ছোটমামার সঙ্গে রাতবিরেতে বাইরে কোথাও গেলেই কী সব বিদঘুটে কাণ্ড বেধে যায়। তাই ছোটমামা সাধাসাধি করলেও সন্ধ্যার পর তার সঙ্গে কোথাও যেতুম না। সে কলকাতায় যাত্রা দেখতেই হোক, কী মেলা দেখতেই হোক। অবশ্য সব সময় দোষটা যে ছোটমামারই, এমন কিন্তু নয়। কোথাও দিনদুপুরে গিয়ে কোনও কারণে ফিরতে সন্ধ্যা বা রাত্রি তো হতেই পারে। তখন কী আর করা যাবে?
তেমনই একটা রাতের বিদঘুটে কাণ্ডের কথা মনে পড়ে গেল। সেটা গোড়া থেকেই বলা যাক।
ঠাকুরদা সপ্তাহে তিনদিন দাড়ি কামাতেন। আর তাঁর দাড়ি কামাতে আসত ভোলারাম নরসুন্দর। ভোলারামকে নাপিত বললেই জিভ কেটে সে বলত, ছি-ছি! নাপিত বলতে নেই। নাপিত বললে কী হবে জানো খোকাবাবু? এই বয়সেই বড়বাবুর মতো তোমার গোঁফদাড়ি গজিয়ে যাবে। আমাকে বলবে নরসুন্দর। কেমন?
এই ভোলারামের অভ্যাস ছিল দাড়ি কামাতেকামাতে গাঁয়ের সবরকম খবর বলা। গাঁয়ের খবর ফুরিয়ে গেলে তখন সে অন্য গাঁয়ের নানারকম খবর বলা শুরু করত। ঠাকুরদা আরামে চোখ বুজে থাকতেন আর হুঁ দিয়ে যেতেন।
সেবার শরৎকালে এক রোববারের সকালে ভোলারাম ঠাকুরদার দাড়ি কামাতে এসেছে। উঠোনে পেয়ারাতলায় চেয়ারে বসে ঠাকুরদা পা ছড়িয়ে চোখ বুজে আছেন। ভোলারাম অভ্যাসমতো ঠাকুরদার গালে সাবান মাখাতে-মাখাতে বকবক করে চলেছে। দাড়ি কামানো হয়ে গেলে সে ঠাকুরদার গোঁফ ছাঁটতে কচি বের করল। তার খবরের এইখানটায় ছিল সিঙ্গিমশাইয়ের ঠাকরুনদিঘির মাছ। জেলেরা জালে একটা দশ কেজি মাছ তুলেছিল। মাছটার লেজের কাছে নাকি সিঙ্গিমশায়ের নাম লেখা। গাঁসুদ্ধু লোক ভিড় করে দেখতে গিয়েছিল।
এবার মাছের কথায় আরও কত খবর এসে গেল। গোঁফ ছাঁটা হয়ে গেলে আয়নায় গোঁফ দেখতে-দেখতে ঠাকুরদা বললেন, হ্যাঁ হে ভোলারাম! এরকম মাছের খবর তো দিচ্ছ। কিন্তু আজকাল আগের মতো বড়-বড় খয়রা মাছ দেখি না কেন? বড় খয়রা কেন, ছোট খয়রারও পাত্তা নেই।
ভোলারাম বলল, কী যে বলেন বড়বাবু? খয়রার পাত্ত থাকবে না কেন? আর ছোট খয়রা কী বলছেন, এই হাতের মতো বড়-বড় জ্যান্ত খয়রা বিক্রি হচ্ছে। দোমোহানির হাটে। বিলভাসানো জল টেনে নিচ্ছে মৌরি নদী। আর নদীর মুখে জাল পেতে বসে আছে জেলেরা। পেল্লায় সাইজের খয়রা জালে উঠছে। দেখলে চোখ জ্বলে যাবে বড়বাবু!
ঠাকুরদা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললেন, বলো কী হে! শুনেছি দোমোহানিতে হাট বসে বিকেলবেলায়। তিন মাইল মেঠো রাস্তায় পায়ে হেঁটে তোমার পেস্লায় সাইজের খয়রা আনতে যাবে কে?
ছোটমামা সবে তখন বাড়ি ঢুকছিলেন। তাকে দেখিয়ে ভোলারাম বলল, ওই তো! নান্টুবাবুকে পাঠিয়ে দিলেই হল। দুপুরে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যাবেন। পড়ন্ত বেলায় বিল থেকে মাছ আসতে শুরু করবে। সস্তার তিন অবস্থা বলে কথা আছে না? দশ টাকা কেজি দর হাঁকতে-হাঁকতে মেছুনিমাসিরা শেষ অবধি পাঁচ টাকায় দর নামাবে। অত খদ্দের কোথা?
ছোটমামার ডাকনাম নান্টু আর আমার ডাকনাম পুঁটু। ঠাকুরদার হুকুম না মেনে উপায় নেই। ছছাটমামা মুখ ব্যাজার করে ঘরে ঢুকলেন। বিকেলে স্কুলের মাঠে ক্রিকেটের টুর্নামেন্ট! আমিও মনমরা হয়ে গেলুম। একা-একা কি খেলা দেখতে ভালো লাগে?
ভোলারাম নরসুন্দর ছুরি-কাঁচি-নরুন গুটিয়ে ছোট্ট বাকসোতে ভরে আমার দিকে তাকাল। চোখ নাচিয়ে সে বললে,—পুঁটুবাবু! তুমিও মামার সঙ্গে যেও। দোমোহানির হাটতলায় ম্যাজিকবাজির তাঁবু বসেছে। কাটা মুণ্ডুর খেলা দেখলে তুমি একেবারে অবাক হয়ে যাবে। হ্যাঁ গো পুঁটুবাবু! দু-চোখের দিব্যি। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি, কাটামুণ্ডু কথা বলছে।
ঠাকুরদা সায় দিয়ে বললেন,বাঃ! এখন তো পুজোর ছুটি। পুঁটু! নান্টুর সঙ্গে দোমোহানি গিয়ে ম্যাজিক দেখে এসো। আমি বাড়তি টাকা দেব।…
পাড়াগাঁয়ের ছেলেদের পায়ে হাঁটার অভ্যাস তখনও ছিল। এদিকের লোকে দূরত্ব মাপতে কিলোমিটার বলত না। কিলোগ্রাম বা কেজি অবশ্য চালু হয়েছিল। কিন্তু মাইল বা ক্রোশ কথাটা চালু ছিল। তিন মাইল মানে দেড় ক্রোশ।
মাটির রাস্তা শরৎকালে মোটামুটি শুকিয়ে খটখটে হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও একটু কাদা আছে। দুধারে আদিগন্ত ধানক্ষেত। কখনও গাছপালার জটলা বা ঝোপঝাড়। দোমোহানির হাটতলায় পৌঁছে দেখি সত্যি ম্যাজিকের তাঁবু বসেছে। একটু পরেই মাইকে গানবাজনা শুরু হয়ে গেল। মনটা নেচে উঠল। খয়রা মাছ কিনেই ম্যাজিকের টিকিট কাটতে বললুম ছোটমামাকে।
ছোটমামা যেখানে মাছ বিক্রি হচ্ছিল, সেখানে গেলেন। হাটে বড্ড ভিড়। ছোটমামার কোমরের কাছে শার্টটা আঁকড়ে ধরেছিলুম, পাছে হারিয়ে যাই।
একটু পরে দেখলুম, ভোলারাম মিথ্যা বলেনি। খয়রা মাছগুলো তার হাতের মতো বড় না হলেও আমার হাতের সাইজ। দরাদরি করে ছোটমামা সাত টাকায় এক কেজি খয়রা কিনে থলেয় ভরলেন। তারপর ভিড়ের বাইরে গিয়ে তিনি বললেন, বুঝলি পুঁটু, দর আরও কমবে। কিন্তু আমারও যে কাটামুণ্ডুর খেলা দেখতে ইচ্ছে করছে। ওই শোন! কী বলছে ম্যাজিশিয়ান।
কালো প্যান্ট-কোট, শার্ট আর মাথায় টুপিপরা একটা লোক গেটের পাশে অঙ্গভঙ্গি করে চ্যাঁচাচ্ছিল,—আড়ম্ভ! আড়ম্ভ! একখুনি আড়ম্ভ হয়ে যাবে। আ–ড়— ম–ভো — ও—ও —ও!
আরম্ভ-কে আড়ম্ভ বলায় খুব মজা পাচ্ছিলুম। বললুম,—চলুন ছোটমামা। এখনই টিকিট কিনে সামনের সিটে বসে পড়ি। দেরি করলে পিছনে বসতে হবে।
ঠিক বলেছিস পুঁটু! বলে ছোটমামা মাছের থলেটা সাবধানে একটু গুটিয়ে নিয়ে দুটো টিকিট কাটলেন। তারপর আমাকে এক হাতে টেনে তাঁবুতে ঢুকলেন।
ভিতরে ঢুকে নিরাশ হলুম। কোনও চেয়ার-বেঞ্চ নেই। মেঝেয় শতরঞ্চি পাতা আছে, কিন্তু ততক্ষণে সামনের দিকটা লোকেরা ঠাসাঠাসি করে বসেছে। ছোটমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, কোনও মানে হয়? তোর না হয় হাফপেন্টুল। আমার যে ফুলপ্যান্ট! শোন! এই পিছনেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটামুণ্ডুর খেলা দেখব।
বাইরে সেই লোকটা, যাকে ম্যাজিশিয়ান ভেবেছিলুম, সে এবার চ্যাঁচাচ্ছে, কাটামুণ্ডু! কাটামুণ্ডু কথা বলবে,—এএ! আড়মভো-ও-ও-ও!
ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। ছোটমামা আর আমার পিঠ তখন তাঁবুর কাপড়ে ঠেকেছে। এতক্ষণে স্টেজের পরদা উঠল। তারপর দেখি, আমি ম্যাজিশিয়ানকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলুম। সে কোন পথে স্টেজে এসে দাঁড়িয়েছে ভেবে পেলুম না। সে বলল, আমি প্রফেসর বংকারাম হাটি। আমি বাগে পেলেই লোকের মাথা কাটি।
সবাই হেসে উঠল। সে বেশ মিল দিয়ে কথা বলছিল। আমিও হেসে অস্থির হচ্ছিলুম; দেখলুম, ছোটমামাও খুব হাসছেন।।
প্রথমে কয়েকটা আশ্চর্য ম্যাজিক দেখানোর পর ম্যাজিশিয়ান বলল,-এবার আমি সেরা খেলাটা দেখাব। কাটামুণ্ডুর খেলা। কাটামুণ্ডুর গলায় দেখবেন চাপ-চাপ রক্ত। খোকাখুকুরা ভয় পেলে চোখ বুজে থেকো। ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করলেই খেলা পণ্ড হয়ে যাবে।
এবার দুটো লোক একটা টেবিলের মতো জিনিস স্টেজে আনল। জিনিসটার চারদিকে কালো কাপড়ে ঘেরা। ম্যাজিশিয়ান বলল,—তাহলে কাটামুণ্ডুর খেলা শুরু করি। ওয়ান টু থ্রি!
অমনি দেখি, ওপরের অংশে কালো কাপড় পরদার মতো গুটিয়ে গেল। তারপর যা দেখলুম, আঁতকে উঠে ছোটমামাকে আঁকড়ে ধরলুম।
টেবিলের ওপর একটা মানুষের মুণ্ডু। গলার কাছে চাপ-চাপ রক্ত। কিন্তু মুন্ডুটা দিব্যি হাসছে। চোখ নাচাচ্ছে। এ তো ভারি অদ্ভুত!
ম্যাজিশিয়ান বলল,-অ্যাই কাটামুণ্ডু! তোর নাম কী?
কাটামুণ্ডু বিদঘুটে গলায় বলল,—ঘংঘাড়াম।
—ভালো করে বল!
-বললুম তো। ঘংঘাড়াম!
ম্যাজিশিয়ান হাসতে হাসতে বলল,—গলাকাটা তো? তাই বোঝা যাচ্ছে না। ওর নাম গঙ্গারাম। আচ্ছা বাবা গঙ্গারাম! তোর বাড়ি কোথায়?
—কাটিহাঁড়!
ম্যাজিশিয়ান লাফ দিয়ে সরে বলল, ওরে বাবা। এ যে বলছে কাটি হাড়। মানে হাড় কাটবে। অ্যাই গঙ্গারাম! ঠিক করে বল।
–কঁটিহাড়! কঁটিহাড়!
ম্যাজিশিয়ান কান পেতে শোনার ভঙ্গি করার পর হাসল,কাটিহার বলছে। বিহারে কাটিহার আছে না? সেই কাটিহার। তা বাবা কাটিহারের গঙ্গারাম, তোর মুণ্ডু কাটল কে?
কাটামুণ্ডু ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, বংকারাম!
ম্যাজিশিয়ান লাফিয়ে উঠল,ওরে বাবা! বংকারাম বলছে যে! আমিই তো বংকারাম! এক্ষুনি আমাকে পুলিশে ধরবে। ওরে! তোরা কাটামুণ্ডুকে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখ!
আবার কালো পরদাটা টেবিলের ওপর ঘিরে ফেলল। সেই লোকদুটো পরদা টেবিলটা স্টেজের পিছনে নিয়ে গেল।
দর্শকরা হাততালি দিল। ম্যাজিশিয়ান হাতে জাদুদণ্ড নিয়ে একটু ঝুঁকে দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করল।..
ম্যাজিক শেষ হওয়ার পর বেরিয়ে দেখি, হাট প্রায় শেষ হয়ে গেছে। মেছেমেছুনিরা পিদিম জ্বেলে তখনও মাছ নিয়ে বসে আছে। গ্যাসবাতি জ্বেলে বসে আছে কিছু পশারি। ম্যাজিক-দেখা লোকগুলো ছড়িয়ে পড়ল কে কোথায় কে জন। তবে মেছো-মেছুনিদের দিকে আবার ভিড় দেখলুম। ছোটমামা বললেন,একটু ভুল হয়ে গেছে, বুঝলি পুঁটু?
–কী ভুল ছোটমামা?
—এখন খয়রা মাছ কিনলে সস্তায় পেতুম। যাক গে। যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন আর ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই! কিন্তু—বলেই ছোটমামা থমকে দাঁড়ালেন।
জিগ্যেস করলুম,–কী হল ছোটমামা?
—আরেকটা ভুল করে বসে আছি রে পুঁটু! টর্চ আনিনি যে!
এতক্ষণে আমিও একটু ভাবনায় পড়ে গেলুম। ছোটমামার সঙ্গে রাতবিরেতে গেলেই কী সব বিদঘুটে কাণ্ড হয়। এতক্ষণ মনে ছিল না।
ছোটমামা বললেন, চাঁদ উঠতে দেরি আছে। অতক্ষণ অপেক্ষা করলে তোর ঠাকুরদার পাতে রাত্রিবেলা এই খয়রা মাছ পড়বে না। বরং এক কাজ করা যাক। হাটে দেখছিলুম, একটা লোক বেতের ছড়ি বিক্রি করছে। আয় তো দেখি। একটা ছড়ি-টড়ি সঙ্গে থাকলে সাহস বাড়ে। বুঝলি পুঁটু?
মাত্র দুটাকায় একটা বেতের ছড়ি পাওয়া গেল। ছাতার বাঁটের মতো বাঁকানো হাতল আছে। ছড়িটা বগলদাবা করে মাছভর্তি থলে ঝুলিয়ে ছোটমামা হাঁটতে থাকলেন। আমি তাঁর কাছ ঘেঁষে হাঁটছিলুম। কিছুক্ষণ চলার পর অন্ধকার স্বচ্ছ মনে হল। শরৎকালের আকাশে নক্ষত্ররা উজ্জ্বল হয়।
ছোটমামা একটু হেসে বললেন,-বুঝলি পুঁটু! ঠিক এমনি একটি ছড়ি সিঙ্গিমশাইয়ের আছে। দেখিসনি তুই?
বললুম, সিঙ্গিমশাই সবসময় ছড়ি হাতে নিয়ে হাঁটেন কেন ছোটমামা?
—ওটা স্টাইল! বুঝলি পুঁটু! সব মানুষ বুড়ো হলেই ছড়ি নিয়ে হাঁটে না। তোর ঠাকুরদা তো বুড়োমানুষ। তার হাতে ছড়ি দেখেছিস?
–না ছোটমামা!
—তাহলেই বুঝে দ্যাখ পুঁটু! সিঙ্গিমশাইয়ের ছড়ি হাতে হাঁটাটা আসলে স্টাইল! আমিও সেইরকম স্টাইলে হাঁটছি, দ্যাখ!
বলে ছোটমামা বাঁ-হাতে মাছের থলে নিয়ে ডানহাতে ছড়ির হাতল ধরে অবিকল সিঙ্গিমশাইয়ের মতো মাটিতে ছড়ির ডগা ঠেকালেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন।
একটু পরে দেখি, ছোটমামা মাটির রাস্তায় জোরে হাঁটতে শুরু করেছেন। আমি দৌড়ে তাঁর নাগাল পাচ্ছি না। রাগ করে চেঁচিয়ে বললুম,—ছোটমামা! অত জোরে হাঁটছেন কেন?
ছোটমামা সামনের দিক থেকে কেন যেন কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,আমি কি জোরে হাঁটছি রে পুঁটু? ছড়িটা আমাকে হাঁটাচ্ছে। মানে, ছড়িটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে! এই! এই ছড়ি! আস্তে আস্তে!
আমি যথাসাধ্য দৌড়ে গিয়ে বললুম,—ছোটমামা! ছোটমামা! আমি দৌড়ুতে পারছিনে।
—ওরে পুঁটু! ছড়িটা সর্বনাশ! এই! এই ব্যাটাচ্ছেলে! রাস্তা ছেড়ে এদিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?
বলে ছোটমামা চ্যাঁচাতে থাকলেন,—পুঁটু! পুঁটু! আমাকে ছড়িটা ধানক্ষেতের আলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রে!
ততক্ষণে পিছনে উঁদ উঁকি দিয়েছে আবছা, জ্যোৎস্নায় দেখলুম, ছোটমামা বাঁ-দিকে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে চলেছেন। চেঁচিয়ে বললুম,—ছোটমামা! ছড়িটা ফেলে দিচ্ছেন না কেন? এক্ষুনি ছড়িটা ফেলে দিন!
ছোটমামার করুণ চিৎকার শোনা গেল,—ওরে পুঁটু! ছড়ির হাত থেকে হাত ছাড়াতে পারছি না যে!
আতঙ্কে, দুর্ভাবনায় আমি এবার চেঁচিয়ে বললুম,ছোটমামা! গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুকে ডাকুন।
কথাটা আমার মাথায় কেমন করে এসেছিল কে জানে! আমার কথাটা শুনেই বাঁ-দিকে খানিকটা দূরে ধানক্ষেতের মধ্যে ছোটমামা এবার হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ওরে গঙ্গারাম! গঙ্গারাম তোর কাটামুণ্ডুটা নিয়ে আয় তো! ছড়ি ব্যাটাছেলের মুন্ডু কেটে তোর মতো করে ফেলবি গঙ্গারাম! ওরে কাটিহারের গঙ্গারাম। শিগগির আয়
রে!
তারপরই ছোটমামার হাসি শুনতে পেলুম। আবছা জ্যোৎস্নায় ছোটমামাকে হাসতে-হাসতে ফিরে আসতে দেখলুম। তিনি বলছিলেন—কেমন জব্দ? আঁ? গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুকে ডাকতে ছড়িটা আমার হাত থেকে খসে ডিগবাজি খেতেখেতে পালিয়ে গেল!
ছোটমামার প্যান্টের নিচের দিকটা শিশিরে আর ঘাসের কুটোয় নোংরা হয়ে গেছে। ভিজে জবজব করছে। তিনি আমার কাছে এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন, ওঃ, কী সর্বনেশে ছড়ির পাল্লায় পড়েছিলুম রে পুঁটু! ভাগ্যিস, তুই বুদ্ধি করে গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলি।
বললুম,—ছোটমামা! কিন্তু গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুকে ছড়ির ভূত অত ভয় পেল কেন?
ছোটমামা বললেন,বুঝতে পারিসনি পুটু? ছড়ির ভূত নিশ্চয় ম্যাজিকের তাবুতে গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু দেখেছিল।
এরপর ছোটমামা আমাকে মাছের থলে দিয়ে জুতোদুটো খুললেন তারপর প্যান্ট গুটিয়ে জুতো বাঁ হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকলেন। ততক্ষণে জ্যোৎস্না উজ্জ্বল হয়েছে। জিগ্যেস করলুম, ছড়িটা অমন করে আপনাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কেন?
ছোটমামা বললেন,—সেটাই তো বুঝতে পারছি না রে পুঁটু! ভূত কি ছড়ি হতে পারে? আমার মনে হচ্ছে, ওটা কোনও ভূতের ছড়ি! বুঝলি? ছড়িওয়ালা কোনও মরা মানুষের ছড়ি সস্তায় কিনে আমাকে বেচেছিল।
কথাটা বলেই ছোটমামা থমকে দাঁড়ালেন। জিগ্যেস করলুম,কী হল ছোটমামা?
—ওই দ্যাখ! দেখতে পাচ্ছিস? ছড়ি ব্যাটাচ্ছেলে আমাদের আগে-আগে খুটখুট শব্দ করে হেঁটে চলেছে।
ভয় পেয়ে বললুম,—ছোটমামা! ছড়ি হাঁটছে না। ভূত ছড়ি হাতে নিয়ে হাঁটছে।
এবার ছোটমামা হুংকার দিয়ে বললেন,আয় তত পুঁটু! দেখি ব্যাটাচ্ছলেকে। এখনও এত সাহস!
ছোটমামা বোকামিই করে ফেলতেন, কারণ ছড়িটা ডিগবাজি খেতে-খেতে তার দিকে আসছিল। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম,—গঙ্গারাম! গঙ্গারাম! তোমার কাটামুণ্ডু নিয়ে এসো শিগগির!
অমনি দেখলুম ছড়িটা পাশের ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে উধাও হয়ে গেল। ছোটমামা বললেন,ধ্যাত্তেরি! কথাটা আমার কিছুতেই মনে থাকছে না। পুঁটু। আমরা দুজনে এবার গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুর জয় দিতে-দিতে হাঁটি!
বলেই ছোটমামা স্লোগানের সুরে হাঁকলেন,–গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু কী? আমি চেঁচিয়ে বললুম,—জয়!
–গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু!
এমন স্লোগান ওই বয়সে কত শুনতুম, তাই চেঁচিয়ে বললুম,অমর রহে। অমর রহে।
-–গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু!
—জিতা রহে! জিতা রহে!
—কাটিহারের গঙ্গারাম কী?
—জয়!
বাড়ি ঢােকার মুখে ছোটমামা মুচকি হেসে বলেছিলেন, ভাগ্যিস ছড়ির ভূতটা প্রফেসর বংকারামের ম্যাজিক দেখতে ঢুকেছিল। নইলে তোর ঠাকুরদার খয়রা মাছ আর খাওয়া হতো না। কাটামুণ্ডু দেখে ভূতটাও ভয় পেয়েছিল।
কিন্তু ম্যাজিক দেখতে আমরা না ঢুকলে আমাদের দুজনের অবস্থাটা কী হতো, সেটা আর ছোটমামাকে বলিনি।