যুঁথির এসএসসি পরীক্ষার পর তার বাবা মবিন সাহেব প্রস্তাব করলেন সবাইকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাবার। যে প্রস্তাব যুঁথির মা আফসানা প্রথমেই নাকচ করে দিলেন। তিনি স্বামীর জ্ঞানবুদ্ধির তিরস্কার করে বললেন তার যুগ বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে, পরীক্ষার পর এখন কেউ আম কাঁঠাল খেতে মামা বাড়ি দাদাবাড়ি যায় না, এসএসসি র পর সামনে আরো বড় পরীক্ষা কিছুদিনের ভেতর ই রেজাল্ট বেড়িয়ে যাবে তখন ভালো কলেজে ভর্তি র তোড়জোড় ইতিমধ্য প্রাইভেট আর কোচিং এর ক্লাসগুলোও শুরু হয়েগেছে এই অবস্থায় তিনি কোনভাবেই ঢাকা থেকে নড়বেন না। নড়বেন বললেও শেষে আফসানাকে নড়তে হলো দুই মেয়ে যুঁথি বিথীর জোরাজুরিতে তে। বিথী যুঁথির তিন বছরের ছোট, বেড়াতে যাবার নাম শুনলেই সে এক পায়ে খাড়া। যুঁথি মা কে যুক্তি দেখালো শেষবার তারা গ্রামে কবে গিয়েছিলো তার মনেই নেই। বছরে দুই ঈদ তাদের মায়ের ইচ্ছাতে নানা বাড়িতে করতে হয়। নানা বাড়ি যে তার খারাপ লাগে তা নয় কিন্তু এই এক নানা বাড়ি আর তার খালামনির বাড়ি ছাড়া তারাতো বলতে গেলে কোথাও যায় ই না। আর বিথীর স্কুলেও এবছর গরমের ছুটি এগিয়ে এসেছে সুতরাং বেড়াতে যাবার এর থেকে ভালো সুযোগ আর হয় ই না। যুঁথি র এসব যুক্তিতে কাজ হতো না, বিথী এসব যুক্তিতর্কের ভেতর গেল না সে পুরো খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলো। এই অনশন পর্বের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় আফসানা সর্বাত্মক চেষ্টা শেষে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হলেন।
গ্রামে যাবার জন্য বুধ বৃহস্পতি মবিন সাহেব ছুটি নিয়েছিলেন যাতে শুক্র শনির সাপ্তাহিত ছুটি মিলিয়ে অন্তত চারদিন পাওয়া যায়। গ্রামের বাড়িতে তার বড় ভাই রয়েছে বাবা মায়ের কবর জিয়ারত করতে তিনি বছরে অন্তত একবার গেলেও আফসানার অনাগ্রহের জন্য মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয়ে ওঠে না। শেষ বার যখন পুরো পরিবার নিয়ে গেছেন তখন বিথী কোলে, যুঁথির বয়স চার কি পাঁচ হবে। যুঁথি এসএসসি দিয়ে ফেললো বিথী এখন সেভেনে সময় কি দ্রুত ই না চলে যাচ্ছে! বুধ বৃহস্পতি ছুটি নিলেও অফিস অডিট এর কাজে বুধ বার সকালটা মবিন সাহেব কে অফিসেই কাটাতে হলো। যুঁথি দের নিয়ে গাবতলি থেকে যখন তিনি ফরিদপুরের বাসে উঠলেন তখন দুপুর দুই টা। সবকিছু ঠিক থাকলে ছ’টার ভেতর মধুখালি পৌঁছে অটো রিকশায় বিশমিনিটে দাদু বাড়িতে পৌঁছে যাবে যুঁথিরা। আফসানা এখনো স্বামীর উপর বিরক্তি। সে পুরো পথে একটা কথাও বলছে না। কিন্তু মেয়েদের আনন্দের সীমা নেই। তারা দুদিন ধরে গ্রামে যেয়ে কি কি করবে মুখে মুখেই তার একটা দীর্ঘ লিস্ট তৈরী করে ফেলেছে যেটা লিখলে পুরো একটা নোটবুক ই লেগে যেতো যুঁথির বিশ্বাস। কয়েকদিন টানা বৃষ্টিতে পদ্মার পানি তীর ছুঁই ছুঁই। পাটুরিয়ার ঘাটে পানি উঠে আসায় ঘাট সচল হয়ে যুঁথিদের বাসের ফেরী পেতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। দিনের শেষ আলোটুকু শুষে নিলো পদ্মার কালো বুক।
ভেজা বাতাস ঝাঁপটা মারছে বিথীর চোখে মুখে। ফেরীর এককোণে দাঁড়িয়ে আছে সে। এদিকটায় যাত্রীদের ভীড় না থাকায় হকার ও নেই। ফেরির উপর যে মাছ আর ফল এর রিতিমত বাজার বসে, এখানে খাবার হোটেল আর চিপস কোল্ড ড্রিংস এর দোকান ও আছে এটা দেখে সে বিস্মৃত। মবিন সাহেব ফেরির উপরের তলায় মাগরিবের কাযা নামাজ পড়তে বসলে বিথী নিচে এসে যুঁথি কে মায়ের সাথে মেয়েদের ওয়াশরুমের সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে দেখে সে একাই ফেরীর সামনের দিকের এই ফাঁকা জায়গাটাতে দাঁড়িয়েছে। এতো পানি সে এর আগে কখনো দেখেনি। রাতের অন্ধকারে পুরো নদী কালো হয়ে আছে। দূরে ফেরি ঘাটের সার্চ লাইট না জ্বললে মনে হতো তারা মহাশূন্যের কালো গহ্বরে হারিয়ে গেছে। নদীর উপর তাদের ফেরির যেটুকু আলো পড়েছে তাতে নদীর যে পানি দেখা যাচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ ঘোলা, যা ঢেউ তুলে ফেরীর ইঞ্জিনের নিরবিচ্ছিন্ন শব্দের মাঝেও স্বতন্ত্র একটা শব্দে ফেরীর গায়ে আঘাত করছে। স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিথী অন্যদিকে যাবার জন্য পা বাড়াতেই পেছনে ঝুপ করে একটা
শব্দ হল যেন কেউ এইমাত্র পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে। সে ভাবলো হয়তো বড় কোন মাছ বা শুশুক হবে। কিন্তু ঘোলা পানির ঢেউ গুলো ছাড়া কিছুই বিথীর চোখে পড়লো না। বিথী যখন ফিরে যাবে তখন ফেরীর ধাতব গায়ে কিছু একটার আঘাতের শব্দ শুনে বিথী ফেরীর রেলিং ধর ঝুকে দেখতে গেল কিন্তু পানিতে তার নিজের ছায়া ছাড়া কিছুই নেই আর সে সময় ই সে দেখলো ফেরীর আলো নদীর যেটুকু সামান্য আলো করে আছে সেখান দিয়ে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে একটা মানুষের মুখ, পানির ভেতর থেকে যার পলকহীন চোখ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বিথী তার পেছনে বাসের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো। তার হাত পা পুরো অবশ হয়ে গেছে। তাকে এ অবস্থায় প্রথম দেখলো বাসের এক বৃদ্ধা। তার উচ্চকন্ঠের ডাকাডাকিতে লোকজনের ভীড় জমে গেল। ফেরির গাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে কোনমতে সেই ভীড় ঠেলে বিথীর বাবা ঘটনাস্থালে পৌঁছে দেখলেন এক অপরিচিত বৃদ্ধাকে তার মেয়ে জাপটে ধরে ফেরির পাটাতলে আধশোয়া হয়ে পড়ে আছে আর একজন তার মাথায় মিনারেল ওয়াটের বোতল থেকে পানি ঢালছে।
বিথী বাবা মা বোন কে দেখার পর ছাড়া ছাড়া ভাবে প্রথম যে কথা বললো তাতে ফেরীর ভেতর একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। অধিকাংশের ধারণা হলো মেয়েটা নদীতে মরা দেখেছে। কোন লাশ পানিতে ভেসে যেতে দেখাই ভয় পাওয়ার কারণ। এদিকে ফেরীতে পার হওয়া স্থানীয় তিন জেলে বললো ওটা কোন সাধারণ মরা নয় নিশ্চয় দানো। আরিচায় যমুনা যেখানে পদ্মার সাথে মিশেছে সেদিকটা দেখিয়ে তাদের একজন বললো তাদের গ্রামের একজন বছর তিন আগে রাতে মাছ ধরতে গিয়ে গাঙে ভেসে যাওয়া মরা দেখছিলো যার পুরো শরীরে ক্ষত। এমন ভাবে মাছে ঠুকড়ে ঠুকড়ে খেয়ে ফেলেছে যে নারী না পুরুষের লাশ বোঝার উপায় নেই। লাশের চোখ দুটো খোলা সে চোখে কোন মনি নেই। এই মরা দেখার কয়েক মাস পরেই শ্রাবণ মাসের সামান্য মেঘেই নৌকা ডুবে সেই লোক মারা যায়, যার লাশ
পাওয়া যায়নি ঐ নৌকার বাকি দুজন কোনমতে সাঁতরে তীরে উঠতে পারায় সেযাত্রা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলো। এজন্য তাদের কেউ নদীর এই জায়গাটাতে রাতে মাছ ধরে না। এক মহিলা যাত্রী আফসানা কে মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে বললো যেন একা একা সে পুকুর বা দীঘীর কাছে না যায়। তার নিজের ই ছ বছরের মেয়ে পুকুরে ডুবে মরেছে মেয়েটা প্রায় ই স্বপ্নের মাঝে ভয় পেতো। ফেরী গোয়ালন্দঘাটের কাছে এসে যাওয়ায় যাত্রী আর ফেরীর হকারদের জল্পনাকল্পনা গুলো পদ্মার সীমাহীন অন্ধকারে কোন অতিপ্রাকৃত ছমছমে আবহাওয়া সৃষ্টর মাঝ পথেই থেমে গেল। যুঁথিরা গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালো রাত সাড়ে দশটায়। রিকশা থেকে বিথীকে কোলে করে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন মবিন সাহেব তখনো সে বাবর শার্ট চেপে ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলেই এ অন্ধকার তাকে ছিঁনিয়ে নেবে। রাতে বিথীর জ্বর ১০৪ডিগ্রী ছাড়িয়ে গেল। জ্বরের ঘোরে সে একটানা শুধুই ভুল বকছে। পরের কদিন মবিন সাহেব আপরাধীর মতো মুখ করে সকাল থেকে সন্ধ্যা কাছাড়ি ঘরের পুরনো হাতল ভাঙা চেয়ারেই একা বসে থাকেন, মাঝে মাঝে ভেতর বাড়িতে এসে জ্বর কমেছে কিনা খোঁজ নিয়ে যান। আফসানা তার সাথে কথা বলা একদম বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়ে সুস্থ হওয়ার পর সে কথার সুনামীতে স্বামীকে বঙ্গোপসাগর থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বিথীর জ্বর কমলো পরের মঙ্গলবার। এই সাত দিনের জ্বরে তার চোখ কোটরের মধ্যে চলে গেছে, হাত পা
দেখলে তাকে মনে হয় পোলিও আক্রান্ত। এ কদিন ডাক্তার কবিরাজ তাবিজ কবজ কম করা হয়নি। বাড়ির বারান্দায় যুঁথি চাচাতো বোন সীমা র সাথে বসে কাজের বুয়া ময়নার মা র কাছে গল্প শুনছিলো। যুঁথির ধারণা ময়নার মা যদি লিখতে পড়তে পারতো তবে সে জে.কে. রাওলিং এর মতো বিখ্যাত হয়ে যেতো। ময়নার মার অধিকাংশ গল্প ই জ্বিন ভূত পেত্নী আর প্রেতসাধক কাপালিক ওঝাদের নিয়ে, তার গল্প গুলোর কিছু আবার অশ্লীল ও। ময়নার মা বলে মায়নার বাপের সাথে তার বিয়ের আগে এক জ্বিনের সাথে তার নাকি প্রেমের সম্পর্কও ছিলো। সে নাকে জ্বিনদের দেশে তৈরী বাতাসাও খেয়েছে। ময়নার মার প্রেমিক সেই জ্বিনের নাম মনসুর। নাম শুনে যুঁথিরা হেসে গড়াগড়ি খায়, জ্বিনের নাম হবে কাবিল কোহেকাফী মুগাবালী, মনসুর আবার জ্বিনের নাম হয়? যুঁথিদের অবিশ্বাসী হাসি ময়নার মার জীবনের সত্যকে তো আর মিথ্যা করে দেবে না সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই পরক্ষণে নতুন একটা গল্প ধরে। গত এক সপ্তাহ বিথীর জ্বরের কারণে ঢাকায় বসে তৈরী তাদের দু বোনের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। বাড়ির আসেপাশে ঘোরাঘুরি আর ময়নার মার কাছে গল্প শোনা ছাড়া যুঁথির করার কিছু নেই। তাও সীমা ছিলো বলে রক্ষা, তাকে একাএকা মন খারাপ করে থাকতে হচ্ছে না। সীমার বয়স যুঁথির কাছাকাছি হওয়ায় তাদের ভেতর একরকম বন্ধুত্ব
হয়ে গেছে। আজ ময়নার মা পুকুরের দানোর গল্প শুরু করেছে। তাদের বাড়ির পুবের পুকুরেই নাকি দানো থাকে। ছোট ছেলে মেয়ে পুকুরে একা পেলে পানির তলে টেনে নিয়ে যায়। ঐ পুকুরে পানিতে ডুবে যাওয়ার ঘটনা বছরে এক দুটো ঘটেই। এই বাড়ির ছোট ছেলে যুঁথির চাচাকে ছোট বেলায় ডুবে মরতে দেখেছে সে। কোন যুবতী মেয়েদের উপর এই দানোর নজর পড়লে তার আর রক্ষা নেই। দানোরা সাধারণত পুরনো পুকুরে বা বড় দীঘীতে থাকে তবে পাতালের সুরঙ্গ দিয়ে তারা মৃত্যুর নেশায় এক পুকুর থেকে অন্যপুকুর বা বড় নদীতে চলাচল করে। এরা মাঝে মাঝে ঘোমটা দেয়া মেয়ে মানুষ সেজে পুকুর ঘাঁটের কাছে বসে থাকে। ময়নার মা তো নিজের চোখেই দেখেছে, তার আর তখন বয়স কত চৌদ্দ পনের হবে। একদিন সন্ধ্যায় ঘোমটা পরা এক বউকে পুকুর ঘাটে বসে কাঁদতে দেখে এগিয়ে যেয়ে কিগো কাঁদছো কেন কে তুমি বলতেই ঘোমটা তুলে তার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সে কথা মনে পড়লে নাকি আজো গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। সেদিন সে পুকুর ঘাট থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে আসতে পেরেছিলো বলে আজ সে ময়নার মা এখানে বসে গল্প করছে। যুঁথি দেখলো বিথী বিছানা ছেড়ে বারান্দার দরজায় দু ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে। গল্পের মাঝেই
সে ময়নার মা কে থামিয়ে দিলো। বিথী নদীতে একটা লাশ ভেসে যেতে দেখেছে এটাই এটুকু একটা মেয়ের জন্য যথেষ্ট ভয়ের। যুঁথির মা এব্যাপারে বিথীকে কোন প্রশ্নকরতে নিষেধ করে দিয়েছেন। ময়নার মার ভূতুরে গল্প বিশেষ করে পানির দানোর গল্প বিথী শুনেফেলেছে এটা ভেবে যুঁথি র মুখ শুকিয়ে গেছে। এ কথা মায়ের কানে গেলে নির্ঘাৎ তুলকারাম কান্ড হয়ে যাবে। যুঁথি উঠে যেয়ে বোনের গায়ে হাত দিলো, তার জ্বর পুরোপুরি ছাড়েনি গা এখনো গরম। সে একটু তিরস্কার করেই বোনকে বলে ভীতুর ডিম নদীর ছায়া না কি ছাতা দেখে ভয়তে মরে যাচ্ছে আয় এখানে বোস। বিথী বিনাপ্রতিবাদেই বোনের সাথে বারান্দায় এসে বসলো। মোবিন সাহেব সোম বার ঢাকা চলে গেছেন। মেয়ে একটু সুস্থ হলেই গাড়ি নিয়ে নিতে আসবেন। রাতে বিথী আর তার মা এক খাটে ঘুমায়। যুঁথি থাকে সীমার ঘরে। ঘুমতে যাবার আগে বিথী বোনকে একা পেয়ে প্রশ্ন করলো- সত্যিই কি আমাদের পুকুরে ওটা আছে? -কি আছে? -দানো! -দূর পাগলী, দানো না তোর মাথা। কাল সকালে পুকুরে গেলেই দেখতে পারবি।
দুবোন দাদাবাড়ির চারপাশ টা দেখতে বেড়িয়েছে। সাথে সীমা থাকলেও আফসানা ময়নার মাকেও সবসময় ওদের সাথে সাথে থাকার জন্য বলে দিয়েছে। একয়দিন যুঁথি গ্রামের কিছুটা দেখে ফেললেও জ্বরে বিছানা বন্দিদশার কারণে বিথীর কিছুই দেখা হয়নি। এখনো তার মাথা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তারা দেখলো গ্রামে সকাল হয় অনেক ভোরে কিংবা হয় ই না হঠাৎ রাত হয়ে যায়। কোথাও যেন কোন তাড়াহুড়া নেই। দশটা পেরিয়ে গেলেও পথে গাছের উপর শিশির সকালের রোদে চকচক করছে। গ্রামের খাল পাড় পর্যন্ত হেঁটে এসে ফেরার সময় তারা তাদের দাদাবাড়ির পুকুর টাও দেখতে গেলো। পুকুরটার তিন দিকে বাঁশ ঝাড় আর ঝোপঝার জঙ্গলে ভর্তি। কেমন একটা গা ছমছমে ভাব থাকলেও পুকুরের লাল বাঁধানো ঘাট টা তে সুন্দর বসার ব্যবস্থা রয়েছে। ঘাটের নিচের দিকের সিঁড়িগুলোতে শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল আর সবুজ হয়ে আছে, পুকুরের পানির রং বোধহয় তার থেকেও সবুজ।
পুকুরের পানি পাড়ের গাছপালার সবুজ সেখানে আয়নার মতো বাঁধিয়ে রেখেছে যেন। ময়নার মা এখন পুকুর পাড়ের জঙ্গল থেকে বাঘ বড়নোর গল্প বলতে ব্যস্ত। যুঁথিরা পুকুর ঘাটে কিছুক্ষণ বসতে চাইলেও বিথী র জন্য তা হলো না। যে সকালে পুকুরের কাছে দাঁড়াতেই চাইনি তাকেই দুপুর তিনটায় পাওয়া গেল পুকুর ঘাটে একা। বিথীর চিৎকারের শব্দে বাড়ির সবাই দৌড়ে যেয়ে দেখলো সঙ্গাহীন অবস্থায় বিথী ঘাটে পড়ে আছে। সন্ধ্যায় মসজিদের মাওলানা সাহেব এসে আবারো দোয়া পড়ে ফু দিয়ে গেলেন, ঢাকায় ফেরার আগে একটা তাবিজ তিনি দিয়ে যাবেন বলে গেলেন। আফসানা স্বামীকে মোবাইল করে কাল ই তাদের নিতে যাবার জন্য বললেন। ঢাকায় ফেরার আগে দুই মেয়েকে ঘর থেকে এক পা বেড়তে দেখলে পা ভেঙে দেবেন বলে ঘোষণা দিলেন। কিন্তু এর পরদিন ই সন্ধ্যায় বিথীকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। দুপুরে আফসানা ঘুমিয়ে পড়েছিলো। এসময় ছোট মেয়ে তার পাশেই ছিলো। তিনি মেয়ের গায়ে হাত রেখে
ঘুমিয়েছেন, ঘুম যখন ভেঙেছে তখন প্রায় সন্ধ্যা বিছানায় আফসানা একা, বিথী তার পাশে নেই। সে হয়তো উঠে বারান্দায় বা যুঁথির ঘরে গেছে মনে করলেও তাকে বাড়িতেই পাওয়া গেল না। যুঁথি প্রথমেই কিছু একটা সন্দেহ করে দৌড়ে পুকুরের দিকে গেল। বিথীকে পাওয়া গেল সেখানেই। শেওলা পড়া ঘাটের শেষ সিঁড়ি থেকে পুকুরের পানিতে পড়ে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে যুঁথি তাকে ধরে ফেললো। বোনকে দেখেই বিথী ডুকরে কেঁদে বললো -ও এসেছে, ও আমাকে নিয়ে যাবে আপা। কিন্তু কে কোথায়? যুঁথি পুকুর পাড়ে আর কাওকে দেখতে পেল না। যুঁথি পুকুরের কাছে পৌঁছানো মাত্র ই পানিতে কিছু একটা ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ পুরো পুকুরটাকে তোলপাড় করে মিলিয়ে গেল। সন্ধ্যার অন্ধকারে পুকুরের রং এখন ঘনকালো যেখানে একটা তরঙ্গ ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে। যুঁথি বোন কে দুহাতে শক্ত করে ধরে পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে। পৃথিবীর কোন শক্তিকে সে তারকাছ থেকে তার বোন কে কেড়ে নিতে দেবে না।
***********************************************সমাপ্ত*****************************************