অনেকদিন আগেকার কথা, ষাট-সত্তরের দশক নাগাদ হবে। আমার দাদামশাই ছিলেন অডিট আপিসের রাশভারী কর্মী। প্রায় প্রতিমাসেই রাজ্যের নানাপ্রান্তে ছুটে বেড়াতে হত তাঁকে, হিসেবনিকেশের কাজেকর্মে। সেবার তিনি গেছেন কার্শিয়াংয়ের কাছাকাছি কোনও একটা জায়গায়। দিনতিনেকের কাজ, উঠেছেন সরকারি গেস্ট হাউসে। গেস্ট হাউসের সবই ভালো – ব্রিটিশ আমলের বাড়িঘর, তাতে ব্রিটিশ আমলের আসবাবপত্র সব, খাওয়ার ঘরের কাচের আলমারিতে বিলিতি বাসনকোসন, একখানা ছোটো আলমারিতে গুটিকয়েক বইও সাজানো রয়েছে। কেবল একটাই সমস্যা, বাড়িটা বড্ড একটেরে। একখানা মিনি টিলার টঙে বানানো বাড়ি, বাকি ঘরবাড়িগুলোর আলো দেখা যায় গেস্ট হাউসের ব্যালকনিতে বসে, কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে প্রায় আধঘণ্টা লাগবে।
দুপুরে খাওয়ার সময়ই চৌকিদার বলে দিয়েছিল সন্ধে সাতটার মধ্যে সাহেবকে ডিনার খাইয়ে বাসনপত্র ধুয়ে মেজে সে আর রাঁধুনি নিচে গ্রামে চলে যাবে। সদর দরজায় বিলিতি গা-চাবি লাগানো, টেনে দিলেই দরজা লকড হয়ে যায়। একটা চাবি তার কাছেই থাকে। ভোরবেলায় চলে আসবে দু’জনেই, সাহেব ঘুম থেকে উঠেই চা পেয়ে যাবেন।
দাদামশাইয়ের রাত জাগা অভ্যেস, তায় আবার বইয়ের আলমারিতে কিছু লোভনীয় বই দেখেছেন, আজ রাতে একটা বই অন্তত কিছুটা এগিয়ে রাখলে হয়। তিনি কিন্তু কিন্তু করে চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, “আমি রাতে দু’বার চা খাই। তোমরা থাকলে ভালো হত। তোমাদের রান্নাঘরে চা-চিনি কোথায় আছে আমি কি আর জানি?”
“আমরা সব ঠিক করে রেখে যাব, সাব। ফ্লাস্কে চা করে রাখব, গরমাগরম কাপে ঢালবেন আর খাবেন।” তড়বড় করে বলে উঠল রাঁধুনি। তারপর দাদামশাইকে বিশেষ কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রান্নাঘরের পানে হাঁটা লাগাল দু’জনে। দাদুকে নিতে গাড়ি এসে গিয়েছিল এর মধ্যে, তিনিও আর কথা বাড়ানোর সময় পেলেন না।
সন্ধে সাতটা নাগাদ দিশি মুরগির ঝোল আর রুটি দিয়ে ডিনার সেরে দাদু গায়ে শালটা ভালো করে জড়িয়ে বইয়ের আলমারিটা খুলেছেন…
“সাআআব!”
চিৎকারে চমকে পেছন ফিরে দেখেন, চৌকিদার চোখ গোল গোল করে দাঁড়িয়ে আছে। কী হয়েছে কিছু বোঝার আগেই রাঁধুনি হাতের জল মুছতে মুছতে এসে চৌকিদার রামচন্দ্রকে প্রায় পাঁজাকোলা করে নিয়ে চলে গেল।
একটু পরে তারা দু’জনে দাদুকে শুভরাত্রি জানিয়ে সদর দরজাটা টেনে দিয়ে রওনা হল বাড়ির দিকে। রামচন্দ্রের মুখখানা তখনও কেমন যেন সাদাটে বলে মনে হল। কী জানি, কী ব্যাপার এদের!
দাদু সোফায় বসে চা-বাগান নিয়ে লেখা একটা বই উল্টোচ্ছিলেন, একটু অন্যমনস্ক হয়েই বাথরুমে গেলেন। বাথরুম থেকে বেরিয়ে মনে হল, খাওয়াদাওয়া যখন হয়েই গেছে, বসার ঘরে থেকে আর কাজ কী, শোওয়ার ঘরে গিয়ে বসলেই হয়। বই, ফ্লাস্ক সব বগলদাবা করে সেখানে নিয়ে গেলেই চলবে। এই না ভেবে তিনি আবার গিয়ে বইয়ের আলমারিটা খুললেন। আরও এক-দুটো বই বের করে নিয়ে যাবেন ঘরে, তাহলে আর বারবার উঠে আসতে হবে না।
বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখলেন, চা-বাগানের ওই বইটা আরও এক কপি আছে আলমারিতে। স্থানীয় ইতিহাস আর খাওয়াদাওয়ার ওপর লেখা দুটো বই বের করে সোফার কাছে গেলেন আগের বইটা আর ফ্লাস্ক নিয়ে শোওয়ার ঘরে যাবেন বলে। কী আশ্চর্য! বইটা কোথায় গেল? সেন্টার টেবিলে রেখেই তো বাথরুমে গিয়েছিলেন, দিব্যি মনে আছে। টেবিলের নিচে, সোফার নিচে দেখলেন ভালো করে, কোত্থাও নেই। অবাক হলেন দাদু। তবে কি বাথরুমে যাওয়ার আগে তিনি বইটাকে আলমারিতে তুলে রেখে গেছেন? তাইই হবে, নইলে যাবে কোথায়? আলমারিতে তো বইটা আছেই দেখে এলেন। ওই কপিটাকেই ডুপ্লিকেট কপি ভেবেছেন নিশ্চয়ই। বইটাকে আবার আলমারি থেকে বের করে সব জিনিসপত্র নিয়ে দাদু হাঁটা লাগালেন শোওয়ার ঘরের দিকে।
বইয়ে ডুবে গেছেন দাদু কখন, বুঝতেই পারেননি। চা-বাগানের পত্তনের কাহিনি বেশ গল্পচ্ছলে লেখা – হারিয়ে গিয়েছিলেন ইতিহাসে। সেই ঘোরের মধ্যেই একবার মনে হল, রান্নাঘরে কী যেন আওয়াজ হচ্ছে – টুংটাং টুংটাং। চিনেমাটির চায়ের কাপে চামচে করে চিনি গুললে যেমন আওয়াজ হয়, তেমনি। প্রথমটা গা করেননি। কিছুক্ষণ পরে আবার কানে আসতে উঠে বসলেন। রান্নাঘরে কে? রামচন্দ্ররা ফিরে এল নাকি? এলে অবশ্য ভালোই হয়, এককাপ কফি বানিয়ে দিতে বলবেন তাহলে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখবেন বলে দাদু ঘর থেকে বেরোলেন। একটা সরু প্যাসেজের একপাশে দুটো শোওয়ার ঘর, আরেক পাশে রান্নাঘর আর কমন বাথরুম। প্যাসেজটা গিয়ে মিশেছে বৈঠকখানার সঙ্গে। সেখানেই একধারে খাওয়ার টেবিল পাতা, সঙ্গে ওই বইয়ের আলমারি, বাসনের আলমারি ইত্যাদি রয়েছে। প্রতি ঘরের দরজায় এবং বৈঠকখানার সামনে লেসের কাজ করা ফিনফিনে পর্দা ঝোলানো। রান্নাঘর থেকেই আওয়াজ আসছিল। উঁকি মেরে দেখলেন কেউ কোত্থাও নেই, সব বাসনকোসন ধুয়ে মুছে রাখা আছে। টুংটাং আওয়াজটা তবে মনের ভুল? তাই হবে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে শোওয়ার ঘরে যাবেন, মনে হল বৈঠকখানার পর্দাটা দুলে উঠল সামান্য। ঠিক যেন কেউ পর্দাটা সরিয়ে ওপাশে চলে গেল। কে রে বাবা? তাড়াতাড়ি দাদু এলেন বৈঠকখানায়। এখানেও একই ব্যাপার, কেউ নেই, সব ভোঁ ভাঁ। কেবল ওই দেওয়ালে ঝোলানো কাঞ্চনজঙ্ঘার অয়েলপেন্টিংয়ের আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে তাঁকে দেখছে একটা টিকটিকি।
‘এ নিশ্চয়ই রাতে গুরুপাক খাওয়ার দোষ, বদহজম হয়ে চোখ-কান সব গোলমেলে কাণ্ড দেখছে, শুনছে। যাই, শুয়ে পড়ি গে যাই কান-মাথা মুড়ি দিয়ে।’ এই ভেবে দাদু শুতে চলে গেলেন। বড়ো চমক অপেক্ষা করছিল সেখানে। খাটের ওপর যে আধখোলা বইটা রেখে গিয়েছিলেন, চা-বাগানের ইতিহাসের সেই বই, সেইটে খাটে তো নেইই, গোটা ঘরে তন্নতন্ন করেও সে বই কোত্থাও পাওয়া গেল না। সেই সঙ্গে টেবিলে রাখা বাকি দুটো বইও বেমালুম গায়েব, যেন ডানা গজিয়ে তিনটে বইই উড়ে গিয়েছে। দাদু তখন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছেন, বইগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে বৈঠকখানার ওই আলমারিতেই। কিন্তু হঠাৎ ভয়ানক গভীর ঘুমে তাঁর দু’চোখের পাতা বুজে আসতে লাগল। রাতের বেলায় যা যা হচ্ছে তাতে ঘুম পালানোর কথা, কিন্তু এ যে ঘুমে চোখ ভারী হয়ে আসছে! গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে দাদুর মনে হল, ঘরটা যেন হাল্কা তামাকের গন্ধে ভরে যাচ্ছে। ব্যস, আর কিছু মনে নেই।
ঘুম ভাঙল রামচন্দ্রের ডাকে। ধড়মড় করে উঠে বসে দেখেন, সকাল হয়ে গেছে। রামচন্দ্র হাতে জলের জগ নিয়ে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কী যেন বলছে, আর তার পাশে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে রাঁধুনিটি, আর কাল যাদের আপিসে হিসেবের কাজে গিয়েছিলেন, সেখানকার ম্যানেজার। তিনিই এগিয়ে এসে বললেন, “ধড়ে প্রাণ এল, মশাই। আরেকটু হলেই আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হচ্ছিল আর কী! রাতে এখেনে থাকবেন, আগে বলবেন তো! তক্ষুনি নিচে কারও বাড়িতে ব্যবস্থা কররে দিতুম। হে ঈশ্বর, এখেনে এই ভূতবাংলায় কেউ রাত কাটায়!”
“কই, আমি তো কিছু…” বলেই দাদু চুপ করে যান। রাতের ঘটনাগুলো একের পর এক মনে পড়তে থাকে। যুক্তিহীন ঘটনাগুলোর নেপথ্যে এতক্ষণে একটা লাগসই যুক্তি খুঁজে পান তিনি।
“বলেন কী, মশাই! কিচ্ছু টের পাননি আপনি? ধন্যি আপনার পুণ্যি যা হোক, ওইতেই তরে গেছেন। বামুনমানুষ, পৈতের জোরে এ-যাত্রা বড়ো বাঁচা বেঁচে গেলেন। নইলে লংম্যান সাহেব কাউকেই ছাড়েন না। খাট থেকে ফেলে দেওয়া, রাতের বেলায় জানালা খুলে দেওয়া হাট করে, নিদেনপক্ষে তামাকের গন্ধ শোঁকানো। মানুষ ভালো ছিলেন তিনি, কারও বড়ো ক্ষতি করতে শুনিনি। কিন্তু ওই, তাঁর সাধের বাড়িতে অচেনা অজানা লোকে এসে রাত কাটাবে, তাঁর বিছানায় শোবে, তাঁরই বই নাড়বে চাড়বে, এ বোধহয় তিনি মরেও সইতে পারেন না। ওরে বাবা, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে এই দেখুন। চলুন চলুন, এই দু’দিন আমার বাড়িতেই গা ফেলবেন।” তাড়া লাগান ম্যানেজারবাবু।
তাড়াহুড়োয় দাদামশাই বলতেই পারলেন না যে তাঁর পৈতেগাছা বাড়িতে ঠাকুরের আসনের নিচে যত্ন করে রেখে দিয়েছেন তাঁর স্ত্রী, আমাদের দিদিমা।
আধঘণ্টা পরে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাংলো থেকে বেরোচ্ছেন, চোখ পড়ল ব্যালকনিতে রাখা একটা ধুলোপড়া আদ্যিকালের চেয়ারের দিকে। ধুলোপড়া চেয়ারটার বসার জায়গাটা দেবে রয়েছে অদ্ভুতভাবে। কোনও ভারী চেহারার মানুষ চেয়ারে বসে থাকলে যেমনটা হয়, ঠিক তেমন। দৃশ্যটা চোখে পড়তেই দাদুর নাকে কাল রাত্রের সেই তামাকের মৃদু গন্ধটাও ভেসে এল। মনের ভুল? কী জানি, হতেও পারে।
…………………………………(সমাপ্ত)……………………………….