বাগানবাড়ি

বাগানবাড়ি

আমি তখন খুব অসুস্থ।

বছর চারেক আগের কথা। তখনো আমাকে নববধূই বলতে হবে, মাত্র কয়েক মাস হলো বিয়ে হয়েছে। অসুস্থ মানে, আমার ওপর এমন নির্যাতন করা হয়েছে, বিছানা থেকে ওঠার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই। নাক-মুখ ফুলে আছে, এখানে-সেখানে আঁচড়ানোর দাগ, হাত-পা মচকানো। নিজে ডাক্তার, জানতাম মারা যাব না। কিন্তু সীমাহীন অপমান আর শরীরের ওই তীব্র ব্যথার চেয়েও খারাপ ছিল গভীর অসহায় বোধ। তার কারণ পাষণ্ড লোকটার হুমকি—বাপের বাড়ি থেকে আরও একবার টাকা আনতে না পারলে হয় কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেবে, নয়তো এসিড মেরে…

এ রকম তীব্র আতঙ্কের মধ্যে যখন আমার সময় কাটছে, হঠাত্ করে প্রতি রাতে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

স্বপ্নের ভেতর আমি যেন ওর, মানে আমার স্বামীর কাছ থেকে পালাচ্ছি। অন্ধের মতো ছুটছি, শুধু ছুটছি।

তবে খানিক পর এই পালানোর অনুভূতিটা আর থাকল না। স্বামীর কথা ভুলে গেলাম, ভুলে গেলাম ব্যক্তিগত সব ভয় আর শঙ্কা। তখন আর ছুটছিও না, শান্তভাবে হেঁটে যাচ্ছি। জায়গাটা আমি চিনি না, কোনো দিন দেখিনি। জানি না কোথায় যাচ্ছি বা কেন যাচ্ছি।

একসময় দেখলাম একটা পাহাড়ি এলাকায় চলে এসেছি। অথচ জীবনে কখনো পাহাড় দেখিনি আমি। গ্রাম্য এলাকা, শীত গিয়ে বসন্ত আসি আসি করছে, শিশিরভেজা মেঠোপথ ধরে মনের আনন্দে একা একা হাঁটছি আমি। আমার ভেতর কোনো প্রশ্ন নেই, ভয় নেই, শুধু আনন্দ আর কৌতূহল বোধ করছি।

দুই পাহাড়ের মাঝখানে ছোট্ট উপত্যকা। সেটার চারদিক কোনো দক্ষ হাতে আঁকা ছবির মতো সাজানো।
আম-জাম-কাঁঠাল-লিচু-পেয়ারা-কলা-আতা-করমচা-বরই-ডালিম আর তেঁতুল…একের পর এক এসব বাগান পার হয়ে যাচ্ছি।

তারপর বেশ খানিক দূর থেকে বাড়িটা দেখতে পেলাম। দেখেই মনে হলো, নিশ্চয় কারও বাগানবাড়ি হবে। আমার স্বামীর মতো কোনো লম্পটের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, তা না হলে এ রকম নির্জন জায়গায় কেউ এত সুন্দর একটা বাড়ি বানাতে যাবে কেন। এ রকম প্রত্যন্ত এলাকার রাস্তাঘাট এত সুন্দর দেখে আমার মনে সন্দেহ জাগল, রোজ রাতেই হয়তো বেশ্যাপাড়া থেকে বাইজি এনে এখানকার জলসাঘরে আসর জমানো হয়, চলে মদ খেয়ে মাতলামো আর তাস নিয়ে জুয়া খেলা…

বাড়িটা সাদা, নিচু আর লম্বা; চারদিক থেকে লেবু ঝোপগুলো যেন পরম মমতায় ঘিরে রেখেছে। ওটার বাঁ দিকে বিস্তীর্ণ ঘাসজমি, কিনারায় সারি সারি নারকেল আর সুপারিগাছ দাঁড়িয়ে—চমত্কার একটা ব্যাকগ্রাউন্ড; বিশেষ করে আকাশছোঁয়া গাছের পাতা সারাক্ষণ দোল খাওয়ায় স্বপ্নটাকে নিরেট বাস্তব বলে মনে হতে লাগল।

যা-ই হোক, স্বপ্নের ভেতর আমি অনুভব করলাম কী এক আকর্ষণ আছে বাড়িটার, ওটার টান অগ্রাহ্য করতে পারছি না। ধীর, কিন্তু দৃঢ় পায়ে ওটার দিকে এগোচ্ছি। আগের সেই আনন্দ আর পাচ্ছি না বটে, তবে কৌতূহল অনেক বেড়ে গেছে।

বাড়ির চৌহদ্দির ভেতর ঢুকতে হলে কাঠের সাদা গেট পেরোতে হয়, সেটার রং এখনো পুরোনো হয়ে যায়নি। তারপর নির্দিষ্ট নকশা ধরে বাঁক নেওয়া সরু পাকা পথ ধরে এগোই, দুই ধারে ডজন ডজন পাতাবাহার আর ফুলগাছ দেখতে পাই। সাদা গোলাপই বেশি, তবে বাসন্তীকুসুম, তারাফুলসহ নাম না-জানা আরও অনেক ফুল আছে। ওগুলোর রং আমাকে যেন মাতিয়ে তুলতে চায়—টকটকে লাল, গোলাপি, কমলা, গাঢ় সবুজ, নীল, বেগুনি…কিন্তু কী অদ্ভুত স্বপ্ন, ওগুলোয় হাত দেওয়া মাত্র নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে। তারপর একসময় পথের শেষ মাথায় পৌঁছে যাই, দালানটা থেকে আর মাত্র কয়েক কদম দূরে আমি।

আমার ওই স্বপ্নের বাগানবাড়ির সামনে চোখ-জুড়ানো লন আছে, দেখলেই বোঝা যায় নিয়ম ধরে যত্ন করা হয়। প্রায় খালি লন, শুধু লম্বা ফ্লাওয়ার বেডটা ছাড়া—তাতে নীললোহিত, লাল আর সাদা রঙের গোছা গোছা ফুল ফুটেছে, সবুজ বিস্তৃতির মাঝখানে ভারি দৃষ্টিনন্দন। শ্বেতপাথরে তৈরি বাড়ি, বিশাল ছাদটা নীলচে স্লেট। রং ও পালিশ করা দামি কাঠের দরজা, পাল্লায় বাহারি নকশা। ওটার সামনে পৌঁছাতে হলে প্রথমে কয়েকটা ধাপ টপকাতে হবে।

বাড়িটার ভেতর ঢোকার জন্য আমার ভেতরটা আকুলিবিকুলি করতে থাকে। কেন যেন মনে হয় ওখানে ঢুকতে পারলে আমার কোনো গোপন আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে, মিটবে কোনো গায়ের ঝাল। আমি বোধ হয় প্রতিশোধ নিতে পারব। কার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ, ঠিক বুঝতে পারি না। সে প্রতিশোধ কীভাবে নেব তাও আমার জানা নেই। শুধু মনে হয় ভেতরে ঢোকা উচিত। খুব দরকার। একান্ত জরুরি।

তবে পরে ঘুম ভাঙার পর ভেবেছি, যে লোক আমার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে, আমার নারীজীবনকে পূর্ণতা পেতে দেয়নি, নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধেই প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ পেতে যাচ্ছি আমি। কে জানে, বাড়িটার ভেতরে ঢুকতে পারলে আমি হয়তো সেই অত্যাচারী লোকটাকেই, মানে আমার স্বামীকে ওখানে দেখতে পাব।

কিন্তু, হায়, ওই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যতই আমি ডাকাডাকি করি, যতই চিত্কার-চেঁচামেচি করি, যতই কলবেল বাজাই, ভেতর থেকে কখনো কেউ সাড়া দেয় না।

পরে এসে আবার চেষ্টা করব ভেবে হাঁটতে হাঁটতে বাড়িটার পেছন দিকে চলে যাই। ওদিকে ভারি সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন বাঁশঝাড় আছে। ওটার ভেতর দিয়ে কিছু দূর গেলেই সামনে পড়বে বিশাল এক দিঘি। ওই দিঘির টলটলে জলে কেউ যদি ডুবেও মরে, কেন যেন মনে হয়, তাহলে তার জন্য বোধ হয় সেটা সুখের মরণই হবে।

শান বাঁধানো ঘাটের শেষ ধাপে যতবার এসে দাঁড়িয়েছি, দিঘির টলটলে জলে নিজের চেহারা দেখে আমার কিন্তু কখনো মনে হয়নি ডুবে মরি, বরং প্রতিবারই মনে হয়েছে আমি না শেষ পর্যন্ত নিজের প্রেমে পাগল হয়ে যাই।

হায়! রূপ-রস বলি, ঢপ-ডাঁশা বলি, কোনো দিক থেকে কিছুতে আমার কমতি নেই। শরীরে যৌবন ধরে না, মনও সারাক্ষণ রং দে রং দে করে, অথচ আমি কিন্তু কোনো পুরুষ মানুষের কাছে যেতে পারি না। এখানেই আমার অসম্পূর্ণতা। আমার নারীজীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে।

আমি কোনো পুরুষের কাছে যেতে পারি না…সমাজ বাধা দেবে, সেজন্য নয়; আর সব বাধার কথা যদি না-ও ধরি, আমার নিজের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বভাব আর রুচি—এগুলোই বড় বাধা।

দিঘি দেখে ফেরার পথে আবার আমার ওই স্বপ্নের বাগানবাড়ির সদর দরজায় থামি, কলবেল বাজাই, চেঁচাই। কিন্তু নীরবতা আমাকে শুধু ব্যঙ্গই করে; ওখান থেকে আমি কারও সাড়া পাই না। অগত্যা রেগে যাই আমি, আর প্রতিবার তাতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়।

শুধু যে নিজের রূপ সম্পর্কে সচেতন ছিলাম, তা নয়; অনেক আগে থেকে জানি আমার মেধাও আছে। চেষ্টা ছিল, খাটাখাটনি করেছি, আর পারিবারিক পরিবেশ আড়ষ্ট হলেও সাহায্য করেছে সচ্ছলতা, দেখা গেল ছাব্বিশ বছর বয়সেই পাস করা একজন ডাক্তার আমি।

কলেজে ওঠার পর উপলব্ধি করেছি, আমি নারী। কাজেই আমার জীবনে একজন পুরুষ মানুষ দরকার। একজন প্রিয় পুরুষ ছাড়া নারীর জীবনের কী মূল্য! তবে ওকে আমার উপযুক্ত হতে হবে।

তাই প্রথমে দেখলাম চেহারা-সুরত ভালো কি না, তারপর খোঁজ নিলাম বংশ কেমন, নিশ্চিত হলাম কেতা-কায়দা সব ঠিকঠাক মতো জানা আছে, সবশেষে স্বভাব-চরিত্রের কঠিন পরীক্ষা নিয়ে তবেই ভালোবাসলাম একজনকে। কিন্তু এত সাবধান হওয়া সত্ত্বেও লাভটা কী হলো! কী বলব…এ একেবারে জাত অভিনেতা, মায়ের পেট থেকে শিখে এসেছে, মূল্যায়ন করতে হলে অস্কার দিয়েও কুলানো যাবে না।

বিয়ের পর প্রথমেই যে ধাক্কাটা খেলাম, আমার স্বামী চোখ মেলে আমাকে যতক্ষণ দেখে এর চেয়ে অনেক বেশি সময় নিয়ে চোখের মণি করে রাখে অন্য মেয়েদের। গাড়ি করে বেরিয়েছি, ড্রাইভ করার সময় রিকশায় বসা মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে ও, অপলক দৃষ্টিতে; মেয়েটা দেখতে ভালো হোক বা খারাপ, চোখ দিয়ে গিলতে ওকে হবেই—আমি যে পাশে বসে আছি, এটা যেন খেয়াল করার প্রয়োজন নেই। ওকে আমার বিপজ্জনক মনে হলো যখন লক্ষ করলাম এমনকি সাবালিকা নয় এমন মেয়ের দিকেও তাকিয়ে থাকে—দৃষ্টিটা কেমন তার ব্যাখ্যায় না হয় না-ই গেলাম।

একদিন হুইস্কি খাচ্ছে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এসব কী হচ্ছে?’

উত্তর দিল, ‘সাইড বিজনেসে যখন বড় কোনো দাঁও মারি কিংবা মারাত্মক কোনো লোকসান দিই, শুধু ওই দিনগুলোয় খাই; কিন্তু যতই পেটে পড়ুক, তোমার স্বামী কখনো মাতাল হয় না—এ নিয়ে তুমি গর্ব করতে পারো।’

কেউ যদি মনে করে তাস খেলতে বসে এক শ টাকা হারাটাও মারাত্মক ক্ষতি কিংবা যদি মনে করে পঞ্চাশ টাকা জিতে বড় দাঁও মেরেছে, তাহলে কারও কিছু বলার থাকে কি?

এই জুয়া খেলাই ওর সাইড বিজনেস, আর এই খেলায় হারজিতের অজুহাতে রোজ শেষরাত পর্যন্ত বসে বসে হুইস্কি কিংবা ছাইপাঁশ অন্য কিছু খাবে। তবে সত্যি সে মাতাল হয় না। কী জানি, সত্যিকার শয়তানেরা বোধ হয় মাতাল হওয়ার ক্ষমতা রাখে না। জ্ঞান জিনিসটা সারাক্ষণ টনটন করে বলেই কি প্রচণ্ড স্বার্থপর হয় এরা? নির্দ্বিধায় অন্যের পাওনা টাকা মেরে দেয়? কী জানি, সাইকিয়াট্রিস্টরা হয়তো ভালো বলতে পারবেন।

আমি শুধু ভাবি, মাতাল হওয়া মানে কি কারও ক্ষতি করার ক্ষমতা কমে যাওয়া নয়? অথচ আমার স্বামীর বেলায় দেখেছি, যত বেশি নেশা করে, তত বেশি নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে তার নির্যাতন। এমন ধৃষ্ট খুব কমই দেখা যায়—নির্লজ্জ নায়ক, অপরাধ করেও নিঃশঙ্ক থাকতে পারে।

যদিও জানি সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে, তবু সেটার যাতে ষোলোকলা পূর্ণ না হয় সে জন্য সময় থাকতে সাবধান হলাম—কনসিভ করলাম না।

শুধু তা-ই নয়, বিয়ের পর মাত্র ছয় মাসের মাথায় সুযোগ পেয়ে দেশের নামকরা একটা এনজিও-তে ঢুকে পড়লাম। দরিদ্র বস্তিবাসীকে চিকিত্সাসেবা দেয় ওরা, বিশেষ করে শিশুদের। নিয়তির নির্মম রসিকতায় আমিও মনে মনে একটু হাসলাম—কীভাবে যেন দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর ব্যবস্থা হচ্ছে! সংসার টিকলে আমি হয়তো একটা বাচ্চা নিতাম, এখন পেতে যাচ্ছি শত শত।

সে যা-ই হোক, কাজটা আমি সিরিয়াসলিই নিলাম। ওরা আমাকে ছোট একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছে, তবে বলে দিয়েছে ড্রাইভার দিতে পারবে না। অগত্যা আমার নিজেকেই সেটা চালাতে হয়। কোনো কোনো দিন ওসব বস্তিতে বারো ঘণ্টারও বেশি সময় দিতে হয় আমাকে।

নতুন যেকোনো বস্তিতে যাওয়ার সময় স্বপ্নে দেখা সেই বাগানবাড়ি খুঁজতে আমার কখনো ভুল হয় না। কারণ, বস্তির পাশেই তো প্রাসাদতুল্য সব অট্টালিকা বানিয়ে রেখেছে আমাদের টাকার কুমিরগুলো। কিন্তু বৃথাই, আমার সেই বাগানবাড়ি আমি কোথাও দেখতে পাই না।

অথচ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস একই স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি। একসময় আমার ধারণা হলো, নিশ্চয়ই ছোটবেলায় বাবা বা মায়ের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে গিয়ে এসব বাগান আর বাড়িটা আমি দেখেছি, অবচেতন মনে তার প্রতিফলন রয়ে গেছে, স্বপ্নের ভেতর দিয়ে চেতন মনে উঠে আসছে সেটা। যা-ই হোক, জেগে থাকা অবস্থায় ওসব আমি চাক্ষুষ করতে পারি না।

আমার চাকরি করা নিয়ে নরকতুল্য সংসারে জ্বলে উঠল নতুন আগুন। প্রথম দুই মাসের বেতনের টাকা জোর করে কেড়ে নিল ও। তারপর আবদার ধরল, আমার এনজিওতে পাঁচজন লোককে চাকরি দিতে হবে, তাতে নাকি মাথাপিছু দেড় লাখ করে টাকা আসবে ওর পকেটে। আর আগের সেই হাতপাতা, মায়ের কাছ থেকে আরও টাকা এনে দিতে হবে, সেটা তো আছেই।

প্রথমবার চাইতে লাখ তিনেক টাকা খুব গোপনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল মা, ফিসফিস করে বলেছিল: আমার কাছে আর নেই রে মা।

সত্বাবা জানতে পারলে কী ভাববেন, এ কথা ভেবে কত রাত ঘুমাতে পারিনি। স্বামী যতই হুমকি দিক, জানতাম মাকে আর বিরক্ত করব না। করিওনি।

আরও টাকা আনতে রাজি না হওয়ায় বারবার মার খেলাম। ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় থেকেছি, ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়। অগত্যা সিদ্ধান্ত নিলাম, এই নরকে আর নয়। নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার একটা সুযোগ আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল, সেটা কাজে লাগালাম।

অফিস থেকে আমাকে সারা দেশ ট্যুর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তবে নানা কারণে সেটা আমি এত দিন গ্রহণ করিনি। এবার করলাম। তা করার অবশ্য আরও একটা কারণ আছে। স্বপ্নটা প্রতিদিন এত বেশি তাগাদা দিচ্ছিল, ঠিক করলাম দেশ ঘোরার এই সুযোগ নিয়ে দেখব বাড়িটার আদৌ কোনো অস্তিত্ব কোথাও আছে কি না।

উকিলকে দিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিলাম, তারপর বদলি হয়ে চলে এলাম বগুড়ায়। বগুড়ায় মাস তিনেক থাকলাম, তারপর শুরু হলো আমার ট্যুর।

মাসের পর মাস গোটা বাংলাদেশ চষে বেড়াতে হলো আমাকে। সে ভ্রমণ আর অভিজ্ঞতার বিশদ বিবরণ আমি দেব না। কোথায় না গেলাম, কত কিছুই না দেখলাম, কিন্তু আমার আসল উদ্দেশ্য যেমন ছিল, তেমনি অপূর্ণই থেকে গেল। সেই বাগান আর বাড়ি কোথাও আমি দেখতে পেলাম না।

অবশেষে দীর্ঘ ট্যুর শেষ হতে চলেছে। গত বছরের মতো চলতি বছরও, প্রতিটি দিন সেই স্বপ্নটা দেখতে হচ্ছে আমাকে। স্বপ্ন নয়, বলতে গেলে ওটা এখন আমার জন্য প্রায় দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। শীত শেষে বসন্ত উঁকি দিচ্ছে, কিন্তু ওই সাদা বাড়ি না আমাকে ছাড়ছে, না ধরা দিচ্ছে।

কুমিল্লার প্রত্যন্ত গ্রাম বিভাবরীতে এসেছি, এখানে মাস দুয়েক থেকে আবার ফিরে যাব ঢাকায়। গোমতী নদী থেকে জগন্নাথপুরের দিকে যেতে, প্রায় সীমান্তের লাগোয়া এই গ্রাম। গ্রামের মাঝখানে একটা দালানে আমাদের মেডিকেল ফ্যাসিলিটিজ সেন্টার, পাশের ছোট্ট দালানটায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা।

আমার এখন যা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে, কাজের ফাঁকে অবসর পেলেই ছোট্ট গাড়িটা নিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ি। সেদিনও ঝোঁকের মাথায় বেরিয়ে এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করার পর মনে হলো আমি বোধ হয় পথ হারিয়ে ফেলেছি।

এখনো বেলা আছে, তাই আতঙ্কিত না হয়ে ফিরতি পথ ধরার চেষ্টা করছি। এই সময় হঠাত্ অভিভূত হয়ে পড়লাম। এটাকে সেই কৌতূহল জাগানো আবেগের সঙ্গে তুলনা করতে হয়—দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার পর ভালোবাসতাম এমন কোনো মানুষ বা স্থানকে হঠাত্ চিনতে পারলে যেমনটি হওয়ার কথা; যদিও ওই এলাকায় আগে কখনো আসিনি আমি, তার পরও আমার ডানদিকে যে দৃশ্য রয়েছে, তা আমি পরিষ্কার চিনতে পারছি—এক জোড়া ছোট্ট পাহাড়ের মাঝখানে সরু উপত্যকা।

গাড়ি নিয়ে সাবধানে এগোচ্ছি আমি। উত্তেজনায়, রোমাঞ্চে আমার হাতের রোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। প্রথমে চোখে পড়ল সুপারি আর নারকেলগাছের মাথাগুলো। আম-জাম-কাঁঠাল-লিচু-পেয়ারা-কলা-আতা-করমচা-বরই-ডালিম আর তেঁতুল…দ্রুত গাড়ি চালিয়ে একের পর এক এসব বাগান পার হয়ে যাচ্ছি।

তারপর বাড়িটা দেখতে পেলাম। সাদা, নিচু আর লম্বা; চারদিক থেকে লেবু ঝোপগুলো যেন পরম মমতায় ঘিরে রেখেছে। ওটার বাঁ দিকে বিস্তীর্ণ ঘাসজমি, কিনারায় সারি সারি নারকেল আর সুপারিগাছ দাঁড়িয়ে—চমত্কার একটা ব্যাকগ্রাউন্ড; বিশেষ করে আকাশছোঁয়া গাছের পাতা সারাক্ষণ দোল খাওয়ায় এটাকে এখন নিরেট বাস্তবই লাগছে।

বাস্তবেও অনুভব করলাম কী এক আকর্ষণ আছে বাড়িটার, ওটার টান অগ্রাহ্য করতে পারছি না। ধীরপায়ে ওটার দিকে এগোচ্ছি।

এরপর সেই কাঠের সাদা গেট পেরোতে হলো। নির্দিষ্ট নকশা ধরে বাঁক নেওয়া সরু পাকা পথ ধরে যাচ্ছি, দুই ধারে ডজন ডজন পাতাবাহার আর ফুলগাছ দেখতে পাচ্ছি। সাদা গোলাপই বেশি, তবে বাসন্তীকুসুম, তারাফুলসহ নাম না-জানা আরও অনেক ফুল আছে, ঠিক এত বছর ধরে স্বপ্নে যেমনটি দেখেছি।

একসময় পথের শেষ মাথায় পৌঁছে গেলাম, দালান থেকে আর মাত্র কয়েক কদম দূরে আমি।

বাড়ির সামনে চোখ জুড়ানো লন, নিয়মিত যত্ন করা হয়। লম্বা ফ্লাওয়ার বেডে নীললোহিত, লাল আর সাদা রঙের গোছা গোছা ফুল ফুটেছে, সবুজ বিস্তৃতির মাঝখানে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। সাদা পাথরের বাড়ি, বিশাল ছাদটা নীলচে স্লেট দিয়ে তৈরি। রং ও পালিশ করা দামি কাঠের দরজা, পাল্লায় বাহারি নকশা; ওটার সামনে পৌঁছাতে হলে প্রথমে কয়েকটা ধাপ টপকাতে হবে।

গাড়ি থামিয়ে নামলাম, ধাপগুলো টপকালাম, তারপর চাপ দিলাম কলবেলের বোতামে। খুব ভয় পাচ্ছিলাম, কেউ সাড়া দেবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একজন দারোয়ান বা কেয়ারটেকার গোছের লোক দরজা খুলল। লোকটার সারা মুখে বিষণ্নতার ছাপ, বয়সও হয়েছে প্রচুর, গায়ে কালো কোট চাপানো। আমাকে দেখে ভারি অবাক হয়েছে বলে মনে হলো, কথা না বলে সপ্রতিভ একটা ভাব নিয়ে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে।

‘মাফ করবেন,’ বললাম আমি। ‘আমার একটা অনুরোধ আছে, শুনতে হয়তো একটু অদ্ভুত লাগবে। কে বা কারা এই বাড়ির মালিক, আমি জানি না, তবে তাঁরা যদি দয়া করে বাড়িটা আমাকে একবার দেখার অনুমতি দেন, আমি খুব কৃতজ্ঞবোধ করব…’

‘এই বাগানবাড়ি ভাড়া হবে, বেগমসাহেবা,’ বাধা দিয়ে বলল লোকটা। ‘লোকজনকে দেখাব বলেই না এখানে আমি আছি।’

‘ভাড়া হবে?’ বললাম আমি। ‘আরে, আমার ভাগ্য তো দেখা যাচ্ছে দারুণ…কিন্তু, এত সুন্দর একটা বাড়িতে মালিকেরা কেন বসবাস করেন না?’

‘মালিকেরাই এখানে বাস করতেন, বেগমসাহেবা। তাঁরা চলে গেলেন এখানে ভূতের উপদ্রব শুরু হবার পর।’

‘ভূতের উপদ্রব?’ ভ্রু কোঁচকালাম আমি। ‘উঁহু, অসম্ভব, এসব বলে আমাকে ভয় দেখানো যাবে না! কী আশ্চর্য, এই যুগে কেউ ভূতটুত বিশ্বাস করে নাকি!’

‘বিশ্বাস আমিও করতাম না, বেগমসাহেবা,’ অত্যন্ত গম্ভীর সুরে বলল লোকটা, ‘যদি যে ভূতটা ওঁদেরকে ভাগিয়েছে, তার সঙ্গে আমারও রাতের বেলা বাগানের ভেতর বার কয়েক দেখা না হতো।’

‘ভালো কাহিনি ফেঁদেছেন!’ অবাক হওয়ার সুরে বললাম, চেষ্টা করলাম হাসতে, তবে সে হাসিতে অদ্ভুত আড়ষ্টতা থেকেই গেল।

‘কিন্তু, বেগমসাহেবা, এই কাহিনি শুনে আপনার অন্তত হাসা উচিত নয়,’ বুড়ো লোকটা যেন খানিকটা তিরস্কারের সুরে বলল, ‘যেহেতু আপনিই সেই ভূত।’

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত