আধাঁরবিলাস

আধাঁরবিলাস

ক্লাস চলাকালীন সময়ে জামিল হঠাৎ রাহাতকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিল। রাহাত তাকাতেই সে বললো, “ভুডুচর্চার নাম শুনেছিস?”

“কিসের নাম?”

“ভুডুচর্চা। একধরনের ডাইনীবিদ্যা। প্রেতসাধনা টাইপ ব্যাপার স্যাপার।”

“জানিস এখন স্যার কি নিয়ে লেকচার দিচ্ছে। ‘মলিকিউলার সিমেট্রি’ আর তোর মাথায় ভুডুচর্চা! পাগলা তুই মানুষ হবি কবে?”

“ক্লাস শেষে সব বলব।”

জামিল রাহাতকে টেনে রহিম মিয়ার চায়ের ঝুপড়ির পাশে নিয়ে গেল। কন্ঠ নামিয়ে বললো,”আমার সাথে এক জায়গায়যাবি?”

“কোথায়?”

“লালমাটিয়ার একটা বাসায়।”

“সেখানে গিয়ে কি হবে?”

“আগে চল তারপর বলব। ঐখানেআমার ওস্তাদ থাকেন। প্রেত সাধনা করে”

রাহাত অট্টহাসি দিয়ে বললো,”কে থাকে? তোর ওস্তাদ?প্রেত সাধনা করে?”

“হ্যাঁ আমার ওস্তাদ। আমাকে বুধবার মানে আগামীকাল তার বাসায় দাওয়াত করেছেন। তিনি একা থাকেন।

আমিবলেছি আমি আমার এক বন্ধুকে নিয়ে আসব। আমরা রাতেও ওখানে থাকব। একা থাকতে কেমন জানি লাগে, এজন্য তুইও থাকবি।”

“রাতে থাকব কেন?”

“আগে বল তুই যাবি কিনা?”

“ভেবে দেখি।”

“ভাবাভাবির কিছু নাই। ঐখানে ওনার সাথে একটু পরিচিত হবি। তোর থাকতে ইচ্ছা হলে থাকবি নাহলে চলে আসবি সোজা হিসাব। কি রাজি?”

“ওকে। যা রাজি।”

“থ্যাঙ্কস্ দোস্ত।”

ঢাকা শহরে এমন জঙ্গলময় বাড়ি আছে এটা রাহাত জানতনা। বিশাল একতলা বাড়ি, চারপাশে অনেক বড় বড় গাছ, লনের ঘাসগুলো না কাটতে কাটতে অনেক লম্বা হয়ে গেছে। চারপাশে অযত্নের ছাপ। জামিল রাহাতকে প্রায় না শোনার মত ফিসফিস করে বলল, “ওস্তাদ কিছুদিন আগে মেক্সিকো থেকে আসছে।”

“এর সাথে তোর পরিচয় কিভাবে হয়েছে?”

“ইন্টারনেটে চ্যাট করতে করতে পরিচয়।”

“ওরে বাবা। আমি এতদিন জানতাম ইন্টারনেটে চ্যাট করে প্রেমিক প্রেমিকা হওয়া যায় আর এখন দেখি ওস্তাদ আর সাগরেদও হয় হাহা হা”

“ফাইজলামি করিসনা।”

জামিল কলিংবেল টিপলো। ডিং ডং রাহাত হঠাৎ টের পেল অজানা আশঙ্কায় তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। যে ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন তাকে দেখে মুহুর্তেই সকল আশঙ্কা উবে গেল। চশমা পরা ভালোমানুষ টাইপ চেহারার একজন ৫০-৫৫ বছর বয়সের লোক। তিনি অভ্যর্থনা জানিয়ে তাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। রাহাত আর জামিল এত সুন্দর করে সাজানো ঘর খুব কমই দেখেছে। দুজনই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, এত দামী আসবাববপত্র দেখে নিজের অজান্তেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ভদ্রলোক সোফায় বসতে বসতে বললেন, “তোমাদেরকে তুমি করেই বলি।”

জামিল বললো, “‘অবশ্যই, আমরা আপনার ছেলের বয়সী। স্যার আমার বন্ধু আপনার সম্পর্কে জানতে চায়। ভুডুচর্চার ব্যাপারে তার খুব আগ্রহ।”

জামিলের বানানো কথা শুনে রাহাতের কান খাড়া হয়ে যায়। ভুডুচর্চা নিয়ে রাহাতের আগ্রহ এটা ভাবতেই তার হাসি পাচ্ছে। আপাতত তার আগ্রহ হলো এই ভাঁড় দুইটা কি করে সেটা দেখা।

ভদ্রলোক বলতে লাগলেন,”আমি যখন তোমাদের মত তখন পড়তে চলে যাই কানাডায়। সারাদিন ক্লাস আর সারারাত পড়াশোনা দিয়েই কাটাতাম। বাপের প্রচুর টাকা থাকার কারনে কখনও পেটের চিন্তা করতে হয়নি। একদিনপরিচয় হয় এক সাউথ আমেরিকানের সাথে ডেভিড রোজারিও। আমি খুব মেধাবী ছাত্র ছিলাম বলে অনেক পরিচিতি পেতাম। ডেভিডের সাথে পরিচয় পর্বটা খুব ইন্টারেস্টিংছিল। একদিন পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। ডেভিড আমার দিকে সুন্দর করে হেসে বললো, ‘আমি জানতাম তুমি এখন পড়ে যাবে, তোমার নিয়তিতে তাই লেখা ছিল, আমি ডেভিড তুমি?” হয়ত এখানেই তার পর্ব শেষ হয়ে যেত কিন্তু তা হয়নি। সে আমার জীবনে আজও ছায়ার মত আছে।”

এইটুকু বলে ভদ্রলোক রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললো, “ইয়াং ম্যান, ইউ ডোন্ট বিলিভ মি? হাহ্!”
রাহাত হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কি বলবে ভেবে পেলনা। সে বললো,”ডেভিড কোন দেশের ছিল?”

“পেরু”

“আচ্ছা। তারপর”

“তারপর ডিনার”

ডিনার শেষে রাহাত আর জামিল ড্রইং রুমে বসে আছে।রাহাত জামিলকে বললো,”দেখ, এত কথা শুনলাম অথচ বেটার নামটা জানিনা। বেটার নাম কি?”

“উনার নাম খালেকুজ্জামান।”

“এই বেটাতো একটা পাগল। শোন আমি পাগক ছাগলের সাথে থাকবোনা। খাওয়া শেষ এখন চলে যাব।”
লোকটা হঠাৎ রুমে ঢুকে বললো “এখনতো যাওয়া যাবেনা। আসল মজা বাকি রয়ে গেছে।”
রাহাত মুখটা সুবোধ বালকের মত করে বললো, ” আপনার কাহিনী এখনও শেষ হয়নি।”

“হ্যাঁ, ডেভিডের সাথে ঘুরাঘুরি করতে করতে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ও একটু অদ্ভুত ছিলো। আজব এক সংগ্রহশালা ছিলো তার মানুষের হাড় থেকে শুরু করে গাছের শিকড় সব ছিলো তার সংগ্রহে আমার থিসিস কমপ্লিট হবার পর ডেভিড আমাকে একদিন অফার দিলো খালেক তুমি হাইতি যাবে? আমি বললাম হাইতি গিয়ে কি হবে? সে

বললো,অন্যদের যা হয়না তা হবে।” তোমরা হয়ত বিশ্বাস করবেনা পরের মাসেই আমি তার পিছন পিছন হাইতি চলে গেলাম। ডেভিড গেল ভুডু শিখতে আর আমি গেলাম বেড়াতে”

জামিল বললো,”ওখানে গিয়ে কি করলেন?”

লোকটা হেসে বললো,”ওখানে গিয়ে আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা দেখলাম”

“সেটা কী?”

খালেকুজ্জামান রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললেন”রাহাত দেখতো বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কিনা?”
রাহাত উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলো বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।

সে ফিরে আসতেই লোকটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে বললো,”তুমি কি মনে কর প্রেতসাধক হতে হলে আলখাল্লা পরতে হয় আর চুলে জট পাকাতে হয়?”

কথাটা শুনে রাহাত থমকে গেল কারন শুরু থেকেই সে এই লোককে অবিশ্বাস করে আসছে কিন্তু মনে হয় এই লোকের সুক্ষ কোনঅজানা ক্ষমতা আছে মানুষের মন বোঝার।

রাহাত বললো, “এটা ২০০৮ সাল। আই ডোন্ট বিলিভ ইন ঘোস্ট।”

লোকটা রক্ত হিম করা হাসি দিয়ে বললো, “হা হা হা হা মি টু। তুমি ভাগ্যবান এবং বুদ্ধিমান।”
লোকটা আবারবলা শুরু করলো, “হাইতিতে আমি ছিলাম ১৮ বছর। এতদিনে দেশের সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে

ফেলেছি। আমি সেটাই চেয়েছিলাম। প্রথম তিন বছর ডেভিড ছিলো আমার সাথে তারপর আমি একা।”
“ডেভিড কি চলে গিয়েছিলো?”

“না মরে গিয়েছিলো। একদল জনতা তাকে জ্যান্ত আগুনে পোড়ায় আমার সামনে।”

শুনে জামিল আর রাহাত চমকে যায়। জামিল বলে, “কেন?”

“ডেভিড কি চলে গিয়েছিলো?”

“না মরে গিয়েছিলো। একদল জনতা তাকে জ্যান্ত আগুনে পোড়ায় আমার সামনে।”

শুনে জামিল আর রাহাত চমকে যায়। জামিল বলে, “কেন?”

লোকটা জামিলের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো যা দেখে হঠাৎ জামিলের বুক কঁপে উঠে। খালেকুজ্জামান উঠে ভিতরে চলে গেল। রাহাত জামিলকে বলল, “দোস্ত তুই আমারেভালো বিপদে ফেলছিস! তোরা নিজেরা নিজেরা জ্বীন ভূত প্রেত নামা। আমাকে এবার ছাড়।

“কীভাবে যাবি? বাইরে বৃষ্টি পড়ে। আসল মজাতো রাত ১২ টার পর।”

“এখন কয়টা বাজে?”

“মনে হয় পৌনে ১১ টা।”

রাহাত পকেট হাতড়ালো মোবাইলের জন্য। সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো যে সে আজকে মোবাইল আনতে ভুলে গেছে, এই ভুল সে কখনও করেনা। সে জামিলকে বলল,”জামিল মোবাইল আনছিস?

“নারেদোস্ত। ভুলে গেছি। রাস্তায় বের হয়ে মনে পড়ছিলো।”

এই ঘরেও কোন ঘড়ি নাই। রাহাতের মনে হঠাৎ খটকা লাগলো।তার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় যেন তাকে বারবার বলছে, “চলে যাও, চলে যাও।

লোকটা একটা মোটাসোটা বোতল নিয়ে ঘরে ঢুকলো। রাহাত মনে মনে ভাবলো “এই লোক কি মদ খায়?এ তো জামিলের ১২ টা বাজাবে!

লোকটা বোতলের তরলটুকু একটা ঝকঝকে গ্লাসে ঢেলে বলতে লাগলো, “এটা শ্যাম্পেন বা হুইস্কি না, এটা জীবনরস

লিকুইড অফ লাইফ। প্রের্ত্রাক নামক একপ্রকার গাছের শিকড়কে প্রসেস করে বানানো তরল। খেলে অনেকদিন নির্ঘুম কাটানো যায় সাধনায় সবচেয়ে বড় ব্যাঘাত ঘটায় ঘুম। চেখে দেখবে একটু?”

তারা দুজনই সজোরে মাথা নেড়ে না করলো। জামিলের অবশ্য আফসোস থেকে গেল সে একা থাকলে চেখে দেখত।
খালেকুজ্জামান আবার বলতে শুরু করলো” ডেভিড খুব হেঁয়ালী করে কথা বলত। আমার ছুটি শেষে আমি যখন কানাডায় ফেরত যাব তখন তাকে বললাম, “ডেভিড আমি এবার যেতে চাই। হাইতিতে দারিদ্র ছাড়া কিছু দেখলামনা তুমি কি থাকবে?”

সে বললো, “আমাকে আমার নিয়তিই এখানে টেনে এনেছে, ঠিক যেমন তোমাকে এনেছে তোমার নিয়তি”। এর কিছুদিন পর সে আমাকে একটা গ্রামে নিয়ে গেল যেখানে কিছু ভুডুচর্চাকারী থাকতো। তারা জীবনযাপন করত স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু কেউ যদি জানত তারা প্রেতসাধকতাহলে পুড়িয়ে মেরে ফেলত। আমি প্রথমে ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিয়ে তার সাথে সেখানে গেলাম। ডেভিড আমাকে নিয়ে গেল এক ডাইনীর কাছে তার নাম ছিলো আইডা। আমার দেখা পৃথিবীর কুৎসিততম মানবী। সেই যে গেলাম তার কাছে আর ফেরা হলোনা। তার কাছেই ১৮ বছর ছিলাম।”

রাহাত হঠাৎ কথার মাঝখানে বললো” এসবতো এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হাইতিতে এখন যাদেরকে ভুডুচর্চাকারী হিসেবে দেখা হয় তারাতো আসলে আমাদের দেশের কবিরাজের মত।”

লোকটা বাঁধা পেয়ে বিরক্ত হলো। সে বললো” তুমি কি সব জান? যারা সত্যিকারের ডাইনী তারা কখনও সেটাপ্রকাশ করেনা।”

বাইরে হঠাৎ কুকুরের ডাক শোনা গেল। লোকটা ফিসফিসিয়ে রাহাতের দিকে ঝুঁকে বললো” আমাকে দেখলে মনে হয় আমি প্রেতসাধক? হা হা হা”

গা হিম করা হাসি শুনে রাহাত আর জামিল ভয় পেয়ে যায়।

খালেকুজ্জামান আবার বলতে লাগলো” আমি যতবারই ফিরে যেতে চাইতাম ততবারই কোন এক যাদু আমাকে আরও শক্ত করে আটকে রাখতো। আইডা আমাকে প্রথম প্রথম কিছু মন্ত্র শিখালো। তারপর শিখালো কুকুর, বিড়াল, সদ্য মৃত মানুষের রক্ত কিভাবে পান করতে হয়।”

রাহাতের গা গুলিয়ে উঠে। তবুও সে ধৈর্য্য সহকারে শুনতে লাগলো।

লোকটা বলতেথাকল “কিভাবে জীবনরস বানানো হয় সেটাও শিখলাম আমি। তবে তখনও কোন মৃত মানুষের দেখা পাইনি। এরপর একদিনআইডা আমাকে ডেকে নিয়ে বলল” আমার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। তোমার হাতটা আমার হাতে রাখ”। আমি হাত রাখলাম আমার সারা শরীর হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে উপরে উঠে গেল আমার চারপাশ ঘুরতে লাগল চারপাশে কালো ধোঁয়া আরকিসব অশরীরী নাচতে লাগলো আর চাপা হাসির শব্দ এরপর সব অন্ধকার।”
রাহাত আর জামিলের নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা।

লোকটা কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে বললো”এখন ১২টা বাজে তোমরা প্রস্তুত?

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত