বৌ গেছে বাপেরবাড়ি।আজ শনিবার।কাল রাতে আমি গিয়ে নিয়ে আসব।আমার খুব মজা হচ্ছে।অবাক লাগল শুনতে।কিন্তু মাঝে মাঝে এমন হয়।বৌএর অতি যত্নের থেকে মাঝে মাঝে মন ছুটি চায়।একটু অনিয়ম..একটু বন্ধনমুক্তি।সবচেয়ে বড় কথা টিভির উপর একটু দখলদারী পাওয়া যাবে।টিভিটা শখ করে কেনা।কিন্তু ওটার নাগাল পাই না।আমি যখন অফিস থেকে বাড়ি ফিরি তখন পৃথিবীর সব সেরা সেরা সিরিয়াল স্টার জলসা, জি বাংলায় চলে।এই সময় টিভি দেখতে চাওয়াটা অমানবিক।আর রবিবার ছেলের স্কুল কোচিঙ আঁকার ক্লাস কিচ্ছু থাকে না।তাই তার মানসিক উন্নতি বিধানের জন্য ওই দিন সারাদিন কার্টুন চলে।আজ তাই ঠিক করেছি দেখব।আমার একটা পুরানো
সিডি প্লেয়ার আছে।এখন তো ডিভিডির যুগ।এটা আগে কেনা।সিরিয়ালের ধাক্কায় বেচারা আলমারী বন্দী।ভাবলাম আজ দুটো ভূতের সিডি নিয়ে যাই।আমি আবার হয় হাসির নয় ভূতের সিনেমা দেখি।বৌ মাছের ঝোল আর দুধ রেখে গেছে।আজ শনিবার দুপুরে ফিরব বলে ভাতও রেখে গেছে।রাতের জন্য রুটি কিনে নিতে বলেছে।কিন্তু বৌ বাড়ি নেই শুনে অফিসের অসীম জোর করে ধরে নিয়ে গেল।ওর বৌ খুব ভালো রান্না করে।আর অসীম খুব খাওয়াতে ভালোবাসে।দুপুরে খেয়ে বিকেলে আড্ডা দিয়ে ফিরছি।রুটির দোকানে তরকাও করে।কিনে নেব।কে ওই ঝোল খাবে।বৌ আমার ভয় পায়।একবার একটা মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গেছে কিনা।তাই এত বেশী খাবার কড়াকড়ি।কিন্তু আজ তো ছুটি।সিডি কিনবো বলে দোকানে ঢুকে হতাশ হলাম।সব ডিভিডি।অনেক খুঁজে যে তিনটে সিডি পাওয়া গেল তাও সামাজিক সিনেমা।হতাশ হয়ে রুটি তরকা কিনে বাড়ি ফিরছি।সোজা হলে অনেকটা ঘুরতে হবে।তাই সাইডিং দিয়েই
যাতায়াত করি।ব্রীজ ফেলে,বাজার পেরিয়ে ঝুপড়ি গুলোর পাশ দিয়ে যাচ্ছি ঠিক সেই সময় অন্ধকার ঝুপড়ির পাশ থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল।এমন আচমকা এল যে আমি চমকে উঠেছিলাম।দেখতেও ভারী বিদঘুটে। কুচকুচে কালো।আফ্রিকানদের মত উঁচু কপাল,উঁচু চোয়াল,ঝোলা পুরু ঠোঁট,কোঁকড়া কোঁকড়া চুল।উঁচু দাঁত বার করে হাসল লোকটা।লোকটার গলায় ঝোলানো ট্রেতে বেশ কিছু সিডি।ঘরঘরে গলায় লোকটা বলল-“সিডি লেবেন।ঝকঝকে ছবি,রগরগে জিনিষ। যেমন চান তেমন।”আমার কেমন রাগ হচ্ছিল লোকটাকে দেখে।বললাম-“জমাটি ভূতের সিডি আছে?”লোকটা বিচ্ছিরি শব্দ করে হাসল।হাসিতে ওর মুখটা বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল।বলল-“আছে।একা ঘরে বসে দেখতে পারবেন?”আমার গা জ্বলে গেল।বললাম-“দাও চটপট।”লোকটা ট্রের একদম তলা থেকে কালো কাগজে মোড়া একটা সি.ডি বার করল।কোন ছবি নেই প্যাকেটের গায়ে।আমি দাম দিতেই লোকটা ঝুপড়ির আড়ালে ঠিক যেমন
ভাবে এসেছিল তেমন ভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল।ভারী অদ্ভুত লোক।বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে সি.ডি চালিয়ে খাবার নিয়ে বসলাম।অনেক দিন ব্যবহার হয়নি।ব্যাটারী কমে গেছে বোধহয়।রিমোটটা বার কয়েক নাড়াচাড়া করে তবে চলল।কে জানে পয়সাটা জলে গেল কিনা।কোন কোম্পানী,সিম্বল,বিজ্ঞাপন ছাড়াই শুরু হয়ে গেল।একটা ধূ ধূ মরুভূমি।বালির ঝড় উঠছে।সূর্য অস্ত যাচ্ছে।একটা গোঙানির মত শব্দ।শব্দটা ক্রমে বাড়ছে।বালি ফাঁক হয়ে যাচ্ছে।সূর্য অস্ত গেল।লালচে অন্ধকারে হাড় হিম করা এক আর্তনাদ করে উঠে দাঁড়ালো একটি অবয়ব।আমার দিকে পিছন ফেরা সেই অবয়বটি আকাশের দিকে মুখ তুলে আবার বিকৃত আর্তনাদ করে উঠল।বুক কাঁপানো আর্তনাদ।স্টার্টিঙেই জমে গেছে।আমি খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে জমিয়ে খাটে বালিশটা টেনে নিয়ে বসলাম।সিনেমাটা এগিয়ে চলল।লোকটা ঈষৎ ঝুঁকে বালিয়াড়ি পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে।অন্ধকার ঘনীভূত। দূরে নগর দেখা যাচ্ছে।একটা খামারবাড়ি।একজন টহলদার পাহারা দিচ্ছে।সে ঘরে ঢুকে যেতেই লোকটা চারপায়ে হামা দিয়ে বেড়া টপকে ঢুকল
খামারে।ভেড়া গুলো চঞ্চল হয়ে উঠল।তারপর একটা ভেড়ার মর্মান্তিক চিৎকার।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল পাহারাদার।কিন্তু শ্বাপদের মত লোকটা ততক্ষণে ঝোপের আড়ালে লুকিয়েছে।পাহারাদার ভেড়ার ঘরে ঢুকে লাঠি ঠুকে কি যেন বলল।তারপর বেরিয়ে গেল। সে ঘরে ফিরে যাবার সাথে সাথে ঝোপের মধ্যে দেখা গেল দুটো জ্বলজ্বলে চোখ।লোকটা এক মনে ভেড়াটা কে মেরে খাচ্ছে।আমি কাঠ হয়ে গেলাম।এই প্রথম লোকটা মুখ তুলে হাসল পৈশাচিক হাসি।আমি ভয়ে চিৎকার করে ফেললাম।এতো সেই লোকটা,যে সি.ডি বিক্রি করেছিল।আমি ঝট করে সুইচ টিপে ভিসিডি বন্ধ করে দিলাম।আমি ঘেমে উঠেছি।বুক ধড়ফড় করছে।গলা শুকিয়ে গেছে।ধকধক করে জল খেলাম।মুখে চোখে জল দিলাম।একটু সুস্থির হয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবলাম।কি হল কেসটা।লোকটা কি তবে অভিনেতা?অনামী পরিচালক,অনামী প্রযোজক,অভিনেতা।তাই কিনে কেউ এই সি.ডি দেখবে না বলে নিজেরাই পুস সেল করছে?এত অদ্ভুত ভাবে ঘটনাটা ঘটেছে যে আমি বুদ্ধি হারিয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।তবে স্বীকার করতেই হয়
শেষটা কি করবে জানা নেই,কিন্তু শুরুটা দারুণ।সিনেমাটা আমায় টানছে।আবার চালালাম।দারুণ এগোচ্ছে সিনেমাটা।লোকটা রোজ রাতে পশু মেরে কাঁচা মাংস খায়।ধীরে ধীরে শিশুদের মেরে খাওয়া শুরু করেছে।দুতিনটি শিশু নিঁখোজ হবার পর পুলিশ মহলে টনক নড়ল।এক দুর্ধর্ষ পুলিশ তদন্ত শুরু করল।কিন্তু কোন সূত্র পাওয়া যাচ্ছে না।এবার মাংসখাদক চালাকি শুরু করল।সে একটা হাসপাতালে এক সদ্যজাতকে তার শিকার করতে গেছে।কিন্তু পাহারাদারের নজরে পরে যাওয়ায় শিকার ছেড়েই তাকে পালাতে হল।যে ইন্সপেক্টর কেসটার তদন্ত করছিলেন তিনি শহরের সব মেটারনিটি হোমগুলোয় সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন করলেন।নিজে রইলেন পাহারায়।কিন্তু নরপশুটা এটা কোথায়?এটা তো ইন্সপেক্টরের বাড়ির সামনে।ইন্সপেক্টরের বৌ উত্তেজিত হয়ে ফোন করেছে।বাচ্চার জ্বর।ইন্সপেক্টর বলছে কোনমতেই আসতে পারবে না। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে নরপশুটা ঠোঁট দিয়ে জিভ চাটছে।
আসতে আসতে পাইপ বেয়ে দোতলায় উঠছে।হঠাৎ আমি শুনতে পেলাম আমার পিছনে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলার শব্দ।আমার বাড়ির দরজা বন্ধ।ঘরে আমি একা।আমি কাঠ হয়ে গেলাম।আমি মনকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম ভুল শুনছি।কিছুতেই পিছন ফিরব না। ওটা আমারই উত্তেজিত নিশ্বাসের শব্দ।টি.ভির দিকে দৃষ্টি স্থির করলাম।নরপশুটা নিশব্দে লাফিয়ে নামল বারন্দায়।ঘরে ছয়মাসের শিশু ঘুমাচ্ছে।পাশের ঘরে মা অষুধ গুলছে।আমার বুকের ভিতরটা ধকধক করছে।স্পষ্ট অনুভব করলাম আমার ঘাড়ে কাঁধে নিশ্বাস পরছে কারোর।বুকের ভিতর যেন রেলগাড়ি চলছে।মাথা দপদপ করছে।পিছনে কে যেন হিসহিসে গলায় বলল-“কি ভয় করছে?জমজমাট নয়?”আমি আতংকে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম নরপশুটা।কষ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে।আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম।চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল।তারপর কিছু মনে নেই।
কতদিন হাসপাতালে আছি জানি না।একমাস না কি তারও বেশী!?আমার সেরিব্রাল হয়ে গেছে ডাক্তারের কথা শুনে বুঝেছি।আমি অজ্ঞান হয়ে পরে ছিলাম।বৌ আমি পৌঁছায়নি দেখে খোঁজ নিতে এসে দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে পরে আছি।তারপর এই হাসপাতাল।আমার ডানদিকটা প্যারালাইস হয়ে গেছে।কথাও বন্ধ হয়ে গেছে।আমি কাউকে আমার কথা বলতে পারিনি।জানিনা, কি দেখেছিলাম সেদিন।আমার মনের ভুল নাকি…..তবে হাসপাতালের বেডে শুয়েই আমার শালার আলোচনা থেকে শুনেছি বাজ পরে নাকি আমাদের টি.ভি আর ভি.সি.ডি টা সম্পূর্ণ খারাপ হয়ে গেছে।ওদের অনুমান কোনভাবে ওই বাজের শব্দেই আমার স্ট্রোকটা হয়েছে।তবে অদ্ভুত ব্যাপার বাড়ির অন্য কোন ইলেকট্রনিক জিনিসের কোন ক্ষতি হয়নি।