েছিলো এবং এভাবেই সে মারা যায়! খুব খারাপ ভাবে রডে আটকে পড়ায় কেউ তাঁকে এখান থেকে উঠাতে পারেনি এবং অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে সে মারা যায়! কিন্তু আনিকা ছাদ থেকে পড়লো কিভাবে?! সবাই ভাবে ছাদে উঠে হয়তো পা পিছলে এখানে পড়ে গেছে সে। তাই সবাই এটাকে সাধারণ একটা দুর্ঘটনাই ভাবে। এরপর পুলিশ আসে এবং আনিকার লাশকে সেই পিলারের রড থেকে বের করেন! এতোক্ষনে সবাই ই বুঝতে পেরে গিয়েছিলো যে আনিকা মারা গেছে। আনিকার মা এইভাবে তার মেয়েকে রডের উপর পড়ে থাকতে দেখে সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। আনিকার বাবাও নির্বাক দর্শকের মতো তাঁকিয়ে তাঁকিয়ে শুধু তার মেয়ের লাশটা দেখছিলো। এইদিকে আবিরো যেনো তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না! সে কল্পনাও করতে পারেনি যে তার জীবনে এমন একটা দিন আসতে পারে! এইদিকে তাঁদের মাও এই দৃশ্যটা দেখে অনেক অসুস্হ্য হয়ে পড়েন!
এই একদিনেই যেনো তাঁদের জীবনটা পুরো পাল্টে গেলো। কয়েকদিন আগে তাঁদের বাবার মৃত্যুর শোক ভুলতে না ভুলতেই এখন পরিবারের আরেকটা সদস্যের অকাল মৃত্যুর সাক্ষী হলো তারা। এরপর আনিকার দাফন শহরের একটা কবরস্হানে শেষ করেন তারা! আসিফ , আবির সহ তাদের পুরো পরিবার যেনো ভেঙে পড়লো! তাঁদের বেঁচে থাকার কারণটাই যেনো তাঁদের চোখের সামনে মারা গেলো! আর তারা কিছুই করতে পারলো না! তারা শুধু ভাবছিলো। ইশ! যদি আরেকটু সতর্ক থাকতাম আমরা। তাহলে হয়তো আজকের দিনটা আমাদের দেখতে হতো না!
তারা কিছুতেই আনিকার কথা ভুলতে পারছিলো না! আর শম্মীতো, আনিকার জন্য প্রায় পাগলই হয়ে গিয়েছিলো! এরপর দেখতে দেখতে প্রায় এক সপ্তাহের মতো কেটে গেলো। আসিফ আবারো অফিসে যাওয়া শুরু করলো, আবির আবার লেখাপড়ায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। আর শম্মী নানান সাংসারিক কাজে ব্যাস্ত থাকার চেষ্টা করে! যদিও কেউই এখনো পর্যন্ত আনিকাকে ভুলতে পারে নি। আর ভুলাও সম্ভব না!
আনিকাকে ভুলতে না ভুলতেই তাদের পরিবারে আরো একটা নতুন বিপদ এসে হাজির হলো! এরই মধ্যে শম্মীর চোখে হঠাৎ আরো একটা অদ্ভুত ঘটনা ধরা পড়লো। এবার শম্মী আনিকার করা আচরণ গুলোর প্রতিফলন লক্ষ করে তার শাশুড়ী অর্থাৎ আসিফের মায়ের ভেতরে। আসিফের মাও কেমন যেনো অদ্ভুত আচরণ করা শুরু করে। শম্মী যখন তার পাশে থাকে তখন সে চুপচাপ বসে থাকে। আর যেই শম্মী তার থেকে একটু দুরে অন্য ঘরে যায়! ঠিক তখনি সে একা একা নিজে নিজেই কথা বলতে থাকে! সেও এমন ভাবে কথা বলে যে মনে হয় তার পাশে কেউ বসে আছে এবং তার সাথে সে গল্প করছে! যদিও শম্মী কাউকেই দেখতে পায় না! শম্মী এই বিষয়টা নিয়েও বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। আনিকার সাথে তার শাশুড়ি মায়ের ব্যবহার কেমন যেনো মিল পায় সে! এরপর সে একদিন সাহস করেই আসিফের মায়ের কাছে জানতে চায় যে, সে একা একা কার সাথে কথা বলে?!
কিন্তু আসিফের মাও অনেকটা আনিকার মতো করেই উত্তর দেয়:-
-আমার একা থাকতে ভালো লাগে। কিন্তু আমি কারো সাথে কথা বলিনা!
এই উত্তর শুনে শম্মী আরো বেশি অবাক হয়ে যায় আর চিন্তায় পড়ে যায়! কারণ ঠিক একই রকম উত্তর সে আনিকার কাছ থেকেও পেয়েছিলো। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিলো না যে তাদের পরিবারের সাথে এসব কী হচ্ছে?! আর কেনো হচ্ছে?! ধীরে ধীরে সবাই এতোটা অদ্ভুত ব্যবহার করছে ইবা কেনো?! প্রথমে আনিকা এখন মা! সে এসব ভাবতে ভাবতে প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলো। এইদিকে একের পর এক শোকে আবির এবং আসিফের মনও তেমন ভালো ছিলো না! তাই শম্মী নতুন করে আর তাদের কোন চিন্তায় ফেলতে চায়নি। তাই এই বিষয়টা তাদের থেকে লুকিয়ে যায় সে! আসিফ বা আবির কাউকেই এ সম্পর্কে কিছুই বলে না শম্মী। এইভাবে আরো বেশ কিছুদিন কেটে যায়। শম্মী ধীরে ধীরে ঘটনাটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। এবারো সে ভাবে, তার শাশুড়ি মা হয়তো হঠাৎ আনিকার এই দুর্ঘটনা দেখে মানসিক ভাবে অসুস্হ্য হয়ে পড়েছেন। এরপরে আর এই বিষয়টা নিয়ে বেশিকিছু ভাবে না সে।
কিন্তু এই স্বাভাবিক বিষয়টা আর বেশিদিন স্বাভাবিক থাকে না! একদিন এই বিষয়টাই তাকে অনেক বেশি অবাক করে দেয়। সেদিন আসিফের মাকে শম্মী রাতে খাবার টেবিলে ডাকতে তার ঘরের দিকে যায়। শম্মী যেই তার শাশুড়ী মায়ের ঘরের সামনে গেলো সে দেখলো দরজাটা ভালো করে চাপিয়ে দেওয়া রয়েছে। আর ভেতর থেকে তার শাশুড়ীর কথা বলার শব্দ ভেসে আসছে। কিন্তু এবার সে একা একা কথা বলছিলো না। এবার আসিফের মায়ের কন্ঠের সাথে আরো একটা কন্ঠ শম্মীর কানে ভেসে আসলো!! কন্ঠটা একটা বৃদ্ধ লোকের। কন্ঠটা শুনে শম্মীর বুঝতে বাকি রইলো না যে, আরে এটাতো আসিফের বাবার কন্ঠ! শম্মী পুরো আৎকে উঠে! আসিফের বাবাতো মারা গেছে! তাহলে আসিফের মা তার সাথে কথা বলছে কী করে?! এরপর শম্মী অবাক হয়ে দ্রুত দরজাটা ধাক্কা মেরে ভেতরে যায় এটা দেখতে যে ভেতরে আসলে কে আছে?! কার সাথে আসিফের মা কথা বলছেন?! কিন্তু এরপর শম্মী যা দেখলো তা দেখে শম্মী আরো বেশি অবাক হয়ে গেলো! কারণ ঘরের ভেতরে শুধু আসিফের মা একা চুপচাপ বসে রয়েছে! আর কেউ নেই! কিন্তু একটু আগেও তো বাহির থেকে সে ঘরের ভেতরে স্পষ্ট আসিফের বাবার কন্ঠ শুনেছে!
শম্মী বেশ অবাক হয়ে ঘরের এদিক,ওদিক আসিফের বাবাকে খুঁজতে থাকে! কিন্তু আসিফের মা ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পায় না সে! এরপর শম্মী অবাক হয়ে আসিফের মাকে প্রশ্ন করে:
-মা! আপনি কার সাথে কথা বলছিলেন?
শম্মীর কথাটা শুনে আসিফের মা কিছুটা অবাক হয়ে উত্তর দেয়:
-আমি আবার কার সাথে কথা বলবো?! আমিতো চুপচাপ এখানেই বসে ছিলাম!
শম্মী এইরকম উত্তর শুনে আর কিছুই বলতে পারেনি আসিফের মাকে। শম্মী শুধু ভাবছিলো, তাহলে কী সে ভুল কিছু শুনেছে?! এরপর ভাবলো হয়তো ভুল কিছুই শুনেছে! নাহলে, মৃত মানুষ কী আবার কখনো ফিরে এসে কারো সাথে কথা বলতে পারে নাকি?!
এরপর শম্মী কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে তার শাশুড়ী মাকে নিয়ে খাবার টেবিলে যায় রাতের খাবার খেতে! আসিফ, আবির,শম্মী এবং তাঁদের মা ৪ জন মিলে একসাথে খাবার টেবিলে রাতের খাবার খাওয়া শুরু করে। খাবার খাওয়ার মাঝখানেই আসিফের মা হঠাৎ খুব রেগে খাবারের প্লেটটা ছুরে মেঝেতে ফেলে দেয়! এটা দেখে সবাই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এরপর আসিফের মা পাগলের মতো হাসতে থাকে। সে হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলে আবার কাঁদতে কাঁদতে হাঁসতে থাকে! তাকে হঠাৎ এইরকম অদ্ভুত ব্যবহার করতে দেখে সবাই ভয় পেয়ে যায়! তারা কিছুতেই বুঝতে পারে না যে মা আবার হঠাৎ এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছেন কেনো?! আসিফ এবং আবির তাকে ধরতে যায় কিন্তু তাদের মা তাদের প্রচুর শক্তিতে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয় !
আসিফ, আবির কেউই বুঝতে পারে না যে তাদের সাথে এটা কী হচ্ছে?! তাদের মা হঠাৎ এতোটা অদ্ভুত ব্যবহার করছে কেনো তাদের সাথে?! এরপর তাঁদের মা হঠাৎ চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, “কেউ বাঁচবে না! কারো বাঁচা উচিত হবে না! তোরাও বাঁচবি না। ও সবাইকে ডাকছে! সবাই তার কাছে যাবে!” এতোটুকু কথা বলেই পাগলের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে তাদের মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যায়। আবির আর আসিফ কেউই বুঝতে পারে না তাদের মা হঠাৎ করে পাগল হয়ে গেলো কিভাবে?! আর বাড়ির বাহিরে কোথায় যাচ্ছে সে ?! এরপর তার পিছু পিছু আবির, আসিফ,শম্মী ৩ জনেই ছুটতে থাকে। যতক্ষনে তারা বাড়ির বাহিরে পৌছালো! দেখলো বাড়ির সামনের রাস্তায় একটা রক্তাক্ত দেহ পড়ে রয়েছে! আবির আর আসিফ দেখেই বুঝতে পারলো যে এটা তাঁদের মায়ের দেহ। তাদের মা দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ একটা ট্রাকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। ট্রাক ড্রাইভারটা হঠাৎ তাকে দেখে কিছু বুঝে গাড়িটা থামাতে থামাতেই তাদের মা গাড়ির চাকার নিচে পিশে গিয়েছিলো। আসিফ আর আবির তাদের মায়ের রক্তাক্ত দেহ এইভাবে দেখে পুরো আৎকে উঠে!! এরপর আশেপাশের লোক ও আবির, আসিফ মিলে তাঁদের মাকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যায়। কিন্তু যতক্ষণে তারা হাসপাতালে পৌছায় তার আগেই তাঁদের মা পৃথিবী ত্যাগ করে ওপারের দুনিয়ায় পাড়ি জমায়!
ডাক্তার তাঁদের মাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপরে আবির, আসিফ, শম্মী ৩ জনেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাদের পরিবারে ৩য় শোক নেমে আসে। আবার তাঁদের বাড়িতে আত্মীয় স্বজনেরা এসে ভীর জমায়। তাদের মায়ের লাশেকেও শহরেরই একটি কবরস্হানেই দাফন দেওয়া হয়। সবাই তাঁদের মায়ের মৃত্যুটাকে একটা সাধারণ সড়ক দুর্ঘটনাই ভাবে। কিন্তু আবির, আসিফ আর শম্মীতো জানে যে এটা কোন সাধারণ দুর্ঘটনা ছিলো না। তাদের মায়ের সাথে নিশ্চই অস্বাভাবিক ভাবে অদ্ভুত কিছু ঘটেছিলো তাই সে আত্মহত্যা করেছেন ! কিন্তু কী ঘটে থাকতে পারে?! এটাই কারো মাথায় আসছিলো না!
এছাড়া তাদের এলাকার মানুষ এবং তাঁদের শহরের আত্মীয় স্বজনেরাও এই বিষয়টা নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো। এক সাথে পরিবারের এতোগুলো সদস্যের ধীরে ধীরে মৃত্যু তাদের কাছেও বেশ অস্বাভাবিক লাগছিলো! কিন্তু যখন পরিবারের কোন সদস্যই এর কোন সমাধান করতে পারছে না বা উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না! তখন এরা আর কী করবে?!
এরপরে দেখতে দেখতে আরো বেশ কিছুদিন কেটে যায়। আবির,আসিফ আর শম্মী শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকলেও তাঁদের আত্মীক মৃত্যু অনেক আগেই ঘটে গিয়েছিলো। হঠাৎ কাছের মানুষগুলোকে হারিয়ে তারা সবাই মানসিক ভাবে অনেক অসুস্হ্য হয়ে পড়েন। এই ঘটনার পর শম্মী আসিফ এবং আবিরকে আগের ঘটা সব ঘটনা খুলে বলেন। শম্মীর দেখা সেই অদ্ভুত ঘটনাগুলোও সে তাঁদের জানায়। শম্মী বলে যে, মাও আনিকার মতো বেশ কিছুদিন ধরে খুব একা একা থাকতো এবং একা একাই নিজের সাথে কথা বলে যেতো! এই কথা শুনে আসিফ এবং আবির কিছুটা আন্দাজ করতে পারে যে, এই দুই জনের মৃত্যূর মধ্যে নিশ্চই কোন সম্পর্ক রয়েছে! কিন্তু কী সম্পর্ক থাকতে পারে এটা তারা কেউই আন্দাজ করতে পারে না!
তাদের জীবন যেনো ধীরে ধীরে আরো বেশি অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছিলো! তাঁদের সাথে অদ্ভুত ঘটনা ঘটা যেনো আর বন্ধই হচ্ছিলো না! এবার তাঁদের সাথে সবচেয়ে বড় অঘটন টা ঘটে গেলো!
সেদিন আসিফ একটা জরুরী কাজে ব্যাংকে যায়। এইদিকে আবিরও বাড়িতে ছিলো না। সে তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। শম্মীকে বাড়িতে একা রেখেই তারা বাড়ির বাহিরে গিয়েছিলো। আসিফ ব্যাংকে জরুরী কাজ করছিলো ঠিক সেই সময়েই তার মোবাইলে তার মামার নাম্বার থেকে একটা কল আসলো। আসিফ কলটা ধরে স্বাভাবিক ভাবেই বললো:
-হ্যালো! মামা?
এরপর তার মামা তাকে যা বললো তা শোনার জন্য আসিফ মোটেও প্রস্তুত ছিলো না! তার মামা বললো:
-তুই কোথায় রে বাবা?! তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আয়! একটা বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে! তোদের পুরো বাড়িতে আগুন লেগে গেছে! বাড়ির সবকিছু পুড়ে গেছে! তুই তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আয়!
মামার মুখে হঠাৎ এই কথাটা শুনে আসিফ ভয়ে আৎকে উঠে! সে জানে যে শম্মী একা বাড়িতে রয়েছে! তাহলে তার আবার কিছু হয়নিতো?! এরপর আসিফ , আবিরকে কল দিয়ে এই আগুন লাগার কথাটা জানায়। আবিরো এই রকম কোন কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না! সে ভয়ে আৎকে উঠে এবং শম্মীর কথা চিন্তা করতে থাকে। এরপর তারা দুজনেই খুব দ্রুত বাড়িতে পৌছায়!
বাড়িতে পৌছেই আবারো সেই হাজারো মানুষের ভীর দেখে তাদের হৃদস্পন্দন যেনো আরো বেড়ে যায়। এরপর তারা ধীরে ধীরে ভীর ঠেলে বাড়ির ভেতরের দিকে এগিয়ে যায়। বাড়িতে যেতেই দেখলো তাদের বাড়ি আর এখন তাদের বাড়ির পুরোনো অবস্হায় নেই! পুরো বাড়ি পুরে কয়লা হয়ে গিয়েছে। আবির এবং আসিফ পাগলের মতো শম্মীকে চারিদিকে খুজতে থাকে। এরপর দেখে বাড়ির সামনে পাটির ওপর সাদা কাপড় দিয়ে একটা লাশ ঢেকে রাখা রয়েছে!! সাদা কাপড়টা সড়াতেই তাঁদের আর চিন্তে বাকি রইলো না যে এটাই তাঁদের শম্মী! শম্মীর পুরো শরীর আগুনে পুড়ে পুরো জ্বলসে গেছে। লাশটা দেখে চেনার উপায় নেই যে এটা কার লাশ!! কিন্তু এর শরীরের গঠন দেখে বোঝা যায় যে এটা স্পষ্ট একটা মেয়ের লাশ। আর এই বাড়িতে শম্মী ছাড়া আর কোন মেয়েই ছিলো না!আসিফ পুরো কান্নায় ভেঙে পড়ে।আবিরও কান্না করছিলো। তাও সে তার ভাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে! এরপর পুলিশ ও গোয়েন্দা দল আসে। এর আগেই ফায়ার সার্ভিসও চলে এসেছিলো। তারা নানান তদন্ত করার পর অবশেষে জানায় যে হয়তো গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে এই পুরো বাড়িতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে! আর এই মেয়েটা অর্থাৎ শম্মী সেই সময়ে রান্নাঘরে ছিলো। তাই সে সাথেই আগুনে পুড়ে মারা যায়!
একের পর এক দুর্ঘটনায় তাদের পরিবারের সদস্যদের এইভাবে মৃত্যু ঘটেই চলছিলো! প্রথমে ৫ বছরের বাচ্চা মেয়ে আনিকা ছাদ থেকে পরে মারা গেলো! এরপর আবির এবং আসিফের মা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলো। আর এইবার শম্মী গ্যাস সিলিন্ডার দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে মারা গেলো! এইসব কিছুই কী শুধু দুর্ঘটনা ছিলো নাকি অন্যকিছু?! এক সাথে একই পরিবারের এতোগুলো দুর্ঘটনা মোটেও স্বাভাবিক ছিলো না। কেউই এইগুলোকে স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছিলো না। এইদিকে এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে এটাও বুঝতে পারছিলো না কেউ!
এবার যেনো শুধু মৃত্যুকেই বরণ করে নেওয়ার জন্যই বেঁচে রইলো আবির এবং আসিফ। শম্মীর দাফন কাজ শেষ করার পর যখন তারা কবরস্হান থেকে বের হলো তখন আবির আসিফের কাছে গিয়ে বললো:
-ভাইয়া! আমি হয়তো জানি এইসব দুর্ঘটনাগুলো কে ঘটাচ্ছে!! আর কেনো ঘটাচ্ছে!! এইগুলো একটাও দুর্ঘটনা ছিলো না ভাইয়া! এইসবই ছিলো খুন! আনিকা,ভাবি এবং মা ৩জনকেই খুন করা হয়েছে!
আবিরের কথা শুনে আসিফ পুরো আৎকে উঠে! এরপর আসিফকে বললো:-
-কী বলছিস এসব? তুই কী করে জানলি যে এইগুলো দুর্ঘটনা না?!খুন!! তাহলে বল কে এই খুনগুলো করেছে?!
এরপর আবির কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। এরপর উত্তর দেয়:
-আমার মনে হয় সেই গ্রামের লোকগুলোর বলা কথাগুলোই ঠিক হচ্ছে! লোকগুলো বলেছিলো ঐটা একটা অভিশপ্ত কবরস্হান! আর ঐখানে যাদেরই কবর দেওয়া হয় তাদের কারো আত্মাই আর শান্তি পায় না! তারা আবার তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের খুন করে তার সাথে করে ওপারের দুনিয়ায় নিয়ে যায়! আমার মনে হচ্ছে তাঁদের বলা কথাগুলোই ঠিক! আমাদের বাবার আত্মা আবার আমাদের পরিবারে ফিরে এসেছে এবং সেই আনিকা, মা এবং শম্মীকে খুন করেছে।
নাহলে তুমিই বলো একসাথে এতোগুলো দুর্ঘটনা হয় কী করে ?!
আবিরের কথা শুনে আসিফ আবার খুব রেগে গেলো আর আবিরকে বললো:
-তুই কী আসলেই পাগল?! এইসব অভিশপ্ত বলে কিছু হয় না! মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা আর ফিরে আসে না! এইসব কিছুই কেবল একটা দুর্ঘটনা ছিলো!! তুই এই বিষয় নিয়ে আর একটাও কথা বলবি না আমায়!
আবির একটা ভিন্নরকম জিনিস নিয়ে চিন্তা করছিলো! কিন্তু আসিফ বরাবরই জেদি স্বভাবের ছেলে। সে কিছুতেই এই অভিশপ্ত কথাটা মেনে নিতে রাজি না!
তাদের বাড়ি থেকে তাদের মামার বাড়িটা খুব একটা দুরে না ! তাই রাতে আবির এবং আসিফ তার মামার বাড়িতে থাকতে যায়। কারণ তাদের নিজেদের বাড়ি আর এখন থাকার উপযুক্ত নেই। রাত তখন প্রায় ৯ টা বাজে। বাড়ির সবাই একসাথে বসে আছে! সবাই আসিফ এবং আবিরকে নানান কথা বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। তাদের আর এই পৃথিবীতে আপন বলে কেউ রইলো না! তারা সবাই একে অপরের সাথে কথা বলছিলো। তাদের সবার কথার মাঝখানে হঠাৎ আসিফ উঠে বললো তাকে একটু তার ব্যাংকের অফিসে যেতে হবে।
ব্যাংক থেকে কেনো যেনো তাকে যেতে বলেছে। বাড়ির সবাই তাকে যেতে নিষেধ করলো ! বললো , আজ এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। তাই আজ আর এতো রাতে অফিসে যেতে হবে না! কিন্তু আসিফ কারো কোন কথাই শুনলো না। সে বললো তাকে নিয়ে নাকি ব্যাংকে কি সমস্যা হয়েছে। আবির তার সাথে যেতে চাইলে সে আবিরকেও যেতে না করলো। এরপর সে তার মামার প্রাইভেট কারটা নিয়ে অফিসের পথে ছুটলো। আবির বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলো। আজকে দিনে তার স্ত্রী মারা গেলো আর রাতের বেলাতেই সে সেটা ভুলে অফিসে যেতে চাচ্ছে!! এরপর এটা নিয়ে আর বেশিকিছু ভাবলো না সে!
রাত তখন প্রায় ১২টা বাজে। নিজের ঘরেই একা একা বসেছিলো আবির। এরপর ভাবলো এতোরাত হয়ে গেছে এখনো তার ভাইয়া বাড়িতে আসছে না কেনো?! এটা ভাবতে ভাবতেই তার মোবাইলে আসিফের নাম্বার থেকে একটা কল আসলো! নাম্বারটা দেখেই আবির দ্রুত কলটা ধরলো। কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে আসিফের কাঁদো কাঁদো কন্ঠ ভেসে আসলো! আসিফ এমনভাবে কথা বলছিলো যে মনে হচ্ছিলো সে কোন কিছু দেখে প্রচুর ভয় পেয়ে গেছে!! আসিফ কাঁদতে কাঁদতে আবিরকে বলতে লাগলো:
-আমায় বাঁচা ভাই! সেই গ্রামের লোকগুলোর কথাই ঠিক হয়েছে! বাবার আত্মা আবার ফিরে এসেছে! আমায় বাঁচা!
রাত তখন প্রায় ১২টা বাজে। নিজের ঘরেই একা একা বসেছিলো আবির। এরপর ভাবলো এতোরাত হয়ে গেছে এখনো তার ভাইয়া বাড়িতে আসছে না কেনো?! এটা ভাবতে ভাবতেই তার মোবাইলে আসিফের নাম্বার থেকে একটা কল আসলো! নাম্বারটা দেখেই আবির দ্রুত কলটা ধরলো। কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে আসিফের কাঁদো কাঁদো কন্ঠ ভেসে আসলো! আসিফ এমনভাবে কথা বলছিলো যে মনে হচ্ছিলো সে কোন কিছু দেখে প্রচুর ভয় পেয়ে গেছে!! আসিফ কাঁদতে কাঁদতে আবিরকে বলতে লাগলো:
-আমায় বাঁচা ভাই! সেই গ্রামের লোকগুলোর কথাই ঠিক হয়েছে! বাবার আত্মা আবার ফিরে এসেছে! আমায় বাঁচা!
এতোটুকু কথা বলেই আসিফ কলটা কেটে দিলো। আর আবির কথাটা শুনে পুরোই আৎকে উঠলো। সে কিছুই বুঝতে পারছিলো না! আসিফ হঠাৎ করে এইসব কথা বলছে কেনো ?! এবার কী তাহলে আবার আসিফের কোন বিপদ হলো?! আবির কথাটা ভেবেই বেশ ভয় পেয়ে গেলো! সে তার পরিবারের সব সদস্যদের হারিয়েছে!! এখন যদি আসিফেরও কিছু হয় তাহলে সে বাঁচবে কি নিয়ে?! এরপর আবির আসিফের নাম্বারে কয়েকবার কল দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আসিফের নাম্বারটা বন্ধ পায় সে ! এবার তার চিন্তা যেনো আরো বেড়ে যায়! সে দ্রুত তার মামার ঘরে যায়। এরপর আবির তার মামাকে সব কথা খুলে বলে। আবির বলে যে , আসিফ হয়তো কোন বিপদে পড়েছে! সে কাঁদতে কাঁদতে একটু আগে আবিরকে কল দিয়েছিলো!! এরপর হঠাৎই কলটা কেটে যায়! এরপর থেকে আসিফের নাম্বারটা বন্ধ রয়েছে!! আবিরের মামাও কথাটা শুনে বেশ চমকে উঠে!! সেও আবিরের মতো বেশ চিন্তায় পড়ে যায়!
এরপর আবির এবং তার মামা দুজনে মিলেই খুব দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসিফকে খুঁজতে যায়। প্রথমে তারা আসিফের ব্যাংকের অফিসে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা আরো বেশি অবাক হয়। কারণ সেখানে গিয়ে তারা জানতে পারে যে আসিফ আজ রাতে অফিসেই আসেনি বা তাকে জরুরী ভাবে কেউ অফিসে আসতে বলেনি!
তারা কথাটা শুনে পুরোই অবাক হয়ে যায়! আর ভাবে আসিফ শুধু শুধু তাদের মিথ্যা কথা বলে এতোরাতে বাড়ি থেকে বের হলো কেনো ?! তাদের চিন্তার মাত্রা যেনো আরো বেড়ে গেলো!
এরপর আবির এবং আবিরের মামা শহরের অনেকগুলো রাস্তা ঘুরে বেড়ায় আসিফকে খুঁজতে! কিন্তু কোথাও আসিফকে খুঁজে পায় না তারা! এর ভেতরেও আসিফকে অনেকবার কল দেয় আবির! কিন্তু সেই একই ভাবে বাড়ে বাড়ে আসিফের মোবাইলটা বন্ধ পায় সে!
এইভাবে দেখতে দেখতে রাত প্রায় ৩টা বেজে যায় । এরপর রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ আবির এবং তার মামা লক্ষ করে যে রাস্তার একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অনেকগুলো মানুষ ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন পুলিশকেও সেখানে ভীর করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে! আবির এবং তার মামা বেশ অবাক হয়! তারা ভাবে যে এতোরাতে রাস্তার পাশে এতোগুলো মানুষ ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে কেনো?! এরপর আবির এবং তার মামা ধীরে ধীরে সেই জায়গাটার দিকে এগিয়ে যায়! এরপর ভীর ঠেলে একটু সামনে যাওয়ার পর তারা যা দেখলো! তা দেখে তারা পুরোই আৎকে উঠলো! তারা দেখলো যে একটা গাড়ি রাস্তার পাশের একটা বড় গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে ধুমড়ে মুচরে রাস্তার পাশে পড়ে রয়েছে। গাড়িটা দেখে তাদের চিন্তে বাকি রইলো না যে! আরে এটাইতো সেই গাড়িটা যেই গাড়িটা আসিফ একটু আগে রাতের বেলা বাড়ি থেকে নিয়ে বেরিয়ে ছিলো!! তারা গাড়িটা দেখেই আৎকে উঠে কাঁদতে থাকে। এরপর গাড়ির একটু কাছে যেতেই তারা দেখলো যে আসিফের রক্তাক্ত শরীর গাড়ির ভেতর পড়ে রয়েছে। আসিফের লাশটা দেখে আবির এবং তার মামা দুজনেই পুরো নির্বাক হয়ে গেলো!! তারা কিছুই বুঝতে পারছিলো না! তারা কল্পনাও করতে পারছিলো না যে আসিফ মারা গেছে?!! তারা ভাবতে লাগলো যে, আসিফ এইভাবে এক্সিডেন্ট করলো কিভাবে?! আসিফতো বেশ ভালো গাড়ি চালাতে পারতো!! এরপর সেখানকার পুলিশ তাদের জানালো যে, আসিফের গাড়ি হয়তো ব্রেক ফেল করেছিলো। তাই সে ব্রেক নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে এই গাছের সাথে গাড়িটা ধাক্কা লাগিয়ে দেয় এবং এক পর্যায়ে অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে সে মারা যায়। এরপর আশে পাশের সব মানুষেরা এই এক্সিডেন্টের শব্দ পেয়ে এখানে ছুটে আসে এবং পুলিশে খবর দেয়। যদিও কেউ নিজের চোখে দুর্ঘটনাটা হতে দেখেনি। কিন্তু নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় দুর্ঘটনা। আর এই দুর্ঘটনা রাত প্রায় ১২টার দিকে ঘটে ।
কথাটা শুনে আবিরের মামা বেশ চমকে যান। কারণ সে জানতো যে তার গাড়িতে কোন রকম সমস্যা ছিলো না ! আর ব্রেকে সমস্যা থাকারতো কোন প্রশ্নই আসে না! তাহলে গাড়িটা ব্রেক ফেল করলো কিভাবে?!
আবির এবং তার মামা কিছুক্ষন চুপচাপ সেখানেই বসে রইলো। আবির জানে যে এটাকেও সবাই একটা স্বাভাবিক সড়ক দুর্ঘটনা ভেবে উড়িয়ে দিবে! কিন্তু আবির জানে যে এটা মোটেও কোন স্বাভাবিক সড়ক দুর্ঘটনা না! এটা একটা খুন। তার মাথায় শুধু আসিফের বলা সেই শেষ কথাগুলোই ঘুরতে থাকে, ” আমায় বাঁচা ভাই! সেই গ্রামের লোকগুলোর বলা কথাই ঠিক হয়েছে! বাবার আত্মা আবার ফিরে এসেছে!” আবির বুঝতে পারে যে, তার ধারণাই ঠিক ছিলো। তার বাবার আত্মা আসলেই আবার ফিরে এসেছে এবং সেই এক এক করে তার পরিবারের সদস্যদের খুন করে ওপারের দুনিয়ায় নিয়ে
যাচ্ছে! প্রথমে আনিকা, তারপর তাদের মা, এরপর শম্মী , আর এখন তার বড় ভাই আসিফকেও খুন করেছে সে! এইভাবে সবাইকেই খুন করছে সে! আর এখন শুধু একজনই বেঁচে আছে! আবির জানে যে এরপর সেই একজনও ওপারের দুনিয়ায় পাড়ি জমাবে। সেই একজনকেও তার বাবা খুন করবে!! সেই একজন আর কেউ না! হ্যাঁ ! সেই বাকি একজন আবির নিজেই! আবির জানে যে, এরপর সে নিজেও মারা যাবে। তার মৃত্যু অতি সন্নিকটে। পরিবারের বাকি সদস্যদের মতো সেও হয়তো কোন এক দুর্ঘটনায়ই মারা যাবে! তার মৃত্যুও এবার কেউই ঠেকাতে পারবে না!
এরপর দেখতে দেখতে প্রায় সকাল হয়ে যায়! আসিফের লাশকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তার নানান আত্মীয়স্বজনেরা আবার বাড়িতে এসে ভীর জমাতে থাকে, কান্নাকাটি করতে থাকে। তবে এই ঘটনাগুলো আবিরের কাছে এখন যেনো একটা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে ! কারণ সে এই ২ মাসে কয়েকবার এইরকম ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে! তার অনুভুতিগুলো এখন যেনো মারা গেছে !! সে একজন জীবন্ত লাশের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু সবার কর্মকান্ড দেখছিলো। এরপরে শহরের একটি কবরস্হানে আসিফেরও দাফন কাজ শেষ করা হয়। এরপর দেখতে দেখতে প্রায় রাত হয়ে যায়। তাদের সব আত্মীয় স্বজনেরা আবিরকে সান্ত্বনা দিয়ে ধীরে ধীরে যার যার বাড়িতে ফিরে যায়! আবিরের মামা আবিরকে তাদের বাড়িতে গিয়ে রাতে থাকতে বলেন। কিন্তু আবির অনেকটা পাগলের মতো ব্যবহার করতে শুরু করে। সে একা একাই অন্ধকারে সেই আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া তাদের বাড়ির ভেতরে বসে থাকে। তার মামাকেও সে এখান থেকে চলে যেতে বলে। আবির তার মামাকে বলে, সে একটু পড়েই তার বাড়িতে যাবে। এখন সে একটু একা থাকতে চায়! এরপর আবিরের মামাও আবিরকে ছেড়ে তার বাড়িতে চলে যায়।
পুরো বাড়িতে আবির শুধু একা একা চুপচাপ বসে থাকে। সে যেনো জানে যে তার মৃত্যু অনেক নিকটে চলে এসেছে! হয়তো একটু পরে এই বাড়িতেই তার মৃত্যু ঘটবে! হয়তো একটু পরেই সে তার পরিবারের বাকি সদস্যের কাছে ওপারের দুনিয়ায় চলে যাবে!
আবির বসে বসে মৃত্যুর অপেক্ষা করছিলো! এরপর হঠাৎ সে ভাবলো! আসলেই কী এই অভিশাপ থেকে বেঁচে ফেরার আর কোন উপায় নেই?! আসলেই কি তার মৃত্যু নিশ্চিত?! আসলেই কী তার বাঁচার আর কোন সুযোগ নেই?! সে কী পারে না এই অভিশাপকে ধ্বংস করে আবার একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে?! তার নিজের মৃত্যু ছাড়া কী তার বাবার আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার আর কোন উপায় নেই?!
এইরকম হাজারো প্রশ্ন এসে আবিরের মাথায় ঘুরপাক খায়। আবির এবার যেনো বেঁচে থাকার জন্য কিছুটা আশা পায়। সে ভাবে এইসব প্রশ্নের উত্তর, রহস্যের সমাধান এবং অভিশাপ থেকে মুক্তির সব উপায়ই একমাত্র সেখানেই পাওয়া যাবে যেখানে তারা তার বাবার
কবরটা দিয়েছিলো। সে বুঝতে পারলো এখন তার কাছে আর কোন রাস্তা নেই!! তাকে সেই অভিশপ্ত কবরস্হানটার পাশেই ফিরে যেতে হবে! কারণ একমাত্র সেখানকার লোকেরাই তার বাবার কবর দেওয়ার আগে থেকেই তাদের নানান ভাবে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলো!! নিশ্চই এখন তাদের কাছে গেলেই এই সমস্যার কোন একটা সমাধান পাওয়া যাবে ! তারা নিশ্চই এই অভিশপ্ত কবরস্হানের রহস্য জানে এবং জানে যে কী করে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়!
এরপর আবির আর কিছু না ভেবেই সিদ্ধান্ত্ব নেয়। যে করেই হোক তাকে আবার তাঁদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে! সেখানেই হয়তো সে এই অভিশপ্ত জীবনের একটা সুন্দর সমাপ্তি পাবে !! কিন্তু রাতের অন্ধকারে সেই গ্রামে যাওয়াটা ঠিক হবে না! তাই সে ভোরের অপেক্ষায় তাদের বাড়িতেই সারারাত বসে রইলো! সকাল হলেই সে রওনা দিবে তাদের গ্রামে।
এরপর রাতের অন্ধঁকার পেরিয়ে যেই ভোরের সূর্যের আলো উঁকি দিয়েছে। ঠিক সেই সময়েই আবির তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার মামা বা অন্য কাউকে কিছু না বলেই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। প্রায় অনেকটা সময় বাসে থাকার পর অবশেষে সে তার গ্রামের বাড়িতে পৌছালো!
গ্রামের বাড়িতে পৌছে সে আবার পুরো দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো। সে ভাবছিলো যে, সে গ্রামেতো ঠিকই পৌঁছে গেছে! কিন্তু এখন সে কী করবে?! সে সাহায্যের জন্য গ্রামের কার কাছে যাবে?! সে কাকে বিশ্বাস করে এইসব ঘটনা খুলে বলবে?! কে তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে?!!
এরপর আবিরের হঠাৎ মনে পড়লো, এই গ্রামের ঈমাম সাহেব তাঁদের সবার প্রথমে সতর্ক করেছিলো! তাহলে নিশ্চই এই অভিশপ্ত কবরস্হান সম্পর্কে সেই সবচেয়ে ভালো জানে। আর এই অভিশাপ থেকে কিভাবে মুক্ত হতে হবে এটাও হয়তো সে জানে!
এরপর আর বেশিকিছু না ভেবে আবির ঈমাম সাহেবের সাথে দেখা করতে মসজিদে যায়! ঈমাম সাহেব আবিরকে দেখে খুব একটা অবাক হয় না। স্বাভাবিক ভাবেই একটা মুচকি হাসি দিয়ে সে আবিরকে বলে:
-আমি জানতাম যে তোমাদের পরিবারের কেউ না কেউ বেঁচে আবার এই গ্রামে ফিরে আসবে। আবার আমার কাছে এই অভিশাপটার ব্যাখ্যা চাইবে। এইরকম ঘটনা এর পুর্বেও অনেকবার ঘটেছে আর এর পরেও আরো ঘটবে!
ঈমাম সাহেবের কথাটা শুনে আবির কিছুক্ষন চুপ হয়ে থাকে। এরপর কাঁদতে কাঁদতে ঈমাম সাহেবকে আবির সব ঘটনা খুলে বলে। সেই গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত তার পরিবারের সাথে যা যা ঘটেছে! পরিবারের সকল সদস্যদের ধীরে ধীরে নানান দুর্ঘটনায় পড়ে মারা যাওয়া! সব ঘটনা পরিষ্কার ভাবে আবির ঈমাম সাহেবকে খুলে বলেন। ঈমাম সাহেব কথাটা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন। এরপর আবিরকে বললেন:
-এইরকম টাতো হওয়ারই ছিলো! প্রায় প্রতি বছরেই এখানে একটা পরিবার আশে তাদের আপন জনকে কবর দিতে। আমাদের নানান নিষেধ থাকার পরেও তারা অনেকটা জেদ করেই ঐ কবরস্হানে তাদের পরিবারের সদস্যকে কবর দেয় এবং যাকে কবর দেওয়া হয় তার আত্মা আর কোনদিনও শান্তি পায় না! এরপর তার আত্মা আবার তার পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু মৃত্যুর পর আর তাদের পরিবারের মানুষদের সাথে থাকতে পারে না তারা! তাই তাদের পরিবারের বাকি সদস্যদেরও খুন করে তাদের সাথে করে নিয়ে ওপারের দুনিয়ায় পাড়ি জমায়।
-কিন্তু সেই লাশগুলো বা তাদের পরিবারের কী দোষ থাকে?! তারা কেনো শুধু শুধু শাস্ত্রী পায়?!
-আসলে দোষটা সেই লাশটা বা তার পরিবারের নয়! দোষটা এই অভিশপ্ত কবরস্হানের! এই কবরস্হানে যাদেরই কবর দেওয়া হয়, তাদের পরিবারের সাথেই কেবল এই ঘটনাটা ঘটে! এই কবরস্হানটাকে অভিশপ্ত বলার পেছনেও একটা বড় ঘটনা রয়েছে! আসলে তোমার বাবাকে যেই কবরস্হানে তোমরা কবর দিয়েছো এটা আগে একটা সাধারন বড় কবরস্হান থাকলেও বর্তমানে এটা একটা গণকবর ! ঘটনাটা প্রায় ১৫ বছর আগের। তখনো আমি এই গ্রামে ঈমাম হয়ে আসিনি। এই ঘটনাটা পুরোটাই একটা বড় হুজুরের কাছে শোনা! আজ থেকে ১৫ বছর আগে এই কবরস্হানটাই এই গ্রামের একমাত্র কবরস্হান ছিলো। এখানে স্বাভাবিক ভাবেই এলাকার মানুষ মারা গেলে তাদের কবর দেওয়া হতো। স্বাভাবিক ভাবেই কাটছিলো গ্রামের মানুষগুলোর দিন। এরপরে একদিন গ্রামের মানুষগুলো একটা বড় পাপে জড়িয়ে পড়লো। সেই সময়ে এই গ্রাম থেকে প্রায় ২০ কি.মি দুরে একটা কেমিকেলের কারখানা ছিলো। সেখানে বিভিন্ন রকম কেমিকেল তৈরি করা হতো। এবং সেখানে অনেক দুর-দূরান্ত থেকেও মানুষ এসে কাজ করতো। যদিও এই গ্রাম সহ আশেপাশের ১০ গ্রামের মানুষেরা তখনো এই কারখানা সম্পর্কে কিছুই জানতো না। একদিন সেই কেমিকেল কারখানায় একটা ভেজাল কেমিকেল তৈরি করতে যায় কারখানার মালিকেরা। তারা সেই কেমিকেল তৈরি করাতো সাধারণ শ্রমিকদের দিয়ে। কিন্তু সেদিন তারা সফল ভাবে কেমিকেলটা তৈরি করতে পারলো না! কেমিকেল তৈরি করার মাঝপথে সেই কেমিকেল থেকে হঠাৎ করে একটা বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন হতে থাকে। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়া সাথে সাথেই কারখানার প্রায় অর্ধেকের বেশি শ্রমিক মারা যায়! ঠিক সেই সময়ে কারখানার মালিকেরা বেশ চিন্তায় পড়ে যায়! তারা ভাবে এই কেমিকেল বা এতোগুলো শ্রমিকের হঠাৎ মৃত্যুর ঘটনা যদি কারো কানে যায় তাহলে তাদের কপালে অনেক বড় দুঃখ রয়েছে। এইদিকে কারখানার বাকি যেই শ্রমিকগুলো বেঁচে ছিলো তারা বেশ রেগে যায় মালিকদের উপর! তারা এতোগুলো শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ জানতে চায় মালিকদের কাছে। মালিকরা বুঝতে পারে যে, এই বাকি শ্রমিকগুলোও যদি বেঁচে থাকে তাহলে এই কারখানার ভেতরের সব খবরগুলো বাহিরে চলে যাবে! সবাই জেনে যাবে যে এই কারখানায় এতোগুলো শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে মারা গেছে !! তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে বাকি শ্রমিকদেরো তারা খুন করবে! তাহলেই আর কোন প্রমাণ থাকবে না! এরপরেই কারখানার মালিক পক্ষের লোকেরা বাকি শ্রমিকদের বোকা বানিয়ে একটা ঘরে নিয়ে খুন করে। সবাইকে প্রথমে একটা কেমিকেল দিয়ে অজ্ঞান করে। পরে ঐ অজ্ঞান অবস্হাতেই তাদের গলা ছুরি দিয়ে কেটে তাদের খুন করা হয়। এরপরেই তারা এইসব গুলো শ্রমিকের লাশগুলোকে গুম করার উদ্দেশ্যে একটা ট্রাকে করে রাতের অন্ধকারেই এই গ্রামে লাশগুলোকে নিয়ে আসে। তারা জানতো যে এই গ্রাম থেকে কারখানাটা বেশ দুরে। তাই এই পর্যন্ত কেউ এদের খুঁজতে আসবে না! এরপর এই গ্রামে এসে গ্রামের প্রভাবশালী মানুষদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে এই কবরস্হানটা এক রাতের জন্য নেয় তারা। এরপর একটা গণকবর খুড়ে শখানেক শ্রমিকদের লাশকে জানাজা ছাড়া ঐ অবস্হাতেই গর্তে ফেলে পুতে রাখে ঐ কারখানার মালিকের দল। ঐ সময় তাদের এই জঘন্য কাজটা গ্রামের প্রায় সব লোকই দেখেছিলো। কিন্তু সেই মালিকপক্ষ গ্রামের সবাইকে টাকা খাইয়ে মুখ বন্ধ করে রাখে! এমনকি গ্রামের অনেকে সেই কবরস্হানে গর্ত খুড়ে সেই লাশগুলোকে গর্ত করে পুতে রাখতেও সহযোগিতা করে। গ্রামের সবাই টাকার নেশায় অন্ধঁ হয়ে গিয়েছিলো!
একটা পবিত্র কবরস্হানে এইরকম নির্মম, জঘন্য কাজ করার জন্য সেই কবরটা এরপর থেকে অভিশপ্ত কবরস্হানে পরিণত হয়। সেই শখানেক শ্রমিকের মধ্যে কারো আত্মাই আর মুক্তি পায় না। তাদের আত্মা গুলো সেই কবরস্হানেই আটকা পড়ে থাকে। এরপরে শোনা যায় যে, এই কেমিকেল কারখানার যে সকল মালিকেরা সেদিন শ্রমিকদের এতোটা নির্মম ভাবে এখানে গণকবর দিয়েছিলো তাদের কেউ আর বেশিদিন বেঁচে থাকে না! তারা সবাই ধীরে ধীরে কয়েকদিনের মধ্যেই নানান দুর্ঘটনায় পড়ে মারা যায়। কিন্তু তাদের এই দুর্ঘটনায় পড়ে হঠাৎ মৃত্যুগুলো কী শুধুই দুর্ঘটনা ছিলো নাকি সেই আত্মাগুলোর প্রতিশোধ নেওয়া ছিলো?! এটা কেউই জানে না! এরপর থেকে সেই অভিশাপ নেমে আসে এই গ্রামের মানুষদের উপর! এই গ্রামের কেউ মারা গেলে তাকে ঐ কবরস্হানেই কবর দেওয়া হতো। তখনো কেউ জানতো না যে ঐ কবরস্থানটা অভিশপ্ত হয়ে গেছে!! তাই তাদের আত্মা কখনোই শান্তি বা মুক্তি পেতো না। সেই কবরস্হানের আত্মাগুলো তাদের আত্মাকেও অভিশপ্ত করে ফেলতো। সেই আত্মা গুলোর ভেতরের ভালো জিনিসগুলো তারা কেরে নিতো এবং তার ভেতরে আরো অনেক খারাপ চিন্তা ঢুকিয়ে তাকে আবার তার পরিবারের কাছে পাঠাতো তারা! এরপর সেই আত্মাটা তার পরিবারের একজন একজন করে সদস্যের দেখা দেয় এবং তাদেরকে ইচ্ছা করেই নানান দুর্ঘটনার স্বীকার বানায় এবং তার সাথে করে ওপারের দুনিয়ায় নিয়ে যায়! এরপরেও এই গ্রামের অনেকগুলো মানুষকে এই কবরস্হানেই কবর দেওয়া হয় এবং তাদের পরিবারের সাথেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে! তাদের পরিবারের সদস্যেরাও ঠিক একই ভাবেই দুর্ঘটনায় মারা যায়! এইভাবে এই গ্রামের অনেকগুলো পরিবার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পড়ে এই গ্রামের মানুষগুলো তাঁদের অপরাধ বুঝতে পারে এবং বুঝতে পারে যে নিশ্চই এই কবরস্হানকে সেই আত্মাগুলো অভিশপ্ত করে রেখেছে । তাই এইরোকম অঘটন ঘটছে !! তাই এই গ্রামবাসী এরপর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর ধরে ঐ কবরস্হানে কারো কবর দেওয়া নিষিদ্ধ করে দেয়! এরপর তারা নতুন একটা কবরস্হান তৈরি করে এবং আজ পর্যন্ত সেখানেই আমরা নতুন লাশদের কবর দেই ! কিন্তু ১২ বছর ধরে এই কবরস্হানকে নিষিদ্ধ করা হলেও প্রায় প্রতি বছরেই এইখানে আমাদের নিষেধ অমান্য করে একটা না একটা পরিবার এসে তোমাদের মতো তাদের পরিবারের কোন সদস্যকে এখানে কবর দিয়ে যায়! এবং তাদের সাথেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে! তোমাদের পরিবারেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে! তোমরাও সেই অভিশাপের স্বীকার হয়েছো! তোমার বাবার আত্মাটা আবার ফিরে এসে তোমাদের পরিবারের সব সদস্যদের ধীরে ধীরে দেখা দেয় এবং তাদের নানান দুর্ঘটনার ফাঁদে ফেলে খুন করে। এখন হয়তো শুধু তুমিই বাকি রয়েছো!!
-এতোসব ঘটনা বাবার কবর দেওয়ার আগে আপনি কেনো আমাদের বলেন নি?(আবির)
-বলার অনেক চেষ্টা করেছিলাম তোমার বড় ভাইকে! কিন্তু সে আমার পুরো কথাটা শুনে না ! সে এর আগেই আমাকে গন্ড-মুর্খ বলে তাঁড়িয়ে দেয়। তোমাদেরকে অনেকবার সতর্ক করা হয়েছিলো যে এই কবরস্হানে তোমাদের বাবার কবর দিয়োনা। কিন্তু তোমরা আমাদের কারো কথাই শুনোনি!
-হুম। যদি আমরা একটু সতর্ক থাকতাম তাহলে হয়তো আমাদের পরিবারটার আজ এই অবস্হা হতো না! কিন্তু এখন কী আমার মৃত্যু নিশ্চিত?! এই অভিশাপ থেকে বাঁচার কী আর কোন উপায়ই নেই?!
-হয়তো আছে! তবে উপায়টা আমার জানা নেই। আমি একটা বড় হুজুরের ঠিকানা তোমাকে দিচ্ছি! হয়তো সে তোমাকে এ ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারে। কিন্তু… !
-কিন্তু কী ঈমাম সাহেব?!
-জানি হয়তো কথাটা শুনে তুমি আরো বেশি ভয় পেয়ে যাবে! কিন্তু এর আগেও অনেকে এই বিষয়ে আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলো! আমি তাদেরকেও সেই হুজুরের ঠিকানা দিয়ে তার কাছে পাঠাই! কিন্তু এরপর থেকে আর তাদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না! আমি জানি না যে হুজুর তাদের কী পরামর্শ দেয়?! বা তারা কী আদো হুজুরের কাছে পৌছাতে পারে কিনা?! কিন্তু তুমি ভয় পেয়ো না! তুমি এগিয়ে যাও।
আবির ঈমাম সাহেবের এই কথাটা শুনে বেশ ভয় পেয়ে যায়! কিন্তু তার কাছে আর কোন উপায়ই নেই । আবির জানে যে সেখানে না গেলেও তার মৃত্যু তাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না! এরপর আবির ঈমাম সাহেবের কাছ থেকে সেই বড় হুজুরের ঠিকানা নিয়ে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
বড় হুজুরের বাড়িতে পৌছাতে পৌছাতে প্রায় বিকেল হয়ে যায়! তবে পথে সে কোন বিপদের সম্মুখীন হয়নি! এরপর সে বড় হুজুরের কাছে গিয়ে তার সব ঘটনা খুলে বলে। আবিরের কথাগুলো শুনে হুজুর কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন! এরপর কিছুটা গম্ভীরকন্ঠে আবিরকে বললেন:
-এটাতো হওয়ারই ছিলো! তোদেরকে তো আগে থেকেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিলো। তাও তোরা শুনিস নি! ভুলের মাশুলতো সবাইকেই দিতে হয়! তাই তোর পরিবারের সবাইকেও দিতে হয়েছে!!এবার তুইও দিবি!
-কিন্তু এই অভিশাপ থেকে মুক্তির কী কোনই উপায়ই নেই?! সেই শ্রমিক গুলোর আত্মাদের মুক্তি দিয়ে কবরস্হানকে আবার অভিশাপ মুক্ত করা কী পুরোই অসম্ভব?!
(আবির)
-হ্যাঁ এটা কিছুতেই সম্ভব না! কারণ যারা সেই শ্রমিকগুলোর মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিলো এবং বাকি নিরোপরাধ শ্রমিকদের খুন করেছিলো তাঁদের সবাইকেই সেই অভিশপ্ত আত্মাগুলো খুন করে ফেলেছে! তার পরেও তাঁদের অভিশপ্ত আত্মাগুলো কেনো এখনো মুক্তি বা শান্তি পেলো না এটা কারোই জানা নেই !! তাই সেই কবরস্হানকে অভিশাপ মুক্ত করার আর কোন উপায়ই আমার জানা নেই। তবে তুই চাইলে শুধু নিজে ঐ অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারিস!
শুধু নিজের জীবনটাই বাঁচাতে পারিস তুই!!
-কিন্তু কিভাবে?
-তুই এখন সেই অভিশপ্ত কবরস্হানটাতে যাবি! তারপর তোর বাবাকে যেখানে কবর দিয়েছিলি সেই কবরটা খুড়বি!
কবরটা খুড়ার পর তার কাফনে মোড়া লাশটা কবর থেকে উঠাবি। এরপর অন্য যে কোনো একটা কবরস্হানে আবার তার কবর দিয়ে দিবি! এরপরে তোর বাবার আত্মা মুক্তি পেয়ে যাবে। আর তোর কোন বিপদ হবে না! তুই বেঁচে যাবি। যদিও এই অভিশাপটা এরপরেও শেষ হবে না! এরপরে অন্য কোন পরিবার আবার তাদের পরিবারের কোন সদস্যকে এই অভিশপ্ত কবরস্থানে কবর দিলে তাদের পরিবারো আবার এই একই রকম পরিস্হিতে পড়বে। কেউ মুক্তি পাবে না! সবাই ওপাড়ে চলে যাবে! তবে তুই একটা কথা মনে রাখিস! তুই যখন কবর খুড়া শুরু করবি তখন সেই কবরস্তানের অনেক আত্মা তোকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করবে! নানান ভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করবে! তবে তারা তোর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না! কিন্তু তুই যদি অর্ধেক কবর খুড়ার পর ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করিস তাহলে তারা তোকে আর বাঁচতে দিবে না! অথবা তুই পুরো পাগল হয়ে যাবি!
সেই বড় হুজুরের কথাগুলো শুনে তার কাছে বিদায় নিয়ে আবির আবার তার গ্রামের দিকে রওনা হলো। গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে আবিরের প্রায় রাত হয়ে গেলো। সে গ্রামের একজনের কাছ থেকে একটা কোঁদাল এবং একটা লাইট ধার নিলো। এরপরে সেই কবরস্হানের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো! সেই কবরস্হানে এমনি দিনের বেলা গেলেই যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে! আর আবির রাতের অন্ধঁকারে লাইটের আলোতে একা একা সেই কবরস্হানে যায়!
এটা ভেবেই ভয়ে আবিরের গলা প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছিলো, তার শরীরের রক্ত যেনো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো, তার শরীরের লোমগুলোও অদ্ভুত শিহরণে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলো! আবির ভয়ে ভয়ে তার বাবার কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো! এরপর ধীরে ধীরে তার বাবার কবরটা খুড়তে থাকলো। আবিরের মনের ভয় যেনো আরো বেড়ে যাচ্ছিলো!! হঠাৎ আবিরের মনে হয় অনেক গুলো অশরীরী আত্মা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে! তারা তাকে কবরটা খুড়তে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা তাকে কবরটা খুঁড়তে নিষেধ করছে!! কিন্তু আবির সেদিকে লক্ষ না করে মনে কিছুটা সাহস এনে কবরটা খুড়তেই থাকে! তার মনে হচ্ছিলো নানান অজানা শক্তি তার কাছে এসে ভিড় জমাচ্ছিলো!!
এরপরে আবিরের মনে হয় যে তার পেছন থেকে তার বাবা, মা, আসিফ,শম্মী, আনিকা তাকে ডাকছে! তাকে এই কবর খুড়তে তারা নিষেধ করছে! কিন্তু আবির এটাকেও পাত্তা দেয় না! সে জানে যে এইসবই ধোকা! এরপরেও সে কবর খুড়তেই থাকে। কবর খুড়তে খুড়তে সে লক্ষ করে যে এই কয় মাসে কবরে দেওয়া বাঁশ, পাটি সব মাটিতে মিশে গেছে! এরপর কবরটা আরেকটু খুড়তেই সে তার পায়ের সাথে কোন একটা শরীরের স্পর্শ পায়! সাথে সাথে ভয়ে তার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়! এরপর আবির হাত দিয়ে কবরের নিচের মাটি সড়াতে থাকে। কিছুক্ষণ মাটি সড়ানোর পর আবির যা দেখলো তা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না! সে হালকা লাইটের আলোতে দেখলো যে কাফনের কাপড়ে মোড়া তার বাবার লাশটা কবরের ভেতর পড়ে রয়েছে। তার বাবার লাশটার চোখ খোলা! চোখদুটো যেনো সোজা আবিরের চোখের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে চোখ দুটো যেনো এখনো বেঁচে রয়েছে!আর একটু পরেই হয়তো লাশটা তাকে
টেনে কবরে শুইয়ে দিবে! কি ভয়ঙ্কর লাশটার চেহারা! আবির যেনো তার বাবার লাশকেই চিনতে পারছে না! লাশটাকে এই অবস্হায় দেখে আবির যতোটানা ভয় পায় তার চেয়ে বেশি অবাক হয়ে যায়। কারণ তারা তার বাবাকে কবর দিয়েছে প্রায় কয়েক মাস হয়ে গেলো। এতোদিনেতো তার বাবার লাশ পঁচে-গলে মাটিতে মিশে যাওয়ার কথা! কিন্তু লাশটা দেখে মনে হচ্ছে হয়তো একটু আগে কেউ এসে এখানে কবর দিয়ে গেছে! এখনো কাফনের কাপড়টাও নতুন রয়েছে আর কবরের উপরের মাটি শক্ত হলেও লাশটার পাশের মাটিগুলো পুরোই ঝুড়ঝুড়ে। তার উপর আবার লাশটার চোখ খোলা! আবির কিছুটা বুঝতে পারে যে! এটা হয়তো এই অভিশপ্ত কবরস্হানের আত্মাগুলোর অভিশাপের ফল!
এরপর আবির আর বেশি কিছু না ভেবে তার বাবার লাশটা কাধে করে নিয়ে গ্রামের অন্য একটা কবরস্হানের দিকে ছুটতে থাকে। তার অন্য হাতে লাইট এবং কোদালটা ছিলো! এরপরে অনেকটা পথ ছুটার পর আবির অবশেষে গ্রামের নতুন কবরস্হানে পৌছায়! এরপরে দ্রুত সেখানে একটা নতুন কবর খুড়ে এবং তার বাবার লাশকে আবার সেখানে কবর দেয়। এরপর আবির সেই কবরস্হানে বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে! সে নিজেও বুঝতে পারছিলো না যে সে কয়েক মুহূর্তের ভেতর কতোটা ভয়ংকর কাজ করেছে!! এরপর হঠাৎ আবিরের মাথাটা ঘুরাতে থাকে আর সে সে সাথে সাথেই সেই নতুন কবর স্হানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়!
এরপর আবির যখন চোখ খুলে তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা মসজিদে। তার মাথার পাশে সেই ঈমাম সাহেব চুপচাপ বসে আছেন! আবির উঠে বেশ অবাক হয়! সে কিছুই বুঝতে পারে না! এরপর ঈমাম সাহেব তাকে সব ঘটনা খুলে বলেন। আসলে আবির রাতে নতুন কবরস্হানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার পর সারারাত সেখানেই পড়েছিলো। এরপর ফজরের নামাজ পড়ার পর গ্রামের কিছু লোক তাকে সেখানে পড়ে থাকতে দেখে এবং সেখান থেকে উঠিয়ে মসজিদে দিয়ে যায়!
এরপর আবিরও ঈমাম সাহেবকে বাকি ঘটনাটা খুলে বলে। গতকাল বড় হুজুরের কাছে যাওয়া থেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ঘটা সব ঘটনা আবির ঈমাম সাহেবকে খুলে বলে। এরপর ঈমাম সাহেব কিছুটা হতাশ আর করুণ দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাঁকিয়ে বলেন:
-তুমিতো বেঁচে গেলে! কিন্তু তোমার পরিবারের বাকি সদস্যদেরতো আর ফিরিয়ে আনতে পারলে না! আমি ভাবছি এরপরে যে সকল পরিবার গুলো এখানে এসে সেই অভিশপ্ত কবরস্হানে তাদের পরিবারের সদস্যদের কবর দিবে তাদের কী হবে?! তাদের সাথেও তো ঠিক একই ঘটনা ঘটবে। তারাও প্রথমে আমাদের কারো কথা বিশ্বাস করবে না এবং পরে বিপদে পড়বে। কোনভাবে যদি এই কবরস্হানকে অভিশাপ মুক্ত করা যেতো! তাহলেই হয়তো সবচেয়ে ভালো হতো! তাহলে আর কোন নিরপরাধ প্রাণকে অকালে ওপারের দুনিয়ায় পাড়ি জমাতে হতো না!
ঈমাম সাহেবের কথা শুনে আবির কিছুক্ষণ নীরব থেকে এরপর ঈমাম সাহেবকে বললো:
-হয়তো এই কবরস্হানকে অভিশাপ মুক্ত করার একটা উপায় আমার জানা রয়েছে!
আবিরের কথাটা শুনে ঈমাম সাহেব পুরো আৎকে উঠলেন আর অবাক হলেন । এরপর অনেকটা কৌতুহলতা আর উদ্দীপনার সাথেই আবিরের কাছে জানতে চাইলেন:
-কী উপায় রয়েছে?! আর এই উপায় তুমি জানলে কী করে?!
এরপর আবির কিছুটা ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিলো:
-আমার বাবার লাশ এই কবরস্হানে কবর দেওয়ার পরেই তার আত্মা অভিশপ্ত হয়। আর এরপর যখন ঐ কবরস্হান থেকে তার লাশটা উঠিয়ে অন্য কবরস্হানে কবর দিলাম তারপরেই তার আত্মা মুক্তি পেয়ে গেলো! ঠিক একই ভাবে এই কবরস্হানে শখানেক শ্রমিকের লাশকে জানাজা ছাড়া, রক্তাক্ত অবস্হায় কবর দেওয়ার কারণে হয়তো তারা এখনো সেখানেই অভিশপ্ত হয়ে আটকে রয়েছে। তারা তাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিলেও এখনো তাদের আত্মা মুক্তি পায়নি। এখনতো আর কবর খুড়ে তাদের লাশগুলো পাওয়া যাবে না! তবে সেই শ্রমিকগুলোর শরীরের বিভিন্ন হাড় খুজে পাওয়া যেতে পারে! আমরা পুরো কবরস্হানটা খুড়ে সেই লাশগুলোর হাড়গুলোকে বের করে আমরা তাদের জানাজা পড়বো। এরপর ভিন্ন একটা জায়গায় তাঁদের হাড়গুলোর কবর দিবো। তারপর হয়তো সেই শ্রমিকগুলোর অভিশপ্ত আত্মা মুক্তি পাবে এবং এই কবরস্হানটাও অভিশাপ মুক্ত হবে!
আবিরের যুক্তিটা শুনে ঈমাম সাহেবের মুখে হাসি ফুটলো। সে বুঝতে পারলো যে আবিরের কথাগুলো পুরোপুরি ঠিক। সে ভাবতে লাগলো, আসলেই সেই শ্রমিক গুলোর সাথে অনেক বড় অন্যায় হয়েছিলো। তাই এখন তাঁদের কঙ্কালগুলোরও যদি জানাজা দেওয়া যায় তাহলেও হয়তো তাদের আত্মাগুলো মুক্তি পেতে পারে!
এরপর আবির এবং ঈমাম সাহেব সেই বড় হুজুরকেও গ্রামে আহ্বান করলেন। এরপর তাকেও এই আত্মাগুলোকে কিভাবে মুক্ত করা যায় এটা আবির গুছিয়ে বললো। আবিরের কথাটা সেই বড় হুজুরো পছন্দ করলেন। সেও তাদের সাথে একমত হলেন। এরপরে গ্রামের মানুষদের সাথে এই কথাগুলো আলোচনা করে তারা সবাই। গ্রামের সবাইও তাদের সাথে একমত হয়। এরপর তারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে , এই অভিশপ্ত কবরস্হানটা তারা পুরোটা খুড়বে। এই পর্যন্ত এই কবরস্হানে যাদের কবর দেওয়া হয়েছে সবার কঙ্কাল গুলোই উঠিয়ে আবার জানাজার নামাজ পড়াবে তারা!
যাতে করে আর অকালে কারো জানাজার নামাজ পড়তে না হয়!!
যেই কথা সেই কাজ। তারা তখন থেকেই সেই পুরো কবরস্হানটা খুঁড়া শুরু করে। এরপর সেই গণ কবরটাও তারা খুড়ে। এরপর সেই সব কঙ্কালগুলোকে তারা একত্রিত করে। এরপর ঈমাম সাহেব গ্রামের সবাইকে নিয়ে জানাজার নামাজ পড়েন! জানাজার নামাজের পর সেই সব কঙ্কালগুলোকে কাফনের কাপড়ে মোড়ে একটা নতুন কবরস্হানে কবর দেওয়া হয়।
আসলেই আবিরের ধারণাটা সঠিক হয়। এরপরেই সেই সকল শ্রমিকের অভিশপ্ত আত্মা গুলো মুক্তি পায়। সেই কবরস্হানও এই ভয়ংকর অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়। এরপরে সেই কবরস্হানটা আবার মেরামত করে সেই গ্রামের নতুন লাশদের কবর দেওয়া শুরু করে গ্রামবাসী। কিন্তু এরপর থেকে আর কোন গ্রামবাসী বা অন্য কোনো পরিবার আর এই ভয়ংকর অভিশাপের স্বীকার হয়নি! এরপর থেকে গ্রামের সবাই স্বাভাবিক ভাবেই দিন কাটাতে থাকে। এইদিকে আবিরও অনেক কষ্টে তার আপনজনদের স্মৃতি ভুলে আবার একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করে। যদিও এই অভিশাপে মারা যাওয়া আর কেউ এই পৃথিবীতে আর ফিরে আসেনি। তাও একটা সুন্দর সমাপ্তি ঘটে এই অভিশপ্ত কবরস্হানের।
********************************************* সমাপ্ত****************************************