সামনে বসা লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করছে শখের গোয়েন্দা সায়েম আহমেদ। লোকটা ধনী তা বুঝতে শার্লক হোমস হবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সায়েম এমন এক জিনিস দেখছে, যা বোঝার সাধ্য নেই শার্লক হোমসের ও। হোমসের কালচারে ওই জিনিসের অস্তিত্বই নেই। লোকটার হাত মেহেদি দিয়ে রাঙানো। পরিণত বয়সী পুরুষের হাতে মেহেদি মানেই সে সদ্য-বিবাহিত। এ ছাড়া তার বাঁ হাতের মধ্যমায় ঝকঝকে নতুন আংটি। ওটা ও নীরবে সাক্ষ্য দিচ্ছে বিয়ের। লোকটার নাম অনুপ হায়দার। গতরাতে সায়েমকে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে সে।
সাইকোলজিতে এম. এ করেছে সায়েম। বেশ কিছু জটিল রহস্যের সমাধান করেছে , ফলে বেশ নাম ও হয়েছে ওর। বাবার কাছ থেকে পেয়েছে বিপুল সম্পত্তি, তাই চাকরি না খুঁজে গোয়েন্দাগিরি শখটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়েছে, ফলে নানা কেস ও আসছে। আজকাল ভাবছে সায়েমঃ নেশাটাকে পেশায় পরিনত করলে ক্ষতি কী?
তিনটি কারনে এখন ও ওকে বলা যায় শখের গোয়েন্দা।
প্রথমতঃ সব কেস ও নেয় না, যে কেস গুলো ওর কাছে অসাধারন মনে হয়, শুধু সেগুলোই নেয়।
দ্বিতীয়তঃ কেস সলভ হবার আগে কোন ও পারিশ্রমিক নেয় না সায়েম।
এবং তৃতীয়তঃ কোন ও ধরাবাঁধা পারিশ্রমিক নেই ওর, কেউ না দিলে ও আপত্তি নেই।
গতরাতে যখন অনুপ হায়দার ফন করল, তেমন আগ্রহ দেখায়নি ও। প্রতিদিনই এ ধরনের অনেক কল আসে ওর কাছে। কিন্তু ফোনের অপর প্রান্তের লোকটা যখন মরিয়া হয়ে জানাল, এটা তার জীবন-মরন সমস্যা, তখন বাধ্য হয়েই তাকে আজ বাড়িতে আসতে বলল সায়েম।
মাত্র কিছুক্ষন আগে ওর স্টাডিরুমে এসে ঢুকেছে অনুপ হায়দার। কুশল বিনিময়ের পর দু,জনেই চুপ হয়ে গেছে। নীরবতার মাঝে লোকটাকে খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছে সায়েম ।
বয়স ত্রিশ হবে না, সম্ভবত আটাশ, সুদর্শন। সাধারন শার্ট ও প্যান্ট পরলে ও লোকটার আভিজাত্য প্রকাশ পাচ্ছে চেহারায়।
‘ সমস্যাটা সম্ভবত আপনার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী-কে নিয়ে, তাই না? ‘ লোকটাকে চমকে দেবার লোভ সামলাতে পারল না সায়েম।
ওর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, এতক্ষন সায়েমের স্টাডিরুমের বিশাল বইয়ের কালেকশন দেখছিল অনুপ হায়দার, অধিকাংশই সাইকোলজির ওপর। সায়েমের প্রশ্নটা যেন একটা ধাক্কা দিল তাকে। ‘ আপনি কীভাবে জানলেন? ‘ নগ্ন বিস্ময় প্রকাশ পেল গলায়।
বেশিরভাগ গোয়েন্দার মত সায়েম ও নাটকীয়তা পছন্দ করে। সাথে সাথে জবাব না দিয়ে সুইভেল চেয়ারটাতে হেলান দিল, ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। অনুপের কৌতূহল আর ও বাড়বার পর বলল, ‘ আপনার হাতের আংটি আর মেহেদি, কিছুদিন আগেই বিয়ে করেছেন। বোধহয় এক সপ্তাহ ও হয়নি। বিয়ের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই গোয়েন্দার কাছে ছোটাছুটি সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর সমস্যাই প্রকাশ করে না?আমি অবশ্য অনুমান করছি, নিশ্চিত নই।’
সমস্যটা কীভাবে বলব, বুঝতে পারছি না, ‘ ইতস্ততভাব অনুপের মধ্যে।
‘ শুরু থেকে বলুন, একেবারে ছোটবেলা থেকে। ‘
‘ আমার সমস্যার সাথে জীবনবৃত্তান্তের কোন ও সম্পর্ক নেই।’
‘ তবু ও বলুন। ছোট অনেক বিষয়ই বড় রহস্যের জট খুলতে সাহায্য করে। আপনার কাছে যেটা গুরুত্বহীন, সেটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।’
‘ নামটা তো আগেই বলেছি,’ শুরু করল অনুপ হায়দার, ‘ আমার বাবা নামকরা গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। আমাদের বাড়ি সাভারে, বাবাই তৈরি করেছিলেন বাড়িটা। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হলাম আমি। আমার দু’বছর বয়সে মা মারা যান, এরপর বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। বিয়েটা অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। একবছরের মাথায় আমার নতুন মা’র সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বাবার। আমার মা’র মত আমার। নতুন মায়ের স্মৃতি ও ঝাপসা আমার কাছে। এরপর বাবা আর বিয়ে করেননি। আমি পড়াশোনায় ভাল ছিলাম, দু’বছর আগে পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসার হাল ধরি।’ একটানা বলে থামল অনুপ কিছুক্ষনের জন্য। ‘ গতবছর আমার বাবা মারা যান……..’
শেষ বাক্যের পর আবার কিছুক্ষনের বিরতি।
বাবার সঙ্গে বোধহয় অনুপের বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল, বাংলাদেশে যেটা বিরল, ধারনা করল তারেক।
‘ বাবা মারা যাবার পর ও আমি ব্যবসাটা সামলে নিতে লাগলাম। কিছুদিন আগে সিদ্ধান্ত নিলাম, বিয়ে করব। ঘটকের মাধ্যমে মেয়ে দেখা চলল। চার-পাঁচটা মেয়ে দেখার পর একজনকে পছন্দ। হয়ে গেল। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে লাবন্য, এরপর গত ছয়দিন আগে আমাদের বিয়ে হল। কিন্তু….. ‘ বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস বেরুল অনুপের বুকের গভীর থেকে। ‘ কিন্তু বিয়েটা আমার জন্য অভিশাপ হয়ে এল, এমনই অভিশাপ, যার জন্য বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় আপনার কাছে ছুটে আসতে হল গেলে। ‘
‘ কেন, আপনার স্ত্রীর সমস্যাটা কী?
‘ সমস্যা হলো ও ডাইনী, রুপক অর্থে না, আসলে ও ডাইনী।’
‘ কী বলছেন আপনি! এতক্ষনে কেসটার প্রতি তৈরি হল সায়েমের।’
‘ হ্যা, লাবণ্য একজন ডাইনী। ‘
‘ কী দেখে মনে হল আপনার স্ত্রী একজন ডাইনী? ‘
‘ ব্যাপারটা বিয়ের প্রথম রাতেই পাই। বিয়ের মেহমানদের বিদায় করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়। যেহুতু আমি নিজেই আমার গার্ডিয়ান, সব ঝামেলা আমাকে পোহাতে হয়। তো সবাইকে বিদায় দিয়ে বাসর-ঘরে ঢুকি, আগেই বসে ছিল লাবণ্য।আমি গিয়ে দেখি মাথা নিচু করে বসে আছে। আমি পাশে গিয়ে বসতেই আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল, ঠিক। সেই মুহূর্তে আমার জীবন ওলট-পালট হয়ে গেল। দেখলাম। আমার। সত্রী একজন ডাইনীতে পরিণত হচ্ছে ধীরে ধীরে।
‘ চোখদুটো ধ্ক করে জ্বলে উঠল লাবণ্যের। কুঁচকে যেতে লাগল চামড়া। নিজের অজান্তেই প্রচন্ড এক চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। লাবণ্যের ফ্যামেলি এবং আমার কিছু আত্মীয় সেদিন আমার বাড়িতেই ছিল, জ্ঞান ফেরার পর দেখি সবাই ঘিরে রেখেছে আমাকে। আমার শাশুড়ি আমাকে জিজ্ঞেস করল, ” কী হয়েছে তোমার, বাবা?”
‘ আমি কি করে বলিঃ আপনার মেয়ে একটা আস্ত ডাইনী?
‘কাজেই বললাম, ” কিছু না, সারাদিনের ধকলে মাথাটা ঘুরে উঠেছিল। ”
‘দশ মিনিট পর সবাই বিদায় নিল আমার রুম থেকে, এরপর ভয়টা আর ও জেঁকে ধরল আমাকে। একটা ডাইনির পাশে আমাকে রাত কাটাতে হবে ভেবে হিম হয়ে গেল সারা গা।ছোটবেলা থেকে যথেষ্ট সাহসী আমি।তবু ও সে রাতটার পুরোটাই দঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে কাটিয়ে দিলাম লাবণ্যের পাশে শুতে, ঘুম হল ছাড়া-ছাড়া।
‘ পরের রাতটা আমার জন্য আর ও ভয় নিয়ে অপেক্ষা করছিল।
‘ বিয়ের পরদিন বাড়ি প্রায় খালি হয়ে গেল, সারাদিন কোন ও রকম কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যের পর থেকে ফিরে আসতে লাগল গতরাতের হিমভাবটা। সারাদিন লাবণ্যের সঙ্গে থাকলে ও একবার ও ওর দিকে মুখ তুলে তাকাইনি।
‘ রাতের খাবারের পর বড় অসহায় মনে হল নিজেকে, সারারাত লাবণ্যের সঙ্গে কাটাতে হবে ভেবে। তবু ও কিছু করার নেই তো, বাধ্য হয়ে আমার রুমে গেলাম। লাবণ্য আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল, আমি দায়সারা ভঙ্গিতে হুঁ-হাঁ করে এড়িয়ে গেলাম।কিছুক্ষন পর লাবণ্য লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল আমার পাশে। ঘুমাবার অনেক চেষ্টা করলাম, পারলাম না। পাশে জান্তব বিভীষিকা নিয়ে ঘুমানো সম্ভব? তবু ও নিশ্চল হয়ে পড়ে রইলাম।
‘একঘন্টা পরে দেখলাম , আস্তে আস্তে বিছানা ছাড়ছে লাবণ্য। ভাবলাম বাথরুমে যাবে।কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম , রুমের দরজা খুলছে। ও বেরিয়ে যাবার পর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি লাবণ্য আস্তে আস্তে ছাদে ওঠার সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে। বাকিটুকু দেখার আর সাহস হলো না। নিশ্চই ছাদে গিয়ে প্রেত-সাধনা করবে ডাইনীটা। এরপর থেকে আমার গোটা জীবনটাই পরিণত হলো দুঃস্বপ্নে।
লাবণ্যকে ডিভোর্স ও দিতে পারছি না। কোর্টে গিয়ে কি বলব, আমার স্ত্রী একজন ডাইনী? প্রমান করব কীভাবে?
এতক্ষন চুপচাপ শুনছিল সায়েম , অনুপ থামতে প্রশ্ন করল, ‘ব্যাপারটা আপনি এতটা নিশ্চয়তা দিয়ে কিভাবে বলছেন? আপনার ভুল ও তো হতে পারে। ‘
‘ ব্যাপারটা আমি একা দেখিনি, গত পরশু রহিম চাচা ও দেখেছে। ‘
‘ রহিম চাচা কে?’
‘আমাদের ম্যানেজার, বাবার আমল থেকে আছে।খুবই বিশ্বস্ত, তিনি নাকি গত পরশু লাবণ্যকে ডাইনীর রুপ ধরে ছাদে যেতে দেখেছেন।’
‘তখন আপনার স্ত্রীর কি চেহারা কি অস্বাভাবিক ছিল?’
‘ না বললাম না, ডাইনীর চেহারা ধারন করেছিল।’
‘ আপনি রহিম চাচাকে আপনার সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন?
‘হ্যা, বিয়ের পরদিনই সব খুলে বলি, তিনিই তো আপনার ঠিকানা দিয়ে এখানে আসতে বললেন আমাকে। ‘
‘ সবই তো শুনলাম, এখন বলুন, আপনি আমার কাছে ঠিক কি ধরনের সাহায্য চান?’
‘ আমি আর এভাবে থাকতে পারছি না। আপনি আমার বাসায় যাবেন এবং নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে দিয়ে আসবেন লাবণ্য মানুষ না, ডাইনী। লাবণ্য স্বাভাবিক মানুষ না হলে যেভাবেই ওকে ডিভোর্স দেব।’
সায়েম এত দিন খুন-জখম আর চুরির রহস্য ভেদ করেছে। তবে এ ধরনের আদি-ভৌতিক কেস এবারই প্রথম। এ কেসটা হাতছাড়া করবার প্রশ্নই আসে না। কাজেই বলল, ‘কবে যেতে হবে আপনার বাড়িতে?’
‘আপনি রাজি থাকলে এখনই , আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি, সমস্যা হবে না।’
‘আমি যেতে রাজি।’
মনে হল অনুপ হায়দার নামের মানুষটার বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেল। অসং্খ্য ধন্যবাদ আপনাকে মি.সায়েম। কিছু মনে না করলে আপনার পারিশ্রমিক মিটিয়ে দিতাম।’
‘এখনই কীসের পারিশ্রমিক? কেসটা আগে সলভ্ হোক।’
‘না মানে…… অ্যাডভান্স? ‘
‘ আমি কোন ও অ্যাডভান্স নিই না। আপনি বসুন, আমি তৈরি হয়ে আসছি।’
ঘন্টাখানেক পর সায়মের বাড়ির গাড়ি-বারান্দা থেকে বেরিয়ে এল ঝকঝঁকে একটা প্রিমিয়ো। সায়েমের মা কিছুতেই অনুপকে না খাইয়ে ছাড়লেন না। মা আর ছোট বোনকে নিয়ে সায়েমের সংসার। মারা গেছেন বাবা। অনুপের অস্তিত্ব জুড়ে যে বিপদ প্রকট হয়ে আছে তা নজর এড়ায়নি সায়েমের মা’র। আপন সন্তানের মতই যত্ন করে খাইয়েছেন অনুপকে। অনুপের তখন বেশ বেগ পেতে হয়েছিল চোখে জমে ওঠা কান্না আড়াল করতে।
অনুপ নিজেই ড্রাইভ করে এসেছিল সায়েমের বাসায়, এখন ও সে-ই চালাচ্ছে গাড়িটা। সিডি প্লেয়ার থেকে পুরনো দিনের একটা গান মৃদুলয়ে ভেসে আসছে, ‘ ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না।’
আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি নামলে পূর্ণতা পেত গানটা। গাড়িতে তেমন একটা কথা হলো না দু,জনের মাঝে। অপ্রয়োজনীয় টুকটাক দু’ একটা কথা। ঘন্টা দেড়েক পর সাভার বাজারে পৌঁছল ওরা, ওখান থেকে ডানে মোড় নিল গাড়িটা। দশ মিনিট যাবার পর বিশাল একটা দোতলা বাড়ির সামনে থামল টয়োটা প্রিমিয়ো। বাড়িটা ডুপ্লেক্স , বোঝা যায় বেশ রুচির অধিকারী মালিক। যদি ও বাড়িটা যথেষ্ট পুরনো, এরপর ও আধুনিক অনেক বাড়ির সাথেই পাল্লা দিতে পারবে।
গাড়ি থেকে নামল ওরা দু’জন। বাড়ির মূল দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সায়েম আগেই জেনেছে, বাড়িতে অনুপের স্ত্রী আর রহিম চাচা ছাড়াও একজন রাঁধুনি, পরিচারক আর ড্রাইভার থাকে, মাঝে মাঝে অনুপের আত্মীয়-স্বজন ও আসে। রাতে ও থাকে কখনও কখনও। তখন নীচতলার ঘর খুলে দেওয়া হয়। দোতলায় কয়েকটা গেস্টরুম থাকলে ও বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া অতিথিরা নীচের গেস্টরুমেই থাকে। আপাতত দোতলায় বাস করছে শুধু অনুপ আর লাবণ্য।
কলিংবেল টিপতে একজন সৌম্য চেহারার ভদ্রলোক দরজা খুলে দিল। মুখে মেহেদি রাঙানো চাপদাড়ি। নিশ্চয়ই রহিম চাচা।
আগেই ঠিক হয়েছে অনুপ আর রহিম চাচা ছাড়া কেউ সায়েমের আসল পরিচয় জানবে না। ওর পরিচয়ঃ ও অনুপের ঘনিষ্ট বন্ধু, কয়েক দিন থাকবে খাওয়া-দাওয়ার কোন ও ঝামেলা নেই, ওটা আগেই হয়েছে, সুতরাং রহিম চাচার সাথে কুশল বিনিময়ের পর সরাসরি দোতলায় চলে আসতে পারল সায়েম।
অনুপ নিজের রুমে উঁকি দিয়ে বলল, ‘ লাবণ্য তো ঘুমাচ্ছে, তুমি ও ঘুমিয়ে নাও কিছুক্ষণ, বিকেলে পরিচয় করিয়ে দেব। এসো, দেখিয়ে দিচ্ছি রুম।’
সম্মতি জানিয়ে অনুপের পিছু নিয়ে পাশের রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল সায়েম।ওদের সম্পর্ক ইতোমধ্যে মেনে এসেছে ‘তুমি’ – তে। এমনিতেও অবশ্য তুমি করে বলতে হত পরস্পরকে, যেহুতু সায়েম অনুপের বন্ধুর পরিচয়ে এসেছে এ বাড়িতে।
অনুপ দরজা খুলে দিতে ঢুকে পড়ল সায়েম গেস্টরুমে।
রুমটা খুব গোছানো।
‘ধন্যবাদ, তুমি ও একটু বিশ্রাম নাও গিয়ে, ‘অনুপকে বলল তারেক।
‘ আমার আবার বিশ্রাম,’ তিক্ত স্বরে বলল অনুপ, মুখেও তিক্ত একটুকরো হাসি।
‘ দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে, ম্যায় হুঁ না?’
কথাটা সায়েম রসিকতার সুরে বললেও দৃঢ় একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে ও। এর শেষ দেখে ছাড়বে। ‘ বাই দ্য ওয়ে, তোমার স্ত্রীর অনিদ্রা রোগ আছে?’
‘ না, বরং ঠিক উল্টো, খুব ঘুম কাতুরে মেয়ে। প্রতিরাতে আধঘন্টা প্রেত-সাধনা করার পর কড়া ঘুম দেয়। আবার দুপুরে খাবার পরে ও কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নেয়।ভ
‘হুম,ঃ গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল সায়েম।
‘আচ্ছা আমি আসি , বিকেলে দেখা হবে,’ বলে চলে গেল অনুপ।
অনুপ রুম ছাড়তে খাটে ওর মাঝারি আকারের ব্যাগটা খুলে বসল সায়েম। এক সপ্তাহ চলার মত সব জিনিসই নিয়ে এসেছে। কতদিন থাকতে হবে কে জানে!
ব্যাগ থেকে ছোট্ট নীল নোটবুকটা বের করল সায়েম। প্রতিটা কেসের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো লিখে রাখে এটায়। প্রথম কয়েকটা পাতা উল্টে একটা সাদা পাতায় চলে এল।
পৃষ্ঠার উপর শিরোনাম করলঃ ‘ডাইনী’।
নীচে কয়েকটা প্রশ্ন লিখলঃ
১। লাবণ্য কি সত্যি ডাইনী?
২। ডাইনী না হলে অনুপ কেন ডাইনী ভাবছে তার স্ত্রীকে? এটা কি হ্যালুসিনেশন?
৩। রহিম চাচাই বা কেন ভাবছে লাবণ্যকে ডাইনী? এটা ও কি হ্যালুসিনেশন?
৪। প্রায় অপরিচিত এক মেয়ের ব্যাপারে দু’জনের হ্যালুসিনেশন কতটা যৌক্তিক?
৫। অনিদ্রা রোগ না থাকা সত্ত্বে ও প্রতিরাতে লাবণ্য ছাদে গিয়ে কি করে? প্রেত-সাধনা (!)
এই প্রশ্নেগুলোর উত্তর জানতে পারলেই কেসটা সলভ হবে।
এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে বসল সায়েম।
প্রথম প্রশ্নঃ লাবণ্য কি সত্যিঈ ডাইনী?
এটাই সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন।
উত্তরটা জানা থাকলে তো কাজই হয়ে যেত।
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ লাবণ্য ডাইনী না হলে অনুপ কেন ভাবছে ক ডাইনী?
হতে পারে মেয়েটা আসলে ও ডাইনী।
আর যদি না হয়, তবে কি হ্যালুসিনেশন?
হ্যালুসিনেশন দুটো কারন এই মুহূর্তে মাথায় আছে সায়েমের।
প্রথমতঃ অনুপ মুখে বললেও লাবণ্য মেয়েটা আসলে অত সুন্দরী নয়, যা অনুপের অবচেতন মন মেনে নিতে পারছে না। ফলে উল্টো-পাল্টা দেখছে অনুপ। আরেকটা কথা হলো, অনুপ ফিজিক্যালি অক্ষম, এর ফলে ছুতোনাতা ধরে লাবণ্যকে ডিভোর্স দিতে চাইছে। অবশ্য এটা ও যুক্তিটা গ্রহনযোগ্য নয়।
প্রশ্ন নাম্বার তিনঃ রহিম চাচা কেন লাবণ্যকে ডাইনী ভাবছে?
এই উত্তরটা অবশ্য জানে সায়েম, রহিম চাচা গত পরশু লাবণ্যকে ডাইনী রুপে দেখেছে।
এখন প্রশ্ন হলোঃ রহিম চাচা এটা কেন দেখবে?
রহিম চাচাকে যতটুকু দেখেছে ও, মানুষটা মিথ্যে বলবার লোক নয়।
তা হলে কি তারটাও হ্যালুসিনেশন?
রহিম চাচার হ্যালুসিনেশন হবার কারনটা দুর্বোধ্য ওর কাছে।
চতুর্থ প্রশ্নঃ দু’ দু’জন মানুষ বাড়ির নববধূর ব্যাপারে এমন উদ্ভট এবং অসম্ভব ধারনা করবে কেন?
একটা ভিত্তি তো থাকা চাই, লাবণ্যকে কোন কারনে পছন্দ না হলে ও ডিভোর্স দেবার জন্য এমন অবাস্তব পথ বেছে নেবার কথা নয় কার ও।
প্রশ্নগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে সায়েমের মাথায়।
পাঁচ নাম্বার প্রশ্ন নিয়ে ভাবনার আগেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সায়েম আহমেদ।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙলসায়েমের। ঘড়ি তখন জানাচ্ছে, সময়টা সন্ধ্যা ছুঁই-ছুঁই। বিছানা থেকে নেমে আড়মোড়া ভেঙে দরজা খুলল সায়েম। হাসি-হাসি মুখ নিয়ে অনুপ দাঁড়িয়ে আছে। ‘ঘুম তো ভালই হয়েছে দেখছি ‘। ‘হুউউউম!’ আরেকটা আড়মোড়া ভেঙে গভীর ঘুমের ব্যাপারটা নিশ্চিত করল সায়েম, ‘ তুমি কী করলে এতক্ষন?’ ‘আমি আর কি করব, ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়লাম। ভাবছি, আজ থেকে রাতে ও লাইব্রেরিতে থাকব, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলব, বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছি। ভাল বুদ্ধি, তাই না?’ ‘ কম খারাপ নয়।’ ‘ তার মানে বেশি খারাপ?’ হেসে ফেলল অনুপ। ওকে হাসতে দেখে ভাল লাগল সায়েমের। সকালের সেই অসহায় ভাবটা এখন অনুপের ভিতরে নেই।বোধহয় ভরসা করতে শুরু করেছে সায়েমের ওপর। বলল, ‘ চলো, লাবণ্য চা নিয়ে অপেক্ষা করছে নীচে।’ ‘ তুমি যাও, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’ ‘তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু।’ হাত-মুখ ধুয়ে গায়ে শার্ট চাপিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল সায়েম। দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে চোখ চলে গেল ওর।
একটা ধাক্কামত খেল সায়েম। ডাইনিং টেবিলে বসে আছে লাবণ্য আর অনুপ। এতদূর থেকেও ওদের সম্পর্কের শীতলতা টের পেল। তবে ধাক্কা খেয়েছে অন্য কারণে। লাবণ্য ডাইনী হোক বা না হোক, চেহারা ঠিক অপ্সরাদের মতই। অপ্সরা কেমন হয় জানে না সায়েম, ওদের অস্তিত্ব আছে কি না তাও জানে না, তবে অপ্সরারা বোধহয় এমনই হয়। এত সুন্দর কোনও মেয়ের মধ্যে ভয়ঙ্কর কিছু বাসা বাঁধে কীভাবে, এই মেয়ে ডাইনী হয় কীভাবে…. ভেবে পেল না সায়েম। নেহাতই অন্যের স্ত্রী, নইলে এত সহজে চোখ ফেরাতে পারত কি না সন্দেহ আছে। সায়েম গিয়ে সামনে দাঁড়াতে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল অনুপ, ‘লাবণ্য, ও সায়েম, আমার একেবারে স্কুলজীবনের বন্ধু। খুব অন্তরঙ্গ। আর সায়েম, ও লাবণ্য। পরিচয়টা তো জানোই।’ কন্ঠস্বর আড়ষ্ট শোনাল অনুপের। নিচু গলায় সালাম দিয়ে লাবণ্য বলল, ‘কেমন আছেন।’ ‘ভাল, আপনি?’ জবাব দিয়ে প্রশ্ন করল সায়েম। ‘ভাল, ‘ ছোট্ট করে জবাব দিল লাবণ্য। সায়েম লক্ষ্য করল, স্বাভাবিক কথা বললে ও লাবণ্যের মধ্যে ওর প্রতি চাপা বিদ্বেষ প্রকাশ পাচ্ছে। স্বামীর বন্ধুর প্রতি লাবণ্যের রাগটার উৎস ধরতে পারল না সায়েম। নাকি প্রেতসাধনার মাধ্যমে সায়েমের পরিচয় আর এখানে আসার উদ্দেশ্য জেনে ফেলেছে লাবণ্য? সেক্ষেত্রে সর্বনাশ! চায়ের আসরটা জমল না, জমার কথা ও না। টেবিলে উপস্থিত তিনজনের
সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। সায়েমকে বিশ্বাস করে অনুপ কিন্তু লাবণ্যের প্রতি রয়েছে তার চরম অবিশ্বাস, যার সাথে মিশে আছে প্রবল ভয়। অনুপের প্রতি লাবণ্যের দৃষ্টিভঙ্গি এ মুহূর্তে পরিষ্কার নয় সায়েমের কাছে।তবে ওর নিজের উপর আক্রোশ আছে ওই মেয়ের মনে। বিব্রতকর পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছে অনুপ। চা শেষে করেই বলল, ‘চলো, সায়েম, এলাকাটা তোমাকে ঘুরিয়ে দেখাই।’ ‘হ্যা, চলো, আসি, পরে আবার কথা হবে,’ শেষের লাবণ্যকে উদ্দেশ্য করে বলল সায়েম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথম কথাটা সায়েমকেই বলল, ‘তোমার স্ত্রী বোধহয় আমার আসার উদ্দেশ্যটা জেনে
গেছে।’ ‘জানবেই তো, ডাইনী না?’ অনুপের কথাটাকে আমল দিল না সায়েম। ‘রহিম চাচা আমার কথা বলে দেয়নি তো লাবণ্যকে?’ ‘না-না, রহিম চাচাকে আমি নিজের চাইতেও বেশি বিশ্বাস করি।জানি, উনি বলবেন না কিছুই।’ এরপর নীরবে কিছুক্ষন হাঁটল দু’জন। এলাকাটা খুব সুন্দর। না-গ্রাম, না-শহর। হাঁটতে-হাঁটতে একটা বিশাল মাঠের কাছে চলে এসেছে ওরা। কিছুক্ষন পরেই ঘনিয়ে আসবে সন্ধ্যা। পৃথিবী এখন লাল, রাতের কালিমা গ্রাস করতে চাইছে সন্ধ্যার লালিমাকে। বেশ কিছু ছেলে মাঠের মাঝে জড় হয়ে বসেছে, খেলা শেষ হলেও মাঠের শীতল বাতাস ছেড়ে যেতে চাইছে না কেউ। কিছুক্ষন পর পর শরীর জুড়ানো বাতাসের এক একটা ঝাপ্টা আছড়ে পড়ছে গায়ে। অসাধারন সব মুহূর্ত । এখন অনুপের পাশে ওর পরিবর্তে লাবণ্যের থাকা স্বাভাবিক ছিল, ভাবল সায়েম। ওরা মাঠের ধারে ঘাসের বুকে বসে পড়ল। ‘আজ থেকেই তদন্ত শুরু করে দেব ভাবছি, ‘বলল সায়েম। ‘কীভাবে শুরু করতে চাও?’ ‘তোমাদের বাড়িতে যারা থাকে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করব।’ ‘তার কি প্রয়োজন ?
লাবণ্যের সমস্যার সাথে ওদের কী সম্পর্ক?’ ‘আছে, তুমি বুঝবে না, কার কথা থেকে কী বেরিয়ে আসবে আমরা কেউ তা জানি না।’ ‘ঠিক আছে, বাসায় পৌঁছে এক এক করে সবাইকে তোমার রুমে পাঠিয়ে দেব।’ ‘মাথা খারাপ! ও কাজটা ভুলেও করো না। লাবণ্যকে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে দেয়া যাবে না। আমিই সময়-সুযোগ বুঝে সবার সাথে কথা বলব। তোমাকে জাস্ট জানিয়ে রাখলাম, রহিম চাচাকে দিয়ে শুরু করব।’ ‘ওহ হো, সেটা তো সম্ভব নয়। আজ বিকালে মাল শিপমেন্ট করতে চিটাগং গেছে রহিম চাচা, ফিরতে ফিরতে পরশু।’
‘আচ্ছা, সমস্যা নেই, একটু বিরতি দিল সায়েম।
‘ভাল কথা, রহিম চাচা বিয়ে করেননি?’
‘করেছে, স্ত্রী-সন্তান থাকে কুমিল্লায়, চাচা প্রতি সপ্তাহে একবার গিয়ে দেখে আসেন। আমি এখানে ওঁদের নিয়ে আসতে বলেছিলাম, রাজি হননি।’ কিছুক্ষন নীরবতায় কাটল, একটু পর সায়েম বলল, ‘ইয়ে…. মানে……একটা প্রশ্ন করতাম।’ ইতস্ততভাব ওর মধ্যে।
‘কী জানতে চাও, বলে ফেলো।’
‘তোমাদের মাঝে কি ফিজিকাল রিলেশান হয়েছে? ‘
‘ পাগল নাকি তুমি? ওকে দেখলেই তো একশ’ হাত দুরে থাকি।’
‘আরেকটা প্রশ্ন করতে চাইছি, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড।’
‘শিয়োর।’
‘তুমি কি ব্যাপারটাতে সক্ষম? ‘
‘পুরোমাত্রায়।’ সলাজ হাসি হাসল অনুপ। লজ্জা কাটানোর জন্যই বোধহয় বলল, ‘চলো ফেরা যাক, রাত হয়ে যাচ্ছে। ‘
‘চলো, ‘বলে উঠে দাঁড়াল সায়েম।
আকাশ থেকে দিনের শেষ আভাটাও অদৃশ্য হয়েছে। বিকেলের চায়ের আসরের কথা মনে আছে সায়েমের। তাই অনুপকে বলে রাতের খাবার ওর রুমে পাঠাবার ব্যবস্থা করল। এতে কাজ হবে আরেকটা। খাবার যে নিয়ে আসবে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে ও।
শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিল সায়েম। খাবার নিয়ে এল বাইশ-তেইশ বছরের একটা ছেলে।,
আগেই সায়েম জেনেছে এই ছেলেটা বাড়ির মোটামুটি সব কাজই করে। তবুও জানতে চাইল ও,
‘নাম কী তোমার?’ ‘মামুন’। খাবার সাজাতে-সাজাতে ছোট করে জবাব দিল ছেলেটা।
‘দেশের বাড়ি কোথায় ‘?
‘নরসিংদী। ‘ ‘তাই নাকি!
‘ সায়েম এমন ভাব করল, যেন নরসিংদী বাড়ি হওয়া দারুন ব্যাপার। ‘খুব সুন্দর জায়গা,
‘যদি ও জীবনে ওখানে যায়নি, তবু বলল। তবে কৌশলটা কাজে লাগল। প্রভাবিত হলো মামুন। ‘নরসিংদী গেছেন আপনি? কোথায়? দেওভোগ? আমাদের বাড়ি কিন্তু দেওভোগ।
‘হু, ‘ অবলীলায় মিথ্যে বলল সায়েম, মামুনকে আর কোন ও প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে জানতে চাইল, ‘এবাড়িতে কতদিন হলো আছ? ‘
‘এই তো দেড় বছর। আগে গুলশানে ছিলাম। মালিক ফালতু লোক ছিল।’ ছেলেটা বড় বেশি কথা বলে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদাত করতে হবে। ‘ তোমার এখনকার মালিক কেমন? ‘ ‘কে, অনুপ স্যার? খুবই ভাল, ওনার বাবাও ভাল ছিল।আমি আসার ছয় মাসের মাথায় মারা যায়। ‘ ‘তোমার বোধহয় অনেক কষ্ট হয়, তাই না? বড়লোক মানুষের বাড়িতে কাজ করো। নিশ্চয়ই ক’দিন পর পর বাড়িতে পার্টি হয়।’ ‘ না, না,আমি এখানে আসার পর শুধু বড় সাহেবের কুলখানি আর অনুপ স্যারের বিবাহের অনুষ্ঠান হইছে।’ সায়েম লক্ষ করল, মামুন ছেলেটা শুদ্ধভাবে কথা বলতে
চাইলেও মাঝে-মাঝে আঞ্চলিক শব্দ বেরিয়েই যাচ্ছে। একটা বিষয়ে অবাক হলো সায়েম। এ বাড়িতে নাকি পার্টি, অনুষ্ঠান হয় না। অথচ উল্টো হওয়ার কথা। ব্যবসায়ীক পরিবার। সামাজিক অনুষ্ঠান তো লেগেই থাকবার কথা বাড়িটাতে।যতটুকু সায়েম বুঝেছে, অনুপ কিংবা ওর বাবা দু’জনেই বেশ উদার ।তবে? ‘আচ্ছা, তোমাদের বেগম সাহেবা কেমন মানুষ?’ ‘বেগম সাহেবারে তো আমি দেখিনি, অনুপ স্যার ছোট থাকতেই মারা যান।’ ‘ওঁর কথা বলছি না, অনুপের স্ত্রী কেমন মানুষ?’ ‘ও, লাবণ্য আপা, খুবই ভাল মানুষ, আমাদের সবাইকে উনি বেগম সাহেবা ডাকতে
নিষেধ করেছেন। ”লাবণ্য আপা” ডাকতে বলছে। এই তো তিনদিন আগে আমাগো রাধুনি জুলেখার জ্বর হয়েছিল।তখন তো লাবণ্য আপাই মাথায় পানি ঢেলে দিছিল,রাত একটা পর্যন্ত চেতন ছিল সেইদিন।’ ‘আচ্ছা! ’ বেশ অবাক হয়েছে সায়েম, তবে প্রকাশ করল না কিছু। ‘খুব ভাল।’ ‘কিন্তু স্যার, লাবণ্য আপার একটা সমস্যা আছে, জানেন?’ ‘তাই নাকি? কী সমস্যা?’ পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠল সায়েম। ‘প্রতিরাতে ছাদে যায় উনি।’ ‘জানো ছাদে গিয়ে কী করে?’ ‘না, আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর নিয়া লাভ কী।’ ‘ঠিকই তো, আমার মনে হয় হাওয়া খেতে যায় তোমার লাবণ্য আপা। ‘ ‘হুঁ, সেটাই হইব’ বিজ্ঞের মত মাথা ঝাঁকাল মামুন, যেন সব বুঝে ফেলেছে। ‘ঠিক আছে, তোমার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগল, পরে আবার দেখা হবে।’ মামুন সালাম দিয়ে চলে যাবার পর এই মাত্র পাওয়া তথ্যগুলো নোটবুকে লিখতে বসল সায়ম।
১। এ বাড়িতে কোন ও সামাজিক অনুষ্ঠান হয় না – কেন?
২। লাবণ্য রুপবতীর পাশা-পাশি একজন গুনবতীও বটে। যে রাত একটা পর্যন্ত কাজের মানুষের মাথায় পানি ঢালার মানসিকতা রাখে।
৩। লাবণ্য সত্যি সত্যিই ছাদে যায়। তবে কী করে কেউ জানে না। জানতে হবে……. এইটুকু লিখে নোটবুক বন্ধ করল সায়েম। পরে এগুলো নিয়ে চিন্তা করবে। খাবারের মনোযোগ দিল আপাতত। খাওয়া শেষ করে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে দেখল বসে আছে অনুপ।
‘সরি, না বলেই ঢুকে পড়েছি। তোমার তদন্ত কেমন এগোচ্ছে? ‘
‘ভাল, কয়েকটা ইন্টারেস্টিং তথ্য পেয়েছি। ‘
‘যেমন? ‘
‘তার মধ্যে একটা হলো, এ বাড়ির সব কাজের লোক লাবণ্যকে ভালবাসে।’
‘তা তো বাসবেই।ওরা তো আর আসল পরিচয় জানে না ওর। ‘
‘ আমরাও কি জানি? ‘ বিড়বিড় করে আওড়াল সায়েম।
‘কিছু বললে?’
‘না, আচ্ছা, তোমাদের ছাদ কি তালা দেয়া থাকে?’
‘না, আর থাকলেও লাভ হত না।মন্ত্র পড়ে ঠিকই খুলে ফেলত ডাইনীটা।’
‘সেটা বলছি না।’ একটু বিরক্তি সায়েম। ‘আমি এখন ছাদে যেতে চাচ্ছিলাম।’ ও, তাই বলো। হ্যাঁ, সব সময় খোলা থাকে ছাদ।’
.. আর শোনো, তোমার লাইব্রেরিতে ঘুমাতে হবে না। এতদিন যখন কিছু হয়নি,সামনের দুই দিনে ও কিছু হবে না। আর যদি দেখো লাবণ্য রাতে বাইরে যাচ্ছে, তো আমাকে একটা মিসড কল দেবে।’ ঠিক আছে, ‘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল অনুও, চলে গেল নিজের রুমের দিকে। সায়েম পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে উঠে এল ছাদে। বিশাল ছাদ। কে যেন বাগান করেছে কী কী ফুল আছে বোঝা যাচ্ছে না অন্ধকারে, তবে পুরো ছাদ ভরে আছে সুবাসে। গাছ-পালা ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ল না। তবে দূরে দেখা গেল এক নদীর বাঁকানো কোমর। ওখান থেকে ছুটে আসছে হাওয়া। আকাশে প্রায় পূর্ণ চাঁদও উঠেছে।
কতদিনের চাঁদ? ভাবল সায়েম। এগারো নাকি বারো? কবে পাবে পূর্ণতা?
প্রেমে পড়ার মত অপূর্ব ছাদ। তবে নিশ্চয়ই গভীর রাতে চুপিচুপি ছাদের সঙ্গে প্রেম করতে আসে না লাবণ্য।
জানা জরুরি কেন আসে। আগামীকাল দিনের বেলায় একবার আসবে এখানে, ভাবল সায়েম। প্রায় পূর্ণ চাঁদটার দিকে আরেকবার চলে গেল ওর চোখ। ঠিক সে মুহূর্তে অদ্ভুত এক প্রতিজ্ঞা করল।
পরের দিন দুটো কাজ করল সায়েম, প্রথমেই ছাদে গেল ভালভাবে দেখার জন্য। স্বাভাবিক ছাদ, কোথাও অস্বাভাবিক কিছুই নেই, যা থেকে বোঝা যায় এখানে প্রেতসাধনা টাইপের কিছু হয়। কাল রাতে অবশ্য ছাদে আসেনি লাবণ্য। অত্যন্ত অনুপ ওকে কোনও মিসড কল দেয়নি। আজ সকালে উঠেই অফিসে চলে গেছে অনুপ।
সায়েমের পরিচয় পেয়েই কি কালকে রাতে ছাদে আসেনি লাবণ্য? ছাদ থেকে নেমে বাড়ির অন্যান্য কাজের লোকদের সাথে কথা বলল সায়েম। সবাই পাঁচ মুখে প্রশংসা করল লাবণ্যের।
লাবণ্যকে অবশ্য সারাদিন দেখতে পেল না সায়েম। নিজের রুমের দরজা আটকে বসে রইল মেয়েটা। অনুপেরও দেখা পেল না সারাদিন। অনেক রাতে যখন অনুপের আগমন ঘটল, সায়েম তখন ঘুমে। সে রাতেও লাবণ্য ছাদে গেল না। পরের দিনটাও ঘটনাবিহীন কেটে গেলেও রাত থেকে ঘটতে শুরু করল ঘটনা। সায়েম নিজের ওপর বিরক্ত। তিনদিন হতে চলল, এখন ও অগ্রগতি নেই কেসের। গতকালের মত আজও অনুপ সকালেই অফিসে চলে গেছে।
তার জন্য মায়া হলো সায়েমের। নিজ বাড়ি থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে অনুপকে। লাবণ্যের জন্যও খারাপ লাগল।
একটা মেয়ে কত স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর বাড়িতে আসে মা-বাবাকে ছেড়ে। লাবণ্যের স্বপ্নগুলো এখন দুঃস্বপ্ন। ভয়ের কারণে স্বামী তার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত করছে লাবণ্যকে।
এর সাথে যোগ হয়েছে বিশাল বাড়ির শূন্যতা। মেয়েটার শ্বশুর নেই, শাশুরি নেই, ননদ, ভাসুর, দেবর কিছুই নেই।
যাকে নিয়ে বাঁচবে, সে স্বামী থেকেও নেই। কীভাবে বাঁচবে এই দম্পতি?
সকাল থেকেই একটা থ্রিলার বইয়ে ডুব দিতে চেয়েও একটু পর পরই সেই হারিয়ে যাচ্ছিল সায়েমের। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বিকেলের দিকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। গতকাল কৌশলে এ বাড়ির রাঁধুনি, ড্রাইভার মতি আর দারোয়ান হোসেন আলীর সঙ্গে কথা বলেছে। মামুনের সঙ্গে তো আগেই কথা হয়েছে। বাকি আছে রহিম চাচা এবং অন্য দারোয়ান। এই বাড়িতে দু’জন গার্ড। একেক দিন একেকজনের ডিউটি। দু’জনই যে যার বাসায় থাকে। আজ ডিউটিতে আছে ফারুক নামে একজন।
‘ তোমার নাম তো ফারুক, তাই না?’ গেটের কাছে গিয়ে বলল সায়েম।
‘জে, ‘ পান চিবানোর কারণে অস্পষ্ট শোনাল ফারুকের কন্ঠস্বর।
‘সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করতে কেমন লাগে?’
‘জ্বে, ‘স্যার, ভাল।’
সিকিউরিটি গার্ড বলায় একটা স্যার আদায় করা গেছে। সায়েম জানতে চাইল, ‘একা একা পাহারা দাও, ভয় লাগে না রাতে?’
‘আগে লাগত না, এখন লাগে।’
‘কেন, এখন ভয় লাগে কেন?’
‘লাবণ্য আপা রাইতে ছাদে খাড়ায়ে থাকে তো, দেখলে ভয় লাগে।’
সায়েম দেখল এখান থেকে পরিষ্কার চোখে পড়ছে ছাদটা। কিনারা ঘেঁষে কেউ দাঁড়ালে স্পষ্ট দেখা যাবে।
‘ছাদে গিয়ে কী করে?’
‘আমি তো খালি খাড়ায়ে থাকতেই দেহি।’
‘তা হলে ভয় পাওয়ার কি আছে?’
‘ভয় তো আমার লাইগা না। এত রাইতে ছাদে গেলে লাবণ্য আপারে যদি জ্বেনে ধরে। মাইয়া মানুষ, তার উরপে আবার সুন্দরী।’
‘লাবণ্য আপার জন্য তোমার খুব মায়া দেখা যাচ্ছে।’
‘হইব না? কুনুদিন শুনছেন, বাড়ির মালকিন দারোয়ানেরে ‘কপি’ বানায় খাওয়ায়?’
‘ তোমাকে কফি বানিয়ে খাইয়েছে তোমার লাবণ্য আপা? ‘
‘হ, তাইলে আর কী কইতাছি।’
‘তোমার লাবণ্য আপার জন্য দোয়া করো।’
‘কেন, কী হইছে লাবণ্য আপার? ‘
‘কিছু যাতে না হয়, সেই দোয়াই করো, ‘ বলে ওখানে আর দাঁড়াল না, চলে এল সায়েম। অনুপ আর লাবণ্য ওদের সম্পর্কের শীতলতা রহিম চাচা বাদে সবার কাছ থেকে গোপন রাখতে পেরেছে জেনে স্বস্তি বোধ করল ও।
একটু পর অনুপের গাড়ি প্রবেশ করল বাড়ির ড্রাইভওয়েতে। সায়েম বাগানেই ছিল, এগিয়ে গেল গাড়িটার কাছে।
পিছন সিট থেকে নামল অনুপ ও রহিম চাচা। বয়স্ক মানুষটা ফিরে এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে। সায়েমকে দেখে বললেন, ‘কেমন আছ বাবা?’ গলায় নিখাদ স্নেহ ঝরে পড়ল।
‘ভাল, চাচা, বলল সায়েম। এক মুহূর্ত পর বলল, ‘চাচা, আপনি কি সন্ধ্যায় আমাকে একটু সময় দিতে পারবেন? কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।’
‘অবশ্যই, চা খেয়ে পরে কথা বলি?’
‘ঠিক আছে, চলুন।’
বাড়িতে ঢুকে পড়ল ওরা তিনজন। ডাইনিং টেবিলে লাবণ্যকে বসে থাকতে দেখা গেল, রহিম চাচা আর অনুপ ফ্রেশ হতে চলে গেল। বিনা কারনে চলে যাওয়াটা খারাপ দেখায় ভেবে লাবণ্যের সামনের চেয়ার টেনে বসে পড়ল সায়েম।
‘ কেমন আছেন, সারাদিন তো আপনাকে দেখাই যায় না, বলল সায়েম।
‘ভাল, চোখ-মুখ শক্ত করে জবাব দিল লাবণ্য।
ইচ্ছা করেই আচমকা বিদঘুটে একটা প্রশ্ন করে বসল সায়েম, আসলে প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছে লাবণ্যের। ‘অনুপকে বিয়ে করে আপনি কতটা সুখী?’
মুখটা লাল হয়ে গেল লাবণ্যের, ‘এ ধরনের প্রশ্ন করার অধিকার আপনাকে কে দিল?’
‘কেউ দেয়নি, তবে আমি কিন্তু আমার উত্তর পেয়ে গেছি।’ হাসি হাসি মুখে জানাল ও।
‘কী উত্তর পেয়ে গেছেন আপনি?’ সায়েমের হাসি লাবণ্যের রাগে যেন ঘি ঢালল।
‘পেয়েছি কিছু একটা, ‘ লাবণ্যের রাগ আমলে নিল না সায়েম।
‘কী পেয়েছেন জানি না, তবে শুনে রাখুন, আমি আমার স্বামীকে ভালবাসি।’
‘অনুপ আপনাকে কতটা ভালবাসে?’
কোনও মানুষের মুখ যতটা লাল হওয়া সম্ভব, ততটাই লাল হয়ে গেল লাবণ্যের মুখ, চা শেষ না করেই ঝট করে উঠে চলে গেল।
আপন মনে হাসতে লাগল সায়েম।
‘একা একা হাসছ যে, লাবণ্য কই?’
‘তোমার রাজকন্যা তো রাগ করে চলে গেল,’ হাসতে হাসতে অনুপের কথার জবাব দিল সায়েম।
‘কেন?’ বসতে বসতে জানতে চাইল অনুপ।
‘আমিই রাগিয়েছি, তাই। দেখতে চেয়েছিলাম তোমার বউ আমাকে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিতে পারে কি না। পারল না তো, লাবণ্য বোধহয় নিম্ম পর্যায়ের ডাইনী, ক্ষমতা-টমতা তেমন নেই।’
সায়েমের রসিকতা সহজভাবে নিতে পারল না অনুপ। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তুমি আমার কথা বিশ্বাস করোনি, তাই না?’
‘অবশ্যই করেছি, তুমি এবং রহিম চাচা যা দেখেছ তা একশ’ ভাগ সত্য।
আর কোনও কথা বলল না অনুপ। একটু পর রহিম চাচা এসে যোগ দিলেন ওদের সাথে। নীরবে চা শেষ করে চলে গেল অনুপ। সায়েম সুযোগ পেয়ে রহিম। চাচাকে বলল, ‘চাচা, কয়েকটা প্রশ্ন করি আপনাকে? ‘ ‘অবশ্যই করবে।’
‘চাচা, অনুপ সম্পর্কে কিছু বলুন। কেমন ছেলে ও!’
‘খুবই ভাল ছেলে। সৎ ছেলে। কোনও দিন ওকে মিথ্যে বলতে শুনিনি।’
‘বাবার সঙ্গে ওর সম্পর্ক কেমন ছিল ? ‘
‘একেবারে বন্ধুর মত। একমাত্র ছেলে তো, সব সময় আগলে রাখতেন। স্কুল ছুটি হবার সাথে সাথে ওকে নিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। খেলাধুলার সমস্ত সামগ্রী ছেলেকে কিনে দিয়েছিলেন হায়দার স্যার। বিকেলে বাপ-বেটা মিলে খেলত।’
‘হায়দার সাহেব বেঁচে থাকতে নিশ্চয়ই বাড়িতে অনুষ্ঠান লেগে থাকত?’
‘না, পার্টি-ফার্টি একদম পছন্দ করতেন না উনি।’
‘আচ্ছা, আপনার বউমা, মানে লাবণ্য মানুষ হিসেবে কেমন?’
দীর্ঘশ্বাস পড়ল রহিম চাচার। ‘সত্যি কথা বলতে বউ হিসেবে এমন মেয়েকে পাওয়া সাত জনমের কপাল। যেমন সুন্দরী, তেমনই গুনবতী। কিন্তু…. ‘ আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মানুষটা।
‘আচ্ছা, সেদিন আপনি ঠিক কী দেখেছিলেন, বলেন তো।’
সে ভয়াবহ দৃশ্য !’ যেন এখনও সে দৃশ্য চোখ থেকে মুছে যায়নি রহিম চাচার। শিউরে উঠলেন।
‘কোন ভয়াবহ দৃশ্য, একটু বলুন তো ! ‘
বলতে শুরু করলেন রহিম চাচা।
এবং পরের আধঘণ্টা পর সায়েমের সামনে থেকে সরে গেল সব অন্ধকার। খুলে গেল সব রহস্যের জট।
রহিম চাচার সাথে কথা বলে মনটা অনেক হালকা সায়েমের।
রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ল। ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিল মোবাইলের ভাইব্রেশনে। ডায়াল স্কিনে দেখল অনুপের নাম্বার। নিশ্চয়ই ছাদে যাচ্ছে লাবণ্য।
ঘড়িতে রাত পৌনে বারো। শব্দ হবার ভয়ে স্যান্ডেল ছাড়াই ছাদে রওনা হলো সায়েম- সতর্ক পদক্ষেপ।
ছাদে ঢোকার দরজার দাঁড়িয়ে উঁকি দিল সায়েম। চমকে উঠল। না, কোনও মরার খুলি সামনে নিয়ে বসে নেই লাবণ্য।অশুভ কোনও পরিবেশও বিরাজ করছে না বিশাল ছাদে।
শুধুই দাঁড়িয়ে আছে লাবণ্য। দেখছে দূরের নদীটা। ভয় পাবার কোনও উপাদান নেই দৃশ্যটায়, তবুও চমকে গেল সায়েম লাবণ্যের পোশাক দেখে। ধবধবে সাদা নাইটড্রেস পরেছে মেয়েটি। গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা, পত্-পত্ করে উড়ছে জোরালো বাতাসে। চাঁদের রহস্যময় আলো ওই গাউনের সঙ্গে যোগ হয়েছে। পৃথিবীর সাধারণ এক মেয়ে যেন পরিণত হয়েছে অন্য ভূবনের কেউ।
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জাতীয় কিছু একটা লাবণ্যকে জানিয়ে দিল ওর বিশ হাত পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। ফিরে চাইতে শুরু করেছে লাবণ্য, রহস্যময় পরিবেশ আবার অযৌক্তিক ভয় জাগিয়ে তুলল সায়েমের মনে।
কী দেখবে এখন?
লাবণ্যের স্বাভাবিক সুন্দর মুখ, নাকি ভয়ঙ্কর কিছু?
না, স্বাভাবিক মুখই দেখতে পেল লাবণ্যের।
ওকে দেখে দু’পা এগিয়ে এল লাবণ্য। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পড়ল ওর মুখে। সায়েম দেখল, লাবণ্য
পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। কাঁদছে মেয়েটা। ডাইনীর চোখে জল !
পায়ে পায়ে ওর একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল লাবন্য।
‘ভাইয়া, আমি জানি আপনি কে। আমাকে বাঁচান, প্লিজ। আর ক’টা দিন এভাবে চললে আমি আবার পাগল হয়ে যাব।
কোনও ভণিতা ছাড়াই কথাগুলো বলল লাবণ্য। বিদ্বেষের ভাবটা উধাও ওর ভিতর থেকে।
‘আবার পাগল হয়ে যাবে মানে?’ সায়েম খেয়াল করল না, লাবণ্যকে তুমি বলে ফেলেছে।
‘ছোটবেলায় আমার মাথায় একটু প্রবলেম দেখা দেয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু আমার স্বামী এ কারণে আমাকে ভয় পায়। কথাও বলে না।’
‘অনুপ ব্যাপারটা জানল কীভাবে? মানে তোমার মেন্টাল প্রবলেমের কথা?’
‘আমাদের বিয়ের আগে বাবা সব জানিয়ে দেয়, যাতে পরে সমস্যা না হয়। কিন্তু ওটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘তুমি আসল ব্যাপারটা তা হলে জানো না? সরি, তুমি বলে ফেললাম।’
‘কী জানব? আর আপনি দয়া করে আমাকে তুমি করেই বলবেন।’
‘অনুপ তোমাকে ভয় পায় অন্য কারণে। তোমাকে ও ডাইনী ভাবে।’
‘কী… ভাবে? … ডাইনী?’ চরম বিস্ময়ে গলা চড়ে গেল লাবণ্যের। ‘এটা কী বলছেন ! আমাকে কেন ডাইনী ভাববে? ‘
‘কেন ভাবে, তা কাল বলব। এখন আমাকে বল তুমি প্রতি রাতে ছাদে কী করো?’
‘ভাইয়া ছোটবেলা থেকে আমার ভয়-ডর কম, প্রতিরাতে ছাদে না এলে আমার ঘুম আসে না। অভ্যাস হয়ে গেছে। পেপারে আপনার ছবি দেখে আপনাকে চিনে ফেলি, তাই গত দুটো রাত ছাদে আসিনি আপনার ভয়ে।দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যেন আমার। আজ থাকতে না পেরে চলে এসেছি। বিয়ের আগে ভাবতাম, স্বামীকে নিয়ে প্রতিদিন ছাদে আসব, গল্প করব। কিন্তু এখন শুনছি ও নাকি আমাকে ডাইনী ভাবে। ভাইয়া, আমি সাধারণ মেয়ে। সারাজীবন স্বামীকে নিয়েই কাটিয়ে দিতে চাই। ও আমাকে ভাল না বাসলে ও এই ক’দিনে আমি ওকে প্রচন্ড ভালবেসে ফেলেছি। আপনি তো অনেক মানুষের হারানো জিনিস ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনার এই ছোট বোনটার স্বামীকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না?’ বলতে বলতে দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল লাবন্য।
সায়েমের খুব ইচ্ছে করল লাবণ্যের মাথায় হাত রেখে কিছু বলতে। কিন্তু কিছুই বলল না। নীরবে নেমে এল ছাদ থেকে।
পরদিন সকালে সায়েমের রুমে জমায়েত হয়েছে অনুপ, রহিম চাচা আর লাবণ্য। সায়েমই আসতে বলেছে ওদের। গতরাতেই সমস্ত রহস্য সমাধান হয়েছে। এখন সময় হয়েছে সব খুলে বলার।
‘আমার পরিচয় তো আপনারা সবাই জানেন, সুতরাং ভূমিকার কোনও প্রয়োজন নেই,’ শুরু করল সায়েম। রুমের মধ্যে একমাত্র ওই দাঁড়িয়ে আছে। ‘অদ্ভুত একটা কেস নিয়ে আমি এ বাড়িতে এসেছিলাম। সেটা হলো, অনুপ এবং রহিম চাচা লাবণ্যকে কোনও কারণে ডাইনী ভাবেন, সে কারন জানার জন্যেঈ আমার আগমন।
‘শুরু থেকে ডাইনীর ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস করিনি। ডাইনীর সংজ্ঞা কী? যারা তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে অলৌকিক সব কাজ করতে পারে। এ জন্যে অবশ্য বিভিন্ন অপশক্তির সাধন্স করতে হয়। এখন কথা হলো, লাবণ্যের মত একটা সুন্দরী মেয়ে কোন্ দুঃখে ডাইনী হতে যাবে।
‘তা হলে কি এরা দু’জন ভুল দেখেছে? নাকি মিথ্যে বলছে দু’জনই?
‘মিথ্যেই বা কেন বলবে?
‘লাবণ্যকে ডিভোর্স দেয়ার জন্যে বলতে পারে, তবে সেটা বিশ্বাস্য নয় কোনও ভাবেই। লাবণ্যের মত সুন্দরী একটা মেয়েকে পাগল ছাড়া কেউ তালাক দেবে না। আর দিলে ও তার জন্যে এমন উদ্ভট অজুহাত কেউ দেবে না। সেক্ষেত্রে আবার সেই পুরনো প্রশ্ন: অনুপ আর রহিম চাচা কী দেখল? কেন দেখল?
‘সেই প্রশ্নের জবাবই আমি গত কয়েকটা দিন খুঁজেছি।
‘প্রথমে অনুপের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি। অনুপ ছোটবেলায় মা’কে হারিয়েছে, মানুষ হয়েছে বাবার হাতে। বাবাও একমাত্র ছেলেকে প্রচন্ড ভালবাসতেন। সারাটা জীবন অনুপকে আগলে রেখেছেন। হায়দার সায়েবের দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হবার কারণ বোধহয় অনুপ। মহিলা অনুপকে আপন করে না নিতে পারায় সম্ভবত সেপারেশন হয়ে যায় তাঁদের মাঝে। এরপর হায়দার সাহেব আর বিয়ে করেননি, সন্তানকে সম্বল করেই বেঁচেছেন আজীবন।
‘ছোটবেলা থেকে অনুপকে একটা গন্ডির মাঝে বেঁধে রেখেছেন তিনি। কোনও বন্ধু-বান্ধব হতে দেননি অনুপের। নিজেই বন্ধু হয়েছন, সঙ্গ দিয়েছেন। হায়দার সাহেব মানুষ হিসেবে তেমন সামাজিক ছিলেন না।অনুপকেও ওভাবেই দেখতে চেয়েছেন। এ কারণেই বোধহয় বাড়িতে কখনও কোনও ধরনের পার্টির আয়োজন করেননি।অনুপও
নিঃসঙ্গভাবে , শুধুমাত্র পিতার সাহচর্যে বেড়ে উঠতে লাগল। অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গতবছর হায়দার সাহেব মারা যাওয়ায় অনুপ বড় ধরনের শক পেল। বাবা হারাবার চেয়ে বেশি বন্ধু হারাবার ব্যথা কাতর করে তুলল ওকে। হায়দার সাহেব স্বভাবগতভাবে আনসোশাল হলে ও অনুপ কিন্তু খুবই মিশুক প্রকৃতির ছেলে।সেটা আমি বুঝছি মাত্র কয়েক ঘন্টায়। অনুপ আমাকে যেভাবে আপন করে নিয়েছে, তা দেখে। ‘যাই হোক, অনুপ তার একমাত্র বন্ধু হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। বাবার গড়া বিশাল লাইব্রেরির বই গুলোকে বন্ধু বানিয়ে নেয়। বই অনেক ক্ষেত্রেই ভাল বন্ধু হলে ও সবক্ষেত্রে নয়, সুখ-দুঃখের ভাগীদার বই কখনও হতে পারে না। সঙ্গ-পিপাসু অনুপের মন সত্যিকারের একজন বন্ধু খুঁজে ফিরতে লাগল। কিন্তু বাবার শিক্ষা অবচেতন মনে গভীরভাবে গেঁথে যাওয়ায় বাধা পেয়েছে অনুপ বরাবর। দুই মনের দ্বৈরথ একধরনের টানা-পোড়েন সৃষ্টি করল অনুপের মনে।’
একটানা বলে থামল সায়েম। এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল উপস্থিত তিনজন। সায়েম থামতে সবাই উৎকন্ঠিত হয়ে তাকিয়ে রইল।
বেশ মজা পাচ্ছে সায়েম।
উদ্বেগমুক্ত করার আগে চরম উদ্বেগের মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে সবাইকে।
‘এই টানাপোড়েন অনুপের মনে অ্যাবনরমাল মেন্টাল ডিজঅর্ডার – এর বীজ বুনে দেয়,’ কিছুক্ষনের বিরতির পর শুরু করল সায়েম। ‘সাইকোলজির ভাষায় এ রোগের নাম ‘ক্যালগাইনিফোবিয়া’ (Caligyne Phobia)। অদ্ভুত এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সুন্দরী মেয়েদের ডাইনী ভাবে, ঠিক অনুপের মত। তবে সব নিঃসঙ্গ মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিন্তু ঘটে না। কারণ সবাই অনুপের মত সঙ্গ-পিপাসু হয় না। নিঃসঙ্গতাই তাদের পছন্দ।’
‘কিন্তু, সায়েম, সুন্দরী মেয়ে তো আমি জীবনে কম দেখিনি, তখন এই সমস্যা হলো না কেন !’ বলল অনুপ। পরক্ষণে জানতে চাইল, ‘আর আমার বিয়ের রাতেই কেন এমন ঘটল?’
‘ আমি আগেই বলছি, তোমার বাবার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে বীজ বপন হয়ে যায় রোগটার। এবং মহীরুহের রুপ ধারন করে বিয়ের রাতে। কারণটা সম্ভবত লাবণ্যের সৌন্দর্য। এবং এই রোগটাই বিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন তৈরি করে তোমার অবচেতন মনে।’
‘বুঝলাম, আমি ক্যালগাইনিফোবিয়া’ রোগে আক্রান্ত হয়ে উল্টো-পাল্টা দেখেছি, রহিম চাচা তা হলে কেন দেখবে? তিনি নিশ্চয়ই এই রোগে আক্রান্ত নন?’
‘ সে ব্যাপারেই আসছিলাম,’ বলল সায়েম, ‘না, রহিম চাচা এই রোগে আক্রান্ত নন। এবং তিনি মিথ্যে বা ভুল কিছুও বলেননি।’
এইমাত্র বলা সায়েমের কথাটা রুমের পরিবেশ গুমোট করে তুলল। সায়েমের দেয়া অনুপের হাইপোথিসিস শুনে লাবণ্যের মুখের কালিমা একটু কেটে গিয়েছিল। এখন আবার দল বেঁধে ফিরে আসছে আঁধার। মেয়েটাকে আর কষ্ট দিতে চাইল না সায়েম, বলল, ‘রহিম চাচাও ভিজ্যুয়্যাল হ্যালুসিনেশন শিকার, তবে ক্যালগাইনিফোবিয়া কারনে তাঁর হ্যালুসিনেশন হয়নি। হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারনে, কারণটা বলছি।
‘রহিম চাচা ছোটবেলা থেকে অনুপকে দেখে আসছেন। জানেন, অনুপ খুবই ভাল একজন মানুষ। সৎ এবং সত্যবাদী, কখনও ওকে মিথ্যে বলতে শোনননি। সেই অনুপ যখন এসে বলল লাবণ্য একটা ডাইনী, এবং ও ভয়ঙ্কর অবস্থায় লাবণ্যকে দেখেছে- রহিম চাচা সেটা বিশ্বাস করলেন। অনুপের কথাগুলো তাঁর মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করল। এর ক’দিন পর যখন লাবণ্যকে ছাদে যেত্ব দেখলেন, অনুপের প্রভাব সৃষ্টিকারী কথাগুলোই তখন হ্যালুসিনেশন তৈরি করল তাঁর মাঝে। এই হলো লাবণ্যের ডাইনী হবার রহস্য। ‘
কথাটা শেষ করে সায়েম হেঁটে গেল টেবিলের কাছে। গ্লাসে পানি ঢালতে-ঢালতে ওদের দিকে পিছনে ফিরেই বলল। ‘আমার এই হাইপোথিসিস দাঁড় করাবার ভিত্তিটা এবার বলি। এ বাড়ির সব কাজের লোকই লাবণ্যকে অত্যন্ত ভালবাসে। অবশ্য ভালবাসা পাবার মতই একটা মেয়ে লাবণ্য।’ কথাটা বলার সময় লাবণ্যের দিকে চেয়ে সায়েম দেখল, মাথা নিচু করে ফেলেছে। সম্ভবত লজ্জা পেয়েছে। ‘এমন একটা মেয়ে যে ডাইনী হতে পারে না এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম। তবে অনুপ এবং রহিম চাচার দেখা দৃশ্য আমার মনে খচ-খচ অনুভূতি তৈরি করছিল। তারা এগুলো কেন দেখবেন? এটা যে হ্যালুসিনেশন তা আমি বুঝি দুটো কারণে। প্রথমত, অনুপ আর রহিম চাচা ছাড়া ও এ বাড়ির আরও দু’জন লাবণ্যের ছাদে যাওয়া দেখেছে। তবে এদের কেউ কিন্তু লাবণ্যকে ভয়ঙ্কর কোনও চেহারায় দেখেনি। কারণ এরা জানত না লাবণ্যকে ডাইনী বলে সন্দেহ করা হয়। জানলে বোধহয় রহিম চাচার মত এরাও লাবণ্যকে ভয় পেত, হ্যালুসিনেশনের শিকার হত।
‘দ্বিতীয় কারণ, আমি এখানে আসবার পথে অনুপের কাছ থেকে জানতে পারি, বিয়ের রাতেও লাবণ্যকে চামড়া কুঁচকে যাওয়া এক বুড়ি হিসেবে দেখতে পেয়েছে ও। যার চোখ জ্বলছিল অঙ্গারের মত। আমরা জানি, ডাইনীরা এক ধরনের তান্ত্রিক, কোনও কারণই নেই তাদের চেহারা ভয়ঙ্কর হবার। তবুও যদি ধরে নিই ডাইনীরা ভয়ঙ্কর চেহারার অধিকারী, তা হলে ও লাবণ্যের চেহারা বুড়ির মত হবে কেন? চুপ হয়ে গেল সায়েম, কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘চেহারা বুড়ির মত হবে, কারণ আমরা ছোটবেলায় রুপকথার পাতায় ডাইনীদের যে বর্ণনা পেয়েছি, সেটা খুনখুনে বুড়ির। চামড়া কোঁচকানো, চুল শনের মত ইত্যাদি, ইত্যাদি। হ্যালুসিনেশনের ভেতর অনুপ এমনই চেহারাই দেখেছে লাবণ্যের। কিন্তু পরবর্তীতে যখন রহিম চাচার কাছ থেকে লাবণ্যের ডাইনী রুপের বর্ণনা পাই, তখন হ্যালুসিনেশনের বিষয়টা নিশ্চিত হই। তিনি সে রাতে লাবণ্যের ঠোঁটের দু’পাশ থেকে শ্বদন্ত বেরিয়ে আসতে দেখেন, চোখ ছিল টকটকে লাল।এখন প্রশ্ন হলোঃ দু’জনের বর্ণনার এ ভিন্নতা কেন? উত্তরটা হলোঃ অনুপ রহিম চাচাকে লাবণ্যের ব্যাপারে সন্দেহের কথা বললেও, বলেনি সে রাতে ঠিক কী দেখেছিল। আর রহিম চাচা ডাইনী আর ড্রাকুলাকে গুলিয়ে ফেলায় পার্থক্য তৈরি হয়। তিনি ভাবতেন, ডাইনীদের চেহারা বুঝি অমনই হয়। শ্বদন্ত থাকবে, চোখ থাকবে লাল। হ্যালুসিনেশনের সময় তিনি তাই লাবণ্যকে এভাবেই দেখতে পান।মোটকথা, যার অবচেতনে ডাইনীদের যেমন চেহারা আকাঁ, সে তেমনই দেখেছে।
‘এই হলো আমার হাইপোথিসিস। কার কোনও প্রশ্ন আছে?’
‘আমি জানি, লাবণ্যের ইনসমনিয়া নেই, তবুও রাতে ছাদে কেন যেত?’ জানতে চাইল অনুপ।
‘এটা ওর ছোটবেলার অভ্যাস, ছাদে না গেলে ভাল লাগে না ওর। আর আর তোমাদের ছাদটা এমনিতেই প্রেমে পড়ার মত। লাবণ্যকে সেটা আরও বেশি টানবে, তাতে আশ্চর্যের কী? লাবণ্যের অবশ্য উচিত ছিল তোমাকে বিষয়টা জানানো। তবে জানাবার সুযোগটাই বা পেল কখন, স্বামী-প্রবর তো ওকে দেখলেই টাশকি খায়’ বলতে বলতে হেসে ফেলল সায়েম, কথা শেষে তিনজনের দিকে তাকিয়ে রইল।
তিনজনই মাথা নিচু করে বসে আছে।
লাবণ্য বোধহয় কাঁদছে। একটু পর-পর ফুলে উঠছে পিঠ। নিশ্চয়ই কষ্টের কান্না নয়।
অনুপও তো কাঁদছে, কাঁদুক।
রহিম চাচাকে ইশারা করে রুম থেকে বেরিয়ে এল সায়েম।
সেদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ব্যাগ গোছাচ্ছে সায়েম। চলে যাবে। পেছনে দাঁড়িয়েছে অনুপ আর লাবণ্য। ওরা দু’জন বারবার অনুরোধ করেছে, যাতে সায়েম আজ না যায়।
রাজি হয়নি সায়েম।
আজকের এই খুশির দিনে এই দম্পতির মাঝে হাইফেন হয়ে থাকতে চায় না ও।
ক’দিন পর আবার আসবে, এ শর্তে নিমরাজি হয়ে এখন ওর ব্যাগ গোছানো দেখছে দু’জন। লাবণ্য সাহায্য করতে চেয়েছিল। মানা করেছে সায়েম।
অনুপের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলল ও, ‘আমার এক সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধুর ঠিকানা দিচ্ছি তোমাকে। মনে করে যেয়ো। নয়তো পরে সোশ্যাল ফোরিয়া হয়ে যেতে পারে তোমার।’
‘যাবে না মানে? ‘ বলল লাবণত। ‘নিজে আমি ওকে নিয়ে যাব। না গেলে খবর আছে না !’
পেছনে ফিরে আছে বলে ওরা দেখল না হাসছে সায়েম।
‘সায়েম, তুমি আমাদের জন্য যা করলে, সে ঋণ শোধ করবার সামর্থ্য আমার নেই। তবুও কিছু মনে না করলে তোমাকে আমরা কিছু দিতে চাই।’
‘পারিশ্রমিক? ‘ জানতে চাইল সায়েম।
‘ছি-ছি ! ভাইয়া, পারিশ্রমিক হবে কেন? উপহার বলতে পার। তবে তোমার অনুমতি ছাড়া দিতে সাহস হচ্ছে না।’ এবার লাবণ্য বলল অনুপের হয়ে। সায়েমকে ‘তুমি’ করে ডাকা শুরু করেছে ও।
‘অনুপের মত বন্ধু পেয়েছি, তোমার মত বোন পেয়েছি- আর কী উপহার তোমরা দিতে চাও?’
‘না-না, ভাইয়া , এসব কথায় কাজ হবে না, বাচ্চা মেয়ের মত জেদ ধরল লাবণ্য।
ব্যাগ গোছানো বাদ দিয়ে সোজা হয়ে ওদের মুখোমুখি হলো সায়েম। অনুপ আর লাবণ্যকে পাশাপাশি দারুণ সুন্দর লাগছে ! কারও চেহারায় উদ্বেগ, ভয়, শংকা, বিষাদের মত অণুভূতি নেই। স্বস্তির ভাব বিরাজ করছে মুখে।
‘সত্যিই আমাকে কিছু দিতে চাও !’ জানতে চাইল সায়েম।
একযোগে মাথা ঝাঁকাল দু’জনই।
‘তো শোন, আজ চতুদর্শী পূর্ণিমা। রাতে তোমরা ছাদে যাবে, হাত রাখবে হাতে, তখন যদি আমার কথা মনে পড়ে, তো বুঝে নিয়োঃ অপেশাদার গোয়েন্দা সায়েম রহমান পেয়ে গেছে তার পারিশ্রমিক।’
ঝকঝকে রুপালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। চতুদর্শী চাঁদের জোছনায় ভেসে যাচ্ছে গোটা পৃথিবী। উথাল-পাতাল জোছনা, নেশা ধরানো এই সৌন্দর্য শুধু চোখ দিয়ে দেখার নয়, হ্রদয় দিয়ে উপলব্ধি করার। জোছনায় ভিজছে দুই মানব-মানবী। একজনের হাতে অপরজনের হাত। ওরা কেউ হাত ছাড়তে চাইছে না অন্যের। কখনও যেন দূরে সরবে না একে অপরেরর কাছ থেকে। কোনোদিনও না। সায়েম ওর পারিশ্রমিক পেয়ে গেছে।
ওই দুই মানব-মানবীকে চাঁদের আলোয় দাঁড় করিয়ে দেয়ার সেই অদ্ভুত গোপন প্রতিজ্ঞাও রক্ষা করতে পেরেছে সায়েম রহমান।
*********************************************(সমাপ্ত)*****************************************