লেকের পানিতে ভূত

লেকের পানিতে ভূত

প্রচন্ড শীত পড়েছে আজ। মেসের ছেলেরা কম্বলের নিচেও গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। একা একা জেগে বসে আছি। কেন জানি আজকাল ঘুম আসেনা।
অনেক রাতে বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। মাঝে মাঝে খালি পায়েও হাটি, ব্যাপক মজা লাগে। বন্ধুরা বলে আমার মাঝে নাকি হিমুর বীজ ঢুকে গেছে তাই মধ্য রাতে খালি পায়ে রাস্তায় একাকি হেটে বেড়াই। তবে এটা ঠিক না।

হিমু তো মহাপুরুষ হতে চেয়েছিলো আমি যে তা হতে চাইনা। হিমু তো পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে খালি পায়ে হাটতো কিন্তু আমি যে টি-সার্ট আর ট্রাউজার পড়ে হাটি আর আমার সঙ্গী হয় একটি মোবাইল ও নিকোটিনের স্বাদ। মাঝে মাঝে মোবাইলের অপর প্রান্তে কোন এক রমণী।
আজকের শীত এতই তীব্র যে গায়ের চামড়া জ্বলছে, হাত পা অসাড় হয়ে আসছে কিন্তু এই শীতের মাঝেও কেন জানি আমার পাতলা একটি সাদা সার্ট গায়ে দিয়ে কুয়াশাস্নান করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মনে ইচ্ছে জাগলে চেপে রাখতে নেই, আমিও রাখিনা।

খুঁজে খুঁজে শতভাজ পড়া পাতলা একটি সাদা সার্ট পেয়ে গেলাম। গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কুয়াশাস্নানে। কুয়াশার গাঢ় সাদা চাদর থেকে টুপটাপ ঝরে পড়া শিশির কণা এসে পড়ছে আমার উপর। শীতে কাঁপছি তবুও অদ্ভুত আনন্দ লাগছে।
মোবাইলের অপরপ্রান্তে থাকা রমণীকে অভিজ্ঞতার কথা জানাতেই রমণী রেগে গেলো। ফিরে যেতে বললো, কিন্তু আমি যে কারো কথাই শোনার পাত্র নই। আমি যে শুধু আমার মনের কথাই শুনি, মন যে এখন ফিরে যেতে চাচ্ছেনা। রমণীকে জানাতেই রেগে বিদায় নিলো সে।

মোবাইলটি এখন আর হাতে রেখে লাভ নেই তাই পকেটে ভরে হাটছি । হাটতে হাটতে খেয়াল করলাম আমি সেই বট তলায় দাঁড়িয়ে যার সামনেই ছোট্ট একটি লেক। এই বটগাছ আর ছোট্ট লেকটি নিয়ে অনেক ভুতুড়ে গল্প প্রচলিত আছে।
এই গাছে নাকি ভুতের বসবাস আর রাতে তারা নাকি গাছ থেকে নেমে লেকে যায় মাছ শিকারে। রাতে অনেকেই নাকি তাদের পানিতে দাপিয়ে বেড়াতে দেখেছে তাই রাতে এই পথে খুব প্রয়োজন ব্যতীত কেউ আসেনা তেমন।

এই পথ দিয়ে প্রায় বন্ধুর বাড়িতে যাওয়া পড়ে তবে কোন দিন এতো রাতে এই পথে আসা হয়নি। আজ যখন এসেই পড়েছি ভাবলাম দেখি তেনাদের দেখা পাওয়া যায় কিনা। আচ্ছা, আমার কি কিঞ্চিৎ ভয় পাওয়া উচিৎ?
মনে হয় পাওয়া উচিৎ, কিন্তু আমি পাচ্ছিনা বরং ভূত দেখার জন্য মনে বেশ উৎসাহ পাচ্ছি। লেকের সামনে দুজন পাশাপাশি বসার মতো ছোট একটি বেঞ্চ আছে। আগ্রহ নিয়ে বেঞ্চিতে বসে পানির দিকে অধির হয়ে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ পানিতে ভুড়ভুড়ি উঠতে দেখলাম।

রাস্তার সাথেই লেকটি তাই ল্যাম্পপোস্ট এর আলো এসে লেকের পানিতে পড়েছে। সেই আলোতেই স্পষ্ট দেখতে পেলাম পানির ভুড়ভুড়ি। নড়েচড়ে বসলাম, তবে কি সত্যি সত্যি ভূত দেখতে চলেছি? আচ্ছা তাকে কি আমার সালাম দেওয়া উচিৎ? নাকি ভূত রাজা বলে অভিবাদন?
আমার চিন্তাধারা বেশিদূর এগোলনা। ছোট একটি মাথা পানি ভেদ করে উঠে এলো। আস্তে আস্তে পাড়ের দিকে এগিয়ে আসছে। আমার দিকে তাকাতেই থমকে গেলো আর আমিও তাকে দেখে অবাক হয়ে বসে আছি। তার হাতে একটা মাছ ধরার টুকরি। তাতে খলবল করছে বেশ কিছু মাছ।

ছেলেটির বয়স বড় জোড় দশ বছর হবে, আমাকে দেখে প্রায় কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল, ভাইজান মাফ কইরা দেন আর মাছ ধরুম না। ঘরে চাল নাই তাই আইছিলাম কয়ডা মাছ ধরতে। আমি এবার উঠে দাঁড়ালাম, কিছুটা এগিয়ে গিয়ে অভয় দিয়ে বললাম, এতো শীতে এই ঠান্ডা পানিতে কেনরে তুই! শীত লাগেনা বুঝি?
লাগে ভাইজান তয় পেটে খুধা থাকলে শরীরের কষ্ট টের পাওয়া যায়না। উঠে আয়, নাম কি তোর?
নয়ন, ভাইজান কি আমার নামে নালিশ দেবেন?
নারে, তুই কি আরো মাছ ধরবি নাকি আজকের মতো শেষ?

ভাইজান এইডাই প্রথম খেপ, আরো দু একবার না ধরলে তো ট্যাকা অইবোনা। তোর বাড়ি কই?
আঙুল দিয়ে লেকের ওই পাড়ের বস্তির দিকে ইশারা করলো, বুঝলাম ওখানেই ওর বাসা। হঠাৎ করে কেন জানি চোখটা জ্বালা করে উঠলো, দু’ফোটা অশ্রু জমা হলো চোখের কোনে। ওকে পিছনে রেখেই উঠে ফিরতি পথ ধরলাম।
এসেছিলাম ভূত দেখতে, দেখা পেলাম দারিদ্রতা নামক ভূতের। ভদ্রপল্লির মানুষেরা কি জানতে পারবে যে দারিদ্রতা আজ দশ বছরের ওইটুকুন বাচ্চাটিকেও ভূত বানিয়ে গা জ্বালা করা শীতেও লেকের পানিতে নামিয়েছে!
না, তারা জানে লেকের পানিতে অর্ধ রাতে ভূত নামে, নাচানাচি করে, মাছ খেয়ে পেটের খুধা মিটায়!

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত