সাভানাহ নদীর ধারের ওকভিলের বাড়িটায় থাকতেন ওয়ালসিংহাম নামের এক কৃষক। ওটা পড়েছে আমেরিকার জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে । ওয়ালসিংহাম মোটেই কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন না । কাজেই শুরুতে বাড়িকে ঘিরে যেসব ছোটখাট ঘটনা। ঘটতে লাগল, ওগুলোকে বদ প্রতিবেশিদের সাজানো নাটক বলে ধরে নিলেন। তবে যতই দিন গড়াতে লাগল অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। পরিবারের লোকেরা রাতে বিছানায় যেতে না যেতেই অত্যাচার বাড়ে। ঘরের দরজায় করাঘাত হয়, বেল বাজে আার বিনা কারণে চেয়ার উন্টে পড়তে থাকে । বাড়িতে একটা কুকুর আছে। বুদ্ধিমান ম্যাস্টিফ কুকুরটাকে সবাই ডাকে ডন সিজার নামে । এক দিন দেখা গেল হল ঘরে ঢোকার মুখের করিডোরে দাড়িয়ে প্রচও কেঁচাচ্ছে সে, রাগে শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেছে, আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দেয়ালের দিকে।
তারপরই লাফ দিয়ে সামনে এগুল । কিন্তু ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার করে মাটিতে পড়ল ওটা। মনে হলো যেন নিম্ভর এক জোড়া হাত তাকে ধরে আছাড় মেরেছে। পরীক্ষা করে দেখা গেল কুকুরটার ঘাড় ভেঙে গেছে।
এদিকে বাড়ির বিড়ালটার সঙ্গে যেন অশরীরীটার একটা চমকার বোঝাপড়া হয়ে গেছে। ঘর ঘর শব্দে আনন্দ প্রকাশ করে। সদরদরজা দিয়ে ঢোকে সে, মনে হয় যেন কোনো আগন্তুককে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে, যে তার পিঠে আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । তারপর দেখা যায় লাফিয়ে একটা চেয়ারে উঠে, আনন্দে তাতে শরীর ঘষছে ।
যতই দিন গড়াতে লাগল রাতের বেলা ততই বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগল অশরীরীটা। ওটার যন্ত্রণায় , ঘুমানো অসম্ভব হয়ে উঠল বাড়ির বাসিন্দাদের পক্ষে । কেঁচামেচি, গোঙানি, উৎকট হাসি, বীভৎস চিৎকার এমনই নানা শব্দে অস্থির হয়ে উঠলেন তারা । কখনো শব্দ আসে বাড়ির নীচ থেকে আবার কখনো শোনা যায় ছাদ থেকে । এক রাতে বাড়ির ছোট মেয়ে এমেলিয়া টয়লেটে গিয়েছে । হঠাৎ মনে হলো আলতো ভাবে একটা হাত রেখেছে কেউ তার কাধে । হাতটা মা কিংবা বড় বোনের মনে করে সামনে আয়নার দিকে তাকাল । কিন্তু সেখানে কারো প্রতিবিম্ব পড়ল না সে ছাড়া । কিন্তু চোখের কোন দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেল প্রশস্ত, পুরুষালি একটা হাত তার কাধের ওপর বিশ্রাম নিচ্ছে। মেয়েটির চিৎকারে বাড়ির বাকি সবাই ছুটে এল । কিন্তু তারা যখন এল হাতের কোনো চিহ্ন নেই ।
আরেকদিন হালকা বৃষ্টির পর মি. ওয়ালসিংহাম বাগানে হাটছিলেন। হঠাৎ পাশেই কারো পায়ের ছাপ নজরে পড়ল । খালি পায়ের একজন লোকের পায়ের ছাপগুলো এভাবে এগিয়েছে, মনে হয় অদৃশ্য কেউ তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই ওয়ালসিংহামরা বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কথাবাৰ্তা বলছিলেন। তবে এর মধ্যে এক রাতের একটা ডিনার পার্টির মাঝখানে এমন একটা ঘটনা ঘটল, স্থির সিদ্ধান্তে পৌছানো সহজ হলো তাদের জন্য । চড়া একটা গোঙানির শব্দ শোনা গেল ওপর থেকে । তবে এসব এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, ওয়ালসিংহামরা কিংবা তাদেরঅতিথিরা কেউই একে গুরুত্ব দিলেন না। কিন্তু তারপরই একজনের নজর পড়ল টেবিলের সাদা চাদরটার ওপর রঙিন একটা বিন্দু বড় হচ্ছে আস্তে আস্তে। মনে হচ্ছে যেন ছাদ থেকে ফোটায় ফোটায় কোনো তরল পদার্থ টেবিলটার ওপর পড়ছে ।
তরলটা দেখতে রক্তের মত হওয়াতে আতংক নিয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে রইলেন সবাই। দু-তিনজন লোকসহ মি. ওয়ালসিংহাম ওপরের তলার কামরাটার দিকে উঠে গেলেন, বীভৎস এই তরল পড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে। কামরাটায় ঢুকে যেখান থেকে তরল পড়ছে মনে হচ্ছে সেখানকার কার্পেট সরিয়ে নীচের কাঠের মেঝে উন্মুক্ত করলেন। জায়গাটা একেবারেই শুকনো, পাতলা ধুলোর আস্তরণ পড়ে আছে। কিন্তু নীচের টেবিলে রক্তের মত তরলটা ঝরে যাচ্ছে আগের মতই। একসময় টেবিলের ওপর গোলাকার একটা প্লেটের আকার নিল লাল পদার্থটা। তারপর বন্ধ হয়ে গেল, তরল পড়া। পরের দিন রসায়নবিদরা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন রঙিন তরলটা মানুষের রক্তই ছিল।
এরপর আর এই বাড়িতে থাকার মত অবস্থা থাকল না ওয়ালসিংহামদের। দেরি না করে পাততাড়ি গুটালেন তারা। এরপর রীতিমত বিখ্যাত তথা কুখ্যাত হয়ে গেল বাড়িটা। নানা জায়গা থেকে লোকজন আসতে লাগল ওটাকে দেখতে । তবে কেউই ওটাতে উঠতে রাজি হলো না। প্রথম যিনি এখানে রাত কাটানোর সাহস দেখালেন তিনি সাভানাহর হোরেস গান । বন্ধুরা বাজি ধরে, এই বাড়িতে তিন-চার ঘণ্টা থাকতে পারবেন না তিনি কোনোমতেই । আর তাদের শিক্ষা দিতে গিয়েই নিজের বিপদ ডেকে আনলেন ভদ্রলোক ।
পরদিন অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হলো গানকে । বেশ কষ্ট করে জ্ঞান ফিরানো হল তার। কিন্তু স্বাভাবিক হলেন না তিনি। বিছানায় পড়ে রইলেন । আর দুর্বল কণ্ঠে ঘোষণা করলন যদি আবার হাঁটা-চলা করার অবস্থায় ফেরেন তবে পৃথিবীর সব সম্পদ দিলেও ওই অভিশপ্ত বাড়িতে আর কোনো রাত কাটাতে রাজী নন। ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতাটা বলার মত সুস্থ হয়ে উঠলেন হোরেস গান।
অাঁধার নামার পর একটা কামরায় বাতি ধরানোর জন্য আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু দেখলেন সেটা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না । প্রতিবারই শীতল একটা দমকা হাওয়া ম্যাচের কাঠি নিভিয়ে দিচ্ছে। এসময় একবার তার ইচ্ছা হলো বাজি টাজির গুষ্টি কিলিয়ে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে । কিন্তু তারপরই মাথায় এল এতে বন্ধুদের কী পরিমাণ ঠাট্টা-মস্করা সইতে হবে তাকে। আর এটা মনে পড়তেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন ।
কিছুটা সময় নিরুপদ্রবে কাটল । এমনকী একটু তন্দ্ৰাভাবও চলে এল তার এসময়ই হঠাৎ বাড়ির নীচ থেকে জোর একটা চিারে সচকিত হয়ে উঠলেন। যন্ত্রণায় নাকি দ্রুদ্ধ হয়ে চিৎকারটা করেছে কেউ বুঝতে পারলেন না । তারপরই সিঁড়ি বেয়ে কারো ওঠা-নামার, আর এক কামরা থেকে আরেক কামরায় ছুটে বেড়ানোর পদশব্দ পেলেন । মোটামুটি ঘন্টাখানেক থাকল। আওয়াজটা। তারপর যেমন শুরু হয়েছে তেমনি হঠাৎ থেমে গেল। সব কিছু এখন একেবারে শান্ত । হোরেস গ্রেনের শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল । তারপরই তার উল্টো পাশের দেয়ালে সাদা একটা বিন্দু দেখলেন। ওটা বড় আর উজ্জ্বল হতে হতে সাদা আগুনের একটা চাকতির আকার নিল । ‘ তারপরই আতংক নিয়ে আবিষ্কার করলেন আলোটা আসছে একজন মানুষের মাথা থেকে। কিন্তু মাথাটার নীচে কোনো শরীর নেই । একজন মানুষের মাথা সাধারণত যে উচ্চতায় থাকে এই উচ্চতায় দেয়াল ঘেষে ধীরে ধীরে চলেছে ওটা। বিকট মাথাটা একজন বুড়ো মানুষের মনে হলো, যদিও ওটা নারীর না পুরুষের তা বোঝা মুশকিল। লম্বা, ধূসর চুল জবজব করছে, গাঢ় রক্তে। কপালের গভীর,দগদগে একটা ঘা থেকে বের হচ্ছে ওগুলো । গালগুলো বসা । গোটা চেহারাটা যেন অবর্ণনীয় কষ্ট আর যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি ।
চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে মুখটা । চোখের মণি জোড়া যেন তাকিয়ে আছে মি. গানের দিকে। আতংকে বাক্যহীন হয়ে পড়েছেন তিনি, এমনকী চিৎকার করে কেঁদে উঠতেও পারছেন না । একসময় মাথাটা অদৃশ্য হলো, তবে শব্দ চলতে লাগল মনে হচ্ছে যেন কয়েকজন লোক মিলে চিৎকার করছে আর এর চোটে বাড়িটা কাপতে শুরু করেছে। চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে গোঙানি আর চিৎকার । সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে কানে পীড়া দেওয়া বানঝন শব্দ। যেন ওপরতলা থেকে টিনের জিনিস টুড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে নীচে।
আর সহ্য করা সম্ভব না । এবার পালাতে হবে, ভাবলেন গান । অপার্থিব জিনিসগুলোকে এড়ানোর আশায় আস্তে আস্তে দেয়ালের পাশ ধরে এগুতে লাগলেন । দরজার কাছে প্রায় পৌছে গেছেন এমন সময় কে যেন’ৰ্তাকে পায়ের গোড়ালি ধরে মেঝেতে টুড়ে মারল। তারপর বরফশীতল এক জোড়া হাত চেপে বসল তার গলার ওপর । অদৃশ্য হামলাকারীর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মরণপণ লড়লেন গান। কিন্তু জোরে ওটার সঙ্গে পেরে উঠলেন না, উল্টো গলার ওপর চাপ বাড়ল ।
পরদিন সকালে হোরেস গানকে যখন বন্ধুরা খুঁজে পেল তখন তার গলা কালো হয়ে আছে, সেখানে ধারাল নখের লম্বা লম্বা আঙুলের ছাপও ফুটে আছে।
জর্জিয়ার এই বাড়ি নিয়ে আরো নানান রকম ভীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে মানুষের । কেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে মি. ওয়ালসিংহাম পরে মনে করতে পেরেছিলেন যখন প্রথম বাড়িতে আবাস গাড়েন তখন কিছু হাড়গোড় খুঁজে পেয়েছিলেন। তবে ওগুলো জন্তু-জানোয়ারের হাড় মনে করে ফেলে দিয়েছিলেন আস্তাকুঁড়ে । কারো কারো ধারণা ওই হাড়গুলোর মালিকের আত্মাই এখন এই বাড়িটায় এত সব কাণ্ড ঘটাচ্ছে । তবে তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার লোকেরও অভাব হয়নি । আর তাই জর্জিয়ার এই ভুতুড়ে বাড়ির রহস্যও ভেদ হয়নি।
******************************************(সমাপ্ত)*********************************