আমি যখন ছোট ছিলাম আমার কিছু অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। এমন কিছু আহামরি ক্ষমতা নয়, কিন্তু অলৌকিক ক্ষমতাগুলির উদাহরণ এরকম ঃ পরীক্ষার রেজাস্ট হবে, ক্লাসে দুরুদুরু বুকে সবাই বসে আছি। হেডমাস্টার ক্লাস টিচারকে সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষার রেজাল্ট বলতে এসেছেন। তাঁকে দেখেই কীভাবে যেন বুঝে গেলাম যে আমি পরীক্ষায় ফাস্ট হয়েছি। আমি মোটামটি ভালো ছাত্র, কিন্তু পরীক্ষায় ফাস্ট হবার মতো ভালো ছাত্র মোটেও নই। তাছাড়া পরীক্ষায় ফাস্ট হতে হলে পড়াশোনায় ভালো হওয়া ছাড়াও আরও নানারকম গুণ থাকতে হয়। হাতের লেখা ভালো হতে হয়, অঙ্ক পরীক্ষায় সরল অঙ্ক সবার শেষে স্পর্শ করতে হয়, পৌরনীতির মতো নীরস জিনিসটাও রীতিমতো শখ করে পড়তে হয় ইত্যাদি। সেরকম গুণাবলির কোনোটাই আমার নেই, তবু আমি ফাস্ট হয়ে গেলাম। হেডমাস্টার সত্যিই যখন আমার নাম ঘোষণা করলেন, সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, কিন্তু আমি একটুও অবাক হলাম না।
তারপর ধরা যাক আমার বন্ধু দেলোয়ারের কথা। তার বাসায় একদিন বেড়াতে গেছি। দেলোয়ারের বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। বাচ্চা হবে, তাই মায়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। তাদের বাসার সবাই এবং পাড়াপড়শি মিলে একদিন জল্পনা-কল্পনা করছে বাচ্চাটি ছেলে হবে না মেয়ে হবে সেটি নিয়ে। তার মাঝে আমিও উপস্থিত, আর হঠাৎ করে আমি বুঝে গেলাম যে, বাচ্চাটি মেয়ে। আলাপ-আলোচনা যখন খুব জমে উঠেছে, আমি তখন বলে ফেললাম, শিরি আপা আপনার মেয়ে হবে।
সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি তখনও জানতাম না সবাই চায় বাচ্চাটা ছেলে হোক। মেয়ে হবে বললে অনেক সময় মায়েরা বেশ রেগে যায়। একজন জিজ্ঞেস করল, তুমি কেমন করে জানো?
আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে তোতলাতে বললাম, আ-আ-আমি জানি। কমবয়সী আরেকটা মেয়ে ছিল, তার বিয়ে হয়েছে কি না। সেটাও আমি জানি না। আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমার কী হবে? ছেলে না মেয়ে?
আমি ভালো করে তার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম তারও মেয়ে হবে। বললাম, আপনারও মেয়ে হবে। তখন আরেকটা মেয়ে বলল, আমার কী হবে? আমি তার দিকে বেশ ভালো করে তাকালাম, তবু কিছু বলতে পারলাম না। বললাম, আপনার কিছু হবে না ।
ব্যাপারটা অনেকটা হাসি-তামাশার মতো ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে পরিবেশটা কেমন জানি থমথমে হয়ে গেল। তখনও আমি জানতাম না যে আসলেই এ মেয়েটির বাচ্চা হয় না, আর সেজন্যে তাকে ছেড়ে দিয়ে তার স্বামী আরেকটা বিয়ে করার পাঁয়তারা আমি যে দুজনকে বলেছিলাম তাদের মেয়ে হবে, সত্যিই তাদের মেয়ে হয়েছিল। কারও পেটে বাচ্চা থাকলে তাকে দেখে বলে দেওয়া বাচ্চাটি ছেলে না মেয়ে আমার জন্যে এত সহজ ছিল যে এ ব্যাপারে কারও মাথাব্যথা থাকতে পারে আমার বিশ্বাসই হতো না। আমি তাই নিজে থেকে কিছু বলতাম না, সেই ছোটবেলাতেই আবিষ্কার করেছি বড়রা কিছু কিছু জিনিস সহজ ভাবে নিতে পারে না।
আমি আরও কয়েকটা জিনিস বলতে পারতাম। যেমন আমাদের ক্লাসের মজিদের কথা। সে তার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবে, আগে কখনো গ্রামে যায় নি, তাই খুব উৎসাহ। যেদিন যাবে সেদিন তার সাথে আমার দেখা হলো আর তাকে দেখেই আমি বুঝে গেলাম তার সাথে এই আমার শেষ দেখা। সে কয়দিনের মাঝেই মরে যাবে। সত্যি সত্যি গ্রামের বাড়িতে মাছ ধরতে গিয়ে শিংমাছের কাঁটা থেকে ধনুষ্টংকার হয়ে মজিদ দুদিনের মাঝে মরে গেল। এসব ব্যাপার আমি কখনো কাউকে বলতাম না, ছোটবেলা থেকেই জানি বড়দের জানিয়ে লাভ নেই। জিনিসটা কেউ বুঝবে না, হয় হেসে উড়িয়ে দেবে, না হয় ধরে শক্ত পিটুনি দেবে।
আরও একটা জিনিস ছেলেবেলায় আমাকে খুব যন্ত্রণা করত। সেটা হচ্ছে ঘুমানোর সময় মানুষের কথা শোনা। ঘুমিয়ে পড়ার পূর্বমুহুর্তে যখন ঠিক জেগেও নেই আবার পুরোপুরি ঘুমিয়েও পড়ি নি, তখন আমি পরিষ্কার কথাবার্তা শুনতাম। কারা যেন আমার সাথে কথাবার্তা বলত। ব্যাপারটা যে অস্বাভাবিক হতে পারে আমি জানতাম না, ধরে নিয়েছিলাম অন্যেরাও নিশ্চয়ই শোনে। সেটাই হয়তো স্বাভাবিক, কাজেই সেটা জানিয়ে কী লাভ?
একবার শুধু অবাক হয়েছিলাম। আমাদের পরিচিত এক মেয়ে, অরু আপা শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দিল। হাসপাতালে নিয়ে গেছে, মরে-বাঁচে অবস্থা-রাতে ঘুমানোর সময় পরিষ্কার শুনলাম অরু আপা আমাকে বলল, ইকবাল, আমি কিন্তু গায়ে আগুন দিইনি। মা আমার গায়ে আগুন দিয়েছে। আমার ঘুম কেটে গেল। বুঝে গেলাম অরু আপা মরে গেছে। সাথে ছোট ভাই ঘুমাত, তাকে ডেকে তুলে বললাম, অরু আপা মরে গেছে।
সে বেশি গা করল না। পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে গেল। এমন বিচিত্র এ ঘটনার কথাও আমি কাউকে বলি নি। শুধু তার পর থেকে অরু আপার মাকে দেখলে আমার বুক দুরুদুরু করত। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, পাতলা ঠোঁটের সেই মহিলা নিজের মেয়ের গায়ে আগুন দিয়ে কেন মারলেন কে জানে!
যাই হোক, আমি আমার অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে বড় হচ্ছি। ঠিক জানি না ক্ষমতাটা কী এবং সেটা কেমন করে ব্যবহার করা যায়। তখন আমার বাবা বগুড়া বদলি হয়ে এলেন। আমাদের বাসা সূত্রাপুরে। পুরনো দালান, বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় ধসে পড়ে যাবে। ভিতরে তত খারাপ না। অনেক ঘর, আমি তখনই কোনার দিকে একটা ঘর আমার নিজের বলে দাবি করে দখল করে নিলাম।
ঘরটাতে অস্বাভাবিক কিছু থাকতে পারে আমার জানা ছিল না, কিন্তু আমি একটা অস্বাভাবিক জিনিস আবিষ্কার করলাম। আবিষ্কার হলো এভাবেঃ গরমের দিন, বাসায় তরমুজ আনা হয়েছে। ঠেসে তরমুজ খেয়েছি সারাদিন।
বিকেলে আমার ঘরে বসে একটা প্রজেক্টর তৈরি করার চেষ্টা করছি, তখন ভীষণ পেচ্ছাব ধরল, এই নিয়ে তৃতীয়বার। তরমুজ খেলে যে খুব ঘনঘন পেচ্ছাব ধরে তখনই আমি আবিষ্কার করলাম। আজকালকার দিনে বাসায় লাগানো বাথরুম থাকে, তখন ছিল না। বাসা থেকে দূরে গিয়ে কাজকর্ম সারতে হতো।
আমার ঘরের পেছনে গাছপালা। ভাবলাম জানালা দিয়ে কাজ সেরে ফেলি। যেই শুরু করেছি তখন দেখি বাড়িওয়ালার ছেলেটা ওপাশ দিয়ে হেঁটে আসছে। কাজেই পেচ্ছাব বন্ধ করে লাফ দিয়ে জানালা থেকে নামতে হলো। যারা পেচ্ছাব করতে করতে মাঝখানে বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন জিনিসটা কত কঠিন। আমি তখন আর ছুটে বাথরুমে যেতে পারি না, থাকতেও পারি না। কাজেই বাধ্য হয়ে ঘরের কোনায় বাকি কাজটুকু সেরে ফেলতে হলো। এক বালতি পানি এনে জায়গাটা ধুয়ে ফেলার আমার একটা সৎ উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু গরমের দিনে দেখতে দেখতে সবকিছু শুকিয়ে যাওয়ায় । সৎ উদ্দেশ্যটা কাজে লাগাতে পারিনি।
সেদিন গভীর রাতে আমাদের ঘম ভাঙল আমার বাবার চিৎকারে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তিনি চিৎকার করছেন, তাঁর পেটে ভয়ানক ব্যথা। আমরা দুই ভাই হারিকেন জ্বালিয়ে ছুটে গেলাম। গোপেন ডাক্তারকে ডেকে আনতে।
গোপেন ডাক্তার এসে কী একটা ইনজেকশন দিয়ে বাবাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। ডাক্তার চলে যাবার পর আমরা ক্লান্ত হয়ে শুতে গিয়েছি, ঘুম আসবে-আসবে করছে, হঠাৎ শুনলাম কে যেন ভারী গলায় বলল, থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলব হারামজাদা, আমার ঘরে পেশাব করিস?
আমি চমকে একেবারে লাফিয়ে উঠে বসলাম। সকালে উঠেই আমি এক বালতি পানি নিয়ে ঝাঁটা দিয়ে ঝেটিয়ে ভালো করে সারা ঘর ধুয়ে দিলাম। বাবার ঘুম ভাঙল দশটার দিকে-কোনো ব্যথা নেই। একেবারে পুরোপুরি সুস্থ মানুষ বাবার পেটব্যথার সাথে আমার পেছাব করার সত্যি কোনো সম্পর্ক আছে কি না জানি না। কিন্তু আমি ঘটনাটা কাউকে বললাম না। ভাইবোনদের মাঝে আমি নাকি একটু বোকা ধরনের, আমাকে নিয়ে প্রায়ই হাসাহাসি করা হয়, খামোখা তার সুযোগ করে দিয়ে কী লাভ? আমি নিজে অবিশ্যি এর পর থেকে খুব সতর্ক হয়ে গেছি, ঘরটা পারতপক্ষে ময়লা করি না।
ব্যাপারটা আমি ভুলে যেতাম, সেই বয়সে বেশি গুরুতর জিনিস মনে রাখার কথা না। কিন্তু এর মাঝে আরেকটা ব্যাপার ঘটল। হঠাৎ করে একদিন মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সন্ধ্যের দিকে বারকয়েক বমি করলেন, তারপর গা কাঁপিয়ে প্রবল জ্বর। মায়ের অসুখবিসুখ সাধারণত হয় না, কাজেই যখন তিনি অসুখে পড়েন । সারা বাসার সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়। শুধু আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেতে হয়, ভাত থাকে অর্ধাসিদ্ধ এবং ডাল । হলুদের জন্যে মুখে দেওয়া যায় না। বোনকে সেটা বলাও যায় না, কারণ সে কানে ধরে একটা চড় লাগিয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, মায়ের অসুখ হলেই আমার শুধু মনে হতে থাকে যে মা বুঝি এখন মরে যাবেন। পৃথিবীতে সব মাতৃহারা বাচ্চাদের কথা মনে পড়ে যায় আর আমার ইচ্ছে হয় ভেউভেউ করে কাঁদি।
মাকে দেখে গোপেন ডাক্তার ওষুধ দিয়ে গেছেন। মশারি ফেলে মা শুয়ে আছেন নিস্তেজ হয়ে। দেখে আমার প্রায় বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ করে আমার মনে পড়ল ঘরে পেশাব করেছিলাম বলে বাবার পেটে ব্যথা হয়েছিল। আবার কি ঘরে কেউ কিছু করেছে
আমি তখন-তখনই আমার ঘরে এসে হাজির হলাম। দরজা খুলতেই একটা পচা গন্ধ নাকে এসে লাগল। লাইট জ্বালিয়ে এদিক-সেদিক তাকালাম, হঠাৎ দেখি টেবিলের নিচে একটা মোটাসোটা হুদুর মরে পড়ে আছে। সম্ভবত বিড়াল মেরে এনে ফেলে রেখেছে। বড় বোনের আদরের বেড়াল, দুধভাত খেয়ে অভ্যাস, মনে হয় ইদুরে সেরকম রুচি নেই। খানিকটা খেয়ে চলে গেছে, শেষ করতে পারেনি। এখন পচা গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না। এরকম বিদঘুটে নোংরা জিনিস আমি নিজে কখনো পরিষ্কার করি না। দেখামাত্র চিৎকার করে একটা হই-হুলস্থূল লাগিয়ে দিই, তখন মা এসে কিছু-একটা ব্যবস্থা করেন। আজ অন্য ব্যাপার, সম্ভবত এটার জন্যেই মায়ের শরীর খারাপ। খবরের কাগজ দিয়ে ধরে আধ-খাওয়া হঁদুর বাইরে ফেলে এলাম, তারপর বালতি করে পানি এনে পানি ঝাঁটা দিয়ে ঘর পরিষ্কার করে দিলাম। বাসার সবাই আমাকে খানিকটা পাগলা গোছের বলে জানে, তাই কেউ বেশি অবাক হলো না।
রাত দশটার দিকে পা টিপে টিপে মায়ের কাছে গিয়ে দেখি। তিনি শান্তিতে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বর নেই। মনটা শান্তিতে ভরে গেল। পরদিন মা দিব্যি সুস্থ মানুষ, দেখে কে বলবে গতরাতে তাঁর এত শরীর খারাপ হয়েছিল। আমি এবারে আমার এত বড় আবিষ্কারটা না বলে পারলাম না, প্রথমে আমার বড় বোনকে একা পেয়ে তাকে বললাম, বড় আপা তুমি যদি কাউকে না বলো তাহলে তোমাকে একটা গোপন কথা বলব।
বড় বোন বলল, বিয়ে করে ফেলেছিস?
যাও তোমার খালি ঠাট্টা!
ঠিক আছে কাউকে বলব না, বল তোর গোপন কথা।
আমার ঘরটা যদি ময়লা থাকে তাহলে কারও-না-কারও অসুখ হয়।
বড় বোন শুনে দাঁত বের করে হেসে তখন-তখনই সবাইকে ডেকে বলল, তোমরা সবাই শুনে যাও। আমাদের ইকবাল পীর হয়ে গেছে! তার ঘর ময়লা হলে ঘরে আজাব নেমে আসে।
শুনে সবার সে কী হাসি! আমার এত রাগ হলো যে বলার নয়-ব্যাপারটা আর বুঝিয়ে বললাম না কাউকে। বড়দের বুদ্ধি কেন যে এত কম হয় কে জানে!
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আমার ঘরটাতে উৎসাহ কমে এসেছে, সেই বয়সে কোনো জিনিসেই একটানা উৎসাহ ধরে রাখা কঠিন। পাশের বাসায় একটা মিউজিয়াম দিয়েছি, তার জন্যে রাতদিন খোঁজাখুঁজি করে জিনিসপত্র জোগাড় করি। একটা গরুর খুলি জোগাড় হয়েছে, স্মশান থেকে মানুষের হাড় আনা যায় কি না তার চিন্তাভাবনা হচ্ছে। বিকেলে সবাই মিলে কাদায় গড়াগড়ি করে ফুটবল খেলি। রাতে মড়ার মতো ঘুমাই। একদিন কী মনে হলো দুপুরবেলায় আমার ঘরটাতে ঢুকেছি। অনেকদিন আসি না, অব্যবহারে ঘরটা শ্ৰীহীন হয়ে পড়ে আছে। ঘরের টেবিলে, গল্পের বইয়ে, অসমাপ্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ওপর ধুলার আস্তরণ পড়েছে। কী মনে হলো জানি না, অনেক সময় নিয়ে ঘরটা পরিষ্কার করলাম, বই গুছিয়ে তুললাম শেলফে, ঝাঁটা দিয়ে ধুলা ঝেড়ে দিলাম, অসমাপ্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র বাক্সবন্দি করলাম। সব শেষ করে যেই ঘর থেকে বের হব, হঠাৎ মনে হলো কে যেন আমার মাথায় হাত রেখেছে। আমি চমকে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখি অনেক লম্বা একটা মানুষ, একেবারে ছাদে মাথা ঠেকে গেছে।
চিৎকার করে ঘর থেকে বের হয়ে মায়ের কাছে যেতে যেতে আমার কাপড়ে পেছাব হয়ে গেল। বেশি ভয় পেলে মানুষ পেচ্ছাব করে দেয় কেন কে জানে!
এবারে কেউ এটা নিয়ে বেশি হাসাহাসি করল না। কী দেখে ভয় পেয়েছি সেটা মিথ্যা হতে পারে, কিন্তু ভয় যে পেয়েছি সেটাতো মিথ্যা নয়। মা আমাকে লবণপানি খাইয়ে অবেলায় গোসল করিয়ে দিলেন। রাতে আমাকে পাশে নিয়ে ঘুমালেন দুই রাত।
বড় বোন আশেপাশে কেউ না থাকলে আমাকে মুতুয়াল মিয়া বলে ডাকা শুরু করল। আমার মনে হতে থাকল পৃথিবী থেকে বড় বোন জাতীয় জিনিসগুলি উঠে গেলে মন্দ হয় না।
এরপর থেকে আমি পারতপক্ষে আমার ঘরে যাই না। হয়তো মাঝে মাঝে এক-আধবার যেতাম, কিন্তু যাই না তার আরও একটা কারণ আছে যেটা কাউকে বলিনি। এ ঘটনার কয়েক দিন পর চোখে ঘুম নেমে আসছে, হঠাৎ পরিষ্কার শুনলাম কে যেন বলল বোকা ছেলে, আমাকে ভয়ের কী আছে?
একেবারে লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি। চিৎকার দেব দেব করেও দিলাম না, ছোট ভাইয়ের একেবারে গাঘেষে শুয়ে রইলাম সারারাত। শুধু মনে হতে লাগল ছাদ খুঁয়ে গেছে এরকম লম্বা একজন মানুষ অন্ধকার ঘরে ঘুরঘুর করছে আমার জন্যে। সেই থেকে আমি আমার ঘর ছেড়ে দিলাম পাকাপাকিভাবে।
এরকম সময়ে আমাদের বাসায় এলেন শওকত মামা। মায়ের দূরসম্পর্কের ভাই। বাসায় কেউ বেড়াতে এলে আমাদের খুব মজা হয়। প্রথমত, কেউ খালিহাতে আসে না, মিষ্টি বা ফলমূল নিয়ে আসে। তারপর কয়েক দিন ভালো-মন্দ নানারকম খাওয়া হয়। শওকত মামার ব্যাপারটি অবিশ্যি অন্যরকম, প্রথমত, তিনি এলেন খালিহাতে। তারপর জানা গেল তিনি এখানে পাকাপাকি ভাবে থাকতে এসেছেন। আমরা আশেপাশে না থাকলে বাবা আর মা শওকত মামাকে নিয়ে গম্ভীর কথাবার্তা বলেন। বোঝা গেল তাঁরা ব্যাপারটি ঠিক পছন্দ করছেন না।
আপাতত তাঁকে আমার ঘরটি দেওয়া হলো। আমার ঘর আরেকজনকে দেওয়া হলো, তবু আমি আপত্তি করলাম না। আপত্তি করলেই যে সে আপত্তি শোনা হতো সেরকম কোন নিশ্চয়তা ছিল না। ঘরটার ওপর থেকে আমার মনও উঠে গেছে। আমি শওকত মামাকে সাবধান করে দিলাম, সুযোগ পেয়ে একদিন বললাম, মামা এই ঘরটা কিন্তু সব সময় পরিস্কার রাখতে হয়। ময়লা হলেই বাসায় কিন্ত অসুখ-বিসুখ শুরু হয়ে যায়। শুনে শওকত মামা হেসে বললেন, ও আচ্ছা বেশ, বেশ তাই নাকি? ভেরি গুড!
শওকত মামা মানুষটি খুব হাসি-খুশি, অনেক জায়গায়। ছিলেন, অনেক রকম অভিজ্ঞতা নানারকম গল্প করতে পারেন।
বাসার সবাই তাই শওকত মামাকে খুব পছন্দ করল, আমি ছাড়া। কী কারণে জানি না আমার লোকটাকে ভালো লাগল না, তাঁর দিকে তাকালে হাসি-খুশি চোখের ভিতর থেকে অন্য কীরকম একটা জিনিস যেন বের হয়ে আসে। শওকত মামাও আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। অন্য সবার সাথে কত মজা করে কথা বলতেন, কিন্তু আমার সাথে এমন ব্যবহার করতেন যেন আমি বাসার কাজের ছেলে।
শওকত মামা মানুষটি যে বেশি সুবিধের নয় সেটি বুঝতে পারলাম আরও কয়দিন পর। আমাদের বাসায় যে কাজের ছেলেটা ছিল সে একদিন বাবার পকেট থেকে দুটি দশ টাকার নোট সরিয়ে নিল। সে অবিশ্যি স্বীকার করল না, কিন্তু শওকত মামা বললেন, তিনি নিজে তাকে শোওয়ার ঘর থেকে গোপনে বের হয়ে যেতে দেখেছেন। অনেক রকম ধমকা ধমকি করার পরও ছেলেটা স্বীকার করে না। মামা তখন তাকে ধরে মারা শুরু করলেন। সে কী মার, ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হয়ে এলো! তবু মামা থামেন না। দেখে মনে হতে লাগল কাউকে মারতে মামার বুঝি এক রকমের আনন্দ হয়। অনেক কষ্টে তাঁকে থামানো হলো।
ছেলেটাকে তখন-তখনই বিদেয় করে দেওয়া হলো। একটা চোরকে তো আর জেনেশুনে বাসায় রাখা যায় না। আমার মনটা খারাপ হয়ে রইল কয়দিন। ছেলেটা সময় পেলে আমাকে তার গ্রামের নানারকম মজার মজার গল্প শোনাত-রহস্যময় সেই গল্প আর কে শোনাবে আমাকে ? এত সুন্দর গল্প করতে পারে যেই মানুষ, সে টাকা চুরি করে কেমন করে কে জানে।
এরপর আবার সপ্তাহ দুয়েক কেটে গেছে, কাজের মানুষ ছাড়া বাসায় খুব অসুবিধে। শেষ পর্যন্ত একজনকে পাওয়া গেল। সে আসার দুদিন পরের কথা। সকালে উঠে শুনি শওকত মামার খুব শরীর খারাপ, গভীর রাত থেকে প্রচণ্ড পেটে ব্যথা। গোপেন ডাক্তারকে ডাকা হয়েছে, মনে হয় হাসপাতালে নিতে হবে। শুনে আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, আমার ঘরটা নিশ্চয়ই ময়লা হয়েছে। সবাই আমার দিকে ভরু কচকে তাকাল। বড়বোন বাঁকা হাসি হেসে বলল, পীর সাহেব!
আমি তাদের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সোজা আমার ঘরটাতে গেলাম, বিছানায় শওকত মামা ছটফট করছেন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ লাল, দেখে চেনা যায় না। আমি বললাম, মামা, এই ঘরটা ময়লা হলেই বাসায় অসুখ হয়। কোনো কিছু কি ময়লা মামা কোঁ কোঁ করে কী বললেন, বোঝা গেল না।
আমি বললাম, আপনি শুয়ে থাকেন, আমি দেখি ময়লা কিছু আছে কি না। একবার বিড়াল একটা ইদুর মেরে রেখেছিল। ঘরটা মোটামুটি পরিষ্কারই। শওকত মামার জন্যে একটা চৌকি পাতা হয়েছে, চৌকির নিচে তাঁর সুটকেস, জুতা ইত্যাদি। আমি ভালো করে খুঁজে দেখলাম ময়লা কিছু নেই। ছোটখাটো যা ছিল আমি ঝেড়েপুছে বের করে নিয়ে এলাম।
আমি শওকত মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা আপনি কি কখনো ঘরের ভেতরে পেচ্ছাব করেছেন? অনেক সময় পাশে বাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন, প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বের করে দিলেন। কোনো মতে চোখের পানি সামলাতে সামলাতে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। বড়দের মতো হৃদয়হীন মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই।
দুপুরের দিকে শওকত মামাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেওয়া হলো। বাসায় মোটামুটি একটা থমথমে আবহাওয়া। তখন দ্বিতীয় দুঃসংবাদটি পাওয়া গেল। মায়ের সোনার বালাজোড়া খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মায়ের বেশি গয়নাগাটি নেই, এই বালা জোড়াই আছে। সেটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে । না, তার অর্থ খুব সহজ। বালাজোড়া চুরি হয়ে গেছে। প্রথম সন্দেহ স্বাভাবিক ভাবে হলো নতুন কাজের ছেলেটির ওপর। ছোট ছোট কুটিল চোখ, দেখলেই কেন যেন মনে হয় সে এ ধরনের কিছু-একটা কাজ করতে পারে। তাকে জেরা করা শুরু হলো। বলা বাহুল্যবলামাত্র সে প্রবল বেগে মাথা নেড়ে অস্বীকার করল। কপাল ভালো শওকত মামা নেই, তাহলে এতক্ষণে রক্তারক্তি শুরু হয়ে যেত ।
মায়ের বালাজোড়ার জন্যে বাসায় মোটামুটি শোকের ছায়া নেমে এলো। মা কিছু বলছেন না, কিন্তু তাঁর ফ্যাকাশে মুখ দেখে । আমার এত কষ্ট হলো বলার নয়! মনে মনে ঠিক করলাম যখন। বড় হব তখন মাকে দশ জোড়া মোটা মোটা সোনার বালা তৈরি করে দেব। বালা চুরির খবর পেয়ে পাশের বাসা থেকে মহিলারা চলে এলেন। কোথায় কোন পীর নাকি বাটি চালান দিতে পারে, তাকে খোঁজ দেওয়া যায় কি না সেটা নিয়ে আলোচনা হতে থাকল।
আমি এদিকে তখনও শওকত মামার ঘরের রহস্য ভেদ করা নিয়ে ব্যস্ত। মোটামুটি নিঃসন্দেহ ছিলাম যে ঘরে কিছু একটা ময়লা জিনিস রয়েছে যার জন্যে এসব হচ্ছে। শওকত মামাকে হাসপাতালে নেবার পর দ্বিতীয়বার তাঁর ঘরটা পরীক্ষা করতে গেলাম। তন্নতন্ন করে খুজেও কিছু পাওয়া গেল না। তোশক উল্টিয়ে দেখলাম, মশারির ওপর, বালিশের নিচে। শুধু সুটকেসের ভিতরটা দেখা বাকি। সুটকেস তালা মারা, তাই ভিতরে দেখা গেল না। এমন কি হতে পারে যে সুটকেসের ভিতরে কিছু একটা ময়লা জিনিস রয়েছে? সম্ভাবনা কম, কিন্তু হতেও তো পারে। হয়তো একটা আম রেখেছিলেন খাবেন বলে। পরে খেয়াল নেই, আমটা পচে গেছে, পোকা হয়ে গেছে।
এরকম কিছু হওয়া তো এমন কিছু অসম্ভব নয়-আমার নিজেরই হয়েছে। কিন্তু সেটা নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্যে সুটকেসটি খোলার কোনো উপায় নেই, সেটাই হয়েছে সমস্যাঠিক তখন আমার মাথায় হঠাৎ করে প্রচণ্ড বুদ্ধির একটা বিদ্যুৎঝলক হলো, পুরো সুটকেসটাই ঘর থেকে সরিয়ে নিলে হয়, তাহলেই তো বোঝা যাবে। আমি তখন-তখনই টেনে-হিচড়ে সুটকেসটাকে আমাদের শোওয়ার ঘরে নিয়ে এলাম।
সন্ধ্যেবেলা বাসায় মোটামুটি শোকের ছায়া। শওকত মামার জন্যে দুশ্চিন্তা না করে সবাই মনে হচ্ছে সোনার বালার জন্যে দুঃখ করছে। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, পুলিশ বলেছিল আসবে, এখনও দেখা নেই। বাটি চালান দিতে পারে। মানুষটির কাছে খোঁজ গেছে, ব্যস্ত মানুষ, আজ আসতে পারবে কি না সন্দেহ। সূরা নাসারা পড়ে ফু দিয়ে চাল খেতে দিলে চোর নাকি সেই চাল চিবাতে পারে না। বাসায় কাজের ছেলেটিকে সেরকম চাল চিবাতে দেওয়া নিয়ে জল্পনাকল্পনা হচ্ছে, এরকম সময়ে রিকশা করে মামা নামলেন। পুরোপুরি সুস্থ মানুষ, তার এগাল-ওগাল জোড়া হাসি। আমি চিৎকার করে বললাম, আমি জানতাম—
উত্তেজনা একটু কমে আসার পর একজন জিজ্ঞেস করল,
কী জানতি:
শওকত মামা ভালো হয়ে যাবেন।
কেমন করে জানতি?
আমার ঘরে খারাপ কোনো জিনিস থাকলে বাসায় অসুখ হয়।
শওকত মামা অবাক হয়ে বললেন, কী খারাপ জিনিস আছে ঘরে?
কিছু খুঁজে পাইনি, তার মানে নিশ্চয়ই আপনার সুটকেসের ভিতরে আছে।
শওকত মামা হঠাৎ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন, আমতা-আমতা করে বললেন, আমার সুটকেস? আ-আমার আমি একগাল হেসে বললাম, আপনার ঘর থেকে বের করে শওকত মামা ভয়ানক চমকে উঠে বললেন, কোথায়? কো-কো-কোথায় সুটকেস?
আমি টেনে-হিচড়ে শোয়ার ঘর থেকে সুটকেসটাকে নিয়ে এলাম। শওকত মামা একেবারে লাফিয়ে উঠে সুটকেসটা নিজের হাতে নিলেন।
আমি বললাম, আপনি ঘরে নেবেন না সুটকেসটা তাহলে আবার আপনার পেটে ব্যথা হবে। আগে খারাপ জিনিসটা বের করে নেন ভিতর থেকে।
বাসায় সবাই বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠল। বড় বোন বলল, মামা, খোলেন দেখি সুটকেসটা। পীর সাহেবের কথা সত্যি কি না। দেখি।
বাবা বললেন, মিষ্টিরিয়াস ব্যাপার। আগেও নাকি হয়েছে তার। খোলো দেখি সুটকেসটা।
শওকত মামা রক্তশূন্য মুখে আমতা-আমতা করে বললেন, কিন্তু চাবিটা-চা-চা-চাবিটা
বড় বোন সুটকেসটা একনজর দেখে বলল, এইটার চাবি তো সবার কাছে আছে। দাঁড়ান, নিয়ে আসি আমি।
শওকত মামা শুকনো মুখে ঢোঁক গিলে বললেন, কিন্তু মানে ইয়ে— আমার…
শওকত মামাকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি সুটকেসটা খুলতে চাইছেন না। বাবার একটু মায়া হলো, বললেন, থাক থাক, সবার সামনে খুলতে হবে না। কী-না-কী গোপন জিনিস আছে ভিতরে। যখন সময় হবে তোমার ঘরে গিয়ে খুলো। খুলে দেখে আমাদের বোলো।
শওকত মামা একেবারে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, ঠিক আছে দুলাভাই, বলব।
তারপর সুটকেসটা নিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। কাজটি ভালো করলেন না। আমার কেমন জানি একটা বাজে সন্দেহ হলো। বড়দের নিয়ে এরকম সন্দেহ করা ঠিক না। কিন্তু মনের ওপর তো আমাদের কোনো হাত নেই– সন্দেহ হলে আর কী করা যাবে? শওকত মামার সুটকেসের ভিতরে কিছু-একটা খারাপ জিনিস আছে, যেটা আমাদের কিছুতেই দেখাতে চান না। কী জিনিস সেটা? শওকত মামা যখন সুটকেস রেখে ঘর থেকে বের হলেন,আমি তীক্ষ চোখে তাঁর দিকে তাকালাম, আর হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম শওকত মামাও বুঝে গেছেন আমি কী সন্দেহ করছি।
রাতে খাবার পর শওকত মামা ঠিক করলেন তিনি কাজের ছেলেটাকে বালা চুরি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তাঁর জিজ্ঞাসাবাদের ধরন-ধারণই আলাদাবাসার পেছনে শিউলি গাছ থেকে একটা লম্বা ডাল ভেঙে নিয়ে এলেন। রক্তারক্তি একটা ব্যাপার হয়ে যেতকিন্তু মা খুব শক্ত গলায় বললেন যে ছেলেটির গায়ে হাত দেওয়া যাবে না।
শওকত মামা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনারা লাই দেন বলেই এরা এত সাহস পায়। চোরকে চুরি করতে দেবেন, তারপর তাকে বসিয়ে দুধকলা খাওয়াবেন, তাহলে এরা মাথায় উঠবে না তো কারা মাথায় উঠবে? ছোটলোকের জাত এরা আমি এই ফাঁকে শওকত মামার ঘরে চলে এলাম। বড় বোনের চাবিটি নিয়ে এসেছি, চট করে খুলে একবার দেখে নেব, কেউ বোঝার আগে।
সত্যি সত্যি চাবিটা দিয়ে সুটকেসটা খুলে গেল। ভিতরে উকি দিলাম আমি, জামা-কাপড়, মেয়েদের ছবিওয়ালা কিছু রংচঙে বই হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো, ঘুরে তাকিয়ে আমার রক্ত শীতল হয়ে গেল। শওকত মামা ঢুকেছেন ঘরে। আমাকে খোলা সুটকেসের সামনে দেখে তাঁর চোখগুলি একেবারে বাঘের মতো জ্বলে উঠল। হাতে শিউলির ডালটি ছিল, কাজের ছেলেটির ওপর ব্যবহার করতে পারেননি, সেটা তুলে অসম্ভব জোরে আমার পিঠে মেরে বসলেন। শপাং করে সেটা একেবারে আমার চামড়া কেটে শরীরের ভিতরে ঢুকে গেল।
গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে গেলাম-আমি সত্যিই তো একটা গুরুতর অন্যায় করেছি। আরেকজনের সুটকেস খুলেছি গোপনে। একজন চোরের সাথে আমার পার্থক্য কোথায়? কেমন করে করলাম এত বড় অন্যায় শওকত মামা এগিয়ে এসে আবার নৃশংসভাবে মারলেন ডালটি দিয়ে। যন্ত্রণায় চোখ ফেটে পানি বের হয়ে এলো আমার, তবু আমি শব্দ করলাম না। মুখ বুজে মার খেয়েও যদি ঘটনাটা অন্য সবার কাছ থেকে গোপন রাখা যায়।
শওকত মামা তখন এগিয়ে এসে আমার বুকের কলার চেপে ধরলেন, তারপর হ্যাঁচকা টান দিয়ে ওপরে তুলে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলেন, মুখের কাছে মুখ এনে হিংস্র স্বরে বললেন, সেয়ানা ছেলে-আমার সাথে রংবাজি করো, তোমার রং আমি বার করি দাঁডাও।
শওকত মামা তখন আমার গলা টিপে ধরলেন-দশ বছরের বাচ্চার কণ্ঠনালি চেপে ধরলে তার প্রাণ বের হয়ে যেতে পারে। আতঙ্কে এবার আমি চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হলো না। নিঃশ্বাস নেবার জন্যে হাঁসফাঁস করছি আমি-চোখের সামনে মনে হচ্ছে আঁধার হয়ে আসছে সব।
ঠিক সে সময় আমি একটা অদ্ভত জিনিস দেখতে পেলাম। শওকত মামার ঠিক পেছনে একজন লম্বা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি এত লম্বা যে তার মাথা ঠেকেছে ছাদে। মানুষটির চেহারা অদ্ভুত, কপালটা এঁচু হয়ে বের হয়ে আছে-এত উঁচু যে চোখ দুটি প্রায় ঢাকা পড়ে আছে। মানুষটির পরনে আলখাল্লার মতো সাদা কাপড় একেবারে মেঝেতে নেমে এসেছে।
আমি দেখলাম লোকটা আস্তে আস্তে হাত তুলে হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে শওকত মামাকে একটা চড় দিল। সেই চড় খেয়ে শওকত মামা প্ৰায় শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে ঘরের কোনায় ছিটকে পড়লেন। প্ৰচণ্ড শব্দে তাঁর মুখ দেয়ালে গিয়ে লাগল-এক ঝলক রক্ত বের হয়ে এলো তাঁর নাক দিয়ে। আমি মেঝেতে পড়ে বিস্ফারিত চোখে
তাকিয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম লম্বা মানুষটি একটুও না নুয়ে শওকত মামাকে তুলে আনল এক হাত দিয়ে, তারপর হাত ঘুরিয়ে
আবার প্রচণ্ড চড় মারল তাঁর মুখে। শওকত মামা শূন্যে উঠে গেলেন, ছাদে আঘাত খেয়ে টেবিলের ওপর পড়লেন প্রচণ্ড শব্দে লোকটা আবার হাত বাড়িয়ে তুলে আনল শওকত মামাকে, রক্তে মাখামাখি শওকত মামার মুখ, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি দেখলাম লম্বা মানুষটি আবার হাত তুলেছে। শওকত মামাকে মারার জন্যে। আমি আর পারলাম না-চোখ বন্ধ করে যত জোরে সম্ভব একটা চিৎকার করে উঠলাম। সাথে সাথে শুনলাম শওকত মামা আছড়ে পড়েছেন ঘরের কোনায়-ঝনঝন করে কী যেন ভেঙে পড়েছে সাথে সাথে বাসার সবাই ছুটে এসেছে আমার চিৎকারে।
দরজায় দাঁড়িয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভিতরে। শওকত মামার সামনের দুটি দাঁত ভেঙে গিয়েছে, রক্তে-মাখামাখি সেই মুখ দেখতে কী বিচিত্র দেখাচ্ছে! শওকত মামা উঠতে পারছিলেন না— হাত তুলে কোনোমতে আমার দিকে দেখিয়ে বললেন-ইকবাল-ইকবাল আমাকে মেরেছে।’
কেউ কোনো কথা বলল না অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। শওকত মামা গোঙাতে গোঙাতে বললেন, আর কেউ কি আছে ঘরে ইকবাল ছাড়া? আছে?
আমি মাকে ধরে হঠাৎ ভেউভেউ করে কেঁদে ফেললাম, মা আমাকে শক্ত করে ধরে রাখলেন। বাবা কী করবেন বুঝতে না পেরে শওকত মামাকে টেনে তুলতে গেলেন। কাপড় জামা ছিড়ে একাকার হয়ে গেছে, তাঁকে তুলতেই খেড়া পকেট থেকে চকচকে একটা জিনিস বের হয়ে এলো। গড়িয়ে গেল ঘরের কোনায় সবাই দেখলাম অবাক হয়ে-মায়ের সোনার বালা।
বড় বোন ফিসফিস করে বলল, দেখছ মা, মুতুয়াল পীর কেমন জাঁদরেল পীর!
***************************************(সমাপ্ত)**************************************