ভুত, প্রেত, অশরীরী এই সব কথার সাথে কিন্তু শুধু আমরা পরিচিত তা নয়। বরং এই সবের নাম মুখে আনলেও শরীর সিরসির করে ওঠে। ছোট বেলায় যখন ভুতের গল্প শুনতাম তখন চোখের সামনে কল্পনার ছলে তা ভেসে বেড়াতো। বড় হয়েছি আর নিজেকে শক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছি। কারো জীবনেই কখোনো না কখনো এমন কিছু ঘটে থাকে যা তার জীবনে চিরসরন্বীয় হয়ে থাকে। এবং এখন আমি যা পাঠকদের বলব তা আমার জীবনে প্রথম আশ্চর্যজনক একটি ঘটনা এবং এই ঘটনার পর থেকে আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট ঘুরে যায়।
আমার নাম আশফাক আহমেদ। BSC পড়ার জন্য এই প্রথমবার আমার এলাকার বাইরে পড়তে যেতে হলো।এতো ভালো কলেজেই যে এডমিশন পাব তা ভাবনায় ছিল না। আমাদের কলেজটা একে বারে যে শহরের উপর ছিল সেটা বললে ভুল হবে। বাসার থেকে এতোদূর যখন পড়াশোনা করতেই এলাম তখন মনের ভেতর অনেক এক্সাইমেন্টের কারনে এখানে থাকার অসুবিধার কথা গুলো ভুলেই গেছিলাম। প্রথমে এসেই যে সমস্যায় পড়তে হলো সেটা হলো থাকার জায়গা। কলেজ অনেক ভালো মানের কিন্তু এখানের হোস্টেল টা বন্ধ। কলেজের হোস্টেল বন্ধ থাকার কারনে প্রথমেই মেস খুজতে আরম্ভ করলাম। মাসের মাঝামাঝি, তাই এই সময়ে মেসেও সীট ফাকা থাকেনা। যদিও কোন মেসে ফাকা থাকে, তবে মেস মালিকেরা সুযোগ খুজে বেশি ভাড়া আদায় করবার।ভাগ্য ভালো থাকার কারনে হয়তো একটা মেস পেয়ে তো গেলাম কিন্তু পরিবেশটা আমার ভালো লাগলো না। আমাদের মেস টা ছিল মেইন রাস্তার পাশে। আর মেসের পাশে ছিল একটা মরা নদী। সেই নদীতে বিভিন্ন ফেলবার জন্য দূর্গন্ধ ছড়াত সবসময়। আবার মাঝে মাঝে দেখতাম কুকুর মরে পড়ে আছে রাস্তায়। হয়তো এলাকার লোক ওই মৃত কুকুরের দেহটাকে মরা নদীতে ফেলে দিত বলেই এতোটা বিদঘুটে গন্ধ পেতাম। তাছাড়া মাঝে মাঝে রাতের বেলায় বিভিন্ন প্রকার মাদকের গন্ধ। সবমিলিয়ে একটা অসহনীয় পরিবেশের মেসে বসবাস শুরু আমার।
এর পরে যার বিষয় আলোচনা করব সে হলো আমার রুমমেট। এরকম মানুষও যে এ জগতে আছে তা তো ভাবতেও আমার কষ্ট হয়। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলতে গেলে যা দারায় তা হলো-
*অতিরঞ্জিত সবকিছু তে মনোযোগী।
*বেশ চুপচাপ।
*বয়সের তুলনায় বিচক্ষণ বেশি।
*আবেগ ও দূষ্চিন্তা মোটেও নেই।
*কারো বিষয়ে নিন্দা বা প্রশংসা শোনার উপর কৌতুহলী নেই।
প্রথম যেদিন তার সাথে পরিচিত হলাম,
– আমি আশফাক। আশফাক আহমেদ।
সে তখন বই পড়ছিল। বই এর পাতা থেকে মুখ না নড়িয়ে শুধু চোখ দিয়ে আমার দিকে একবার দেখে বলল ” রাশেদ, রাশেদ হাসান”
প্রথমে ভেবেছিলাম এর সাথে বোধহয় আমার বেশি দিন থাকা হবেনা। ঝগড়া হতো না এটা ঠিক আছে। তাই বলে এতোটা চুপচাপ মানুষের সাথে থাকা যায় নাকি। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর আমার সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। সে চুপচাপ হয়তো ছিল তবে তার কিছু বিশেষ দক্ষতা দেখে আশ্চর্য হলাম। যতদিন যায় ততই যেন তাকে আমি নতুন ভাবে দেখি।
এবার তার কিছু দোষ গুন সম্পর্কে আলোচনা করা যাক-
* রাত জাগে স্বাভাবিকের বাইরে। কিন্তু সকালে উঠে হালকা without Instrument exercise করে দৌড়ানো শুরু করে।
* প্রতিষ্ঠানগত পড়াশোনায় মন না থাকলেও বাহ্যিক জ্ঞানার্জনে প্রচুর আগ্রহী।
* এই বয়সের ছেলেদের মতো অত্যান্ত চঞ্চল না হলেও অনেক চালাক।
* যে কোন ধরনের hint বা ধাধা সমাধান করার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে।
* রাজনৈতিক ধারনা পূর্ণাঙ্গ থাকলেও এ দেশের রাজনীতির উপর কোনো আকর্ষন নেই।
* ইতিহাস ও সাহিত্যের উপর আকর্ষন আছে অনেক।
* বিজ্ঞান বিষয়েও জ্ঞান অর্জন করতে আগ্রহী, তবে আপেক্ষিকতা নিয়ে নাড়ানাড়ি করেনা।
* আর সর্বশশেষ যেটা তা হলো রহস্যের উপর আগ্রহ তার আমি বরাবরই দেখেছি।
এই বিষয়গুলো ওর মাঝে দেখার পর একটা অন্যরকম টান সৃষ্টি হলো ওর উপর।
ওর পুরো নাম রাশেদ হাসান চৌধুরী। ওখানেই আমার ওর সাথে প্রথম পরিচয়। ভাবতে পারিনি আমাদের বন্ধুত্ব এতো দূর পর্যন্ত আসবে। কারন ওর সাথে যখন গল্প করতাম তাতে এতোটুকু বুঝেছি যে রাশেদের সাথে কারো বন্ধুত্ব হওয়াটা একটু কষ্টকর হয়ে যায়। এই পৃথিবীতে অনেক রকম মানুষ আছে বটে তবে ওর মতো মানুষ আরেক টা আছে বলে আমার তো মনে হয়না।
ও খুব কম বিষয় নিয়েই আমার সাথে কথা বলত। বরং আমি ওকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতাম।
– খেলাধুলার প্রতি ইন্টারেস্ট কেমন তোমার?
– আগে প্রচন্ডরকম ছিল। এখন আকর্ষন টা কমে গেছে। ক্রিকেট পছন্দ, ফুটবল তেমন পছন্দ না। তবে মাধ্যমিক এর পর অনেকদিন ধরে বক্সিং খেলেছি।
– বক্সিং?
– হ্যা। মোটামুটি অনেক দূর এগিয়েছিলাম। ন্যাশনাল লিগ খেলতে গিয়ে থার্ড হয়ে বাসায় ফিরি। তারপর থেকে ওটার উপরও আকর্ষন কমে গেছে।
ওর কাজকর্ম দেখে বুঝতে পারতাম ওর জীবনের লক্ষ্য ওর সেভাবে ঠিক করা নেই। কখন যে কিসের উপর আকর্ষন চলে আসে তা যেন ও নিজেও জানেনা। যা আছে তা হলো শুধুই জ্ঞানার্জন। ও আমাকে প্রায়সময়ই বলত – ” আমার আছে অতীত নিয়ে ভাবার সময় নেই। আর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে মস্তিষ্ককে কষ্ট দিতে চাইনা। আমি বর্তমান বিশ্বাসী।”
ওর সাথে থাকে আমি বুঝেছিলাম যে ওর এই বিচক্ষণতা ও যদি বিজ্ঞান কিংবা রাজনীতি তে লাগায় তাহলে ও অনেক উপরে উঠতে পারবে। কিন্তু ও সেটা চায়না। ও চায় মানুষকে অন্যরকম ভাবে সাহায্য করতে। যে কাজ সাধারন মানুষের করতে গেলে একটু কষ্টলভ্য হয়ে পড়ে তা কেমন যেন ওর কাছে অনায়াসসাধ্য। যেহেতু আমরা একই রুমে থাকতাম তাই ওর এই অদ্ভুত প্রতিভা গুলো আমার সাথেও সেয়ার করতো। তবে কোনোদিন চাক্ষুষরুপে দেখিনি। তবে আমার এই আশাটা পূরণ হতে বেশী দিন অপেক্ষা করতে হলো না।
আমার সম্পর্ক দিনদিন গভীর হতে থাকলো। তাই আমাদের সম্পর্ক “তুমি” থেকে “তুই” তে নামতে বেশি সময় লাগেনি।
একদিন রাতে, হঠাত করে লোডশেডিং হলো। চারিদিকে ঝিঝিপোকাদের কর্কশ আওয়াজ ভালো করেই কানে আসছিল। আজ অবশ্য চাঁদের আলো নেই। তাই বুঝতে পারলাম যে আমাবস্যা। মনের ভেতর কেমন করতে শুরু করল। রাশেদ তখন মাত্র মোমবাতি জালিয়ে আমার সামনে বসল। ভয় কাটাবার জন্য ওর সাথে কথা বলা শুরু করলাম –
– মেসের ভাড়াটা একটু বেশি হয়ে পড়ছে না দিন দিন?
– হ্যা, কলেজের হোস্টেলটা বন্ধ থেকেই ঝামেলাটা হয়ে গেলো।
– ওরে বাবা, তুই ওই ভুতুরে হোস্টেলে উঠবি নাকি?
– বিংশশতাব্দী তে বসবাস করেও ভুতের উপর বিশ্বাস করিস?
– আসলে এই বিশ্বাস টা কিন্তু ছোটবেলায় দাদাদাদি দের মুখে ভুতের গল্প শুনেই সৃষ্টি হয়।
– তোর কি মনে হচ্ছে আমি কোনদিন ভুতের গল্প শুনিনি? এই ভয় টা কখনোই গল্প শুনে আসেনা। আত্মার দুষ্চিন্তা ও কষ্টের কিছু রুপক চেহারা হলো ভয়।
কথা টা কেমন যেনো মাথার উপর দিয়ে গেলো। তবে বুঝতে পারলাম যে এটা অনেক গভীর কথা। পরে ভেবে দেখবো। ও আবার বলল-
– মনে যদি সাহস থাকে আর দূষ্চিন্তা যদি দূর করা যায় তবে ভয় জানালা দিয়ে পালাবে।
বেশকিছু দিন কেটে গেলো। আমার মেস টা কলেজ থেকে বেশি দূর নয় বটে তবে এখানে যে সব ঘটনা ঘটে তা চিন্তার বিষয়। প্রায় সময়ই পুলিশের রেইড হয়। এবং মাদক ব্যবসায়ী রা ধরা পড়ে। তবে মূল উৎস খুজে পাওয়া যায়না। কখন কোথায় রেইড শুরু হয়ে যায় বলা যায় না। তাই এবার মনকে স্থির করে ফেললাম যে এই এলাকায় থাকা অসম্ভব। কিন্তু যাবো কোথায়। কলেজের হোস্টেল খোলা তো দূরে থাক, হোস্টেলের চৌকাটের আশে পাশেও কেও যায়না। ঐ একটাই কারন। আর সেটা হলো ভুত। শুধু ভুত নয় এনারা নাকি মহিলা ভুত। আসলে এর পেছেনও রয়েছে একটা ঘটনা।
৬ বছর আগে এখানে ঘটে যায় এক অস্বাভাবিক শোচনীয় একটা ঘটনা। সেই ঘটনায় স্বীকার হয় দুইজন মেয়ে। যাদেরকে প্রথমে ধর্ষন করা হয় এবং অবশেষে খুন। খুন করার পর নাকি তাদের পানির ট্যাংকের ভেতর রাখা হয়। এবং যখন সবাই দেখে যে পানির পাইপে পানির বদলে রক্ত বের হচ্ছে তখনই সবাই টের পায়। তারপর থেকেই হোস্টেল বন্ধ।
রাত ১২ টা পার হতে না হতেই হোস্টের চৌকাঠ যেন ভিন্ন এলাকায় পরিণত হয়। নুপুরের আওয়াজ আর সেই তীক্ষ্ণ কুচ্ছিস মেয়েলি হাসি নাকি যে শুনে থাকে তার দেহ নাকি নাড়াবার ক্ষমতা থাকেনা। এই কথা রাশেদকে বলতেই আমাকে বলে উঠলো-
– সেই রহস্যের সমাধান হয়েছিল কি?
– নাহ তা হয়নি। খুন টা ছেলেদের হোস্টেলে হয়েছিল ঠিকই কিন্তু প্রত্যক্ষ দোষী দের ধরা যায়নি।
– সে রহস্যের সমাধান তখন যেহেতু হয়নি, এখনো হবেনা।মারামারি কাটাকাটি হয়ে অনেক হোস্টেলই তো বন্ধ হয়, তাই বলে যে এখানকার লোকজনসহ সরকারের কোন মাথা ঘামানো নেই সে টা এই প্রথম দেখছি।
– (ঠাট্টার ছলে বললাম) আরে এটা জানিস না যে দুনিয়াতে যতো ভয় আছে সব চেয়ে বড় ভয় হলো ভুতের। তুই যেহেতু এই ভয়টাই পাস না তাহলে তুই একটু গিয়ে দেখে আয় ওই হোস্টেলের ভুত গুলোকে।
৫ সেকেন্ডের মতো চুপ করে হঠাত করে বসে থাকা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো।
– কি হলো?
– তুই এরকম ভুতুড়ে বিনোদন সরাসরি দেখতে যেতে বলছিস, এই সুযোগ টা হাতছাড়া করি কি করে বল।
– তুই কি পাগোল। রাত হউয়ার সাথে সাথে শিয়াল যেভাবে ডাকে, সেই ডাক নাকি বাঘের গর্জনের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে ওঠে মধ্যরাতে।
– সব ছেড়ে মধ্যরাতে?(একটু হেসে বলল)
– হ্যা। আমি তো শুনেছি যে মধ্যরাতে শেয়াল আর কুকুর দুটোই একসাথে হাক দেওয়া শুরু করে।
– তুই এতো কথা আবার কবে কার কাছে শুনলি?
– শুনতে হয়। সবাই তো তোর মতো না। কলেজে আসার পর থেকে কার মুখে এই সব নিয়ে কথা শুনিনি বলতো।
– চল
– কোথায়?
– একটা কৌতুহল মিটিয়ে আসি।
সেই দিন ওর সাথে কলেজ এর আশে পাশে ও হোস্টেল টাকে দূর থেকে কিছুটা পর্যবেক্ষন করলাম। আসলে অনেকদিন ধরে হোস্টেলের এলাকাজুড়ে ওই শেয়াল কুকুর ছাড়া আর কোন প্রাণীর অবস্থান নেই। তাই জায়গাটা যে শুধু জনমানবহীন হয়ে পড়েছে তা নয় বরং হয়ে পড়েছে ভয় দ্বারা আচ্ছন্ন। মনে মনে ভাবলাম, দিনের বেলাতেই এখানে এরকম ভীতি সঞ্চয় হচ্ছে মনে তাহলে রাতে যে এখানে কোন অশরীরী আসে না এর কোনো নিশ্চিত কথা বলা ঠিক হচ্ছে না।
মানলাম যে ভুত বলতে কিছু নেই, তাই বলে মানুষের সাথে যে অলৌকিক কিছু ঘটেনা তা তো নয়। আর অলৌকিক বিষয় যদি থাকতে পারে তাহলে ভুত কেনো থাকবে না।
দিন যাচ্ছে আর পরিস্থিতিও খারাপের দিকে যাচ্ছে। মেসের অনেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই মেস সহ এই এলাকাতে তারা আর থাকতে রাজি নয়। রাশেদকে বলেছি কিন্তু ওর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কারন ওর এই রকম পরিবেশে থাকতে অসুবিধা নেই। তবে আমি যদি জোড় করি তবে আমার সাথেই ও থাকবে।
যেমন কথা তেমন কাজ। মাসটা শেষ হতেই সব জিনিসপত্র নিয়ে সরে পড়লাম পাশের এলাকার মেসে।এখানে সকালের পাখিদের কলরব বেশি ভালো লাগে। মাঝে মাঝে দেখি রাশেদ একমনে পাখিদের ডাক শুনে যাচ্ছে। যেন মনে হয় ও রবিন্দ্র সংগীত শুনছে। এখানে কিছুদিন থাকার পর একদিন,
(কলিং বেলের আওয়াজ)
রাশেদ দরজা খুলল। যে এসেছে সে হলো আমার মামা। আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। নতুন পরিবেশে কেমন আছি সেটা দেখতেই মামা এসেছে। আমিও মামাকে বলে দিলাম আগের মেসের তুলনায় এখানে দিব্যি আছি।
মামার সাথে রাশেদেরও পরিচয় হলো। মামার নাম রিয়াজুল ইসলাম। মামার হাতে একটা ব্যাগ এবং একটা ফাইল। ফাইলটা ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে আমাকে বলল – তোর জন্য একটা Surprise এনেছি।
– Surprise টা বুঝি আপনার নতুন গাড়ী? (হঠাত রাশেদের প্রশ্ন)
– তুমি কিভাবে জানলে? (মামা)
– আপনি যখন আপনার ব্যাগে ফাইল টা ঢুকাচ্ছিলেন তখন আপনার সবে বানানো ড্রাইভিং লাইসেন্স টা দেখতে পেলাম। তাই একটু অনুমান করেই বললাম।
Surprise টা মামা আমাকে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি রাশেদের কথাতেই Surprised হয়ে গেছি।
– বাহ, তুমি তো ভালো অবজারভেশন জানো। তো আর কিছু অনুমান করতে পারলে কি?(মামা)
– হুম।
– কি?
– আপনি পুলিশ বা অন্যকোন প্রতিরক্ষা বাহিনী তে চাকরিরত অবস্থায় রয়েছেন।
এই টা শুনে আমিও অবাক হয়ে গেলাম। তারপর ওকে বললাম।
– মামা আসলে পুলিশের OC পদে রয়েছে।
– কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে?(রাশেদকে মামার প্রশ্ন)
– আপনার মুখ এবং হাতের তুলনায় পায়ের চামড়া অনেক ফর্সা। অর্থ্যাত আপনার মুখ এবং হাতের চামড়া আবহাওয়াগত কারনে পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এটা আপনার চামড়ার আসল রঙ নয়। আর পায়েরটা পরিবর্তন হয়নি কারন পা সবসময় ঢাকা অবস্থায় থাকে। অর্থ্যাত বুট পড়ে থাকেন। তাছাড়া আপনার হাটাচলার স্টাইল ও বডি ফিটনেস দেখে আপনি যে কোন বাহিনী তে চাকরি করেন তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না।
– আমি তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছিনা। শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতেও যে এতো বড় অবজাভেশন করা যায় তা এই প্রথমবার দেখছি।
রাশেদ মুচকি একটা হাসি দিল।
হ্যা মামা আসলেই একটা সাদা Private Car কিনেছে। সেটাতে চড়েই এসেছেন আমাকে দেখবার জন্য
মামা আমাদের বলল তার গাড়ী নিয়ে এলাকার আশেপাশে একটু ঘোরার জন্য। কিন্তু আমাদের দুইজন কেওই আমরা ড্রাইভিং পারিনা। তাই মামাকে নিয়েই বের হোলাম। মামার পাশে গিয়ে বসলো রাশেদ এবং আমি বসলাম পেছনে। আমরা তিনজন ভালই গল্প করতে করতে যাচ্ছি। মামা বলল,
– তোমাদের আগের মেসের পাশে আবারো একটা মাদকের আড্ডাখানা পাওয়া গেছে। তবে আসলটাই পাওয়া যাচ্ছে না।
– আসলটা এমন কোথাও আছে যেখানে মানুষ কোনদিন কল্পনাও করতে পারবেনা। (আমি)
– আচ্ছা এটা কি ভাসমান ডেরা হতে পারে? (রাশেদ)
– যেমন? (মামা)
– যেমন, হয়তো কোন গাড়ির মাধ্যমেই এই মাদক বিক্রি করা হয়। দেখুন, গাড়ি কিন্তু যখন তখন তার স্থান পরিবর্তন করতে পারে। তাই এই রকম ডেরা খুজে পাওয়া কিন্তু কষ্টকর। তবে গাড়ি ছাড়া অন্যকিছুও হতে পারে।
– একদম রাইট। এরকম ভাবনা পুলিশের মাথায় এলোনা আর তোমার মাথায় চলে এলো। কিন্তু সেটা যদি গাড়ি হয় তবে আমি বলব যে, গাড়ি তো আমরা সার্চ করে থাকি। তবে সেটা গাড়ি ছাড়া অন্যকিছু হলে বোধহয় ধরাটা কষ্টলভ্য হয়ে পড়বে।
কিছুক্ষণ যাবার পর দুই তিন টা কুকুর আমাদের গাড়ীর পেছনে এমন ভাবে ছুটছে তা দেখে মনে হচ্ছে ওদের কি না কি আমরা নিয়ে যাচ্ছি। মোটেও পিছু ছাড়ছেনা। বরং ওদের হিংস্র মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে যে ওরা যদি পারত তবে গাড়ীটিকে চিবিয়ে খেত। বিষয় টা আমার বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু ভালো লাগার থেকে বিরক্তিকর হয়ে উঠলো তখন যখন দেখলাম ২/৩ টা নয়, পুরো ১০/১২ টা কুকুর আমাদের পেছন পেছন আসছে ও ঘেউ ঘেউ করছে। রাশেদ দেখলাম মিটি মিটি করে হাসছে কুকুর গুলোকে দেখে। মামা বলে উঠলো,
– এই খানের কুকুরগুলা যা বদ। সাদা গাড়ী দেখলেই এরা যেনো এদের শত্রুদের দেখে।
– সবসময়? (রাশেদ প্রশ্ন করলো)
– হ্যা। তবে রাতে তুলনামূলক কম। কারন রাতে ড্রাইভার রা আর কুকুরের মায়া করেনা, যার কারনে অনেক কুকুরই গাড়ীর নিচে চাপা পড়ে।
এবার কুকুরের রাস্তার মারা যাওয়ার ঘটনা টা বুঝলাম। হঠাত করে সামনের দিকে তাকাতেই দেখলাম রাশেদ আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর চোখগুলো যেন আমাকে কিছু বলতে চায়।
ঘোরাঘুরি পর্ব শেষ হবার পর মামা বিদায় নিতে চাইলো। সন্ধ্যা হয়ে এলো। রাশেদও মামাকে আবার আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে মামার ফোন নাম্বার টা রেখে দিয়ে মামাকে বিদায় জানালো। মেসে ফিরে এসে রাশেদকে একটু উত্তেজিত অবস্থায় দেখলাম।
এবার লক্ষ্য করলাম রাশেদের কিছু একটা নিয়ে ভাবছে। কি নিয়ে ভাবছে জিজ্ঞেস করতে যাবো তখনই
– এক্ষুনি একটা খোজ নিতে হবে, চল।
– কোথায়, কিসের, কেন?
– তোর এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর খুজে পাবোনা।
কথা না বাড়িয়ে ওর সাথে বেড়িয়ে পড়লাম। প্রথমেই আমরা চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে চা খেতে বসলাম। চায়ের এই দোকান টা হোস্টেল থেকে বেশি দূর নয়। এখান থেকে কলেজ গেটের বাতি ভালো ভাবেই দেখা যায়। আর কলেজের পেছনেই তো হোস্টেল। যে দোকানে বসে চা খাচ্ছি সেই দোকানের বোর্ডে লেখা রয়েছে “রতন টি স্টল”। বুঝলাম যে এই চা ওয়ালা দোকানদারের নাম রতন। তাকে আমরা কাকা বলে সম্বোধন করেই ডাকতে শুরু করলাম। তারপর চা ওয়ালা দোকানদারের সাথে রাশেদ কথা বলা শুরু করল
– কাকা, আপনি দোকান বন্ধ করেন কখন?
– খুব জোড় হলে ১২:৩০ টা। এছাড়া ১১:৩০ বা ১২ টা তেই দোকান বন্ধ করে দিই। এর বেশি সময় আমার দোকান চলেনা।এর পর আর কাওকে খুজে পাওয়া যায়না। আর আমার বাসা কাছে বলেই এতো রাত পর্যন্ত থাকা হয় আমার। নাহলে আমিও থাকতাম না।
– কোথায় আপনার বাসা?
– এই যে রাস্তা দেখছ। এর ওপাশে কয়েকটা কাঁচাবাজার এর দোকান আছে। তার পেছনেই আমার বাড়ি।
এই ভাবে কিছু কথা বলার বলার পর সরাসরি আসল কথায় আসলো রাশেদ।
– আচ্ছা, আমার এই হোস্টেলে রাতে যে ভৌতিক ঘটনা গুলো হয়ে থাকে, এইগুলো ঠিক কখন শুরু হয়?
– আসলে আমি তো দোকান টা একটু তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিই।
– বন্ধ করে দেওয়ার কারন টা কি ভয়?
– এখানকার কোন দূরের দোকানই ১ টার পর আর খোলা থাকেনা। আমাদের ভয় দেখে আর কি হবে। কাস্টমাররাই ভয় পায়। ওই সময় কেও আর বাড়ির বাইরে বের হয়না। তাই আমিও আর খোলা রাখিনা।
– আপনার এই তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করার কারন বুঝি…..
– (রাশেদের প্রশ্ন করার আগেই উত্তর) ভুত। (এর পর আমতা আমতা করে বলল) আসলে আসলে আমি একটু যেদিনই দেরি করে ফেলি সেইদিনই এখানকার ওইসব ভুতুড়ে কান্ডগুলোর শব্দ শুনতে পাই।
– থাক। আপনার আর কিছুই বলা লাগবে না। এই রহস্যের সমাধান আমি আজই করব।
– ভুত দেখতে দেখতে রহস্য খুজে পেলি কখন? (আমি)
– সেটা আজ রাতেই দেখবি।
তারপর রাশেদ কাকাকে বলল-
– আজ কিন্তু আমরা ভুত দেখেই ছাড়বো কাকা। আর আপনি আমাদের সাথে থাকবেন।
– (একটু ঢক গিলে) এই না না না। আমাকে মাফ করো তোমরা বাবা। আর এই সব কাজে জড়িয়ো না। মারা পড়বে।
– আরে কাকা, ভুত ফুত বলতে কিছু নেই। আর এখানে যেটা দেখেন তা হলো রহস্য।
– কোন রহস্য?
– আপনাদের এলাকার বাতাশে যে রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে। এমনকি পুলিশও যে রহস্য এখনো ধরতে পারেনি। এই রহস্যের সমাধান আজকে আমি করবো।
– মানে কি তুমি…..
– এতো মানে আপনার জানার দরকার নেই। আপনি শুধু আমাদের সাথে থাকবেন এটাই ফাইনাল।
রতন কাকা চুপ করে গেল। বুঝতে পারলাম সে আর নারাজি হবেনা। আমরাও মেসে চলে আসলাম। আমি তো এসেই রাতের কথা ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে পড়ছি। আমাকে রাশেদ বলল – এখন একটু ঘুমিয়ে নে। একটু বেশি রাত পর্যন্তই জাগতে হবে কিন্তু।
আমি আর কথায় দ্বিমত না করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। প্রথমে ঘুম আসছিল না। রাতের কথা ভেবেই শরীরের মধ্যে কাটা ফুটছিল। তবুও ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমানোর পর দেখলাম এক ভয়ংকর সপ্ন। এরকম সপ্ন আমি আগে কোনদিন দেখিনি। আমি দেখতে পেলাম কিছু কুকুর ও শেয়াল একটা রক্ত মাখা ছেড়া পোশাক নিয়ে টানা হেচরা করছে। পোশাকটা একটা মহিলার। দেখলাম কিছুদূরে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে হিংস্র ভাব। সে ওই কুকুর গুলোর দিকে তার মনের সমস্ত ঘৃণার সাথে তাকিয়ে আছে। এবার লক্ষ্য করলাম ওই মহিলার ঠিক পেছনে আরেকজন মহিলা। ঠিক মহিলা বললে চলেনা। ১৯/২০ বছরের একজন মেয়ে। মেয়েটি ওই মহিলার দ্বারা আড়াল হয়ে দেখছে সব। জামাটা বোধহয় ওই মেয়েটার। কি জঘন্যতম দৃশ্য। কিছু সময় পর দেখছি আমার আশে পাশে সবাই কুকুর। কেও কি মানুষ নেই। সব পুরুষই কি তাহলে কুকুর হয়ে গেলো। ভাবলাম নিজে কি এখনো মানুষ আছি? নিজের শরীরের দিকে তাকাতেই ঘুম ভেঙে গেলো। রাশেদ আমাকে ডাকছে। উঠে বসলাম। দেখলাম আমার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে গেছে। কেন এই সপ্ন দেখলাম। এই সপ্নের মানে কি? আমার এই সব প্রশ্নের উত্তর খোজার আগেই রাশেদ আমাকে রেডি হতে বলল বের হবার জন্য। ঘড়িতে রাত ১১ টা বাজে। আমরা বের হোলাম। গিয়ে বসলাম রতন কাকার দোকানে। রাশেদ কাকাকে জিজ্ঞেস করল,
– আজ একটু বেশি সময় পর্যন্ত আপনাকে দোকান খোলা রাখতে হবে।
– তোমার কি মনে হয়? এখানে কি আছে? (ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কাকা)
-(মুচকি হাসল। তারপর বলল) যাই থাকুক না কেন, ভুত নেই এতোটুকু বলতে পারি।
মামা অস্থির হয়ে উঠল।
রাত ৩ টা। এলাকা পুরো নীরব। রাশেদ দাত চেপে চেপে বলল, “এটাই পারফেক্ট সময়। চলুন ভেতরে যাওয়া যাক”।
কাকা দেখলাম ভেতরে যেতে কেমন না না ভাব করছে। কিন্তু রাশেদের পীড়াপীড়িতে শেষমেশ যাওয়াই লাগল। আমরা কলেজ গেটের ভেতরে ঢুকলাম।
শুনতে পেলাম অসম্ভব কুচ্ছিত ভয়ংকর সেই আওয়াজ। যা শুনে আমার শরীরকে আমি কম্পন থেকে বিরত রাখতে পারছি না। রাশেদের উপর খুব রাগ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যে কেন যে ওর কথা শুনে এখানে আসলাম। এই কথা ভাবছি আর ওর দিকে তাকালাম। দেখলাম ওর চোখ গুলো তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে আছে সম্মুখে। আর ওর পাশে রতন কাকা তো মুখটাকে হাত দিয়ে চেপে রেখে দিয়েছে। বুঝলাম সে আমার থেকেও ভয়ংকর পরিস্থিতিতে রয়েছে।
হঠাত করে একটা ক্ষীণ আওয়াজ পেলাম। আওয়াজ টা শুনে মনে হচ্ছে কোন কিছু গড়িয়ে গেলে যে রকম আওয়াজ হয় ঠিক সেই রকম। সাথে সাথে কুকুরের ডাক ও শুরু হয়ে গেলো। রাশেদকে জিজ্ঞেস করলাম,
– কিসের আওয়াজ রে এইটা?
– গাড়ীর।
– গাড়ীর?
– হুম। অনেক ধীরে ধীরে যাচ্ছে। আর তারপর ব্রেক করেছে। সেই জন্যই আওয়াজ টা হলো। আর এই জন্যই কুকুর ডাকছে।
– গাড়ী যাচ্ছে বলে কুকুর ডাকবে কেনো?
– কারন গাড়ী টা সাদা।
(আমি যেন কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলাম)
আসলেই এই বিষয় টা আগে ভাবা হয়নি।
আমরা কলেজ প্রাচীর ডিঙিয়ে পার হয়ে হোস্টেল গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকে হোস্টেলের ক্ষেত্রে প্রবেশ করলাম। এবার আসলেই দেখতে পেলাম এই অঞ্চলের সবচেয়ে সমালোচিত বিষয়বস্তুর আড্ডাখানা এখানেই। বর্ডার থেকে যেসব মাদকদ্রব্য সাপ্লাই করা হয় তার ডেরা তৈরী হয়েছে এখানে। আগুন জ্বালিয়ে ওরা সব কাজ করছে বোধহয়। দূর থেকে আমরা ভাল করে দেখতে পাচ্ছি না। তাই আসতে আসতে কাছে যেতে লাগলাম। সল্প আলোতে ওই খানে যে একটা গাড়ী আছে তা ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছিলো না।
রাশেদ ফিসফিস করে বলল,
– ভেতরের কেও তো অবশ্যই আছে।
– ভেতরের কেউ মানে?
– মানে, আমাদের কলেজেরই কেও। ভেতরের কারো হাত না থাকলে এতো বড় ডেরা খোলার সাহস হত না।
রাশেদ আরো কিছু বলতে যাবে এমন সময় হঠাত রতন কাকার চিৎকার। চিৎকার দিয়েই মুখে আবার হাত চেপে ধরল। তার ভীত ভাবকে সে আর চাপা দিয়ে রাখতে পারেনি।
আমাদের আর ভাবার সময় নেই। কারন রতন কাকার চিৎকার শুনে ওরা ডেরা থেকে বেড়িয়ে এসেছে।
আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি দুইজন স্বাস্থ্যবান লোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। রাশেদও অকস্মাৎ ভাবে ওদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল ওর বক্সিং এর শেখা কয়েকটা হুক আর পাঞ্চ মেরে ওদের দুইজনকে কাবু করে দিল।
এরপর দেখলাম ওরা আরো কয়েকজন এগিয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের কপাল ভালো যে ইতি মধ্যে আমরা পুলিশের হুইসেলের আওয়াজ পেয়ে গেছি। বুঝতে পারলাম পুলিশ ডাকা টা রাশেদেরই কাজ। পুলিশ আসার আওয়াজ পেয়ে সবাই পেছনের গেট থেকে বের হবার জন্য সেই দিকে দৌড় দিল। কিন্তু বেচারাদের ভাগ্য খারাপ। পুলিশ সবগুলা গেট ঘিরে ফেলেছে। বুঝতে পারলাম এখানে আমার মামার মাধ্যমেই রাশেদ পুলিশ আনিয়েছে। এরজন্যই রশেদ হয়তো মামার ফোন নাম্বার নিয়েছিল।
ধরা পড়ল সবাই। আর রাশেদ ঠিক কথাই বলেছিল। কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের সহায়তাতেই এই কুকর্মের ডেরা এখানে গজিয়েছিল। পুলিশ সবাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। অবৈধ মাল বলতে তেমন কিছুই পাওয়া গেলোনা। শুধু মাত্র কিছু ইন্ডিয়ান মাদকদ্রব্য পাওয়া গেল। কিন্তু এতো টুকু দিয়ে তো আর ব্যবস্যা চলেনা। তাছাড়া শুধু এই মাদকদ্রব্য দিয়েও এতো বড় ব্যবস্যা পরিচালনা করলে তো এতোটা গোপনীয় ভাবে করতো না। এই ভাবনা গুলো শুধু আমি না রাশেদও ভাবছিল। হয়তো ও আমার থেকে একটু বেশি ভেবেছে। পুলিশ এমনিতেও সব তল্লাশি করত তবুও রাশেদ বলল “গাড়ীটা ভালো করে সার্চ করেন”।
গাড়িতে তেমন কিছুই পাওয়া গেলোনা। যা পাওয়া গেল তা হল ঝালের গুড়ার প্যাকেট। আসলে আমরা যেটাকে কিছুনা মনে করছি এটাই আসলে সবকিছুর মূল।
দারোগা তাৎক্ষণিক ভাবে প্যাকেট গুলো খোলার নির্দেশ দিল। কিন্তু রাশেদ বলল,
– তার কোন প্রয়োজন নেই। এর ভেতর কি আছে আমি জানি।
– কি আছে? (দারোগা)
– ইয়াবা ট্যাবলেট।
– ঝালের প্যাকেটে ইয়াবা ট্যাবলেট?
– হুম।
– কিন্তু কেনো?
– এটা বুঝলেন না। আজ পর্যন্ত কেউ ঝালের সাথে ইয়াবা পাচারের পরিকল্পনা করেনি। তাই পুলিশও এতে সন্দেহ করেনি।
– তাহলে তুমি কি করে বুঝলে?
– আমি সবকিছু অন্যরকম ভাবে বোঝার চেষ্টা করি দারোগা বাবু। ইয়াবা ট্যাবলেট লাল এবং ঝালের গুড়াও লাল। তাই এরা এমন একটি পদ্ধতি বানালো যে ঝালের সাথে সংমিশ্রণ করে রাখলেও তা পরে গিয়ে আলাদা করা যাবে।
পরে দেখা গেল রাশেদের অনুমানই ঠিক আছে। ঝালের গুড়ার সাথে ইয়াবা ট্যাবলেট গুলো এমন ভাবে মিশ্রন করা হয়েছিল যে তা পরবর্তীতে আলাদা করা যাবে।
বাসায় আসার পর,
– এত অনুমান আসে কোথা থেকে রে তোর?
– এত অনুমান করেও তো আমার কোন লাভ হলনা।
– কোথায় লাভ হলোনা। তুই না ধরতে পারলে এই ডেরা কেও ধরতে পারত না, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি।
– কিন্তু বেলাশেষে এই ডেরাও যে সাময়িক ডেরায় পরিণত হলো।
– মানে?
– এই ডেরা তখনই স্থায়ী ডেরা হত যখন এর মাস্টার প্লানার কে ধরতে পারতাম।
– তারমানে ওদের ভেতর আসল অপরাধী নেই।
– আমি দৃঢ় বিশ্বাস দিয়ে বলতে পারি নেই। কারন যার এতো বুদ্ধি, যে এতো সাবধান কৌশলে কাজ করেছে এতোদিন। তাকে ধরা এতো সোজা হবেনা। যার মাথায় এতো বুদ্ধি সে এতো সহজে আমাদের ধরা দেবে বলে তো মনে হয়না।
আমিও দেখেছি আসলে এই সব কেসের ক্ষেত্রে সাধারণত আসল মাথা টা কেই ধরা যায়না। হয় তো সে আমাদের মাঝেই আছে, আমাদের সাথে কথা বলছে। কিন্তু আমরা তাকে ক্ষণিকের জন্যেও সন্দেহ করিনি।
অবশেষে রাশেদকে বললাম – এতো দিনে বুঝতে পারলাম যে তোর কোন কাজ করতে সবচেয়ে ভালো লাগে?
– কী?
– গোয়েন্দাগিরি।
– কোন কিছু উদ্ঘাটন, গবেষণা আর অনুষন্ধান করা আমার শখ এবং নেশা। এখন এটাকে তুই যদি গোয়েন্দাগিরি বলিস তাহলে আমার কিছু বলার নেই।
তবে রাশেদের মনোভাব দেখে যা বুঝলাম, ও এতো বড় সাফল্য পাবার পরও খুশি নয়। কারন ও অবশ্য আমাকে বলেছিল এই সব ছোটখাটো কেস ও আগেও সমাধান করেছে। কিন্তু এই কেসের মাস্টারপ্লানার কে ওর ধরার খুব ইচ্ছা ছিল। ওকে দেখে আমি বুঝেছি ও কখনই নিজেকে সবার সামনে প্রতিভাবান প্রমাণ করতে চাইনি। তবে অপরাধীদের কাছে সবসময় কাটা হয়ে দারাতে চেয়েছে।
এখন ওকে কলেজে চেনেনা এমন কেও নেই। সবাই এখন ওর প্রতি গর্বিত। কারন ওর জন্যেই তো সবাই এখন হোস্টেলে থাকার সুযোগ পেল। আর আমি নিজের কাছে গর্বিত এই রকম একজনের সংস্পর্শ পেয়ে। তাই আমি ওকে ছাড়ার কথা কোনোদিনও ভাবতে চাইনা।
শুধু এটাই নয়। আরো অনেক কেস ঘেটেছি আমি ওর সাথে। তাই ও যতক্ষন পাশে থাকে আমার একটা মুহূর্তও নিরামিষ মনে হয়না।
*********************************************সমাপ্ত******************************************