পুতুল

পুতুল

এই নিয়ে তিনবার বাসা বদলাতে হলো। অজানা শহরে মাত্র দুইমাসের মধ্যে তিনবার বাসা বদলাতে ভালো লাগে? কী আর করা! নিনা কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না। রাত নেই, দিন নেই, শুধু কান্না! কোনরকমে কান্না থামালেই বলে, “আম্মাম, কার্তুুনটা এখানেও এসে গেছে। আমাকে শুধু নিয়ে যাবে বলে।”

আমি হৃদি। নিনা আমার দুই বছরের মেয়ে। নিনার বাবা তাহরীমের কাজের জন্য এখানে বাসা নেওয়া। কিন্তু নিনার অদ্ভুত সব সমস্যা হচ্ছে। ডক্টর বললেন নতুন পরিবেশে এরকমটা হয়। প্রথম বাসাটা ফাঁকা এলাকায় বলে তিনি সদরে বাসা নিতে বললেন, দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ জায়গায় এমনিতেই মস্তিষ্কে চাপ পড়ে। দ্বিতীয় বাসাটায় আমাদের টপ ফ্লোরে ফ্লাট। ছাদে অনেক শব্দ হত, নিনার ঘুমের সমস্যা হচ্ছিল। তাছাড়া ওই কার্টুনের ভয় তো আছেই। আবারো বাসা বদলানো হলো। কোনো পরিবর্তন নেই! নিনার কান্না আর আবোল তাবোল কথা সমানে বাড়ছে। শেষমেশ আমার আপু তার এক সাইক্রিয়াট্রিস্ট বন্ধুর কথা বলল, বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। নাম সায়েম বিন রাহাত। তিনি সবটা শুনে দেখা করতে চাইলেন। আজই আসছেন তিনি।

বড়ই মিশুক ভদ্রলোক। সবাইকে সহজেই আপন করে নিলেন। অদ্ভুত হলো এই ক’দিনে নিনা তেমন কান্নাকাটি করেনি। বোঝাই যাচ্ছে না নিনার কোনো সমস্যা আছে। রাতে নিনা ঘুমিয়ে পড়লে তাহরীম কথা তোলে।

: আচ্ছা খেয়াল করেছো? নিনা আর কান্নাকাটি করছে না।
: হুম। আমার মনে হয় নিনা একা থাকতে ভয় পায়। এখন ডক্টর ওকে কম্প্যানি দিচ্ছেন।
: তাহলে একটা কাজের লোকের ব্যবস্থা…
: কিন্তু ওরকম হলে কার্টুনের কথা কেন বলবে?
: ছোট মানুষ!
: না তাহরীম। নিনা কখনই উল্টাপাল্টা কিছু বলে না।

এমন সময় আমাদের বেডরুমের দরজায় ঠক্ ঠক্!
খুলে দেখি সায়েম ভাইয়া কী কথা আছে বলে আমাদের বাইরে যেতে বললেন। নিনাকে ভালো করে শুইয়ে যখন বসার ঘরে গেলাম, তাহরীমের মুখটা দেখে ভালো বোধ হলো না। কাছে যেতেই তাহরীম বলল,”হৃদি এটাই বলছিল যে নিনা কখনো উল্টাপাল্টা কিছু বলে না…”
ভাইয়া: আমারও তাই মনে হয়েছে। নিনা ছোট হলেও বুদ্ধিমতী। না দেখে কোনো কথা বলার মতো মেয়ে না।
আমি: আপনি আসার পর ও কিন্তু আর কান্নাকাটি করছে না, এমনিতে আমি রান্না করার সময়টা ওর একা থাকতে হয়। এখন আপনি থাকাতে…
সায়েম: এমন তো নয় যে ও কোন কিছু দেখে ভয় পেয়ছে, একা থাকলে সেটা মনে পড়ে ভয় পায়। হ্যালুসিনেশন?
তাহরীম: কিন্তু তাহলে তো বলত আমাদের। নিনা সবকিছু স্পষ্ট করে বলে।
সায়েম: তাহলে নিশ্চয় ও এমন কিছু দেখেছে বা দেখছে, যেটা আমরা পাচ্ছি না।
আমি : তা কিভাবে সম্ভব?
সায়েম: সেই উত্তর তো আমিও খুঁজছি।

তখনই ঘর থেকে নিনার কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। আমরা তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে দেখি নিনা বিছানার একদম ধার ঘেঁষে বসে কাঁদছে। আরেকটু হলে পড়েই যেত। সায়েম ভাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। এর আগে তিনি নিনার এই কান্না দেখেননি। অনেকটা সময় লাগল নিনাকে থামাতে। ভাইয়া চিন্তিত মুখে আমাদের গুডনাইট বলে চলে গেলেন।
সকালে ভাইয়া আমাদের ঘরটা ভালো করে দেখে যা বললেন তাতে আমরা খানিকটা অবাক হলাম, কিছুটা ভয়ও পেলাম। কারণ ভাইয়া যা ভাবছেন তা হলে বিষয়টা খুব একটা ভালো হচ্ছে না।

আমাদের ঘরে একটা বড় জানালা আছে। চোর ডাকাতের উৎপাত না থাকায় দোতলার এই জানালা খোলাই থাকে। ভাইয়া বললেন কেউ একজন আমাদের আসার আগে এই জানালায় ছিল, যাকে নিনা দেখেছে। নিনাকে জিনিসটা আজ খুব ভালোভাবে জিজ্ঞেস করলেন ভাইয়া। নিনা প্রথমে কিছু না বললেও পরে বলল, “কার্তুন আসে, লালচুল কার্তুন আসে। আমাকে নিয়ে যাবে বলে।”

ভাইয়া আমাদের পুরো বাসা খুঁজে লাল মাথাওয়ালা অনেক কিছু বের করলেন। আমার চোখ পড়ল একটা পুতুলের ওপর, লাল চুলওয়ালা, সাদা ফ্রক পরা, কিন্তু মুখটা ঠিক পুতুলের মত না, একটা ক্লাউনের মত।
ওটা তুলে নিলাম।
এমন সময় নিনা এ ঘরে এল।
নিনা: আম্মাম ওতা ফেলে দাও। ওতা পঁচা। ওতা ভয়।
ভাইয়া: কেন নিনামনি? ওটা নিয়ে খেলবে না তুমি?
নিনা দৌড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলল, “কক্ষনো না। ওতা ভয়, ওতা ফেলে দাও না!”
ভাইয়া: পুতুলটা কোথায় কেনা?
আমি: এখানে সবকিছুই একটা বড় শপে কেনা, ওখানেই হবে।
ভাইয়া: যাওয়া দরকার, দেখি এর উৎস কোথায়!

তাহরীম আর ভাইয়া ওই দোকানে পুতুলটা নিয়ে গেছেন। আমি নিনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেও কিছুক্ষণ পরে নিনা আবার ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল।
পুতুলটা তো বাড়িতেই নেই! নিনা ভয় পেল কেন?

ওরা ফিরে আসার পর বলল এরকম কোন পুতুল নাকি দোকানে আসেইনি। অথচ আমরা নিশ্চিত ওই দোকানেই কিনেছি। তাড়াতাড়ি রিসিপ্ট বের করলাম।
রিসিপ্ট দেখে আমাদের নিজের চোখকেই বিশ্বাস হল না। ওখানে কোন পুতুলের উল্লেখ নেই! সেদিন খেয়াল হয়নি।
অথচ ওই দোকানেই কেনা হয়েছে ওটা!

মাথায় কিছুই আসছে না। পুতুল ফেলে দিয়ে লাভ নেই। কারণ পুতুল না থাকলেও নিনা ভয় পেয়েছে। ভাইয়া আমাদের ঘরে কী যেন করছেন তাই আমরা বসার ঘরে। চিন্তা হচ্ছিল, পুতুলটা নিজে থেকেই আমাদের ঘরে এসেছে, কিন্তু কেন?
হঠাৎই ভাইয়ার চিৎকার শুনে আমরা ঘরে এলাম। ভাইয়া ফ্যাকাশে মুখে বিছানায় আর পুতুলটা মেঝেতে। আমরা যেতেই পুতুলটা ধীরেধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল! চোখের সামনে! এবার আমরা সত্যিই ভয় পেলাম।
আমি: কী হয়েছিল?
ভাইয়া: ওটা কোন পুতুল হতে পারে না। আমি পরীক্ষা করতে করতে যখন ওটার জুতা খুলছিলাম তখন…
আমি: কী?
ভাইয়া: ওটার লাল চোখ ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছিল। হাতে তীব্র শক্ মারে ওটা। আমি ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠি।
সত্যিই ভাইয়ার হাতে পুড়ে যাওয়া কালচে দাগ। অবিশ্বাস্য হলেও আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। তাহরীম ভাইয়ার ক্ষতটা দেখতে গিয়ে খাটের কোণায় পড়ে থাকা পুতুলের জুতাটা দেখতে পায়। জুতার তলাটা আশ্চর্যরকম মোটা! তাহরীম তলাটা নখ দিয়ে খুঁটতেই একটা স্টিকারের মত অংশ উঠে এল। ভেতরে একটা ভাঁজ করা কাগজ। তাতে রক্ত দিয়ে লিখা, “তৈরী হ! ওর হৃৎপিণ্ড আমার চাই।”
নিচে একটা তারিখ।
আর অদ্ভুত একটা চিহ্ন আঁকা।

আমরা প্রচণ্ড ভয় পেলাম। এই একুশ শতাব্দীতেও এসব সম্ভব? কাগজটা ভাল করে দেখতে গিয়ে মনে হল, এই চিহ্নটা আমি চিনি। একমনে ভাবতে লাগলাম, কোথায় দেখেছি!
ঘরের কোণে আমাদের লাগেজ পড়ে আছে। নিনা আপাতত ওটাতে বসার চেষ্টায় মত্ত। লাগেজটা পরিষ্কার করা দরকার। শেষবার গ্রামে গিয়ে…
কি? গ্রামে? হ্যাঁ! গ্রামের জঙ্গলে একটা গাছে আমি এই চিহ্নটা দেখেছি!
তাহরীমদের সব খুলে বলতেই…
ভাইয়া: আর দেরী করা যাবে না। গ্রামে চল।
আমি: আজই বেরিয়ে পড়তে হবে।
ভাইয়া: হুম। রেডি হও তোমরা।
বিকেল নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম।

কাগজের তারিখটা কালকের!

গ্রামে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সবাই ঘুমানোর অপেক্ষা করতে লাগলাম। সবাই ঘুমোলে নিনাকে ওর দাদির কাছে রেখে বেড়িয়ে পড়লাম।
অন্ধকারে হারিকেন আর তিনটা মোবাইলের আলোও কিছু করতে পারছে না। মাকে সব বলার পর মা জোর করেই এক পুরাতন চাকরকে পাঠিয়েছেন। গাছটা খুঁজে বের করতে অনেক সময় লাগল। মিলিয়ে দেখি একই চিহ্ন! আমরা আশেপাশে খুঁজতে লাগলাম, কিছু যদি পাওয়া যায়! কখন যে রাত বারোটা পার হয়ে গেছে কেউ খেয়াল করেনি। হঠাৎ জোরে বাতাস বওয়া শুরু করল, ডালপালা যেন ভেঙে পড়বে। আমরা কী করব বুঝে ওঠার আগেই একজন বুড়ো এসে…
বুড়ো: কেন এসেছিস এখানে? মধ্যপ্রহরের পর এখানে আসতে নেই জানিস না?
আমি আর পারলাম না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম
আমি: সন্তান বাঁচাতে এসেছি! আমার মেয়ে!
বুড়ো: কী বললি? তোরই মেয়ে তাহলে এটা?
বুড়ো হাত নাড়াতেই সামনের পুকুরের জলে নিনার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। ভাইয়া আর তাহরীমও দেখেছে। ওরা ছুটে এল।
বুড়ো: সারাজীবন ধরে এই প্রেতাত্মাকে ধ্বংস করার সাধনা করেছি আমি। আজ এই শেষপ্রহরে তোরা এলি?
তাহরীম: একি বলছেন আপনি?
বুড়ো: কাল মাঝদুপুরে তোদের মেয়েকে নিয়ে আসবি। দেখি বাঁচাতে পারি কি না! মধ্যরাত পর্যন্ত সময়। আর…
আমি: আর?
বুড়ো: মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে আসবি।
ভাইয়া: কেন?
বুড়ো: কাউকে তো মরতেই হবে। যার রক্ত আহুতি দিয়ে রক্তকূপে আগুন জ্বলবে, সেই বাঁচাবে তোদের বাচ্চাকে। আর ধ্বংস করবে ওই পাপীকে। তোর মেয়ের জন্ম শুক্লালগ্নে! ৭৭৭ দিনের শুক্লালগ্নবতী মেয়ের বলিই পারে এই প্রেতাত্মাকে অমরত্ব দিতে, কাল সেই দিন! এখন যা!

বাড়ি ফিরে চুপ করে রইলাম। পরের দিন নিনাকে নিয়ে সবার অলক্ষ্যে আমরা তিনজন জঙ্গলে পৌঁছে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলাম একটা সরু রক্তের দাগ চলে গেছে দক্ষিণে।কিছুদূর গিয়ে দেখি একটা কালো দেয়াল, একটা ফোকর দিয়ে দাগ চলে গেছে। ভেতরে ঢুকব কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু নিনা কোনো কথা না শুনেই ভেতরে ঢুকে গেল। নিনার চিৎকারে তাকিয়ে দেখি ভেতরে কিছুই নেই, অতল গহ্বর!
আমি চিৎকার দিতেই সেই বুড়ো এসে বললেন, ” একি করলি? আমার অনুমতি ছাড়া কেন এলি? এ যে ফাঁদ! আর দেরী করা যাবে না। আয় কে রক্ত দিবি।”
আমরা একটু আগেই এসেছিলাম, কারণ কেউ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত নই। বলতাম কোন পশু দিয়ে হবে কি না!
এখন আর ভাবার সময় নেই। আমি এগিয়ে গেলাম। তাহরীম চেঁচিয়ে উঠল, “কী করছ, হৃদি? আমি থাকতে তুমি কেন?”
আমরা তর্ক করতেই ভাইয়া এগিয়ে গেল। আমরা কিছু বলার আগেই…
ভাইয়া: দেখ, আমি বিয়ে করিনি, মা বাবা কেউ নেই। আমার জন্যে কারও কিছু হবে না। তোমরা না থাকলে নিনার কী হবে? এই কয়দিনে আমি ওকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি, আমাকে যেতে দাও। দাদু, আপনি রক্ত নেন।
বুড়ো: কী বললি? দাদু? আমার নাতি হলি তুই? সারাজীবন আমার চলেই গেছে, আর আজ নাতিকে মেরে নিজে বাঁঁচব? আয় তোরা।”
আমি : কিন্তু ভেতরে তো শুধুই খাদ!
বুড়ো : ও তোদের চোখের ভুল, আয়।
আমি এই মৃত্যু মানতে পারছিলাম না। তবুও গেলাম।দেখি খাদ আছে, কিন্তু একটু দূরে। নিনা সামান্য নিচে পড়েছে। তাহরীম তুলে আনতে গেলে দাদু মানা করেন, বলেন ওটাই নিরাপদ, আগুন থেকে বাঁঁচবে।
যজ্ঞ শুরু হল, আমাদের অলক্ষ্যেই তিনি বাম হাতের রগ কেটে রক্ত দিচ্ছিলেন, ধীরেধীরে কমে আসছিল তার প্রাণশক্তি। আমরা যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছি। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সময় আমাদের হাতে একটা অদ্ভুত দণ্ড দিয়ে বললেন…
“আমার সময় শেষ, কিছুক্ষণ পরে ও এই কূপে দেখা দিলে এই দণ্ড ওর হৃৎপিণ্ডে বসিয়ে দিস। কিন্তু সাবধান! যদি হৃৎপিণ্ডে না বসাতে পারিস তাহলে সোজা নিচে পড়বি, বাচ্চাসহ সবাই মারা পড়বি।”
আমাদের ঘোর কেটে গেল, আমি দাদুকে ধরতেই দাদুর রক্ত আমার কপালে লেগে গেল। হঠাৎ চারদিক অন্ধকার করে একটা বিশালাকার মূর্তির আবির্ভাব! মুখ সেই ক্লাউনের মত! আমার কী হল জানিনা, দণ্ড হাতে নিয়ে কেউ কিছু বোঝার আগেই ঝাপিয়ে পড়লাম।

জ্ঞান ফিরল হাসপাতালে। আমি সফল হয়েছিলাম। নিনা আমার পাশে বসে খেলছে।
ভাইয়া: যা খেলটা দেখালা বোন, আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া।
তাহরীম কেঁদে ফেলল, “দুইদিন পর তোমার জ্ঞান ফিরল।”
নিনা হাসছে…

হাসপাতালের জানালার বাইরে কার যেন মুখ! দাদু! আমি তাকাতেই চলে গেলেন। দাদু, আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত