প্রতিবেশী

প্রতিবেশী

রুপমদের পাশের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। সকাল থেকেই পাশের ফ্ল্যাট থেকে নানারকম শব্দ আসছে । ফ্ল্যাটটা খালি পড়েছিল গত একমাস ধরে। হেনা বললো, ‘ ভালোই হলো, এখন আর আমাদের ফ্লোরটা খালিখালি লাগবে না। চলো আজ বিকালে দেখা করে আসি ওদের সাথে।’

বিকালে রুপম আর হেনা দুজনেই গেল নতুন প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করতে, কিন্তু পরে দুজনেরই মনে হলো এদের সাথে দেখা না করাই ভালো ছিল।

ওদের ফ্ল্যাটটা গুমোট আর কেমন যেন একটা বাজে গন্ধে ভরা। দিনের বেলাও ফ্ল্যাটটা অন্ধকার করে রাখা হয়েছে। ঘরের ভেতরে আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা স্বয়ং ফ্ল্যাটের মানুষগুলো।

রুপম যথেষ্ট আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করলো। তাদের সম্পর্কে যতটুকু বলা যায় বললো-তার আর হেনার দশ বছরের বিয়ে,তাদের সন্তান না হওয়া, তার ব্যাংকের চাকরি, হেনার কিন্ডারগার্টেনের চাকরি- সবই। কিন্তু ওদের মাঝে কোন আন্তরিকতা নেই, কেমন একটা আড়ষ্ট ভাব, দেখে মনে হচ্ছে অনেক কষ্টে কোন একটা ইচ্ছা দমন করে বসে আছে। চারজনের পরিবার ওদের, স্বামী, স্ত্রী, দুই ছেলে মেয়ে। ভদ্রলোকটি কি এক ব্যবসা করেন, তার স্ত্রী ঘর সামলান- এর বাইরে আর কোন কথাই জানা গেল না। রুপমের বারবার মনে হচ্ছিল পরিবারের সবাই ওদের দিকে কেমন লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে, ওদের চাহনিটা পছন্দ হচ্ছিল না ওর। কোনরকম তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে চলে আসল ওরা।

বাসায় এসে হেনা বললো,’ দেখলে, ওরা নামও বললো না ঠিকমতো।’ রুপম মাথা নেড়ে বললো,’ এদের এড়িয়ে যাওয়াই ভালো হবে।’

কিন্তু এড়াতে আর পারলো কই! ঐদিনের তিনচারদিন পর একরাতে রুপম আর হেনার ঘুম ভেঙে গেল একটা আর্তনাদ আর গোঙানির শব্দে। মনে হলো শব্দটা পাশের ফ্ল্যাট থেকে আসছে। ওরা দুজন খোঁজ নিতে গেল পাশের ফ্ল্যাটে।

ওরা দরজা খোলার পর হেনা জিজ্ঞেস করলো, ‘ ভাবি, সব ঠিক আছে তো? কেমন একটা চিৎকার শুনলাম আপনাদের বাড়ি থেকে?’ মহিলাটি বললো, ‘ কই, এরকম তো কিছু শুনিনি। আমরা তো ঘুমাচ্ছিলাম এতক্ষণ।’ ওদের দেখে অবশ্য মনে হলো না ওরা এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলেন।

এই ঘটনার কিছুদিন পর, একরাতে রুপমের ঘুম ভাঙালো হেনা।ভয়ে রীতিমতো কাঁপছে ও।

রুপম তাড়াতাড়ি উঠে জিজ্ঞেস করলো,’ কি হয়েছে? ‘

‘ ড্রয়িংরুমে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।’

রুপম তাড়াতাড়ি ড্রয়িংরুমে গেল।লাইট জ্বালিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না ও। কিন্তু কেমন একটা বাজে গন্ধ পেল নাকে, যেই গন্ধটা ও পেয়েছিল পাশের ফ্ল্যাটে বেড়াতে গিয়ে।

এরপর থেকে ওদের প্রায়ই মনে হয়, ওদের ফ্ল্যাটে রাত্রে কে যেন হাটাহাটি করে। মাঝে মাঝে একটা বাজে গন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায়না ওরা। রুপম বুঝতে পারেনা কেউ কিভাবে ওদের বাসায় ঢুকতে পারে? ঘুমানোর আগে দরজায় ভালোমতো তালা মেরে, জানালা লক করে ঘুমায় ওরা, কোন মানুষের ঘরের ভেতরে আসা অসম্ভব। কিন্তু কোন লাভই হয় না, মাঝরাতে ঠিকই পায়ের শব্দে ঘুম ভাঙে ওদের।

একরাতে রুপম জেগে উঠে দেখে, হেনা চুপচাপ বিছানায় বসে আছে। ওর চোখে পানি।
রুপম উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো,’ কি হয়েছে হেনা, কাঁদছো কেন তুমি?’

‘ একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছি।’
‘ কি স্বপ্ন?’

‘ দেখলাম আমার সামনে অদ্ভুত দুটো জন্তু দাঁড়িয়ে আছে, দেখতে মানুষের মতো কিন্তু মানুষ না। এর মধ্যে একটা জন্তু আরেকটাকে বললো, ‘ ছেলেটাকে নিবি, না মেয়েটাকে?’ দ্বিতীয়টা বললো,’মেয়েটাকে, এটার স্বাদই ভালো হবে মনে হচ্ছে।’ প্রথম জন্তুটা তখন হঠাৎ আমার হাতটা ধরে তাতে কামড় বসিয়ে দিলো।’

রুপম হাসতে হাসতে বললো, ‘ ধুরো বোকা, এতে কান্নার কি আছে? এরচেয়ে কত ভয়ংকর স্বপ্ন মানুষ দেখে…’
হেনা কিছু না বলে ওর হাতটা এগিয়ে দিলো। চাঁদের আলোয় রুপম দেখল, হেনার হাতে কামড়ের দাগ।রক্ত জমে কালশিটে পরে গেছে।

এর কিছুদিন পরই সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনাটি ঘটলো।

সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ করে রুপমের ঘুম ভেঙে গেল, এবং ঘুম ভাঙার সাথে সাথে ও বুঝতে পারলো, কেউ একজন ওর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ও তাড়াতাড়ি উঠে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালালো এবং যা দেখলো তাতে ভয়ে ওর নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।

ও দেখল ওর সামনে পাশের ফ্ল্যাটের ছোট মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে, ওর দিকে তাকিয়ে ভয়ঙকর ভাবে হাসছে। রুপম একটু সামলে নিয়ে কড়া গলায় বললো, ‘ এই মেয়ে, তুমি রুমে আসলে কিভাবে? ‘

মেয়েটা বললো,’ দেয়ালের ভেতর দিয়ে।’ বলেই হাসতে হাসতে ড্রয়িংরুমে চলে গেল। রুপম তাড়াতাড়ি ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখল, কেউ নেই।

রুপম তখনই পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিংবেল বাজালো। দরজা খুললেন মহিলা।

‘ ভাবি, আপনার মেয়ে কোথায়?’
‘ কেন, ওতো ঘুমাচ্ছে। আমরা সবাই ঘুমাচ্ছিলাম।’
‘তাহলে ও আমাদের ফ্ল্যাটে কিভাবে গেল?’
মহিলা হঠাৎ অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

রুপম ঠিক করলো, পাশের ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে কথা বলবে। ভদ্রলোক এখানে ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে অন্য জায়গায় থাকেন, তার বাড়ি রুপমের অফিসের কাছাকাছি। তার ভাড়াটিয়াদের যে সমস্যা আছে এটা তাকে জানানো দরকার, প্রয়োজন হলে রুপমই তার জন্য ভাড়াটিয়া খুঁজে দিবে।

পরদিনই অফিস ছুটির পর রুপম চলে গেল ভদ্রলোকের সাথে দেখা করতে। তাকে গিয়ে সরাসরি বললো, ‘আপনার ভাড়াটিয়াদের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।’

বাড়িওয়ালা বেশ অবাক হয়ে বললেন, ‘ কি ব্যাপার, বলুন তো?’

রুপম তখন সবকথা খুলে বললো তাকে। তিনি চুপচাপ সব কথা শুনে গেলেন, কিছু বললেন না। রুপমের কথা শেষ হলে তিনি বললেন, ‘ আমি যদি আপনাকে ভালোমতো না চিনতাম, তবে বলতাম আপনি নেশা করে এসেছেন।’
‘মানে?’

‘আমার বাসা আড়াই মাস ধরে খালি পরে আছে। আমি কোন নতুন ভাড়াটিয়া উঠাইনি।’

একটা ভয়ের শীতল স্রোত রুপমের মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল। ওর মনে হলো কোন একটা বিপদ ঘটে গেছে, খুব বড় বিপদ। হেনা বাসায় একা আছে, ওর আজকে ছুটি।

রুপম যে কিভাবে বাসায় পৌঁছালে তা সে বলতে পারে না। অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল বাজালো ও, কেউ দরজা খুললো না। শেষে জোরে জোরে দরজায় বাড়ি দিতে শুরু করলো। ওর চিৎকারে পুরো বাড়ির লোকজন জড়ো হয়ে গেল ওর ফ্ল্যাটের সামনে, এদের মধ্যে কেউ একজন পুলিশ নিয়ে আসলো। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ঢুকে গেল ভেতরে। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল পুরো ঘরের জিনিসপত্র লন্ডভন্ড হয়ে পরে আছে। হেনা নেই।

এরপর তিনবছরের মতো কেটে গেছে, হেনাকে আর পাওয়া যায় নি। ওদের পাশের ফ্ল্যাট থেকে নাকি মানুষের হাড় আর রক্ত পাওয়া গেছিল, কে ওখানে এসব রেখে গেছে কেউ বলতে পারে না। তদন্ত করে জানা গেল ওগুলো হেনার না।সবাই একবাক্যে স্বীকার করলো যে এই ফ্ল্যাটে কোন ভাড়াটিয়া উঠতে দেখেনি তারা।

রুপম এসব ব্যাপারের কিছুই জানে না। ও অবশ্য ওর চারপাশে ঘটা কোন কিছু নিয়েই এখন আর মাথা ঘামায় না, সারাদিন চুপচাপ বাড়িতেই বসে থাকে, কোন কিছুর দরকার পরলে কখনো সখনো বাইরে বের হয়। তবে মাঝে মধ্যে ও স্বপ্নে দেখে,হেনার নিথর শরীর পরে আছে, ওর চোখদুটো খোলা। আর চারটা ভয়ঙকর জন্তু ওকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে। রুপমের ঘুম ভেঙে যায়, সারারাত আর ঘুম আসে না ওর ।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত