জ্যৈষ্ঠ মাস। স্কুল গ্রীষ্মকালীন ছুটি। পড়াশোনার খুব একটা চাপ নেই। তবে আমার লক্ষ্য এবার ক্লাসে রোল নম্বর এক করতেই হবে। সে জন্য নিয়মিত পড়াশোনা করতে হচ্ছে। আজ কেন যেন পড়তে একদম ভালো লাগছে না। বই খুললে আনমনা হয়ে যাচ্ছি। কলম দিয়ে লিখতে গেলে হাতের লেখাও ভালো হচ্ছে না। লাইন আঁকাবাঁকা হচ্ছে।
গরমে শরীর হাত-পা ঘেমে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ নেই। কী আর করব। রাগ করে বাংলা বইয়ের উপর ইংরেজি বই, ইংরেজি বইয়ের অংক বই রেখে গুনতে থাকি। খাতায় উপর খাতা সাজিয়ে রাখি। বই-খাতা কয়টা হিসাব করে জানতে পারলাম মোট পনেরটা।
বইয়ের উপর হাত রেখে চুপ করে বসে ভাবছি। শহরে থাকলে বিদ্যুতের আলো, ফ্যানের কৃত্রিম বাতাস আরো কত সুবিধা পেতাম। ওগুলো ভেবে আর আফসোস করে লাভ নেই। গ্রামের প্রকৃতিক আলো বাতাস আমার কাছে ভালো লাগে।
দুপুর বেলা। প্রচণ্ড রোদ। এই রোদে আম, কাঁঠাল সব পাকতে শুরু করেছে। হঠাৎ খালি গায়ে দীলিপ আমার সামনে এসে হাজির। ওকে দেখা মাত্র বললাম, কি রে দীলিপ, এত রোদ বাড়ি থেকে বের হয়েছিস। তোর বাবা-মা কিছু বলেনি?
দীলিপ বলল, ‘তোর কথা বললে সাত খুন মাফ আমার।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আমার কথা বললে সব অপরাধ মাফ!’
‘হ্যাঁ, সত্যি মাফ পাওয়া যায়। কারণ আমার বাবা-মা তোকে খুব বিশ্বাস করে।’
‘তাই? কোথাও যাবি? সেইজন্যই কি এসেছিস?’
দিলীপ ডান হাতটা উঁচু করে বলল, ‘চল কালী বাড়িতে। আম গাছের নিচে গিয়ে একটু বাতাস খেয়ে আসি।’
বললাম, ‘চল তাহলে, কী আর করা। দুজন বের হলাম। আম গাছে নিচে গিয়ে বসলাম। বসার কিছুক্ষণ পর গাছে থেকে দুইটা আম পড়ল, একটা কাঁচা আম আর একটা পাকা আম। আমি দৌড়ে দিলাম পাকা আমটার দিকে। দীলিপ ছুটল কাঁচা আমটার দিকে।
আম ধরতে গেলেই, তাজা মাগুরমাছের মাথা কেটে ছেড়ে দিলে যেমন লাফালাফি করে, গড়াগড়ি করে, আমটা তেমনি করছে। অথচ ঢালু জায়গা না। সমান জায়গায়। বুঝতে পারছি না। দুইজনের কেউ আম দুটা ধরতে পারছি না। গাছের দিকে তাকালাম, গাছে কেউ নেই, এমনকি একটা পাখি পর্যন্ত নেই। আম দুটা পড়ল কী করে। বাতাস নেই। আচ্ছা, পাকা আমটা না হয় এমনিতে পড়েছে। কিন্তু কাঁচা আমটা কেন পড়ল? আমি বারবার গাছের দিকে তাকাচ্ছি।
আমাদের গ্রামের গেছো বন্ধু গগন, গাছের ডালে বসে দুষ্টুমি করে মাঝে মধ্যে। আজও কি আমাদের সঙ্গে করেছে। গাছের ডালে তাকালাম, কেউ নেই। এই ভরদুপুরে মনে মনে খুব ভয় পাচ্ছি। কালী বাড়ি জায়গাটা এমনিতেই ভালো না, শুনেছি অনেকের মুখে। অমাবস্যা, পূর্ণিমা, সন্ধ্যা, দুপুর কে যেন বের হয়ে মানুষকে ভয় দেখায়। এমনকি রাস্তার মানুষের যাতায়াত বন্ধ করে দেয়।
কিছুক্ষণ পর দীলিপ বলল, ‘আমটা ধরেছি রে।’
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘এ দিকে আয়, পাকা আমটা ধরি। চেষ্টা করতে লাগলাম। অবশেষে আমটা ধরলাম। আমের ওপর হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে মোমবাতিতে যেমন আগুন দিলে গলে যায়, ঠিক আমার হাতটা লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমটা গলে গেল। আমের আটি নেই। এটা কী আঙ্গুর ফল। আমগাছে আঙ্গুর ফল ধরবে এটা অসম্ভব। আটি ছাড়া পাকা আম। নিশ্চয় রহস্য আছে!
দীলিপকে বললাম, ‘চল বাড়িতে যাই। অদৃশ্য কিছু একটা আমাদের পেছনে লেগেছে।’ দীলিপের সাহস আমার চেয়ে আরও দ্বিগুণ বেশি।
দীলিপ বলল, ‘ভয়ের কিছুই নেই। রাত তো না, দিন। সূর্যটা দক্ষিণ দিক থেকে তাপ ছাড়ছে। দেখি কে বের হয়।’
দীলিপের এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে গাছের থেকে একের পর এক পাকা আম পড়তে লাগল। অথচ গাছের পাকা আমের সংখ্যা খুবই কম। দুজন চুপ করে আম পড়া দেখছি।
দীলিপকে আবারো বললাম, ‘চল দীলিপ। ভালোই ভালোই এখান থেকে পালাই।’
দীলিপ সাহস করে বলল, ‘না, যাব না। এর শেষ না দেখা পর্যন্ত এখান থেকে যাব না। আমি গাছে উঠব। দেখি আছে কে।’
বললাম দেখ, গাছে যদি মানুষ থাকত, তাহলে নিচে থেকে ঠিক কি দেখা যেত। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা কর। তুই থাক, আমি চললাম।
দীলিপ আমার প্যান্ট টেনে ধরে বলল, ‘দাঁড়া আমগুলো কুড়াই, তারপর যাই।’
আগে জান বাঁচাই তারপর আম। চল, কথা শেষ করেই গাছের দিকে যেই তাকিয়েছি। দেখি লাল শাড়ি পরা বউ। কপালে লালটিপ, হাতে কাচের চুড়ি। দেখা মাত্র চিৎকার দিলাম, দীলিপ উপর দিকে তাকা। কে যেন বসে আছে। দীলিপ তাকাল দেখা মাত্র ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। দুজন দুজনের হাত শক্ত করে ধরলাম। কানে মুখে দৌড় দেওয়া কথা বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় গাছে থেকে শব্দ করে বলল, ‘তোমরা চলে যেও না সোনামনিরা। আমি তোমাদের কোনো বিপদে ফেলব না। আমাকে তোমরা চেনোনি। ভয়ের কিছুই নেই।’
আমরা মনে মনে উত্তর দিলাম, চিনি না।
গাছ থেকে আবার বলল, ‘আমি যদি পরিচয় দেই, তাহলে চিনতে পারবে আমাকে। তোমরা চলে যেও না। আমার কথা শোন। তোমাদের গ্রামের গণেশকে কি চেনো? আমি গনেশের বউ ছিলাম।’
দীলিপ হঠাৎ বলে উঠল, ‘ হ্যাঁ চিনি, গতবার দুর্গাপূজার সময় মাকে প্রশ্ন করেছিলাম, লম্বা মুখওয়ালা কে?’
‘মা উত্তরে বলে ছিল দুর্গাদেবীর বড় ছেলে গণেশ। ও আপনি সেই দেবতার বউ।’
গাছের বউটা হেসে দিয়ে বলল, ‘না, না আমি কোনো দেবতার বউ না। আমি পশ্চিমপাড়ার বলরামের বড় ছেলে গণেশের বউ, ওনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর থেকে আমাকে কেন যেন দেখতে পারে না, নেশা করে ঘরে ফিরত। আমি কিছু বললেই আমাকে মারধর করত। একদিন আমার বুকের মধ্যে লাথি মেরেছে। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তার কিছুক্ষণ পর আমি মারা যাই। সেই থেকে মন্দিরের এই আম গাছে আশ্রয় নিয়েছি। আমি বেঁচে থাকলে তোমাদের মতো আমার সন্তান হতো। আমার সামনে ঘুরত, খেলত, হাসত, এটা-ওটা দাবি করত। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার। আজ গাছে গাছে ঘুরে বেড়াই। যখন বেশি মন খারাপ হয়, তখন মানুষকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখাই। তোমাদের মতো ছোট ছেলেমেয়েদের দেখলেই মা ডাক শুনতে খুব ইচ্ছে করে আমার।’
মায়াবী কথা শুনে আমার ভয় কিছুটা কেটে গেল। আমি দীলিপের কানে কানে বললাম, ভয়ের কিছুই নেই। সন্তানহীনা নারীদের কি যে কষ্ট তা জানে আমাদের গ্রামের কালুর বউ। উনি মা ডাক শুনতে চাচ্ছেন মনে হয়।
বউটা বলল, ‘তোমরা কানে কানে কী বলছ?’
তাড়াতাড়ি বললাম, কিছুই না। বলছি, আপনি খুব ভালো।
‘আচ্ছা তোমাদের একটা কথা বলি। কথাটা যদি রাখো তাহলে আমি খুব খুশি হব।’
আমরা দুজন মাথা নাড়ালাম। বুঝতে পারল বলার জন্য অনুমতি দিলাম।
‘তোমরা আমার ধর্ম সন্তান হবে? আমার মা ডাক শোনার খুব ইচ্ছে। একটু মা ডাক দাও।’
আমরা দুজন খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমাদের মা তো বেঁচে আছেন। নিজের মা বাদ দিয়ে কেন ধর্ম মা বানাতে যাব।
দীলিপ আমার কানে কানে বলল, ‘শোন বিষয়টা আমরা তিনজন ব্যতিত কেউ জানবে না। আমরা যদি ওনাকে মা ডাক দিতে পারি, তাহলে ওনি খুশি হবেন। মা ডাক দেওয়া কোনো ব্যাপার হলো। মনে কর কোনো দেবতাকে মা ডাক দিচ্ছি। একজনের অভাব দূর করা এটা অবশ্যই ভালো কাজ। ধর্মের কাজ। আর ভালো কাজ করার মধ্যেই আলাদা একটা তৃপ্তি আছে।’
আমি আবার দীলিপের কানে কানে বললাম, বাড়িতে যদি জানে, কোনো ভূত-পেতনিকে মা বলে ডেকেছি তাহলে! বাড়িতে আর উঠতে দেবে না।’
দীলিপ বলল, ‘আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানবে না বিষয়টা।’
যদি জানে কেউ। তার চেয়ে না ডাকাই মনে হয় ভালো।
দীলিপ রাগে আমার কান ধরে বলল, ‘যদি না করি, ভূতটা রাগ করে আমাদের সব সময় ডিস্টার্ব করবে। এমনকি রাতে ঘুমের ঘরে মেরেও ফেলতে পারে।’
ভয় পেয়ে গেলাম। যদি সত্যি সত্যি তাই হয়। দীলিপকে বললাম, ‘যা মা বলে ডাকব। ’
বউটা বলল, ‘তোমরা কিছু ভাবছ? তোমরা শুধু একবার আমাকে মা বলে ডাকো।’
অবশেষে দুজন একসঙ্গে মা, মা বলে ডাক দিলাম। ভূতবউটা মহাখুশি হলেন।
খুশিতে বললেন, ‘তোমরা যখন যেখানে যে কোনো বিপদে পড়বে, তখন শুধু ধর্ম মা বলে দুইবার ডাক দিবে। আমি গিয়ে হাজির হব। বিপদ থেকে উদ্ধার করব। তোমরা বিভিন্ন জিনিস পাবে আমার কাছে থেকে। গাছের নিচে যখন শুধু তোমরা দুজন আসবে তখনই দেখা হবে।’
‘আচ্ছা মা। তাহলে আজ যাই।’
‘আচ্ছা যাও, আবার একটু মা ডাক দাও।’
তারপর মা ডাক দিয়ে চলে আসি আমরা।