আজ অফিসে একটু দেরী করে পৌঁছেছি। গিয়ে দেখি বস এখনো আসেন নি। ভাগ্যটা ভালো,নইলে আজকেও ওনার ঝাড়ি খেতে হতো। বস আসেননি তাই সবার কাজের মধ্যেই একটা ঢিলেঢালা ভাব দেখতে পাচ্ছি। প্রতিদিনের মত ডেস্কে ব্যাগটা রেখে নিশ্চিন্তে চেয়ারে বসে একটু দম নিলাম।
আমার ডানপাশের ডেস্কটা আমার ভার্সিটি লাইফের বন্ধু আর এখনকার কলিগ তনয়ের। তনয় ওর মুখের সামনে পত্রিকা উঁচু করে ধরে আছে,তাই আমায় দেখতে পায়নি। পত্রিকাটা আজকের কিনা বলা যাচ্ছেনা। কারন ওর পুরনো পত্রিকা পড়ার অভ্যাস আছে। তবে খবর পড়ার জন্য নয়,রাশিফল দেখার জন্য। ব্যাটা রাশিফলের মত ফালতু একটা বিষয় এত কেন পছন্দ করে বুঝিনা। কাজের ফাঁক পেলেই রাশিফল নিয়ে বসে যায় ও।ওর ধারনা ওতে প্রতিদিনকার যে ভাগ্যের বিবরণ লেখা থাকে তা সত্যি। অনেক সময় নাকি তনয়ের রাশিফলে লেখা ভবিষৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে।
কাকতালীয় বলে যে একটা ব্যপার থাকতে পারে সেটা ওকে কোনকালেই বোঝাতে পারিনি। শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছি। যে যে যার যার বিশ্বাস নিয়ে পড়ে থাকবে। কিছুকিছু ক্ষেত্রে তাতে বাধা দেয়াটা নিতান্ত দায়িত্ব বলে মনে হলেও মাঝেমধ্যে পিছু হটে আসাটাই ভালো। কি দরকার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর?
বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে সাধারণ মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে লেখক,টিভি ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা,খেলোয়াড় ইত্যাদি। আর তনয়ের পছন্দের তালিকায় ছিলো প্রাচীনকালের এক বিখ্যাত জ্যোতিষী নস্ট্রাডামুস। তিনি নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, নেপোলিয়নের পরাজয়, লন্ডনের অগ্নিকান্ড ও কম্পিউটারের আবির্ভাব সম্পর্কে ভবিষৎবাণী করে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সব নাকি ফলে গেছে।
তনয়কে অবশ্য আমি দোষ দিইনা। কারন এস্ট্রোলজি আর হরোস্কোপ ওর রক্তে আছে। শুনেছি ওর দাদু নাকি এককালে বিরাট জ্যোতিষী ছিলেন। রাশি দেখে ভাগ্য গণনা করতে পারতেন। সে গণনা ঠিকঠিক ফলে যেতো। ভদ্রলোক ভালোই পসার জমিয়েছিলেন সেসময়। তখন ওরা কোলকাতায় থাকতো। কিন্তু কি যেন একটা ব্যপার নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় শেষে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়। ওখানকার বাড়ি, গাড়ি, জমিজমা সব বিক্রি করে দিয়ে একেবারে দেশান্তর যাকে বলে। আত্মীয়স্বজন তেমন ছিলোনা ওখানে। যারা ছিলো তারা বিপদের সময় কোন কাজে আসেনি। তনয়ের দাদু কি বিপদে পড়েছিলেন তা তনয় নিজেও ঠিকমতো জানেনা।
কিন্তু এদেশে আসার পর দাদু নাকি প্রায়ই বলতেন “রাশি বড় সর্বনাশী “!
সম্ভবত ভাগ্য গণনা নিয়ে কারোর সাথে ঝগড়া-টগড়া হয়েছিলো। অনেকেই জানেনা কিন্তু এ ব্যবসায় মোটা অঙ্কের টাকাপয়সার লেনদেন ব্যাপক হারে চলে। হয়তো ওসব নিয়েই গণ্ডগোল বেঁধেছিল। অন্তত তনয়ের সেরকমই ধারনা।
বাংলাদেশে আসার পর নাকি দাদু জ্যোতিষীগিরি ছেড়ে দেন। যা সহায় সম্পদ ছিলো তা দিয়ে ব্যবসা করা শুরু করেন এবং শেষকালে বেশকিছু টাকা কামিয়ে রেখে যান ওনার একমাত্র ছেলে তনয়ের বাবার জন্য। দাদু যখন মারা যায় তখন তনয়ের বয়স বারো কি চৌদ্দ। নাতিকে দাদু খুব ভালোবাসতেন। মৃত্যুর আগের কয়েকটাদিন ছেলের চাইতে নাতিকে বেশি কাছে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। নাতি ছাড়া অন্য কারো সাথে তেমন কথা বলতেন না। সেবা করার জন্য তার ছেলের স্ত্রী অর্থাৎ তনয়ের মাকেও কাছে আসতে দিতেন না।
শুধু তনয় কে কাছে ডেকে
বলতেন “শুরু যখন করেছি তখন এর শেষ দেখাটা দরকার দাদুভাই,আমি না দেখলেও তুই দেখবি। রাশি বড় সর্বনাশী”!
কিন্তু দাদু কি শুরু করেছিলেন আর কিসের ই বা শেষ দেখতে চান তা বলেননি কখনো। তনয় কে কোন কাজের শেষ দেখতে হবে বলে যাননি। রাশি বা জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে কিছু কিনা কে জানে। হয়তো মরার আগে নিজের আদি পেশার কথা খুব মনে পড়তো দাদুর। তাই রাশির দোষ দিয়েছেন, ওটাকে সর্বনাশী বলেছেন।
তনয় এই নিয়ে মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে আলাপ করতো। দাদুর শেষকালে বলে যাওয়া হেয়ালির মত কথাগুলোর অর্থ জানার খুব ইচ্ছে ছিলো ওর। কিন্তু শেষমেশ আর জানতে পারেনি। সেইথেকে রাশিচক্র নিয়ে ওর এতো গবেষণা।
এই আষাঢ়ে গল্পটা ও প্রায় ই করতো আমার সাথে। কাছের বন্ধু বলে প্রথমদিকে ঠাট্টা করলেও একটা সময় থেকে ওকে বুঝতে না দিয়ে ব্যপারটা এড়িয়ে যাওয়া শুরু করেছি।
আজ হঠাৎ কেন জানি তনয়ের সাথে ঠাট্টা করার ইচ্ছাটা প্রবল ভাবে জেগে উঠেছে। তাই ওর মুখের ওপর রাখা পত্রিকাটা সরিয়ে প্রশ্ন করলাম
“কি খবর নস্ট্রাডামুস এর বংশধর? সব ভালো তো? ”
“খবর ভালো না রে। আজ আমার দুটো রাশির ফলাফল ই খারাপ “!
আমি রাশি সম্বন্ধে ততটা না জানলেও কমপক্ষে এটা জানি যে একজন মানুষের জন্য একটা রাশিই যথেষ্ট।
বললাম “দুটো রাশি মানে? ”
“আর বলিস না। আমার জন্মের মাস নিয়ে বাবা মার মধ্যে ব্যপক কনফিউশন আছে। মায়ের বিশ্বাস আমি এপ্রিল মাসে জন্মেছি তাই আমার রাশি মেষ। আর বাবার ধারনা আমি ডিসেম্বরের আগে জন্মাতেই পারিনা তাই আমার রাশি মকর। তাই আমি পত্রিকায় দেখার সময় দুটো রাশির রাশিফল চেক করি। যাতে মিস না হয়!”
“হুম বুঝলাম। একটা জিনিস খেয়াল করেছিস তোর রাশি গুলোর দুটোই কিন্তুই বেশ ইন্টারেস্টিং। একটার সিম্বল মেষ অর্থাৎ ভেড়া আর অন্যটার মকর অর্থাৎ ছাগল। তুই যে এই দুটো প্রানীর কোন একটার সমগোত্রীয় তা তোর রাশিফল পড়ার ধরন দেখলে বেশ বোঝা যায়। ”
বলে হাসি চাপার চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু পারলাম না। তনয়ের অসহায় মুখ দেখে হাসি আটকে রাখা সম্ভব হলোনা। হাসির দমকে আশেপাশের অফিস স্টাফরা রীতিমত চমকে গেছেন। আমি কোনমতে নিজেকে সামলে নিলাম।
তনয় বললো “এতে এতো হাসির কি আছে? ভেবেছিলাম তোকে একটা জিনিস দেখাবো, মুডটা নষ্ট করে দিলি। ”
“আচ্ছা! আচ্ছা! কি দেখাবি বল?
তনয় একটু শান্ত হয়ে ডেস্কের ড্রয়ার খুলে একটা বাক্সের মত জিনিস বের করলো। জিনিসটা আকারে তেমন বড় নয়। তনয়ের টেবিলে রাখা কফি মগটার সমান হবে। রঙ মিশমিশে কালো। মাঝামাঝি একটা স্ক্রিনের মত জায়গা আছে। তলার দিকে একটা লাল সুইচ আর একটা ধাতব কাটা আছে। সুইচের নিচে ইংরেজিতে কিছু একটা লেখা আছে যেটা এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেনা।
জিজ্ঞেস করলাম” এটা কি রে তনয়?”
“এটা হররস্কোপ! আমার দাদুর আবিষ্কার। আজ সকালে তার ঘর থেকেই পেয়েছি। পুরনো জিনিসের জঞ্জালের মধ্যে ছিলো। সাথে এই যন্ত্র চালানোর একটা ম্যানুয়াল ও আছে। কিভাবে যন্ত্রটা কাজ করে তার বর্ণনা আছে ম্যানুয়ালে।এই দেখ।”
বলে খোলা ড্রয়ার থেকে ছোট নোটপ্যাডের মত একটা জিনিস বের করলো। ম্যানুয়াল হাতে লেখা।দাদু লিখেছেন। জেনে অবাক হলাম এই হররস্কোপ যন্ত্রটাও নাকি দাদুর তৈরি।
“জ্যোতিষী মানুষ যন্ত্র আবিষ্কার করে কিভাবে?”
জিজ্ঞেস করাতে
তনয় বললো “ম্যানুয়ালে তাই লেখা আছে। আমরা বাড়ির কেউই এব্যাপারে জানতাম না। এমনকি বাবাও নয়। এই যন্ত্রের কাজ নাকি ভাগ্য গণনা করা। এই যে লোহার কাটা দেখছিস, ওটা ঘোরালে যন্ত্রের মাঝের স্ক্রিনে বিভিন্ন রাশির সিম্বল দেখা যায়। সব সিম্বল সাদা কাগজের ওপর হাতে এঁকে বানানো হয়েছে। তার ওপর প্লাস্টিকের ঢাকনা বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এটাকে এনালগ স্ক্রিন বলা যায়। ম্যানুয়াল অনুযায়ী কাটা ঘুরিয়ে স্ক্রিনে যে রাশির সিম্বল দেখা যাবে সেই রাশির ভাগ্য জানার জন্য লাল সুইচটা চাপতে হবে। কিন্তু তারপর কিভাবে ভাগ্য জানা যাবে তার পুরো বর্ণনা লিখে যাননি দাদু।
আমি বললাম “যন্ত্রটার নাম হওয়া উচিৎ ছিলো হরোস্কোপ অর্থাৎ রাশিচক্র তার বদলে সুইচের নিচে স্পষ্ট লেখা হররস্কোপ। কেমন ভৌতিক শোনাচ্ছে।ব্যপার কি ? ভুল লেখা কেন? ”
“হয়তো লিখতে গিয়ে ভুল হয়ে গেছে। দেখতেই পারছিস হাতের লেখা। ”
মনে মনে ভাবলাম রাশির রশি গলায় দিয়ে ভালোই আছিস বন্ধু।
মুখে বললাম “যন্ত্রটা খুব অদ্ভুত। সুন্দর ও বটে। জ্যোতিষীরা হাত দেখার বদলে যে মাঝেমধ্যে যন্ত্র ও ব্যবহার করেছে তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন তোর দাদু। এটা কাজ করে কিনা পরীক্ষা করে দেখেছিস নাকি? ”
“না এখনো দেখিনি। তবে আজ ইচ্ছা আছে। ”
বলে যন্ত্রের লোহার কাটা ঘুরিয়ে স্ক্রিনে একটা সিম্বল ফুটিয়ে তুললো। তারপর লাল সুইচটা টিপে দিলো। স্ক্রিনের সিম্বলটা অস্পষ্ট। কোন রাশি সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। দুই বন্ধু যন্ত্রটার দিকে ঝুকে পড়ে সিম্বল বোঝার চেষ্টা করছি তখন হঠাৎ অফিসে একটা হইচই এর শব্দ শোনা গেলো।
কি হয়েছে দেখার জন্য উঠে দাঁড়ালাম দুইজন। দেখি বসের কেবিনের দিকে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে কর্মচারীরা। তাদের হাবভাবে দুঃখের ছাপ স্পষ্ট । কোন দুঃসংবাদ শুনলে যেমন মুখের অবস্থা হয় ওদের মুখটা সেরকম হয়ে রয়েছে। আমরা ভীড় ঠেলে ওদের কাছে গেলাম।
কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই একটা ভয়ানক দুঃসংবাদ শুনলাম। বসের সেক্রেটারি নাকি বসের অফিসে আসতে দেরী হওয়ায় ফোন দিয়েছিলেন বসের নাম্বারে। অনেকবার ফোন দিয়ে না পাওয়ায় বসের স্ত্রীর নাম্বারে ফোন দিয়ে বসকে চাইতেই উনি কান্নায় ভেঙে পড়েন আর জানান বস আর কোনদিন ই অফিসে আসতে পারবেন না । কারন বস খুন হয়েছেন!আর তাকে খুন করেছে তার ই একমাত্র আদরের কন্যা!
বসের মৃত্যুতে অফিসে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। কিছু কিছু স্টাফের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি।
তারা দুঃখ পেয়েছে না খুশি হয়েছে বোঝার উপায় নেই। অনেকেই চাপা গলায় নিজেদের মধ্যে আলাপ করছেন। তাদের আলাপের বিষয়বস্তু বসের খুন সংক্রান্ত। অনেকে বলছে মেয়ে হয়ে বাবাকে খুন করলো কিভাবে? আবার অনেকে বলছে বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া সন্তান হয়তো সামান্য কথা কাটাকাটিতেই বাবাকে খুন করতে দ্বিধা করেনি।
এরকম নানান জল্পনা কল্পনা চলতে থাকলো কিন্তু কারোর মধ্যেই ঘটনাস্থলে যাবার মত কোন লক্ষন দেখলাম না। বসের বাসায় একবার হলেও যাওয়া উচিত সবার। কিন্তু খুনের মত সেনসিটিভ বিষয় বলেই সবার মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করছে। ভাবটা এই যেন তার বাসায় গেলেই আমাদের ওপর খুনের দায়ভার চাপিয়ে দেয়া হবে।
তনয় কে বললাম “তুই যাচ্ছিস তো আমার সাথে? বসের জন্য শেষ এইটুকু তো করতে পারি নাকি?”
ওর মুখ দেখে দ্বিধান্বিত মনে হলেও শেষটায় আমার অনুরোধ ফেলতে পারলোনা। বললো তুই গেলে আমার সাথে যেতে আপত্তি নেই। ”
“যাক!তুই অন্তত এদের মত অমানুষ না।
বস আমাদের এই সংবাদ সংস্থার প্রাণ ছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে বসের খুনের কারনটা জানা আর সেই অনুযায়ী অনুসন্ধান করা আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
তবে এখন গেলে ভীড়ের মধ্যে পড়ে যেতে হবে। বিকেলে একসাথে যাবো। তোকে তোর মেস থেকে পিক করে নেবো। রেডি থাকিস।”
তনয় ছোট করে বললো “আচ্ছা”!
বিকেলে তনয় কে নিয়ে বসের বাসায় গেলাম। ওনার স্ত্রী আমাদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন আর অভিযোগ করলেন যে আমরা ছাড়া অফিসের আর কোন স্টাফ ই আসেনি বসকে শেষদেখা দেখার জন্য। আমরাও দেরীতে এলাম। সবাই এত স্বার্থপর, এত কঠিন হৃদয়ের কিভাবে হয়?
তারপর ভেজা গলায় আপনমনে বলে যেতে লাগলেন
“নিজের মেয়ে যে এভাবে তার বাবাকে খুন করবে সেটাই বা কে জানতো?অথচ বাবা মেয়ের মধ্যে কত ভালো সম্পর্ক ছিলো। কোনদিন কিছু নিয়ে তর্ক পর্যন্ত হয়নি ওদের মধ্যে। সেই মেয়ে কিনা ছুরি মেরে বসলো নিজের বাবাকে?ওকে দুপুরবেলা পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। মা হয়ে আমি কিছুই করতে পারি নি। বাবার লাশ দেখার পর মেয়েটা পাগলের মত হয়ে গেছে। শুধু বলছে “আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো নইলে আমি এটা করতাম না। বিশ্বাস করো নইলে আমাকে মরতে হতো। ”
নিশ্চয়ই আমাদের কোন শত্রুপক্ষ মেয়েটাকে ফুসলিয়ে এই কাজ করিয়েছে।”
ঘোরের মধ্যে একটানা কথাগুলো শেষ করতে না করতেই ওনার গলাটা ধরে এলো। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন উনি।
আমরা দুই বন্ধু উনাকে যথাসম্ভব সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকাটা ঠিক হবেনা। অফিসের কর্মচারীদের দেখলে ওনার বারবার বসের কথা মনে পড়ে যাবে। তাই দ্রুত বিদায় নিলাম আমরা।
মেসে ফিরতে না ফিরতেই খবর এলো বসের স্মরণে অফিস ছুটি ঘোষনা করা হয়েছে প্রায় এক সপ্তাহের জন্য। অন্যান্য সময় অফিস ছুটি হলে খুশি হতাম। কিন্তু এই ছুটিটা কেমন মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছিলো। বস কড়া মেজাজের লোক হলেও ভেতরে ভেতরে ভালো মানুষ ছিলেন। এতদিন একসাথে কাজ করেছি। অথচ এখন তিনি আর নেই। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।
দুদিন পর।সকালবেলা। তনয় ফোন করে আরেকটা দুঃসংবাদ দিলো। আমাদের সংবাদ সংস্থার এডিটর মঈন উদ্দিন নাকি আজ মারা গেছেন। মৃত্যুর কারণটা একদম অপ্রত্যাশিত। মঈন গতকাল ছুটি পেয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলো। ফেরার সময় ওদের বাড়ির পালিত একটা ষাঁড় নাকি হঠাৎ ই পাগল হয়ে যায় আর মঈনের ওপর আক্রমণ করে বসে।শক্তিশালী ষাঁড়ের ধারালো শিংয়ের আঘাতে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যায় মঈনের পেট। তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরেও বাঁচানো যায়নি ওকে। প্রবল রক্তক্ষরণের ফলে সন্ধ্যার মধ্যেই মারা পড়ে মঈন!
বসের মৃত্যুর শোক কাটাতে না কাটাতেই আরেকটা মৃত্যু!তার ওপর অহিংস্র একটা প্রানীর হাতে মৃত্যু!
মঈনকে শেষ দেখা দেখে এলাম অফিসের অনেকে মিলে। বসের মৃত্যুতে এতো লোক আসেনি।
ফেরার সময় তনয় একটা অদ্ভুত তথ্য দিলো আমায়। ওর “হররস্কোপ” যন্ত্রটা নাকি একা একাই কাজ করছে। যন্ত্রের লোহার কাটাটা একদিন পরপর আপনা আপনি ঘুরে স্ক্রিনে ফুটিয়ে তুলছে নানান সব রাশির সিম্বল। তনয় প্রথমে ব্যপারটা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু পরে যখন নিজের চোখের সামনে কাটা ঘুরে যেতে দেখেছে তখন ভয় পেয়েছে। এটা ব্যাটারি চালিত কোন যন্ত্র নয় যে নিজেনিজে কাজ করবে। তাছাড়া কাজের কাজ তো কিছুই করছেনা। এই যন্ত্রের কাজ হলো ভাগ্য গণনা করা। কিন্তু তারবদলে শুধু কাটা ঘুরিয়ে সিম্বল পরিবর্তন করে কি লাভ?আমি পরে একদিন যন্ত্রটা নিজের কাছে রাখবো ভাবছি। দেখবো কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটে কিনা। এখন মনটা বিক্ষিত। পরপর দুটো মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন। তাও আবার কাছের মানুষগুলোর মৃত্যু।
পুরনো ক্ষত মুছতে না মুছতেই আরো দুটো মৃত্যুর খবর এলো পরের দুদিনে!
এরাও অফিস স্টাফ। এদের মৃত্যুর কারন ও অদ্ভুতুড়ে! প্রায় পাগলের মত মনে হচ্ছিলো নিজেকে। কি এক অজানা অভিশাপ যেন এক এক করে শেষ করে দিচ্ছে আমাদের অফিসের কর্মচারীদের!বসের মৃত্যু দিয়ে মৃত্যুর ছায়া নেমে এসেছে। সেই ছায়া ধীরেধীরে গ্রাস করছে সবাইকে।
এবার যারা মারা গেছে তাদের একজনের নাম গোলাম মাওলা। অন্যজনের নাম রাকিব হোসেন। গোলাম মাওলা অফিসের প্রিন্টিং সেকশনের প্রধান ছিলেন।
ঘটনার দিন রাত্রে তিনি একটা কাজ সেরে বাসার দিকে ফিরছিলেন। বাসায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যে আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছাবেন।কিন্তু রাত গভীর হয়ে যাবার পরেও যখন উনি ফেরেন নি তখন ওনার পরিবারের সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন।ফোনে ও পাওয়া যাচ্ছিলোনা।তাই তারা ঠিক করেন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখবেন নইলে পুলিশে খবর দেবেন। কিন্তু সকালে ওনার স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে বাসার বাইরে গন্ডগোলের শব্দ শুনে বাইরে এসে দেখেন এক বীভৎস দৃশ্য। ওনার স্বামী গোলাম মাওলা সাহেবের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পড়ে রয়েছে তার ই বাসার সামনে। দ্রুত পুলিশকে খবর দেয়া হলো। পুলিশ বললেন একাজ মানুষের নয়। ফরেনসিক রিপোর্টে এলো অবিশ্বাস্য এক তথ্য!কোন হিংস্র প্রাণীর আক্রমনে গোলাম মাওলার মৃত্যু হয়েছে!প্রানীটার গায়ের লোম নাকি তারা সংগ্রহ করেছেন। লোমটা সিংহের কেশরের লোমের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। কিন্তু শহরে সিংহ আসবে কোথা থেকে? কোনভাবে এলেও ঝকঝকে আলোর মধ্যে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করবে কিভাবে? আর অন্য কারোর জখম হওয়ার কোন খবর তো কোথাও পাওয়া যায়নি।এসব হচ্ছেটা কি?
দ্বিতীয় জন অর্থাৎ রাকিব হোসেন,যিনি আমাদের অফিসের রিপোর্টার ইউনিটের একজন সদস্য ছিলেন তার মৃত্যুটাও অবাক করার মত। মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে উনি নাকি উনাদের স্টোররুম পরিষ্কার করছিলেন। সেখানে পুরনো আমলের নানা জিনিসপাতি রাখা ছিলো। দেয়ালের সাথে লাগোয়া সেলফের ওপর সাজানো ছিলো সেই আদ্যিকালের তামার বাসনকোসন। সেই সেলফের এককোনায় ছিলো একটি ভারী পিতলের কলস। সেলফ পরিস্কার করার সময় সেই ভারী কলস সরাসরি এসে পড়ে রাকিবের মাথায়। সাথে সাথে মাথা ফেঁটে যায়। ঘন্টাখানেক পর মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় তার!
চার চারটে মৃত্যু দেখার পর জীবনের প্রতি হঠাৎ করে যেন মায়া বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমিও বেশীদিন বাঁচবোনা। এই অফিসের কেউই বাঁচবেনা। কোন এক অশুভ আত্মা একের পর এক মৃত্যুর পয়গাম নিয়ে আসছে। কি অভিনব তার উপায়!কত নৃশংস সে! কত অদ্ভুত তার প্রাণহরা পদ্ধতি!
অফিস খোলার আর একদিন বাকি। তনয় আর আমি ওর বাসায় চুপচাপ বসে আছি। বলাই বাহুল্য কারোর মন ভালো নেই। তনয়ের হাতে ওর “হররস্কোপ” যন্ত্রটা ধরা রয়েছে। যন্ত্রটা নাকি আগের মতই সিম্বল বদলাচ্ছে ঠিক চব্বিশ ঘন্টা পরপর। এই অদ্ভুত ঘটনা প্রায় সয়ে এসেছে ওর। এখন যন্ত্রের স্ক্রিনে ভাসছে একটা নতুন সিম্বল।
বারোটার রাশির ঠিক কোনটা এটা? জিজ্ঞেস করলাম আমি?
“এটা কুম্ভ রাশির সিম্বল! এই যে দেখতে পারছিস একটা প্রাচীন কলসের মত দেখতে। ”
তনয়ের কথাটা শেষ হতে না হতেই একটা ব্যাপার বিদ্যুৎের ঝলকের মত মাথার ভেতর খেলে গেলো। যদিও আমি শতভাগ নিশ্চিত নই তবুও মনের মধ্যে যে প্রায় অসম্ভব একটা ব্যপারের খোলাসা হচ্ছে তা যাচাই করে দেখা দরকার।
তনয় কে বললাম “আমাদের অফিসের ওয়েবসাইটে সব স্টাফদের জন্মতারিখ পাওয়া যাবে? ”
“যাবে না কেন? চাইলে বসের জন্মতারিখ ও জানতে পারবি। কিন্তু কি দরকার? ”
“তুই ওয়েবসাইটে ঢুকে পর এক্ষুনি।বস থেকে শুরু করে সকল কর্মচারীর জন্মতারিখ চাই আমার। আর আমাকে আজকের পত্রিকার রাশিফলের পেজটা বের করে দে। ”
তনয় কথামতো ওর কম্পিউটার থেকে অফিসের ওয়েবসাইটে ঢুকলো। জন্মতারিখের তালিকা বের করতে কিছু সময় লাগলো। আমার হাতে রাশিফলের পেজ। ওখানে কোন মাসে জন্মগ্রহণ করলে কোন রাশির অধিকারী হওয়া যায় তার বর্ণনা আছে।
প্রথমেই বসের জন্মতারিখের সাথে তার রাশি মিলিয়ে দেখতেই বিস্ময় আর ভয় আমাকে একসাথে জাপটে ধরলো!বসের রাশি কন্যা। আর তার মৃত্যু হয়েছে নিজ কন্যার হাতে!
তালিকা ধরে মৃত ব্যক্তিদের জন্মতারিখের সাথে রাশি মিলিয়ে দেখলাম আমার অদ্ভুত ধারনাটাই সত্যি।
এডিটর মঈনের রাশি ছিলো বৃষ অর্থাৎ ষাঁড়। ষাঁড়ের হাতেই ওর মৃত্যু ঘটেছে!গোলাম মাওলার রাশি সিংহ। যেভাবেই হোক যেখান থেকেই আসুক একটা সিংহের হাতে যে ওনার মৃত্যু হয়েছে সে ব্যপারে নিশ্চিত হলাম!আর সর্বশেষ মৃত অর্থাৎ রাকিবের রাশি কুম্ভ অর্থাৎ কলস। পিতলের কলস মাথায় পড়ে ও মারা গেছে!
যার যে রাশি সে রাশির সিম্বলের মাধ্যমে মারা পড়েছে ওরা।
বসের মেয়ের বলা একট কথা মনে পড়ে গেলো হঠাৎ
ও নাকি নির্দেশ পেয়েছিলো বাবাকে হত্যা করার জন্য! নইলে নাকি ওকে মরতে হতো। এই নির্দেশ টা দিলো কে? কে ওকে মেরে ফেলার হুমকি দিলো?
তনয়ের কম্পিউটার টেবিলে রাখা “হররস্কোপ” যন্ত্রটার দিকে চোখ পড়লো হঠাৎ আর আমার মনের বন্ধ দরজা এক ঝটকায় খুলে গিয়ে বেরিয়ে এলো এক নির্মম সত্য।
হররস্কোপ মূলত ভাগ্য গণনার যন্ত্র নয়, বরং দুর্ভাগ্য বয়ে আনার যন্ত্র।ওটার স্ক্রিনে যে রাশির সিম্বল দেখা যায় সেই রাশির মানুষের ভাগ্যে নেমে আসে মৃত্যুর ভয়াল ছায়া! অফিসে প্রথম চালু করা হয়েছিলো যন্ত্রটা তাই ওখানকার মানুষের মৃত্যু দিয়েই শুরু হয়েছে যন্ত্রের পৈশাচিক প্রভাব। দাদু যে কেন এটার নাম “হররস্কোপ” রেখেছেন তা বুঝলাম। তনয়কে সব খুলে বললাম। ও আমার কথায় একমত হলো। ঠিক করলাম যন্ত্রটা নষ্ট করে ফেলতে হবে । যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে, আগুনে পুড়িয়ে বা পানিতে ডুবিয়ে কোনভাবেই যন্ত্রটাকে নষ্ট করা গেলোনা। দূরের একটা জায়গায় রেখে এসেছিলাম বস্তুটাকে। কিন্তু আমাদের আগেই আগের অবস্থানে অর্থাৎ তন্ময়ের টেবিলে ফিরে এসেছে ওটা!বাসায় থাকলে বাসার টেবিল আর অফিসে থাকলে অফিসে টেবিলে দেখা যায় যন্ত্রটা। আমরা দুই বন্ধু বুঝে গেছি এই যন্ত্র আমাদের পিছু ছাড়বেনা!
অফিস খোলার পর স্টাফদের মৃত্যুমিছিলে দিনদিন লোক বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। অফিসটা এক কথায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমরা দুই বন্ধু মৃত্যুর প্রহর গুনছি। হররস্কোপের বয়ে আনা দুর্ভাগ্যের কবলে আমাদের ও পড়তে হবে তাতে সন্দেহ নেই। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা যে সাক্ষাত মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক।
আমার মৃত্যুর কারণ হবে বিষ। কারণ আমার রাশি বৃশ্চিক। বিষাক্ত বিছের কামড়ে মৃত্যুযন্ত্রণা কেমন হয় জানিনা।এখনো আমার বা তনয়ের রাশির সিম্বল দেখা যায়নি হররস্কোপে। শুধু মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তনয়ের দাদুর বলা একটা বাক্য।
“রাশি বড় সর্বনাশী! ”
………………………………………………………(সমাপ্ত)………………………………………………….