ডাইনি

ডাইনি

“বুড়ি টা ডাইন ছে। মোর কথাখান মেনে লে রে বিটি”

রান্নাঘরের ভিতরে বসে আটা মাখতে মাখতে রাধার মায়ের দিকে বিরক্ত চোখে তাকায় সীমা। রাধার মায়ের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। চৌকাঠের বাইরে চা খেতে খেতে নিজের বক্তব্যের স্বপক্ষে যুক্তি সাজায় সে। বলে- “কুতো দিন হল বিছানা লিয়েছে, মরবার লামটিও লাই! ইদিকে দেখ, ব্যাটা মল, জামাই মল, ছোটটাও যমে লিলো, এ বুড়িকে দেখ! ইবারে তোর ছেলে..”

“তুমি থামবে?” চীৎকার করে ওঠে সীমা। “চা খেয়ে বাড়ি যাও। আর কাল তাড়াতাড়ি এসে কেচে দিও দয়া করে….”

যাঁর সম্পর্কে এত কথা হচ্ছে, তিনি বিছানার একপাশে শুয়ে আছেন। এত শীর্ণা যে হঠাৎ ঘরে ঢুকলে সাদা ধুতিটাই আগে চোখে পড়ে। চুয়াল্লিশ বছরে স্বামী হারানোর পর পুজো আচ্চা নিয়েই ছিলেন। তার পরে বড় ছেলের বিয়ে দিয়ে বউমা এনেছেন। সংসার বউমার হাতে দিয়ে একটু নিশ্বাস নেবেন, তার আগেই ফুল তুলতে গিয়ে ইঁটের পাঁজার ওপর থেকে পড়ে কোমর ভাঙলেন। সেই থেকে বিছানায়। আজ পনের বছর হয়ে গেল। তা নিয়ে সীমার ক্ষোভ ছিলনা কোনওদিন। শাশুড়ি তার বড় লক্ষ্মী, একথা গর্ব করেই বলত সকলকে। তাছাড়া স্বামীসোহাগী ছিল সে। বিয়ের দুবছর পর নাতির মুখ দেখে বুড়ির সে কি আনন্দ! তারপর কি সব হয়ে গেল! একটা দীর্ঘনিশ্বাস বের হয় তার বুক থেকে।

বঁটি থেকে উঠে সদরদরজা বন্ধ করে শাশুড়ির ঘরে উঁকি মারে সীমা। একই রকম ভাবে শুয়ে আছেন। বাড়িতে আজ তারা দু’জনা। কয়েক বছরের মধ্যে কয়েকটা দুর্ঘটনা ছারখার করে দিয়েছে তার জীবন। পাঁচ বছর আগে বর্ষার এক রাতে তাদের বাড়িতে খবর আসে তার দেওর খোকনকে কে বা কারা আধমরা করে রাস্তায় ফেলে গেছে। তারপর কয়েকদিন হাসপাতাল আর থানা করতে করতে অস্থির হয়ে ওঠে তাদের জীবন। ছ’দিন যমে মানুষে টানাটানির পর মারা যায় খোকন। সেই প্রথমবার শাশুড়িকে অশান্ত হতে দেখে সীমা। বারবার বলছিলেন, “কারা ছেলেটাকে এভাবে মেরে ফেলল? কার কি ক্ষতি করেছিল ও?” একথার উত্তর হয়না। খোকন মাতাল ও চরিত্রহীন ছিল, তাই এই বিষয় নিয়ে বেশি ঘাঁটালে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে যাবে, এই ভয়ে দাদা তোতন বিষয়টি চেপে যাওয়াই মনস্থির করেন। তাছাড়া সে তখন গ্রামপঞ্চায়েতের সদস্য। এর ঠিক ছ’মাস পরে নন্দাই এর হার্ট ফেল করে মৃত্যু হয়।

একবছর আগে তোতনের ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পরে। সাতমাস বেঁচে ছিল সে। এসময় যারাই সীমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, সবাই বলছিল সীমার সংসারে শনির দৃষ্টি পড়েছে। আকারে ইঙ্গিতে সীমার শাশুড়ির বেঁচে থাকাকেও সুনজরে দেখেনি অনেকে। এসব কথা শুনে সীমার রাগ হতো খুব। মানুষের মৃত্যু কি নিজের হাতে! তোতন মারা যাবার পর সরাসরি অনেকেই বৃদ্ধার দিকে আঙুল তুললেন। দু’ দুটো জোয়ান ছেলে মরে গেল আর মা বেঁচে, এ তাঁর কি অবিচার! আস্তে আস্তে শূন্যতা গ্রাস করে সীমাকেও। ভাবে মাঝেমাঝে, সত্যি, শাশুড়ি যদি মারা যেতেন তোতনের বদলে! কি এমন ক্ষতি হতো?

হঠাৎ ঝনঝন করে বেজে ওঠে দরজা। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে সরে দাঁড়ায় সীমা। তার দাদার ছেলে অভ্র ঝড়ের বেগে ঘরে ঢোকে। “পিসিমণি, দাদার কয়েকটা জামা, গামছা, আর ক্যাশ টাকা কিছু থাকলে দাও। শিগগিরি!” চেয়ারে বসে পড়ে সীমা! কি হয়েছে তার ছেলের জিজ্ঞাসা করারও সাহস হয় না। তাড়া দেয় অভ্র, “আরে বসলে কেন? রাহুলদাকে নিয়ে আমি আর বাবা কলকাতা যাচ্ছি। হাসপাতালে রেফার করে দিল। এর নাম সুপার স্পেসালিটি হাসপাতাল!” ধীরে ধীরে ওঠে সীমা। আলমারি খুলে টাকা দেয়। আলনা থেকে জামা আর গামছা। অভ্র যাবার আগে তার হাত দুটো ধরে সীমা আকুতি জানায়, “ফোনে ঠিকঠাক খবর দিস বাবা…”

কি যে হয়ে গেল ছেলেটার! সুস্থ সবল ছেলে, হঠাৎ করে গিঁঠে গিঁঠে ব্যাথা আর জ্বর। তারপর শ্বাসকষ্ট। ডাক্তার বলেছেন, খারাপ ধরণের ভাইরাল সংক্রমণ হয়েছে, তা থেকে ফুসফুস আর হার্ট এ জল জমেছে। ফোনটা তুলে বোনকে সব জানায় সীমা, অভ্রর নাম্বারটাও দিয়ে দেয়। কলকাতায় পৌঁছে যোগাযোগ করতে বলে। এরই মধ্যে ক্ষীণ কন্ঠে “বৌমা, ও বৌমা” ডাক শুনতে পায় সীমা। শাশুড়ির ঘরে যায়। বেডপ্যানটা দেয়। সেসব পরিষ্কার করে বাথরুম থেকে ফিরতেই ননদের ফোন আসে। ফোন রেখে শাশুড়িকে দুধরুটি দিতে গিয়ে দেখে আবার তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। খাবার চাপা দিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে সে। বিছানায় রাহুলের জামা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেগুলো নাকে চেপে গন্ধ নিতে গিয়ে আর সামলাতে পারেনা নিজেকে। কান্নায় ভেঙে পড়ে, কাঁদতে কাঁদতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে সারাদিনের উৎকন্ঠার পর নিজেও জানেনা।

সকালে ঘুম ভেঙে বিছানা থেকেই ফোন করে অভ্রকে। এইমাত্র রাহুলকে আই সি ইউ তে ভর্তি করানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছে ৭২ ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা যাবে না। শুনে হাতপা অসাড় হয়ে যায় তার। আরও কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সে। তারপর উঠে ধীরে ধীরে শাশুড়ির ঘরে যায়।

খুব দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে ঘর থেকে। রাগে, দুঃখে কান্না পায় তার। রাতের দুধরুটিতে পিঁপড়ে ছেয়ে গেছে। সেটা রান্নাঘরে রেখে শাশুড়িকে গরম জল করে পরিষ্কার করে বিছানা বদলে বিছানার চাদর, কাপড় জামা সার্ফে ভিজিয়ে স্নান করে বাথরুম থেকে বের হয় সে। এসে দেখে বোনের দুটো মিসকল। দরকারি কথা সেরে রান্নাঘরে চা বানাতে যায় সে। এরই মধ্যে ননদ নিলীমা আসে, মায়ের জন্য রসগোল্লা নিয়ে। আগেও এনেছে, কিন্তু এবারে কেমন যেন রাগ হয়ে যায় তার।

“চা খাওনি বউদি?”

“না ভাই; সময় পাইনি।”

“তার মানে তো মাও খায়নি? আহারে, বুড়িমানুষ, কত ক্ষিধে পায়, বলতে পারেনা! ”

গা পিত্তি জ্বলে যায় সীমার।

“রাহুল কেমন আছে?”

“ভালো। ”

উত্তর দিতে ইচ্ছে করছেনা সীমার। আরও কিছুক্ষণ পরে চা খেয়ে বিদায় নেয় নিলীমা। যাবার আগে বলে, “মাকে রসগোল্লাটা গরম থাকতে খাইয়ে দিও বউদি..”

এরপর রাধার মা এসে বাসি কাজ করে। দেরী করে আসার কারণ হিসেবে কি একটা বলে। এখন তাড়া আছে, তাই দুপুরে কেচে যাবে, বলে বিদায় নেয়। এরপর শাশুড়িকে খাওয়াতে বসে সীমা। আজ দেরী হয়ে গেল অনেক। একটা রসগোল্লা খাবার পর তিনি বলেন, “বৌমা, আরেকটা রসগোল্লা দেবে?” কেমন যেন মাথার ভিতর জ্বলে উঠল সীমার। তার ছেলে চব্বিশ ঘন্টার ওপর হয়ে গেল দানা কাটেনি মুখে আর এই ডাইনিবুড়ি রসগোল্লা খাচ্ছে! সে ভুলে গেল, রাত্তিরে তাঁর কিছু খাওয়া হয়নি। সে ভুলে গেল নাতির অসুস্থতার বিষয়ে কেউ তাঁকে কিচ্ছু জানায়নি। ছুটে গিয়ে রান্নাঘর থেকে সবগুলো রসগোল্লা একটা থালায় ঢেলে জোর করে একটার পর একটা রসগোল্লা খাওয়াতে থাকে শাশুড়িকে।

“খান, সব খান। ছেলে খেয়েছেন, জামাই খেয়েছেন, এবারে আমার ছেলেটাকেও খান… ” গলায় বিষম আটকে দম বন্ধ হয়ে আসে তাঁর। একটু জল পাবার আগেই সীমা কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমে ঢুকে যায়।

পুরো ব্যাপারটা বারান্দা থেকে লক্ষ্য করে নীলিমার মেয়ে মৌ। সে টিউশন থেকে ফেরার পথে রাহুল দাদা আর দিম্মার খবর নিতে এসেছিল। মামীর জোর করে মিষ্টি খাওয়ানো, দিম্মার বিষম লাগা আর তাকে লক্ষ্য না করে মামীর বেরিয়ে যাওয়া – সবটাই অবাক দৃষ্টিতে দেখছিল সে। মামী চলে যাবার পর দিম্মার ঘরে ঢুকল সে। দিম্মা কেমন খাবি খাচ্ছে। তার সামনেই চোখ দুটো বুঁজে গেল। দিম্মার চোখের কোল বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে আর কষ বেয়ে রসগোল্লার রস। অস্ফুট এক চিৎকার বের হয় তার গলা দিয়ে। পিছন ফিরতেই মামীকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পায় সে। পিছন ফিরে একছুট লাগায় নিজের বাড়ির দিকে।

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে নীলিমা। রাস্তা থেকেই সে বিলাপ জুড়েছে। সেই বিলাপ পাড়াপ্রতিবেশীদেরও উৎকর্ণ করেছে। একে একে তারা সীমার বাড়ি এসে ভীড় জমায়। নীলিমা তাদের সামনেই শাপশাপান্ত করে সীমাকে। বলে, “ডাইনি, আমার মাকে মেরে ফেললি? ভাইয়ের খুনীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কেস করলি না। আমি কিছু জানিনা ভাবছিস?”

কেউ কিছু বোঝার আগেই নীলিমাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে যায় সীমা। কিছুক্ষণ পরে তারা যখন বের হয়, নীলিমার শাপশাপান্ত থেমেছে তখন।

অনেক রাত্রে সব মেটার পর মৌ দেখে মা একজোড়া বালা আলমারিতে রাখে। বালাদুটো চিনতে পারে মৌ। দিম্মার বালা। এটা নিয়ে মা অনেক ঝগড়া করেছে মামীর সাথে, মামী দেয়নি। আজ মায়ের কাছে এল কিভাবে?

মায়ের হঠাৎ করে শান্ত হয়ে যাবার রহস্য বুঝতে পারে মৌ। অস্ফুটে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, “ডাইনি……..”

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত