মতি ছুটছে উর্দ্ধশ্বাসে গাঁয়ের পথ ধরে। অন্ধকার অমাবস্যার রাত। পথ ঠিক মতো ঠাহর করা যাচ্ছে না। ছুটতে ছুটতে ঝপাস করে পড়লো একটা ছোট নালার মধ্যে। কোমর সমান পানিতেই খাবি খেল তিন চারটা। তারপর হাঁচড়ে পাচড়ে ওপারে উঠেই আবার দে ছুট – প্রানের মায়া যে বড় মায়া। সে যা দেখেছে তা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। গ্রামের অশিক্ষিত তরুন সে। থাকে এ গ্রামের হাইস্কুলের শিক্ষক হক সাহেবের বাড়িতে। কাজ হক সাহেবের ফাই-ফরমাস খাটা, বাজার করে দেয়া ইত্যাদি। আজও সে বাজারে গিয়েছিল কেরোসিন আনতে। কেরোসিন কিনে ফেরার পথে ঘটলো এই বিপত্তি।
এখন ছোটার তালে কোথায় ছিটকে গেছে সে কেরোসিনের বোতল। আর হাতে যে টর্চ লাইট ছিল সেটারও কোন হদিস নেই। ছুটতে ছুটতে সে কোনমতে হক সাহেবের বাড়িতে পৌঁছালো। পৌঁছেই সোজা হক সাহেবের রুমে গিয়ে উপস্থিত হলো।হক সাহেব তখন হ্যারিকেনের আলোয় বই পড়ছিলেন। আজ তিনি বাড়িতে একা। তাঁর বউ ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছে। মতিকে দেখে হক সাহেবের চোখ মাথায় ওঠার জোগাড় – কি রে কি হয়েছে তোর? কেরোসিন আনতে গিয়া তো ভূত হয়ে আসছিস। কাদা পানিতে মাখামাখি অবস্থা। মারামারি করেছিস নাকি কারো সাথে?
মতি তখনো হাঁপাচ্ছে ভিষণ। তার ফাঁকেই বলল – না সার মারামারি করি নাই। তয় আরেকটু হইলেই মারা গেছিলাম। বাজার থিকা আসার পথে মুন্সি বাড়ির জঙ্গলে আইজ আমি জ্বীন দেখছি সার। আরেকটু হইলেই হেরা আমারে ধইরা ফালাইছিলো। কোন মতে দৌড়াইয়া পলাইয়া আইছি। হক সাহেব আবারো ধমকে উঠলেন – হয়েছে এত রাতে আর জ্বীন-পরীর গল্প শোনাতে হবে না। গোসল করে, কাপড় ছেড়ে ঘুমাতে যা।
হক সাহেবের কথায় মতির কোন ভাবান্তর হলোনা। আসলে সে এতই উত্তেজিত হক সাহেব কি বলেছেন তা শুনতেই পায়নি। সে তার মতো বলা শুরু করলো – সার, আমিতো কেরাসিন কিনা তারাতারি বাড়ির পথে রওনা হইছি। আমাবইস্যার আন্ধারে কিচ্ছু দেহন যায় না। টস লাইটটা জ্বালাইয়া জ্বালাইয়া পথ দেহি। মুন্সি বাড়ির জঙ্গলের পাশ দিয়া আসার সময় দেহি জঙ্গলের মইদ্দে কেমন যেন হালকা আলো দেহা যায়। আমি ভাবলাম কেউ মনে হয় গরু-ছাগল কিছু হারাইছে এহন জঙ্গলের মইদ্দে লাইট লইয়া খোঁজা-খুঁজি করতাছে। ব্যাপারডা আসলেই কি দেহার জইন্য আলোর কাছে গেলাম। যাইয়া সার যা দেখলাম তা দেইখা পুরা তাজ্জব হইয়া গেলাম। তারাতারি কইরা একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াইলাম। দেখি সার জঙ্গলের মইধ্যে একটু ফাকা জায়গায় ইয়া বড়, আমাগো এই ঘরের সমান হইবো, একটা মুরগীর ডিম খাড়াইয়া আছে।
হেই ডিমের চাইরপাশে অনেকগুলা লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, সাদা লাইট খালি জ্বলতাছে আর নিবতাছে। দেইখা তো সার আমি কিছু বুঝবার পারি না। এতো বড় মুরগীর ডিমের মতো এইডা কি, এতো লাইটই বা কেন জ্বলে? এমন সময় আমার পিছনে শুনি কেমন খর খর আওয়াজ হইতাছে। কি ব্যাপার দেখতে গিয়া আমার জানডা সার ধরাক কইরা লাফ মারলো। দেখি দুইডা জ্বীন আমার দিকে তাকাইয়া রইছে। সাদা কি যেন কি পইড়া আছে তারা। চক্ষু গুলা অনেক বড়, নাক নাই খালি নাকের ফুটা আছে, মুখ একদম ছোড। লম্বায় দুইডাই আমার বুকের সমান। আলো কম হইলেও গায়ের রং যে সবুজ হেইডা বোজা যায়। মাথা মুখ আবার কেমন যেন কাঁচের বাক্স দিয়া ঢাকা।
আমি তো সার দেইখাই বুজছি আমার আর রক্ষা নাই। আমারে জ্বীনে দরছে। কিছুক্ষন হেরা আমার দিকে তাকাইয়া থাকলো। তারপর ঘ্যাজম্যাজ কইরা নিজেরা কি যেন বলাবলি করলো। আমি কিছুই বুজলাম না। তারপর একজন হঠাত্ আমারে কইলো – হেল্লো হোমসাপিন, হেল্লো হোমসাপিন। বইলাই তার সবুজ হাত দিয়া আমারে ধরতে
আইলো। ধরতে পারলেই আমি গেছিলাম সার। পুরা জ্বীন-পরীর দেশে নিয়া ভাইজ্জা খাইতো আমারে। কোনমতে ওগো পাশ দিয়া বাইর হইয়া দিলাম দৌড়। কেরাসিন আর টস লাইট কোনখানে পইড়া গেছে টের পাই নাই। জানডা লইয়া যে আসতে পারছি সার হেইডাই আল্লার কাছে হাজার শুকুর। মোটামুটি এক নিশ্বাসে এই কাহিনী বলে মতি থামলো।
হক সাহেব মতির গল্প শুনে চমকে উঠলেন। শিক্ষক মানুষ তিনি, প্রচুর পড়াশুনা করেন। মাথায় বুদ্ধিও ধরেন প্রচুর। সাইন্স ফিকশন গল্প-উপন্যাস খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েন। আর তাতেই তিনি বুঝতে পারলেন মতি যাদের দেখে এসেছে তারা আসলে জ্বীন-ভূত না। বরং ভিনগ্রহবাসী অর্থাত্ এলিয়েন। ঐ ডিমের মতো বস্তুটা ওদের স্পেসশিপ। আর মতি যে বলল ওরা তাকে হাল্লো হোমসাপিন বলেছে তা আসলে হবে – হ্যালো হোমোসেপিয়েন। যা কিনা মানুষের
বৈজ্ঞানীক নাম। কোন ভাবে তারা এটা জানতে পেরেছে এবং তার মাধ্যমে মতির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। হক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। এলিয়েনদের সাথে অবশ্যই দেখা করা উচিত। এমন সুযোগ হাজার বছরে হয়তো একবার আসে। তিনি মতিকে বললেন – চল ওঠ। তোর জ্বীনগুলোকে দেখে আসি।
মতি তার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না প্রথমে। বুঝতে পেরে হতভম্ব ভঙ্গিতে বলল – সার আপনে কি পাগল হইছেন? জ্বীনে যদি একবার ধরে তাইলে আর রক্ষা নাই। সোজা হেগো দেশে ধইরা নিয়া যাইবো। আর ফিরা আসতে পারবেন না। হক সাহেব আবার মতিকে ধমক দিলেন – চুপ থাক তো ! যা বলছি কর। আমাকে ঐ জ্বীনদের কাছে নিয়া চল।
মতি অনেক গাঁই-গুঁই করলো। অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করলো জ্বীনদের সাথে দেখা করতে যাওয়া আর শেওড়া গাছে উঠে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়া একই কথা। কিন্তু হক সাহেব ওর কোনো অজুহাত শুনলেন না। বললেন – শোন ব্যাটা তুই যদি জানতি যে তুই কি দেখে এসেছিস তাহলে তুই এখন ধেই ধেই করে নাচতি আনন্দে। মতি সন্দেহের চোখে হক সাহেবের দিকে তাকালো। মনে মনে ভাবলো – কি ব্যাপার সাররেও কি জ্বীনে আছর করছে নাকি। নাইলে জ্বীন দেইখা নাচার কথা কয় কেন?
যতই অনিহা থাকুক শেষ পর্যন্ত মতিকে উঠতেই হলো। কিন্তু ঘরের দরজা খুলে এক পা বাইরে ফেলেই সে আবার লাফ দিয়ে পিছিয়ে এসে সপাটে দরজা বন্ধ করে দিল। তার পেছনে থাকা হক সাহেব চমকে উঠে বললেন – কি হলো? অমন করে দরজা বন্ধ করে দিলি কেন? মতির চোখে তখন আতঙ্ক ভর করেছে। সে মৃগি রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে বলল – সার আর যাওন লাগবো না। হুজুরেরা নিজেরাই চইলা আসছে। কারা চলে এসেছে ? কি বলছিস এসব? – হক সাহেব মতির উপর ভিষণ বিরক্ত হলেন।
এমন সময় দরজার বাইরে কেমন যেন খর খর আওয়াজ হতে লাগলো তার সাথে কেমন যেন একটা – টুঁট টুঁট পুঁট পুঁট আওয়াজও যোগ হলো। মতি আর থাকতে পারলো না। সে ওরে আল্লারে! বলে চিত্কার করে ছুটে ঘরের ভেতরে চলে গেল। হক সাহেব বুঝতে পারলেন এলিয়েনরা মতিকে অনুসরন করে এখানে চলে এসেছে। তাঁর বুকটাও একটু দুরু দুরু করে উঠলো। কিন্তু সেটাকে তিনি পাত্তা না দিয়ে দরজা খুললেন। দেখলেন দুটো এলিয়েন দাঁড়িয়ে আছে। মতি যে রকম বর্ননা দিয়েছিল ঠিক সে রকম দেখতে। হক সাহেব তাদের ইশারায় থেতরে আসতে বললেন। তারাও গুটি গুটি পায়ে ভেতরে ঢুকলো। তারপর একটু কিম্ভূত উচ্চারনে ইংরেজীতে কথা বলল – হ্যালো হোমোসেপিয়েন, ভয় পেয়ো না। আমরা নিরীহ পরিব্রাজক মাত্র। এসেছি তোমাদের প্রতিবেশি গ্যালাক্সি থেকে। যাকে তোমরা অ্যান্ড্রেমিডা নাম দিয়েছ।
হক সাহেব ওদের সম্ভাসনের জবাব দিলেন ইংরেজীতে। তারপর তাদের মধ্যে অনেক কথা হলো। কথার মাঝে হক সাহেব জানলেন তারা কি করে ইংরেজীতে কথা বলছে। আসলে তারা পৃথিবীর কাছাকাছি এসে প্রথমেই বিশেষ
শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে আমাদের তথ্যভান্ডার (ইন্টারনেট) থেকে সব তথ্য সংগ্রহ করেছে। তারপর সেই তথ্য নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে তারা মোটামুটি একটা ধারনা পেয়ছে এই পৃথিবী আর তার শাসক প্রানী মানুষ সম্পর্কে। আর মানুষের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষা ইংরেজীকে অনুধাবন করেছে তাদের ভাষা-অনুবাদক যন্ত্রের মাধ্যমে। এখন সেই ভাষা-অনুবাদক যন্ত্রের সাহায্যে তারা কথা বলছে।
ইতিমধ্যে মতি আরেক কান্ড শুরু করেছে। সে কিছুক্ষণ পর পর ভেতরের ঘরের দরজা দিয়ে এ ঘরে উঁকি দিচ্ছে আবার ঝট করে মাথা সরিয়ে নিচ্ছে। মনে মনে ভাবছে – হায় আল্লাহ আমাগো সার যে এত বড় সুফি মানুষ তা তো আমি বুঝবার পারি নাই। এই জ্বীন দুইডারে তো সে বশ করছেই এহন আবার জ্বীনগো ভাষায় হেগো লগে কথা কইতাছে।
ওদিকে এলিয়েনদের যাওয়ার সময় হয়েছে। তারা জানালো যে – তাদের মোটামুটি যে সব তথ্য দরকার ছিল তার সব ঐ তথ্যভান্ডার থেকে পেয়ে গেছে। এখন তারা মানুষের দেহের কিছু জৈবীক উপাদান চায় গবেষনার জন্য। হক সাহেব সানন্দে রাজি হলেন তার দেহ থেকে কিছু রক্ত দিতে। এলিয়েনরা সেটা একটা বিশেষ যন্ত্রে সংগ্রহ করলো।
ওদিকে এলিয়েনদের যাওয়ার সময় হয়েছে। তারা জানালো যে – তাদের মোটামুটি যে সব তথ্য দরকার ছিল তার সব ঐ তথ্যভান্ডার থেকে পেয়ে গেছে। এখন তারা মানুষের দেহের কিছু জৈবীক উপাদান চায় গবেষনার জন্য। হক সাহেব সানন্দে রাজি হলেন তার দেহ থেকে কিছু রক্ত দিতে। এলিয়েনরা সেটা একটা বিশেষ যন্ত্রে সংগ্রহ করলো।
এরপর এলিয়েনরা চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালো। এতক্ষণ তারা শুন্যে কি ভাবে যেন বসার ভঙ্গি করে ছিল। যাবার আগে তারা হক সাহেবকে দুটো কালো চশমার মতো বস্তু দিল। বলল – এগুলোর একটা তোমার আরেকটা তোমার ঐ ভিতু সঙ্গীর জন্য। এটা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ওপর একটা তথ্যচিত্র। আমরা তৈরি করেছি আমাদের জন্য।
তোমাদেরও নিশ্চই ভালো লাগবে। হক সাহেব সানন্দে তাদের উপহার গ্রহন করলেন। এলিয়েনরা চলে গেল এরপর। হক সাহেব তাদের এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন স্পেসশিপ পর্যন্ত। কিন্তু তারা রাজি হলোনা।
এলিয়েনরা চলে যাওয়ার পর হক সাহেব কালো চশমার মতো বস্তুর একটা চোখে দিলেন। মুহুর্তে তাঁর মনে হলো তিনি যেন উড়ে একটি গ্যালাক্সির মাঝখানে চলে এসেছেন। এ এক আশ্চর্য জীবন্ত অনুভুতি। তিনি মুগ্ধ হয়ে গ্যলাক্সির সৌন্দর্য উপভোগ করলেন। ততক্ষণে মতি তাঁর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে – সার আপনে যে এত বড় সুফি দরবেশ তা তো আগে বুঝি নাই। আপনে জ্বীন বশ করছেন আবার তাগো লগে তাগো ভাষায় কথা কইছেন। হক সাহেব চোখ থেকে চশমার মত বস্তুটা নামিয়ে বললেন – চুপ কর গাধা ! ওরা জ্বীন হতে যাবে কেন ? ওরা হচ্ছে অন্য গ্রহের বাসিন্দা। বলে মতির দিকে এগিয়ে দিলেন একটা কালো চশমা – নে এটা তোকে ঐ ভিন গ্রহের বাসিন্দারা দিয়ে গেছে। মতি হক সাহেবের কথা মোটেও বিশ্বাস করলো না – ভাবলো জ্বীন তো জ্বীনই অন্যগ্রহের বাসিন্দা হইলেই বা কি? ভয়ে ভয়ে সে চশমাটা নিল। জ্বীনের দেয়া হাদিয়া তো আর অবহেলা করা যায়না।
এ ঘটনার পর অনেকদিন পর্যন্ত মতি সুযোগ পেলেই সবাইকে বলে বেড়াতো হক সাহেব হচ্ছেন জ্বীন বশ করা হুজুর। তবে কেউ তার কথা বিশ্বাস করতো না। এখনো মাঝে মাঝে মতি রাতের বেলা চুপে চুপে সেই চশমা বের করে চোখ দেয়। দিয়েই ওরে আল্লারে! বলে চিত্কার করে খুলে ফেলে। আর মনে মনে ভাবে – কি তামশা চশমা চোখে দিলেই জ্বীনের দেশ আইসা পড়ে। কি জাদুর কারবারই না কইরা গেছে জ্বীনেরা।
আর হক সাহেব এ ঘটনা কাউকে বলেন নি। কেউ কি এটা বিশ্বাস করবে? তিনি নিজেও তো অন্যের মুখে এ ঘটনা শুনলে বিশ্বাস করতেন না। সুতরাং তিনি চুপচাপ থাকাই মনস্থ্য করেছেন। মাঝে মাঝে কেবল সেই চশমাটা চোখে দিয়ে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বিপুল সৌন্দর্য উপোভোগ করেন। আর মনে মনে ভাবেন – আর না জানি কত এলিয়েন আছে এই গোটা মহাবিশ্বে। তারা না জানি কতবার এই পৃথিবী ঘুরে গেছে। যাদের আমরা চিনতে না পেরে মতির মত জ্বীন-পরী, দৈত্য-দানো বানিয়ে ফেলেছি। আর তাইতো পৃথিবীর তাবত দেশের রূপকথায় এদের উপস্থিতি এত বেশি।
*********************************************সমাপ্ত*****************************************