‘আমার দিকে তাকাবে না, চলে যাও তুমি, চলে যাও,’ সজোরে চিৎকার করে চলেছে ইতি। ‘মা, ও মা আমাকে বাঁচাও। ও আমাকে নিয়ে যেতে চায়।’
কিছুতেই থামছে না ইতির চিৎকার। সারা ঘরময় প্রতিধ্বনিত হয়ে সে চিৎকার আরো ভয়ংকর শোনাচ্ছে। চেঁচামেচি শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন ইতির মা মিসেস সাবেরা বেগম। এসে দেখলেন তার মেয়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় হাত পা ছুড়ছে আর তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। হাত কেটে রক্ত চুইয়ে পড়ছে, এদিকে ইতির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি ইতির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে মা তোর? ভয় পেয়েছিস?’
-আয়না! মা ওই দেখো আয়না। ওই…ওই মেয়েটা আমাকে নিয়ে যাবে।
মিসেস সাবেরা এদিক ওদিক তাকিয়ে তার ছেলের ঘরের পাশে বড় একটা ড্রেসিং টেবিল দেখতে পেলেন। এদিকে ইতির চিৎকার বেড়েছে। তিনি দ্রুত একটা কাপড় দিয়ে ড্রেসিংটেবিলের আয়নাটা ঢেকে দিলেন।
-ইতি মা আমার, দেখো আয়না ঢেকে দিয়েছি। আর কিছুই আসবে না। শান্ত হ।
-মা, ওটা আমাকে বাঁচতে দেবে না। আমাকে মরতে হবে।
-এসব বলিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। কেউ মারবে না তোকে।
কথাগুলো বলতে বলতে হাতের কাটা জায়গা পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছেন তিনি নীরবে চোখের জল ফেলছেন। ইতির মা জানেন যে এটা ঠিক হওয়ার না কারণ গত পাঁচ বছর ধরে তো কত চেষ্টা করা হলো। কত ডাক্তার, কবিরাজ,ওঝা কিছুতেই কাজ হয়নি। তবুও এসব বলে মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা। এটা বলার পরে ইতি কিছুটা শান্ত হলো। সে এখন স্থির হয়ে বসে কি যেন বলছে আস্তে আস্তে। কি যে বিড় বিড় করে তা বোঝার উপায় নেই। ইতিকে সবসময় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। আগে ওকে ঘরেই বেঁধে রাখা হতো কিন্তু এখন রান্নাঘরের পাশে বেঁধে রাখা হয় যেন ওর মা মেয়ের দিকেও খেয়াল রাখতে পারেন। ওকে খোলা রাখলেই নিজের মনে হাটতে হাটতে বাইরে চলে যায়, দেখলে মনে হয় কোন কিছু যেন সম্মোহিত করে রেখেছে।
আবার মাঝেমাঝে চিৎকার করতে করতে হাতের কাছে যা পায় তাই ছুড়তে থাকতো অদৃশ্য কোন কিছুর দিকে। একবার তো রাতে ঘুমের মাঝে উঠে ছাদে রওনা দিতো, ভাগ্যিস ওর বড় ভাই ছাদে বসে ছিলো। না হলে ওই দিনই ছাদ থেকে পড়ে মরতো মেয়েটা। তাই এই পাঁচ বছর যাবত ও এই বন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। যখন দরকার হয় ওর মা বাঁধন খুলে দেয় আর সঙ্গে থাকেন। মা আছেন বলেই রক্ষে। সবাই ভাবে ইতি মানসিক ভাবে অসুস্থ। সত্যি কি তাই? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোন অজানা রহস্য?
ইতি বাড়ির কাউকে কাউকে চিনতে পারে না ওর মাকে ছাড়া। বাবাকে দেখলে তো গর্জে ওঠে। চোখের চাওনি হিংস্র রূপ ধারণ করে। প্রবল আক্রোশে বিকৃত হয়ে আসে মুখ। যা ইচ্ছে তাই বলে গালি দেওয়া শুরু করে। তাই পারতপক্ষে ওর বাবা তানজীম আহসান ওর সামনে আসেন না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার কোন এক অদ্ভুত কারণে আয়না দেখলেই ভয় পাওয়া শুরু করে ইতি। এই আয়না থেকেই সব কিছুর শুরু। আয়না দেখলেই চিৎকার করতে থাকে। ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে ওঠে মুখ। আর বলতে থাকে-ও আসছে। ওই মেয়েটা আমাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু কে যে এই অদৃশ্য ‘ও’ সেটা হাজার চেষ্টাতেও জানা যায়নি। এই আয়না ভীতি হঠাৎ করে আসেনি। এর পেছনেও রয়েছে পাঁচ বছরের পুরনো ইতিহাস। তখন থেকেই ইতি সারাক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করে, আর স্বাভাবিক নেই সে, চেঁচামিচি না করলে সারাক্ষণ নিজের মনে কথা বলতে থাকে মেঝের দিকে তাকিয়ে।
একবারও মুখ তুলে চায় না। সবসময় পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বসে থাকে। আয়নাতে ভয় থাকার কারণে ইতির ঘরে ইতির আশেপাশে কোন আয়না রাখা হয়না। বাড়ির সব আয়না সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আজকে ইতি আয়না দেখেই এরকম চেঁচামেচি শুরু করেছে। আজকে এমন ঘটনা ঘটলো ড্রেসিংটেবিল এর জন্য, ওটা ওর বড় ভাইয়ের ঘরে রাখার জন্য আনা হয়েছে। নতুন বিয়ে করেছে সে, তাই ড্রেসিং টেবিল লাগবেই। যে গাড়িতে করে ওটা আনা হয়েছে সেই গাড়ির লোক সেটাকে ঘরে না ঢুকিয়ে ঘরের দরজার পাশে রেখেই চলে গেছে। সেটার আয়নার দিকে ইতির চোখ পড়তেই এতো সব কান্ড ঘটলো।
কেন, কিভাবে এই আয়না ভীতি তৈরি হলো তা জানতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে পাঁচ বছর পেছনে। সেখানেই আপনারা জানতে পারবেন কিছু অজানা কথা। হয়ত বিশ্বাস হবে না কিছুই। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোটানার মধ্যে পড়তে হবে আপনাদেরকে। কিন্তু অলৌকিক কিছু হয়ত সতিই আছ। মরে গেলেও হয়ত অতৃপ্ত বাসনার মৃত্যু হয় না। আসুন জেনে আসি সেই অবিদিত রহস্য। ঘুরে দেখে আসি সেই অতীত জগত। ডুবে যাই কুহেলির মায়াজালে।
পাঁচ বছর পূর্বেঃ ইতি বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে। সবার চোখের মণি। বড্ড ভালোবাসতো ওকে সবাই। ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে পড়তো তখন। লেখাপড়ায় খুব ভালো। ছোটবেলা থেকে ইতি খুব ডানপিটে স্বভাবের। ওর দুরন্তপনায় মাঝেমধ্যে ওর ভাই বিরক্ত হতো,তবে সেও ইতিকে কম ভালোবাসতো না। ইতির অভ্যাস ছিলো খুব কথা বলতো, কথা বলেই যে কারো মন ভালো করে দিতে ওর জুড়ি মেলা ভার। সাজগোজ করতেও ভীষণ পছন্দ করতো, অবসর পেলেই সময় কাটতো আয়নার সামনে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো, নিজেকে দেখতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, যেন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের সাথে নিজেই একাত্ম হয়ে যেতো। বিভিন্ন ডিজাইন এর ছোট ছোট আয়না সংগ্রহেও ছিলো ভীষণ ঝোক।
আয়না রাখার জন্য আলাদা একটা টেবিলও ছিলো, সেখানে স্থান পেয়েছিলো দেশি-বিদেশি নানান রকম আয়না। ওর বাবা একবার একটা ছোট্ট আয়না এনে দেয় চীন দেশ থেকে যার বাইরেটা পাথরে তৈরি এবং ভেতরে বসানো ছোট্ট আয়না যা দিয়ে পুরো মুখ দেখা যায় না, সেটা সবসময় থাকতো ওর পার্সের ভেতর। খুব খুশি হয়েছিলো বাবার উপর অথচ বর্তমানে এই বাবাই ইতির চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতির আরেকটি শখ হলো অ্যান্টিক(Antic) বা পুরনো জিনিস সংগ্রহ করা। এসবের মধ্যে আয়না অবশ্যই অগ্রাধিকার পায়। ইতি এবং ওর কলেজের পাঁচ বান্ধবী (মিলু, পলি, জিনিয়া, রোজ, আদ্রি) মিলে তাই ঢাকা শহরের অলি গলিতে খুঁজে বেড়ায় অ্যান্টিকের দোকান। ছয়জন ছয়জনের প্রাণের বান্ধবী। চরিত্রগত দিক থেকেও মিল রয়েছে। সবার দুঃখ কষ্টের কথা শেয়ার করে একে অপরের কাছে। তবে ইতি ওদের দলের প্রাণ। ছয়জনই অ্যান্টিক বলতে পাগল। তাই অ্যান্টিকের দোকানের সন্ধান পাওয়া মাত্রই হানা দেয় সেখানে আর কিছু না কিছু কিনে তবেই বাড়ি ফেরে। এভাবেই হাসি,আনন্দে দিন কাটতো ইতির দিনগুলি কিন্তু এখন ওর পুরো জীবনটাই যেন বিভীষিকা।
একদিন সকালেঃ
-মা আমি কলেজে যাচ্ছি।(ইতি)
-তাড়াতাড়ি ফিরবি কিন্তু। আজ আবার অ্যান্টিকের দোকান খুঁজতে নেমে পড়িস না।(মিসেস সাবেরা)
-উফ! মা তুমিও না। সবসময় চিন্তা আর চিন্তা।
-চিন্তা কি আর সাধে করি? তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি আসবি এটাই শেষ কথা।
-মা! -কি রে কিছু বলবি?
-আজ না মিলু ফোন করেছিলো। ও একটা অ্যান্টিকের দোকানের খোঁজ পেয়েছে। ওখানে ভীষণ সুন্দর আর পুরনো সব আয়না পাওয়া যায়। আজ কলেজ শেষে যাবো মা?
-না, কোথাও যাওয়া চলবে না।
-প্লিজ, আমার লক্ষী মা, তুমি নিষেধ করো না।
-আচ্ছা এসব পুরনো আয়না দিয়ে কি হবে শুনি? তোর ঘর ভর্তি কত আয়না আছে।
-পুরনো জিনিসের কত্ত রকম ইতিহাস থাকে। কত হাত বদল হয়ে ওগুলো আসে, পুরনো জিনিসের যে ডিজাইন নতুন জিনিসে তা পাওয়া যায় না। এটা আমার নেশা, তুমি এটা বুঝবে না। আর তুমি তো জানো যে আমার একটা বড় আয়না কেনার শখ আছে যেটা দেওয়াল জুড়ে থাকবে আর আমি ওটার সামনে দাঁড়ালেই নিজেকে পুরোপুরি দেখতে পাবো।
মেয়ের কথা শুনে হাসলেন মিসেস সাবেরা বেগম। তিনি মেয়ের কথায় না বলতে পারেন না কখনো। প্রথমে একটু জোরাজুরি করলেও মেয়ের দেখানো যুক্তির সামনে হার মানতে হয় তাকে।
-তুই একদম তোর বাবার মতো হয়েছিস। তোর বাবারও একসময় এসব জিনিসের প্রতি আগ্রহ ছিলো।
-তাই নাকি মা? বাবা তো আগে কখনো বলেনি।
-তোর ভাই যখন খুব ছোট তখন প্রায়ই তোর বাবা পুরনো আসবাবপত্র কিনে আনতেন।
-তাহলে সেসব গেলো কোথায়?এখন তো দেখি সবই নতুন।
-তোর বাবা সব কিছু বিক্রি করে দিয়ে নতুন করে সব তৈরি করিয়েছেন। তার নাকি পুরনো জিনিসের প্রতি আগ্রহ কমে গিয়েছিলো।
-কেন? তুমি বাবাকে জিজ্ঞেস করোনি?
-না। তুই এখন যে রুমে থাকিস একসময় ওখানেই ছিলো তোর দাদুর আমলের একটা দেওয়াল আয়না। ঠিক তুই যেমন চাস। রাজকীয় আয়না বলতে যা বোঝায় ওটাও ছিলো তাই। তোর বাবাকে অনেক বলেছিলাম ওটি যেন বিক্রি না করে, কিন্তু তোর বাবা রাখেননি।
-ইস্! আয়নাটা যদি থাকতো তাহলে আমার আর অ্যান্টিকের দোকানে যেতে হতো না।
-এই তো পেয়ে গেলি একটা অজুহাত। (হাসতে হাসতে)
-তাহলে আমি যাবো মা?
-যাস, কিন্তু বেশি দেরি করবি না।
-ঠিক আছে মা। তুমি খুব ভালো।
-এই নে টাকাটা রাখ। যা পছন্দ হবে কিনিস।
এই হলো ইতির মা। মেয়ের কোন আবদার অপূর্ণ রাখেন না।
-মা আসি।
-সাবধানে যাস। মেয়ে চলে যেতেই মিসেস সাবেরার মনের মধ্যে কেমন কু ডাকতে শুরু করলো। এর আগে এরকম কখনো হয়নি তো। তবে আজ কেন? তবে কি খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে? মন থেকে এসব চিন্তা সরিয়ে দিতে চাইলেও পারছেন না তিনি। তবুও নিজের কাজে মন দিলেন।
-কিরে ইতি তোর আসতে এতো দেরি হলো যে? (পলি)
-নিশ্চয় আন্টির সাথে কথা বলতে বলতে দেরি করে ফেলেছিস? (মিলু)
-হুম। মা তো রোজ বের হওয়ার সময় একবার করে বলে যে অ্যান্টিকের দোকানে যেন না যাই। আজও তাই। (ইতি)
-তাহলে আজ যাচ্ছিস না আমাদের সাথে? (আদ্রি)
আসলে ইতি না থাকলে ওদের মজাটাই নষ্ট হয়ে যায়। ইতি আছে বলেই এতো প্রাণচঞ্চল থাকতে পারে ওরা।
-যাবো তো। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা যাবে না রে, মা এই শর্তেই যেতে অনুমতি দিয়েছে।(ইতি)
-হুম, আন্টি তোর কথা শুনবে না এটা আবার হয় নাকি! আজ পর্যন্ত কোন কিছুতেই তো তোকে বারণ করেননি।(রোজ)
-একদম ঠিক বলেছিস রোজ।(জিনিয়া)
-চিন্তা করিস না ইতি। দোকানটা আমাদের কলেজ থেকে বেশি দূরে নয়। আর দোকান থেকে তোদের বাসায় যেতেও খুব বেশি সময় লাগবে না।(মিলু)
-সে যাই হোক। আমি মাকে ম্যানেজ করে নেবো একটু দেরি হলে। (ইতি)
-তোরা সবাই বাসায় বলে এসেছিস তো ফিরতে দেরি হবে? (ইতি)
-হ্যা,সবাই জানিয়েই এসেছি।(রোজ)
-আমার তো তর সইছে না। আজ আমি অনেক কিছু কিনবো।(জিনিয়া)
-তুই কবেই বা কম কিনিস শুনি? খাওয়াদাওয়াও বেশি করিস জিনিসপত্র বেশি কিনিস। (পলি)
সবাই সমস্বরে হেসে উঠলো।
-ইতি তুই কি কিনবি?(আদ্রি)
-আয়না কিনবো।(ইতি)
-আবারো আয়না? তুই তো প্রত্যেকবার একটা করে আয়না কিনিস। আয়না দিয়ে কি পুরো ঘরটাই ভরিয়ে ফেলবি নাকি?(আদ্রি)
-আরে একটা দেওয়াল আয়না কিনবো,বহু দিনের শখ। (ইতি)
-হ্যা, এটাই বাকি ছিলো আরকি। পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন নিজেকেই দেখতে থাকবি এবার।(জিনিয়া)
-আমি মোটেও পড়াশোনা বাদ দিয়ে আয়না দেখি না।(ইতি)
-দেখিস তোর এই আয়না প্রীতি যেন কাল হয়ে না দাঁড়ায়। কবে যে আয়না থেকে ভূতুড়ে আয়না হয়ে যাবে কে বলতে পারে। (জিনিয়া)
বলেই হাসতে শুরু করলো জিনিয়া। ওর দেখাদেখি মিলু আর পলিও হাসা শুরু করলো। কিন্তু ইতির কাছে এই রসিকতাটা মোটেও ভাল লাগলো না। ও গোমড়া মুখে বসে থাকলো।
-এই তোরা যে কি! শুধু অবাস্তব কথা বার্তা।(রোজ)
-কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে তোদের?(আদ্রি)
-আচ্ছা অনেক হয়েছে হাসা হাসি। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে ক্লাসে চল সব। না হলে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। (ইতি)
-হ্যা চল। (মিলু)
সবাই ক্লাসে ঢুকে যে যার জায়গায় বসে পড়লো। এক মিনিট পরেই বাংলার অধ্যাপক ক্লাসে ঢুকলেন। আর একমিনিট দেরি হলেই ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো ওদের। বিকাল তিনটায় ক্লাস শেষ হলো। সকালের দিকে ঝলমলে রোদ থাকলেও এখন রোদের চিহ্ন টুকু নেই। আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা।
-এই বৃষ্টি নামতে পারে যাবি তোরা দোকানে?(ইতি)
-হ্যা, বেশিক্ষণ লাগবে না।(আদ্রি)
-আচ্ছা, চল অটোতে করে যাই। মিলু জায়গা চিনিয়ে দিতে পারবে সমস্যা হলে।(রোজ)
-আমি আগে যাইনি দোস্ত। ভাইয়া খোঁজ দিয়েছে।(মিলু)
-সমস্যা নাই, অটোওয়ালাকে ঠিকানা বললেই চিনবে।(জিনিয়া)
-হুম। (ইতি)
সবাই অটো নিয়ে অ্যান্টিকের দোকানের দিকে রওনা দিলো। আধাঘণ্টা পরে অটো এসে থামলো একটা সরু গলির সামনে। ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো সব। গলির শেষ মাথায় একটা একতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। গলি ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। জায়গা নির্জল। রাস্তায়ও মানুষজন বেশি দেখেনি। এদিকে আগে কখনো আসাও হয়নি কারো। ঢাকা শহরেও যে এতো নির্জল জায়গা থাকতে পারে তা কল্পনাও করেনি ওরা।
-এই মিলু, তুই ঠিক জানিস তো এটাই সেই দোকান?(আদ্রি)
-হ্যা রে, এটাই। ভাইয়া তো এই ঠিকানাই বলেছে। (মিলু)
-দেখে তো মনে হচ্ছে এখানে কেউ থাকে না।(পলি)
-আর বাড়িটাও ভাঙাচোড়া দেখেছিস?(রোজ)
-তাই তো দেখছি। মনে হয় দোকানের অ্যান্টিক জিনিস গুলোর মতো বাড়িটাও অ্যান্টিক। এটাও বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা। হি হি হি…. (জিনিয়া)
-উফ!জিনিয়া তুই আবার ফাজলামি শুরু করলি?(ইতি)
-ভয় পেয়ে গেলি নাকি?(জিনিয়া)
-আমার কিন্তু কেমন গা ছমছম করছে। আমরা তো এর আগেও বহু অ্যান্টিকের দোকানে গেছি এরকম তো দেখিনি। চল ফিরে যাই।(আদ্রি)
-মিলু তোর ভাইয়া এই দোকানের খবর কিভাবে জেনেছে রে? (রোজ)
-আমি কি এতসব জানি নাকি? ভাইয়াকে বলেছিলাম খোঁজ দিতে, খোঁজ দিয়েছে, আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।(মিলু)
-ঢুকেই দেখি না। তোরা এতো ভয় পাস কেন?(পলি)
-হুম, চল ভেতরে যাই। ভেতরে কেউ না কেউ তো আছে অবশ্যই।(ইতি)
-ঠিকই তো। এতদূর এসে ফিরে যাবোই বা কেন? আমরা ছয়জন একসাথে থাকতে কিসের ভয়।(পলি)
দোকানের দরজা খোলাই আছে। একে একে ভেতরে ঢুকে পড়লো ছয়জন। ভিতরে আলো আধারের খেলা। একটা অল্প আলোর ঝাড়বাতি ঝুলছে ছাদ থেকে। ওটা যেন অন্ধকার বাড়িয়ে দিচ্ছে আরো। ভেতরে ঢুকে কাউকেই দেখতে পেলো না কেউ। হঠাৎ করেই প্রবল বেগে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো বাইরে।
এখনই বৃষ্টি শুরু হওয়ার ছিলো?(আদ্রি) ইতি মুখে একরাশ বিরক্তির রেখা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-যে বৃষ্টি এখন তো বেরও হতে পারবো না। কেন যে এলাম।(রোজ)
-কেউ কি আছেন?(ইতি) বেশ জোরে চিৎকার করে ডাকলো সে। নাহ কোন সাড়াশব্দ নেই।
-ওই দেখ(একটা ছোট্ট দরজার দিকে নির্দেশ করলো জিনিয়া)
-আরে একটা দরজা! আমার মনে হয় দোকানের মালিক ওই রুমেই আছে। (মিলু)
-এভাবে দোকান খোলা রেখেই ভেতরে চলে গেছে! জিনিসপত্র তো চুরিও হতে পারে।(রোজ)
-আমার মনে হয় ভেতরে ঢুকে ঘুমাচ্ছে।(জিনিয়া)
-ভেতরে ঢুকে দেখবি?(ইতি)
-ধুর, এটা ঠিক হবে না।(আদ্রি) ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে থাকলো কি করা যায়। এদিকে বৃষ্টিও থামার নামগন্ধ নেই। থেকে থেকেই বিজলি চমকাচ্ছে। ওদের আলোচনা চলাকালীন অবস্থায় খুলে গেলো সেই ছোট্ট দরজা। দরজা খোলার শব্দে একসাথে সবার চোখ গেলো সেদিকেই। বেরিয়ে এসেছে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক । বয়স ভালোই হয়েছে তার। সাদা চুল। মুখের বড় বড় দাঁড়িতে চেহারা ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না। কোটরাগত চোখ ভাটার মতো ধিকিধিকি জ্বলছে। বেশ ভয় পেয়ে গেছে মেয়ে গুলো।
-তোমরা কারা? কি চাই? (বৃদ্ধ)
-আ…আমরা আসলে আপনার দোকানের অ্যান্টিক সামগ্রী গুলো দেখতে এসেছি। (ইতি) বেশ অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিলো ইতি। লোকটা এভাবে চলে আসায় কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না কেউ। ইতি উত্তর দেওয়ার সাথে সাথেই পলি কথা বলে উঠলো..
-আসলে এখানে এসে কাউকে না পেয়ে বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিৎ। (পলি)
-ও তাই। এই দোকানের ঠিকানা কোথায় পেলে তোমরা?(বৃদ্ধ)
-আমার ভাই জানিয়েছে। (মিলু)
-তোমার ভাইকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিও। (বৃদ্ধ) অদ্ভুত কন্ঠস্বরে কথা গুলো বলো বুড়ো লোকটা।
-এখানে আলো এতো কম কেন? (পলি) প্রশ্নটা করেই ফেললো ও।
-তোমাকে এতকিছু নিয়ে ভাবতে হবে না। (বৃদ্ধ) কঠোর সুরে জবার দিলো বুড়ো। তার কথা আমলে না নিয়ে রোজ প্রশ্ন করলো, আমরা কি জিনিস গুলো দেখতে পারি?
-অবশ্যই। আয়না আছে ওই দিকে!(বৃদ্ধ)
-আয়না! আপনি কিভাবে জানলেন আমরা আয়না দেখতে ইচ্ছুক? (ইতি) (অবাক হয়ে) অবাক হয়েছে সবাই। এই বুড়োর আচার আচরণ কেমন সন্দেহজনক। কিন্তু বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত যেতেও পারবে না।
-মেয়েরা আয়না একটু বেশিই পছন্দ করে, তাই নয় কি?(বৃদ্ধ)
-সবাই যে আয়না পছন্দ করবে তা তো না।(আদ্রি) উত্তরে কুৎসিত ভাবে হাসলো বুড়ো।
-তাহলে চলো তোমাদের আয়না দেখিয়ে আনি।(বৃদ্ধ) কথা না বাড়িয়ে বৃদ্ধের পিছুপিছু হাটতে থাকলো মেয়েরা। রুমটা অনেক বড়। পুরনো জিনিসে ঠাসা। কোথায় রাখা পুরনো আলমারি, পুরনো দিনের কলমদানি, কলম, চেয়ার টেবিল,বাক্স,ছুরি,ঘড়ি,তৈজসপত্র, ফুলদানি আরো অনেক বাহারি জিনিস। একটা জায়গায় এসে থামলো বৃদ্ধ। থরে থরে সাজিয়ে রাখা দেওয়াল আয়না,ড্রেসিং টেবিল, ছোট আয়না।
চমৎকার সেগুলোর ডিজাইন। কাঠের, স্টিলের আরো নানা ধাতুর ফ্রেমে আয়না বসানো, সোনা এবং রূপার আয়নাও আছে। ইতি সব ভুলে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো এক নিমিষে। এতো আয়না আগে একসাথে দেখেনি ওরা। -এত্ত আয়না! কি সুন্দর সব গুলো! (ইতি)
-আমি তো এতো আয়না একসাথে কখনো দেখিনি। (মিলু) বুড়ো নিঃশব্দে হাসছে। কিন্তু তা কেউ খেয়াল করলো না। আয়না দেখায় মত্ত সবাই। ইতির চোখ পড়লো বেশ দূরে রাখা একটা আয়নার দিকে। অনেক বড় একটা দেওয়াল আয়না যার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে পুরোপুরি দেখা যাবে।
এরকম একটা আয়নাই চায় ইতি। আয়নাটা দেখতেও অসাধারণ। রূপার ফ্রেমের মধ্যে আয়না বসানো। রূপার মধ্যে ফুলের ডিজাইন। ফুলগুলো তৈরি করা হয়েছে সোনা দিয়ে। অন্ধকারের মধ্যেও ঝিকমিক করছে সেগুলো। উপরের দিকে দামী গোল গোল পাথর বসানো। আয়নার নিচের দিকে সুন্দর ডিজাইন করা। দেখে মনে হচ্ছে এটা কোন রাজবাড়ির আয়না। রাজকীয় ডিজাইন। আয়নার কাচটা একটু ময়লা, তবে ভালোভাবে পরিষ্কার করালে ঝকঝকে হয়ে যাবে। আরেকটা জিনিস খেয়াল করলো ইতি, সহসাই যেন আয়নাটা থেকে কেমন আলো ঠিকরোচ্ছে। তবে এই দোকানের অন্যসব আয়নার তুলনায় এই আয়নাটাই সবচেয়ে নজর কাড়া। আরো সোনার আয়নাও আছে সেগুলো এটার কাছে কিছুই না। সবগুলোর সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে গেছে এটি। -দোস্ত, দেখ তো এই আয়নাটা কেমন মানাবে আমার ঘরের দেওয়ালে? (ইতি)
-ভীষণ সুন্দর। (পলি) সবাই একবাক্যে স্বীকার করলো এই আয়নাটাই সেরা। এটা ওদের কারো চোখে পড়েনি এতক্ষণ, প্রথম ইতিই দেখেছে।
-শুনুন,ওই আয়নাটার দাম কত? (ইতি)
-কোনটা? (বৃদ্ধ) -ওই যে ওইটা।(আয়না দেখিয়ে)(ইতি)
-তুমি ওটা নিতে চাও?(বৃদ্ধ) বৃদ্ধ লোকটার মুখে হাসি।
-নেওয়ার জন্যই তো জিজ্ঞেস করেছে।(জিনিয়া)
-এখন বলুন দাম কত রাখবেন?(ইতি)
-তুমি যা খুশি দাও।
-এই আয়নার দাম তো অনেক হবে। আপনি দাম বলুন।(আদ্রি)
-বললাম তো যা খুশি দাও। তোমাদের দেখে তো ছাত্রী মনে হচ্ছে। আমি দাম চাইবো না।(বৃদ্ধ)
-৭,০০০ টাকা দিলে হবে?
-হুম,দাও। এতো কম দামে বুড়ো আয়নাটা দিতে রাজি হবে ওরা ভাবতেও পারেনি। এই আয়নার দাম কম করে হলেও ১৬,০০০ হবে বা তারচেয়েও বেশি। তবে নিজের পছন্দের জিনিস এতো কম দামে পাওয়ায় আনন্দে আর কিছুই চিন্তা ভাবনা করলো না ইতি। ওর আয়না ও পেয়েছে আর ভেবে কি হবে। -আচ্ছা, এই নিন টাকা। (ইতি) -এতো বড় আয়না নিবি কিভাবে তুই?(মিলু)
-এটাই তো ভাবছি।(ইতি) ইতোমধ্যে বৃষ্টি কমে এসেছে। প্রকৃতিও যেন চায় আয়নাটা তাড়াতাড়ি তার নতুন বাড়িতে যাক!
-আংকেল, একটা গাড়ি জোগাড় করে দিতে পারবেন আয়নাটা নেওয়ার জন্য?(ইতি) বৃদ্ধর কাছেই শেষ পর্যন্ত সাহায্য চাইতেই হলো।
-দেবো না কেন? এখনই ব্যবস্থা করছি। (বৃদ্ধ) এই কথা বলেই বৃদ্ধ বাহিরে চলে গেলো গাড়ি নিয়ে আসতে। বোঝাই যাচ্ছে আয়না বিক্রি করতে পেরে বৃদ্ধ খুব খুশি। বৃদ্ধ চলে যেতেই ইতি এগিয়ে গেলো আয়নার দিকে। আয়নাটা স্পর্শ করলো আর সাথে সাথে আকাশ কাঁপিয়ে বিদ্যুৎ চমকালো অথচ বাহিরে এখন আর বৃষ্টি হচ্ছে না!
ভয়ে দূরে সরে এলো ইতি। সবাই ভীত চোখে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। সবাই একটু ধাতস্থ হওয়ার পর ইতি আবারো আয়নাটাকে স্পর্শ করলো। আয়নার দিকে মুখ তুলে তাকালো। এক মুহুর্তের জন্য ইতির মনে হলো আয়নাতে তার মুখের জায়গায় অন্য মুখ দেখা গেছে। কিন্তু আবার ভালো করে তাকাতেই দেখলো সব ঠিকই আছে,তাকেই তো দেখা যাচ্ছে আয়নায়। ইতি ভাবলো এটা ওর মনের ভুল। পুরনো আয়না, তাছাড়া কাচটাও ঘোলাটে। বান্ধবীদের এ বিষয়ে কিছু বললো না।
শুনলে ওরা ওকে নিয়ে হাসা হাসি করবে। মিলু,পলি,আদ্রি,জিনিয়া আর রোজও কয়েকটা জিনিস পছন্দ করে ফেলেছে কেনার জন্য, বুড়ো গাড়ি নিয়ে ফিরলে তারা সেগুলো কিনবে।
-গাড়ি এসে গেছে।(বৃদ্ধ) নিজেদের পছন্দ করা জিনিস গুলো কিনে ফেললো বাকিরা। তবে আয়নার মতো এসব জিনিসের দাম কম রাখা হয়নি! সবশেষে বৃদ্ধ আর গাড়িওয়ালা মিলে আয়নাটাকে গাড়িতে তুলে দিলো। ইতি তাদের বাড়ির ঠিকানা আর নাম গাড়িওয়াকে বলে দিয়ে নিজে একটা রিকশা নিলো। দোকান থেকে বের হওয়ার সময় ওরা কেউ খেয়াল করলো না বৃদ্ধ লোকটা পৈশাচিক হাসি হাসছে!
ইতি আয়না নিয়ে ভালোভাবেই বাড়িতে ফিরলো। আয়না নিয়ে গাড়িওয়ালা তখনো বাইরে দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢুকেই ইতি মিসেস সাবেরা বেগমকে ডাকা শুরু করলো।
-মা এদিকে এসো। মিসেস সাবেরা ইতির গলা শুনে ছুটে আসলেন।
-বৃষ্টিতে আটকা পড়েছিলাম তাই এতো দেরি হলো।(ইতি)
-বৃষ্টি! কই আজ তো ঢাকার কোথাও বৃষ্টি হয়েছে বলে খবরে দেখলাম না।
-সবই কি তোমার খবরে দেখাবে নাকি? তারচেয়ে তুমি দেখো আমি কি সুন্দর একটা জিনিস এনেছি। টানতে টানতে মাকে নিয়ে গেলো আয়নার কাছে। ইতির মা আয়নাটাকে আগেও দেখেছেন। তার মনে পড়ে গেলো। এই সেই আয়না যা ইতির বাবা বিক্রি করে দিয়েছিলো বহু বছর আগে, তখনো ইতির জন্ম হয়নি।
মিসেস সাবেরা ইতিকে বললেন আয়না ফেরত পাঠাতে,কারণ এই আয়না আবার বাড়িতে আনা হয়েছে দেখলে রেগে যেতে পারেন ইতির বাবা তানজীম আহমেদ। কিন্তু ইতি নারাজ। তার এই আয়না চাই ই চাই। ইতির জেদের কাছে পরাজিত হলেন মিসেস সাবেরা। আয়নাটাকে ইতির রুমে ঠিক আগের জায়গায় সেট করা হলো। ইতির ভাইও আয়নাটা পছন্দ করেছে, যে দেখবে সেই পছন্দ করবে।
ইতির বাবা বাড়ি এসে ইতির মায়ের কাছে সব শুনে মেয়ের রুমে গেলেন। মেয়েকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন যেন এ আয়না ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু ইতিও বলে দিলো এ আয়না ফেরত দেওয়া হলে সে খাওয়া,কলেজ সব বাদ দেবে। আর ও একবার যা বলে তাই করে। কাজেই আয়না ফেরত দেওয়ার চিন্তা বাদ দিতে হলো তানজীম আহমেদকে। মেয়েকে বড্ড ভালোবাসেন তিনি। কিন্তু কেন এতো ভয় তার? তবে কি অন্য কোন কারণ আছে যার কারণে ইতির বাবা আয়নাটাকে রাখতে চান না?
ইতির কথা মেনে নিলেও অনেক চিন্তিত ইতির বাবা। ইতির মা কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে আয়না রাখলে কি সমস্যা? তাছাড়া এটা তো অনেক আগে থেকে এই বাড়িতে ছিলো একসময়, এমন কি হলো যে এটা বাড়িতে রাখা যাবে না? সব প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন তানজীম আহমেদ। রাতে খাওয়ার টেবিলেও কারো সাথে কথা বললেন না তিনি। দুশ্চিন্তার মেঘ ভর করেছে তার মনে। খাওয়ার পরে সবাই সবার রুমে শুতে চলে গেলো। . নিজের রুমে এসে বিছানায় বসে আয়নায় বার বার নিজেকে দেখছে ইতি। কি এক নেশা। ইতি অনেক ক্লান্ত থাকায় ঘুম পাচ্ছিলো ওর। তাই কিছুক্ষণ পর শুয়ে পড়লো ও। শোয়ার সাথে সাথেই ঘুম। . রাত ২ টা। ইতির বাবা গভীর ঘুমে মগ্ন। কিন্তু জেগেই আছেন মিসেস সাবেরা। ইদানীং রাতে তার ঘুম হচ্ছে না। হঠাৎ ইতির ঘর থেকে ভেসে আসলো গোঙানির আওয়াজ। ইতির বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে ইতির রুমে গেলো ইতির মা। রুমে গিয়ে যা দেখলো তা দেখার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলেন না তারা!
আয়নার সামনে মেঝেতে পড়ে আছে ইতি আর গোঙাচ্ছে। ওর পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা চিরুনি। মিসেস সাবেরা বেগম ছুটে গেলেন ইতির দিকে। ইতির চোখ বন্ধ। গায়ে হাত ছোয়াতেই দেখলেন ভীষণ গরম। গায়ের তাপমাত্রা থেকে মনে হচ্ছে ১০৩-১০৪ডিগ্রী জ্বর। ইতির বাবা আর মা মিলে ইতিকে মেঝে থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। ইতি ঘোরের মধ্যে আছে। অস্পষ্ট ভাবে কিছু বলে চলেছে। মিসেস সাবেরা শোনার চেষ্টা করলেন কি বলে ইতি। সামান্য বোঝা গেলো। ইতি বলছে,”আমাকে ছেড়ে দাও,তুমি আসবে না।” মিসেস সাবেরা ভাবলেন জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বলছে মেয়ে।
-ইতি, এই ইতি, তাকা মা।(মিসেস সাবেরা) এভাবে তিন চার বার ডাকার পরে ইতি চোখ মেললো।
-কি হয়েছিলো তোর?(ইতির বাবা)
-জানি না। ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। তারপর সারা শরীরে যন্ত্রণা।(ইতি)
-এসব কথা কালকেও শোনা যাবে। তুমি যাও তো ওষুধ নিয়ে এসো। (ইতির মা) ইতির বাবা ওষুধ নিয়ে এলেন। ওষুধ খেলো ইতি। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। ইতির বাবা-মা আর নিজের ঘরে না গিয়ে মেয়ের সাথেই থাকলেন সে রাতটা। . পরদিন সকালেঃ ইতির জ্বর কমেছে। এখন নেই বললেই চলে। আজ সে স্কুলে গেলো না। বাবা অফিসে গেলো।ইতি ওর মায়ের সাথে বসে গল্প করছে।
-তুই কাল রাতে কী দেখেছিলি স্বপ্নে?(মা) প্রশ্ন শুনে ভয় মুখ শুকিয়ে গেলো ইতির। -অনেক ভয় পেয়েছিলাম মা। স্বপ্নে দেখলাম যে আমি আমার ঘরের আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছি। আয়নায় আমাকেই দেখা যাচ্ছিলো। কিন্তু একসময় আয়নার অন্য একটা মেয়ের মুখ দেখতে পেলাম। কি ভয়ংকর মেয়েটা! চোখগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে, ঠোঁট কাটা, দাঁত গুলো দেখা যাচ্ছিলো-রক্তমাখা লাল দাঁত, সমস্ত শরীরে ক্ষত চিহ্ন। গায়ে সূচ বিধানো এখানে ওখানে। মাথা ফেটে রক্ত পড়ছিলো, পেটে ছুরি ঢোকানো। উফ! মনে পড়লেই গা গুলিয়ে ওঠে। মেয়েটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে। হঠাৎ করে কথা বলে উঠলো।
বললো-“আমি আসবো, আমার আসার সময় হয়েছে। সব বুঝিয়ে দেবো। আমি আসছি….ইতি প্রস্তুত হও…” এটা বলেই মেয়েটা ওর দুটো হাত বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। আমি চাইছিলাম ছুটে পালাতে কিন্তু এক অদৃশ্য মায়াবলে আমি কিছুতেই আয়নার সামনে থেকে উঠতে পারলাম না। মেয়েটার ডান হাত ভর্তি সূচ। বা হাতে সে আমার গলা টিপে ধরলো। শব্দ করতে পারছিলাম না। শুধু গো গো আওয়াজ বের হচ্ছিলো গলা দিয়ে। তারপর ডান হাতে থাকা সূচ গুলো আমার শরীরে বিঁধিয়ে দিতে লাগলো। আমার কাছে পুরোটাই বাস্তব মনে হচ্ছিলো। খুব যন্ত্রণা দিয়ে ও আমাকে মারতে চায় মা। তারপর কি হয়েছে আমার আর মনে নেই। কেঁদে ফেললো ইতি।
এতো ভয় জীবনে কখনো পায়নি আগে। ইতিকে জড়িয়ে ধরলো মিসেস সাবেরা। বহু কষ্টে মেয়ের কান্না থামিয়ে ভয় দূর করলেন তিনি। -আসলে ব্যাপারটা হলো তুই সবসময় ভূতের গল্প পড়িস আর তোর বাবা আয়নাটা রাখতে দিতে চেয়েছিলো না তাই তুই এমন স্বপ্ন দেখেছিস। এখন দেখ গিয়ে আয়নাটা ঠিকই আছে।(মা)
-আচ্ছা মা।(ইতি)
-তুই কালকে রাতে শোয়ার আগে চুল আঁচড়িয়েছিলি বা চিরুন বের করেছিলি?
-না তো। কেন মা?
-এমনি রে। ঘরে যা। আমি দুপুরের রান্নাটা সেরে নেই। ইতি ঘরে চলে গেলো। মিসেস সাবেরা একটা জিনিস কিছুতেই মেলাতে পারছেন না। স্বপ্নে ইতি চুল আড়াচ্ছিলো ঠিক আছে, কিন্তু তিনি যখন ইতির ঘরে গেলেন তখন ইতির পায়ের কাছে চিরুনি কিভাবে আসলো? চিরুনি তো থাকে ইতির ড্রয়ারের মধ্যে! ইতি নিজেই বলেছে রাতে চিরুনিটা বের করা হয়নি। কিছু একটা হচ্ছে। মায়ের মন বলে কথা।
কিন্তু কি হচ্ছে তিনি বুঝতে পারছেন না। এদিকে ইতির বাবার আয়নাটার প্রতি বিদ্বেষ। কাল রাতে ইতি যখন তাদের পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলো তখন ইতির বাবা বলেছিলো-‘তোমাকে আর ইতিকে কত করে বারণ করলাম আয়নাটা রেখো না। বললাম ইতিকে বোঝাও। তোমরা মা-মেয়ে আমার কথা তো কানে তুলবে না। আজ যদি ইতির ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে যেতো তাহলে কি করতে?’ তখন মিসেস সাবেরা জানতে চেয়েছিলেন আয়নাটার কি দোষ? কথাটা এড়িয়ে যান ইতির বাবা।
-বাদ দাও। তুমি ইতির কাছে স্বপ্নের ব্যাপারে জানতে চেও। এখন ঘুমাও। স্বামীর এরকম কথা আর ইতির স্বপ্ন ভাবাচ্ছে ইতির মাকে। তিনি বাহিরে স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরে ভেতরে দুশ্চিন্তা করছেন। . ইতি নিজের ঘরে এসে আয়নাটা দেখলো। কোথায় অস্বাভাবিক কিছুই নেই। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে ইতি অনেকটা সহজ হয়ে এলো। গতরাতের স্বপ্ন এখন নিছকই দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে ইতির কাছে। সারাদিন ভালোই কাটলো ইতির। . অন্যদিকে ইতির বাবা,তানজীম আহসান বাড়ি ফিরলে মিসেস সাবেরা তার কাছে ইতির স্বপ্নের ব্যাপারটা বললেন। শুনেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন তিনি। তার চোখেমুখে আতংক।
-এই আয়না আজই আমি ফেরত পাঠাবো। (তানজীম আহসান)
-আয়না থাকলে কি সমস্যা? তুমি খুলে বলবে?(মিসেস সাবেরা)
-তুমি দেখছো না আয়নাটা আসার পরে কি ঘটলো আমাদের মেয়ের সাথে?(তানজীম)
-এটা কাকতালীয় ব্যাপার। ইতি কিছুতেই রাজি হবে না। (সাবেরা)
-রাজি না হলেও করার কিছু নেই। আমি জোর করেই আয়নাটা ফেরত দেবো।(তানজীম) চেঁচামিচির আভাস পেয়ে ইতি আর ওর ভাই বাবা-মায়ের রুমে চলে আসলো।
-এই আধুনিক যুগেও একটা আয়না নিয়ে এতো ভয় পাচ্ছো বাবা?(ইতির ভাই)
-ভাইয়া ঠিকই বলেছে। বাবা তুমি একজন ডাক্তার হয়ে এরকম করছো কেন?(ইতি) ছেলে-মেয়ের কথার কাছে আবারো হার মানলেন তানজীম আহমেদ। তবে তিনি বলে দিলেন ইতি যদি আবার এরকম স্বপ্ন দেখে তাহলে আয়নাটা কিছুতেই রাখা হবে না বাড়িতে। ইতিও শর্তটা মেনে নিলো। . পড়াশোনা সেরে রাত ১২ টায় শুতে গেলো ইতি। আজ রাতেও স্বপ্ন দেখলো ইতি। তবে সেই স্বপ্নটা গতদিনের চেয়ে একটু ভিন্ন। আজ রাতের স্বপ্নে সেই ভয়ংকর মেয়েটা শুধুই তাকিয়ে ছিলো ইতির দিকে আর হাত দিয়ে ডাকছিলো।
ইতি আজকেও ভয় পেয়েছে,কিন্তু জ্বর আসেনি। ও ঠিক করলো বাবা- মাকে কিছুতেই বলা যাবে না স্বপ্নের কথা। বাবা যদি জানতে পারে তাহলে আর আয়নাটা রাখা হবে না। তাই কেউ স্বপ্নের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে মিথ্যা বলবে সে। যত যাই হোক কেন আয়নাটা হারাতে চায় না ইতি। . সকালবেলাঃ -ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো কেন? শরীর ঠিক আছে তো?(তানজীম আহসান)
-হ্যা বাবা। -ইতি তোর ভাইয়াকে নিয়ে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো আমরা। তাই ভাবছি তোকে তোর খালার বাসায় রেখে যাবো। তুই সেই চট্টগ্রাম যেতে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়বি। একদম জার্নি করতে পারিস না তো তুই।(মিসেস সাবেরা)
-আমি বাসাতেই থাকবো।(ইতি)
-কি বলিস? তোকে বাসায় একা রেখে যাওয়া যাবে না। (তানজিম আহসান) -উফ!তুমি কি আয়না নিয়ে ভয় পাচ্ছো? আজ তো আমি স্বপ্ন দেখিনি। (ইতি) স্বপ্ন দেখেনি শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন ইতির বাবা।
-তোর বাবা ঠিকই বলেছে। একা থাকা চলবে না।(মিসেস সাবেরা) -ইতি তো এর আগেও একা থেকেছে মা। সব অভিজ্ঞা অর্জন করতে হয়। (ইতির ভাই)
-ঠিক বলেছিস ভাইয়া। আমি আমার বান্ধবীদের ডেকে নেবো। গতবার তোমরা যখন গেলে তখনও তো ওদের ডেকেছিলাম। কাজের খালাকে বলে দেবো রাতে আমাদের সাথে থাকতে,তাহলে তো আর চিন্তা থাকলো না। (ইতি) অনেক কথা বার্তার পর ইতিকে বান্ধবীদের সাথে থাকতে দিতে রাজি হলেন ইতির বাবা-মা। বাবা মায়ের ব্যাগ গুছিয়ে দিলো ইতি। তারা মোট দুই দিন চট্টগ্রামে থাকবে ইতির চাচার বাসায়। বান্ধবীদের ফোন করে রাজি করালো। তাদের বাবা-মা অবশ্য আপত্তি করেনি কারণ তারা জানেন ইতির বাড়িতে কোন সমস্যা হবে না তাদের মেয়ের। বেশ ব্যস্ত সময় পার করলো। ইতি শুয়ে আছে। সকাল সাতটায় বাবা-মায়ের গাড়ি। বান্ধবীরা স্কুল থেকে সারাসরি ওর সাথেই বাসায় আসবে। “আজ কি কোন স্বপ্ন দেখতে পাবো?”,ভাবছে ইতি। এটা যেন খুব স্বাভাবিক। স্বপ্ন না দেখলেই বরং খারাপ লাগবে ইতির। মেয়েটাকে জানার এক টান অনুভব করে ইতি। কে সে? এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলো। আজও স্বপ্ন জগতে প্রবেশ করলো ইতি। কিন্তু আজকের স্বপ্নটা একদম অন্যরকম প্রথম দুই দিনের থেকে।
স্বপ্নে দেখতে পেলো সেই ভয়ংকর মেয়েটা একটা ঘরের বিছানায় বসে আছে। শুধু মেয়েটাই নয় আরও একজন আছে। “একে তো আগে দেখা যায়নি”,স্বপ্নের মধ্যেই চিন্তা করলো ইতি। মেয়েটার কোলে একটা রক্তাক্ত বাচ্চা,এটাই হলো সেই নতুন মানুষ। বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে মেয়েটা। সে কাঁদতে কাঁদতে ঘুরে তাকালো ইতির দিকে। চোখ গুলো জ্বলে উঠলো তার, কান্নার বেগ বাড়লো। ইতির কাছে এই ঘরটা পরিচিত লাগছে, খুব পরিচিত। অনেকবার এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ঘরের বিছানার পাশে একটা বড় জানালা।
“এরকম জানালা তো আমার ঘরেও আছে। তবে কি এটা আমার ঘর?”,ভাবছে ইতি। জানালা ঠিকই আছে, ঘরটা সাজানো একটু অন্যভাবে, আসবাবপত্র গুলো অনেক পুরাতন ডিজাইনের। এটা ইতির ঘর একেবারে নিশ্চিত সে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে যেন স্বপ্নে নয় অতীতে চলে গেছে। ইতি মেয়েটার দিকে তাকালো,কেন কাঁদছে মেয়েটে? বাচ্চাটার এরকম অবস্থা হলো কিভাবে? এরকম হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যাচ্ছে ইতির অবচেতন মনে। হঠাৎ করেই ভয়ংকর মেয়েটার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করলো ইতি।
মেয়েটার মাথা থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেছে, পেটে বেঁধানো ছুড়িটা নেই, চোখটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে-ভীষণ মায়া সে চোখে, কাটা ঠোঁটের জায়গায় শোভা পাচ্ছে সুন্দর স্বাভাবিক মানুষের ঠোঁট, গায়ের ক্ষত গুলোও মুছে গেলো, শরীরে বেঁধানো সূচ গুলো উধাও হয়ে গেলো। শরীরে আঘাতের চিহ্ন মাত্র নেই। মেয়েটার কোলে থাকা শিশুটাও স্বাভাবিক হয়ে গেছে,কোথায় রক্ত? এখন সব ঠিকঠাক।
বাচ্চাটা খুব সুন্দর দেখতে। টিকালো নাক, আয়তলোচন চোখ, গোলাপি ঠোঁট। এতো সুন্দর বাচ্চা আগে কখনো দেখেনি ইতি, শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর দিকে। ইতির খুব ইচ্ছে ছিলো একটা ছোট ভাই অথবা বোনের। আচ্ছা এই মেয়েটাই কি বাচ্চাটার মা? তাই যদি হয় তাহলে সে তার মায়ের মতোই সুন্দর দেখতে। নাকি রাক্ষসী মেয়েটা এই বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছে? আর চিন্তা করতে পারছে না ইতি। মেয়েটা বাচ্চাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ইতির দিকে আসতে লাগলো। কিন্তু এখন খুব বেশি ভয় লাগছে না ইতির। মেয়েটা এসে ইতির থেকে এক হাত দূরে দাঁড়ালো। ইতি মনে সাহস সঞ্চয় করে তাকে প্রশ্ন করলো, -তোমার নাম কী? কি চাও আমার কাছে? আমাকেই কেন দেখা দিচ্ছো বার বার?
-আমি ইশিতা ইসলাম। অনেক অপেক্ষার পর আমি…মেয়েটা কি চায় তা বলার আগেই মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেলো ইতির। তাই স্বপ্ন দেখাও শেষ হলো না। মনে মনে আফসোস করলো ইতি। এই সময়টায় না ডাকলেই কি হতো না। মেয়েটার ব্যাপারে তো কিছুই জানা গেলো না নামটা ছাড়া। যে করেই হোক আমাকে জানতে হবে, এসব ভাবতে ভাবতেই ঘরের দরজা খুলে দিলো ইতি।
-মা তুমি এতো সকালে?(ইতি)
-আজ আমাদের চিটাগাং যেতে হবে তুই ভুলে গেলি নাকি?(মিসেস সাবেরা)
-ও তাইতো। কত বাজে এখন?(ইতি) -৫:৩০ টা বাজে।(সাবেরা)
-এখনো তো অনেক দেড়ি। তোমরা কি এখনি বেরুবে? (ইতি)
-না, রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট করবো তারপর বের হবো। কিছুটা আগেই বের হবি বুঝলি না হলে বাস স্ট্যান্ডে পৌছাতে দেড়ি হতে পারে। তাছাড়া তোর ভাইয়াকেও তুলতে হবে, তার তো আবার রেডি হতে অনেক সময় লাগে। আর তোর তো সাড়ে সাতটায় প্রাইভেট আছে। খেয়ে রেডি হতে হবে না?(সাবেরা)
-ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি ফ্রেস হয়ে আসি। তোমরা রেডি হও।(ইতি) ইতি ফ্রেস হয়ে আসলে চারজন একসাথে ব্রেকফাস্ট করলো। ইতির বাবা-মা ৬:২০ মিনিটে বেড়িয়ে গেলো। তারপর ইতি একা। ইতি অনেক ভেবেচিন্তে একটা প্ল্যান করলো। আজ রাতেই সেটা বাস্তবায়ন করার ইচ্ছে আছে ওর। এর জন্য অবশ্যই বান্ধবীদের সাহায্য লাগবে। প্রাইভেটে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে দেখা হলেও তখনই তাদের কাছে প্ল্যানের কথা বললো না ইতি, ওরা যখন বাসায় আসবে তখনই বলবে। এখন বললে রাজি নাও হতে পারে।
স্কুল শেষে বান্ধবীদের সাথে হই হই করতে করতে বাসায় ফিরলো ইতি। আজ অনেক উত্তেজনা আর আনন্দের মধ্যে আছে সে। একরকম রোমাঞ্চ ভর করেছে ইতিকে। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম করে খেয়ে নিলো বান্ধবীদের সাথে, একটু ঘুমিয়ে নিলো সবাই। তারপর ছাদের চিলেকোঠার ঘরে চলে গেলো গল্প করতে। বিভিন্ন বিষয়ে গল্প, হাসি- ঠাট্টা করতে করতে ইতি তার স্বপ্নের কথাটা জানালো।সবাই তো অবাক! একি মানুষকে পরপর তিনদিন স্বপ্নে দেখা। তাকে না চিনলে সে কিভাবে বার বার স্বপ্নে আসে? সবাই কৌতুহলী হয়ে উঠলো বিষয়টা নিয়ে, বিশেষ করে জিনিয়া। ভূত-প্রেত,কালো জাদু এসেবে ওর প্রচুর আগ্রহ। এই সুযোগে প্ল্যানের কথাটা বলে ফেললো ইতি।
-শোন, আজ রাতে আমরা মেয়েটার আত্মা ডাকবো! এটাই আমার প্ল্যান। মেয়েটা কি চায় তা আমার জানতে হবেই।(ইতি)
-কি অবাস্তব কথা বলিস না তুই।(আদ্রি)
-মানুষের আত্মা আবার ডাকা যায় নাকি!(মিলু)
-এই তোরা থামতো। কিভাবে কি করবি? প্ল্যানচেট নাকি?(জিনিয়া)
-সেটাই বলছি। আয়না যখন আছেই তখন শুধু শুধু প্ল্যানচেট করতে যাবো কেন? Ouija বোর্ডও নেই আমার কাছে,জোগাড় করাও ঝামেলা। মেয়েটা যখন আয়নাতেই আসে তখন আয়নাতেই সমাধান মিলবে।(ইতি)
গ্রেট আইডিয়া। সত্যি তোর বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়।(জিনিয়া) -আমি এসবের মধ্যে নেই বাবা! আমার ভয় করে। (রোজ)
-এসব করা যাবে না। তোর প্রাণের মায়া নেই? আংকেল আন্টি বাসায় নেই এইসময় যদি কোন অঘটন ঘটে যায় তখন আমরা সামলাবো কিভাবে?(পলি)
-আরে কিছুই হবে না। এটাকে মজা হিসাবেই নে। আমি এক পায়ে খাড়া।(জিনিয়া)
-আমার ভয় করছে। ভেবে দেখ তোরা একবার। (আদ্রি)
-যারা করবি না তাদের জোর করবো না কিন্তু আমি কারো নিষেধ শুনছি না।(ইতি)
-এই ইতি আমি তোর সাথে আছি। একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চার হবে কি বলিস? (জিনিয়া)
-হুম। আর মেয়েটার ব্যাপারেও জানা যাবে। (ইতি) অন্যরা বিমর্ষ মুখে ইতি আর জিনিয়ার কথা শুনে যাচ্ছে। ওরা এসব করতে ইচ্ছুক না। বলা তো যায় না কি থেকে কি হয়ে যায়।
-আচ্ছা ইতি এবার পুরো প্রক্রিয়াটা বল তো?
-রাত ১২ টার পরে আয়নার সামনে গিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে বত্রিশ বার(৩২) মেয়েটার নাম ধরে ওর আত্মাকে আমাদের পৃথিবীতে আসার জন্য আহ্বান জানাতে হবে। মানে আয়নার সামনে গিয়ে নাম ধরে ডাকতে হবে সিম্পল। তারপর অপেক্ষা করতে হবে ওর আগমনের জন্য। ও আসলে মোমবাতি নিভে যাবে। এটাই ওর আসার চিহ্ন। আয়নার ভেতরে আসবে ও। তারপর ওর সাথে কথা বলতে হবে। যা জানতে চাই জিজ্ঞেস করবো। এখানে একটাই শর্ত আছে তা হলো মোমবাতির আলো ছাড়া অন্যকিছুর আলো জ্বালানো যাবে না। আর তোদের ভয় পাওয়ার দরকার নেই। এই আত্মা ডাকার প্রক্রিয়ায় একা একাই আত্মা ডাকতে হয়। আমি নিজেই আত্মা ডাকবো, তোরা শুধু আমার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি এটাই তোদের কাজ। প্লিজ না করিস না। (ইতি)
-তোর যদি কোন ক্ষতি হয়? আমরা এটা হতে দিতে পারি না। (মিলু)
-তোরা তো দরজার বাহিরে থাকবিই। আমি যদি ভয় পাই তাহলে চিৎকার করবো তোরা ভেতরে চলে আসবি।প্লিজ,এবার তো রাজি হ।(ইতি)
সবাই আলাপ আলোচনা করে ইতির প্রস্তাবে রাজি হলো। তাদের ধারণা কোন আত্মা-টাত্মা আসবে না। সবই ইতি মজা করার জন্য করতে চাইছে কারণ সবকিছুতে নতুনত্ব খোঁজাই ওর কাজ।
-একটা প্রশ্ন থেকেই গেলো। আত্মা যদি আসে তাহলে ওটাকে ওদের জগতে ফেরত পাঠাবি কিভাবে?(জিনিয়া)
-ঘরের আলো জ্বালালেই আত্মা চলে যাবে,আত্মাদের জগতের সাথে আমাদের জগতের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবে।(ইতি)
-তুই ঠিক জানিস তো?(রোজ)
-হ্যা রে। আমার মনে হয়না এটা কোন শক্তিশালী আত্মা। যেসব আত্মা প্রতিশোধ নিতে চায় তারা অবশ্য এভাবে যায় না, মন্ত্র পড়তে হয় তাদের তাড়াতে।(ইতি)
-এসব তুই কোথা থেকে জানলি?(পলি)
-আজ প্রাইভেট শেষে তোরা যখন বাসায় চলে গেলি কলেজের জন্য রেডি হতে তখন আমি লাইব্রেরীতে যাই আর আজ তাই কলেজে জন্য রেডি হয়েই এসেছিলাম। অনেক খোঁজাখুঁজি করে কালো জাদুর উপর লেখা একটা বই পাই। ওখানেই লেখা ছিলো কিভাবে আত্মাকে ডেকে আনতে হয়। আত্মা ডাকার অনেক পদ্ধতি আছে তবে এটাই আমার কাছে সহজলভ্য মনে হয়েছে।
-হুম বুঝলাম। খুব এক্সাইটেড লাগছে রে। (জিনিয়া)
-আমারও দোস্ত।(ইতি)
এরপর ওদের গল্প চলতেই থাকলো। রাতেঃ রাত ১২ টায় ছয়জন একসাথে হলো। ইতি মোমবাতি জ্বালিয়ে একটা টুলের উপর রেখে টুলটা আয়নার সামনে নিয়ে আসলো। তখন বান্ধবীদের সামনে যতই লম্ফঝম্প করুক না কেন এখন খুব ভয় করছে ইতির। ইচ্ছে হচ্ছে এসব করা বাদ দিলে। “না, বাদ দেওয়া যাবে না, ওরা আমাকে এমনিতেই ভীতুর ডিম ভাবতো এখন যদি আমি পিছু হটি তাহলে আর মানসম্মান থাকবে না”,ভাবলো ইতি।
-এই আমি রেডি। তোরা ঘরের বাইরে যা। আমি না ডাকা পর্যন্ত ঘরে ঢুকবি না কেউ।(ইতি)
-আচ্ছা। সাবধানে করিস, আমরা বাইরেই আছি। (জিনিয়া)
ঘরের লাইট বন্ধ করে দিলো ইতি। জোরে শ্বাস নিয়ে মেয়েটাকে ডাকা শুরু করলো। ইশিতা ইসলাম…ইশিতা ইসলাম…ইশিতা ইসলাম….. গুণে গুণে ঠিক ৩২ বার ডাকলো, এর কমও নয় বেশিও নয়। এদিকে দরজার বাহিরে উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর বান্ধবীরা। ওদেরও খুব চিন্তা হচ্ছে। ইতি অপেক্ষা করছে কিছু একটা ঘটার। হয়ত এখনই মোমবাতি নিভে যাবে। পাঁচ মিনিট গেলো মোমবাতি নিভলো না।
হঠাৎ কোথা থেকে যেন বাতাস এসে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিলো।
উত্তেনায় ইতির বুক ঢিপ ঢিপ করছে। আরো অনেকক্ষণ কেটে গেলো, কিন্তু কিছুই হলো না।
-তুমি কি এসেছো?(ইতি) কোন উত্তর নেই। বন্ধঘরের দেওয়ালে এই কথাটি প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেলো। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা। নাহ ধৈর্যের বাধ ভাঙল ইতির। বইয়ের কথা সব মিথ্যা মনে হলো ওর।
-এই তোরা পাশের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়,কিছুই তো হল না সব ভুয়া। এখন আর আমার ঘরের ভেতরে আসতে হবে না, খুব ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাবো রে। (ইতি)
-তুই ঠিক আছিস?(মিলু) বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করলো মিলু।
-হ্যা,যা ঘুমা তোরা।(ইতি)
ওর বান্ধবীদের চলে যাওয়ার শব্দ শোনা গেলো। ঘরের আলো জ্বালানোর প্রয়োজনবোধ করলো না ও। জানালার একটা পাল্লা খুলে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো ইতি, প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে ওর, সাধারণ রাত জাগে না ইতি। শোয়া মাত্রই রাজ্যের ঘুম ঘিরে ধরলো ওকে। জানালার ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প চাঁদের আলো ঢুকছে। ইতি যদি চোখ মেলে চাইতো তাহলে দেখতে পেতো দুটো চোখ নির্নিমেষ ভাবে তাকিয়ে আছে ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে!
সকালবেলাঃ আজ ছুটির দিন তাই ইতির বান্ধবীরা বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলো। কিন্তু ইতি এখনো ওঠেনি। ইতির দেখা না পেয়ে ওরা ইতির রুমে গেলো। বিছানাতেই ঘুমাচ্ছে সে।
-ইতি ওঠ। কত ঘুমাবি?(রোজ) কোন সাড়া নেই। আরও কয়েকবার ডেকেও সারা মিললো না। ওরা এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে ইতির মুখে ঢেলে দিলো। এইবার নড়ে চড়ে উঠলো ইতি। আস্তে আস্তে উঠে বসলো। চোখ ফুলে গেছে আর লাল হয়ে আছে ওর।
-কি করলি এটা?(ইতি) বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলো ইতি।
-তোর ঘুম ভাঙছিল না তাই ভাবলাম একটু মজা করি।(পলি)
-সবসময় মজা ভালো লাগে না।(ইতি)
-কিরে রেগে যাচ্ছিস কেন? রাতে ঘুম হয়নি তোর?(মিলু)
-হয়েছে। তোরা যা আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।(ইতি) ইতি আসার পর সবাই মিলে খাওয়ার টেবিলে বসলো। আজ সবাই অনেক হই-হুল্লোর করলেও ইতি ওদের সাথে যোগ দিচ্ছে না। বিষয়টা খেয়াল করলো আদ্রি।
-তোর কি হয়েছে? সেই কখন থেকে দেখছি মন মরা হয়ে বসে আছিস?(আদ্রি)
-তেমন কিছুনা। সামান্য মাথাব্যথা। (ইতি)
-ওষুধ খেয়েছিস?(জিনিয়া)
-হুম, খেলাম তো কিন্তু কমছে না।(ইতি)
-কালকে রাতের ব্যাপারে তো কিছুই বললি না?(পলি)
-কোন কাজ হয়নি দেখলিই তো তোরা। এখন এসব বলতে ভালো লাগছে না। তোরা গল্প কর,আমি গোসল করে একটু ঘুমাবো।(ইতি) ইতির মেজাজ একদম ঠিক নেই। কথায় কথায় রেগে যাচ্ছে। তাই ওকে আর কেউ কিছু বললো না।
দুপুরবেলা খাওয়ার সময় দেখা গেলো ইতির মন ভালো হয়ে গেছে। চিন্তা মুক্ত হলো ওর বান্ধবীরা। ইতির বাবা-মাও ফোন করে মেয়ের খোঁজখবর নিয়েছেন। ওরা ঠিক করলো আজ রাতে একটা হরর মুভি দেখবে। গল্পগুজব, খেলা, এটা ওটা রান্না করে খাওয়া এইসব মিলিয়ে বেশ দারুণ একটা দিন পার করলো ওরা। মুভি দেখে শুতে শুয়ে রাত ১ টা পার হয়ে গেলো। বেশ ভয় করছে ইতির। আজ কাউকে নিয়ে শুলেই বোধহয় ভালো হতো। কাউকে ডেকে নিয়ে আসতে পাশের রুমে দিকে রওনা দিলো ইতি।
ওর মনে হতে লাগলে পেছন থেকে ওকে কেউ ফলো করছে। পেছনে তাকিয়ে দেখলো। নাহ, কেউ তো নেই। কিন্তু ইতি স্পষ্ট পায়ের আওয়াজ পেয়েছে। “হয়ত কাজের খালা উঠে বাথরুমে গিয়েছে”, ভাবলো ইতি। একবার কি বাথরুমে গিতে দেখে করে আসবো? না থাক, কি দরকার। কাজের খালাই হবে। বাইরের বাথরুমে তো বান্ধবীরা যাবে না কারণ ঘরেই এটাচড বাথ আছে। এই চিন্তা নাকচ করে দিয়ে হাটতে শুরু করলো ইতি। ওদের রুমে গিয়ে দেখে সবগুলো ঘুমে কাদা হয়ে গেছে। এখন আর ওদের ডেকে তুলে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হলো না ইতির। নিজের ঘরে চলে এলো। আসার সময় আবারো পদশব্দ।
কিন্তু পাত্তা দিলো না সে। ঘরে ঢুকেই দরজাটা ভিড়িয়ে দিলে শুয়ে পড়লো, ভেতর থেকে লক করলো না। এখন সমস্ত বাড়িতে পিনপতন নিস্তব্ধতা। লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো ইতি। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো মনে নেই তবে একটা ক্ষীণ গলার আওয়াজে ঘুম ভাঙল ইতির।
-ইতি………(অচেনা গলার আওয়াজ) মনে হচ্ছে বহুদূর থেকে সুর করে কেউ ডাকছে। আশেপাশে তো কেউ নেই আর এই জমাট বাঁধা অন্ধকারে কাউকে দেখাও যাবে না।
-কে? তোরা নাকি? রাতের বেলা আমাকে ভয় দেখাতে এসেছিস?(ইতি) ও ভেবেছি বান্ধবীরা যুক্তি করে ভয় দেখাতে এসেছে ওকে।
-ইতি…….আমি ফিরে এসেছি।
-কে? কে তুমি?(ভয়ার্ত কন্ঠে)
-ইশিতা।(জোরে জোরে আত্মা কাঁপানো হাসি হাসলো মেয়েটা) ইতির হৃৎপিন্ড লাফিয়ে উঠলো নামটা শুনে। তারমানে কালকে এসেছিলো ইশিতা?
-ইশিতা! তুমি ফিরে এসেছ মানে? কি তোমার পরিচয়?
-আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। কিন্তু কষ্ট সহ্য করার জন্য প্রস্তুত হও।
-আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কেন এসেছ তুমি?
-এই আয়নার ভেতরে আমার আত্মা আটকা পরে ছিলো ত্রিশ বছর ধরে, তুমিই আমাকে এই জগতে ফিরিয়ে এনেছ ইতি। আমি জানতাম একমাত্র তুমিই পারবে আমাকে মুক্ত করতে।
-আমি বিশ্বাস করি না। তুমি ইশিতা নও।
-কেন দেখতে চাও আমাকে? তাহলে বিশ্বাস হবে তো?
-দেখবো। (ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে ইতির। ওর অসতর্কতার জন্যই এমন হলো।) -আয়নার দিকে তাকাও ইতি। ইতি আয়নার দিকে তাকালো। আলোকিত হয়ে উঠেছে জায়গাটা। এবার আর আয়নার ভেতরে নয় আয়নার বাইরে সেই ভয়ংকর বীভৎস মেয়েটা দাঁড়িয়ে হাসছে। চিৎকার করে উঠলো ইতি। বান্ধবীদের ডাকলো। আর ওদিকে আয়নার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ইশিতার হাসির শব্দ বেড়েই চলেছে।
-চিৎকার করো। আরো জ্বরে, আরো….তোমার চিৎকার কেউ শুনবে না,কেউ না। আমার চিৎকারও কেউ শোনেনি সেই দিন। কেঁদে ফেললো ইতি। আমি তো তোমাকে মুক্তি দিয়েছি তাহলে আমার সাথে কেন এমন করছো? ছেড়ে দাও।
-এতো সহজে ছাড়া পাবে না। কই আমার প্রতি তো সামান্যতম দয়া দেখানো হয়নি?
-তুমি কিসের কথা বলছ? আমি তোমার সাথে কিছুই করেনি। তুমি চলে যাও। আর কখনো তোমাকে ডাকবো না। অসহায় ভাবে কাঁদছে আর মিনতি করে চলেছে ইতি। বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা।
-তুমি আমার সাথে কিছুই করোনি বরং আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার কাজ শেষ না করে আমি ফিরবো না। তোমাকে এখন আজ থেকে ত্রিশ বছর পূর্বে ঘটা একটা কাহিনী শোনাই। তুমিই বলবে সেটা ঠিক ছিলো কিনা।
-তুমি যা ইচ্ছে বলো তবুও আমাকে মেরো না।
-হা হা হা………প্রাণ ভিক্ষা! তুমি হয়ত ভুলেই গিয়েছ এই আয়নাটা যখন তুমি কিনতে গিয়ে ছুঁয়েছিলে তখন একটা মুখ তুমি সামান্য সময়ের জন্য দেখতে পাও?
-এখন মনে পড়েছে। আমি ভুললাম কিভাবে?
-আমি ভুলিয়ে দিয়েছিলাম তাই। তুমি আয়নাটা ধরার সাথে সাথেই আমি বুঝতে পারি তুমি কে। আমি এই ত্রিশটা বছর তোমার জন্যই অপেক্ষা করেছি। ইতি অবাক হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার প্রতিটা কথা শুনে। কান্না থামিয়ে ইতি জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমাকে আগে থেকেই চেনো?
-তোমার রক্তকে চিনি! তোমাকেও চিনি! এতো ভয়ের মধ্যে থাকা শর্তেও ইতির কৌতুহল হচ্ছে। কি বলছে এসব ইশিতা।
-আমি তোমার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না।
-শুনতে থাকো, বোঝার সময় হলেই বুঝবে।
-এই আয়নাটা তো আমাদের বাড়ির কিন্তু তুমি এর ভেতরে ঢুকলে কিভাবে?
-ঢুকতে বাধ্য হয়েছি। (ক্ষোভের সাথে) তোমরা যার দোকানে আয়না কিনতে গিয়েছিলে সে আসলে একজন প্রেতসাধক। কালো জাদু তার জীবিকা।
তারকাছে লোকজন আসে তাদের শত্রুকে শেষ করার জন্য সাহায্য চাইতে। অ্যান্টিকের দোকানের নাম করে ভয়ংকর জীবন-মরণের ব্যবসা করে যাচ্ছে লোকটা। তবে আমি তার প্রতিও কৃতজ্ঞ। তার একজন সহযোগী আছে যে তার দোকানের ঠিকানা মানুষকে দেয়, ঠিক যেরকম মিলুর ভাইকে দিয়েছিলো। আমি জানতাম নতুন দোকানের ঠিকানা পেলে তুমি অবশ্যই আসবে। আবাক হয়ে শুনছে ইতি।
-আয়নাটা প্রেত সাধকের কাছে আসলো কিভাবে?
-তোমার বাবা আয়নাটা বিক্রি করে দেয় পুরনো আসবাবপত্রের দোকানে। সেখান থেকে আয়নাটা অ্যান্টিকের দোকানের লোক কিনে নেয়, সে যেহেতু প্রেত সাধক সেহেতু সে বুঝতে পারে আয়নার মধ্যে কোন অতৃপ্ত আত্মার বাস। কালো জাদুর মাধ্যমে আমাকে ডেকে নিয়ে আসে লোকটা। আমি তাকে সবকিছু খুলে বলি। লোকটা আমাকে প্রস্তাব দেয় আমি যদি তার হয়ে কাজ করে দেই তাহলে সে আমাকে আমার অতৃপ্ত বাসনা পূরণ করতে সাহায্য করবে। আমি রাজি হয়ে যাই কারণ আমার সাথে যা হয়েছে তা ভালো ছিলো না।
প্রতিশোধ স্পৃহা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আমাকে আস্তে আস্তে এই ত্রিশটা বছর ধরে ভীষণ শক্তিশালী করে তোলে উনি।আমি অনেক লোকের ক্ষতি করেছি শুধু আজকের এই দিনটার জন্য, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। কালরাতে তুমি যখন আমাকে ডেকেছ তখন মোমবাতি নেভার সাথে সাথেই আমি এসেছি,কিন্তু তখন তোমাকে দেখা দেওয়ার সঠিক সময় ছিলো না। তুমি আর ঘরের আলো জ্বালালে না, অবশ্য আলো জ্বালালেও আমি যেতাম না কারণ আমি শক্তিশালী আত্মা।
-এখন তুমি কি চাও? আমাকে মেরে ফেলো না।
-তোমাকে মারার কোন ইচ্ছে আমার নেই। তোমাকে এবার আসল ঘটনা বলবো। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে আমি ছিলাম রক্ত মাংসের মানুষ। খুব গরীব ঘরের মেয়ে ছিলাম আমি, অভাব অনটনের মধ্যে বড় হয়েছি। লেখাপড়া বেশিদূর করতে পারিনি। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পরে বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দেন। তবে আমার স্বামীর পরিবার ছিলো খুব ধনী। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি নিজে আমাকে পছন্দ করেন। আমি গরীব, অল্প লেখাপড়া জানা হওয়া সত্ত্বেও তাদের ডাক্তার ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দেন আমার শান্ত স্বভাব আর আচার-ব্যবহারের জন্য। একরাশ স্বপ্ন নিয়ে আমি শ্বশুবাড়িতে আসি।
প্রথম তিন বছর খুব সুখে কাটলো, স্বামীও আমাকে অনেক ভালোবাসতো। কিন্তু সুখ বেশিদিন সইলো না আমার কপালে। স্বামী খারাপ ব্যবহার করা শুরু করলো। পাঁচ বছরের মাথায় শ্বশুর-শাশুড়ি গত হলেন। স্বামীর দুর্ব্যবহার বাড়লো। আগে শ্বশুর-শাশুড়ি ছিলেন বলে বেশি কিছু বলতে পারতো না কারণ আমি তাদের মেয়ের মতো ছিলাম। তার উপর আমি ছয় মাসের গর্ভবতী। আমার মেয়ে হওয়ার কথা ছিলো। একসময় জানলাম আমার স্বামীর অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে, সে মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। আমার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত। তারা নাকি বিয়েও করবে শুনলাম। ইতি তুমি কি জানতে চাও আমার স্বামী কে?
-কে?
-তোমার বাবা! বিখ্যাত ডাক্তার তানজীম আহসান।
-তুমি কি বলছ? এটা কখনো হতে পারে না। আমার বাবা খুব ভালো মানুষ।(কাঁদছে)
-ইতি শান্ত হও। বাকিটা শোনো তাহলে বুঝতে পারবে তোমার বাবা আসলে ভালোর মুখোশ পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। -এতোকিছুর পরেও আমি তাকে কিছুই বলতাম না। ও তোমাকে বলা হয়নি আমি তোমার ঘরেই থাকতাম আর এই আয়নাটাও এই ঘরেই লাগানো ছিলো। একদিন রাতে তোমার বাবা আমাকে একটা কাগজ দিয়ে বললো সাইন করে দিতে। হাতে নিয়ে দেখলাম ডিভোর্স পেপার।
এই প্রথম আমি তার বিরুদ্ধে কথা বললাম।কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না ডিভোর্স দিতে শুধুমাত্র আমার অনাগত সন্তানের মুখে চেয়ে। আমি একা হলে ডিভোর্স দিয়ে চলে যেতাম। অনেক বোঝালাম তাকে। সে আমাকে বললো ডিভোর্স দেওয়ার সাথে সাথে গর্ভপাতও করাতে হবে কারণ যদি বাচ্চাটার কথা তার সেই ভালোবাসার মানুষ মানে বর্তমানে তোমার মা যদি জানতে পারে তাহলে তোমার বাবাকে কিছুতেই বিয়ে করবে না। তোমার মাকে কিছু না জানিয়েই তার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে গেছে তোমার বাবা, তাই তোমার মায়ের কোন দোষ নেই, তার উপর আমার কোন রাগও নেই। গর্ভপাতের কথাটা শুনে পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো। যে আমার শরীরের অংশ তাকেই মেরে ফেলবো? মা হয়ে আমি তা কিভাবে করি?
রাজি হলাম না। ডিভোর্স দিয়ে চলে যেতে চাইলাম আর আমার বাচ্চাটার প্রাণ ভিক্ষা চাইলাম। তোমার বাবা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। ডাক্তার তো মানুষকে সুস্থ করে কিন্তু তোমার বাবার মাথায় আসলো এক ভয়ংক নীল নক্সা। রেগে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো মেঝেতে। ব্যথায় চিৎকার করলাম। একটু সাহায্য চাইলাম ওঠার জন্য। কিন্তু সেই নির্দয় পিশাচটা আমার কথা শুনলো না।
আমার পেটে লাথি মারতে থাকলো। আমি অনেক বোঝাতে চেষ্টা করলাম আমার বাচ্চাটা তো কোন দোষ করেনি, আর এটা তো তারও বাচ্চা, ওর জন্য বার বার প্রাণ ভিক্ষা চাইলাম ঠিক তুমি যেমন আমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছ। বিছানার কাছে আমার ফলের ঝুড়ি আর ফল কাটার ছুড়ি ছিলো, তোমার বাবা সেটা হাতে নিলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম কি ঘটবে। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে পিছাতে লাগলাম আর এই আয়নার সামনে এসে ঠেকে গেলাম। ব্যথার নড়ার উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও ছিলো না।
তোমার বাবা কাছে আসতেই তার পায়ে ধরে বললাম,”আমাকে আর আমার সন্তানকে বাঁচতে দাও। আমি অনেক দূরে চলে যাবো ওকে নিয়ে, আমার কথা কেউ জানবে না।” তোমার বাবা বললো,”শত্রুর যেমন বাঁচিয়ে রাখা ঠিক না ঠিক তেমন তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা বিপদজনক।” ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার পরিকল্পনা করেই রেখেছিলো শয়তানটা। আমার হাজার প্রাণ ভিক্ষা উপেক্ষা করে আমার পেটে ছুড়ি বিধিয়ে দিলো। আমার স্বত্বা, আমার সন্তান, আমার মেয়েটাকে আমার ভেতরে থাকতেই মেরে ফেললো।
মৃত্যু যন্ত্রণা কত কষ্টের তা কেবল মৃত্যু পথযাত্রীই বুঝতে পারে। এতসব কষ্ট ছাপিয়ে আমার অনাগত মেয়েটার জন্য প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিলো। আমি মরে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার বাবা আমাকে কষ্ট দিয়েছে। একফোঁটা পানি পর্যন্ত আমার মুখের সামনে ধরেনি। ছটফট করতে করতে জীবনের যবনিকাপাত ঘটেছে আমার আর আমার বাচ্চাটার। নিশ্চয় ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলো বাচ্চাটা। সেই কষ্ট আমি আমার মর্মমূল দিয়ে, মাতৃ মন দিয়ে উপলব্ধি করেছি। মৃত্যু যন্ত্রণার এক পর্যায়ে আমি অভিশাপ দেই তোমার বাবাকে।
“আমি আবার ফিরে আসবো। তুমি বেঁচে থাকতেই ফিরে আসবো। তোমার সবথেকে প্রিয় জিনিস হারানোর বেদনা তোমাকে বুঝিয়ে দেবো,শান্তিতে থাকতে দেবো না। আমি এই ঘরে মৃত্যুর সময়ে অভিশাপ দিলাম তোমাকে, এই ঘরেই আমি ফিরবো। আমার সন্তানকে তুমি বাঁচতে দাওনি, আমি তোমাকে শাস্তি দিতে আসবো।” এই কথা শুনে তোমার বাবা আরও কষ্ট দিলো আমাকে। তার অপারেশনের জন্য কেনা নতুন যন্ত্রপাতি বাড়িতে ছিলো।
তারমধ্যে থাকা কাঁচি দিয়ে অভিশাপ দেওয়ার জন্য আমার ঠোঁট কেটে দিলো। বাচ্চার কাথা সেলাই করার সূচ বিঁধিয়ে দিতে লাগলো আমার হাতে,পায়ে, মুখে। চিমটা দিয়ে আমার দুইচোখ বের করে ফেললো। আমি আর প্রাণবায়ু ধরে রাখতে পারলাম না। এই ঘরে এই আয়নাটার সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লাম আমি আর আরেকটি নতুন প্রাণ। আমার লাশটা তোমাদের বাড়ির পেছনে বড় আম গাছের পাশে পুতে রাখা আছে। আমার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তোলেনি কারণ টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলো মানুষরূপী পিশাচ। কিছুক্ষণ থেমে আবারো বলতে শুরু করলো ইশিতা।
তোমার মতোই আমি আয়নায় নিজেকে দেখতে পছন্দ করতাম। দিনের অনেকটা সময় এই আয়নার সামনে কাটতো আমার। তাই আমার অতৃপ্ত আত্মা এই আয়নায় বন্দি হয়ে যায়। আমার পৃথিবীতে ফিরে আসার পথ এই আয়না আবার পৃথিবী থেকে নিজের জগতে ফিরে যাওয়ার পথও এই আয়না। সেই থেকে আমি অপেক্ষার প্রহর গুণেছি, কবে শাস্তি দিতে পারবো তোমার বাবাকে। তোমার বাবা আয়নাটাকে ভয় পেতো কারণ আমি রাতে তাকে ভয় দেখাতাম আয়নায় এসে। তাই সে আয়নাটা বিক্রি করে দেয়।
এখনো তুমি বলবে তোমার বাবা ভালোমানুষ? ইতি কথা বলতে ভুলে গেছে। যে বাবাকে এতো শ্রদ্ধা করতো,ভালোবাসতো কিন্তু সেই মানুষটা দুজনকে খুন করেছে। মেয়ে হিসাবে এটা জানতে পারা কত দুঃখের,লজ্জার। অনেকক্ষণ চুপ থেকে হু হু করে কেঁদে ফেললো ইতি। শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলো এতক্ষণ। -আমি আজ থেকে বাবাকে ঘৃণা করি। মানুষ কতটা খারাপ এরকম একটা কাজ করতে পারে। আমার ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে এই মানুষটা আমার বাবা আর যাকে কিনা আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা ভেবে এসেছি এতদিন। যে নিজের সন্তানকে হত্যা করতে পারে তার বাবা হওয়ার কোন যোগ্যতা নেই।
তোমার সাথে চরম অন্যায় করা হয়েছে। কিন্তু তুমি তার শাস্তি স্বরূপ আমাকে মেরো না। আমি আর আমার মা তো নির্দোষ, মা এসব কিছু জানে না। -ইতি আমি তোমাকে মারবো না, তোমার মাকেও কিছু করবো না। আমি ইচ্ছা করলে তোমার বাবাকে মেরে ফেলতে পারি। কিন্তু আমি সেটাও করবো না। আমি তাকে এমন কষ্ট দেবো যেরকম সে আমাকে দিয়েছিলো। সন্তান হারানোর যন্ত্রণাটা আমি তাকে বোঝাতে চাই। আমার সন্তানকে সে পৃথিবীর আলো দেখতে দিলো না। এখন সে বুঝবে সন্তান থাকা সত্ত্বেও তাদের মুখে বাবা ডাক না শোনা, তাদের ভালোবাসা না পাওয়ার কেমন যন্ত্রণা। সন্তানের কষ্টে কেমন কষ্ট সেটাও হারে হারে বুঝবে।
-তারমানে তুমি কি করবে?
-আমি তোমার মাধ্যমে তোমার বাবাকে বোঝাবো সন্তানের কষ্টে কেমন লাগে। তোমার বাবা এর জন্য দায়ী। তোমাকে না মারলেও সবসময় শঙ্কার মধ্যে রাখবো তোমার বাবাকে। সবাই ভাববে কেউ তোমাকে মারতে চায়,কিন্তু আমি তোমাকে মারবো না বরং মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে ফিরিয়ে আনবো। আমার হাতে তোমার মৃত্যু নেই। তুমি আর নিজের মধ্যে থাকবেনা, আমি তোমাকে দিয়ে যা বলাবো সেটাই তুমি বলবে। তবে হ্যা আমি সবসময় তোমাকে ভর করবো না,কিছুসময়ের জন্য তুমি নিজস্ব সত্ত্বায় থাকবে কিন্তু তুমি কাউকে বোঝাতে পারবে না তোমার কি হয়েছে। ইতি কথাটা শুনে ভয়ে শিটিয়ে গেলো। কান্না বেড়ে গেলো।
-তুমি চলে যাও। আমি মানছি তোমার সাথে খারাপ হয়েছে কিন্তু আমাকে কেন তুমি তোমার প্রতিশোধের অংশ হিসাবে নিচ্ছো?
-আমার সত্যিই কিছু করার নেই ইতি। তুমি ‘আয়না বলয়ে’ প্রবেশ করেছো! ত্রিশ বছর আগে আমিও এভাবে কেঁদেছিলাম আমার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু….. যাই হোক তুমি যেহেতু আমাকে মুক্ত করেছ তাই তোমার জন্য একটা সুযোগ থাকবে ‘আয়না বলয়’ থেকে বের হওয়ার।
-আয়না বলয়! কিভাবে বের হবো আয়না-বলয় থেকে? কতদিন পর?
-কতদিন লাগবে তা আমি বলতে পারবো না। যদি কেউ এসে এই বলয় ভেঙে ফেলে তাহলে তুমি আয়না বলয় থেকে মুক্তি পাবে আর আমিও এই পৃথিবী থেকে অন্য জগতে চলে যাবো। এই বলয় না ভাঙা পর্যন্ত আমি তোমার সাথেই থাকবো ইতি। আমি আয়না থেকে মুক্তি পেয়েছি ঠিকই তবে আমার আত্মার মুক্তি হয়নি, যেদিন বলয় ভেঙে যাবে সেদিন আমার আত্মা পুরোপুরি মুক্তি পাবে আর ততদিনে আমার প্রতিশোধ নেওয়া পূর্ণ হয়ে যাবে। -আয়না-বলয় ভাঙতে কিভাবে হবে? বলে দাও?
ইতির প্রশ্নের জবাব না দিয়েই ইতির দেহের মধ্যে মিশে গেলো ইশিতার ছায়ামূর্তি!
পরদিন সকালঃ ইতির বান্ধবীরা ইতিকে অজ্ঞান অবস্থায় পায়। অনেক চেষ্টা করার পর ইতির জ্ঞান ফেরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর বান্ধবীরা লক্ষ্য করে ইতি অস্বাভাবিক আচরণ করছে। ইতির বাবা-মাকে খবর দেওয়া হয়। তারা অনেক চেষ্টার পরেও ইতি স্বাভাবিক হয় না। ওই ঘটনার পর বিগত পাঁচবছর ইতিকে আর স্বাভাবিক দেখা যায়নি। আয়না দেখেই ভয় পায়। চেঁচামেচি করে। বলে-তুমি চলে যাও।
আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে সব আয়না সরিয়ে ফেলা হয়। ইতির ঘরের সেই সুন্দর দেওয়াল আয়নাটা আবারো বিক্রি করে দেওয়া হয়। ইতি ওর বাবাকে দেখলেই তেড়ে আসে মারার জন্য আর আজেবাজে কথা বলে। ওর বাবা কখনো ভাবতেও পারেনি তার মেয়ে তার সাথে এরকম করবে। মন ভেঙে যায় তানজীম আহসানের। মেয়ের শোকে দুইবছর পরে তার হার্টে সমস্যা ধরা পড়ে। বড় ছেলের সাথেও সম্পর্কে ভাঙন ধরে। বেঁচে থেকেও সুখে নেই ইতির বাবা। ইশিতা তার নিজের এবং সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পেরেছে।
এই হলো পাঁচ বছর আগের সেই পুরনো অতীত যা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে ইতি। ত্রিশ বছর আগের ঘটনাও জানা গেলো যা এই কাহিনীর মূল। ইশিতার প্রতিশোধ নেওয়া হলেও কাটেনি আয়না-বলয়! অতীতের কুহেলিকা তো কাটলো এবার ফিরে আসি বর্তমানে। ইতি এখন কষ্টে,ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। আগে মাথা তুলে বসে থাকতে পারতো কিন্তু এখন সবসময় মাথানিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে কারণ মাথাতুলে তাকালে দেখতে পায় এক রক্তাক্ত মৃত শিশু। ইতি যে একবার রাতে উঠে ছাদে চলে গিয়েছিলো তা নিজের ইচ্ছেয় নয়, গিয়েছে ইশিতার মায়াজালে পড়ে। জিনিসপত্র ছোড়াছুঁড়ি করে ইশিতার নির্দেশে। আয়নার সামনে যেতে ভয় পায় কারণ আয়নায় ইতি নিজেকে দেখতে পায় না আর, আয়নার দিকে তাকালেই দেখতে পায় ইশিতাকে হত্যার দৃশ্য অথবা ইশিতার বীভৎস মুখ। যখন ইশিতার আত্মা ওর ভেতরে প্রবেশ করে তখনই চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। আর বাবাকে গালাগালি করে, মারতে যায় নিজস্ব সত্ত্বা থেকে। ভীষণ ঘৃণা হয় বাবাকে দেখলে ওর।
ইতির মধ্যে এখনও নিজস্ব বোধ কাজ করে কিন্তু তা বুঝতে পারে না কেউ কারণ অদৃশ্য আয়না বলয়ে বন্দী সে! কেউ জানে না বোঝে না ইতি কেন এরকম করে, এই রহস্য অজানাই রয়ে গেলো ইতির কাছের মানুষ গুলোর কাছে। জানে শুধু একজন, সে হলো ইতির বাবা।
ইতি অস্বাভাবিক হওয়ার তিন বছর পর ইতির বাবা স্বপ্নে দেখতে পায় কেন তার মেয়ের এই অবস্থা। ইশিতা স্বপ্নে তাকে বলে,”দেখো কেমন লাগে সন্তানের কষ্টে।” নিজের পাপের ফল এভাবেই ভোগ করতে হচ্ছে তাকে। তবে এই কথা সে বলতে পারে না কাউকে, বললে যে তার পাপ সবার সামনে চলে আসবে। এখন মেয়ের এই পরিণতি নিজের চোখের সামনে দেখা ছাড়া কোন উপায় নেই তার। এভাবেই পাপীরা তাদের পাপের শাস্তি পায়। পাপ করলে শাস্তি অবশ্যম্ভাবী।
অতৃপ্ত আত্মার মনে থাকা প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেলেও এখনো বলয় থেকে বের হতে পারেনি ইতি। হ্যা, আয়না বলয় থেকে বের হওয়ার উপায় অবশ্যই আছে। দূরের এক কুটিরে বসে কেউ একজন বহুদিন ধরে তন্ত্র সাধনা করে চলছে আয়না বলয় ভাঙার জন্য। হয়ত একসময় সে পৌঁছে যাবে ইতির কাছে ভেঙে ফেলবে আয়না বলয়, মুক্ত হবে ইশিতা সহ অতৃপ্ত আত্মার দল, মুক্তি পাবে ইতি। পদার্পণ করবে স্বাভাবিক জীবনে!
…………………………………………………………………….সমাপ্ত…………………………………………………………