ডেলিভারীম্যান যেদিন মমিটাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এল, এমন ভাব দেখালাম যেন ওটা দেখে আমি ভয় পাইনি। জানি, বড় আপু, শীলা, যদি একবার বুঝতে পারে আমি ভয় পেয়েছি তাহলে খেপাতে-খেপাতে আমাকে মেরে ফেলবে।
‘ওহ, মমি!’ বিস্ময়ে চেঁচিয়ে বলল শীলা। ‘ওটা দেখে তুমি নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছ, অনিক? ‘
শীলা সব সময় আমাকে ভয় দেখাতে পছন্দ করে।ওটা ওর শখ। আমাকে ভীতুর ডিম বলে খেপায় ও।
আমার বাবা, আশরাফ হোসেন, শহরের একমাত্র মিউজিয়ামের কিউরেটর। তাই মিউজিয়ামে অনেক কাছ থেকে মমি দেখেছি।কিন্তু এবারই প্রথম একটা বাক্সে করে মমি আমাদের বাড়িতে আনা হয়েছে।
কোথাও একটা ভুল হয়েছে, মাকে বলতে শুনলাম। কিন্তু মমি কেসটা। রাখার জন্য মা লোকগুলোকে বলল। ওটার কাছে যেতে নিষেধ করল আমাদের দু’জনকে।
মা-র সাথে লোকগুলো চলে গেলে, শীলা আর আমি সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে নীচে বেসমেন্টের দিকে তাকালাম । ‘ মমিদের নিয়ে লেখা অনেক বউ পড়েছি আমি, ‘ শীলা বলল। ‘বইয়ে পড়েছি শিকার ধরার জন্য ওরা রাতে জেগে ওঠে।’
‘ আমি বিশ্বাস করি না, ‘ বললাম আমি।
`না, আমি সত্যি বলছি, ‘শীলা জোর দিয়ে বলল। মমিরা জীবিত মানুষদের হিংসা করে।তাই ওরা অন্ধকার হলে বেরিয়ে আসে। আর জীবিত মানুষদের খুন করে।’
‘ঠিক আছে, তোমার কথা মানলাম, ‘ বললাম আমি। ‘কিন্তু ওই মমিটা কাউকে খুন করতে পারবে না। ওটার বাক্সটা শিকল দিয়ে বাঁধা। ‘
‘একটা কথা কি জান, অনিক, ‘শীলা বলল, ‘তুমি অনেক ভীতুর ডিম। ‘
‘না, আমি ভীতু নই,’ আমি প্রতিবাদ করলাম।
‘ তুমি যদি যদি ভীতু না হও, তা হলে নীচে ওটার কাছে যাচ্ছ না কেন?’ শীলা জানতে চাইল।
‘কখনওই না,’ আমি বললাম। ‘পাগল হয়েছ? মা কী বলেছে মনে নেই?’
‘নীচে গিয়ে বাক্সটা স্পর্শ করে আসছ না কেন?’ শীলা বলল। ‘শুধুমাত্র একবার।বাজি ধরে বলতে পারি তুমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছ।’
‘ঠিক আছে, ‘ বললাম আমি। ‘যাব আমি।’ কথাটা বলে মনে-মনে নিজেকে গালি দিলাম। বেসমেন্টের বাতির সুইচটা ভাঙা। পুরো জায়গাটা কালিগোলা অন্ধকারে ঢাকা। আলো বলতে ছোট একটা ভেন্টিলেটার দিয়ে আসা সুর্যের আলো। ধীরে-ধীরে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে লাগলাম। বাক্সটা রুমের মাঝখানে রাখা। চারপাশের সবকিছুতে পুরু ধুলোর স্তর। কিন্তু বাক্সটা চকচক করছে।মনে হচ্ছে ওটার ডালাটা থেকে বৈদ্যুতিক দ্যুতি ছড়াচ্ছে। পায়ে-পায়ে কফিনটার কাছে এলাম।আমার হার্টবিট ছাড়া আর কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। বেসমেন্টের বাতাস ঠান্ডা আর ভেজা। মনে সাহস আনার জন্য দুই হাতের তালু ঘষলাম। চকচকে কালো বাক্সটা স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়ালাম।আর তখনি ওটার ঢাকনাটা নড়ে উঠল। ঢাকনাটাকে আটকে রাখা শিকলটা ঝনঝন শব্দ করে উঠল। আমার হার্টবিট যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। চিৎকার করে উঠলাম। ঘুরে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিলাম।একবারের জন্যেও পেছনে তাকালাম না। বেসমেন্টের দরজা বন্ধ! আমি নীচে নামার সাথে-সাথে শীলা নিশ্চয়ই ওটা বন্ধ করে দিয়েছে! গায়ের জোরে দরজায় ধাক্কা দিলাম।দরজা খুলে ছিটকে রান্নাঘরে চলে এলাম। শীলা ডাইনিং টেবিলে বসে আছে।আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে। ‘মমিটা জ্যান্ত!’ চিৎকার করে বললাম আমি। ‘কফিনের ঢাকনা নড়েছে! ‘ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল শীলা। ‘তুমি সত্যিই একটা ভীতুর ডিম।’ বেসমেন্টের দরজার কাছে গিয়ে ওটা খুলল ও। নীচে রাখা বাক্সটার দিকে তাকাল।
‘ কই, কিছুই তো দেখছি না। ‘
ঠিকই বলেছে ও।ঢাকনাটা বন্ধ। শিকলটা ও আগের জায়গায় আছে।
আমি কি ভুল দেখেছি!
না কি সত্যিই?
ওই রাতে আমার ভাল ঘুম হলো না।কোনও ভাবেই শান্তি পাচ্ছি না।
কেন ঘুমাতে পারছি না?
ঘুমিয়ে পড়ো, অনিক, নিজেকে বললাম।আব কিছু ঠিক আছে।
কিন্তু তারপরই শব্দটা শুনলাম।
ধুপ।
বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসলাম।শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে কেউ যেন ফুনবুকটা মেঝেতে ফেলে দিয়েছে।
আবার ও শোনার জন্য কান পেতে অপেক্ষা করছি।
ধুপ।
আবার।
কী হতে পারে?
ধুপ।
শব্দটার মধ্যে একটা ছন্দ আছে।একটার পর আরেকটা ….. মনে হচ্ছে……
হাঁটার শব্দ!
প্রতিটা আওয়াজ একবার করে মাটিতে পা ফেলার শব্দ।
ধুপ।
এবার মনে হচ্ছে শব্দটা সামনে চলে আসছে!
তারপর ভীতিকার আরেকটা তীক্ষ্ণ শব্দ শুনলাম। ভাল করে শোনার জন্য কান খাড়া করলাম।
ধুপ। ঠং।
আমার হার্টবিট দ্রুত হতে লাগল।
বুঝতে পারলাম, পরের শব্দটা শিকলের।
ধুপ। ঠং।
মমিটা!
শিকারের খোঁজ করছে।
আমাকে খুঁজছে!
দম আটকে আসছে আমার। চিৎকার করে উঠলাম আমি, একই দিনে দ্বিতীয়বারের মত।
আমার বেডরুমের দরজা সশব্দে খুলে গেল।
মমিটা এসে পড়েছে!
ওটার পরনে লম্বা আলখিল্লা। মাথায় এলোমেলো চুল।
আবার ও চিৎকার করে উঠলাম। ভয়ে চাদর দিয়ে মাথা ঢাকলাম।
‘শশশ,’ নরম একটা কন্ঠস্বর বলে উঠল। ‘সব কিছু ঠিক আছে, বাবা। আমি এসে পড়েছি। ‘
‘কে? মা? ‘জিজ্ঞেস করলাম আমি।মাথা থেকে চাদর সরিয়ে দেখলাম বিছানায় আমার মাথার পাশে মা বসে আছে। তার পরনে আলখিল্লা, মাথায় আলুথালু চুল।
‘খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?’ মা আমাকে বলল, আমার চুলে হাত বুলাচ্ছে।
‘না!’ আমি চিৎকার করে বললাম।’মমিটা বের হয়ে গেছে।ওটা আমাকে ধরতে আসছে।ওটার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার শব্দ শুনতে পেয়েছি।’
‘তুমি খারাপ স্বপ্ন দেখেছ। ‘ মা ঝুঁকে আমার কপালে চুমু খেল। ‘এবার ঘুমাও। ‘
মা’র চলে যাবার শব্দ পেলাম।
ভাবতে লাগলাম, মা যা বলল, তা কি সত্যি? সত্যিই কি আমি খারাপ স্বপ্ন দেখেছি? কিন্তু আমি তো পায়ের শব্দ নিজ কানে শুনেছি।এমনকি শিকলের শব্দও। মমিটা বের হয়ে গেছে। আমার মন বলছে, ওটা আবার ও আসবে।
আমাকে ধরার জন্য !
পরদিন মমির কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করার উপায় খোঁজার জন্য লাইব্রেরিতে গেলাম। কিন্তু অবাক কান্ড! ওখানে শুধুমাত্র আছে ভৌতিক উপন্যাস আর ইতিহাস বই।
ব্যর্থ মনে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু মেইন রাস্তায় ওঠার সময় হঠাৎ নতুন দোকানটা চোখে পড়ল।দোকানের সাইন বোর্ডে লেখা – “স্যাম জোন’স মিস্ট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইস”। দোকানের ভেতরে জানালার পাশে একটা বড় টেবিল বিছানো, ওতে নানা রকম ক্রিস্টাল বল রাখা।
দোকানের সামনে এসে জানালা দিয়ে ভেতরে তাকালাম। দেখলাম, কাউন্টারের ওপাশে একজন বয়স্ক লোক বসে বই পড়ছেন। লোকটা লম্বা-চওড়া, মাথায় এলোমেলো চুল, গালে চাপদাড়ি। উনি হয়তো আমাকে সাহায্য করতে পারবেন, ভাবলাম আমি।
বাইরে সাইকেলটা রেখে দোকানের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। দরজার ওপরে ঝোলানো ছোট ঘন্টাটা মিষ্টিভাবে বেজে উঠল।
‘গুড আফটার নুন, স্যর,’ লোকটা বলল, বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। ‘আপনার জন্য কী করতে পারি?’
‘আপনিই কি স্যাম জোনস? ‘ আমি জিজ্ঞেস করলাম তাঁকে।
‘হ্যাঁ, ‘ স্যাম জোনস বললেন।
‘মমি সম্পর্কে আমার কিছু তথ্য দরকার, ‘ ইতস্তত করে বললাম আমি।
‘তথ্যগুলো কি স্কুল প্রজেক্টের জন্য লাগবে? ‘ স্যাম আমার কাছে জানতে চাইলেন। ‘নাকি তুমি মিশরে যাবার প্ল্যান করেছ?’
‘না, না। আমার বাবা এই শহরের ন্যাচারাল হিস্ট্রি-মিউজিয়ামের কিউরেটর। ভুল করে একটা মমি আমাদের বাড়িতে ডেলিভারী…. ‘ পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম তাঁকে।
আমার কথা বলা শেষ হলে, স্যাম জোনস পায়চারি শুরু করলেন।কিছুক্ষন পর তাক থেকে বেশ কয়েকটা বই বের করে কী যেন খুঁজলেন।তারপর বেশ কয়েকটা কৌটা খুলে দেখলেন। কিন্তু ওঁকে দেখে মনে হলো যেটা খুঁজছেন সেটা পাননি।
‘ পেয়েছি,’ হঠাৎ চিৎকার করে বললেন স্যাম।
কাউন্টারের পেছনে একটা রুমের ভেতরে চলে গেলেন।কয়েক মিনিট পর ফিরে এলেন।তাঁর মুখে প্রশস্ত হাসি। উনি ডান হাতের মুঠি আমার মুখের সামনে তুলে ধরলেন।তারপর মুঠি খুললেন।
স্যামের হাতের তালুতে একটা গোলাপী রঙের পাউচ দেখলাম।ওটার সারা গায়ে সোনালি রঙের অনেকগুলো চোখের ছবি।
পাউচের মুখ খুলে ওটার ভেতর থেকে এক চিমটি নীল রঙের পাউডার বের করলেন। ‘মমি ডাস্ট! ‘ বললেন স্যাম। ‘ এটা খুবই প্রাচীন রহস্যময় এক খনিজ পদার্থের গুঁড়ো। লোকে বলে, মিশরীয়রা এই গুঁড়োটা পিতামিডের প্রবেশ পথে ছড়িয়ে দিত যাতে কোনও অশুভ আত্মা জীবিত মানুষের দুনিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে। এই গুঁড়োর এক চিমটি যে কোনও মমির ক্ষমতা নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। ‘
তারপর উনি আমার দিকে একটু গুঁড়ো ছিটিয়ে দিলেন। আম কেশে উঠলাম। গুঁড়োটার স্বাদ কটু।
‘ আমি ওটা নেব!’ চিৎকার করে বললাম আমি। ‘ওটার দাম কত?
রান্নাঘরে আসতে তোমার ভয় লাগে, তাই না, অনিক? ‘ ডিনারের সময় ডাইনিং টেবিলে শীলা ব্যঙ্গ করে বলল আমাকে।’আসলে বেসমেন্টের দরজাটা তো এখানে।’ ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের পেছনের দরজাটা নির্দেশ করল। ‘বাক্সটার ভেতরে রাখা মমিটাকে তুমি ভয় পাও, তাই না? ‘ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও। মমিরা যেভাবে হাঁটে সেভাবে হাঁটতে লাগল। ‘ওটা রাতের জন্য অপেক্ষা করছে।রাত হলে জেগে উঠবে।তারপর তোমার রুমে গিয়ে তোমাকে…’
‘চুপ করো! ‘ আমি চিৎকার করে বললাম।
‘যথেষ্ট হয়েছে! ‘ বাবা বলল। ‘শীলা , তুমি তো বড় বোন। ছোট ভাইকে ভয় দেখানো উচিত নয়।’ খাওয়া শেষ হলে বাবা চলে গেল ড্রইংরুমে টিভি দেখতে, আর মা রান্নাঘরে থালা বাসন ধুতে লাগল। আমি ডাইনিং টেবিলে বসে আইসক্রিম খাচ্ছি। শীলা আমার পাশে এসে বলল, ‘নিজেকে খুব সাহসী ভাবো, তাই না? আজ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করো।’
‘তুমি কী বলতে চাচ্ছ? ‘ আমি রাগত কন্ঠে জানতে চাইলাম।
‘বুঝতে পারোনি?’ শীলা বলল। গতকাল রাতে আমি ও মমিটার হাঁটার শব্দ শুনেছি। তুমি যে বাচ্চাদের মত কান্না করেছ তা-ও শুনেছি।’
তা হলে আমি গতকাল স্বপ্ন দেখিনি! শীলাও শুনেছে।
‘আমি ভয় পাচ্ছি না, ‘ বললাম আমি। ‘নিজেকে রক্ষা করতে জানি আমি। ‘
‘ঠিক আছে, দেখা যাবে, ‘ শীলা বলল।
নিজের বেডরুমে বিছানায় শুয়ে আছি আমি। খুব ঠান্ডা লাগছে।বাইরে প্রচন্ড ঝড় উঠেছে। তীব্র বাতাসের জন্য ক্ষণে-ক্ষণে জানালাগুলো কেঁপে উঠছে।
আমি অপেক্ষা করছি।
ডান হাতে শক্ত করে মমি ডাস্টের পাউচটা ধরে রেখেছি।ওটার স্পর্শ আমাকে সাহস জোগাচ্ছে।
জানালার কাঁচে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন ড্রাম বাজাচ্ছে।বারবার আকাশে বিদ্যুৎ চমকের সাথে-সাথে পুরো ঘরটা ক্ষনিকের জন্য সাদা আলোতে ভরে উঠছে।হঠাৎ শব্দটা শুনতে পেলাম।
ধুপ।
শব্দটা আমার বেডরুমের নীচ থেকে আসছে, রান্নাঘর থেকে। ভয়ে কেঁপে উঠলাম।
ধুপ। ঠং।
কারো কিংবা কিছু একটার অনুচ্চস্বরে গুঙিয়ে ওঠার শব্দ শুনলাম। ওটা কি বাতাসের শব্দ, নাকি মমিটা করেছে?
ধুপ।
মমিটা আমাকে ধরতে আসছে।
কিন্তু ওটার আসার জন্য আমার অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বেডরুমের দরজা খুললাম।পুরো শরীর থর থর করে কাঁপছে। কিন্তু তারপরে ও কোন ও মতে দোতলার সিঁড়ির কাছে এলাম।
হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল। নীচতলার হলঘরটা দিনের আলোর মত আলোকিত হয়ে পড়ল কয়েক মুহূর্তের জন্য।কোন ও মমিকে দেখলাম না।
ধুপ। ঠং।
আমি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলাম।একেক বারে দুটো করে ধাপ টপকালাম।হাতে এখন ও পাউচটা ধরে রেখেছি। হলরুমের কোনা ঘুরে রান্নাঘরের দিকে এগোলাম।
ধুপ।
কিছুটা একটা আমার পথ আগলে দাঁড়াল।
মমি !
এত ভয় পেয়েছি যে চিৎকার করতে ও পারছি না।
গলা দিয়ে শুধু গোঁ-গোঁ আওয়াজ বেরুল।
হলরুমের কোনার ছায়ায় ওটা দাঁড়িয়ে আছে। মমি ! একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে ওটা। সারা শরীর সাদা কাপড়ের ফালি দিয়ে মোড়ানো। সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো ওটার দু’হাত দেহের দু’পাশে ঝুলে আছে। হাতের আঙুল গুলো পর্যন্ত ব্যান্ডেজে মোড়ানো। নখগুলো লম্বা, ধারাল আর কালো রঙের।
বাক্সটা যে শিকল দিয়ে আটকানো ছিল ওটা এখন মমিটার কাঁদে ঝুলছে। মমিটা আমার কাছে এগিয়ে আসার সময় শিকলটা মাটিতে ঠং-ঠং শব্দ করছে।
তাড়াতাড়ি ! নিজেকে বললাম। অনেক কষ্টে ওটার ওপর থেকে নজর ফেরালাম। পাউডার নেবার জন্য পাউচটা খুলতে লাগলাম।
কিন্তু হায় ! ওটার মুখের গিঁটটা শক্ত হয়ে আটকে গেছে। আমার হাত এত কাঁপছে যে ওটা তে পারছি না। মমিটা নিচু স্বরে গুঙিয়ে উঠল। আমাকে ধরার জন্য ব্যান্ডেজে মোড়া হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দিল। ওটার থাবাগুলো বিশাল। ওটা এগিয়ে আসছে। আসছে।
অবশেষে পাউচের গিঁট খুলল। ভেতরের সবটুকু পাউডার হাতে ঢালার জন্য পাউচটা উপুর করতে লাগলাম। তখুনি মমিটা আমার সামনে এসে পড়ল। ওটার মুখের অশুভ হাসিটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
নিজেকে বাঁচাবার জন্য দুই হাতে মুখ ঢাকলাম। ওটার দুই হাত থেকে ঝুলে পড়া জীর্ণ কাপড়ের টুকরোগুলো আমার মুখে লাগল। ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলাম।
হঠাৎ পা হড়কে পেছনে পড়ে গেলাম।ব্যথায় দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরলাম। আমার হাত থেকে পাউচটা ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। সমস্ত মমি ডাস্ট মেঝেতে পড়ে গেছে।
বহুকষ্টে মেঝে থেকে এক মুঠো পাউডার তুলে নিলাম।
মমিটার মুখ থেকে ভয়ঙ্কর একটা গর্জন বেরিয়ে এল। বিদ্যুৎ চমকাল।দেখলাম, ভয়ঙ্কর দানবটা আমার দিকে ধেয়ে আসছে। দুই হাত প্রসারিত করে, তীক্ষ্ণ নখর যুক্ত হাত দুটো আমার দিকে তাক করা।ওটার মুখের সেই ভয়ঙ্কর হাসিটা আবারও দেখলাম।
কে ওখানে?’ দোতলার সিঁড়ির ওপর থেকে মা’র কন্ঠস্বরটা যেন গর্জে উঠল।
মমিটা আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেল।
হলরুমের সব গুলো বাতি জ্বলে উঠল।
আমাকে অবাক করে দিয়ে মমিটা ঘুরে দৌড়াতে শুরু করল ! যেন পালাতে চাইছে !
বিশ্বাস করতে পারছি না ! মা আমাকে বাঁচাল !
মমিটা বেসমেন্টের দরজার কাছে পৌঁছে গেছে। দরজা খুলে নীচে নেমে গেল ওটা।
আমিও দরজার কাছে দৌড়ে গেলাম।তারপর ওটা বন্ধ করে নবের নীচে একটা চেয়ার দিয়ে ঠেস দিলাম।
মা দ্রুত রান্নাঘরে এসে পৌছুল।পরনে নাইট গাউন। বাবা ও পেছনে-পেছনে এসেছে।
‘কী হচ্ছে, অনিক? ‘ মা কড়া গলায় জানতে চাইল।
‘মা, মমিটা…. জীবিত….’ আমি ফ্যাঁস-ফ্যাঁসে গলায় বললাম।’ওটা আমাকে ধরতে এসেছিল।এখন আবার বেসমেন্টে ফিরে গেছে।’
‘ওহ, যথেষ্ট হয়েছে, ‘ মা বলল। ‘আশরাফ, তোমার ছেলেকে বলো মমিরা জীবন্ত নয়।আর রাতের বেলায় ঘুরে বেড়ায় না।’
‘আসলে তোমাদেরকে কিছু কথা বলা হয়নি,’ বাবা গাল চুলকে বলল। ‘গুজব আছে, এই মমিটা নাকি জীবন্ত। ভেবেছিলাম কথাটা নেহাতই গুজব।’
‘কী’ মা আর আমি একসাথে চিৎকার করে উঠলাম।
বাবা ব্যাখ্যা করল। ‘অন্য একটা মিউজিয়ামে থেকে এই মমিটা আমাদের মিউজিয়ামে পাঠানো হয়।ওরা এটাকে রাখতে চায়নি, কারন ওদের নাইট গার্ড বলেছিল প্রতি রাতেই নাকি ওই মমিটা মিউজিয়ামের হলরুমে ঘুরে বেড়ায়।কিন্তু কিউরেটর শপথ করে বলেছে, মমিটা যে বাক্সে রাখা আছে ওটার শিকল কেউ না খুললে কোন ও সমস্যা হবে
না। কারন ওটা মন্ত্রপূত শিকল। ওই শিকল খোলা না হলে মমিটা জীবন্ত হতে পারবে না’
‘অনিক, তুমি কি বাক্সের শিকলটা খুলেছ?’ মা অস্থিরভাবে জানতে চাইল।
‘প্রশ্নই ওঠে না,’ আমি চেঁচিয়ে বললাম।
বাবা আঁতকে উঠল। ‘তা হলে নিশ্চয়ই কোনও ভাবে ওটা মুক্ত হয়েছে। ওটাকে আটকে রাখতে হবে ! কিচেন কেবিনেটের একটা ড্রয়ারে কী যেন খুঁজল। ওখান থেকে ভারী একটা তালা নিল।তারপর সশব্দে বেসমেন্টের দরজায় তালা মারল।
‘আমি খুবই দুঃখিত, ‘ বাবা বলল। ‘বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে নিজের পরিবারকে এত বড় বিপদের মধ্যে ফেলেছি। ভাবতে পারিনি গুজবটা সত্যি হয়ে যাবে। ‘
‘আমি ও দুঃখিত, অনিক,’ মা বলল, ‘তোমাকে বিশ্বাস করি নি। ‘
মা-বাবার সাথে দোতলায় উঠে এলাম। মমিটাকে ভালভাবে আটকে রাখা হয়েছে। এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব।
ওহ ! খুবই অন্ধকার। লাইটের সুইচটা ঠিক করার কথা বাবাকে বলতে হবে।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তো কিছুই দেখতে পাইনি।
বেসমেন্টটা ভুতুরে লাগছে।
সবাই ঘুমুতে যাবার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাকে।তারপর নিজের রুমে চুপটি করে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব।
ওহ, আরেকটু হলে ধরা পড়ে যাচ্ছিলাম।তবে খুব মজা পেয়েছি।এরকম মজা জীবনে ও পাইনি।অনিকের চেহারাটা হয়েছিল দেখার মত। যখন ওকে ধরতে যাচ্ছিলাম মনে হয়েছিল আরেকটু হলে পেসাব করে অজ্ঞাম হয়ে যাবে।
শীলা, তুমি আসলেই জিনিয়াস !
ওপরে, রান্নাঘরে কোনও শব্দ হচ্ছে না, মনে হয় সবাই চলে গেছে।এবার উঠতে হবে……..
কিন্তু একী ! বেসমেন্টের দরজা খুলছে না কেন? নিশ্চয়ই ওরা তালা আটকে দিয়েছে।
‘মা বাবা ! তোমরা আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? আমি শীলা। তোমরা আমাকে বেসমেন্টে আটকে ফেলেছ?’
বাইরে প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে। তীব্র বাতাসের শব্দে কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
‘মা ! বাবা ! অনিক ! তোমরা কোথায়?’
ওরা আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না। সারা রাত কি আমাকে এখানে আটকে থাকতে হবে?
ঠিক আছে, থাকলাম না হয় এখানে। পরনের এই কাপড়গুলোর জন্য নিশ্চয়ই শীত করবে না।ওহ, কাঁদের এই শিকলটা খুব ভারী।কেন যেন মনে হচ্ছে, বাক্স থেকে শিকলটা খোলা ঠিক হয় নি।কিন্তু টিভিতে দেখেছি মমিদের শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়।আর এই শিকল ছিঁড়ে ওরা বেরিয়ে আসে। অনিককে ভয় দেখানোর জন্য এবং পুরো আয়োজনটাকে জীবন্ত করার জন্য ওটা নেয়ার দরকার ছিল।
ছোট্ট ভেন্টিলেটার দিয়ে বাইরের বিদ্যুৎ চমকের আলো বেসমেন্টকে আলোকিত করে ফেলল কয়েক মুহূর্তের জন্য। ওই আলোতে ঘুমানোর জায়গা ঠিক করলাম।পুরনো একটা কাউচ।চলবে।
এক মিনিট ! এটা কী?
কফিনের ডালাটা খোলা !
শিকলটা নেবার সময় ওটা তো খুলিনি আমি !
কী হয়েছে?
মমি কেসটা খুলল কে?
ধুপ !
ধুপ !
ধুপ !
বাইরে আবার ও বিদ্যুৎ চমকাল। ক্ষণিকের সেই আলোতে শীলা দেখল বেসমেন্টের এক কোনা থেকে এগিয়ে আসছে…
*******************************************সমাপ্ত******************************************