নূপুর

নূপুর

নূপুরের ছমছম আওয়াজে প্রতিদিনের মতো আজকেও ঘুম ভেঙে গেলো তুরের।রোজ মধ্য রাতে এই একি সময়ে আওয়াজ টা শুনতে পায় তুর।কিন্তু তেমন গা লাগায় না।ভাবে হয়তো কেউ ভয় দেখানোর জন্য এমন করে কিন্তু তাই বলে প্রতিদিন এমন করে বিরক্ত করবে। তাই আজ তুর বিছানা ছেড়ে বাইরে এলো দেখার জন্য কে এমন করছে।আষাঢ়মাস শুরু কিন্তু বৃষ্টির নাম গন্ধ নেই খাঁ খাঁ রোদ আর গাঁ তাতানো গরম। আকাশ একদম চকচকে তারাই ভরা।এক ফালি চাঁদ উকি দিয়েছে। অন্ধকার তেমন নেই।বাইরে বেরিয়ে মেইন গেট খুলে তুর তুরের জানালার পাশে এলো। কারণ আওয়াজ টা জানালার পাশেই শোনা যায় রোজ।হাতে কোনো আলো না নিয়েই বের হয়েছে তুর।কারণ বাইরে সব কিছু দেখা যাচ্ছে।জানালার পাশে এসে এদিকওদিক ঘুরে ফিরে দেখলো তুর।কিছুই নেই।মনে মনে এক রাশি বিরক্তি নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল তুর তখনি আমার ছমছম আওয়াজ শুনতে পেলো পিছনে। একটু ভয় ভয় চোখে পিছে তাকালো তুর।কেউ একজন জানালার পাশ থেকে ছুটে চলে গেলো বাড়ির পিছে পুকুরের দিকে।ছুটে যেতে গিয়েও কি জানি মনে হয়ে সেদিকে না গিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলো তুর।

তুর বড় লোক মা বাবার এক মাত্র সন্তান। গ্রামের মধ্যে নাম করা বড় লোক তুরের বাপ দাদা।দেখতেও একদম রাজপুত্রের মতো এক নজরে যে কোনো মেয়ে প্রেমে পরে যাবে।এমনি কি ছেলেরাও অনেক সময় হা করে তাকিয়ে থাকে তুরের দিকে।যেমন লম্বা তেমন ফর্সা গায়ের রঙ।সব দিকের ভালো শুধু চরিত্র একটু খারাপ ছিল।বাজে নেশা না করলেও মেয়েদের নেশা বেশি ছিল তুরের। তবে সব মেয়েদের ঘায়েল করে না তুর।যেসব মেয়েরা ছেলেদের দেখে দশ হাত দূরে সরে যায় প্রেম থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চায় তুর সেইসব মেয়েদের নিজের রুপের জালে ফাঁসিয়ে ভালো মানুষী ব্যবহার দেখিয়ে ২ দিন বন্ধু তার পর বন্ধু থেকে আরেকটু এগিয়ে প্রেমে ফাঁসিয়ে কিছুদিন মজা করে ছুড়ে ফেলে দেয়।এমন করে অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে তুর।

সেদিন ছিল ঈদের দিন। ঈদের দিন বিকেলবেলা ঝুম আর ওর ৪ জন চাচাতো বোন বিকেলে বের হয়েছিল ভাটা পার্ককে পানি দেখতে যাবার জন্য।বর্ষার সময় পার্কের দুই পাশে পানি জমে সেই পানি রাস্তার উপর চলে আসে আর ভেসে আসে পানির সাথে অনেক শাপলা ফুল।সেটা দেখার জন্য বিকেল হলেই ভির জমায় অনেক ছেলে মেয়ে।ঝুম আর ওর চাচাতো ৪ বোন স্যান্ডেল হাতে নিয়ে খালি পায়ে রাস্তার উপর পানিতে পা ভিজাচ্ছিল আর এক পার থেকে আরেক পারে হেটে যাচ্ছিল।তুর আর তুরের বন্ধু বাইক নিয়ে সেখানে ঘুরতে যায়।আরো অনেক ছেলে মেয়ে জোড়ায় জোড়ায় ঘুরছিল।তুরের চোখ আটকে যায় সামনে রাস্তার উপর হেটে চলা ৫ জন মেয়ের দিকে।সবার মুখ না দেখা গেলেও পেছন থেকে অনেক সুন্দর লাগছিল ৫ জন এক সাথে হাত ধরে হাটছিল।সবার সালোয়ার সামান্য পা থেকে

উঁচু করা ছিল যাতে ভিজে না যায়।মাঝখানে ছিল ঝুম।অন্য চার জনের পায়ে নূপুর বা পায়েল ছিল না। কিন্তু ঝুমের পায়ে মোটা চওড়া নূপুর ছিল।যেটা হাটার তালে তালে ছমছম আওয়াজ করছিল।একেই পানির আওয়াজ তার উপর নূপুরের আওয়াজ আশেপাশের অনেকেই তাকিয়ে দেখছিল এই ৫ কন্যা কে।তুর নিজের ফোন বের করে একটা ছবি তুলে নিলো ৫ জনের পিছন থেকে। মেয়ে গুলা এক মনে হেটে সামনের উঁচুতে উঠে রিক্সা করে চলে যাচ্ছিল।তুর একবার খেয়াল করে দেখলো যে মেয়ের (ঝুমের) পায়ে নূপুর ছিল তার এক পায়ে নূপুর আছে আরেক পায়ে নেই।কি মনে হয়ে বাইক থেকে নেমে মেয়ে গুলা যে দিক দিয়ে হেটে গিয়েছিল তুর সেই দিক দিয়ে হাটতে লাগলো কিছু দূর যাবার পর দেখতে পেলো পানির মধ্যে রাস্তার উপর পরে আছে নূপুর।আশেপাশে তাকিয়ে নূপুর টা তুলে নিয়ে পকেটে রেখে বাইক নিয়ে সেই রিক্সা কে ফলো করতে লাগলো। রিক্সার নাগাল পেয়ে তুর খেয়াল করে দেখলো পিছে বসা সেই মেয়ে যার নূপুর হারিয়ে গেছে।তুরের নেক্সট টার্গেট হলো ঝুম।বাইক থেকে ঝুম কে উদ্দেশ্য করে তুর বললো

তুর ; এই যে মিস নূপুরালী আপনার আরেক পায়ের নূপুর কই।

তুরের কথা পায়ের দিকে তাকিয়ে হা হয়ে চিৎকার করে উঠল ঝুম।তুর মুচকি হেসে বাইক ছুটিয়ে চলে গেলো। রিক্সা ঘুরিয়ে সেই পানির মধ্যে এসে অনেকখুঁজেও না পেয়ে নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলো সবাই।সেদিনের পর থেকে রাস্তাঘাট গাড়ি যেখানেই দেখা হয় সেখানেই তুর ঝুমকে বলে নূপুর পেয়েছেন। এমন পিছন ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ঝুম আর তুরের বন্ধুত্ব হয়ে যায়।কিন্তু তুর ঝুমকে এখনো বলেনি সেই নূপুরের কথা।ঝুম সব সময় চাইতো সে যাকে ভালবাসবে বিয়ে করবে সে যেন নামাযী ছেলে হয়।ভদ্র হয় কম কথা বলে।এসব কথা ঝুমের থেকে জানার পর মিথ্যা মিথ্যা অভিনয় শুরু করে দিলো তুর।এভাবেই ঝুমের মন জয় করে তুর।বন্ধুত্ব থেকে প্রেম অব্দি গড়িয়ে গেলো রিলেশন। সেদিন ছিল তুরের জন্ম দিন।তুর ঝুমকে invite করে নিজের বাড়িতে।বাড়িতে ছোট খাটো একটা পার্টি দেয় তুর।কিছু কাছের বন্ধুদের দাওয়াত করে।ঝুম প্রথমে আসতে রাজি ছিল না কারণ পার্টি ছিল রাতে।তুরের অনেক জুরাজুরিতে মন রক্ষাতে রাজি হয় ঝুম। সন্ধ্যা সাতটায় পৌছে গেলো তুরের বাড়ি। বাইরে থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই।মনেই হচ্ছে না বাড়িতে পার্টি আছে।

কলিংবেল চাপলো ঝুম।তিন বার চাপার পর দরজা খুলে দিলো তুর।ঝুম কে অসাধারণ সুন্দর লাগছে জামদানী লাল শাড়ি হাতে লাল রেশমি চুড়ি খোলা চুলে যেন মনে হচ্ছিল লাল পরী।

ঝুম ; কি হলো কি দেখছো এইভাবে হ্যা।

তুর ; ওয়াও আমি মানুষ দেখছি নাকি পরী। আসো আসো ভিতরে আসো।

ঝুম ভিতরে ঢুকে একটু অবাক হলো।আশেপাশে কেউ নেই। পার্টির কোনো চিহ্ন নেই।

ঝুম ;আর কেউ নেই।সবাই কোথায়।

ঝুমের কথায় হো হো করে হেসে উঠল তুর।

তুর ; সরি ঝুম।আসলে আজকে আমার জন্মদিন না।আমি মিথ্যা বলেছিলাম তোমায়। আসলে বাড়িতে কেউ নেই মা বাবা নানার বাড়ি গেছে তাই ভাবলাম তোমায় আসতে বলি।কিন্তু তুমি তো এমনিতে আসতে না।তাই এই মিথ্যা বলা সরি বাবু।

ঝুম ; ছি তুর ছি।তুমি একবার আমার কথা ভাবলে না একা বাড়িতে আমি আর তুমি থাকলে কেউ জানলে কি বলবে।আমি এখনি চলে যাবো এখনি,,,

বলেই ঝুম চলে যাচ্ছিলো। তখনি পিছন থেকে ছমছম আওয়াজ হচ্ছিল।ঝুম পিছে ফিরে দেখে তার সেই একটা নূপুর তুরের হাতে।সেটাই তুর নাড়িয়ে আওয়াজ করছে।

ঝুম ; এই নূপুর তুমি কই পাইলে।

তুর ; এটা সেদিন আমি পার্কে পেয়েছিলাম তোমায় সারপ্রাইজ দিবো বলে এখানে ডেকেছি এই ভাবে আর তুমি আমায় ভুল বুঝলে।

ঝুম ; কিন্তু,,

তুর ; কোনো কিন্তু না আমি নিজে হাতে পরিয়ে দিতে চায় নূপুর তোমার পায়ে।

তুর নূপুর নিয়ে ঝুমের পায়ে পরিয়ে দিয়ে দাড়ালো।ঝুমের দুগালে হাত দিয়ে কপালে আলতো করে ছুঁয়ে দিলো নিজের ঠোট। ঝুম কিছুটা অসস্থি বোধ করে নিজেকে সরিয়ে নিলো তুরের থেকে।তুরের থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসতে চাইলো। কিন্তু পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ঝুমকে তুর।কোনো খারাপ কিছুর আভাস পাচ্ছিলো ঝুম তাই জোর করেই বেরিয়ে আসছিল। তখনি তুর ঢাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয় ঝুম কে।
তুর এমন আচরণ দেখে ভয় পেয়ে যায় ঝুম।

তুর ; আরে কোথায় যাবি।যেতে দিবার জন্য কি তোকে এতো দিন মিথ্যা ভালবাসায় পটিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে আজ এখানে এতো দূর অব্দি এনেছি।এত সময় অন্য মেয়েদের দেইনি যতো সময় তোর পিছে দিয়েছি আজ সময় আর খেল খতম।

ঝুম অনেক অনুরোধ করলো অকে ছেড়ে দিবার জন্য কিন্তু কোনো লাভ হলো না।তুর আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে লাগলো ঝুমের দিকে।নিজেকে বাঁচাতে ঝুম উঠে দাড়ালো।হাতের কাছে কিছু না পেয়ে দেওয়াল থেকে একটা ওয়ালমেট খুলে তুরের দিকে ছুড়ে মারলো।

সেটা গিয়ে তুরের কপালে লাগলো। তুর রেগে গেলো। রাগটা এতো বেশি হয়ে গেলো যে পাশে থাকা ট্রি টেবিল তুলে ঝুমের মাথার উপর মারলো।নিস্তেজ হয়ে নিচে পরে গেলো ঝুম।মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে ফিকনি দিয়ে। নিজেকে বাঁচাতে তুর ঝুমের লাশ বাড়ির পিছে পুকুরের পাশে মাটিতে পুতে ফেললো।সেদিনের পর থেকে মাঝ রাতে শুনতে পায় নূপুরের আওয়াজ। কিন্তু সেটা তুর বুঝতে পারে না।

আজ রাতে আবারো মাঝরাতে নূপুরের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো তুরের। আজকেও তুর বাইরে বেরিয়ে জানালার কাছে গেলো। মনে হলো কেউ দৌড়ে পুকুরপাড়ে গেলো। তুর ও সেই দিকে গেলো,,
পরেরদিন সকালে গ্রামের লোকজন পুকুর থেকে তুরের মরা দেহ উদ্ধার করে।

……………………………………………………………..সমাপ্ত………………………………………………………

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত